সঞ্চারিণী পর্ব -২০

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

২০.
ঘড়ির কাঁটা নয়টার পেট ছুঁই ছুঁই।অফিসের পোশাক পাল্টে নরমাল ড্রেসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবাই।মেধা বাসায় ফিরে নরমাল একটা ওয়েস্টার্ন টপসের উপরে জিন্সের কোটি পরে বেরিয়ে পড়েছে।
ঠিক হলো,সবাই আলাদা আলাদা ভাবে ক্লাবে ঢুকবে।একসাথে ঢুকবেনা।শাওন দুপুরে ঔষধের ডোজটা খাওয়ার পর থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা।শরীর খারাপ লাগছে।মাথা ঘুরছে আর সবকিছু ঝাপসা মনে হচ্ছে।একটু কাজ করেই হাঁপিয়ে যাচ্ছে সে।আরেকটা সমস্যা হলো এত কিছুর ভেতরে সে রশ্নিকে সামনে দেখছেনা।সে কি রাগ করে আসছেনা নাকি এর পেছনে একমাত্র দোষী ঔষুধ গুলো??ডাক্তার কি রশ্নিকে মন থেকে তাড়ানোর কোনো ঔষুধ দিয়ে দিলো নাকি? ‘

বাসায় আর আসলো না সে।কালো শার্টের উপরে যে অফিসের ব্যাজ লাগানো কোটটা পরিহিত ছিল সেটা খুলে রেখে দিয়ে বেরিয়েছে ক্লাবের উদ্দেশ্যে।ক্লাবের নাম রয়েল ব্লু।
সব নীল।সব জায়গায় নীলের হাতছানি।লাইটিংয়েও নীল ব্যবহার হয়েছে।ক্লাবে ঢুকার সময় নুহাশকে এক নজরে দেখলো শাওন।সে তন্মধ্যে ক্লাবে ঢুকে পড়েছে।ক্লাবের ভেতরে প্রবেশ করার পর বাকি সবাইকে কোণায় কোণায় নজরে পড়লেও মেধাকে দেখতে পেলোনা সে।মেজাজ খারাপ হচ্ছে।দেরি করা কি ওর স্বভাব নাকি ইচ্ছে করে এমন করছে মেয়েটা?এখন থেকে কাজ শুরু না করলে পরে অনেক কিছু বাদ পড়ে যাবে।নূন্যতম কমন সেন্স নাই এই মেয়েটার।
ফুটেজে দেখা যতগুলো চেনামুখ ছিল রাত যত গড়াচ্ছে ততজনকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এক এক করে।শুধু দেখা গেলোনা এ্যামিলিকে।সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর্ব শুরু হয়ে গেলো।মেধা এসেছে ঠিক সেই মূহুর্তে।শাওন ওর সঙ্গে কথা বলছেনা।রাগে তার মাথা ধরে আছে।
কথা বলতে গেলে দেখা গেলো রাগারাগি শুরু হয়ে যাবে।মানুষে ঝট পাকিয়ে যাবে।কাজের কাজ আর হবেনা।
নুহাশ মেধাকে বললো কাজে লেগে পড়তে।বুঝতে দেওয়া যাবেনা যে তারা সবাই অফিসার।কথার ছলে সত্যি কথা বের করিয়ে আনতে হবে।
মেধা একটা ছেলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।ছেলেটাকে দেখে বিদেশী মনে হয়েছে।সোনালী চুল আর ফকফকা ফর্সা শরীর। কথাবার্তায় ১০% বাংলা আর ৯০% ইংরেজী।মেধাকে দেখে সে দিওয়ানা হয়ে গেছে তা বুঝতে দু মিনিট সময়ও লাগলোনা।মেধার জন্য সুবিধা হয়ে গেলো।সে রেদোয়ানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো ছেলেটাকে।ছেলেটা বললো এই ক্লাবে অনেক বড় বড় লোক আসে।তবে রেদোয়ানকে সে চেনে।কারণ রেদোয়ান সেবার একটা বড় পার্টি করেছিল এই ক্লাবে।জনপ্রতি ৫গ্লাস বিয়ার খাইয়েছিল সেদিন।ছেলেটা রেদোয়ানের সম্পর্কে কিছু হয়না তাও পার্টিতে তাকে জয়েন হতে বলা হয়েছিলো বলে ছেলেটা রেদোয়ানকে নিয়ে প্রশংসা করলো অনেক।
মেধা জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা এ্যামিলি নামে কাউকে চেনে কিনা।সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা ফোন বের করে কতগুলো ছবি স্ক্রল করে একটা ছবি পেলো যেটাতে কিনা রেদোয়ানের সঙ্গে এ্যামিলি দাঁড়িয়ে আছে।তবে তার এক পাশ দেখা যাচ্ছিল শুধু।মেধা ছবিটা নিয়ে শাওনের কাছে ছুটতে গিয়েই ধাক্কা খেলো একটা লোকের সঙ্গে।ঠিক সেই মূহুর্তে লাইট অফ হয়ে গেছে।মানুষের মধ্যে চেঁচামেঁচি শুরু হয়ে গেলো।মেধার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গিয়েছিলো।সে নিচে ফ্লোরের উপর হাতিয়ে ফোনটা খোঁজার চেষ্টা করেও পেলোনা।২মিনিটের ব্যবধানে কারেন্ট চলে আসলো।কিন্তু ফোন গায়েব সাথে গায়েব ঐ ছেলেটাও।মেধা উঠে পুরো ক্লাব খুঁজলো তাও ছেলেটাকে পেলোনা।
ক্লাবের পেছনে বড় আকারের একটা পুল ছিল।
পুলের কিণারায় বেগুনী রঙের পোশাকে একটা ছেলেকে দেখলো সে যে কিনা ফোন এগিয়ে ধরে কিসব ইশারা করছিলো ওকে।মেধা তা দেখতে পেয়ে দোতলা থেকে ছুটে এসে যতক্ক্ষনে সেখানে পৌঁছালো ততক্ষণে ছেলেটা গায়েব।পুলের পাশেই ঘন বন।মেধা ঐদিকটা যাওয়া ধরতেই কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে পা থামিয়ে নিলো।পেছনে তাকাতেই মুখোমুখি হলো শাওনের।সে একটা ধমক মেরে বললো,’এখানে কি করো তুমি?’

