সেই তুমি💐
পর্ব -৩১+৩২
Samira Afrin Samia
#Nipa
ইয়াশ অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। ইশিতা রুমেই যেন কি কাজ করছে। ইয়াশ ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে ইশিতা কে দেখছে। ইশিতা ইয়াশের দিকে তাকালে দুজন চোখাচোখি হয়ে গেলে ইয়াশ আবার চোখ নামিয়ে নেয়। এমনটা ইশিতা অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে। কিন্তু কিছু বলছে না। ইয়াশ শার্টের হাতা ভাঁজ করে এদিক সেদিক তাকিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগলো। ইয়াশ কি খুঁজছে তা ইশিতা বুঝতে পেরে একটা টাই এনে ইয়াশের সামনে তুলে ধরে।
— এটাই খুঁজছিলে?
— হ্যা।
ইয়াশ ইশিতার হাত থেকে টাই নিতে চাইলে ইশিতা টাই না দিয়ে নিজে ইয়াশ কে পড়িয়ে দিতে লাগলো। ইয়াশ ইশিতার চোখের দিকে এখনও তাকাচ্ছে না। মাথা সোজা করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
ইশিতা টাই বাঁধতে বাঁধতে
— কি হলো আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন?
ইয়াশ ইশিতার কথার জবাবে কিছু বললো না।
— আমাকে ওভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলে কেন?
এবার ইয়াশ ইশিতার দিকে চোখ তুলে তাকালো ঠিকই কিন্তু সাথে সাথে আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে ইশিতার হাত থেকে টাই নিয়ে ওপাশ ফিরে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই বাঁধতে লাগলো।
হঠাৎ করে ইয়াশের কি হয়েছে তা ইশিতা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ইয়াশের এমন বিহেইভ দেখে ইশিতা প্রথমে কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ইয়াশের সামনে এসে দাঁড়ায়।
— নিজের বউ কে এমন ভাবে লুকিয়ে দেখতে হয় নাকি?
আমি তোমার বউ। আমার দিকে তুমি তাকিয়ে থাকলে আমি কিছু মনে করবো না।
— লুকিয়ে দেখবো কেন?
তোমাকে লুকিয়ে দেখার কি আছে?
— লুকিয়ে দেখার কিছু না থাকলে আমার চোখে চোখ পড়ার সাথে সাথে তুমি আমার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলে কেন?
— এমনি।
ইয়াশের টাই বাঁধা হয়ে গেলে ইয়াশ ইশিতার সামনে থেকে চলে এসে ওয়ালেট নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিচ্ছিল।
এতক্ষণ ইশিতা খুব কষ্টে কান্না চেপে রাখলেও এখন আর পারলো না। ইশিতার দু’চোখ ভরে পানি পড়তে লাগলো।
— কি করেছি আমি। আমার সাথে এমন করছো কেন। আমার দোষ টা কি তা একবার বলো?
কথা গুলো বলেই ইশিতা ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো।ইয়াশ ইশিতা কে কান্না করতে দেখে রুম থেকে বের হতে নিয়েও হলো না। ইয়াশের চোখ ও পানিতে টলমল করছে।
— আমি যাকেই নিজের করে নিতে চাই, যাকেই আপন ভাবতে শুরু করি সেই আমার থেকে দূরে সরে যায়। আমার ভাগ্য টাই এমন। ইফান কে ভালোবেসে জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করছি। প্রথমে ও আমাকে ধোঁকা দিলো। এখন যখন ওকে ভুলে তোমাকে ভালোবাসতে চেষ্টা করছি এখন তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছো।
ইশিতা কেঁদে কেঁদে ফ্লোরে বসে পড়লো। ইয়াশ ইশিতার কাছে এসে
— চুপ কি বলছো এসব?
