সুখতারার খোঁজে পর্ব -০৭+৮

#সূখতারার_খোজে🧚‍♀️
#লেখক:আর আহমেদ
পর্ব ৭

মুখ থমথমে! এক রক্তি বিষাদ মন ঘিরেছে তারার মনে ভির দেখেই। তার কলিজা কেমন ছ্যাত করে উঠলো। তারা ধির পায়ে ভির ঠেলে এগিয়ে যায়। সামনে আসতেই বুক চিড়ে ডেকে ওঠে তারা,

-মাআআআআ!

তারার এক চিৎকারে পুরো পরিবেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। কেউতো কেঁদেই ফেলেছে! চালিতে চিত করে শোয়ানো তারার মা! লতিফা নিথর শরীরটার পাশে তার চাচী বসে মাথায় পানি দিচ্ছেন। তারও চোখে পানি! তারার বুকে যেন ছুড়ি বসালো কেউ! রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কষ্টে শ্বাস প্রশ্বাস ভারি হয়ে আসছে ক্রমশ তারার। বুকে ব্যথা করছে। ব্যাগ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তারার। চোখে নোনাজল! এক ছুটে মায়ের পাশে বসে পড়ে তারা। চিৎকার দিয়ে ডাক দেয়,

-মায়ায়ায়া! ও মা! মা কথা বলো কি হয়েছে? ওঠো না, মা!

মেয়ের কাতরতাসূচক আকুতিতে কিছু মহিলা মুখে হাত গুজলেন। তাদের চোখে বাধ ভাঙলো! তারা এক নাগাড়ে মায়ের মুখ নাড়িয়ে ডাকতে লাগছে,

-মা। কিছু হয়নি তো! কি হলো ওঠো না মা! মাহ্!

আধোআধো চোখ খুলে তাকান লতিফা। তার চোখ আজ দেখা যাচ্ছে না। মেয়ের জন্য তার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। নিশ্বাস তার কঠিন হয়ে উঠছে। তারা লতিফার মাথা কোলে রাখে। মুজ ভিজে গেছে তারার। আজ কত কত মানুষ তারার বাড়িতে। তারা সকলকে লক্ষ করে বলে উঠলো,

-মা দেখো,সবাই তোমায় দেখতে এসেছে! তুমি সবাইকে ছেড়ে যেতে পারো না। তুমি সুস্থ হবে। হতেই হবে।

লতিফা শেষ হাসি হাসেন। কেন তার বাঁচতে ইচ্ছে করছে? কেন তারার আকুতি তাকে বাঁচতে ইচ্ছে করায়? লতিফা এতদিন তো দুটো জিনিসই চেয়েছেন সৃষ্টিকর্তার থেকে, মেয়ের ভালো ভবিশ্যত, আর তার মৃত্যু! আজ কেন তাকে দুনিয়ার মিছে মায়া টানছে বড্ড? তারা মাকে বুকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে। তারার চাচী কঠোরতা আজ ভুলে গেছেন। তার মন চাইছে, সময়টা পিছিয়ে যাক, মহিলাটার একটু যত্ন করার সময় যেন পান তিনি! কিন্তু দেড়ি হয়ে গেছে।

তারার কান্না থামে না! এই বুঝি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন লতিফা! তারা বারবার বলছে, কেউ ডাক্তার ডাকো! আজ এতো নিষ্ঠুর হয়ো না! অন্তত আজ একটু সাহায্য করো কেউ!

বাধ ভাঙা নদীর মতো ডুকরে কেঁদতে থাকে তারা। মায়ের মৃত্যু দেখাটা কত কঠিন শুধু সে’ই বুঝছে! তারার চাচী ইলিমা বেগম উঠে ছুট দিলেন নিজ ঘরের দিকে। তূর বেশ দামি মোবাইলটা টিপছে! ইলিমা ছুট দিয়ে ছিনিয়ে নিলেন ফোন। তূর ভ্রু নামিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,

-উফফ! মা কি হয়েছে?

