#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম
০৯
কিছুটা সময় পর ভেতর থেকে ডাক আসে আমার। আমার বুকে কাপন শুরু হয়, বুক ধুরুধুরু করতে থাকে বার বার। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই সে রুমটার দিকে।
রুমের ভেতর গিয়ে দেখলাম তিনজন লোক বসে আছে পাশাপাশি। তাদের মধ্যে একজন বেশ স্বাস্থ্যসম্মত, লম্বায়ও অনেক। একজনের দেখলাম তার থেকে এক হাত সামনে তার ভুড়ি। অন্যজন যেনো কয়েক বছরের না খাওয়া হাড্ডি কঙ্কালসার দেহখানি নিয়ে বসে আছে।
উনাদের তিনজনের মধ্যে যিনি লম্বা আর স্বাস্থ্যসম্মত তিনিই হলেন জি এম স্যার। উনি আমাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করলেন, আমি উত্তর দিলাম। শেষে আমাকে ইংলিশে কিছু লিখার জন্য দিলেন.. সেগুলোও আমি ঠিকঠাকভাবে লিখলাম। উনি খুশি হলেন। পাশের জনের দিকে তাকিয়ে আমার হাতের লেখা আর ব্যাসিক বুদ্ধির তারিফ করলেন খুব।
চাকরিটা পাকাপোক্ত। সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত। বেতনও ভালোই, সেদিনের পর আর কিছুদিন শিহাবের বাসাতে ছিলাম আমি। এরপর অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে শিফট করি। শিহাবকে বার বার করে বলে দেই, যেনো আমার কথা বাড়িতে না জানায়৷ সে আমাকে আশ্বস্ত করে।
নতুন বাসাটা ভালোই, বাড়িটা দেখতে কিছুটা বাংলো বাড়ির মত, সামনে বিশাল বাগান। বাড়ির মালিক বাংলাদেশে থাকেন না, একজন কেয়ার টেকার বাড়িটার দেখাশোনা করেন। খুবই অল্প ভাড়ায় বাড়িটা আমি পেয়ে গেছি। তবে আমি একা নয়, এ বাড়িতে আরো একটা ফ্যামিলি আছে, তারা একতলায় থাকে৷ আমি নিজের মতো চলছি, চাকরি বাকরি করছি। বেশ ভালোই আছি।
নিচতলার মহিলাটা প্রায়ই আমাকে খোঁচা মেরে বলে
“কি গো মেয়ে, এতো বড় বাসায় একা একা থাকো কেন? বিয়েসাদী হয় নি নাকি তোমার? আছে কেউ?
আমি মুচকি হাসলাম। বললাম
“ছিলো, কিন্তু সাপে খেয়ে নিয়েছে।
তিনি অবাক হলেন। ভ্রু কুচকে বললেন
“মানে?
আমি উত্তর দিতে চাইছিলাম না, কিন্তু উনি বার বার প্রশ্ন করলেন। আমি বললাম
“আমার জীবনটা একটা সাপলুডুর ছক। এ ছকে বার বার আমি সিড়ির দেখা পেয়েছি, সিড়ি বেয়ে উপরে উঠেছি, কিন্তু টিকে থাকতে পারিনি। সাপে খেয়ে নিয়েছে।
বুঝলাম, তিনি আমার কথার মাথামুণ্ডু বুঝলেন না৷ শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।
আমি দিন পার করতে থাকলাম আমার মতো। প্রথম চাকরির বেতন পেয়ে একটা ফোন কিনেছি। চাইলেই নতুন সিম কিনতে পারতাম.. কিন্তু সেটা না করে আমার পুরোনো সিমকার্ডটা তুলে নিলাম। ফোনে ইমুও সেট করেছি। আগের অনেক নাম্বার চোখে আসলো। আমি অজান্তে হাসলাম, কিন্তু কি কারণে জানিনা।
ইদানিং বেশ পরিচিত একটা নাম্বার থেকে ইমু তে কল আসে, মেসেজ আসে। আমি শুধু তাকিয়ে থাকি, কল রিসিভ করিনা, মেসেজের উত্তরও দেই না।
সকাল সকাল অফিসে যাবার জন্য রেডি হচ্ছি। ঠিক এই সময় সেই নাম্বারটা থেকে আবারও কল এলো। কিন্তু এবার আর ইমু তে নয়, সরাসরি সিমে। আমি অবাক হলাম, দুশ্চিন্তায় পরলাম, রিসিভ করবো কি করব না ভাবতে থাকলাম
এক দুই ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেলো, আমি ফোনটা রাখতে যাবো তখন আবারও বেজে উঠলো মোবাইল। এবার রিসিভ করলাম। ধীরে ধীরে ফোনটা কানে ঠেকালাম। শুনতে পেলাম সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর থেকে নিসৃত শব্দ..
