#সোহাগী
#পর্ব :১২
Lutful Mehijabin
চৌকির উপর কাত হয়ে শুয়ে ছিলো সোহানা। আজ একবার ও কাঁদে নি মেয়েটা। সেই সকাল থেকেই সে উদাসীন মনে ভেবে চলছে রাশেদের সাথে অতিবাহিত মধুর স্মৃতিগুলো। আব্বার আগমনের অপেক্ষায় তার ভেতরটা ছটফট করছে। ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললো তবুও কেউ তার মুখে এক মুঠো ভাতের দানা তুলে দেই নি। এমনকি তার খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তার আদরের নানীও নিজ স্বার্থের কাছে হেরে গিয়েছে। সব মিলিয়ে সোহাগী তিক্ত বাস্তবতার অভিজ্ঞতা নিচ্ছে। অনুভব করছে বাস্তবতা বড়োই কঠিন। পৃথিবীতে বাবা- মা ব্যতীত সবাই যেন বড্ড স্বার্থপর! তবে পৃথিবীতে কিছু সংখ্যক বাবা-মাও নানান ক্ষেত্রেই সন্তানের প্রতি উদাসীন, নিজ স্বার্থে সন্তানকে অস্বীকার করতে মোটেও অনুতাপ হয় না। তারা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ স্বার্থপর! ঠিক যেমনটা সোহানার ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এক ধ্যানে উন্মুক্ত আকাশে দৃষ্টি রেখে আকাশ কুসুম কল্পনা করে যাচ্ছে সোহাগী। হঠাৎ দরজা চাপানোর মৃদু শব্দ কর্ণপাত হতেই স্বল্প কেঁপে ওঠে সে। ঘরে কেউ এসেছে? সামান্য নড়েচড়ে বসলো সোহাগী। মানুষ জনের কোলাহল তার ভালো ঠেকছে না।
— সোহা,,
সোহানার কোমল কন্ঠস্বর শুনে সোহাগীর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। আজ কতোকাল পর সোহানা তাকে এতো ভালোবাসার সহিত আদুরে গলায় ডেকেছে, তার কোনো হিসেব নেই!
— তুই এমনে উপড় হইয়া শুয়া আছিস কেন! তাড়াতাড়ি উঠ তো মা। যা গিয়ে কলপাড়ার থাইকা পরিষ্কার হইয়া আই তো। জমিলা, রুমা তোরা আই তো এখানে।
মায়ের আচরণে বেশ আনন্দিত হলো সোহাগীর ছোট হৃদয়। মন বললো, মা বুঝি তার বিষন্নতা সহ্য করতে না পেরে আমিরুলদের না করে দিয়েছে। হয়তো সোহানা তার উপর করুণা করেছে। এসব ভেবে মুহূর্তেও অপেক্ষা করলো না সোহাগী। মুখের উপর থাকা বালিশটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে বসলো। সোহানার দিকে একবার তাকিয়ে আশেপাশে লক্ষ্য না করেই ঝাপটে ধরলো সোহানা কে।
আচমকা সোহাগীর ছোঁয়া পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন সোহানা। তবে মেয়েটা অবশেষে তার কথা খুশী মনে মেনে নিলো। সোহাগী তার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে! কঠিন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সোহানা কে। মেয়েটার চোখের জল সোহানার হৃদয় কতটুকু পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে তা বলা মুশকিল! তিনি মুচকি হেসে সোহাগীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলেন। এক হাত সোহাগীর পিঠে অন্য হাত মাথায় রেখে বলে উঠলেন,
— এতো কান্দিস না। এখন কানলে তোর চোখ গর্তে চইলা যাইবো।
সোহানার কথার সারমর্ম বুঝে উঠতে পারলো না সোহাগী।
