সেই তুমি ৩ পর্ব ১৭+১৮

#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_১৭
#Tabassum_Kotha

সাদা বিছানা চাদরে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। বিছানার এক পাশে তুর্য ঘুমিয়ে আছে। অন্য পাশে হীর গুটিয়ে বসে আছে। একটু আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। সারারাত মরার মতো পরে থাকার পর ভোর রাতের দিকে তার চোখ লেগে যায়। কিন্তু কিছু সময় পর পুনরায় তুর্যর স্পর্শে আতকে উঠে হীর। যদিও তুর্য ঘুমের ঘোরে তাকে জরিয়ে ধরেছিল তবুও তুর্যর স্পর্শে ভয়ে কেঁপে উঠে সে। কাল রাতের ঘটনা যদি দুঃস্বপ্ন হতো তাহলে হয়তো মন্দ হতো না। হীর ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে সারা শরীরে। তুর্য যে এতোটা অমানবিক নির্যাতন করবে তার উপর এটা হীর ভাবতে পারে নি। অবশ্য তুর্যর কাছে এসব নতুন কিছু না। এর আগেও তুর্যর এমন ভয়াবহ রূপ হীর সহ্য করেছে। তবে এবার নির্যাতনের ধরণ টা ভিন্ন।

আগের বার তুর্যর আঘাত শুধু শরীরে ব্যথা দিয়েছিল। কিন্তু এবার তার আঘাত আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তুর্য আমার সাথে জোর জবরদস্তি করলেন! কিভাবে পারলেন সে এটা করতে!
ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখছি। সারা শরীরে কামড় আর আঁচড়ের দাগ। খামচি দেওয়া জায়গাগুলো তে রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে। একটা মানুষ যে এতোটা নিচ হতে পারে সেটা আমার জানা ছিল না। ঝর্ণার পানি শরীরে পরাতে ক্ষতস্থানে আরও বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে। শত যন্ত্রণা উপেক্ষা করে হলেও পুরো শরীর ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। তুর্যর কোনো স্পর্শ আমার শরীরে লেগে থাকুক সেটা আমি কখনোই চাইবো না।
প্রায় একঘন্টার মতো সময় নিয়ে শাওয়ার শেষ করে নিলাম।তুর্য এখনও ঘুমিয়ে আছেন। কুম্ভকর্ণও হয়তো এর থেকে কম ঘুমায়। আমার জীবন থেকে শান্তি কেড়ে নিয়ে সে দিব্বি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছ। এটা আমি হতে দেবো না।

বেড সাইড টেবিলে রাখা পানির বোতলটা হাতে নিয়ে তুর্যর মুখে পানি ঢেলে দিলাম। আচমকা চোখে মুখে পানি এসে পরায় চমকে উঠে তুর্য।
— বৃষ্টি হচ্ছে! বৃষ্টি হচ্ছে! হীর গ্লাস ক্লোজ করো।

— ক্লোজ করা চোখ জোড়া খুলে দেখেন। বৃষ্টি নয় টর্নেডো দাঁড়িয়ে আছে আপনার সামনে।

— ওভাবে সঙ এর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? আর আমার উপর পানি ছুড়ে দিলে কেনো?

হঠাত্ তুর্যর কথার সুর কেমন বদলে গেলো মনে হচ্ছে। কাল রাতে কতোটা বাজে ছিল এখন আবার এতো সুইট করে কথা বলছেন। মতলব টা কি তোর বেটা খচ্চর?

— তুমি এইমাত্র শাওয়ার শেষ করলে বুঝি!

— হ্যাঁ তো!

— না মানে তোমার ভেজা চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি মেঝেতে পরছে।

— নেশা টেশা করেছেন বুঝি?

— তুমি নিজেই তো একটা আস্ত নেশা! তোমাকে দেখলেই নেশা ধরে যায়।

তুর্যর কথায় আমার কান দিয়ে গরম ধোয়া বেরুচ্ছে।
— এসব কি বলছেন?