কে তোমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমি তোমাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ভালোবাসি নি। কথায় কথায় শুধু বাচ্চাদের মত কান্না করা।
— তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো না। তাহলে আমার সাথে এমন করছো কেন কথা বলছো না।
ইয়াশ ইশিতা কে তুলে বেডে বসিয়ে হাত দিয়ে ইশিতার গাল বেয়ে পড়া পানি গুলো মুছে দিয়ে। মাথা নিচু করে
— তুমি এক সময় ইফান কে ভালোবাসতে। এখন হয়ত ভালোবাসো না। তবে ইফান তোমার জীবনে প্রথম ভালোবাসা।
ইশিতা টলমল চোখ নিয়ে ইয়াশের দিকে তাকিয়ে ইয়াশের কথা শুনছে
— ইফান ওর ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন ও তোমাকে ফিরে পেতে চাই। তুমি ওকে একটা সুযোগ
ইয়াশ কথা শেষ করার আগেই ইশিতা দাঁড়িয়ে গেল।
— তুমি আমাকে এতো টা ও নিচু মনের মনে করো না। ইফান আমি অতীত তুমি আমার বর্তমান আর তুমি ই আমার ভবিষ্যত। ইফান ওর ভুল বুঝতে পেরেছে ভালো কথা, এখন তুমি ভাবলে কি করে আমি আবার ওর কাছে ফিরে যাবো।
ইফান আমার প্রথম ভালোবাসা তাই তুমি আমাকে ওর কাছে ফিরে যেতে বলছো। ওকে হ্মমা করে দ্বিতীয় একটা সুযোগ দিতে বলছো। আচ্ছা একটা কথা বলবে?
ইফান আমার প্রথম ভালোবাসা হলে, আমি কি তোমার প্রথম ভালোবাসা না?
তুমি পারবে আমাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে?
ইয়াশের চোখের কোণা বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। ইয়াশ ইশিতা কে ওর চোখের পানি দেখতে দিলো না। আড়ালে ই চোখের পানি মুছে নিলো।
— ইফান ওর ভুল বুঝতে পেরে কষ্ট পাচ্ছে। আর তুমি তো ওকে ভালোবাসতে।
— ইফান ওর ভুল বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছে।
আর হ্যা আমি ওকে ভালোবাসতাম কিন্তু এখন তো বাসি না।
আমি সবার সামনে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি। এখন আমার একটাই পরিচয় আমি তোমার স্ত্রী। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তোমার ভালোবাসা আমাকে বাধ্য করেছে তোমাকে ভালোবাসতে।
ইয়াশ কিছু বলছে না। চুপ করে ইশিতার কথা শুনে যাচ্ছে।
— আর ইফান ওর ভুল বুঝতে পেরেছে এটা খুব ভালো কথা এখন সব কিছু ভুলে গিয়ে নিজের ওয়াইফ কে নিয়ে সুখে সংসার করুক। রিহা ইফান কে পাগলের মত ভালোবাসা ইফান ও রিহা কে ভালোবাসার চেষ্টা করুক।
— তুমি কি ইফানের কাছে ফিরে যেতে চাও না।
— এই যে মি.জামাই আর একটা কথা মুখ দিয়ে বের করলে খুন করে ফেলবো।
ইশিতার মুখে এমন কথা শুনে ইয়াশ ব্যাবাচেকা খেয়ে গেল।
— কত বার বলতে হবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। এক কথা একবার বললে কানে যায় না?
— আসলে।
— কি আসলে অনেক হয়েছে। সেই কখন থেকে আমাকে কাঁদাচ্ছো আর লুকিয়ে লুকিয়ে নিজে ও কেঁদে যাচ্ছো।
খুব ভালো লাগে আমাকে কষ্ট দিলে।
— আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আর তাই তোমার ইচ্ছে মত তোমাকে সিধান্ত নিতে বলছিলাম। যদি তুমি ইফানে কাছে ফিরে যেতে চাও। তাহলে আমি তোমাকে জোর করে আটকে রাখবো না। এমনকি তোমাকে বাঁধা ও দিব না।
ইশিতা ইয়াশ কে নিজের দিকে ফিরিয়ে ইয়াশের পায়ের উপর নিজের দু’পা রেখে ভর দিয়ে ইয়াশের গলায় হাত পেঁচিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
ইয়াশ বেশ অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে মুখ একটু হা করে তাকিয়ে আছে।
ইশিতা হাত দিয়ে ইয়াশের মুখ মিশিয়ে দিয়ে
— কি মি. এতো অবাক হচ্ছেন কেন?
আমি আপনারই বউ। তবে এটা আমার নতুন রূপ। এই রূপে আপনি আমাকে আগে কখনও দেখেন নি।
ইয়াশ ইশিতার কোমর পেচিয়ে ধরে নিয়ে
— তাই নাকি?