— ইশ! কান্দা বাদ দিয়ে উঠো তো মা। জমিলা, রুমা আর কতক্ষণ দাঁড়ায় থাকবো। একটু পর তো জামাই বাবাও চইলা আইবো।
সোহানার শেষোক্ত বাক্য কর্ণকুহুরে পৌঁছানো মাত্রই চমকে উঠে সোহাগী। তার মানে সে ভুল ভেবেছিলো! তৎক্ষণাৎ ঝড়ের বেগে সোহানা কে ছেড়ে দিয়ে, দূরে সরে এলো। বিছানা ত্যাগ করে শাড়ির আঁচল দু হাতের মুঠিতে চেপে ধরলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলো তার। কিন্তু না, সজরে গলা ফাটিয়ে সে কাঁদতে পারলো না। শুধু মাত্র তার মূল্যহীন চোখের নোনা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো যত্রতত্র! প্রতিবাদ স্বরে এক দমে বলে উঠলো,
— আমি মরে গেলেও বিয়া করবো না আম্মা। কতবার বলবো, আব্বা আসুক তারপর তুমি যা বলবে তাই হবে। আমার আব্বা চাই না আমার বিয়ে হোক। আব্বা চাই আমি যেন পড়াশোনা করি। তুমি ওই বেডা দের নিষেধ করে দেও।
সোহাগীর কথাগুলো শেষ হওয়ার মাত্র সোহানা সজোরে এক থা’প্পড় মেরে বসলেন মেয়েটার কোমল গালে। সোহাগী কিছু বুঝে উঠার আগে তার চুলের মুঠো চেপে ধরেন। অতঃপর সোহানা দাঁত চেপে বলে উঠেন,
— কী বললি তুই বিয়ে করবি না তাই তো? আবার বল,,
চুলের গোড়ায় ব্যথায় অনুভব করলো সোহাগী। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। অথচ সোহানার প্রত্যুত্তরে নাছোড়বান্দা ন্যায় বলে উঠে,
— হ্যাঁ আম্মা, আমি বিয়ে করবো না। দরকার পড়লে পালিয়ে যাবো তবুও করবো না বিয়ে।
মুহূর্তেই ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠেন সোহানা। অদ্ভুত কান্ড করেন! সোহাগীর চুলের মুঠো ছেড়ে দূরে সরে আসেন। মিনিট দুইয়েক প্রাণ খুলে হাসলেন। এমন পরিস্থিতিতে সোহাগী কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এই মুহূর্তে সোহানার হাসি বেমানান! সোহাগী কিছু বুঝে ওঠার আগে সোহানা ফির এগিয়ে এলেন মেয়েটার নিকটবর্তী।
— সত্যিই তো করবি না?
কথাটা ফিসফিসে বলে উঠেন সোহানা। বিস্ময়ের সাথে সোহাগী অস্পষ্ট গলায় উত্তর দেয়।
— না।
সোহাগীর উত্তর পেয়ে নিমিষেই সোহানার মুখশ্রী রুপ পরিবর্তন হলো। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো পৈশাচিক হাসির রেখা। সোহাগীর কানের নিকট মুখ নিয়ে এলেন তিনি। অতঃপর ফিসফিসে কিছু বললেন। যা শুনে সোহাগীর গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে সে বলে উঠলো,
— না আম্মা, এমনটা করো না। তুমি যা করবা আমি তাই করবো। আমাকে মাফ করে দেও আম্মা। আমি বিয়ে করবো তো।
কথাগুলো শুনে সোহানা মেয়েটার থুতনিতে স্পর্শ করলেন। মুচকি হেসে বলে উঠেন,
— এই তো ভালো মাইয়া! কথাটা মনে থাকে যেন। তুই যদি বিয়ে না করিস তাহলে,,,
সোহানার বাক্য সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই সোহাগী বলে উঠে,
— সত্যি মা আমি করবো বিয়ে। পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করবো না। তুমি শুধু এমনটা করো না।