-একছুটে সরকারি হাসপাতালে ছুটে যা। ডাক্তার ডেকে আন জলদি!

-ডংগিটা(তারা) কি করে?

ইলিমা রাগি গলায় বললেন,

-তূর! যা বলছি চুপচাপ তা কর গিয়ে!

-আজ তেজ গেছে? আরে সেদিনতো একটু কথাই বলতে গেছিলাম, সে তার কিনা তেজ?

-তুই যাবি না ফোন ট্রাংকে ভরে রাখবো?

-যাচ্ছি!

তূর ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। ইলিমা ভাবছিলেন একবার ভালো ডাক্তার ডাকবেন। কিন্তু বলার বেলায় আর বলতে পারলো না। কিছুক্ষণ আগের জোস কেমন তলিয়ে গেলো!

_____

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ডাক্তার চেকাপ করে চলে গেছেন কিছুক্ষণ আগে। মায়ের একপাশে বসে নিরবে অস্ত্রুবিসর্জন দিচ্ছে তারা। লতিফার দেহ নিথর হয়ে গেছে। শুধু শ্বাসটুকুই চলছে! ডাক্তার তেমন কিছুই করতে পারেনি। একে একে সবাই চলে গেছে। ভির আর নেই! দু মুহুর্তে আবারো একলা তারা। তারার চাচা আজ শহরে গেছে। চাচী তারার পাশে বসে। তনয়াকে একবারের জন্যেও দেখা যায়নি আজ! তূর সে একবারই বের হয়েছিলো। তনয়া এমন স্বার্থপর ছিলোনা! খুব ছোট থাকতে আসতো এ বাড়িতে। কিন্তু এখন সে আসে না। তূর,তারার তিন বছরের বড়। সে আগে অনেক জ্বালাতো তারাকে। হঠাৎ দমে গেছে! আজকাল সামনেই আসেনা।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। তারা যেন মৃদু কাঁপছে। তার থেকে দু হাত দূরে ফোনটা৷ অথচ তারার মনে হচ্ছে কয়েক ক্রশ দূরে। ভরহীন ভাবে হেটে ফোনটা রিসিভ করে তারা।

– কি করছিস তুই?

মন অন্যকোথাও তারার। এদিকে কবিতা আবারো জিজ্ঞেস করলো,

-তারা কথা কেন বলছিস না?

তারা অস্ফুটস্বরে বললো,

-কে আপনি?

কবিতা যেন বৈদ্যুতিক শর্ট খেলো কথাটায়। আপাদমস্তক বলে দিলো কে আপনি? তারা চমকানো সুরে তারাকে ডাকতে লাগলো,

-তারা কি হয়েছে তোর? কি রে..ওই তারা!

সজ্ঞানে আসতেই বুক চিড়ে কান্না আসতে লাগলো তারার। চোখ ফেটে পানি পড়তে লাগলো চোখ বেয়ে। কান্নার স্বর পেতেই কবিতা আরো উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো,

-কি রে তারা? তোর কি হয়েছে? তারা কি হয়েছে বলবি তো!

-ম্া মা..

-আন্টি? আন্টির কি হয়েছে?

-মা..খুব..

কবিতা যেন বুঝতে পেলো! বলল,

-আমি আসছি তারা। আমি আসছি!

ফোন কেটে ফিরতেই পেছনে অভ্রকে দেখতে পেলো কবিতা। অভ্রের চোখ জিজ্ঞেসু! সে অকপট বলে উঠলো,

-আসছি মানে? সন্ধ্যায় কই যাচ্ছো?

কবিতা অপ্রস্তুত এমন প্রশ্নে। কিছুটা সময় নিলো কবিতা। কবিতার পা’ও কেমন মৃদুভাবে কাপছে! সে বললো,

-তারার মা খুব অসুস্থ! আমি ওখানেই যাবো।

বলে কবিতা পাশ কাটিয়ে এগোতেই পেছন থেকে অভ্র বলে উঠলো,

-আমিও যাবো!

থামলো কবিতা! বললো,

-তারাতাড়ি এসো..