-‘একটা ছেলের ফোনে এ্যামিলিকে হাফ দেখলান।কিন্তু ছেলেটা ফোন সমেত গায়েব।কারেন্ট গেলো আর আসলো।সাথে করে সব নিয়ে গেলো।

-‘এ্যামিলিকে পুরোটা দেখোনি?’

-“নাহ।তবে অর্ধেক দেখলাম।মনে হয় সামনা সামনি দেখলে চিনে ফেলবো’

-‘আমরা যাদের জিজ্ঞেস করেছি তারা কেউই এ্যামিলি সম্পর্কে জানেনা।কিন্তু ছেলেটা গায়েব হলো কেন?আমি বুঝতেছিনা, সব খবর ঐ খুনি কি করে পেয়ে যায়!’
—-৭
শাওন আবার চলে গেছে নুহাশদের কাছে।মেধা চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিতে নিতে সেও শাওনের পিছু পিছু চলে আসলো।সব কাস্টমার এক এক করে চলে যাচ্ছে এখন।মেধা আর শাওন মিলে ফুটেজে ঐ ছেলেটাকে দেখছে যার ফেনে এ্যামিলির ছবি ছিল।ছেলেটাকে এরপরে আর কোনো ফুটেজেই দেখা গেলোনা
আশ্চর্যকর হয়ে দাঁড়ালো একটা বিষয়।আর সেটা হলো ক্লাব থেকে বের হওয়ার যে সেকশান আছে।সেকশান “সি” সেখান দিয়ে কাউকে বের হয়ে যেতে দেখা গেলোনা।তার মানে খুনি আর ঐ ছেলেটা ক্লাবেই আছে।এই ভেবে ক্লাব খুঁজে দেখা হলো কিন্তু তাদের পাওয়া গেলোনা।তাহলে গেলোটা কোথায়?ক্লাবের পাশেই ঘন জঙ্গল।তারা ধারণা করে নিলো।ঐ জায়গা দিয়ে চলে গেছে হয়ত।
ক্লাব থেকে বের হওয়ার পর শাওন সুইমিং পুলটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,’কেসটাতে রহস্যের অভাব নেই।জানিনা আর কত সময় লাগবে খুনিকে খুঁজে পেতে।লড়ে যাব যতদূর পারি।রিপোর্ট এসেছে আশার।আশা মাথায় চোট পেয়ে মারা গেছে।তা নিশ্চয় সেন্টার টেবিলে পড়ে নয়।তাহলে কিসে??কি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছিলো?’

