#সুখপাখির_উড়াল
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_২
রুমের মধ্যে অনবরত পা*ই*চা*রী করছে তিথি। ভেবেছিলো বিয়ের পর একটু সুখ জু*ট*বে কপালে। কিন্তু শাশুড়ির জন্য তাও পাবে না মনে হচ্ছে। শাশুড়ি তাকে পছন্দ করে না বলেই যে এমন আচরণ করছে, তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে তিথি। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই তার সাথে অন্য রকম আচরন করে চলেছেন সীমা বেগম।
তিথির বয়স যখন ৫, তখন একটা দু*র্ঘ*ট*না*য় মা*রা যায় তার বাবা। সে আর তার ছোট ভাই বাবা নামক ছা*য়া হারিয়ে অ*স*হা*য় হয়ে পরে। তাদের দেখার জন্য বা সাহায্য করার জন্য দূর দূর পর্যন্ত কেউ ছিলো না। এমনিতেই গরিবের সংসার, তার মধ্যে পরিবারের কর্মক্ষম মানুষটাকে হারিয়ে একটা খা*রা*প পরিস্থিতির মধ্যে পরে তিথি রা। একেই হয়তো বলে ‘ম*ড়া*র উপর খাঁ*ড়া*র ঘা’। তিথির মা তামান্না বেগম হাতের কাজ করে, কাপড় সেলাই করে অনেক ক*ষ্টে তিনজনের সংসার চালাতেন। তিথিও একটু বড় হওয়ার পর মায়ের কাজে সাহায্য করা শুরু করে। এই টু*ক*টা*ক ইনকাম দিয়ে কোনোরকমে চলছিল তাদের।
কলেজে উঠার পর একটা পার্ট টাইম জব জোগাড় করে তিথি। তা দিয়ে নিজের আর ভাইয়ের পড়াশোনা চালাতো। তিথির ভাই তানিম ও অল্প বয়সেই ম্যাচুর হয়ে গিয়েছিল। কর্মক্ষম হওয়ার পর থেকে যা পারতো করতো। অন্য ছেলেরা সেই বয়সে অনেক রকমের আবদার, ইচ্ছা পুরন করলেও সে একটা টাকাও অ*প*চ*য় করতো না।
তিথির কোনো বড় ভাই নেই। কিন্তু বুঝ হবার পর থেকে তানিমই তিথির বড় ভাইয়ের ভূমিকা পালন করে এসেছে। এই তো কয়েকদিন আগেও তো বোনের বিয়ে কতো ধু*ম*ধা*ম করে দিলো। সে নাকি অনেক আগে থেকেই বোনের বিয়ের জন্য অল্প অল্প করে টাকা জমাচ্ছিলো। সেই টাকা আর অফিসের বসের কাছ থেকে আরও টাকা ঋ*ণ নিয়ে সাধ্যমত আয়োজন করে সে। তবে এই বিয়েতে তানিমের ও মত ছিলো না। সেও অনেক উ*স*খু*স করেছে সীমা বেগমের ব্যবহার দেখে। তার কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো বোন ওখানে ভালো থাকবে না। কিন্তু বোনের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলেনি সে।
জীবনে অনেক ক*ষ্ট করেছে তিথি। ভেবেছিলো এবার শুধু সুখ করবে। কিন্তু সব মেয়েরা যে রাজকপাল নিয়ে জন্মায় না এটা হয়তো ভুলে গিয়েছিলো সে। কিছু কিছু মেয়েদের যে মানিয়ে চলতে হয় এটা মানতে না*রা*জ তিথি।
———-
সময় বহমান। দিনগুলো খুব দ্রুতই যাচ্ছে তবে শান্তি নামক জিনিসটা হারিয়ে গেছে রাফিদের জীবন থেকে। তার মা সীমা বেগম আর তিথির মাঝে এখনো কোনো কিছুই ঠিক হয়নি। দুইজনের মাঝে ঝা*মে*লা লেগেই আছে। সীমা বেগম আর তিথি কেউই কাউকে ছাড় দিতে চায় না। ঘরে,অফিসে কোথাও শান্তি পায় না রাফিদ। একবার সীমা বেগম, একবার তিথি ফোন দিয়ে এটা ওটা নিয়ে বি*চা*র দেয়। কাউকেই কিছু বুঝাতে পারে না রাফিদ। বুঝাতে গেলেই তারা উ*ল্টো বুঝে।