ইরাকে বলেই চলে গেলো কবিতা আর অভ্র। কবিতা সামনে না থাকলে উনি যেতে দিতেন না। হয়তো আরও লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবে..!

দেড় ঘন্টার আগেই পৌছে যায় কবিতা আর অভ্র। ঘরে ডুকতেই দুজন কাটখোট্টা মানুষ চোখে পরে কবিতার। তারার মুক কেমন শুকিয়ে গেছে। কাট কাট মুখশ্রী ভেজা, স্যাতস্যাতে! কবিতা ছুটে গিয়ে গলা জড়িয়ে নেয় তারার। এদিকে লতিফা খুব বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিচ্ছে তো একটু দমছে। কবিতা তারাকে অভয় দিয়ে বলে,

-কিছু হবে না। কিছু হতে দিবো না আমরা। তুই দাড়া আমি এখনি ডাক্তারকে কল করছি।

কবিতা বাইরে চলে আসে। তারাকে প্রথম দরজার আড়াল থেকে দেখেই বাইরে চালিতে দাড়িয়ে অভ্র। মেয়েটাকে এভাবে মানায় না। খুব খারাপ লাগছে অভ্রের!

কবিতা ফোন করে আসতে বলে দেয় ডাক্তারকে। তারপর ঘরে চলে আসে। ডাক্তার আসতে আসতে রাত আটটা বেজে যায়। তবুও একবার চেকাপ করে ডাক্তার। সব শেষে কবিতা বলে,

-উনি সুস্থ হবে তো ডাক্তার?

না সূচক মাথা নাড়ায় ডাক্তার। তারা হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকে। কবিতার চোখেও শেষ পর্যন্ত বাধ ভাঙলো। সে কেঁদে উঠলো। ডাক্তার বললেন,

-অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। আর সম্ভব নয়। এখন চিকিৎসা করেও লাভ নেই আর।

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই হাউমাউ করে সশব্দে কাঁদতে থাকে তারা। চালিতে শব্দ আসছে, কান চেপে নিজেকে দমে দাড়িয়ে অভ্র!

মধ্যিরাত!
অসহ্য চিৎকরে তারার লাগা চোখ মেলে ওঠে। লতিফা চিৎকার ছাড়ছে! মেয়ের গালে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়েও তিনি হাত দিতে পারলেন না। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। তারা লতিফার বুকে জড়িয়ে আর্তনাত করে কাঁদতে লাগলো। কবিতা কঁদছেই! অনেক কস্টে তারাকে ঘুম পাড়াতে চেয়েছিলো কবিতা। তার আগেই শেষ হলো সবটা। অভ্র ভিতরে আসতে চেয়েও আসলো না। তার মন বলছে, দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে নিতে। বুকে জাপটে ধরে বলতে, কেঁদে না! আমার বুকও ঝলসে যাচ্ছে তোমার কান্নায়। কেঁদো
না সুখতারা, কেঁদো না!

ফজরের আগেই লতিফাকে গোসল করিয়ে সাদা কাফনে মোড়ানো হয়েছে। তারাকে ধরে দাড়িয়ে আছে কবিতা। এখনো একফোঁটা পানি পান করেনি তারা। অনেক বুঝিয়েও কিচ্ছু খাওয়াতে পারেনি। সকলে জানাজা পড়ে নিয়ে যান লতিফাকে খাটিয়ায় করে। পর্দাসহ কবর দেয়া হয়।
____

তারা মাটিতে বসে! অভ্র চালিতে এসে দাড়ালো এখনি। মাটি দিতে গিয়েছিলো সে। দিয়েই এসে দাড়িয়েছে অভ্র।

দুপুর গড়িয়েছে…

তারা একচোখে মাটিতে তাকিয়ে রয়েছে। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে তারার। কবিতা পাশে বসে মাথায় তেল দিচ্ছে। তারার চাচা এখনি আসলো। সবটা শুনে তিনিও স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। অভ্র একটিবারও কথা বলেনি তারার সাথে। কবিতা তারার চাচার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো,

-আমরা তারাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চাই। ও এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবে। নিয়ে যেতে চাই আমরা।

অভ্র বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। কবিতা হঠাৎ কি বলে উঠলো? তারার চাচার তেমন হেলদোল নেই। তিনি সেদিকে তাকিয়েই রয়েছেন। কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে কটকটে গলায় কথাটা আরেকজন বলে উঠলো,

-তারা কোথাও যাবে না। ও আমাদের কাছে থাকবে। ওর চাচা চাচী কি মরে গেছে?