— কিছু না। কাছে এসো। শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।

— তো আমি কি করবো!

— তোমাকে জরিয়ে ধরলে আমার ক্লান্তি চলে যাবে।

তুর্যর কথায় আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। সত্যি মনে হয় ঘুমের ঘোরে নেশা করেছেন। আমি কাছে না আসাতে তুর্য নিজেই আমার হাত ধরে হেচকা টান দিলেন। টাল সামলাতে না পেরে তুর্যর কোলে গিয়ে পরলাম। তুর্য আমার চুলগুলো সরিয়ে তার ঠোঁট জোড়া আমার দিকে এগিয়ে আমার ঠোঁটে চেপে ধরলেন। কি বিশ্রি পরিস্থিতি। কেনো তাকে উঠাতে গেলাম। নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারা যাকে বলে। এই লোকটার শক্তির সাথে পেরে উঠা আমার পক্ষে কখনই সম্ভব হবে না।

হঠাত্ দরজায় টোকা পরলে তুর্য কে সরিয়ে উঠে পরলাম।
দরজায় কিয়ারা দাঁড়িয়ে আছে। এমন সাত সকালে তুর্যর ঘরে আসার তার একমাত্র উদ্দেশ্য হীর আর তুর্যর মধ্যে কি চলছে সেটা জানা। বন্ধ দরজার ওপাশে তুর্য আর হীর এর মধ্যে কি হচ্ছে এই চিন্তায় কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি সে। এতোদিন তুর্য কে একা ছেড়ে সে বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে। এখন সেই ভুল টা পুনরায় রিপিট করতে চায় না। দরজা খুলতেই কিয়ারার বুকটা মুচড়ে উঠে। হীর এর শাড়ির আঁচল ঠিক নেই। তবে কি তুর্য সম্পূর্ণ ভাবে হীর এর হয়ে গিয়েছে? না এটা হতে পারে না। তুর্য শুধু তার।

— কিয়ারা তুমি? এতো সকালে? কিছু প্রয়োজন ছিল?

হীর এর ডাকে কিয়ারার ধ্যান ভাঙে।
— মামি তোমাকে আর তুর্য কে নিচে যেতে বলেছেন। অনেক কাজ আর মামি একা সামলাতে পারছে না।

— ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।

কিয়ারা যেতে নিলে হীর পিছন থেকে আবার ডাকে।
— কিয়ারা।

— হ্যাঁ?

— তুর্য তোমার বড়। তাই তাকে নাম ধরে না ডেকে ভাইয়া বলে ডাকবে কেমন। আর আমি সম্পর্কে তোমার ভাবী,, তুর্যর ওয়াইফ।

হীর এর কথায় কিয়ারার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তুর্য কে সে কখনোই ভাইয়ের চোখে দেখে নি। তার থেকে বড় কথা হীর তুর্যর উপর অধিকার জমাচ্ছে যেটা তার মোটেও ভালো লাগছে না।

কিয়ারা চলে গেলে হীর আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। তুর্য অবাক হয়ে হীর কে দেখছে।
— ওভাবে কি দেখছেন?

— আর ইউ ফিলিং প্রটেকটিভ টুওর্ডাস মি?

— এ্যা! প্রটেকটিভ তাও আবার আপনাকে নিয়ে! হা হা হা। ভেরি ফানি!

— তোমার কি হিংসে হয় কোনো মেয়ে আমার কাছে এলে?

— না একদমই না। আপনার কাছে মেয়েরা আসুক বা আপনি মেয়েদের কাছে জান। আমার তাতে কিছুই আসে যায় না।

— সত্যি?