“তনু, আমি ফায়াজ। তুমি চিনতে পেরেছো আমায়?
আমি শক্ত গলায় বললাম
“চিনতে পারি নি। কে আপনি.?
সে আবারও বললো
“আমি ফায়াজ, তোমার ভালোবাসার ফায়াজ। তুমি ভুলে গেছো আমায়?
এবার আমি কড়া গলায় বললাম
“আমার ভালোবাসা মানে? মাথা গেছে আপনার? সেই কবেই আপনি আপনার খালাতো বোনকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। তবে এখন আপনি কি করে এই কথাটা বলতে পারেন?
সে বিমর্ষ গলায় বললো
“তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে তনু। একটু সময় হবে কি?
“আমার মোটেও সময় নেই। আপনি ফোনটা রাখুন।
“প্লিজ তনু।
এবারে আমিই কেটে দিলাম। আমার সারা শরীর ঘামছে। এতো বছর পর সে কেন আমায় কল করলো? কেন বললো সে আমার ভালোবাসা? বার বার মাথায় প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে লাগলো। তবে এখন এইসব নিয়ে ভাবার সময় নয়। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। আমি সমস্ত চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। হাতের ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে পরলাম অফিসের উদ্দেশ্যে।
(ফ্ল্যাশব্যাক)
যখন আমি প্রথম বার এন্ড্রয়েড ফোন নিয়েছিলাম তখন সবেমাত্র ইন্টার পাশ করেছিলাম। তখন আমার জীবনে না ছিলো ফায়াজ, আর না ছিলো মৃদুল। আর না ছিলো সজলের কোনো ছায়া। তবে ফায়াজ যেহেতু আমার প্রথম ভালোবাসা ছিলো, তাই এতো সহজে ভাকে ভুলতেও পারছিলাম না। দীর্ঘদিন তার বিরহে ভুগেছি আমি। প্রায়ই ইচ্ছে হত, একবার যদি তাকে দেখতে পেতাম। একবার যদি তার কন্ঠস্বরটা শুনতে পারতাম। সে তাড়না থেকেই আমি ইমু থেকে তার নাম্বারে কল করি। প্রথম বার কল হতেই সে রিসিভ করেছিলো, বলেছিলো
“কে?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম
“আমি!
“আমি কে?
“তনু।।
সে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে এক পর্যায়ে বললো
“হঠাৎ কল দিলে যে? আমি বারণ করেছিলাম তো।
আমি মুচকি হেসে বললাম
“মনটা যে বারণ মানে না।
“আবেগটাকে জলাঞ্জলি দাও তনু। আবেগ দিয়ে দিন চলে না, বাস্তবতাটাকে মেনে নাও। আমি তোমায় বার বার বলেছি আমি বিয়ে করেছি, তারপরও কেন আমায় এভাবে কল দাও? আমার বউ আছে, একবার যদি তার চোখে এটা পরে তাহলে আমার সংসারে ঝামেলা হতে পারে তনু।
আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ মেরে গেলাম। সে বললো
“কি হলো?
“আপনার জীবনে কোনো অশান্তি হোক আমি চাইনা। আপনার কাছে ভালোবাসার দাবীও আমি করি না। শুধু একটু সময় চাই, আপনাকে একটু দেখতে চাই।
সে গম্ভীর গলায় বললো
“ইমু খুলেছো! তা ফোন কিনলে কবে?
“এইতো কিছুদিন। ভিডিও তে কল দিবো?