আড়চোখে তাকালো তারা। তূর দারিয়ে সামনে। তারা মাথা তুলে অবাক চোখে তাকায়! হঠাৎ দরদ?
#সুখতারার_খোজে🧚‍♀️
#লেখক:আর আহমেদ
পর্ব ৮

কেটে গেছে এক সপ্তাহ। তারার সূদুর আকাশপানে তাকিয়ে। একঝাক পাখি উড়ে যাওয়া দেখছে তারা। যদি সেও পাখি হতো। তারও দুটি ডানা থাকতো? থাকতো আকাশ বেড়ানোর ক্ষমতা! তাহলে বোধহয় ভালো হতো। এই পৃথিবীতে কাটাতে হতো না তাকে। নরকের মতো কষ্ট গুলো সে উড়িয়ে দিতো! তবুও ভালো হতো। সুখ নামক কিছু একটা তার হাতে থাকতো অন্তত!

তারা এখন তার চাচার বাড়িতেই থাকে। সেদিন কবিতার কত ঝগড়া তাকে না নিয়ে যেতে দেওয়ায়, ভাবলেই হাসি পায় তারার। শ্যামবর্ন মুখখানা দিনদিন কাঠ কয়লা হয়ে উঠছে তারার। চোখের কোনে কালসিটে দাগগুলো জেকে বসেছে। ঠোঁটগুলো,যারা কিনা একদম জিবন্ত লাল আভা সম্পূর্ণ ছিলো তা এখন কুঁচকে গেছে। তারা জিভ দিয়ে একবার ভিজিয়ে নেয় ঠোঁট! তারার চোখের সামনেই কেমন পুরো আকাশ কালো হয়ে যাচ্ছে। হয়তো আজ বৃষ্টি হবে। তারার সাধ জাগছে সে বৃষ্টি দেখবে। জানালার রডগুলোয় জং ধরেছে। হাত দিলেই অক্সাইড অরফে লাল মরিচা হাতে আটকে আসে। তারা তবুও হাত দেয়। জানালা ধরে সে দেখবে বৃষ্টি। হাত বাড়িয়ে ভেজাবে। দোয়া করবে মায়ের জন্য! মাগফিরাত কামনা করবে। দীর্ঘসময় পর তারা বৃষ্টির দেখা পায়! আকাশ ভেঙে নামতে থাকে বৃষ্টি। কিন্তু তারার আরাম স্থায়ী হয়না। কারো বীভৎস আওয়াজে হকচকিয়ে উঠে তারা।

-কি রে? বৃষ্টি চোখে দেখিস না তারা? কাপড়গুলা তুলবি তো!

ঘার আধঘোরা করে ঘুরতে চেয়েও ঘোরে না তারা। এতকিছুর মাঝেও সে মুচকি হাসে। বৃষ্টিবিলাস হয়না তারার। বিছানা থেকে নেমে ছুটে বাইরে আসে। উঠোনে দড়ি বাধা সব কাপর তুলে চালিতে দাড়িয়ে সশব্দে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয় তারা। ডান পার্শে চোখ যেতেই তারা দেখে চাল ফুটো, টপে টপে পানি পড়ে মাটির চালি ভিজছে। কাপড়গুলো ঘরে রেখে একটা বর বাটি দেয় সেখানে। পানি মাটিতে না পড়ে বাটিতে পড়ছে। তারার চাচীবাড়ির সবথেকে বড় পেঁপে গাছটার পেঁপেগুলো হলদে রঙা হয়ে উঠেছে, পেঁপেতে সংগঠিত জৈব-রাসায়নিক প্রকিয়ায় হলুদ বর্নের নতুন যৌগ সৃষ্টি করেছে। তাই সেগুলো হলুদ হচ্ছে।