— হ্যাঁ সত্যি।

— ভেবে বলছো তো? কাল জেসিকা ফোন করেছিল। যেতে বলেছে।

জেসিকার নাম শুনে হীর রেগে আগুন হয়ে যায়।
— আপনি জেসিকার কাছে জান আর অন্য কোন মেয়ের কাছে জান আমার কিছু আসে যায় না। বুঝলেন আপনি? কিছু আসে যায় না আমার।

— ওকে কুল কুল। আচ্ছা এটা তুমি আমাকে বললে নাকি নিজেকে?

— আমি আপনার সাথে কথাই বলতে চাই না।

হীর রাগ করে রুমের বাইরে চলে যায়। তুর্য বিছানা ছেড়ে উঠে শাওয়ারে যাওয়ার সময় তার চোখ বিছানার উপর পরে। রক্তের দাগ গুলো জানান দিচ্ছে হীর এর যন্ত্রণার কথা। কাল রাতে তুর্য নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিল। সেই রাগের ফলেই হয়েছে সবকিছু। হীর কে সে কষ্ট দিতে চায় নি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে তার হাতে কিছুই ছিল না।
হয়তো কাল রাতের পর হীর তাকে ভুল বুঝবে। কিন্তু সে তো শুধু হীর এর ভালোবাসা পেতে চায়। এটা কি তার খুব বেশি অন্যায় হচ্ছে? এক মুহূর্তের জন্য তুর্যর মনে হয় হয়তো সে হীর কাছে অনেক বেশি কিছু চাইছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে একটা আশা ঘর বাধে। এমনও তো হতে পারে যে হীর সত্যি তাকে ভালোবাসে কিন্তু কোনো কারণে তার উপর অভিমান করে আছে। যেই জন্য হীর তার ভালবাসা কে মেনে নিচ্ছে না। এমন তো যে হীর জেসিকা আর তুর্যর অতীতের সম্পর্কের জন্য তুর্য কে মানতে পারছে না!
তাফসির বিয়ের পর এই ব্যাপারে হীর এর সাথে কথা বলে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটাতে চায় তুর্য।

.
আর এক-দেড় ঘণ্টা পরেই তাফসি আর রায়ান এর বিয়ে পড়ানো হবে। বিউটিশিয়ান রা এসে তাফসি কে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে। পরনে লাল একটা লেহেঙ্গা আর বেশ ভারি গহনায় অপরুপা লাগসে তাফসি কে। তবে এতে তাফসির তেমন মাথা ব্যথা নেই। এতো সাজগুজ করার তার কোনো ইচ্ছাও ছিলো না। তমা বেগমের জোরাজোরিতেই এতো সেজেছে সে। সাধারণত বিয়ের দিন মেয়েরা সাজগোজ নিয়ে চিন্তায় থাকলেও তাফসির চিন্তা শুধু রায়ান কে নিয়ে। আগের বার বিয়ের মাত্র দুই ঘণ্টা আগে বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। সেই বার বহু কষ্টে নিজেকে সামলিয়েছিল সে। এবারও যদি এমন হয় তাহলে আর নিতে পারবে না সে। হয়তো আজকের দিনই তার জীবনের শেষ দিন হতে চলেছে! ছোট একটা কাঁচের শিশি সবার অগচরে কোমরে লেহেঙ্গার ভাজে গুজে নেয় সে। একবুক আশা বেধে শুধু একটাই দোয়া করছে সে আজ যেনো তার আর রায়ান এর বিয়ে তে কোনরকম বাধা না আসে।
হঠাত দরজায় নক পরলে তাফসি লেহেঙ্গার আচল দিয়ে শিশি তা ঢেকে ফেলে।

তাফসির রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি ভিতরে আসার অনুমতির অপেক্ষায়। কাল রাতে বড় আম্মু তাফসিকে হলুদ ছোয়া তে দেন নি। আজ যদি তাফসি মানা করে দেয়!
আমার ভাবনা কে ভুল প্রমাণিত করে হাসি মুখে আমাকে ভিতরে দেকে নেয় তাফসি।
— বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছিস?

— না আসলে তোমাকে দেখতে এসেছিলাম। তৈরি হয়েছো কিনা!