— ঠিক আছে। যা তবে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আই। জমিলা, রুমা সাজিয়ে দিবো। আর আমি ভাত পাঠাইতেছি তুই খাইয়া নিস। বাসর ঘরে তোর জামাই যদি দেহে মুখ কালা, চোখের নিচে কালি, ঠোঁট শুকনা তাইলে কী হইবো জানিস! আমারে খারাপ কইবো। কইবো পচা মা’ল ধরাইয়া দিছি। তাই খাইস কইলাম।
কথাগুলো শুনতেই কেঁপে উঠলো সোহাগী। তার মা এতো নিষ্ঠুর কেন? তার আব্বার অর্ধাঙ্গী এমন পাষাণভার বিষয়টা সত্যিই আশ্চর্য জনক তার কাছে। বর্তমানে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানবী বলে মনে হচ্ছে। বুক চিরে কান্না আসছে। তার আব্বা আসবে কবে ফিরে! কেন সে সোহানার গর্ভে জন্ম নিলো। সৃষ্টিকর্তা কেন তাকে অন্য কোন নারীর গর্ভের সন্তান বানালো না। নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে সোহাগীর।
তড়িঘড়ি করে সোহানা চলে গেলেন। চোখের পানি মুছে ফেললো সোহাগী। এখন আর কেঁদে কোন লাভ নেই! তাকে শক্তিশালী হতে হবে। এতটুকুতে ভেঙে পড়লে চলবে না। মুহূর্তেই হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে পড়লো সে। দরজার দিকে চোখ দিয়ে দেখলো, কেউ নেই। জামিলা আর রুমা এসেছিলো কিন্তু চলে গিয়েছে। চোখ জোড়া বন্ধু করে সোহাগী বলে উঠলো,
— আল্লাহ আমার এতো বড়ো পরীক্ষায় ফেললে কেন? আমি যে আর পারছি না। আমার আব্বা কে আমার কাছে ফিরিয়ে দেও। আমাকে শক্তি দেও। আমাকে প্রগাঢ় ক্ষমতা দেও যেন পৃথিবীর কোনো ঝড় আমাকে আঘাত করার ক্ষমতা না রাখে। আব্বা কে আমার কাছে ফিরিয়ে দেও আল্লাহ! আমি শুধু একবার আব্বা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাই। তার কষ্ট, যন্ত্রণা সবকিছু আমাকে দিয়ে দেও। আমি আর কিছু চাই না। শুধু আব্বার মুখে বিজয়ের হাসি দেখতে চাই। আমাকে নিয়ে তার গর্ব ভরা চলের জল দেখতে চাই। আমাকে শক্তি দেও আল্লাহ। বলো তো তুমি ব্যতীত আমার আর কে আছে? তুমি যদি তোমার বান্দর কথা না শুনো তবে তোমার বান্দা যে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়বে।
_______________
চৌকির উপর সারি বেঁধে বসে রয়েছে কয়েক জন মহিলা। তাদের ঠোঁটে মুখে উপচে পড়া হাসির ধারা। সোহাগীর দিকে তাকিয়ে তারা মিটি মিটি হেসে চলছে অবিরাম! কয়েক জন বয়স্ক মহিলা গীত গেয়ে পরিবেশটা আরো আকর্ষণীয় করে তোলার প্রচেষ্টা করছে। তাদের ঠিক মধ্য খানে বসে রয়েছে সোহাগী। পরনে তার মোটা জামদানি শাড়ি! মেয়েটার সারা শরীর জুড়ে ভারী অলংকার! গলায় পরু হাড়, দু হাতে পুরু বালা, দু কানে ঝোলানো দুটো দুল, নাকে নথ, সিথি বরাবর ছোট টিকলি সব মিলিয়ে দারুণ দেখাচ্ছে মেয়েটা কে। তবে অলংকারের সাথে তার স্বাস্থ্য যেন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে! খানিক পূর্বে ভুঁইয়া বাড়ির পক্ষ থেকে গয়না গাটি সহ যাবতীয় সবকিছুই দিয়ে গিয়েছে কয়েক জন যুবক। অলংকার দেখে সোহাগীদের বাড়িতে আগত প্রায় সকালেই সোহাগী কে ভাগ্যবান বলে গণ্য করছে। সত্যি তো ভাগ্যবান না হলে কী এতো দামী অলংকার পড়ার সৌভাগ্য হতে মেয়েটার!