তাহলে তো ভালোই হলো। প্রতি দিন একটা করে নতুন নতুন রূপ দেখা যাবে। আর এতে অবাক হবো না বরং সারপ্রাইজড হবো।
— আচ্ছা?
এবার ইয়াশ ইশিতা কে পাঁচকোলে তুলে নিয়ে। ইশিতার নাকের সাথে নিজের নাকের ডগা একটু ঘসে দিয়ে দুষ্টুমি করে বললো
— হুম ম্যাডাম হুম।
ইশিতা চোখ বন্ধ করে নিলো হতে পারে ভয় পেয়ে নয়তো হতে পারে ইয়াশ এভাবে কোলে তুলে নেওয়ার লজ্জা পেয়েছে।
— কি করছেন পড়ে গেলে কেমন হবে? নামান বলছি।
— এই টুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন আমি আপনাকে ফেলবো না।
— হুম বিশ্বাস আছে। অনেক বিশ্বাস আছে।
এই বলে ইশিতা ইয়াশের গলা থেকে হাত ছেড়ে দিলো। ইয়াশ ইশিতার কান্ড দেখে একটু মৃদু হাসলো। কিছু বললো না।
প্রায় কিছুক্ষণ পর ইশিতা নিজের থেকে বলে উঠলো।
— আজ কি অফিসে যাবে না?
নাকি সারা দিন এভাবেই বউ কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে?
— ইচ্ছে তো তাই করছে তবে অফিসে ও তো যেতে হবে। আমার যে অনেক কাজ। আমি না গেলে সেই কাজ গুলো কে করবে?
— হুম এখন অফিসে গিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে আবার তাড়াতাড়ি করে বাসায় চলে আসো।
— হুম।
— হুম না মশাই নামান আমাকে।
ইয়াশ ইশিতা কে নামিয়ে দিয়ে শার্ট টা একটু ঠিক করে ফোন আর ওয়ালেট নিয়ে রুম থেকে বের হতে যাবে ঠিক তখনই ইশিতা পেছন থেকে “” আহ””” করে শব্দ করে পেটে হাত দিয়ে নিচু হয়ে গেল।
ইয়াশ ইশিতার শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে দৌঁড়ে এসে
— কি হয়েছে ইশিতা?
শরীর খারাপ লাগছে নাকি? আমি ডক্টর রে ফোন দিবো?
ইয়াশ নাজমা চৌধুরী কে ডাকতে নিলে ইশিতা মুখে হাত দিয়ে
— এভাবে চেচাঁমেচি করছো কেন?
ঠিক আছি আমি। আমার কিছু হয়নি।
— কিছু হয়নি তাহলে এমন করে উঠলে কেন? ইশিতা ইয়াশের হাত নিয়ে পেটে ধরে
— দুষ্টু টা যে বড্ড বেশি জ্বালাচ্ছে। মনে হচ্ছে বাইরে আসার জন্য ওর তড় সইছে না।
ইয়াশের মুখে প্রাপ্তির হাসির রেখে স্পষ্ট ফোঁটে উঠেছে।
— ও কিছু করেছে?
— কিছু করেছে? ফুটবল খেলছে। একবার আসুক বাইরে তারপর আচ্চা করে বকে দিব।
— হুম। তোমাকে বকতে দিলে তো। কিছু বলতে পারবে না আমার ছেলেকে।
ইশিতা অবাক হয়ে
— ছেলে?
তুমি কি করে জানলে ছেলে না মেয়ে হবে?
— সিউর জানি না। তবে আমার মন বলে আমাদের ছেলে হবে।
— আচ্ছা তা হবে একটা।
এখন অফিসে যাও। লেট হচ্ছে তো।
ইয়াশ আলতো করে দুই হাতে ইশিতার হাত চেপে ধরে বের হয়ে গেল।
ইয়াশ অফিসে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল। সাথে সাথেই ইফান রুমে ঢুকলো। ইশিতা কি যেন করছিল ইফানের শব্দ পেয়ে ফিরে দাঁড়ালো। ইফান রাগে কটমট করছে।
— তুমি আমাকে ভালোবাসো। ভাই কে না। আমি আমার বাচ্চা কে চাই।
ইশিতা ইফানের কথায় কান না দিয়ে রুম থেকে বের হতে চাইলে ইফান ইশিতার হাত ধরে নেয়।
— কোথায় যাচ্ছো?