— হ্যাঁ। দেখ আমাকে কেমন লাগছে।

— এই বিয়ে টা করো না তাফসি। রায়ান ভালো না।

তাফসি বসা থেকে উঠে যায়।
— তুই এখনও বিয়ে তা ভাঙতে চাইছিস? কেনো হীর? কি ক্ষতি করেছি আমি তোর?

— আমি শুধু চাই তুমি সুখি থাকো সবসময়। আর রায়ান এর কাছে তুমি কিভাবে সুখি থাকবে? রায়ান তোমাকে ঠকাচ্ছে। রায়ান তোমাকে ভালোবাসে না তাফসি।

— তুই এখান থেকে যা তো হীর। একটু পরেই আমার বিয়ে। আমার মন নষ্ট করিস না।

তাফসির কথার পিঠে আর কিছুই বলতে পারলাম না। কেন তাফসি বুঝতে পারছে না রায়ান ভালো না!
তাফসির রুম থেকে বেরুতেই ড্রয়িং রুমে রায়ান এর সাথে দেখা হয়। রায়ানের চেহারাও এখন আর সহ্য হয় না। রায়ান কে উপেক্ষা করে যেতে নিলে রায়ান পথ আটকে ধরে।
— হুয়াট হ্যাপেন্ড হীর? তোমাকে অনেক টেন্সড্ মনে হচ্ছে! কি হয়েছে নাকি?

— এতো খুশি হওয়ার কিছুই নেই। আমি আপনার মনবাসনা কখনও পূরণ হতে দেব না।

— তুমি কিছুই করতে পারবে না। ফাইনাল এ্যান্ড মাষ্টার স্ট্রোক আমি অলরেডি খেলে নিয়েছি। এখন সবকিছু আমার প্ল্যান অনুযায়ী হবে।

— একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন রায়ান? কি লাভ পাবেন আপনি তাফসি কে কষ্ট দিয়ে? আপনাকে বিয়ে করে তাফসি কষ্ট পাবে, আর এতে আপনি কি সুখ পাবেন?

— তাফসি কষ্ট পেলে তুমি আর তুর্য কষ্ট পাবে। এতে আমার ইগো স্যাটিসফাই হবে। কারণ তোমরা দুজন আমার প্ল্যান ফেইল করেছ।
#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_১৮
#Tabassum_Kotha

— মানছি তাফসির কষ্টে আমি আর তুর্য কষ্ট পাবো। কিন্তু এতে আপনি কি সুখে থাকতে পারবেন?

— কেন পারবো না? বরং তোমাদের সুখে দেখলেই আমি অশান্তিতে থাকব। তাই তাফসি কে কষ্ট পেতেই হবে।

— আসলেই কি তাই?

এক মুহূর্তের জন্য রায়ান মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে। আসলেই কি সে তাফসিকে কষ্ট দিয়ে সে সুখ খুঁজে পাবে!

রায়ান কে চুপ থাকতে দেখে হীর আবার বলতে শুরু করে।
— আপনি প্রথম বার বিয়ে টা ভেঙেছিলেন আপনার বাবার উপর রাগ করে। কারণ সে আপনাকে জোর করেছিল তাফসিকে বিয়ে করতে। বিয়ে ভাঙার জন্য আপনি আমাকে ব্যবহার করেছেন। বিয়ে ভাঙার পর তুর্য যখন আপনাকে মেরেছিল তখন তুর্যর উপর প্রতিশোধ নিতে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। এখন যখন তুর্য আমাকে বিয়ে করেছে এখন আপনি প্রতিশোধ নিতে তাফসিকে বিয়ে করছেন। আজ পর্যন্ত যা যা করেছেন সবটা প্রতিশোধের জন্যই। এই প্রতিশোধের জেদ আপনাকে কোথায় নিয়ে দাড় করাবে বুঝতে পারছেন? একদিন আপনি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবেন। কিন্তু তখন কাউকে কাছে পাবেন না। ভালোবাসা আর সম্পর্কের মর্যাদা দিতে শিখুন রায়ান। এমন যেনো না হয় যতোদিনে এসবের মর্যাদা শিখবেন ততোদিনে সব শেষ হয়ে যায়।