— সোহানা তোমার মাইয়ার মুখখান কালা হইয়া রয়েছে কেন? ভয় পাইতেছে বুঝি?
মহিলা গুলোর মধ্যে থেকে একজন অর্ধ বয়স্ক মহিলা হঠাৎ কথাটা বলে উঠেন সোহানার উদ্দেশ্যে। মুহূর্তেই হাসির রোল পড়ে গেলো চারপাশে। জমিলা নামের মেয়েটা সোহাগীর খোপা করতে ব্যস্ত ছিলো। তৎক্ষণাৎ রসিকতার ছলে মেয়েটা বলে উঠলো,
— বিয়ে আগের দিন আমি ও ডরাইছিলাম। কিন্তু পরে,,
আর কিছু বলতে পারলো না জমিলা। নিমিষেই তার মুখখানা রঞ্জিত হয়ে উঠলো লাল আভায়। তার অবস্থান লক্ষ্য করে বৃদ্ধ মহিলা ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন। তার গাল ভর্তি ছিলো একগাদা পানের রস। তিনি অতি দ্রুত রস ফেলে দিয়ে বলে উঠেন,
— হ হ আর শরম পাইতে হইবো না। সব মাইয়ারাই শশুড় বাড়ি যাওনের আগে কান্দে ভাসায়। কিন্তু পরের দিনই মাইগো দেমেগ বাইরা যাই। স্বামীর সোহাগী পাইয়া বাপের বাড়ির মানুষ গো ভুইলা যাই। আ্যজ সোহা কানতেছে তো কী হইছে। কাল দেখবা জামাইরে ছাড়া কিছু বুঝবো না। ও তোরা সোহারে ঢক কইরা সাজা যেন ওর রুপে জামাই বাবা পাগল হইয়া যায়।
বৃদ্ধ মহিলার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই পুনরায় ঘর ভর্তি থাকা মানুষগুলো অট্টহাসিটে ফেটে পড়লো। রুমা সোহাগীর পায়ে আলতা পড়ানো থামিয়ে হাসির সহিত বলে উঠে,
— পাগল তো হইবো। তয় শুনলাম বেডার নাকি আগে বিয়া হইছিলো। তা কাকি তোমরা সোহারে বিয়াত্তা বেডার লগে ক্যেন বিয়া দিতেছো। মানলাম ভুঁইয়া বাড়ির পোলা কিন্তু যাগো একটা বউ থাকে তারা নাকি দ্বিতীয় বউরে সহ্য করবার পারে না। আর ওই বেডার তো একখান ছাওয়াল ও আছে! ওই ছাওয়ালরে পাললে সোহাগী নিজের পোলাপান পালবো কখন? সৎ পোলাপান নিয়ে সংসার করা বহুত কষ্ট।
রুমার কথাগুলো শুনে ক্রোধে ফেটে পড়েন সোহানা। ইতোমধ্যে চারপাশ স্তব্ধ হয়ে পড়েছে, সবাই চুপ কারো মুখে কোনো কথা নেই! লহমায় সোহানা ক্ষোভের সহ্য রুঢ় কন্ঠে রুমাকে বলে উঠেন,
— আমার মাইয়াডার কান ভাংগাস কেন ছেমড়ি? সৎ ছাওয়াল নিয়ে সংসার করলে কী হয়! মানলাম সৎ কোনদিন আপন হইবো তয় কী হয়েছে, আমার মাইয়া সব সামলায়ে নিবো। দেখিস আমার মাইয়া তগো চেয়ে সুখী হইবো। জামাইয়ের মহব্বত দিয়ে সুখ কিনা যাই না। জীবনে সবচেয়ে বড়ো সুখ হইলো টাহা। টাহা ছাড়া জীবন চলে না। যার যতো টাহা যে ততো সুখী। আমার মাইয়া রাজধানী হইবো। ভুঁইয়া বাড়ি রাজত্ব করবো। বুঝছোস?