“আমি ব্যস্ত আছি তনু। প্লিজ ডিস্টার্ব করো না আমায়।
সে কল কেটে দিলো। আমার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পরছে। ফোনটার দিকে তাকালাম আবারও। সেদিনই এই নাম্বারটা খুলে ফেলে দিয়েছিলাম। নিয়েছিলাম নতুন সিমকার্ড।
বর্তমানে আমি বসে আছি বাসে৷ এই বাসে করেই আমি প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করি। আগে বাসে চড়তে পারতাম না, তবে এখন অনেক কিছুই পারি। বাসটা যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখনও আমার মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, “হঠাৎ সে কেন আমায় কল করলো? কি এমন কথা থাকতে পারে আমার সাথে যার জন্য একটু সময় চাইলো?
অফিসে গিয়ে যখন পৌছুলাম তখন অন্যদিনের চাইতে প্রায় দশ মিনিট লেইট হলো। অফিসে ঢুকামাত্রই জিএম স্যারের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলো। তিনি লেট হবার কারণে কিছুটা বকাঝকা করলেন আমায়। আমি সেগুলো এক কানে ঢুকিয়ে অন্যকান দিয়ে বের করে স্যারকে স্যরি বলে নিজের ডেস্কে বসে পরলাম।। মাথাটা তখনও ভোঁ ভোঁ করছে, মাথা থেকে কিছুতেই তার কথাটা সরাতে পারিনি।
সাইড বেগ থেকে ফোনটা বের করলাম। চেক করলাম সে নাম্বার থেকে আবারও কোনো কল এলো কিনা। একটা দীর্ঘস্বাস ছাড়লাম। কোনো কল আসেনি। তবে তাতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই, আমি এখন আর তাকে ভালোবাসি না। সমস্ত ভালোবাসা যে মৃদুলকে দিয়ে দিয়েছিলাম, তার জন্য অবশিষ্ট আর কিছুইই ছিলো না। অস্বীকার করবো না, তার জন্য অনেক দিন পর্যন্তই আমার মনে ভালোবাসা ছিলো, প্রথম প্রেম কিনা। তবে এখন আর সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই।
আমি কাজে মন দিতে পারছিনা আজ। বার বার কিছু না কিছু ভুল করেই বসছি। আমার পাশেই ডেস্কেই আমার কলিগ জাহানারা বসা। তিনি বার বার আমায় খেয়াল করছিলেন। আমাকে উষ্কখুষ্ক দেখে প্রশ্ন করলেন
“তুমি কি অসুস্থ তনিমা?
আমি উনার কথায় তাকালাম। বিমর্ষ গলায় বললাম
“শারীরিক নয়, তবে মানসিক ভাবে আমি অসুস্থ।
তিনি আবারও প্রশ্ন করলেন
“তোমার মানসিক রোগের কারণ কি?
এবারে আমি হাসলাম। বললাম
“এ রোগের কারণ মুখে বলা যায় না, ঔষধেও সারে না।
আমি কাজ শুরু করলাম। দেখলাম, উনিও এবার নিজের কাজে মন দিয়েছে। সারাদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে তখন সন্ধ্যে ছ’টা। রান্নাবান্না করা হয় নি সকালে। গতরাতের খাবার ছিলো, সেগুলো খেয়েই গিয়েছিলাম অফিসে। দুপুরে লাঞ্চ করেছি হোটেল থেকে আনিয়ে।। এবার রান্না না করলে আর হবেই না।।
চুলায় ভাত চাপিয়ে তরকারি কুটতে বসলাম আমি। কাটাকাটি প্রায় শেষের পথে, এমন সময় আবারও ফোন বেজে উঠলো। হাতটা ধুয়ে গেলাম ফোন নিতে। নাম্বার দেখে রিসিভ করার ইচ্ছেটাই মরে গেলো। ফোন রেখে দিলাম আবার আগের জায়গা তেই। ততক্ষণে ভাত হয়ে গেছে। ভাতের মাড় ঝড়িয়ে সেটা ছ্যাকা বসিয়ে তরকারি বসানোর রেডি করতে থাকলাম। ফোন এখনো অবিরাম ভাবে বেজেই যাচ্ছে। তরকারি বসিয়ে তারপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিলাম। রিসিভ করে কানে ঠেকাতেও ওপাশ থেকে শক্ত গলায় ফায়াজ বলে উঠলো
“কখন থেকে কল করে যাচ্ছি, রিসিভ করছো না কেন?