এই তো কয়েকদিন আগের কথা। বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি বলে তিথি বায়না ধরলো হানিমুনে যাবে। রাফিদ ও এক কথায় রাজী হয়ে গেলো যদি এতে অ*শান্তি একটু কমে সেই আশায়। কিন্তু এতে অ*শান্তি কমার বদলে আরও বেড়ে গেলো যেনো। সীমা বেগম কে হানিমুনে যাওয়ার কথা বলতেই তিনিও বায়না ধরলেন সাথে যাবেন। তার ও অনেকদিন ধরে কোথাও যাওয়া হয়না। তাই তিনিও যেতে চান। বি*প*দে পড়ে গেলো রাফিদ। সে জানে তিথিকে এখন এই কথা বলামাত্র তু*ল*কা*লা*ম কা*ন্ড বা*ধ*বে ঘরে। কিন্তু মাকেও যে কিছু বলতে পারবেনা।
মুখ অ*ন্ধ*কা*র করে মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসলো সে। তিথিকে এই বিষয়ে বলতেই সত্যিই ঝ*গ*ড়া করা শুরু করলো সে। সীমা বেগম ও কিছু কম যান না। কিছুতেই শাশুড়ি কে নিজেদের সাথে নিবে না তিথি। আর সীমা বেগম ও জি*দ ধরেছেন, তিনি যাবেনই। রাফিদ অনেক ক*ষ্টে তিথিকে রাজী করালো। ভাবলো ঘুরতে গেলে হয়তো দুজনের মুড ফ্রেশ হবে। কিন্তু হানিমুনে গিয়েও শান্তি পেলো না রাফিদ। সুখপাখি যেনো তার জীবন থেকে সবসময়ের জন্য উ*ড়ে চলে গেছে।
———
কে*টে গেছে দুই মাস। দিনগুলো চলে গেলেও তিথি আর সীমা বেগমের সম্পর্কের কোনোরকম উন্নতি হয়নি। বাড়িতে গেলেই সীমা বেগম রুমে নিয়ে বলেন তিথিকে ছেড়ে দিতে। তিনি আরও অনেক ভালো মেয়ের সাথে ছেলেকে বিয়ে দিবেন। অন্যদিকে তিথি রাফিদ রুমে গেলেই বলে, এই অ*শান্তি সে আর স*হ্য করতে পারছেনা। সে আলাদা হতে চায়। চিন্তায় চিন্তায় চোখ কো*ট*রে ঢু*কে গেছে রাফিদের। কতো রাত যে চিন্তায় ঘুম আসে নি তার তা শুধুমাত্র সেই জানে। কিন্তু তার দিকে কোনো খেয়ালই নেই কারোর। না সীমা বেগম নিজের ছেলের দু*র*ব*স্থা দেখছেন, না তিথি। দুইজনই প্রতি নিয়ত নতুন নতুন ঝা*মে*লা সৃষ্টিতে ব্যস্ত। রাফিদের মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় ম*রে যেতে। এতো চা*প সে নিতে পারছেনা।
রাতে বাড়ি ফিরতেই সীমা বেগম ছেলে কে রুমে যেতে বলেন। রাফিদ বুঝতে পারে কেনো মা তাকে ডা*ক*ছে। ক্লা*ন্ত পায়ে মায়ের রুমে যায় রাফিদ। মা*ন*সি*ক ভাবে ভীষণ ক্লা*ন্ত সে। রুমে যেতেই সীমা বেগম ছেলে কে বসিয়ে তিথির নামে অনেক কথা বলেন আর আবারও বলেন তিথি কে ছেড়ে দিতে। রাফিদ ক্লা*ন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় মায়ের দিকে। কিন্তু সীমা বেগমের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি এক মনে তিথির বি*রু*দ্ধে কথা বলতে ব্যস্ত।
তিথি রুম থেকে খুব কম বের হয়। কারণ বাইরে গেলেই সীমা বেগম উ*ল্টা*পা*ল্টা কথা বলতে শুরু করে, তার সাথে কাজের মানুষের মতো ব্যবহার করতে চায়। তিথির চিন্তা ভাবনা, সে এই বাড়ির বউ কোনো কাজের মানুষ না যে সীমা বেগম তাকে যেভাবে ইচ্ছা খা*টা*বে। তার যখন ইচ্ছা হবে কাজ করবে, ইচ্ছা না হলে করবে না। সে কারোর হু*কু*মে উঠতে আর বসতে পারবেনা। তাই এখন যতটুকু পারে রুমেই থাকে। সীমা বেগম বাইরে থেকেই অনেক কিছু বলেন কিন্তু তিথি শুনেও না শুনার ভা*ন করে থাকে আজকাল। রুমে থাকা জগে পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় পা টি*পে*টি*পে বের হয়েছিল তিথি। কিন্তু সীমা বেগমের রুম পার হওয়ার সময় কিছু কথা কানে আসে তার। থেমে যায় পা। কথাগুলো শুনে মাথায় আ*গু*ন জ্ব*লে উঠে তার। ভি*রা*নো দরজা এক ধা*ক্কা*য় খুলে ভেতরে চলে আসে। ক্ষি*প্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সীমা বেগমের দিকে।
