সেই তুমি💐
পর্ব -৩৫+৩৬
Samira Afrin Samia
#Nipa
সকালে রিহার ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে পাশে কাউকে পেল না। তবে বেড সাইড টেবিলের উপরে জলপট্টি দেখতে পেল। রিহা মনে করতে লাগলো রাতে তার জ্বর আসছিল আর ইশিতা তার পাশে বসে কিভাবে তার যত্ন নিয়েছে।
এখন অনেকটা ভালো লাগছে রিহার জ্বর ও সেরে গেছে। শরীরে এখনও অনেক ব্যথা। রিহা আস্তে আস্তে বেড থেকে উঠে সিঁড়ির রেলিং ধরে নিচে নেমে এলো। নিচে কেউ নেই। ইশিতা কোথায়? রিহা মনে মনে ইশিতা কে খুঁজছে। কাল রাতের পর থেকে ইশিতার প্রতি রিহার নতুন এক ধারনা তৈরি হয়েছে। আগে রিহা ইশিতা কে সম্পূর্ণ ভাবে ভুল চিনতো। কাল সারা দিন রিহা অসুস্থ থাকায় ইশিতা কে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সত্যি ই একটা মানুষ কে কাছে থেকে না দেখলে কখনও বুঝা যায় না সে কেমন।
রিহা হাঁটতে হাঁটতে কিচেনে চলে গেল। ইশিতা রান্না করছে ইয়াশ আজ সকালের ফ্লাইটে ই চলে যাবে। ইশিতা রিহা কে দেখে
— রিহা তুমি নিচে আসলে কেন? কিছু লাগবে?
আমাকে ডেকে বলতে আমি তোমার কাছে যেতাম।
রিহা কিছু না বলে ইশিতার পাশে এসে দাঁড়ায়। ইশিতা কাজে ব্যস্ত হয়েই রিহার সাথে কথা বলছে।
— এখন কেমন আছো?
শরীর ঠিক লাগছে তো?
জ্বর কমেছে নাকি এখনও আছে?
— আমি ঠিক আছি। জ্বর নেই এখন।
— আচ্ছা তাহলে তুমি রুমে যাও। আমার রান্না শেষ হয়ে গেলে আমি তোমাকে ডেকে নিব।
ইশিতা খুব তাড়াতাড়ি করে সব কাজ করছে।
— তুমি নিচে এসে খাবে নাকি আমি খাবার তোমার রুমে নিয়ে যাবো?
রিহা এবার ইশিতার হাত ধরে ইশিতা কে সোজা দাঁড় করিয়ে
— কিছু কথা ছিল তোমার সাথে। একটু চুপ করে শান্ত হয়ে দাঁড়াবে।
আজ রিহা এই প্রথম ইশিতা কে তুমি করে বললো। আর ইশিতার সাথে কোন কথা বলতে চাইলো তাও এতো ভালো করে। ইশিতা মনে মনে হাসলো।
— এখন তো কোন কথা শুনতে পারবো না। আসলে তোমার ভাইয়া আজকের সকালের ফ্লাইটে ই দেশের বাইরে চলে যাবে। অফিসের কিছু কাজের জন্য সপ্তাহ কয়েক থাকবে। তাই ওর জন্য ই এতো রান্না হচ্ছে।
— ওহ তাহলে আমিও তোমার সাথে হাতে হাতে কিছু কাজ করে দেই। আমি তো কাজ তেমন পারি না। আমি তোমাকে এটা সেটা এগিয়ে দেই?
