#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–3
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
বড় আপা কোন দিন মা হতে পারবেনা। এজন্য এর ভর্তুকি সেজুতি কে দিতে হচ্ছে। আপার বদলে সে আপার শ্বশুড়বাড়ির বংশের প্রদীপ এনে দিবে। বোন হিসেবে এটা নাকি তার নৈতিক দায়িত্ব।
একথা মনে মনে ভাবতেই সেজুতির ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে। দুনিয়ার হিসাব কি এতোটাই সহজ? কে জানে হয়তো ক্যালকুলাসের চেয়েও দুনিয়াবি হিসাব বেশী সহজ। কি সুন্দর তার জীবনের অংক কষচ্ছে বাহ্যিক কেউ একজন!
সেজুতিকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।সে আয়নায় নিজের মুখ দেখে নিল।
চমৎকার লাগছে তাকে! নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হলো সে। লাল বেনারসি শাড়ি এবং গোল্ডেন পাড়। দারুণ কারুকার্য করা এই শাড়ি। হাতে মোটা মোটা সোনার চুড়ি। একটা নেকলেস আর লম্বা চেন। টিকলি বাদে সবই সোনার!
সেজুতির মুগ্ধ হওয়ার প্রবলতা তীব্র। যেকোন জিনিসের প্রতি সে মুগ্ধ হতে পারে।দেখা যাবে, বিয়ের পর সে মুহিবের নাক ডেকে মুখ হা করে ঘুমানোর প্রতি মুগ্ধ হয়ে সারারাত জেগে সেই দৃশ্য দেখে চোখে কালি জমিয়ে একাকার করে ফেলবে!
সেজুতি জানে সে বড্ড বোকা। এজন্যই তো সবসময়ই বুদ্ধিমানের মতো করে কথা বলার ভান ধরে। হুমায়ুন আহমেদের একটা বইয়ে পড়েছিল মেয়েদের জীবনের এক অংশ অভিনয় করতে করতেই কেটে যায়। সে কি অভিনয় করে? সুখে থাকার? করে হয়তোবা।
অভিনয় করতে করতে এক সময় সেই অভিনয়কেই সত্য বলে মনে হয়! — এগুলো সাইকোলজি।
সে দম ফেলল। চারপাশে ফুলের গন্ধে ভরপুর। মানুষ-জন গিজগিজ করছে বাইরে। অনেকে তার রুমেও উকি মারছে। সেজুতি এতে প্রচুর বিরক্ত হচ্ছে কিন্তু মুখে এমন এক আন্তরিকতা টেনে আনছে যেন সে মহাখুশি।
সোভা আপা রুমে এসে এক গাল হেসে বলে উঠে, দেখি তোর মেহেদীর রঙ কেমন হয়েছে?
সেজুতি হাত বাড়িয়ে দিল উৎসাহের সঙ্গে। মুহিব ভাই ভুল বলেছিলেন। সেজুতির বিয়ের অনুষ্ঠান বাসায় হলেও বেশ ঝাকঝমক ভাবেই করা হচ্ছে প্রত্যকটা অনুষ্ঠান। কালকে হলুদ ছোয়ার অনুষ্ঠানের পর রাত দেড়টা অব্দি হাতে মেহেদী পড়ার আসর জমেছিল। সেজুতির শুতে যেতে যেতে রাত দুটো বাজে।প্রচন্ড ক্লান্ত ছিলো সে। তারপর ও একফোটা ঘুম হয়নি।
তার মনে হয়, দেশে এমন কোন মেয়ে নেই যে বিয়ের আগের দিন রাত না জেগে থেকে ঘুমায়। প্রত্যকটা মেয়েই বিয়ের আগের রাতে বিভিন্ন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে জেগে থাকে।
সারারাত চোখ খোলা ছিল সেজুতির। নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো তার। কি থেকে কি হয়ে গেল?? ভালোই চলছিল দিন গুলো। ভার্সিটি লাইফ কতো মজার চলছিল। সবকিছু তে পানি ঢেলে দিলো আপার মা হতে না পারার অক্ষমতা। আপা আর দুলাভাইয়ের বিয়ের আট বছর চলছে তাও কোন সন্তান নেই। দেশ-বিদেশে চিকিৎসা করানো হচ্ছিলো। লাস্টে থাইল্যান্ড যাওয়া হয়। সেখানকার ডাক্তার জানিয়ে দিলো, আপা কখনো মা হতে পারবে না!