— জাস্ট শাট্ আপ। তোমার কাছে কেউ জ্ঞান চায় নি।

— জ্ঞান দিচ্ছি না। আসলে যা আমার নিজেরই কম তা আমি মানুষ কে অযথা দেই না। কিন্তু আশা করি একবার ভেবে দেখবেন এভাবে তাফসি কে ঠকিয়ে, কষ্ট দিয়ে আপনি ঠিক কতোটা সুখী হবেন!

রায়ান কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে হীর কে উদ্দেশ্য করে বলে,
— ওয়ান মোর থিঙ। তুমি তুর্য কে ভালোবাসো তাই না? কিন্তু তুর্য তোমাকে ভালোবাসে না। হি লাভস্ জেসিকা। ইউ নো রাইট! তাহলে দেখো এই বাড়িতে আর তুর্যর জীবনে তোমার অবস্থান কোথায়?

— আপনি এসব আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলছেন নাকি নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য? আপনি মূলত তাফসির ব্যাপার টা এড়াতে চাইছেন। তাই তুর্য আর জেসিকার ব্যাপার টা তুলছেন। জেসিকা তুর্যর অতীত। আমি তার বর্তমান এবং ভবিষ্যত। আর হ্যাঁ! মাথায় রাখবেন এটা আমার আর তুর্যর ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনার এতে কথা বলার কোনো অধিকার নেই।বিয়ের জন্য শুভ কামনা।

হীর সেখান থেকে চলে গেলে রায়ান বেশ বিচলিত হয়ে পরে। এতোদিন সে তার সিদ্ধান্তে অটল ছিল। কিন্তু আজ নিজের সিদ্ধান্তেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। সত্যি কি সে ভুল করছে তাফসিকে বিয়ে করে? হীর যা বলে গেলো তাতে তো বিন্দুমাত্র মিথ্যে কিছু নেই। নিজের ইগোর জন্যই তো রায়ান সবকিছু করছে! আর কিছু ভাবতে পারছে না রায়ান। সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে, অথচ সব তার ইচ্ছে অনুযায়ী ই হচ্ছে।

.
হীর সারাক্ষণ তাফসি আর রায়ানের বিয়ে টা থামাতে চাইলেও শেষ মুহূর্তে এসে হাল ছেড়ে দেয়। তার শত চেষ্টা বৃথা করে দিয়ে রায়ান আর তাফসির বিয়ে টা খুব ভালো মতোই সম্পন্ন হয়। তুর্যর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তমা বেগম তাফসি আর রায়ানকে চৌধুরী মেনশনে রেখে দেন। চৌধুরী মেনশনেই রায়ান আর তাফসির বাসর সাজানো হয়।

পুরো বাড়ি মেহমানে ভর্তি। ভাবা যায় একটা রুমও খালি নেই। শুধু বড় আম্মুর রুম ছাড়া। কিন্তু বড় আম্মু তার রুমে কখনই আমাকে থাকতে দেবেন না। কি মুশকিল কোথায় থাকবো আমি রাতে? তুর্যর রুমে আর যাবো না, ভুলেও না। উনার রুমে না গেলে আমাকে পাবেন কোথায়? কিন্তু থাকবো কোথায়? বেশকিছুক্ষণ চিন্তা করে ড্রয়িং রুমের কাউচে শুয়ে পরলাম। কাল সকালে সবার উঠার আগেই এখান থেকে সরতে হবে। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে গিয়েছে। কাউচে গা এলিয়ে দিতেই দুচোখে ঘুম এসে ভর করে।
তুর্য রুমের একদিক থেকে অন্য দিকে পায়চারি করছে আর বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। আশ্চর্য রাত ১:২৪ মিনিট চলছে অথচ হীর এখনও ঘরে আসে নি। এতোক্ষণে তো বাড়ির সব মেহমানরাও ঘুমিয়ে পরেছে। তুর্য আর দুই মিনিট অপেক্ষা করে রুম থেকে বেরিয়ে যায় হীর কে খুঁজতে।