তোমার সাথে আমার কথা আছে। তুমি এভাবে আমার কথা না শুনে চলে যেতে পারো না।
— হাত ছাড়ো ইফান।
— না তোমাকে আমার কথা শুনতেই হবে।
— হাত ছাড়ো বলছি।
ইশিতা ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো।
— দ্বিতীয় বার আমার হাত ধরার সাহস করবে না।
ইফান ইশিতার দুই হাত চেপে ধরে দেওয়ালের সাথে আটকে ধরে
— কেন? আমি তোমার হাত ধরার সাহস করবো না কেন?
— আমার হাত ধরার অধিকার তুমি অনেক আগে হারিয়েছো।
— ভাইয়ের সাথে তো দেখছিলাম খুব ভালই রোমান্স করছিলে। ভাই তোমার হাত ধরার সময়, তোমাকে কোলে তুলে নেওয়ার সময় তো তোমার কোন অসুবিধা হয়নি।
— আমার স্বামী আমার হাত ধরেছে অন্য কেউ তো ধরেনি সমস্যা কেন হবে। আর স্বামীর সাথে স্ত্রী রোমান্স করবে এটা তো অস্বীকার কিছু না।
তুমি তাহলে লুকিয়ে আমরা কি করছি তা দেখছিলে। বড় ভাইয়ের ঘরে আড়ি পাতার আগে লজ্জা করলো না। এতো টা নিচে নামতে পারলে তুমি। অবশ্য তোমার কাছে এসব নতুন কিছু না।
ইশিতা ধাক্কা দিয়ে ইফানের থেকে সরে এসে দাঁড়াল।
— স্বামী? তুমি কি তাহলে ভাই কে মেনে নিয়েছো?
— অবশ্যই মেনে না নেওয়ার কি আছে। এখন উনি আমার স্বামী। আর আমি আমার স্বামী কে অনেক ভালোবাসি।
ইফান রেগে গিয়ে ইশিতার গালে শক্ত করে চেপে ধরে
— তুই আমাকে ভালোবাসতিস। আমার পিছনে পাগলের মত ঘুরতি। এখন তুই আমার ভাই কে পেয়ে সব কিছু ভুলে গেলি। সত্যি ই তুই একটা ক্যারেক্টারলেস। তোর মত মেয়ে যখন যাকে পায় তাকেই ফাঁসিয়ে নেয়।
— হ্যা আমি ক্যারেক্টারলেস। আমি আমার স্বামী কে ভালোবাসি। তোর মত অমানুষ কে না। আরে তুই তো একটা পশু। মনে আছে কি ভাবে দিনের পর দিন তুই আমাকে অপমান করেছিস। আমার ভালোবাসা কে অবহেলা করে ফিরিয়ে দিয়েছিস আমাকে। আমি যখন আমার সন্তানের দাবি দিয়ে তোর কাছে যেতাম তখন তুই লাথি দিয়ে আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতি। মনে আছে এসব কথা। এখন তোর ভুল বুঝতে পেরেছিস তাই আমাকে ফিরিয়ে নিতে চাইছিস। যদি কোন দিন তোর ভুল না ভাঙ্গত। ইয়াশ আমাকে বিয়ে না করতো তখন আমার কি অবস্থা হতো এটা ভেবে দেখেছিস কখনও। আমি ক্যারেক্টারলেস হলে তুই নিজে কি?
ইফান ইশিতার কথা শুনে কিছুই বলতে পারলো না। ইশিতা ইফান কে আর এক মিনিট ও সময় না দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল।
চলবে….