— তোমার কিছুই করতে হবে না। আমি একাই পারবো। আর তাছাড়া তোমার শরীর ভালো না। তুমি অসুস্থ। তুমি গিয়ে রেস্ট নেও।
— আরে না আমি পারবো। তুমি শুধু আমাকে বলো আমার কি কি করতে হবে।
ইশিতা মনে মনে অনেক খুশি। সে যেন আজ নতুন কোন রিহা কে দেখছে। এই রিহার সাথে তার আগে পরিচয় ছিল না। ইশিতা কখনও রিহা কে এমন করে দেখে নি। শুধু ইশিতা কেন কেউই দেখি নি হয়ত।
ইফান রুমে সব কিছু গুজগাজ করছে। নিজের যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও ইশিতার জোরে যেতে হচ্ছে। ইশিতা চায় না তার জন্য ইয়াশের বিজন্যেসের কোন হ্মতি হোক।
নাজমা চৌধুরী বাসায় নেই তাই উনিও ইয়াশ কে এখন বাসা থেকে কোথাও যেতে না করছিল। ইশিতা নাজমা চৌধুরী কে ও বুঝায়। অনেক বলার পর নাজমা চৌধুরী রাজি হয়। ইয়াশ আজ চলে গেলে ইশিতা বাসায় পুরো একা হয়ে যাবে। রিহা আছে ইফান ও আছে। কিন্তু তাদের থাকায় ইয়াশের আরও বেশি চিন্তা। ইফান রিহা ইশিতার সাথে যেকোন সময় যে কিছু একটা করে ফেলতে পারে।
নাজমা চৌধুরী আজ আসতে না পারলেও কাল ঠিক চলে আসবে যেভাবেই হোক।
ইশিতা রুমে এসে দরজার সামনে থেকেই বলতে লাগলো
— তোমার ফ্লাইট কয় টায়?
বাসা থেকে কখন বের হবে? এখনও কি করছো তুমি?
ইশিতা ইয়াশের কাছে এসে দাঁড়ালে ইয়াশ ইশিতা কে কাছে নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়।
— না গেলে হয় না?
— যাওয়ার সময় এটা কেমন কথা?
— ইচ্ছে হচ্ছে না তোমাকে একা রেখে যেতে। কেনই যেন মন বলছে তোমাকে একা রেখে না যেতে।
ইশিতা ইয়াশের হাতে আলতো করে হাত রেখে
— কি হয়েছে হুম?
এতো টেনশন কেন? কিছু দিনের ই তো কথা। তুমি একদম চিন্তা করো না আমাকে নিয়ে। মা কাল চলে আসলে তার পর তো আমি আর একা থাকবো না তাই না?
— জানি না কিছু ভালো লাগছে না। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।
— এতো চিন্তা করলে এমনই হবে।
এখন চলো খেয়ে তোমাকে আবার বের হতে হতে। তা নাহলে ফ্লাইট মিস করে যাবে।
— ইশিতা?
— হুম।
— আমি চলে গেলে তোমার একা থাকতে কষ্ট হবে না?
— কষ্ট কিসের তুমি কি একে বারের জন্য চলে যাচ্ছো নাকি?
কিছু দিনের ই তো ব্যাপার। তার পর তো কাজ শেষ করে চলেই আসবে। আর তাছাড়া তুমি তো আমাদের ফিউচারের কথা ভেবেই এতো কাজ করছো। আমাদের পুচকো টা কে ভালো একটা লাইফ গিফট করার জন্য ই তো এতো কিছু।
কথা গুলো বলার সময় ইশিতার বুক ফেটে যাচ্ছিল। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল। বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল তুমি যেও না, তুমি চলে গেলে যে আমি বড্ড একা হয়ে যাবো।
ইশিতার দু’চোখ ভরে পানি আসছিল। অনেক কষ্টে ইশিতা নিজের কান্না থামালো। ইয়াশ এখন ইশিতা কে কাঁদতে দেখছে কোথাও যাবে না। দেশের বাইরে তো দূর বাসা থেকে এক পা ও বের হবে না।
ইয়াশের দু’চোখ লাল হয়ে আছে। ইশিতা কে ছেড়ে যেতে ইয়াশের একদম ই ইচ্ছে হচ্ছে না।
ইয়াশ চলে গেল। গাড়ি নিয়ে ড্রাইভারে সাথে এয়ারপোর্টের উদেশ্যে রওনা দিলো। ইয়াশ চলে যাওয়ার পর ইশিতা সমানে কেঁদে যাচ্ছে। ইয়াশ কে নিজের থেকে দূরে যেতে দিয়ে ইশিতার ও ভালো লাগছে না। ইয়াশের বিজন্যেস প্রায় সব টা ই বিদেশে। দেশে কয়েকটা কোম্পানি আছে তবে বেশির ভাগ কোম্পানি দেশের বাইরে ই। আগে ইয়াশ প্রায় সময় ই দেশের বাইরে থাকতো।বিকেলে রিহা ইশিতার কাছে আসে। ইশিতা শুয়ে আছে। রিহা রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে জিঙ্গেস করলো
— ইশিতা আসবো?