সোহানার কথাগুলো শুনে সোহাগীর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কয়েক জন মহিলা সোহানার তালে তাল মিলালেন। ধন সম্পদ হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড়ো সুখ। সত্যি ক সম্পদ মানুষ কে সুখ, আনন্দ, প্রশান্তি দিতে পারে! সংসারে শাস্তি নিয়ে আসে!
#সোহাগী
#অন্তিম পর্ব : ১৩
Lutful Mehijabin
কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ। সোহাগী কে ঘিরে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে সবাই। বিয়ের কনে বলে কথা! কতো মানুষের আনাগোনা, অথচ আমেনা সকাল থেকে একটি বারের জন্যও নাতির মুখ দর্শন করেনি! কিছুক্ষণ বাদে চিরকালের মতো নাতির বিদায় তবুও আমেনার হদিস নেই। রান্নার দায়িত্ব তার উপর অর্পিত করেছেন সোহানা। উঠানে চারটা শীতল পাটি বিছানো হয়েছে। আমেনার রান্না শেষ হয়েছে বেলা তিনটে নাগাদ। আসরের আযান পড়তেই রাশেদের চেনা জানা লোকগুলো ছুটে আসতে শুরু করেছে। অবশ্য এতে খরচ হলেও বিরক্ত হন নি সোহানা। সামান্য ডাল ভাতের আয়োজন! জন পঞ্চাশ মানুষের জন্য এই স্বল্প খরচ না করলে সবাই তাদের কী ভাববে! ভুঁইয়া বাড়ির আত্মীয় হয়ে কৃপণতা বড্ড বেমানান। সোহানা বুদ্ধি করে ভিন্ন খাবারের ব্যবস্থা করেছেন ভুঁইয়া বাড়ির লোকদের জন্য। কষানো লাল টকটকে মুরগির ঝোল, বাজার থেকে ক্রয় করে এনেছেন দু কেজি গরুর মাংস, টাটকা ইলিশ ভাজা, বাসন্তী চালের পোলাও এবং মিঠাই দিয়ে তৈরি পায়েশ। এসব খাবার গুলো নিজের হাতে তৈরি করেছেন সোহানা।
— সবাই খাইতে চলেন। বেডাগো বইঠক খাইয়া উইঠা পড়ছে। ঘরে কারো জন্যে খাওউন আনবেন পারুম না কইলাম।
সোহাগীর ভাই হঠাৎ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলে উঠে! ছেলেটার মুখশ্রী চিকচিক করছে। বোনের বিয়েতে কাজে লেগে পড়েছে খোকন। কাজের পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। গর্বে তার বুকটা ভরে উঠেছে। বন্ধুদের কাছে গর্ব করে বলছে, তার বোন ভুঁইয়া বাড়ির বউ হতে চলেছে! গ্রামের প্রভাবশালী পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করাটা তাদের নিকট। যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো আনন্দের।
খোকনের কথা শুনে একে একে সবাই চলে গেলো। মিনিট খানিকের মধ্যে পুরো জমজমাট ঘরটা নিরব হয়ে এলো। যাওয়ার আগে রুমা মেয়েটা পইপই করে বলে গেলো সোহাগী কে যেন সে বিছানা থেকে না উঠে। সবাই চলে যেতেই প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলো সোহাগী। তার বুক ফেটে কান্না আসছে। আজ যদি তার আব্বার কাছে মোবাইল নামক যন্ত্রটা থাকতো তাহলে কতোই না ভালো হতো। মোবাইল ফোন সম্পর্কে পাঠ্যবই এ বিস্তারিত তথ্য জানতে পেরেছে সোহাগী। গ্রামের দু একজন মানুষ কে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখলেও, তা ছুঁয়ে দেখার মতো ভাগ্য হয় তার। বিষয়টা মনে পড়তেই সোহাগীর বুকটা ভারী হয়ে এলো। মুহূর্তেই রফিক এবং তামিমের মুখশ্রী ভেসে উঠে তার চোখে! ওরা কী তার সাথে শেষ দেখা করতে এসেছে? পরক্ষণেই তার কথা মনে পড়লো সকালে সোহানা কৃত আচরণ। নিজের উপর ধিক্কার জানাতে লাগলো সে। এমন মায়ের পেট থেকে জন্ম নেওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার!