সেই তুমি💐
পর্ব -৩২
Samira Afrin Samia
#Nipa
ইশিতা আগে আগে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আজ ইফানের সাথে কথা বলার সময় ইশিতা একটু ও কাঁদেনি এমনকি ভয় ও পায়নি। ইশিতার নিজের ভেতর অনেক টা সাহস এসে গেছে। এখন সে সবার বিরুদ্ধতা করতে পারে। নিজেই নিজের জন্য লড়তে পারে। এই সাহস টা হয়ত ইয়াশ কে পেয়েই হয়েছে। ইয়াশ ইশিতার ভেতর এই সাহস টা তৈরি করে দিয়েছে।
ইশিতা রুম থেকে বের হওয়ার একটু পর পর ইফান ও রুম থেকে বের হয়ে আসে আর রিহা সেটা দেখতে পারে।
— এই ইশিতার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। নাহলে ও আমার থেকে ইফান কে কেড়ে নিবে। আমি এটা হতে দিতে পারি না। ইফান আমার। শুধুই একার আমার।
ইশিতার শরীর টা আজ তেমন ভালো লাগছে না। প্রতি দিনের থেকে আজ একটু বেশি ই দূর্বল লাগছে। তার পর ও ইশিতা দুপুরে রান্না ঘরে গেল।
নাজমা চৌধুরী আজ রাতের ট্রেনেই ভাইয়ের বাড়ি যাবেন। উনার ভাইয়ের শরীর টা নাকি আজকাল ভালো যাচ্ছে না। তাই উনাকে দেখতে যাবেন।
নাজমা চৌধুরী ইশিতার কাছে এসে
— আমি চলে গেলে তুই একা বাসায় থাকতে পারবি তো?
ইশিতা সবজি কাটতে কাটতে
— একা কোথায় মা। তোমার ছেলে আছে। রিহা ইফান সবাই তো বাসায় ই আছে।
— ইয়াশ তো সারা দিন বাসায় থাকে না। অফিসেই পড়ে থাকে সব সময়।
— রিহা তো থাকবে সব সময়
আমার সাথে।
— ওর থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।
ইফান টা আজকাল যা পাগলামি শুরু করেছে। ভয় হয় না জানি কখন কি করে বসে।
— কিছু হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে তোমার ভাইকে গিয়ে দেখে আসো।
— তোকে ও সাথে করে নিয়ে যেতাম। কিন্তু তোর এই অবস্থায় কিভাবে যাবি।
— আরে মা এতো চিন্তা করো না তো। আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি।
নাজমা চৌধুরী রাতের ট্রেনে যাবে তাই সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। বাসায় শুধু রিহা আর ইশিতা। রিহা নিজের রুমে বসে আছে। ভাবছে কি ভাবে ইফান কে নিজের করে পাওয়া যায়।
— ইফান আমি তোমাকে মন দিয়ে পাইনি তো কি হয়েছে। শরীর দিয়ে ঠিকই তোমাকে হাসিল করবো। আমি আমার রূপ দিয়ে তোমাকে নিজের করে নিব। আজ রাতেই আমি তোমার সামনে আমার রূপের জাদু তুলে ধরবো।
— হ্যালো।
— হ্যা বলো।
— আজ কি অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি চলে আসা যায় না।
— কেন। কিছু হয়েছে?
— না এমনি। বাসায় আমি আর রিহা একা আছি তো।
— আচ্ছা আমি চেষ্টা করছি সব কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করার।
— আচ্ছা রাখি তাহলে।
ইশিতা ফোন রেখে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। শরীর টা সত্যিই খুব খারাপ লাগছে।
রিহা পুরো রুম অন্ধকার করে বেশ অনেক গুলো ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে রেখেছে। সব কিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। অন্য রকম একটা সুগন্ধ আসছে রুম থেকে। মাতাল করা গন্ধ।
রিহা একটা নাইটি পড়ে ইফানের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।
ইশিতার শরীর দূর্বল লাগছে তাই শুয়ে ছিল কখন যে চোখ দু’টো লেগে গেছে তা ইশিতা ও জানে না।
ইফান মদ খেয়ে মাতাল হয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে। আজ ইফান এতটাই ড্রিঙ্ক করেছে সোজা হয়ে হাঁটতে ও পারছে সব। দুই তিন বার পড়ে গিয়ে নিয়ে নিজে নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছে। এখানে সেখানে কয়েক বার ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে কোন ভাবে নিজেকে সামলে নেয়।
আজেবাজে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো ইফান। নেশার ঘোরে কি সব যা তা বলছে তা ইফান ও জানে না।
ইফান অনেকক্ষণে নিজের রুমে যায়। রুমে অন্ধকার থাকায় ইফান কিছু দেখতে না পেতে হুংকার দিয়ে
— কে আমার রুম অন্ধকার করে রেখেছে?