হুট করে স্ত্রীর আগমনে আর তার এমন দৃষ্টি দেখে রাফিদ দাঁড়িয়ে যায়। বুঝতে পারে সীমা বেগমের বলা কথাগুলো হয়তো শুনে ফেলেছে তিথি। এতদিন সীমা বেগম আর তিথি যাই বলতো না কেনো, তা নিজের মাঝেই রাখতো রাফিদ। কারোর কথা কারোর কাছে বলতোনা। কিন্তু আজ দু*র্ভা*গ্য*ব*শ*ত সব শুনে ফেলেছে তিথি। এখন কি হতে পারে ভেবে গলা শু*কি*য়ে গেলো তার।
তিথি আ*গু*ন ঝ*রা*নো কণ্ঠে চি*ল্লি*য়ে বললো,
— এইসব করেন আপনি হ্যা, এইসব করেন? ছেলে কে এভাবেই উ*ল্টা*পা*ল্টা বুঝাচ্ছেন এতদিন ধরে তাইনা? আরে কেমন মা আপনি যে নিজের ছেলের সংসার ভা*ঙা*র জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন? মা নাকি ডা*ই*নি আপনি?
সীমা বেগমের গা জ্ব*লে উঠলো তিথির কথায়। তে*জী কণ্ঠে বললেন,
— চুপ কর ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চা। তোর মতো ফ*কি*ন্নি*র আমার সাথে চি*ল্লি*য়ে কথা বলার সা*হ*স হয় কি করে? ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চা কোথাকার! তোর মতো ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চার কোনো যোগ্যতা নাই আমার সোনার টু*ক*রো ছেলের বউ হওয়ার। এই জন্যই আমি বিয়েতে মত দিতে চাইনি। জানতাম কোনো ফ*কি*ন্নি ঘরের মেয়ে আমার ছেলের যোগ্য না।
রাফিদ এসে তিথিকে স*রা*নো*র চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু সে যাবেনা কিছুতেই। বারবার ফ*কি*ন্নি বলায় আরও ক্ষে*পে গেছে তিথি। রা*গে গ*ড়*গ*ড় করে বলতে লাগলো,
— আমি নাহয় ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চা তাই আমার যোগ্যতা নাই আপনার বাড়ির বউ হওয়ার কিন্তু আপনি তো ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চা ছিলেন না তাহলে আপনার স্বামী কেন আপনারে ছেড়ে চলে গেলো? আমার কি মনে হয় জানেন? আপনার এই ফা*ল*তু ব্যবহারের জন্যই সে অন্য মহিলার হাত ধরে চলে গিয়েছে।
— তিথিইইই!
রাফিদ চি*ৎ*কা*র করে একটা থা*প্প*ড় বসিয়ে দিলো তিথির গালে। তিথি গালে হাত দিয়ে ছ*ল*ছ*ল নয়নে তাকিয়ে রইলো রাফিদের দিকে। সীমা বেগম তিথির কথায় ভীষণ আ*ঘা*ত পেলেন। মুখে আঁচল চে*পে গু*ন*গু*ন করে কাঁ*দ*তে লাগলেন। তিথি কাঁ*দ*তে কাঁ*দ*তে বললো,
— বাহ্! শেষ পর্যন্ত গায়েও হাত তুললে? তোমার মাকে এভাবে বলায় তোমার কতো রা*গ হলো যে আমাকে থা*প্প*ড় মা*র*তে তোমার হাত কাঁ*প*লো না। অথচ তোমার মা যখন আমাকে বারবার ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চা বলছিলো, আমার বাপ মা তুলে কথা বলছিলো তখন তুমি কা*পুরুষের মতো চুপ করে ছিলে। এটাই হয়তো আমার প্রাপ্য ছিলো তাই না? ভালোবাসা, হাহ! এটাই তোমার ভালোবাসা? বিয়ের আগে যখন আমরা রিলেসন এ ছিলাম, তখন কতো ওয়াদা করেছিলে মনে আছে? বলেছিলে বিয়ের পর আমাকে রাজরানী করে রাখবে। কখনো কোনো ভাবে আমাকে ক*ষ্ট দিবে না। আমার জীবনের সব দুঃ*খ ক*ষ্ট ভুলিয়ে দিবে। আমাদের জীবনে সুখের কোনো ক*ম*তি হবে না। একটা ওয়াদাও কি পূরণ করতে পেরেছো বলো?