রফিক এবং তামিমের প্রসঙ্গ মনে কোণে উঁকি দিতেই সোহাগীর স্মৃতিতে ভেসে উঠে তাদের একসাথে অতিবাহিত মুহূর্তগুলো। তৎক্ষণাৎ আঁখির কথা ও মনে পড়লো চুপিসারে! আজ একবার আঁখির মা কে দেখেছিলো সোহাগী। মেয়েটার সাথে কয়েক যাবত তার দেখা সাক্ষাৎ হয় না। মেয়েটা কী তাকে ভুলে গিয়েছে। জানালার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথাগুলো ভাবতে লাগে সোহাগী। চৌকাতে বসলে জানালা দিয়ে একটা নারিকেল গাছ বরাবরই চোখে পড়ে সোহাগীর। উন্মুক্ত আকাশে গাছের পাতাগুলো হাওয়াতে দুলছে। আজ প্রকৃতি তার মতো উদাসীন! জানালা খুলে গাছটার দিকে তাকালে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সোহাগী।
এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে কেউ এসে জাপটে ধরলো সোহাগী কে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিনমিন করে বললো,
— আফা তুমি পালায় যাও। বিয়া করুন লাগবো না। বিয়া করা সুখের না।
আঁখির কন্ঠস্বর শুনে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে সোহাগী ঠোঁটের কোণে। মিনমিন গলায় সে বলে,
— তুই একশো বছর বাঁচবি আঁখি বুড়ি।
নিজের থেকে থেকে আঁখি কে ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটার মুখ জোড়া দু হাতের মাঝে আবদ্ধ করে নিলো সোহাগী। আঁখির চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লক্ষ করলো মেয়েটার চোখ জোড়া সজল! আপনজন হারানোর তীব্র আতঙ্ক তার চোখে স্পষ্ট। মেয়েটার শুষ্ক মুখ লক্ষ্য করে সোহাগী মলিন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
— কীরে, এতক্ষণ পর আমার কথা মনে পড়লো?
সোহাগীর কথার প্রত্যুত্তরে আঁখি ভাঙা গলায় বললো,
— কাকী তোমার কাছে আমারে আসবার দেই নাই। তাই আইবার পারি নাই। রফিক ভাই কইলো তুমি নাকি বিয়েতে রাজি না?