ইশিতা উঠে বসে
— হ্যা রিহা আসো।
রিহা রুমের ভেতর এসে ইশিতার কাছে বসলো
— তুমি এখানে কিছু লাগবে?
— না। এমনিতে কি আমি তোমার রুমে আসতে পারবো না?
— তা না।
— তুমি কাঁদছিলে?
ইশিতা ফ্যাকাশে হাসি দিয়ে
— কই না তো।
— তাহলে তোমার চোখ লাল হয়ে আছে কেন? আর চোখ ফোলা ফোলা ও লাগছে।
ইশিতা কি বলবে তা ভেবে না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু বলতে গেলে
— আচ্ছা থাক আমার সাথে আর মিথ্যে কথা বলতে হবে না।
আমি জানি তুমি কাঁদছিলে। আর তাই চোখ লাল হয়ে ফোলে গেছে।
— তুমি এখন কেমন আছো?
— ভালোই। ইশিতা?
— হ্যা বলো।
— তুমি আমার সাথে কথা বলছো। এতে তোমার কোন রকম খারাপ লাগছে না?
— খারাপ লাগবে কেন?
— আমি তোমার সাথে
ইশিতা রিহা কে থামিয়ে দিয়ে
— রিহা যা ঘটে গেছে তা মনে রাখার কোন মানে নেই। আমরা সবাই সবার জীবনে অনেক টা আগে চলে গেছি। এখন পিছনে তাকিয়ে দেখলে আমাদের ই কষ্ট হবে।
— আমি কারো কাছে কখনও হ্মমা চাইনি। আমার হাজার ভুল হলেও না। আজ কেনই যেন খুব ইচ্ছে করছে তোমার কাছে একবার হ্মমা চাই।
— এসব কি কথা রিহা।
— তোমার মত মানুষ খুব কম হয়। তোমার সাথে আমি যা যা করেছি আমার সাথে কেউ এমনটা করলে আমি তো তাকে মার্ডার করতাম। কখনও হ্মমা করা তো দূর আমি যেকোন মূল্যে তার জীবনের সব সুখ কেড়ে নিতাম।
— রিহা সবাই ভুল করে কেউ বড় কোন ভুল করে আবার কেউ ছোট ভুল করে। আমাদের সবার দ্বারা ই ভুল হয়ে থাকে।
তবে একটা কথা কি জানো সবাই কিন্তু নিজের ভুল স্বীকার করে নেয় না। যারা ভুল করে ভুল স্বীকার করে তাদেরকে কি আমাদের হ্মমা করে দেওয়া উচিত না?