রাফিদ মাথা নিচু করে ফেললো। এক ফোঁ*টা অ*শ্রু গ*ড়ি*য়ে পড়লো তার চোখ থেকে। এটা হয়তো ব্য*র্থ*তা*র অ*শ্রু। সে না একজন যোগ্য ছেলে হতে পেরেছে না যোগ্য স্বামী।
তিথি রাফিদের নিচু মাথার দিকে তাকিয়ে তা*চ্ছি*ল্য করে বললো,
— তুমি একজন ব্য*র্থ স্বামী রাফিদ। কি পেয়েছি এই জীবন থেকে বলো? সবটাই তো জানতে। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কতোটা st*ru*ggl*e করতে হয়েছে আমাকে। ভেবেছিলাম তোমাকে বিয়ে করার পর লাইফে আর কোনো ক*ষ্ট থাকবে না। কিন্তু তুমি কি করলে? তোমার মায়ের অ*মতে আমাকে বিয়ে করলে। আমাকে পছন্দ হয়নি বলে, আমি গরীব ঘরের সন্তান বলে তোমার মা আমার সাথে উ*ল্টা*পা*ল্টা ব্যবহার করতে লাগলো, যখন যা মুখে আসে তাই বলতে লাগলো, কাজের মানুষের মতো ট্রিট করতে চাইলো। যাতে তার ব্যবহারে অ*তি*ষ্ট হয়ে আমি বা*জে ব্যবহার করি আর সে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তোমার কাছে আমাকে খা*রা*প প্রমান করতে পারে আর আমাদের সংসার ভা*ঙ*তে পারে। তারপর তিনি নিজের পছন্দের বউ আনবেন।
দ*ম ফেললো তিথি। চোখের পানি মু*ছে পুনরায় বললো,
— যাও মু*ক্ত করে দিলাম তোমায়। আমি জানি তুমি তোমার মাকে অনেক বেশি ভালোবাসো আর তুমি তাকে কখনোই ছাড়তে পারবেনা। আর তোমার মা তোমার আমার সংসার টি*ক*তে দিবে না তা এই ক’দিনে বেশ বুঝেছি। আমি আর এসব নিতে পারছিনা। ছোট বেলা থেকে অনেক অ*ভা*বে ছিলাম কিন্তু এতো অ*শা*ন্তি ছিলো না বিশ্বাস করো। আমি আর এসব স*হ্য করতে পারবোনা। তাই তুমি তোমার মায়ের পছন্দে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিও। আমি চলে যাচ্ছি তোমার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করে দিয়ে।
তিথির কথায় থ*ম মেরে তার দিকে তাকিয়ে রইলো রাফিদ। তিথি রাফিদের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা ক*ষ্টমাখা হাসি দিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে। সাথে কিছুই নিলো না। রাফিদের ম*স্তি*ষ্ক সচল হতেই সে বুঝতে পারলো তিথি চলে যাচ্ছে। তাকে আ*ট*কা*নো*র জন্য দৌড়ে বাসা থেকে বের হলো রাফিদ। কিন্তু ততক্ষনে তিথি চলে গিয়েছে।
তিথিকে না পেয়ে ঘো*লা চোখে ট*ল*তে ট*ল*তে ঘরে ঢু*ক*লো রাফিদ। মায়ের ঘর থেকে কা*ন্না*র গু*ন*গু*ন আওয়াজ আসছে। কিন্তু ঐদিকে আর না গিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো সে। বিছানায় টা*ন*টা*ন হয়ে শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। দুই চোখ দিয়ে একাধারে ট*প*ট*প করে পানি পড়ছে তার। তারপর….
