সঞ্চারিণী পর্ব -১২

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

১২.
রশ্নি এমন ভাবে স্পর্শ করে মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি সে ফিরে এলো।তার ছোঁয়াতে বাস্তবতা খুঁজে পেলেই মনে হয়, নতুন করে আশা জাগে হয়ত সে সত্যি সত্যি চলে এসেছে।আর কোনো দুঃখ রইবেনা।শুধু ভালোবাসা আর সুন্দর একটা সমাপ্তি।
এর ভেতরে হঠাৎ বাবা ফোন করে ওকে আসতে বললেন বাসায়।কারণ তৃনার হবু শ্বশুর বাড়ির লোক এসে গেছে।তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই শাওনকে দেখতে চাচ্ছে তাই সে যেন জলদি চলে আসে।
শাওন বেশ ভালোমতন বুঝতে পেরেছে যে বাবা কেন এত তাড়া দিচ্ছে।এর কারণটা হলো তৃনার ননদের সঙ্গে ওর বিয়ের আলাপ জমানোর কথা আজ।সে মুখের উপর বলে দিলো তার ফিরতে অনেক রাত হবে।আজ মিটিং এটেন্ড করতে হবে।মিটিংটা যে সে ডেকেছিল এটা বাবাকে বললোনা।
রশ্নি অনেক রিকুয়েস্ট করেও শাওনকে বসা থেকে এক বিন্দু ও ওঠাতে পারেনি।
—–
গিয়াস স্যার মেধাকে বলেছেন বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে।মিটিংয়ের এখনও দেরি আছে।আজকের জন্য সে যেন এখান থেকে বিরতি নেয়।মেধার ও শরীরটা দূর্বল লাগছিল তাই গিয়াস স্যার বলতেই রাজি হয়ে গেলো।বাস ধরে বাসায় এসে গোসল দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় আলমারির ভেতরে রাখা পার্সেলটা সে বের করে বিছানায় গোল হয়ে বসলো।বাবা বাসায় নেই।মৌমিতা ঘুমাচ্ছে।বিকেল এখন।বোমা হামলার কথা মেধা এখনও মাকে জানায়নি।জানালে মা যুদ্ধ শুরু করবে এই চাকরি ছাড়ানোর জন্য।হয়ত আজকেই ছাড়িয়ে ছাড়বে।রক্ষে নেই।
নীল রঙের মোড়ক পার্সেলটার।তাতে আবার ফুল একটা লাগানো।ফুলের সাথে কাগজ ঝোলানো একটা সুতির গোলাপি রঙের দড়ি দিয়ে।তবে সেই কাগজটা একেবারেই ছোট একটা কাগজ।কাগজটাতে শুধু লেখা,’গেস কর’