-“স্যার আলমারিতে যে হাতুড়ি পাওয়া গিয়েছিল সেটা না তো?’

-‘না সাজিদ!সেটা না।সেটা পুরোনো রক্ত ছিল।একেবারে হলদে ভাব ছিল।নতুন রক্ত হলে লাল হতো।আর যেটা দিয়ে মেরেছে সেটা কেন সামনে রাখবে?আমি রিপোর্টে বিশ্বাস করিনা।আমি তথ্য বের করে যেটা জানতে পারবো ঠিক সেটা বিশ্বাস করবো।বাই দ্যা ওয়ে!মেধা কোথায়?ওর কাজ আছে।যেটুকু হাফ দেখেছে তার স্কেচ তৈরি করে নিলে আমরা সবাই দেখতে পাবো’

-‘এখানেই তো ছিল।পুলের ঐ সাইডটাতে হাঁটছিল তো দেখলাম’

মেধা বনের অর্ধেক পথ একা একা চলে এসেছে।সে আজ ঐ ছেলেটাকে খুঁজে বের করবেই করবে।ঘুটঘুটে অন্ধকার।ছোট বড় পোকামাকড়ের আওয়াজ ভেসে আসছে কানে।গায়ের পশম দাঁড়িয়ে আসছে তাতে।গরম অথচ গা কাঁপছে।পায়ের তলায় হাজারো শুকনো পাতা।সেগুলোর শব্দ শুনে মনে হয় তার সঙ্গে আরও কজন হাঁটছে।
ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে হেঁটে চলেছে মেধা।অনেকদূরে কিঞ্চিত আলো নজরে আসছে।কাছে আসতেই মেধা আস্তে করে ফোনের লাইটটা বন্ধ করে দিলো।আলোটা একটা ল্যাম্পপোস্টের।বনের শেষ হয়েছে মেইন রোডে এসে।তার মানে ওদের খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। ল্যাম্প পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে মেধা রোডটার শেষ প্রান্ত অবধি চেয়ে দেখলো।যানবাহন,মানুষ কিছুরই কোনো চিহ্ন নেই।শুকনো পাতার খসখসে আওয়াজ কানে আসতেই মেধা পাশে ফিরে তাকালো।কেউ নেই।পাতার খসখস আওয়াজ এবার তার পেছন থেকে আসলো।তাকানোর আগেই অনেক জোরে একটা আঘাতে ছিঁটকে পড়লো সে রোডের উপর।মাথা মনে হয় ফেটে যাবে।ব্যাথা এবার মাথায় পেয়েছে।মাথায় হাত দিয়ে মেধা সামনে তাকিয়ে সেই বেগুনি রঙের পোশাকের ছেলেটাকে দেখতে পেলো।চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার।গান বের করে শুট করার ক্ষমতা তার মাঝ থেকে উঠে আসছে ধীরে ধীরে।ছেলেটার অট্টহাসি শুনে মেধা চিনে ফেললো তাকে।মুখে একটা মুখোশ লাগানো।মেধার সামনের সবকিছু ঘুরছে।মুখোশ না থাকলেও সে মুখটা দেখে চিনতে পারতোনা।ছেলেটা চেয়েছিলো আরও আঘাত করতে।কিন্তু বন থেকে কজনের হেঁটে আসার আওয়াজ কানে আসতেই সে পালিয়ে গেলো।শাওন রোডে এসে মেধাকে এমন অবস্থায় দেখে সবাইকে বললো চারিদিকটা সার্চ করতে।এরপর মেধার কাছে এসে নিচে বসে বললো,”কোথায় ব্যাথা পেয়েছো?’