চলবে,
(আস্সালামুআলাইকুম। দুঃ*খি*ত লেট হয়ে গেলো দিতে। আর একটা পর্ব হবে। দ্রুত দেয়ার চেষ্টা করবো। সবাই ভু*ল-ত্রু*টি ক্ষ’মা’র দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।)
#সুখপাখির_উড়াল
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_২
রুমের মধ্যে অনবরত পা*ই*চা*রী করছে তিথি। ভেবেছিলো বিয়ের পর একটু সুখ জু*ট*বে কপালে। কিন্তু শাশুড়ির জন্য তাও পাবে না মনে হচ্ছে। শাশুড়ি তাকে পছন্দ করে না বলেই যে এমন আচরণ করছে, তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে তিথি। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই তার সাথে অন্য রকম আচরন করে চলেছেন সীমা বেগম।
তিথির বয়স যখন ৫, তখন একটা দু*র্ঘ*ট*না*য় মা*রা যায় তার বাবা। সে আর তার ছোট ভাই বাবা নামক ছা*য়া হারিয়ে অ*স*হা*য় হয়ে পরে। তাদের দেখার জন্য বা সাহায্য করার জন্য দূর দূর পর্যন্ত কেউ ছিলো না। এমনিতেই গরিবের সংসার, তার মধ্যে পরিবারের কর্মক্ষম মানুষটাকে হারিয়ে একটা খা*রা*প পরিস্থিতির মধ্যে পরে তিথি রা। একেই হয়তো বলে ‘ম*ড়া*র উপর খাঁ*ড়া*র ঘা’। তিথির মা তামান্না বেগম হাতের কাজ করে, কাপড় সেলাই করে অনেক ক*ষ্টে তিনজনের সংসার চালাতেন। তিথিও একটু বড় হওয়ার পর মায়ের কাজে সাহায্য করা শুরু করে। এই টু*ক*টা*ক ইনকাম দিয়ে কোনোরকমে চলছিল তাদের।
কলেজে উঠার পর একটা পার্ট টাইম জব জোগাড় করে তিথি। তা দিয়ে নিজের আর ভাইয়ের পড়াশোনা চালাতো। তিথির ভাই তানিম ও অল্প বয়সেই ম্যাচুর হয়ে গিয়েছিল। কর্মক্ষম হওয়ার পর থেকে যা পারতো করতো। অন্য ছেলেরা সেই বয়সে অনেক রকমের আবদার, ইচ্ছা পুরন করলেও সে একটা টাকাও অ*প*চ*য় করতো না।
তিথির কোনো বড় ভাই নেই। কিন্তু বুঝ হবার পর থেকে তানিমই তিথির বড় ভাইয়ের ভূমিকা পালন করে এসেছে। এই তো কয়েকদিন আগেও তো বোনের বিয়ে কতো ধু*ম*ধা*ম করে দিলো। সে নাকি অনেক আগে থেকেই বোনের বিয়ের জন্য অল্প অল্প করে টাকা জমাচ্ছিলো। সেই টাকা আর অফিসের বসের কাছ থেকে আরও টাকা ঋ*ণ নিয়ে সাধ্যমত আয়োজন করে সে। তবে এই বিয়েতে তানিমের ও মত ছিলো না। সেও অনেক উ*স*খু*স করেছে সীমা বেগমের ব্যবহার দেখে। তার কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো বোন ওখানে ভালো থাকবে না। কিন্তু বোনের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলেনি সে।
জীবনে অনেক ক*ষ্ট করেছে তিথি। ভেবেছিলো এবার শুধু সুখ করবে। কিন্তু সব মেয়েরা যে রাজকপাল নিয়ে জন্মায় না এটা হয়তো ভুলে গিয়েছিলো সে। কিছু কিছু মেয়েদের যে মানিয়ে চলতে হয় এটা মানতে না*রা*জ তিথি।
———-
সময় বহমান। দিনগুলো খুব দ্রুতই যাচ্ছে তবে শান্তি নামক জিনিসটা হারিয়ে গেছে রাফিদের জীবন থেকে। তার মা সীমা বেগম আর তিথির মাঝে এখনো কোনো কিছুই ঠিক হয়নি। দুইজনের মাঝে ঝা*মে*লা লেগেই আছে। সীমা বেগম আর তিথি কেউই কাউকে ছাড় দিতে চায় না। ঘরে,অফিসে কোথাও শান্তি পায় না রাফিদ। একবার সীমা বেগম, একবার তিথি ফোন দিয়ে এটা ওটা নিয়ে বি*চা*র দেয়। কাউকেই কিছু বুঝাতে পারে না রাফিদ। বুঝাতে গেলেই তারা উ*ল্টো বুঝে।