উনার ঝাঝালো কথায় রাগ হলো আমার। তিক্ত গলায় আমি বললাম
“আমাকে এভাবে কথা বলার মতো অধিকার নিশ্চয়ই আপনার নেই।
উনি এবার নরম গলায় বললেন
“বার বার কল করার পরেও তুমি ধরছিলে না, তাই রাগ হচ্ছিলো আমার।।
“ঠিক কি কারণে আপনার রাগ হচ্ছিলো?
কথাটা বলার পর উনার উত্তরের অপেক্ষা না করে আমি আবারও বললাম
“আপনার বউ কোথায়? এখন সে দেখবে না? আমার সাথে কথা বললে এখন আপনার সংসারে অশান্তি হবেনা?
উনি কিছু বলছে না, নিরবে শুনে যাচ্ছে আমার কথা। আমার এবার খুব কান্না পেলো। ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়েছি। দ্বিতীয়বার ভালোবেসে বিয়ে করেও স্বামীকে হারিয়েছি, কলিজার টুকরা মেয়েটাকে হারিয়েছি জীবনের মতো। সবগুলো কষ্ট একে একে মনে ক্ষতে থাকা ঘাঁয়ে আঘাত করছে। আমি কান্না বিজড়িত গলায় বললাম
“এতটা বছর পর কেন এভাবে আমাকে বিরক্ত করছেন, আমিতো আমার মতো করে ভালোই আছি। সুখে আছি, শান্তিতে আছি। তবে কেন আপনি আমার শান্তিতে আগুন ঢালছেন?
তিনি অবাক গলায় বললেন
“আমি তোমার শান্তিতে আগুন দিচ্ছি!!
“আপনার কথাটাই এখন আমার কাছে আগুনের মতো লাগছে।
তিনি এবার নরম গলায় বললেন
“জানি, আমাকে তোমার সহ্য হচ্ছেনা, আমার কথায় তুমি রাগ হচ্ছো। এটা দোষের নয়, আমার প্রতি তোমার রাগ থাকাটা স্বাভাবিক। তোমার সাথে আমি যে অন্যায়টা করেছি, তার কোনো ক্ষমা নেই। তবুও আমি তোমার কাছে মাফ চাইছি। তুমি কি আমায় মাফ করবে তনু?
আমি এবার ভেজা গলাতেও তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। দায়সারাভাবে বললাম
“হাহ মাফ! আজ আমার জীবনটাই অন্যরকম হতো, যদি আপনি সেদিন আমার সাথে এমনটা না করতেন। বিশ্বাস করেছিলাম আপনাকে, তার ফল দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র আপনার কারণেই আজ আমার এই করুণ দশা। না আপনি আমাকে ছেড়ে যেতেন, না আমি অন্য কারো ভালোবাসায় জড়াতাম.. আর না আজ আমার এই হাল হতো। আজ আমি অসহায়, স্বামী হারিয়েছি, সংসার হারিয়েছি, এক মাত্র মেয়েকে হারিয়েছি… তার দায় কার? শুধুমাত্র আপনার।
কথাটা বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম আমি। হেচকি দিয়ে কান্না করছি। চোখের বাধ আজ মানছে না, ভেঙ্গে গেছে পুরোটাই। কান্নার মাঝেই ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম বিষণ্ণ গলার আওয়াজ..
“তুমি বিয়ে করে নিয়েছিলে তনু?
আমি ভেজা গলাতেই শক্ত করে বললাম
“কেন, আপনি বিয়ে করেন নি? আপনিও তো করেছেন..
“আমি বিয়ে করিনি তনু, সত্যিই করিনি।
#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম
১০
“তুমি বিয়ে করে নিয়েছিলে তনু?
আমি ভেজা গলাতেই শক্ত করে বললাম
“কেন, আপনি বিয়ে করেন নি? আপনিও তো করেছেন..
“আমি বিয়ে করিনি তনু, সত্যিই করিনি।
আমি অবাক হলাম। প্রশ্ন করলাম
“মানে?
সে কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলো। এরপর নিরীহ গলায় বললো
“তোমার সাথে প্রেমের সম্পর্ক হওয়ার কিছুদিন পরই আমার চাকরিটা চলে গেছিলো। বর্তমানে চাকরি হারানো মানে আস্ত একটা সোনার হরিণ ই হারিয়ে ফেলা। আমি দিশেহারা হয়ে গেছিলাম। চাকরিটা ফিরে পাওয়ার অনেক চেষ্টাই করছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। তোমার কথা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরতো। বার বার মনে হতে থাকলো, আমি বেকার শুনে তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো!