তাকে আমি খুন করবো।
এমন ভাবে কথা বলছে ইফান চেষ্টা করে খুব কষ্ট করে কথা গুলো বুঝা সম্ভব হবে। রিহা ইফানের কোন কথাই বুঝলো না।
রিহা এসে ইফান কে ধরে সোজা করে রাখার চেষ্টা করছে।
— কে, কে আমাকে ধরলো?
কার এতো বড় সাহস?
রিহা ইফানের কানের কাছে গিয়ে খুব কষ্ট করে এই বার ইফানের কথা একটু একটু বুঝতে পারলো।
— ইফান আমি।
ইফান রিহার থেকে সরে নিজে টলতে টলতে দাঁড়িয়ে থেকে রিহার দিকে তাকিয়ে
— কে ইশিতা?
নেশার ঘোরেও ইফানের মুখে ইশিতার নাম শুনে রিহা রাগে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
— আমি ওই ইশিতা কে ছাড়বো না। জানে মেরে দিব ওকে।
— কি বললে?
ইফান রিহার কথা বুঝলো না
— কিছু না। তুমি আজ ড্রিঙ্ক করে এসেছো।
ইফান চোখ বড় বড় করে রিহা কে দেখে চেনার চেষ্টা করছে।
— কে তুমি আগে তো তোমাকে দেখিনি।
— এতো ড্রিঙ্ক করো কেন?
আমাকেও চিনতে পারছো না।
রিহা কিরমির করে আস্তে করে বললো।
ইফান হঠাৎ টাল সামলাতে না পেরে রিহার উপর ই পড়ে গেল। রিহা ইফান কে নিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেল। ইফান উপরে আর রিহা নিচে পড়ে আছে।
— ইশিতা তুমি আমাকে
ইফান কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই রিহা ইফান কে উপর থেকে সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইফান কে তুলার চেষ্টা করছে ।
রিহা ইফান কে তুলে বেডে শুইয়ে দিয়ে রুমের আলো জ্বালায়।ইফান মাতাল হয়ে বেঘোরে পড়ে আছে। রিহার রাগে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে। রিহা এতো প্লেন করার পরও ইফান কে কোনো ভাবেই নিজের করে পাচ্ছে না। ইফান তার থেকে প্রতিনিয়ত আরো দূরে সরে যাচ্ছে। আর এসব কিছুর জন্য রিহা ইশিতা কে দায়ী করে।
রিহা ইফানের কাছে গিয়ে। ইফানের পাশে শুয়ে ইফানের গালে হাত বুলাতে বুলাতে
— কি কমতি আছে আমার মাঝে?
কেন তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারো না? কেন বার বার ওই ইশিতার কাছে ফিরে যাও?
একটা বার আমাকে ভালোবেসে দেখো। আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দিব।
রিহা ইফানের হাত রেখে একটু নাড়িয়ে
— কি হলো কথা বলছো না কেন?
ওহ কথা বলবে কি করে তুমি তো এখন ঘুমাচ্ছো।
আচ্ছা ঘুমাও। ঘুমানো অবস্থায় তোমাকে অনেক সুন্দর লাগে।
রিহা ইফানের মুখের কাছে গিয়ে ইফানের ঠোঁটে একটা চুমু খেলো। কিছুক্ষণ পর ইফানের থেকে সরে এসে কপালে গাঢ় করে একটা চুমু দিয়ে ইফান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।
সকালে রিহার আগে ইফানের ঘুম ভেঙে গেল। ইফান চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মাথা টা প্রচন্ড ব্যথা করছে। চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্টে জোর করে মিটমিট করে চোখ মেলে তাকালো। মাথা ঝিমঝিম করছে। ইফান উঠতে নিলে নিজের উপর ভারী কিছু অনুভব করলো। রিহা ইফান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। ইফান নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে রিহা ওর উপর শুয়ে আছে। ইফান সাথে সাথেই রিহা কে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে বেড থেকে উঠে দাঁড়ালো।
রাগে ইফানের গা জ্বলছে। রুমের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো ইফান। ক্যান্ডেল দিয়ে সাজানো।
রিহার এখনও ঘুম ভাঙেনি।
ইফান হেঁচকা টান দিয়ে রিহা কে বেড থেকে নামিয়ে নিয়ে সোজা দাঁড় করিয়ে
— তোর সাহস হয় কি করে আমার সাথে আমার বেডে শোবার।
রিহা এখনও ঘুমে টলছে। ঠিক মত দাঁড়াতে পারছে না।
ইফান রিহার হাত ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে
— তোকে বলেছিলাম আমার সামনে না আসতে পরেও তুই আমাকে পাওয়ার জন্য এসব করছিস।
রিহা ঘুমের ঘোরে
— ইফান হাতে ব্যথা পাচ্ছি। কি করছো। আজকাল কি হলো তোমার?