এই তো কয়েকদিন আগের কথা। বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি বলে তিথি বায়না ধরলো হানিমুনে যাবে। রাফিদ ও এক কথায় রাজী হয়ে গেলো যদি এতে অ*শান্তি একটু কমে সেই আশায়। কিন্তু এতে অ*শান্তি কমার বদলে আরও বেড়ে গেলো যেনো। সীমা বেগম কে হানিমুনে যাওয়ার কথা বলতেই তিনিও বায়না ধরলেন সাথে যাবেন। তার ও অনেকদিন ধরে কোথাও যাওয়া হয়না। তাই তিনিও যেতে চান। বি*প*দে পড়ে গেলো রাফিদ। সে জানে তিথিকে এখন এই কথা বলামাত্র তু*ল*কা*লা*ম কা*ন্ড বা*ধ*বে ঘরে। কিন্তু মাকেও যে কিছু বলতে পারবেনা।
মুখ অ*ন্ধ*কা*র করে মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসলো সে। তিথিকে এই বিষয়ে বলতেই সত্যিই ঝ*গ*ড়া করা শুরু করলো সে। সীমা বেগম ও কিছু কম যান না। কিছুতেই শাশুড়ি কে নিজেদের সাথে নিবে না তিথি। আর সীমা বেগম ও জি*দ ধরেছেন, তিনি যাবেনই। রাফিদ অনেক ক*ষ্টে তিথিকে রাজী করালো। ভাবলো ঘুরতে গেলে হয়তো দুজনের মুড ফ্রেশ হবে। কিন্তু হানিমুনে গিয়েও শান্তি পেলো না রাফিদ। সুখপাখি যেনো তার জীবন থেকে সবসময়ের জন্য উ*ড়ে চলে গেছে।
———
কে*টে গেছে দুই মাস। দিনগুলো চলে গেলেও তিথি আর সীমা বেগমের সম্পর্কের কোনোরকম উন্নতি হয়নি। বাড়িতে গেলেই সীমা বেগম রুমে নিয়ে বলেন তিথিকে ছেড়ে দিতে। তিনি আরও অনেক ভালো মেয়ের সাথে ছেলেকে বিয়ে দিবেন। অন্যদিকে তিথি রাফিদ রুমে গেলেই বলে, এই অ*শান্তি সে আর স*হ্য করতে পারছেনা। সে আলাদা হতে চায়। চিন্তায় চিন্তায় চোখ কো*ট*রে ঢু*কে গেছে রাফিদের। কতো রাত যে চিন্তায় ঘুম আসে নি তার তা শুধুমাত্র সেই জানে। কিন্তু তার দিকে কোনো খেয়ালই নেই কারোর। না সীমা বেগম নিজের ছেলের দু*র*ব*স্থা দেখছেন, না তিথি। দুইজনই প্রতি নিয়ত নতুন নতুন ঝা*মে*লা সৃষ্টিতে ব্যস্ত। রাফিদের মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় ম*রে যেতে। এতো চা*প সে নিতে পারছেনা।
রাতে বাড়ি ফিরতেই সীমা বেগম ছেলে কে রুমে যেতে বলেন। রাফিদ বুঝতে পারে কেনো মা তাকে ডা*ক*ছে। ক্লা*ন্ত পায়ে মায়ের রুমে যায় রাফিদ। মা*ন*সি*ক ভাবে ভীষণ ক্লা*ন্ত সে। রুমে যেতেই সীমা বেগম ছেলে কে বসিয়ে তিথির নামে অনেক কথা বলেন আর আবারও বলেন তিথি কে ছেড়ে দিতে। রাফিদ ক্লা*ন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় মায়ের দিকে। কিন্তু সীমা বেগমের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি এক মনে তিথির বি*রু*দ্ধে কথা বলতে ব্যস্ত।
তিথি রুম থেকে খুব কম বের হয়। কারণ বাইরে গেলেই সীমা বেগম উ*ল্টা*পা*ল্টা কথা বলতে শুরু করে, তার সাথে কাজের মানুষের মতো ব্যবহার করতে চায়। তিথির চিন্তা ভাবনা, সে এই বাড়ির বউ কোনো কাজের মানুষ না যে সীমা বেগম তাকে যেভাবে ইচ্ছা খা*টা*বে। তার যখন ইচ্ছা হবে কাজ করবে, ইচ্ছা না হলে করবে না। সে কারোর হু*কু*মে উঠতে আর বসতে পারবেনা। তাই এখন যতটুকু পারে রুমেই থাকে। সীমা বেগম বাইরে থেকেই অনেক কিছু বলেন কিন্তু তিথি শুনেও না শুনার ভা*ন করে থাকে আজকাল। রুমে থাকা জগে পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় পা টি*পে*টি*পে বের হয়েছিল তিথি। কিন্তু সীমা বেগমের রুম পার হওয়ার সময় কিছু কথা কানে আসে তার। থেমে যায় পা। কথাগুলো শুনে মাথায় আ*গু*ন জ্ব*লে উঠে তার। ভি*রা*নো দরজা এক ধা*ক্কা*য় খুলে ভেতরে চলে আসে। ক্ষি*প্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সীমা বেগমের দিকে।