মেধা বক্সের নীল মোড়কের সেই কাগজটা ছিঁড়লো সবার আগে।ভেতরে কার্ড বোর্ডের একটা বক্স।বক্সটা কেঁচি দিয়ে কাটলো সে।এক হাত দিয়ে টেপ খোলা অসম্ভব।বক্সটাতে টিস্যু মোড়ানো একটা জিনিস দেখতে পেলো সে।জিনিসটা হলো একটা ধারালো ছুরি।তাতে রক্ত মাখানো।শুধু তাই নয়।ঐ ছুরির সঙ্গে একটা বন্দুক ও আছে।খেলনা বন্দুক।টিপ দিলে একটা আওয়াজ ভেসে আসে।জোকারের হাসি।বিরাট বড় একটা কাগজ ছিল তার ঠিক পেছনে।কাগজে ইংরেজীতে লেখা সব।তবে সেটা বাংলা কথা।তাতে লেখা আছে
-‘ডিয়ার মেধা!
ওপস!মেধা অফিসার।ক্রাইম ব্রাঞ্চের মেধা না আপনি??হাতের চোট ভালো হয়েছে?নাকি এখনও এক হাত দিয়ে জামা চেঞ্জ করতে হয়?সমস্যা না।যেদিন হাত ভালো হবে সেদিন দেখবি পা কাজ করছেনা।খুব ভালো লাগে কাউকে টর্চার করতে, স্পেশালি তাদের! যারা আমাকে ধরার মিশনে নামে।বাই দ্যা ওয়ে!গিফট কেমন লাগলো?ছুরির রক্তটা কিন্তু তোর।তোর হাতেরই রক্ত।আফটার অল চোট টা তো আমিই দিয়েছিলাম।ভালোই ভালোই ক্লিপটা আমাকে হস্তান্তর কর নাহলে আমি কি জিনিস সেটা তো আর বোঝাতে হবেনা?আমার লোকদের কি হাল করেছো দেখলাম।আসলে এরকম চটপটা মেয়েদের টর্চার করতে আলাদা শান্তি আছে।কপালে ঘাম জমবে,ঠোঁট ভেজানো থাকবে,চোখে এক রাশ হিংসা,ক্রোধ,হাত ছাড়া পাবার লালসা!!ইশ!!কবে সেই হালে তোকে একটিবার দেখবো!
নেক্সট যাদের পাঠাবো তারা মোটেও ভীতু হবেনা।জাস্ট ক্লিপই তো চাইছি এটাতে তুমি এরকম দ্বিধান্বিত হয়ে যাচ্ছো কেন?
তোমার কি ছোট বোনটার জন্য মায়া হয়না?তোকে সম্মান দিয়ে তুমি বলছি।নাহলে তুই ছাড়া বলতে পারিনা আমি।ক্লিপটা নিজের কাছে না রাখলে তোমার কপালে শনির দশা এসে জমতো না।কি দরকার বোঝা কাঁধে ফেলে?ক্লিপ দাও আর স্বাধীন ভাবে বাঁচো।আমি তোমায় দেখতেও আসবো না আর।
জাস্ট আমার ক্লিপ চাই।তারপর না তুমি আমায় চিনবে আর না তোমায় আমি চিনবো ‘

মেধা কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো।মা আসছে এদিকে।কথা শোনা গেলো।তাড়াহুড়ো করে বক্সটা লুকিয়ে ফেললো সে।একেবারে বালিশের তলায়।মা ওর সামনে কফির মগটা রেখে বললেন,’তোর না পার্সেল এসেছিল?কই দেখি কে, কি পাঠালো?’

-‘অফিসের কাগজপত্র। ওসব দেখে কি করবে?’

-‘ওহ।শুনলাম ঐ বিজন্যাসম্যান রেদোয়ানের আর তার স্ত্রীর কেসটা তুই ও সামলাচ্ছিস।’

-‘কে বললো?’

-‘কে আর।তোর বাবা বলেছে।আজকে গিয়েছিলো তো ঐ রেদোয়ানের বাসায়।তোর একটা কলিগের সঙ্গে গিয়ে কোথা থেকে ঘুরেও এসেছে।ছেলেটা নাকি অনেক ভালো।কাজে এক্সপার্ট।সে নাকি একাই খুনীকে বের করতে পারবে তোর বাবার মনে হলো।

-‘কে?’

-‘নাম মনে হয় শাওন’

মেধা ভেংচি কেটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো।মা ওর হাতের প্লাস্টারটার দিকে তাকিয়ে বললেন,’কাল গিয়ে এটা খুলে আসিস।কদিন তো হলো।দরকার হলে নতুন একটা লাগিয়ে আনবি এটা ময়লা হয়ে গেছে’