— ব্যথা পাচ্ছিস?
আচ্ছা আজ তোকে বুঝাবো ব্যথা কাকে বলে। আমি যে টুকু কষ্ট পাচ্ছি। আজ তোকেও ঠিক ততটাই কষ্ট দিব।
আমার কিছুই হয়নি। তুই শুধু আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা তাহলে আমি একদম ঠিক হয়ে যাবো।
— আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। যতটুকু কষ্ট দিতে চাও দিতে পারো। আমি তোমার জন্য পৃথিবীর সব কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করে নিবো।
ইফান শয়তানি হাসি দিয়ে
— ওহ ওকে তাহলে তোর ইচ্ছা টা ই আজ পূরণ হোক। আমিও দেখি আমার জন্য তুই ঠিক কতটা কষ্ট সহ্য করতে পারিস।
ইফান সাথে সাথে ওয়ারড্রব থেকে একটা বেল বের করে। বেলের উপরের একটু অংশ ইফান হাতে পেঁচিয়ে নিলো।
শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে ইফান রিহার শরীরে আঘাত করছে। রিহা কিছু করছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইফানের এতো আঘাত আদৌও রিহার শরীরে লাগছে কিনা, রিহা ব্যথা পাচ্ছে কিনা তা রিহা কে দেখে বুঝা যাচ্ছে না। ইফান এতো দিনের জমিয়ে রাখা সমস্ত রাগ রিহার উপর ঝাড়লো। রিহার সুন্দর শরীরে আঘাতের প্রতি টা দাগ গাঢ় হয়ে ফোঁটে উঠেছে। যেখানে যেখানে আঘাত লেগেছে মনে হচ্ছে এখনই ওই জায়গা ফেটে রক্ত ঝড়তে লাগবে। আঘাতের স্থান গুলো উঁচু হয়ে ফোলে উঠেছে। একজন মানুষ এতটা কষ্ট সহ্য করতে পারে তা রিহা কে না দেখলে বুঝাই যেত না। এতো কিছুর পর ও রিহা মুখ ফোটে একটা শব্দ করছে না। নিরবে ইফানের দেওয়ার সমস্ত কষ্ট, সব আঘাত গুলো সহ্য করে যাচ্ছে। এভাবেই কি ইফান ওর ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছে আর রিহা কি এভাবে ভালোবাসার পরীক্ষা দিচ্ছে?
একসময় ইফান নিজে থেকে ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল। ইফান হাঁপাচ্ছে। কপালে কয়েক বিন্দু ঘাম জমে গেছে। হাত থেকে বেল নিচে ফেলে দিয়ে। ইফান হাঁপাতে হাঁপাতে রিহার দিকে তাকালো। রিহা এখনও ঠিক আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু রিহার চোখ গুলো লাল টকটকে হয়ে গেছে। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল।
রিহা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো
— কি হলো ইফান? থেমে গেলে কেন?
ক্লান্ত হয়ে গেছো এটুকু তে ই।
তুমি মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে কি হবে দেখো আমি কিন্তু মার খেতে খেতে এখনও ক্লান্ত হয়নি।
তোমার যত কষ্ট আছে সব আমার উপর দিয়ে বের করে দেও। তোমার ভিতর লুকিয়ে রাখা কষ্ট গুলোর আমি ও ভাগীদার হতে চাই।
ইফান রিহার কথা শুনে রেগে রিহা কে আবার মারতে আসলে পেছন থেকে কে যেন ইফানের হাত ধরে নেয়।
চলবে…..