একটা সময় যখন সব চেষ্টা বৃথা হলো, তখন আমার মনে হলো আমার এই বেকার জীবনে তোমাকে না জড়ানোই ভালো। এমনিতে বললে হয়তো তুমি মানতে না, কিন্তু বিয়ের কথা বললে তুমি নিজে থেকেই আমাকে ছেড়ে যেতে। তাই আমি এমনটা করেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাকে ভুলতে পারিনি কিছুতেই। কয়েক মাসের ব্যবধানে অনেক চেষ্টার পর আমি আবারও আমার জবটা ফিরে পাই। তখন তোমার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি, অনেক বার কল দিয়েছি, মেসেজ করেছি। কিন্তু কিছুতেই কোনো লাভ হয় নি। বার বার মনে হয়েছে, আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি, সারাজীবনের জন্যই হারিয়ে ফেলেছি।
আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম উনার কথা, কিন্তু মনের মধ্যে তেমন কোনো কষ্টের অনুভুতি আসলো না। সে আবার বললো
“আমি অলটাইম তোমার এই নাম্বারে ডায়াল করেছি, কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। এবারে যাও পেলাম, কিন্তু….
আমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললাম
“কিন্তু কি?
“তুমি বিয়ে করে নিলে। তবে বিশ্বাস করো, আমি এখনো তোমাকে অনেক ভালোবাসি, এখনো আমার জীবনে আমি তোমাকেই চাই।
আমি হাসলাম, তবে খুশির নয়.. তাচ্ছিল্যের হাসি। সে খানিক অসহায় ভরা গলায় বললো
“তুমি হাসছো তনু? আমার কথায় তোমার হাসি পাচ্ছে?
আমি এবার শান্তভাবে গম্ভীরমুখে বললাম
“আপনার এইসব কথার বিন্দুমাত্র মূল্য নেই আমার কাছে, একবার যে সাপের মুখে পড়েছি, দ্বিতীয় বার সেই সাপের আশেপাশেও আমি থাকতে চাই না। আপনি আপনার মতো থাকুন, আর আমাকেও আমার মতো থাকতে দিন।
“তনু..!!
আমি আর কথা বাড়ালাম না। মুখের উপর ফোনটা কেটে দিলাম। খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ফোনের দিকে। কল আসছে আবারও, বিরক্ত লাগছে খুব। এই সিমটা আমি লাগিয়েছিলাম তার জন্য নয়, আমার বাবা মায়ের জন্য। এই নাম্বারটা তাদের জানা, যদি ভুল করে হলেও তারা একবার আমায় কল দিতো, একবারের জন্যও আমার বাবা আমায় মা বলে ডাকতো.. একবারের জন্য হলেও মায়ের গলাটা শুনতে পেতাম।
তবে আমি নিরাশ হলাম, সেই রকম কিছুই হলো না, উলটো এক উটকো ঝামেলা এসে হাজির হলো। হ্যাঁ উটকো ঝামেলা, যাকে একটা সময় জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতাম, সে এখন আমার কাছে উটকো ঝামেলাই বটে।
আমি বুকভাঙা ব্যাথা নিয়েই ফোনের সিমটা খুলে ফেললাম৷ শোনা হলো না মায়ের কন্ঠ, শোনা হলো না বাবার মুখে স্নেহভরা গলায় মা ডাক। আমি আবারও কাঁদলাম, অঝোরে কাঁদলাম। ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বললাম
“আমি মরবো, বার বার মরবো.. তবে আমাকে মারার জন্য নিজে থেকে কাউকে আর আহবান করবো না।
রাতের খাওয়া আর হলোনা, ভাত ছ্যাকা বসিয়েছিলাম তখন, ফায়াজ নামের সেই ব্যক্তির কারণে আর নামাতে পারি নি, চুলাতে থেকেই পুড়ে গেছে। তরকারি রান্নার মানসিকতাও মরে গেছে।
রাতের শেষভাগে ঘুম ভেঙ্গে গেলো হঠাৎ। একটা স্বপ্ন দেখলাম.. আমার মেয়ে। হ্যাঁ, আমার কলিজার বৃষ্টিকে দেখেছি। সে আমার দিকে তাকিয়ে কান্না করছে, আমায় ডাকছে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমি দৌড়ে যেতে চাইলাম মেয়েটার কাছে, জড়িয়ে ধরতে চাইলাম দুহাত চেপে। কিন্তু পারলাম না, তার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বসে বসে কান্না করছি আমি, আফসোস হচ্ছে খুব। কেন পারলাম না তাকে জড়িয়ে ধরতে? এই জীবনে তো আর তাকে জড়িয়ে ধরতে পারবো না, স্বপ্নেই নাহয় ধরলাম। কিন্তু সেটা আর হলো কই।
সকাল সকাল অফিসের জন্য রেডি হতেই হঠাৎ শিহাব এসে হাজির হলো বাসায়। আমি কিছুটা অবাক হলাম, ওর মুখটা মলিন দেখাচ্ছে তাই। তাকে নরম গলায় প্রশ্ন করলাম
“হঠাই এতো সকালে তুই? তোর মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে তোর?