— আমি তো কখনও ই আমার ভুল স্বীকার করিনি। তার পর ও তুমি আমার জন্য কত কিছু করলে।
— তুমি মুখে তোমার ভুল স্বীকার করো নি তা ঠিক। তবে মনে মনে ঠিকই কষ্ট পেয়েছো। তোমার ভুলের জন্য তুমি অনুতপ্ত হয়েছো।
— সত্যি ই ইশিতা তোমার মত কেউ হতে পারবে না। আমি হাজার বার জন্ম নিলেও তোমার মত হতে পারবো না।
তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি নিজে একটা মেয়ে হয়ে তোমার সাথে যা করেছি তার জন্য আমার কোন হ্মমা নেই আমি তা জানি।
— ওসব কথা এখন বাদ দেও। এখন তো তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে হ্মমা চাইতে আসছো এটাই অনেক।
রিহা আজ সত্যি সত্যি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। ও ইশিতার সাথে কতটা খারাপ কাজ করেছে তা আজ উপলব্ধি করতে পারছে। নিজের এই ভুলের জন্য রিহা হয়ত কখনও নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তবে ইশিতা যে তাকে হ্মমা করে দিয়েছে এটা ভেবেই রিহা সস্তি পাচ্ছে।
ইয়াশ ঠিকঠাক পৌঁছে গেল। গিয়ে ইশিতা কে ফোন করেছে। নাজমা চৌধুরী পরের দিনই চলে আসার কথা ছিল। কিন্তু আসতে পারে নি। উনার ভাই অনেক অসুস্থ বাঁচবে না হয়ত। ইশিতা এসব শুনে নাজমা চৌধুরী কে এখন আসতে বারণ করে দিয়েছে। রিহা আগের থেকে অনেক ভালো হয়ে গেছে। ইশিতা মাঝে মাঝে রিহা কে দেখে চিন্তা করে এটা কি সেই আগের রিহা?
ইশিতা প্রেগন্যান্ট, আট মাস চলছে। রিহা ইশিতার অনেক খেয়াল রাখে। এমন ভাবে সব সময় ইশিতার কাছে থেকে ওর খেয়াল রাখে মনে হয় রিহা ওর মায়ের পেটের বোন। মানুষ ভুল করে সেই ভুল টা শোধরে নিতে পারে কয়জন?
রিহা তার ভুল শোধরে নিয়েছে।
এভাবে দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ হয়ে গেল। নাজমা চৌধুরী এখন আসতে পারলেন না। কারণ উনার ভাই মারা গেছেন। ভাবী আর ভাইয়ের ছোট ছোট তিন টা সন্তান কে রেখে আসবে কি করে?
ইফান এই এক সপ্তাহ বাসায় আসেনি। কোথায় ছিল তা কেউ খোঁজ নেয়নি। আজ নিজে থেকেই ইফান বাসায় এসেছে।
বাসায় এসে কাউকে কিছু না বলে সোজা নিজের রুমে চলে যায়।
ইশিতা আজ একটু অসুস্থ। দুপুর থেকেই পেট ব্যথা করছে। রিহা ইশিতা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
— ইশিতা আমি ডক্টর ডাকি?
— ডক্টর ডাকতে হবে না। একটু ব্যথা এমনিতেই থেমে যাবে।
— বাসায় কেউ নেই। তোমার কিছু হলে আমি একা একা কিছুই করতে পারবো না।
এক কাজ করি ইফান কে কল করে দেখি ও কোথায় আছে।
— না রিহা তুমি ইফান কে কল করে বাসায় আসতে বললে ও এসে আরও ঝামেলা করতে পারে।
ইশিতা কিরমির করে চুপ থেকে ব্যথা সহ্য করছে। হঠাৎ করে এটা কিসের ব্যথা হলো ইশিতা তা ই বুঝতে পারছে না।
রাত প্রায় এগারোটা ইশিতার পেট ব্যথা একটু কমেছে। রিহা ইশিতা কে কোন ভাবে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে আসে। রুমে এসে দেখে রুমের লাইট অফ করা রিহা তো লাইট অফ করে যায়নি। তাহলে কেউ আছে নাকি রুমে। রিহা এসব ভাবতে ভাবতে রুমের লাইট অন করে দেখে ইফান বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।
ইফান এতো দিন পর হঠাৎ করে কোথায় থেকে আসলো। ইফান কে দেখে রিহার চোখ আনন্দে ঝলমল করতে লাগলো।
ইফান তখনও পুরোপুরি ঘুমায় নি। তবে চোখ লেগে এসেছিল। ঘুম ভর করে এসেছিল চোখের পাতায়। হঠাৎ রিহা রুমের লাইট অন করায় ইফানের কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। ইফান কে বলে রেগেমেগে বেড থেকে উঠে এসে
— তোর সমস্যা কি?