এরপর থেকে শুরু হলো ঝড়-তুফান। প্রাকৃতিক ঝড় না। মানব সৃষ্ট ঝড় এটা। যে ব্যক্তি এই তুফান তৈরি করলেন তিনি আর কেউ নন বরং আপার শ্বাশুড়ি আম্মা। উনি কঠিন স্বভাবের মহিলা। তাদের এলাকার প্রথম নারী চেয়ারম্যান। এলাকা কাপানো ক্ষমতা তার। উনি এই সংবাদ মেনে নিতে পারলেন না। তাদের বিশাল বাড়ি, একর-একর জমি,ব্যাংক ওভারলোডেড টাকা এইসবের উত্তরাধিকার কে হবে যদি সোভা আপার সন্তান না হয়? বানে ভাসবে তার সম্পত্তি! রাজনীতি করায় শক্রুর অভাব নেই। ঘরের মানুষ কেও তিনি চরম শক্রু বলে দাবী করেন।
তার ভাষ্যমতে, সবচেয়ে ক্ষতি করতে পারা শক্রুই মানুষের কাছে থাকে!
সোভা আপা মাথা দুলিয়ে বলে উঠে, খুব চমৎকার রঙ হয়েছে রে সেজু! তোর ভাগ্য ভালো। মুহিব খুবই ভালো ছেলে। তোকে সুখে রাখবে দেখে নিস! তোরা যে আমার নাকের ডগায় প্রেম করলি আর আমি টেরই পেলাম না! হেসে বললেন কথাগুলো আপা।
সেজুতির ঠোঁটে আবারো হাসি জমা হলো। প্রেম ভালবাসা তার কপালে নেই।বিধাতা সবাইকে ভালোবাসা উপহার দেন না। কেউ কেউ অভাগী হয় তার মতো। যারা এক চিলকে ভালোবাসা পাওয়ার আশায় চাতক পাখি হয়ে রয়! সেজুতি দুম করে নিশ্বাস ছাড়ে এবং মাথা নিচু করে নেয়। ভাবখানা এমন লজ্জা পেয়েছে সে।
আপা বাচ্চাদের মতো আগ্রহ নিয়ে বলে উঠে, মুহিব তোকে খুব ভালোবাসে তাই না রে? কেমন প্রেমিকের মতো এসে তোকে হলুদ লাগিয়ে গেল,,,,,,,,,
সেজুতির চোখ ভরে এলো। আপাকে জানানো হয়নি সে মা হতে পারবেনা কোন দিন। যেদিন এই খবর আপা জানবে না জানি কত কষ্ট পাবেন।
শোভা আপা সেজুতির কপালে চুমু খেয়ে বলে, মুহিবরা চলে আসবে এক্ষুনি!
— ওহ,,,,,,,
— তুই চুপটি করে বস। আমি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি।
— খাব না আপা। খিদে নেই।
— বিয়ের দিন কোন মেয়েরই খিদে পায় না। কিন্তু তাও খেতে তো হবেই।
শোভা আপা সেজুতিকে আদর করে খাইয়ে দিলো। সেজুতি খেয়ে নেয়৷
★★★
পৌষ মাসে নাকি সর্বনাশ ঘটে এই কথা ভুল সেজুতির জন্য। তার সর্বনাশ ঘটছে চৈত্র মাসে।
সে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। কাজী সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন। কি বলছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না সেজুতির। সে ঝিম মেরে বসে আছে। এক বারো মুহিবের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি সে।
মুহিবকে ঘিরে বিশাল জটলা। তার কাজিন থেকে শুরু করে, ফ্রেন্ড সবাই তার সঙ্গে আছে। গল্প করছে, মজা নিচ্ছে।কিন্তু মুহিবের পাঁচ ইন্দ্রিয়ই সেজুতিকে দেখায় ব্যস্ত।