তারা আবারো হাসে। আজকাল সব কিছুতে তার হাসি পায়। মায়ের কথা মনে পড়লেও হাসে তারা। আবারো হেসে পেছন ফিরে ঘরের দিকে হাটতে থাকলো তারা। হঠাৎ তূর তার সামনে এসে দাড়ায়। তারা ভ্রুক্ষেপহীন পাশ কাটাতে চাইলে আবারো সামনে এসে দাড়ায় তূর। ঠোঁটজোরা বাঁকিয়ে বলে,

-এখনো তোর ট্রমা কাটেনি?

-কিসের ট্রামার কথা বলছেন তূর ভাই?

তারা জিজ্ঞেস করলো। উত্তরে বেখায়ালি হাসলো তূর। যেন এতটুকু কথা জোক্স মনে হলো তূরের। বললো,

-ওহ্হো ওটাতো ড্রামা হবে তাইনা,তারা?

বলেই হো হো করে হসতে লাগলো তূর। তারা বুঝলো না। হয়তো বুঝতেই চাইলো না। তারা বললো,

-আর কিছু বলবেন?

-হুম, অবশ্যই।

সিরিয়াস হয়ে বললো তূর। তার মুখ দেখেই স্পষ্ট সে তারাকে খোঁচা দিতে এসেছে। সয়তানি হাসিটাই তার প্রমান। তারা এক চিলতে হেঁসে বললো,

-বলেন..

-অভ্রকে বিয়ে করতে চাইছিলি না তুই? তাহলে যে আমি আরেকটা মেয়েকে দেখলাম ওর পাশে..

-কবে?

-আরে ওইযে…সে কি’না ঝগড়া! বেশ তো বলছিলো,’ওকে আমরা নিয়ে যাবোই! তারাদের তো আপনারা কোনদিন খেয়াল রাখেননি! আর আজও রাখবেন না! আমি নিয়ে যেতে চাই ওকে। দরকার পড়লে লাশ ফেলে দেবো। তাও নিয়ে যাবো! ‘ তা নিয়ে গেলো না কেন?

কবিতার মতো ব্যাঙ্গ করে বললো তূর! এটা সত্যি কবিতা সেদিন সবটা দিয়ে লড়েছে তূরের সঙ্গে। কিন্তু অভ্রের এক ঝাড়ি দমিয়ে দেয় কবিতাকে। ভেজা বেড়ালের মতো চলে গেছিলো সেদিন।

তূরের কতাগুলোতেও তারা হেঁসে বলে,

-এটাকে ভালোবাসা বলে তূর ভাই। বোঝেন ভালোবাসা কি? বখাটে গুলোর মতো এসে একগাদা গিফট আর একটা আই লাভ ইউ বললে ভালোবাসা হয় না। কবিতা যেটা করেছিলো সেটা মন থেকেই করেছে!

কথাগুলো তূরকে উদ্দেশ্য করে বলেছে তারা। তূর বুঝেও রাগ দমালো। একটা পেপার তারার হাতে ধরিয়ে বললো,

-এটা এডমিট! মাত্র তিনটে দিন বাকি তোর পরিক্ষার। এতো ট্রামা সরি, ড্রামা না করে পড়! পারলে রাত দিন এক করে পড়। পরিক্ষা টাফ হবে শুনলাম!

তারা এডমিট হাতে অবাক চোখে তাকিয়ে। তাহলে কবিতা কাল এটার’ই কথা বলেছিলো? তারা এডমিটে চোখ বুলায়।

-আপনি এটা আমার জন্য এনেছেন?