আমি ঘুমাচ্ছিলাম এটা তোর সহ্য হলো না। তুই আমাকে একটু ও শান্তিতে বাঁচতে দিবি না।
চলবে…..
সেই তুমি💐
পর্ব -৩৬
Samira Afrin Samia
#Nipa
— ইফান এসব কেন বলছো?
আমি তো তেমন কিছুই করিনি।
ইফান হাসতে লাগলো
— তুই কিছু করিস নি?
কি করে পারিস তুই এসব কথা বলতে। আমার জীবনে এ পর্যন্ত যা যা হয়েছে তা সবই তো তুই করেছিস।
— ইফান আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আর এজন্য আমি ইশিতার কাছে হ্মমা ও চেয়েছি। ইশিতা আমাকে হ্মমা করে দিয়েছে।
— সত্যি তুই তোর ভুল বুঝতে পেরেছিস?
তাহলে তো এটাও বুঝে গেছিস। ইশিতা কে ভুল বুঝে আমি তোকে বিয়ে করেছি। তোর বাবা আমাকে এক প্রকার জোর করে বাধ্য করেছে তোকে বিয়ে করার জন্য।
এখন যেহেতু তোর ভুল ভেঙে গেছে তাহলে তুই আমাকে ছেড়ে চলে যা। আমি ইশিতা কে এখনও ভালোবাসি। আমি ইশিতা কে আমার বাচ্চা কে ফিরে পেতে চাই।
— ইফান ইশিতা তোমাকে ভালোবাসে না। ইশিতা ইয়াশ ভাইয়ার সাথে অনেক সুখে আছে। তুমি আর তাদেরকে ডিস্টার্ব করো না। ইশিতা কে ইশিতার মত ছেড়ে দেও।
রিহা কথা শেষ করার সাথে সাথে ইফান রিহা কে চড় মারে।
— ইশিতা আমাকে ভালোবাসে না সেটা শুধু তোর জন্য।
ইশিতা আমাকে ভালোবাসে না বলে তুই আমাকে ইশিতা কে ছেড়ে দিতে বলছিস।
তাহলে আমি যে তোকে ভালোবাসি না,এখন তুই কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?
রিহা কিছু বলতে পারছে না শুধু কেঁদে যাচ্ছে। তার ভুলের জন্য ইফান তাকে কখনও হ্মমা করবে না।
— যা হয়ে গেছে তাকে কি হাজার চেষ্টা করে ও পাল্টানো যাবে?
— কেন পাল্টানো যাবে না। তুই ইশিতা কে বলবি যা হয়েছে আমি ইশিতার সাথে যা যা করেছি তার জন্য তুই দায়ী। বলবি ইশিতা যেন আবার আমার কাছে ফিরে আসে।
— এটা সম্ভব না ইফান। তুমি কেন বুঝতে চাইছো না।
তুমি যেটা কে ভালোবাসা বলছো সেটা কি আদৌও ভালোবাসা?