-‘হুম যাবো তো।
——
শাওন, নুহাশ আর নিতুকে পাঠিয়েছে বরিশালে।বাকেরগঞ্জ।দুজনে বাস ধরে রওনাও হয়েছে।সেখানে আশার একটামাত্র বান্ধুবীর বাসায় যাচ্ছে তারা।বান্ধবীর থেকে হয়ত কিছু হলেও খবর পাওয়া যাবে।এমন ও হতে পারে এই কেসের সঙ্গে সে জড়িত।তাকে সাথে করে নিয়ে আসবে তারা সোজা ঢাকাতে।
শাওন এখন রায়হান,মেধা আর বাকিদের নিয়ে কেসটা সামলাবে যতক্ষণ না নুহাশ আর নিতু আসছে।
আপাতত সাজিদ,মিলন এবং সামিয়া কেসে সাহায্য করবে।তারা এতদিন একটা কেসের কাজে নিযুক্ত ছিল।ঐ কেস শেষ তাই তাদের ডাকা হয়েছে এটাতে হেল্প করতে।মিটিংয়ে সবাই উপস্থিত হলেও মেধা এখনও আসেনি।নয়টা দশ বাজে।তার খবর নেই।শাওন বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে।সাজিদ বললো হয়ত সে আসবেনা।মিটিং শুরু করা উচিত।শাওন বললো আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে।
পাঁচ মিনিট ফুরানের আগেই মেধা ছুটতে ছুটতে হাজির।হলুদ রঙের কোট,খোলা চুল আর মুখে মিষ্টি হাসি দেখে সাজিদ নামের নম্র- ভদ্র ছেলেটা দু মিনিটের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল স্বপ্নের দেশে।
“কিছু কিছু মেয়েকে পাগলামিতে দারুণ মানায় আর কিছু কিছু মেয়েকে পাগলামিতে সত্যি পাগল মনে হয়। প্রথমটার উদাহরণ মেধা আর দ্বিতীয়টার উদাহরণ পরে জানতে পারবেন।”
জিভ বের করে চুলগুলোকে ঠিক করে মেধা বললো,’সরি স্যার।একটু দেরি হয়ে গেলো।’

মিলন ব্রু কুঁচকে বললো,’একটু দেরি?ভেরি ফানি’

শাওন মেধার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। মেজাজ দেখাতে গেলে মিটিং করার মুডটাই বিগড়ে যাবে তাই হালকা দম ফেলে ঠাণ্ডা মাথায় সে বললো,’বোসো’

মেধা সাজিদের দিকে তাকাতে তাকাতে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসলো।সাজিদকে চেনা মনে হলো।পরে মাথায় আসলো এরে টিভিতে দেখেছিলো সে।শাওনের সঙ্গে।ওর মতোই একজন অফিসার।কদিন আগের একটা কেস সাজিদ নিজে সলভ্ করেছিল।
শাওন ও বসেছে এবার।দুহাত সামনে এনে টেবিলের উপর রেখে বললো,’পয়েন্ট হলো নেক্সট আমরা যার থেকে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করবো ঠিক তখনই তার উপর হামলা হবে।
হতে পারে না,একচুয়ালি এটাই ঘটবে।একটা বোমা হামলা মুখের কথা না।’

সামিয়া বললো,’তাহলে স্যার আমরা পরবর্তীতে যার সঙ্গে কথা বলবো তাকে অধিক নিরাপত্তা দেবো।’

-‘নাহ।এরকম সহজ প্ল্যান আমরা কষবোনা।আমরা ঠিক উল্টো চাল চালবো।’
কথাটা বলে শাওন উঠে দাঁড়িয়ে হোয়াইট বোর্ডে মার্কার দিয়ে একজন মানুষ আঁকলো, তার সামনে তিনজন।তিনজনের উপরে লিখলো অফিসার’স।আর ঐ একজনের উপর লিখলো নেক্সট টার্গেট।’

এরপর পেছনে তাকিয়ে বললো,’এটা আমরা মিডিয়ার সামনে জানিয়ে দেবো।এবং এটাও বলবো আমরা তাকে কড়া নিরাপত্তা দেবো।’

মিলন কপাল কুঁচকে বললো,’তাহলে স্যার খুনী তো সব জেনে গেলো।সে হয়ত এবার হামলা করবেনা’

-‘অবশ্যই করবে।সে মজবুত হামলা করবে।তবে!!সে যার উপর হামলা করবে সে হবে আমাদের মাঝেরই একজন।মানেটা হলো আমাদেরই একজন নেক্সট টার্গেট হয়ে কাল নাটক করবে।খুনী হামলা করতে আসবে আর ধরা পড়ে যাবে।ইজি।আর যদি সে না এসে অন্য কাউকে পাঠায় তবে তাকে ধরলেও আমাদের লাভ আছে’

-‘স্যার যদি সে বোমা হামলা করে?’