আবারো বাকা হেঁসে বলে তূর,

-সেন্টিমেন্টাল হোস না! জাস্ট পরিক্ষাটার জন্যই এনেছি! নাহলে তেমন কিছুই না।

-কিন্তু আপনি তো একদমই সহ্য করতে পারেন না আমায়। আমি ফেল করলে তো আপনার খুশি…

কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত থেকে এডমিট পেপার ছিনিয়ে নেয় তূর। ঠোঁট খিচে বলে,

-ছিড়ে দেবো বলেদিলাম! এনেছি এটা তোর সৌভাগ্য!

আবারো হাতে গুজে দিয়ে চলে গেলো তূর। তারা অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,

-আপনি ভালো হওয়ার নন..

তূর আড়ালে গিয়েই ফোন হাতে নেয়। এদিকে তারা পড়ার টেবিলে চলে যায়।
_____

গেম খেলার মাঝে ফোনকল একদমই পছন্দ নয় তূরের। আর নাম্বারটাও অনেকটা বিরক্তিজনক। তূর ফোন রিসিভ করে। ওপার থেকে বলে ওঠে কেউ,

-ও কি করছে এখন?

তূর বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,

-নিজে দেখে যান।

তারপর আবার সান্ত হয়ে বললো তূর,

-পড়ছে!

-খায় ঠিকঠাক?

-তেমন একটা খায় না! মুখ শুকিয়ে গেছে আগের থেকে অনেক।

-ওর কি বাস্তবে ফিরতে আরও সময় লাগবে নাকি?

-তা অত কিছু কি কারনে বলবো আমি আপনাকে? বিয়ে হয়ে গেছে চুপচাপ নিজের সংসার করুন। তারার প্রতি আপনার ইন্টারেস্ট না দিলেও হবে। এখন রাখুন।

ফোন কেটে দিলো তূর। অভ্র হতাশার শ্বাস নিয়ে ফোন বিছানায় রাখলো। কবিতাও পড়ার টেবিলে, কিন্তু মন পড়ায় নাই। সে চিন্তাতেই পড়তে পারছে না। একবার এক সাবজেক্ট তো আরেকবার আরেক সাবজেক্ট পড়তে ইচ্ছে করছে কবিতার। মাঝেমাঝে কলমে চুল পেঁচাচ্ছে ও। অভ্র বিছানায় বসে পড়লো। কবিতার মাথায় এখন পড়া বাদে সব ঘুরপাক খাচ্ছে। এই যেমন, তার নক্ কাটতে ইচ্ছে করছে। আবার ঘরটাকে একটু গুচাতেও মন চাইছে। এমন আজেবাজে চিন্তা গুরপাক খাচ্ছেই কবিতার মাথায়। অবশেষে বিরক্তি নিয়ে উঠেই পড়লো টেবিল থেকে। অভ্র ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,

-পরশু পরিক্ষা আর এখন এমন ওঠাউঠি করছো কেন?

কবিতা মাথা বাঁকিয়ে বললো,

-আর ভালো লাগছে না।

-তুমি কিছু পড়ছো আদেও?

-পড়লাম তো!

-কখন? পড়তে বসেছো থেকে দেখছি এদিক সেদিক তাকাতাকি করছো। পড়তে বসো।

-পারবো না।

-কবিতাহ্!

কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো অভ্র। কবিতা যেন বেলুনের মতো চুপসে গেলো এরিমধ্য। অভ্র আবার বলে উঠলো,

-কেন পারবে না?

-করন, আজ অব্দি আমি নিজে নিজে কখনো পড়িনি। তাও আবার একলা!

-তো তোমার জন্য অন্য কেউ পড়ে দিয়েছিলো নাকি?

-তারাই তো আমায় স্বল্প সিলেবাসে খুব পরিপাটিভাবে পড়াতো। একসাথে পড়তাম দুজনে। এতদিনের অভ্যাসে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

-তো ওকে একবার ডাকো!..