-“মাথায়।’

-“কে ছিল?চিনেছো?’

-“না!মুখোশ ছিল।চিনতে পারলাম না।’

নুহাশ,রায়হান,সাজিদ আর মিলন জনমানবশূন্য এলাকাটা অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে সবটা সার্চ করেও কাউকে পেলোনা।ছেলেটা মনে হয় হেলিকপ্টার নিয়ে পালিয়েছে।এত কম সময়ে কি করে গা ঢাকা দিলো।
গাড়ী ডেকে মেধাকে নিয়ে তারা হসপিটালে আসলো।মাথায় হালকা চোট লেগেছে।রক্ত বের হয়নি।জাস্ট ব্যাথাটা ঘাড়ো ছিল।শাওন মেধাকে ধমকিয়ে যাচ্ছে সেই কখন থেকে।মেধা কেন একা একা বাহাদুরি দেখাতে এত ঘন জঙ্গল পার হলো।আজ যদি তার কিছু হতো গিয়াস স্যার শাওনকে দোষারোপ করতেন

মেধা ব্রু কুঁচকে বললো,’আপনাকে দোষ দিতো কেন?আমিও একজন অফিসার।আমি ভীতু না মোটেও।একা একা পারবো বলেই পথ পাড়ি দিয়েছি”

-“দেখলাম তো কেমন পারলে!বাড়ি খেয়ে অজ্ঞানই হয়ে যেতে যদি আমরা না পৌঁছাতাম।’

-‘দুপায়ে দুইটা গান আছে আমার।দ্বিতীয় বার হার্ম করতে আসলে শুট করে দিতাম’

-“একবারের বাড়িতেই তোমার অবস্থা কাহিল করে দিয়েছিল।দ্বিতীয়বার আর প্রয়োজন ছিলনা’

মেধা মাথা ধরে উপরে তুলতেই বাবাকে দেখে আচমকা ভয় পেয়ে গেলো।শাওন ও চমকে গেছে।সালাম দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিলো উনাকে।উনি মেধার পাশে বসে বললেন,’বুঝলে শাওন!!মেয়েকে ছোট থেকে সাহসী মনে করে এরকম একটা চাকরির জন্য তৈরি করেছি।
আমি চেয়েছিলাম ওকে পুলিশ বানাতে।কিন্তু তার ইচ্ছে ছিল ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার হওয়া।বলতে গেলে একই।তাই রাজি হলাম।প্রতিদিন তাকে চোট পেতে দেখি।এটা কিন্তু স্বাভাবিক। যত চোট পাবে ততই সে শিখবে।এটা মনে করতাম।
কিন্তু এখন মনে হয় বেশি হয়ে যাচ্ছে।এই তো কদিন আগে মাইক্রো বাসের ধাক্কায় হাত ভেঙ্গে ছিল অথচ এখন পর্যন্ত হাতে প্লাস্টার।আর আজ মাথায় চোট পেলো।মাথায় চোট পাওয়া মোটেও স্বাভাবিক না।আমি কাল চলে যাব পটুয়াখালী। তাকে কার ভরসায় দিয়ে যাচ্ছি জানিনা।তবে তুমি আমার বন্ধুর ছেলে।একটু দেখে রেখো।হয়ত সবসময় দেখে রাখতে পারবেনা তাও তোমার সাধ্যে যতটুকু থাকে’

-“বাবা!!আমার দায়িত্ব আরেকজনকে দিয়ে তুমি আমাকে ছোট করছো”

-‘তুমি নিজের দায়িত্ব নেওয়া শিখলে আমি কাউকে আর দায়িত্ব দিতে যাবনা’

-“আমার খবর দিলো কে তোমায়?’

-“ভুলে যাচ্ছো আমি একজন পুলিশ অফিসার?’

মেধা মাথায় হাত দিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে শাওনের দিকে তাকালো।শাওনের মনে পড়লো মেধা বলেছিল সে সিঁড়ি থেকে পড়ে ব্যাথা পেয়েছিল হাতে।তাহলে আঙ্কেল কেন বলছে সে বাসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে হাতে ব্যাথা পেয়েছে?
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here