হুট করে স্ত্রীর আগমনে আর তার এমন দৃষ্টি দেখে রাফিদ দাঁড়িয়ে যায়। বুঝতে পারে সীমা বেগমের বলা কথাগুলো হয়তো শুনে ফেলেছে তিথি। এতদিন সীমা বেগম আর তিথি যাই বলতো না কেনো, তা নিজের মাঝেই রাখতো রাফিদ। কারোর কথা কারোর কাছে বলতোনা। কিন্তু আজ দু*র্ভা*গ্য*ব*শ*ত সব শুনে ফেলেছে তিথি। এখন কি হতে পারে ভেবে গলা শু*কি*য়ে গেলো তার।
তিথি আ*গু*ন ঝ*রা*নো কণ্ঠে চি*ল্লি*য়ে বললো,
— এইসব করেন আপনি হ্যা, এইসব করেন? ছেলে কে এভাবেই উ*ল্টা*পা*ল্টা বুঝাচ্ছেন এতদিন ধরে তাইনা? আরে কেমন মা আপনি যে নিজের ছেলের সংসার ভা*ঙা*র জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন? মা নাকি ডা*ই*নি আপনি?
সীমা বেগমের গা জ্ব*লে উঠলো তিথির কথায়। তে*জী কণ্ঠে বললেন,
— চুপ কর ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চা। তোর মতো ফ*কি*ন্নি*র আমার সাথে চি*ল্লি*য়ে কথা বলার সা*হ*স হয় কি করে? ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চা কোথাকার! তোর মতো ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চার কোনো যোগ্যতা নাই আমার সোনার টু*ক*রো ছেলের বউ হওয়ার। এই জন্যই আমি বিয়েতে মত দিতে চাইনি। জানতাম কোনো ফ*কি*ন্নি ঘরের মেয়ে আমার ছেলের যোগ্য না।
রাফিদ এসে তিথিকে স*রা*নো*র চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু সে যাবেনা কিছুতেই। বারবার ফ*কি*ন্নি বলায় আরও ক্ষে*পে গেছে তিথি। রা*গে গ*ড়*গ*ড় করে বলতে লাগলো,
— আমি নাহয় ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চা তাই আমার যোগ্যতা নাই আপনার বাড়ির বউ হওয়ার কিন্তু আপনি তো ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চা ছিলেন না তাহলে আপনার স্বামী কেন আপনারে ছেড়ে চলে গেলো? আমার কি মনে হয় জানেন? আপনার এই ফা*ল*তু ব্যবহারের জন্যই সে অন্য মহিলার হাত ধরে চলে গিয়েছে।
— তিথিইইই!
রাফিদ চি*ৎ*কা*র করে একটা থা*প্প*ড় বসিয়ে দিলো তিথির গালে। তিথি গালে হাত দিয়ে ছ*ল*ছ*ল নয়নে তাকিয়ে রইলো রাফিদের দিকে। সীমা বেগম তিথির কথায় ভীষণ আ*ঘা*ত পেলেন। মুখে আঁচল চে*পে গু*ন*গু*ন করে কাঁ*দ*তে লাগলেন। তিথি কাঁ*দ*তে কাঁ*দ*তে বললো,
— বাহ্! শেষ পর্যন্ত গায়েও হাত তুললে? তোমার মাকে এভাবে বলায় তোমার কতো রা*গ হলো যে আমাকে থা*প্প*ড় মা*র*তে তোমার হাত কাঁ*প*লো না। অথচ তোমার মা যখন আমাকে বারবার ফ*কি*ন্নি*র বাচ্চা বলছিলো, আমার বাপ মা তুলে কথা বলছিলো তখন তুমি কা*পুরুষের মতো চুপ করে ছিলে। এটাই হয়তো আমার প্রাপ্য ছিলো তাই না? ভালোবাসা, হাহ! এটাই তোমার ভালোবাসা? বিয়ের আগে যখন আমরা রিলেসন এ ছিলাম, তখন কতো ওয়াদা করেছিলে মনে আছে? বলেছিলে বিয়ের পর আমাকে রাজরানী করে রাখবে। কখনো কোনো ভাবে আমাকে ক*ষ্ট দিবে না। আমার জীবনের সব দুঃ*খ ক*ষ্ট ভুলিয়ে দিবে। আমাদের জীবনে সুখের কোনো ক*ম*তি হবে না। একটা ওয়াদাও কি পূরণ করতে পেরেছো বলো?