হঠাৎ মুখ ফসকে বলে উঠলো অভ্র। তারা না সূচক মাথা নাড়িয়ে বসে পড়লো বিছানায়। অভ্র একটু ক্ষেপে গিয়ে বিছানা থেকে টেনে তুললো কবিতাকে। এক টানে বিছানা থেকে টেবিলে নিয়ে এসে বসালো তারাকে। এরপর পাশের আরেকটা চেয়ারে নিজে বসে পড়লো। পরাতে লাগলো কবিতাকে। তা কবিতার মন মত করে। পড়া দিচ্ছে আর ধরছে। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগছে কবিতার। পড়ায় মন দিলো কবিতা,!

দেখতে দেখতে পরিক্ষার সময় আগত। খুব ভোরে কবিতাকে টেনে তুলে পড়তে বসিয়েছে অভ্র। এরপর নিজে মর্নিং ওয়ার্কে চলে গেছে। তারাকেও উঠিয়েছে নিজের অজান্তে তূর। তারা ঘুমে থাকা অবস্থায়তেই ব্লুটুথে স্পিকারে ফুল সাউন্ড দিয়ে গান চালিয়েছিলো তূর৷ তার ফলস্বরূপ ঘুম ছেড়েই পড়তে বসে তারা। ভেবেছিলো এই গানের জন্য তার পড়াই হবে না। কিন্তু পরতে বসতেই গান বন্ধ হয়ে যায়। তবুও তারা আগের মত পড়তে পারছে না। পড়ালেখায় কেমন মন নেই তারার।

ঠিক সারে সাতটায় ফোন বেজে উঠতেই টেবিল ছাড়ে তারা। কবিতা ফোন করেছে। তারা রিসিভ করে ফোন। কবিতার তাড়াহুড়ো করে বলে,

-তুই রেডি তো তারা?

-রেডি মানে?

-পরিক্ষা আটটায় শুরু। তুই আসবি কখন? খেয়েছিস তো?

তারার মাথায় যেন বাজ পড়লো। সে তো এখনো খায়ইনি। ওপার তেকে কবিতা আবার বললো,

-জানিস তো পরিক্ষা সিটি কলেজে হবে!

-হ্যা কিন্তু..

-এবার কি করবি তুই?

‘আপু আসলাম’ বলেই তখনি ঘরে প্রবেশ করলো তনয়া। এইপ্রথম সে এ ঘরে আসলো তারা আসার পর। তাও হাতে খাবার। ফোন নামিয়ে অবাক চোখে তাকালো তারা। মাত্র মাসখানেকের ছোট তনয়া। অথচ সে তারার আশেপাশেও ঘেষেঁ না। আর আজ খাবার নিয়ে এসেছে? তনয়া খাবার বিছানায় রেখে বললো,

-খেয়ে নাও। তোমার তো দেড়ি হয়ে গেছে। তাহলে তুমি রেডিও হওনি। যাবে কখন?

তারা নিশ্চুপ হয়ে তনয়ার দিকে তাকিয়ে। তনয়া আবার বলে,

-তুমি বরং একটা কাজ করো, ভাইয়া এখনি মোটর সাইকেল বের করলো। হয়তো কোথাও যাবে। তুমি বরং সেটাতেই না হয় যাও।

-কিন্তু তূর ভাই কি আমায় নেবে?

-আমি বলছি। তুমি রেডি হও।

বলে চলে গেলো তনয়া। তারার ফোনের কথা মনে পড়তেই কবিতাকে বললো সে আসছে। অতপর একটু রেডি হয়ে নিলো তারা। সব গুছিয়ে বাইরে আসতেই তূরকে চোখে পড়লো তারার। সে বাইকে বসে আছে। তারা ওখানে যেতেই তূর কটাক্ষ স্বরে বলে উঠলো,

-নিজের পরিক্ষার টাইমও নিজে জানিস না। আর এসেছিস ছাত্রীগিরি দেখাতে? তারাতাড়ি বস!

বাঁকা কথা না বললে যেন ভালোই লাগে না এই লোকটার। তারা বসে পড়ে। কোনমতে পেছনের হাতল ধরতেই বাইক স্টাট দেয় তূর।

আড়ালে হিংসায় জ্বলতে লাগলো কেউ। এক পশলা ঘৃনা ছুড়লো তারার দিকে।

#চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here