“আমার একটা কথা রাখবি?
ওর শান্ত গলার আওয়াজে আমি অন্যরকম কিছুর ঘ্রাণ পেলাম। বললাম
“কি হয়েছে?
“আমার কথা রাখবি কিনা বল।
“আগে বল তুই কি বলতে চাস, রাখবো কি রাখবো না সেটা পরে বুঝা যাবে।
সে এবার নরম গলায় বলল
“তুই দরজার বাইরে যা।
আমি অবাক হয়ে বললাম
“কেন?
“যা না তুই, গেলেই দেখতে পাবি।
আমি সন্দিহান চোখে শিহাবের দিকে তাকালাম। কিন্তু কিছু না বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম ঠিকই। শিহাবের দিকে আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সে আমাকে চোখের ইশারায় বাইরে বেরোনোর জন্য অনুরোধ জানালো। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বাইরে গেলাম। দরজার বাইরে গিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। গতকাল রাতেই যে মায়ের গলা শোনার জন্য এতটা ব্যাকুল ছিলাম সেই মা এই মুহূর্তে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এ কি? মায়ের চোখের নিচটা এতো কালো হয়ে আছে কেন? মুখটা এতো মলিন কেন? যে মা এত হাসিখুশি থাকতো, সেই মায়ের মুখটা কালো আধারে ছেয়ে আছে। আমি খুটে খুটে মাকে দেখছি, অন্য কোনো হুশ আমার নেই।
এক পর্যায়ে মা আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলেন, আমার হুশ এলো। আমিও কেঁদে উঠলাম মায়ের সাথে। মা জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমার মাথাটা চেপে ধরলো মায়ের বুকের সাথে। আমি কাঁদছি, কিছু বলার মতো ভাষা আমার মুখে নেই। মা আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন
“কেন আমার কাছে গেলি না রে মা? তোর জীবনে এতো বড় একটা অঘটন ঘটে গেলো, কেন আমায় একবার জানালি না? কেন এভাবে বনে বাদারে পরে আছিস? মা কি এতোই পর হয়ে গেছি? এতো কিছু হয়ে যাবার পরেও মাকে একটাবার মনে পরলো না রে তোর? এতটা পাষাণ কিভাবে হলি তুই?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম
“তোমরাও তো পাষাণ হয়ে গেছিলে মা। একটাবার কেউ আমার খবর নাও নি কেন? তোমাদের একটা কলের আশায় কত যে বুক বেধেছিলাম, কিভাবে বুঝাবো তোমায়? অনেক অপেক্ষা করেছি, প্রহর গুণেছি, কেউ আমার খবর নাও নি। আমি ভুল করেছি তাই? ভুল তো সবাই করে মা, আমি নাহয় একটু বড় ভুলই করেছিলাম। কেন আমাকে মাফ করে আমায় আপন করে নাও নি?