তুমি যদি সত্যিকারে ইশিতা কে ভালোবাসতে তাহলে ওকে বিশ্বাস না করে আমার কথা বিশ্বাস করতে না।
ইফান রিহা কে মারতে এসেও থেমে গেল।
— তোকে ফ্রেন্ড ভেবে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করেছিলাম। যদি জানতাম তুই আমার বিশ্বাসের যোগ্য না। তোকে বিশ্বাস করা আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল তাহলে কখনও ই আমি তোকে নিজের ভালোবাসা থেকে বেশি প্রাইওরিটি দিতাম না।
রিহা তার ভুলের জন্য সত্যি ই অনুতপ্ত। তার পরও রিহা যা করেছে তার জন্য তাকে কোন দিনও হ্মমা না করাটাই স্বাভাবিক। রিহার তো ইফানের কাছে হ্মমা চাওয়ার ও কোন যোগ্যতা নেই।
— তোর জন্য এখন আমার সন্তান আমার পরিচয়ে জন্ম নিবে না। আমি তার মুখ থেকে কোন দিনও বাবা ডাক শুনতে পারবো না। সে কখনও জানবে না আমি তার আসল বাবা।
যেভাবেই হোক আমি ইশিতা কে আবার ফিরিয়ে আনবো। আমার সন্তান কে আমার পরিচয়ে বড় করবো। এর জন্য আমাকে যা যা করতে হবে আমি তাই তাই করবো।
রিহা ইফানের কথায় কিছু উত্তর দিচ্ছে না। নিরবে শুধু কেঁদে যাচ্ছে। রিহা কে কাঁদতে দেখে ইফান আরও রেগে গেল।
— বন্ধ কর তোর ন্যাকা কান্না। এই কান্না শুধুই তোর নাটক আমার মন গলানোর জন্য। আমি তোকে খুব ভালো করে চিনি। তুই নিজে কখনও কাঁদিস না। অন্য কে কাঁদাস তুই। অন্য কে কষ্ট দিয়ে কাঁদাতে তুই আনন্দ পাস।
ইফান রিহা কে রুম থেকে বের করে দিয়ে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো। রিহা কাঁদতে কাঁদতে দরজা ঘেসে নিচে বসে পড়লো। সারা রাত রিহা রুমের সামনে বাইরে ই বসে থাকলো। কাঁদতে কাঁদতে রিহা কখন এখানে বসেই ঘুমিয়ে গেল তা খেয়াল নেই।
সকালে ইশিতা এসে রিহা কে ঘুম থেকে তুলে।
— রিহা এই রিহা।
ইশিতা কয়েক বার ডাক দিলে রিহার ঘুম ভেঙে যায়। রিহা ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে
— ইশিতা তুমি?
— হুম আমি।
তুমি এখানে কি করছো?
রুমের বাইরে বসে ঘুমিয়ে আছো কেন? ভেতরে কে?
সারা রাত কি এখানেই ছিলে?
রিহা কিছু বলার আগে ইফান দরজা খুলে বের হয়ে আছে।
ইশিতা ইফান কে দেখে সব কিছু বুঝে গেল। রিহার আর কিছু বলতে হলো না।
— আসলে ইশিতা
— থাক রিহা। যা বুঝার আমি বুঝে গেছি। আর কিছু বলতে হবে না।
ইফান ইশিতা কে কিছু বলতে চাইলে ইশিতা ইফান কে বাঁধা দিয়ে
— আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না। তোমার সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধছে।
তুমি এতটা নিচ তা আমার ভাবতেও অবাক লাগছে।
রিহা তোমাকে ভালোবাসে। কেন তুমি ওকে কষ্ট দিচ্ছো। কেউ ভুল করলে তাকে কষ্ট না দিয়ে হ্মমা করে দেওয়া উচিত।
— তাহলে তুমি আমাকেও হ্মমা করে দেও। আমি ও তো আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।
— আমি তোমাকে অনেক আগেই হ্মমা করে দিয়েছি।
— হ্মমা করে দিয়েছো। তাহলে আমার কাছে কেন ফিরে আসছো না। কেন ভাই কে এখনও ডিভোর্স দিচ্ছো না।
— তোমার মাথা ঠিক নেই।
তুমি কি বলছো তা বুঝতে পারছো না। আমি তোমাকে হ্মমা করে দিয়েছি তার মানে এই না আমি ইয়াশ কে ডিভোর্স দিবো। আর তোমার কাছে ফিরে যাবো।
— তুমি আমার কাছে ভালো ভাবে ফিরে আসতে না চাইলে ও আমি তোমাকে আমার করে নিব।
— তোমার যা ইচ্ছে হয় তুমি তাই করতে পারো।
— তোমাকে না পেলেও আমি আমার সন্তান কে আমার কাছে নিয়ে আসবো।
ইশিতা এবার ইফানের কথা শুনে জোরে চিৎকার করে উঠলো
— ইফান।
— আমার সন্তান কে আমার কাছে নিয়ে আসলে তখন তুমি বাধ্য হয়ে বাচ্চা টার জন্য আমার কাছে আসবে।
— তুমি এমন কিছুই করতে পারবে না।
— তাহলে দেখ ই না। এই ইফান কি কি করতে পারে।
আজকাল ইশিতার ভিষণ ভয় হয়। ইফান ঐদিন যা বলেছে তা যদি ও করে দেখায় তাহলে ইশিতা কি করবে। ইফান যদি সত্যি ই বাচ্চা টা কে তার কাছে নিয়ে যায়। ইশিতা তার বাচ্চা ছাড়া কি করে বাঁচবে?