রাফিদ মাথা নিচু করে ফেললো। এক ফোঁ*টা অ*শ্রু গ*ড়ি*য়ে পড়লো তার চোখ থেকে। এটা হয়তো ব্য*র্থ*তা*র অ*শ্রু। সে না একজন যোগ্য ছেলে হতে পেরেছে না যোগ্য স্বামী।
তিথি রাফিদের নিচু মাথার দিকে তাকিয়ে তা*চ্ছি*ল্য করে বললো,
— তুমি একজন ব্য*র্থ স্বামী রাফিদ। কি পেয়েছি এই জীবন থেকে বলো? সবটাই তো জানতে। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কতোটা st*ru*ggl*e করতে হয়েছে আমাকে। ভেবেছিলাম তোমাকে বিয়ে করার পর লাইফে আর কোনো ক*ষ্ট থাকবে না। কিন্তু তুমি কি করলে? তোমার মায়ের অ*মতে আমাকে বিয়ে করলে। আমাকে পছন্দ হয়নি বলে, আমি গরীব ঘরের সন্তান বলে তোমার মা আমার সাথে উ*ল্টা*পা*ল্টা ব্যবহার করতে লাগলো, যখন যা মুখে আসে তাই বলতে লাগলো, কাজের মানুষের মতো ট্রিট করতে চাইলো। যাতে তার ব্যবহারে অ*তি*ষ্ট হয়ে আমি বা*জে ব্যবহার করি আর সে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তোমার কাছে আমাকে খা*রা*প প্রমান করতে পারে আর আমাদের সংসার ভা*ঙ*তে পারে। তারপর তিনি নিজের পছন্দের বউ আনবেন।
দ*ম ফেললো তিথি। চোখের পানি মু*ছে পুনরায় বললো,
— যাও মু*ক্ত করে দিলাম তোমায়। আমি জানি তুমি তোমার মাকে অনেক বেশি ভালোবাসো আর তুমি তাকে কখনোই ছাড়তে পারবেনা। আর তোমার মা তোমার আমার সংসার টি*ক*তে দিবে না তা এই ক’দিনে বেশ বুঝেছি। আমি আর এসব নিতে পারছিনা। ছোট বেলা থেকে অনেক অ*ভা*বে ছিলাম কিন্তু এতো অ*শা*ন্তি ছিলো না বিশ্বাস করো। আমি আর এসব স*হ্য করতে পারবোনা। তাই তুমি তোমার মায়ের পছন্দে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিও। আমি চলে যাচ্ছি তোমার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করে দিয়ে।
তিথির কথায় থ*ম মেরে তার দিকে তাকিয়ে রইলো রাফিদ। তিথি রাফিদের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা ক*ষ্টমাখা হাসি দিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে। সাথে কিছুই নিলো না। রাফিদের ম*স্তি*ষ্ক সচল হতেই সে বুঝতে পারলো তিথি চলে যাচ্ছে। তাকে আ*ট*কা*নো*র জন্য দৌড়ে বাসা থেকে বের হলো রাফিদ। কিন্তু ততক্ষনে তিথি চলে গিয়েছে।
তিথিকে না পেয়ে ঘো*লা চোখে ট*ল*তে ট*ল*তে ঘরে ঢু*ক*লো রাফিদ। মায়ের ঘর থেকে কা*ন্না*র গু*ন*গু*ন আওয়াজ আসছে। কিন্তু ঐদিকে আর না গিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো সে। বিছানায় টা*ন*টা*ন হয়ে শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। দুই চোখ দিয়ে একাধারে ট*প*ট*প করে পানি পড়ছে তার। তারপর….
চলবে,
(