মা আমায় আবারও জড়িয়ে ধরলো। দীর্ঘবছর পর মায়ের সাথে দেখা৷ ইচ্ছে করছে মায়ের কোলে মাথা রেখে কাটিয়ে দেই বাকিটা জীবন। শিহাবের কথায় মা মেয়ের ঘোর ভাঙ্গলো। আমরা দুজনেই শিহাবের দিকে তাকালাম। সে হাসিমুখে বললো
“মাকে নিয়ে রুমে তো আসবি নাকি।
আমি মুচকি হেসে মায়ের দিকে তাকালাম। মান অভিমানের পালা শেষ এবার, মাকে নিয়ে ঢুকলাম ঘরে। অফিসে যাওয়া আর হলো না। মা আমাকে অনুরোধ করে বললো
“এবার বাড়ি চল তনু, অনেক তো হয়েছে।
আমি মাথা নোয়ালাম, অপরাধীর গলায় বললাম
“মুখ নেই মা, বড় মুখ করে ভাইয়া আর বাবাকে বলে এসছিলাম ও বাড়িতে আর পা দিবো না। কি করে যাই বলো সেখানে?
মা আমার হাত চেপে ধরলো। করুন গলায় বললো
“সব কথা ভুলে যা মা, জীবনটাকে নতুন করে শুরু কর। এখনো তোর জীবনের কিছুই শেষ হয় নি। আর যদি কিছু শেষ হয়েও থাকে, তাহলে বুঝে নিবি এই শেষটাই আরেকটা শুরুর সুচনা।
আমি মৃদু হেসে বললাম
“আর কিছুই শুরু করতে চাই না মা। এই জীবনে যা পেয়েছি তার তুলনায় অনেক বেশি কিছুই হারিয়েছি। এই পাওয়া আর হারানোর খেলায় আর যেতে চাই না আমি।
মা আবারও কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিহাব মাকে কিছুটা ধমকে বলে উঠলো
“আহ মা, এইসব কথা এখন রাখো তো। যেটার জন্য এসেছো আগে সেটা করো।
মা এবার মমতাভরে আমার দিকে তাকালেন। বললেন
“এক্ষুনি আমার সাথে বাড়ি চল তনু।
“সেটক কিভাবে হয় মা? ভাইয়া বাবা.. তারা কি আমাকে মেনে নিবেন?
“সেটা আমি বুঝবো।
“তা হয় না মা। আমি যেভাবে আছি, সেভাবেই ভালো আছি। তুমি নাহয় মাঝেমধ্যে এখানেই চলে এসো। মা মেয়ে দুজন দুজনকে মন ভরে দেখব।।
শিহাব সামান্য ক্ষোভ নিয়ে বললো
“বেশি কথা বলবি না তো। মা যা বলছে সেটা কর।
আমি অসহায়ের চোখে মায়ের দিকে তাকালাম। মন থেকেই ইচ্ছে করছে বাড়ি যেতে, কিন্তু এই মুখটা বাপ ভাইকে গিয়ে কিভাবে দেখাবো?
মা আর শিহাবের অনেক জোরাজোরিতে এক সময় বাড়ি যেতে রাজি হলাম। কিন্তু মাকে জানিয়ে দিলাম এখন যাবো না, আর কিছু দিন পর যাবো। কিছুদিন পর আমার স্যালারি হবে। সেই স্যালারিটা আমি একটা পূন্যের কাজে লাগিয়ে তারপরই বাড়ি যেতে চাই। এ পূণ্যের জোরে বাবা আর ভাই যদি আমাকে ক্ষমা করেন।
মা বিস্ময়ে বললেন
“কি এমন করতে চাস তুই?
“আগে বেতনটা পাই, তারপর নাহয় দেখা যাবে কি করি।
সেদিন মা বিদায় নিয়ে চলে গেছিলো। মাকে তেমন কিছু খাইয়ে দিতে পারিনি। ঘরে যা ছিলো তার থেকেই কিছুটা জোর করে খাইয়েছি। সেদিন অফিস মিস হয়েছে তাই পরের দিন অফিসে অনেক বকুনি শুনতে হয়েছে আমাকে। তবে আজকের বকুনিটা আমার কাছে খারাপ লাগেনি, মাকে পাওয়ার আনন্দে সেই বকুনিটাও আমার কাছে মধুর মতো মনে হয়েছে।
সারাটা দিন কাজ করলাম খুশ মেজাজেই। আমার অফিসের কলিগেরাও আজ অবাক। সবার বক্তব্য একটাই, অফিসে জয়েন হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র আজকের দিনটাই তারা আমাকে প্রফুল্ল মেজাজে দেখেছে। আমিও তাদের কথায় সায় দিলাম। সত্যিই আজ আমি অনেক খুশি।
সারাদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরলাম, ফোনে মায়ের সাথেও কথা হলো। যদিও এখনো পর্যন্ত বাবা কিংবা ভাই কারো সাথেই কথা বলার সাহস হয়ে উঠেনি। তবে মনে মনে পণ করলাম এটা ভেবে যে, বাড়ি গিয়ে বাবা আর ভাইয়ের পা দুটো শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো। নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা না করে পারবে না তারা।
দিন যাচ্ছে রাত পোহাচ্ছে। বেতনের দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। ইদানিং একটা স্বপ্ন বারবারই দেখছি। আমার মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদে, আমাকে বার বার তার দিকে ডাকে। আমিও এগিয়ে যাই, তাকে কোলে নিতে চাই। কিন্তু পারিনা, ঘুম ভেঙ্গে যায়। এক স্বপ্ন বার বার দেখার কারণটা আমার অজানা। তবে এটা আমাকে ভাবায়। বার বার একই স্বপ্ন দেখার মানেটা কি!