নিজের থেকে নিজের বাচ্চা কে কিছুতেই আলাদা হতে দিবে না ইশিতা।
ইয়াশ বাইরে আছে। বাসায় যা হচ্ছে এসব ব্যাপারে কিছুই জানে না। ইশিতা ইয়াশ কে কিছু জানায়নি। ইয়াশ এসব শুনলে শুধু শুধু চিন্তা করবে।
ইয়াশ বাইরে গেছে এক সপ্তাহ হয়ে গেল। আর কিছু দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারলে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।
আজ নাজমা চৌধুরী বাসায় ফিরে আসবেন।
ইয়াশ সকাল থেকে ফোন করেনি। ইশিতার মন আনচান করছে। প্রতি দিন তো এই সময়ের মধ্যে হাজার বার ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়। এটা সেটা কত কিছু বলে ইশিতা কে শাসন করে।
ইশিতা একবার চিন্তা করছে। আবার নিজেই নিজেকে বুঝাচ্ছে। হয়ত আজ কাজ অনেক তাই ফোন দিতে পারছে না। কাজ শেষ হলে ঠিকই ফোন দিবে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। ইশিতা দুপুরে খেয়ে রুমে এসে একটু ঘুমিয়ে গেছিল। এখন ঘুম ভাঙলে ওয়াশরুমে গেল চোখে মুখে পানি দেওয়ার জন্য।
ইশিতা চোখ পানি দিতে দিতে আয়নায় তাকিয়ে ইয়াশের কথা ভাবছিল। কি হলো ইয়াশের সারা দিনে একবার ও কল করলো না। ইশিতার খোঁজ নিলো না। ইয়াশ ঠিক আছে তো। বলতে বলতেই ইশিতার ফোন বেজে উঠলো। ইশিতা বেডের উপর ফোন রেখে এসেছিল। মনে হয় ইয়াশ ফোন করেছে। ইয়াশ কে ছাড়া এসময় আর কে ফোন করবে। ইশিতা ব্যস্ত হয়ে তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুম থেকে বের হতে গেলে কিভাবে যেন পা পিছলে নিচে উপুড় হয়ে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ইশিতা মা গো বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
বাসায় কেউ নেই। শুধু রিহা আছে। রিহা কি ইশিতার চিৎকার শুনতে পেয়েছে?
ইশিতা পড়ে যাওয়ার পর পেটে প্রচন্ড ভাবে আঘাত লাগে। ইশিতা পেটে হাত দিয়ে কুঁকড়ে জোরে জোরে চিৎকার করছে। পুরো ফ্লোর রক্তে বেসে যাচ্ছে। চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার দেখছে ইশিতা। কতটা কষ্ট হচ্ছে তার পরিমাপ করা যাবে না। এই মুহূর্তে ইশিতার শুধু একটাই ভয় হচ্ছে ওর বাচ্চার কিছু হবে না তো। ওর বাচ্চা ঠিক আছে তো? সব কষ্ট সহ্য করে ইশিতা নিজের বাচ্চার কথা চিন্তা করে প্রানপন চেষ্টা করছে উঠে দাঁড়াতে। তবে ইশিতা কোন ভাবেই নিজেকে তুলে দাঁড় করাতে পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছে না ইশিতা।
রিহা নিজের রুমেই বসে আছে। ইফান কে নিয়ে ভাবছে। ইফান কি কখনও রিহা কে হ্মমা করবে না? রিহা তো তার ভুল বুঝতে পেরেছে। সে যা করেছে তা অন্যায় কিন্তু কেউ তার অন্যায় স্বীকার করলে তো তাকে হ্মমা করে দেওয়া উচিত তাকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।
এসব ভাবতে ভাবতেই রিহার মনে হলো ইশিতা তাকে ডাকছে। আর ইশিতার কষ্ট স্বাভাবিক শুনাচ্ছে না।
— ইশিতা কি সত্যিই আমাকে ডাকছে নাকি আমার মনের ভুল?