ব্যালকনির রেলিং এর কার্নিশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে রায়ান। প্রায় একঘন্টা হয়ে গিয়েছে একই ভঙ্গিতে এখানে দাঁড়িয়ে আছে সে। সিগারেটের একটা প্যাকেট আর একটা লাইটার তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে নেয় সে। মাথাটা হ্যাঙ হয়ে আছে তার। বেশ লম্বা চওড়া একটা প্ল্যান বানিয়েছিল কিভাবে তাফসি কে টর্চার করবে। কিন্তু এখন যেনো তার মাথা কাজ করছে না। হ্যাজিটেশনে সে তাফসির সাথে চোখ ই মেলাতে পারে নি। তাই তো এখানে দাঁড়িয়ে সময় পার করছে। লাইটার টা হাতে নিতেই তার মনে পরে এটা তাফসির দেওয়া উপহার। সহসাই বিরক্ত হয়ে সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছা টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। লাইটার টা ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে তার। তবুও কোথায় কিছু একটা বাঁধা দিচ্ছে।
আরও কিছুক্ষণ পর রুমে ফিরে আসে রায়ান। সে ভেবেছিল হয়তো এতোক্ষণে তাফসি ঘুমিয়ে পরেছে কিন্তু তার ভাবনা ভুল ছিল। তাফসি এখনও জেগে বসে আছে রায়ানের জন্য। তাফসির সাথে মুখোমুখি হতে চায় না সে। টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। প্রায় আধা ঘন্টা পর শাওয়ার শেষ করে সে। কিন্তু তখনও তাফসি জেগে আছে। এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে রায়ানের। তাফসি কি বুঝতে পারছে না যে সে তাকে ইগনোর করছে। বেশ রাগ নিয়েই ভেজা তোয়ালে টা বিছানায় ছুড়ে মারে রায়ান। ভেজা চুল গুলো হাত দিয়ে ঝাড়া দিয়ে পুনরায় ব্যালকোনিতে যেতে নিলে তাফসি পিছন থেকে রায়ানের হাত টেনে ধরে।

— আবার কেনো যাচ্ছো বাইরে?

— তোমার পারমিশন নিতে হবে নাকি?

— না। তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়ো। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে তোমার উপর।

রায়ানের ইচ্ছে করছে তাফসিকে অনেকগুলো কথা শোনাতে কিন্তু কেনো যেনো তার মুখ থেকে কিছুই বেরুচ্ছে না। বিছানার দিকে তাকিয়ে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার। হাজারো ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বাসর ঘর। বিছানায় তাফসির পছন্দের লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। সেন্টেড ক্যান্ডেল এর সুবাস আরও বেশি টর্চার করছে মনে হচ্ছে। হাত পা খিচে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রায়ান।
বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে কাউচে রাখে তাফসি।
— তুমি বিছানায় ঘুমাও আমি কাউচে ঘুমাতে পারবো।

— আই ডোন্ট নিড ইউর সিমপ্যাথি।

— সিমপ্যাথি হতে যাবে কেনো? তুমি আমার হাসবেন্ড রায়ান। তোমার কমফর্ট এর খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব।

— হুম। তোমার প্রব্লেম হবে না কাউচে ঘুমালে?