এক এক করে দিন পার হয়ে বেতনের দিন ঘনিয়ে আসে। আমি অতি আগ্রহে সেদিন আগে আগেই অফিসে চলে যাই। সারাদিন পর বিকেলে স্যালারি হাতে পাই। সেদিনই রিজাইন দিয়ে আসি। যেহেতু বাড়ি চলে যাবো, তাই চাকরির আর প্রয়োজন হবে না। বাড়িতে থাকা কালীন আমার বাবা আর ভাই ও চাকরি করতে দিবেনা এটা নিশ্চিত।। ফেরার আগে কলিগের সাথে পরামর্শ করি, এই টাকাটা দিয়ে কি করা যায়। কি করলে এই দুনিয়াতে মানুশের উপকার হবে আর স্বয়ং আল্লাহ পাক খুশি হবেন। আমার কলিগ আমাকে পরামর্শ দেয়, এখান থেকে কয়েকটা মহল্লা পেরিয়ে গেলেই একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে। সেখানে অনেক অসহায় বাবা মায়েরা আছেন। তাদের কিছু সাহায্য করলেও করতে পারি।
মনে মনে ভাবলাম, এটা করলে মন্দ হয়না। আমি সেদিনই মার্কেটে চলে যাই। যদিও রাত হয়ে গেছে, তাও আমার তর সইছে না। টাকাটা দিয়ে আমি আমার সাধ্যমতো কিছু কাপড় আর লুঙ্গি কিনলাম। পরের দিন সকাল সকাল রওনা করলাম বৃদ্ধাশ্রমের উদ্দেশ্যে। কয়েকটা মহল্লা বললেও ঠিকানা নিয়ে যখন গেলাম, তখন মনে হলো, এটা ঠিক ততটাও কছে নয়। যেতে যেতে প্রায় বারোটা বেজে গেলো। সেখানকার মেডামের সাথে গিয়ে দেখা করে আমি আমার সাহায্য করার আকুতি জানালাম। তিনি খুশি হলেন, দেখাশোনা করার জন্য যে আয়া রাখা হয়েছে তার মাধ্যমে আমাকে প্রথমে পুরুষ লোকেদের কাছে পাঠানো হলো। আমি সকল বাবাদের হাতে একট করে লুঙ্গি তুলে দিলাম। খুব খুশি হলেন উনারা। আমাকে প্রানভরে দোয়া করলেন সবাই। আমি তাদের কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে চলে এলাম মহিলাদের নিকট।
আয়ার সাহায্য নিয়ে আমি কিছুজনের হাতে কাপড় তুলে দিলাম। আরো কিছু বাকি আছি। আমি সেগুলো দেওয়ার জন্য বাকিদের কাছে এগিয়ে যেতে থাকলাম। নির্দিষ্ট যায়গায় পৌছুনোর আগেই কোনো এক অতি পরিচিত মুখ আমার সামনে ভেসে উঠলো। আমি হতবাক হলাম, বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। স্বপ্ন নাকি সত্যি… সেটাও বুঝতে পারছিলাম না তখন। এক পর্যায়ে খেয়াল করলাম, অতি পরিচিত মুখটা আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। তার চোখের কোনে পানি চিকচিক কছে। আমি তার দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। এক পা, দু পা করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে….
চলবে….
[