আঁখির কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো সোহাগী। সে যে এখন নিরুপায়। একমাত্র রাশেদের উপস্থিতি ব্যতীত তার পক্ষে বিয়ে না করে পালানোর কোনো উপায় নেই। সোহাগীর উত্তর না পেয়ে আশাহত হলো আঁখি। লহমায় উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো,
— তুমি পালাই যাও আফা। তোমার কিছু হইলে আমি ম’ইরা যামু। পদ্ম বুরে হারাইছি। এখন তোমারে হারাইতে চাই না।
আঁখির মুখ থেকে পদ্ম নামটা শুনে কেঁপে উঠে সোহাগী। বছর খানিক পূর্বে আঁখির বড়ো বোন পদ্মর বিয়ে হয় একজন একুশ বছরের যুবকের সঙ্গে। পদ্মর বয়স তখন মাত্র বছর ষোলো। তার স্বামী শহরে ইট ভাটায় কাজ করতো। বিয়ের তিনমাস পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিলো। অবশ্য বিয়ের পর যখন প্রথম পদ্ম বাবার বাড়িতে আসে তখন আঁখির মায়ের পায়ে ধরে কেঁদেছিলো পদ্ম। বাবা মায়ের কাছে বাইনা ধরেছিলো যেন তাকে স্বামী নামক জন্তুর কাছে না পাঠাই। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো সে সংসার করতে পারবে না। তাকে নাকি রাতে ভীষণ অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। হাত, পা, গলা, মুখ, ঠোঁট ইত্যাদি জায়গায় ক্ষত দেখেও কেউ তার কথা মেনে নেই নি। তার মা দেখেও দেখিও দেখেনি। আঁখির মা ভেবেছিলেন নতুন বউ হিসেবে বিষয়টা অস্বাভাবিক নয়! সেদিন বিদায়ের বেলায় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যায় পদ্ম। জ্ঞানহীন পদ্ম কে নিয়ে শশুড় বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেই তার স্বামী। তার ঠিক দু মাস পর পদ্ম বাপের বাড়িতে এসে মায়ের কাছে টাকা ভিক্ষে চাই। যৌতুক চেয়েছে তার স্বামী! সে প্রথমে যৌতুক দিতে রাজি হতে পারে নি। সে ই তো জানে তার আব্বা কতো কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে। তার পাঁচ ভাই বোনের খরচ চালিয়ে মোটা অংকের যৌতুক দেওয়া তার বাবার পক্ষে অসম্ভব! বাবার কথা ভেবে দিন কয়েক মুখ বুঁজে সহ্য করে গিয়েছে পদ্ম। পৃথিবীতে হয়তো এমন পদ্মের অভাব নেই যারা স্বামীর যৌতুকের দাবি পূরণ করতে না পেরে একমাত্র বাবার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিনিয়ত সহ্য করে আসছে সীমাহীন মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার! পদ্মর মা সেদিন বাধ্য হয়ে মেয়ে কে নিজের স্বল্প দামি গননা গাটি খুলে দিয়েছিলেন যৌতুক হিসেবে। কিন্তু এতেও পদ্মর স্বামীর চাহিদা মিটে নি। যার ফলে শুরু হয় পদ্মর প্রতি নিষ্ঠুর অত্যাচার। এরপর কিছুদিন মেয়ের কোনো খোঁজ পান নি তারা। কিন্তু তার ঠিক দু সপ্তাহ পর কোনো এক মধ্যে দুপুরে মাথায় পদ্মর সাদা কাপড় মোড়ানো লাশটা উঠোনে পড়ে থাকতে দেখেন তারা। নিজের সন্তানের মৃত্যু দেহ টা বাবা মায়ের কাছে কতোটা অসহ্যনীয় যন্ত্রণার হতে পারে তা হয়তো বলে বোঝানো মুশকিল। পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর হলেও বেলা শেষে সন্তানের মৃত্যুতে আফসোস করবেই পিতা মাতা।
পদ্মর আঘাত প্রাপ্ত লা’শের কথা স্মরণ হতেই কেঁপে ওঠে সোহাগী। পদ্মর শরীর আঘাতে ফুলে গিয়েছিলো। সারা দেহ দেখেই বোঝা গিয়েছে যে মেয়েটা এ কয়দিন কতোটাই না শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।