— না। আমি ম্যানেজ করতে পারবো।

এতোক্ষণে রায়ান তাফসি কে ভালোমতো দেখে। আজ তাফসি কে অন্যরকম লাগছে। বিয়ের লেহেঙ্গা টা পালটে একটা শিফনের লাল রঙের শাড়ি পড়েছে সে। ছিমছাম গড়নে শাড়ি টা তাকে ভালো মানিয়েছে। স্লিভলেস ব্লাউজে খোলা চুল। সব মিলিয়ে বেশ আবেদনময়ী লাগছে তাকে। এক মুহুর্তের জন্য রায়ান এর মনে হয় তাফসি কে কাছে টেনে নিতে। কিন্তু পরক্ষনেই রায়ান তার মনে আসা লালসা কে নিয়ন্ত্রণে এনে নেয়। তাফসি রায়ান এর সাথে আর কোন কথা না বলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরে। কিন্তু রায়ান এর দুচোখে কোন ঘুম নেই। এটা তো সে চায় নি। কেনো তার মন এতো অস্থির? সব তো তার ইচ্ছাতেই হয়েছে। তবে কেনো সে খুশি হতে পারছে না!

.
ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছে কেউ আমাকে স্পর্শ করছে। প্রথমে পাত্তা না দিলেও কিছুক্ষণ পর মনে হয় আমি শূন্যে ভাসছি। ভয় পেয়ে চোখ খুলতেই নিজেকে তুর্যর বুকে আবিষ্কার করলাম। তুর্য আমাকে পাজাকোলে তুলে কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন। রুমে এনে আমাকে ধপ করে বিছানায় ফেলে দিলেন তিনি।

— আমাকে এখানে আনলেন কেন?

— তুমি ড্রয়িং রুমে কি করছিলে? জানো আমি কতোক্ষণ যাবত তোমার রুমে ওয়েট করছি?

— কেন ওয়েট করছিলেন? আমি কি বলছিলাম নাকি?

— না আমি তোমাকে আমার কাছে চাই তাই ওয়েট করছিলাম।

কথা তা বলে তুর্য হীর এর কোলে মাথা গুজে দেয়। হীর খানিকটা কেপে উঠে তুর্য কে সরানোর চেষ্টা করে। তুর্য এতে কিছুটা বিরক্ত হয়।
— কি হলো? আমার স্পর্শে কি তোমার খারাপ লাগে হীর?

— না তেমন কিছু নয়।

— তবে কেনো আমি কাছে এলে তুমি সরে যাও আর নয়তো আমাকে সরিয়ে দাও? বলো হীর! আমার অপরাধ টা কি বলো! কেনো আমাকে, আমার ভালোবাসা কে তুমি মেনে নিতে পারছো না?আমি কি এতোটাই খারাপ হীর?

তুর্যর দুচোখে পানি টলমল করছে। যেকোনো সময় এই পানি গুলো অশ্রুতে পরিণত হয়ে ঝরে পরবে।
তুর্য আবার বলতে শুরু করে।
— তুমি কি জেসিকা আর আমার অতীত নিয়ে এখনো সন্দেহ করছ? বিশ্বাস করো হীর। জেসিকা আর আমার মধ্যে এখন কোনো সম্পর্ক নেই। হ্যাঁ একটা সময় ছিলো যখন আমাদের সম্পর্ক ছিল কিন্তু এখন সেটা আর নেই। সব শেষ। জেসিকার সাথের সম্পর্ক টা মূলত একটা টাইম পাস ছিল। জেসিকা ফরেইনার। তার কাছে এসব রিলেশন খুবই সাধারণ। আমার কাছেও তেমনি ছিল। ট্রাষ্ট মি।

এতোক্ষণ পর হীর তার নীরবতা ভাঙে।
— কিন্তু আমার কাছে সাধারণ নয় তুর্য। ভালোবাসা, সম্পর্ক এসব আমার কাছে অনেক বড় কিছু। আপনি আর জেসিকা যতটা সহজে ভুলে গিয়েছেন আমার পক্ষে ততটা সহজ নয় আপনার আর জেসিকার সেই মুহুর্তগুলো ভুলে যাওয়া। সেই মুহুর্তগুলো আমি নিজের চোখে দেখেছি। কয়েকটা রাত আমি একটা মৃত দেহের মতো কাটিয়েছি। এখনো আপনার সাথে নিজেকে কল্পনা করার আগে আপনার বুকে থাকা জেসিকার ছবি ভাসে। কি করব আমি বলুন?