মুহিব বেশ ঘটা করে, সেজুতির ফোলা ফোলা গোলাপী ব্লাসন মাখা গাল দেখলো।কানের ঝুমকা দেখলো ।ঝুমকার ভার সইতে না পেরে কানের লতি ডেবে যাচ্ছে।হাতের ফর্সা আগুলে পড়া আংটি দেখলো।হাতের মেহেদী আর গলার কালো তিল সবই খুটিনাটি দেখে নিল। যতোবারই সেজুতিকে দেখছে তার বুকে ব্যথা হচ্ছে।এই ব্যথা প্রেমময় ব্যথা না। অন্য ব্যথা। যার কোন ঔষধ নেই। আজকের পর থেকে এই ব্যথা বুকে পুষে রাখতে হবে। বড় যত্নের এই ব্যথা যে।
কাজী সাহেবের কথা অনুযায়ী মুহিব আলহামদুলিল্লাহ কবুল বলে ফেলে।
এরপরে ভাবতে থাকে, পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় জীব কে?? পিপড়া? যে কিনা পানিতে ডুবার সঙ্গে সঙ্গে মরে যায়? উহু! পিপড়া নিজের ওজনের তুলনায় কয়েক গুন ওজনের জিনিস বয়ে নিয়ে যেতে পারে৷
পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় জীব হলো মানুষ। এই জীবের হাতে নিজের জীবনেরই কলকাঠি থাকে না।এদের জীবন অন্য কেউ নিধারিত করে দেয়। তবে পিপড়ার সঙ্গে মানুষের মিল আছে এক জায়গায়। মানুষ ও নিজের ওজনের চেয়ে কয়েকশ গুন বেশী ওজনের যন্ত্রণা সইতে পারে।
সেজুতির কাপা গলায় কবুল শুনে কেপে উঠে মুহিব। সে সুক্ষ্ম চোখে সেজুতিকে দেখলো।মেয়েটা কাপছে।আচমকা হাউমাউ করে কাদতে লাগে।
সেজুতির কান্না করায় বড়ই আশ্চর্য হয় মুহিব। তার মুখ থেকে বের হয়, কি আশ্চর্য! কাদে কেন?
সেজুতির কান্না আর থামে না।বিদায় বেলায় প্রত্যক সদস্য কে জড়িয়ে ধরে দফায় দফায় কাদলো।
মুহিব হিসেব করে রাখলো, গণ প্রতি চার মিনিট ধরে কেদেছে সেজুতি। আশ্চর্য! সেজুতির সবকিছুই মুহিবকে অভিভূত করছে। এটা উচিত হচ্ছে না। সেজুতির কোন কাজেই অভিভূত হলে চলবে না তার৷
অভিভূত হওয়া প্রেমে পড়ার প্রাথমিক লক্ষণ। অভিভূতর সঙ্গে অনুভূতির এক প্রগাঢ় সম্পর্ক আছে। মুগ্ধ হওয়া থেকেই প্রেম-ভালোবাসার উৎপত্তি।
গাড়িতে বসেও সেজুতি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। মুহিব তাকে একটুকুও সান্ত্বনা দিল না। সে কিন্তু চাইলেই পারে বলতে, আহা শুধু শুধু কান্না কেন করছো? বিয়েই তো করেছো? নাকি দশ খুন করে এলে যে এখন জেলে যাওয়ার ভয়ে কাদছো। অবশ্য দশ খুন করলেই অসুবিধে নেই৷ আমার মামা হাইকোর্টের জাজ। কোন একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। ডোন্ট ক্রাই।
সে এসব না করে সিগারেট ধরিয়ে বলে উঠে, আর দুই ফোটা চোখ থেকে পানি পড়লে তোমাকে হাসপাতালে ইমারজেন্সি তে নিয়ে যেতে হবে। রোগের নামের জায়গায় ফাইল লিখতে হবে, চোখের খরার অসুস্থ! ডিহাইড্রেশন অফ আইস!
সেজুতি অদ্ভুত ভাবে মুহিবের দিকে তাকালো। মুহিব নিবিকার ভাবে ড্রাইভার কে বলল,
গাড়িতে গ্যাস আছে কুদ্দুস?
ড্রাইভার উত্তর দেয়, জি স্যার৷
সেজুতি কান্নামিশ্রিত গলায় বলে, খবরদার আপাকে সত্য কথাগুলো জানাবেন না!
— কোন সত্য কথা?