-‘শোনো সাজিদ!সে যেই রকম পদ্ধতিই করে থাকুক না কেন তাকে কিন্তু আগে সিসি ক্যামেরার নিচ দিয়ে যেতে হবে।আর আমরা সিসি ক্যামেরার সামনে বসে দেখবো সে আসলে বোম দিয়ে মারতে চায় নাকি ছুরি,নাকি গান।একজন খুনী থেকে আমরা অফিসাররা নিজেকে বাঁচাতে পারলেও সাধারণ মানুষ পারবেনা।তাই টার্গেট সেজে আমাদেরই একজন অফিসার যাবে।নেক্সটে সব প্রশ্ন করতে চলেছি আশার একমাত্র বান্ধবী তন্নিকে।তন্নিকে সাথে নিয়ে নুহাশ আর নিতু ঢাকায় ফিরবে।তার লোকেশান আমরা বলবোনা।শুধু বলবো তার নাম তন্নি।
খুনী বুঝবে সে একটা মেয়ে।বাট সে তন্নিকে আগে দেখেনি।হয়তবা হালকা ঝাপসা দেখেছে।সাজলে তন্নির মতন সাজতে হবে।
আমাদের একজন অফিসার তন্নি সাজে আমাদের সামনে প্রশ্নের উত্তর দিতে আসবে।এবার সামিয়া,এন্ড মেধা অথবা নিতু তোমরা তিনজনের মধ্যে ডিসাইড করবে কে টার্গেট সাজবে।’

সামিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’মেধার হাত ভাঙ্গা সে যদি টার্গেট সাজেও সহজে ধরা পড়ে যাবে।আমাদের এমন করে প্ল্যানটাকে মজবুত করতে হবে যেন গুপ্তচরও কানে ভুল শোনে।নিতু তো জার্নি করে এসে দায়িত্ব নিতে পারবেনা।সুতরাং কাজটা আমি করতে চাই’

-“ওকে।তৈরি হও।তবে যে বললে গুপ্তচরও যেন কানে ভুল শোনে সেটা তুমি ভুল বললে।গুপ্তচরকে আমরা সত্যিটাই জানাবো।সে গিয়ে খবর দেবে।কিন্তু সেই সত্যিটা বালি চাপা দিয়ে আমরা একটা নতুন সত্যি কাল উদ্ভাবন করবো।
আগামীকাল সন্ধ্যা সাতটায় আমাদের নাটক শরু হবে।নিজেকে তৈরি করো।কারণ খুনী এসেই হামলা করবেনা।সে দেখবে কি হচ্ছে,কেন হচ্ছে কার সাথে হচ্ছে’

-‘ওকে স্যার।নিশ্চিন্ত থাকুন।এমন লুক নিয়ে আসবো আপনি নিজেও চিনতে পারবেন না আমায়।যদি তার জন্য আমাকে লম্বা চুল বয়ে আসতে হয় তাও করবো তারপরেও খুনীর চোখে আমি ধুলো দেবো।’

সাজিদ,মিলন আর সামিয়া চলে গেলো মিটিং শেষ হতেই।মেধা মুখটা গম্ভীর করে শাওনের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,’টার্গেট আমি হবো।এই সামিয়াকে আমি চিনি।ও বামহাতি শুটার।ডান হাতে কোনো কাজ পারেনা ঠিকমত।নিজেকে তো বাঁচাতে পারবেই না উল্টে আর কজন আহত হবে।’

শাওন হাত ভাঁজ করে দু কদম এগিয়ে এসে মেধার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বললো,’তো তুমি কোন দিক দিয়ে পারফেক্ট?তোমার তো হাতই ভাঙ্গা।তার উপর তুমি গান ধরলে তোমার হাত কাঁপে।তোমাকে দিলে আহত হবে কি! নিহত ও হতে পারে সবাই।আমি এমনিতেও তোমায় নিতাম না’
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here