— সব ভুলে যাও। আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি হীর। আজ থেকে না। সেই প্রথমদিন যেদিন লন্ডন থেকে ফিরেছিলাম। প্রথম দেখাতেই তোমার জন্য মনে আলাদা একটা জায়গা তৈরি হয়েছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে সামলানোর। অনেক বার চেয়েছিলাম তোমাকে জেসিকার কথা বলে দেবো। কিন্তু সাহস করতে পারি নি। ভয় হতো যদি তুমি ভুল বুঝে আমায় আপন করে না নেও! জানো আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ভালোনাবাসার কিন্ত ব্যর্থ হয়েছি।

চুপচাপ তুর্যর সব কথা শুনছি। তুর্য কে অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু তবুও কেন যেনো তাকে আপন করে নিতে পারছি না। কিছু একটা দেওয়াল হয়ে আমাকে বাধা দিচ্ছে। কোন একটা জড়তা আমাকে আকড়ে ধরছে।
তুর্য আমার দুই হাতে অনবরত চুমু খাচ্ছেন। কিন্তু আমার মধ্যে কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। তুর্য আমার ঠোঁট স্পর্শ করলে তাকে সরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে উঠে পরলাম। পিছন থেকে হাতে হালকা টান অনুভব করলে পিছন ঘুরে দেখি তুর্য আমার হাত ধরে রেখেছেন।

— কেনো আমাকে কাছে টেনে নিতে পারছো না হীর? কেনো আমার ভালোবাসায় সাড়া দিচ্ছো না? তুমি কি বুঝতে পারো না আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি?

— আপনি আমার কাছে এতোকিছু আশা করছেন তুর্য! আপনি কি আমার মনের অবস্থা বুঝেন? কখনও বুকে টেনে নিয়ে বলেছেন ভালোবাসি? আমি মনের ভাষা বুঝতে পারি না তুর্য। এজন্যই পাগলের মতো চাই একবার আপনি বলবেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আচ্ছা এসব বাদ দেই। কিন্তু কাল? কাল রাতে আপনি যেটা আমার সাথে করেছেন সেটা কি ঠিক ছিল।

— কাল রাতের জন্য আ’ম সরি হীর। আসলে আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি। যার কারণে এমন করেছিলাম। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। সব ভুলে নতুন করে শুরু করি সবকিছু।

আবারও আমি চুপ করে গেলাম। তুর্য যা বলছেন সবই ঠিক। কিন্তু আমি কেনো পারছি না তুর্য কে আপন করে নিতে। কেনো এতো সংকোচ বোধ হচ্ছে? কেনো এতো সংশয়? কেনো এতো দূরত্ব? আমারও ইচ্ছে করছে তুর্যর বুকে নিজেকে লুটিয়ে দিতে। ইচ্ছে করছে চিত্কার করে তুর্য কে জানিয়ে দিতে যে আমি তাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
তুর্যর দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দুইচোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে আছে। নিচে ঝড়ে পরার অনুমতি পাচ্ছে না। তুর্য আমার সামনে অনবরত তার ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। আর আমি কি না তাকে প্রতিনিয়ত প্রত্যাখ্যান করে কষ্ট দিচ্ছি। এই একই কষ্ট একটা সময় আমিও পেয়েছি। তুর্য কে পাগলের মতো ভালোবাসার পরেও তার পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে হতো প্রতিনিয়ত। আচ্ছা অনেক তো হলো কষ্ট কষ্ট খেলা। এখন না হয় একটু ছুটি নেওয়া যাক।

চলবে..
চলবে…

[ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here