সেজুতির রাগ উঠে যায়। মুহিব সবকিছু ই জানে তারপর ও এখন এমন ভান করছে যেন কিছুই জানে না৷
সে দাতে দাত চেপে বলে, আপার থেকে দুইটা সত্যই গোপন করা হয়েছে। এক নাম্বার হলো আপা মা হতে পারবেনা আর দুই নাম্বার হলো, আমাদের প্রেমের বিয়ে৷
মুহিব সিগারেটে টান দিয়ে বলে, দুই নাম্বার টা কি আসলেই মিথ্যা?
সেজুতি চোখ তীক্ষ্ম করে তার দিকে তাকাতেই মুহিব হেসে বলে, ভয় পেলে নাকি?
— না।
— ভয় পাওয়ার কিছু নেই সেজুতি। আমি খুবই নিরীহ টাইপের ছেলে।
সেজুতি চোখ সরিয়ে নিল। তার পাচ মিনিটের মধ্যে মুহিবের বাড়ি পৌঁছে গেল।
গাড়ি থেকে সেজুতি বের হতেই মুহিবের কাজি নরা আর ফ্রেন্ডরা ভাবি ভাবি বলে ডাকা শুরু করে দিলো।
সেজুতিকে সরাসরি মুহিবের রুমে বসিয়ে দেওয়া হয়। সেজুতি চোখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুমটা দেখতে লাগলো। খুব সুন্দর করে সাজানো রুমটা।
সেজুতি বিছানায় বসল। বিছানায় লাভ সেইপ আকা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে। এর ভেতরে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে মুহিব নামের প্রথম অক্ষর এম আর সেজুতির এস দিয়ে এম প্লাস এস লেখা। কেন যেন এই জিনিস টা সেজুতির ভালো লাগলো।
সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুহিবকে পছন্দ করার জন্য। মুহিবের কন্ঠস্বর চমৎকার। এই কন্ঠস্বরের প্রতি মুগ্ধ হওয়া যায়৷ আর কি বৈশিষ্ট্য আছে মুহিবের? সে লম্বা এটা কি বৈশিষ্ট্যর কাতারে পড়ে? না বোধহয়।
তখনি মুহিব হন্তদন্ত করে রুমে এসে রুমের দরজা লাগিয়ে দিল৷
সেজুতি ঘাবড়ে গেল। ছেলেটার কি দরজা লাগানোর রোগ আছে।
মুহিব রুমের সাজসজ্জা দেখে বলে উঠে, আম্মাকে কত করে বললাম রুম সাজানোর দরকার নাই। আরে বাপ! ভালোবাসা থাকলে দিনেও রাত হবে আর ভালোবাসা না থাকলে মধ্যরাতেও এতো সাজসজ্জা থাকার পরও আসল কাজ হবে না।
সেজুতি নড়েচড়ে উঠে খুকখুক করে কাশল। মুহিব এতো ঠোঁট কাটা কেন? মুহিবকে জানিয়ে দিতে হবে তার সামনে এতো আজেবাজে কথা বলা চলবে না।
মুহিব ফ্রেশ হয়ে এসে বলে উঠে, আমি শুয়ে পড়ব৷ লাইট অফ করো৷
সেজুতি তার কথা শুনলো না। লাইট ও অফ করলো না।
মুহিব বিছানা থেকে উঠে বসে বলে, কাইন্ডলি এখন ঢং করে বলবে না, এই বিয়ে আমি মানি না৷ আপনার সঙ্গে এক বিছানায় শুবোনা। এইসব শুনলে গালে চড় বসাব।
সেজুতি বলে উঠে, আপনি কি রেগে আছেন কোন কারনে?
— অবশ্যই৷ নিজের রুমে আসার জন্য আমাকে দশ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।তার উপর বিয়ের খাবার একদমই ভালো ছিলো না। রেজালা বাদে সব পানসে ছিল। তিতা তিতা লাগলো আমার কাছে। কাচ্চি দুই লোকমা মুখে দিয়েই আর খাইনি।
সেজুতি ঠোঁট বাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, আপনার মুখ তেতো এজন্য কোন খাবারই ভালো লাগবে না।
আচমকা মুহিব তার কান থেকে পরম যত্নে ঝুমকো জোড়া খুলে দিল।
এই প্রথম মন থেকে সেজুতি তার প্রতি মুগ্ধ হলো।
চলবে।