রিহা আবার শুনতে পেল ইশিতা ইয়াশের নাম ধরে ডাকছে।
— আচ্ছা ইশিতা তো জানে ইয়াশ ভাইয়া বাসায় নেই তাহলে শুধু শুধু কেন ভাইয়া কে ডাকতে যাবে?
ইশিতা সত্যি ই ইয়াশ কে ডাকছে। এখন এই সময় ইয়াশে ই ইশিতা খুব করে পাশে চাইছে। ইয়াশ কে ছাড়া নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছে।
— না দেখেই আসি। ইশিতার কি হলো কেন ভাইয়া কে ডাকছে।
রিহা ইশিতার রুমের দিকে যতই এগুচ্ছে ততই তার মনে অজানা একটা ভয় কাজ করছে। ভয় করার কারণ হলো ইশিতা অস্বাভাবিক ভাবে একবার ইয়াশ কে ডাকছে আরেক বার রিহা কে ডাকছে। নয়তো মাঝে মাঝে মা,মা বলে চিৎকার করছে।
— ইশিতার কিছু হলো না তো? ইশিতা ঠিক আছে নাকি
রিহা আর কিছু ভাবতে না পেরে দৌঁড়ে ইশিতার রুমে আসে। রুমে কোথাও ইশিতা নেই।
— ইশিতা কোথায় তুমি?
রিহার কন্ঠ শুনতে পেয়ে ইশিতা মনে হয় নতুন করে জীবন ফিরে পেল। ইশিতা রিহা বলে ডেকে উঠলো। রিহা ওয়াশরুম থেকে ইশিতার কথা শুনতে পেয়ে দৌঁড়ে গেল। রিহা ইশিতা কে নিচে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখে ইশিতা বলে চিৎকার দিয়ে ইশিতার পাশে গিয়ে বসলো।
— কি হয়েছে তোমার এ অবস্থা কি করে হলো তোমার?
রিহা ও অনেক ভয় পেয়ে গেল। ওয়াশরুম রক্তে লাল হয়ে গেছে। ইশিতা পেটে হাত দিয়ে কুঁকড়ে আছে।
— রিহা আমার বাচ্চা।
ইশিতা শুধু আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চা বলে কেঁদে যাচ্ছে।
— কিছু হবে না তোমার। আর তোমার বাচ্চার ও কিছু হবে না। আমি আছি তো।
— আমার বাচ্চা।
— আমি আছি তো তোমার পাশে। দেখো আমি তোমাদের কারোর ই কিছু হতে দিব না।
রিহা কি করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। ইশিতা কে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। তবে একা একা কি করে ইশিতা কে হসপিটালে নিয়ে যাবে। বাসায় কেউ নেই কার কাছে সাহায্য চাইবে। এদিকে ইশিতা ব্যথায় এখনও চিৎকার করে যাচ্ছে। যেভাবে ব্লিডিং হচ্ছে এতে ইশিতার বাচ্চা ঠিক আছে তো?
রিহা কিছু বুঝতে না পেরে ইফান কে ফোন করে। অনেক বার রিং হয় কিন্তু ইফান ফোন তুললো না।
— এভাবে বেশিক্ষণ ইশিতা কে রাখা যাবে না। তাহলে ওর আর ওর বাচ্চা দু’জনের ই হ্মতি হতে পারে।
চলবে…..