— সোহা আফা, তুমি পালাই যাও। ওই বুইড়া বেডারে বিয়া করতে হইবো না।
সোহাগীর দু বাহু ধরে ঝাকাতেই বাস্তবে ফিরলো। আঁখি বারংবার একই কথা বলছে! সোহাগী ভারি নিশ্বাস ফেলে মিনমিন স্বরে বলে,
— তুই এতো ভয় পাচ্ছিস কেন রে? চিন্তা করিস না আব্বা স্বপ্ন পূরণ করার আগ পর্যন্ত আমি ম’রবো না, ইনশাল্লাহ।
সোহাগীর কথার প্রত্যুত্তরে আঁখি ভীত কন্ঠে বললো,
— আ্যজ তো তোমার বাসর রাত হইবো আফা। তুমি জানো না আফা পদ্ম বু রে দুলাভাই বাসর রাইতরে মেলে মারছিলো। বু আমারে কইছে আঁখি নিজে বড়ো হইয়া যোগ্য ছেলে রে বিয়া করবি যে তোরে সম্মান করবো আর ভালোবাসবো। ছোট বেলায় বিয়া বইলে নাকি বাসর রাইতে মা’ইর খাইতে হয়। বু আরো কইছিলো আমি যদি মা’রই সহ্য করবার না পাইরা হাউমাউ কইরা কান্দি তাও কেউ আমারে বাঁচাইতেও আইবো না। বিয়ে করলেই শাশুড়ির আর স্বামীর মা’ইর খাইতে হয়। তুমি জানো আফা আমার পদ্ম বু রে বাসর রাতে দুলাভাই বেল্ট দিয়া পিটাইছে। বু আমার কাছে চুপিচাপি কইছে আর ফুপাই ফুপাই কাঁনছে। সোহা আফা আমি তোমারে হারাইতে পারুম না। রফিক ভাই, তামিম ভাই তোমার বাড়ির পাশ দিয়া ঘুরঘুর করতেছে কিন্তু কাকি ওগো ভেতরে ঢুকবার মানা করছে।
কথাগুলো তড়িঘড়ি করে শেষ করলো আঁখি। ইতোমধ্যে মেয়েটার কথাগুলো শুনে সোহাগীর আত্মা কাঁপতে আরম্ভ করেছে। পদ্মর মতো কী তাকেও মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হবে। আজ রাতে তবে কী তার স্বামী ও তাকে বেল্ট দিয়ে পিটাবে? স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটার উৎপত্তি ঘটলো সোহাগীর ছোট মস্তিষ্কে। আচ্ছা তার আব্বা কে সত্যি বুঝতে পারছে না যে তার সোহাগী কষ্টে আছে। সে কেনো তাকে উদ্ধার করতে আসছে না?
আঁখি সজল চোখে সোহাগীর হাত জোড়া শক্ত করে ধরেছিলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সোহাগী বাকরুদ্ধ! এমন সময় সোহাগীর ঘরে তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন আমেনা। অবশেষে অপেক্ষার অবসান! নানীর মুখশ্রী দৃশ্যমান হতেই স্বল্প মেঘ জমতে শুরু করলো সোহাগীর হৃদয়ে।
আমেনা ঘরে এসে হাঁপাতে লাগলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
— আঁখি রে তুই ওহনে যা। জমাইরা প্রায় চইলা আইছে। যা দেখ গিয়ে তোর মা কী করে।
আমেনার আদেশ পেয়ে সোহাগীর হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আঁখি। ঘর ত্যাগ করার পূর্বে সোহাগী কে চোখের ভাষার কিছু বলে গেলো। আঁখি চলে যেতেই ঘরের শক্ত কাঠের দরজাটা খিল দিয়ে দেন আমেনা। অতঃপর সাত প্যাচ না ভেবেই দৌড়ে গিয়ে সোহাগী কে জড়িয়ে ধরেন। মুহূর্তেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি। ক্রন্দনের সহিত উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করেন,
— তুই আর কোনদিনই এই বাড়িতে পা রাখিস না সোনা। আর কোনদিনই তোরে যেন এ বাড়িতে বাড়িতে না দেহি। ওরা তরে বাঁচাতে দিব না। তোরে মা’ইরা হেলাবো।
আমেনার অদ্ভুত কথাগুলো শুনে চমকে উঠে সোহাগী। কে এবং কারা তাকে মা’রতে চাই! আমেনা কেন তাকে এমন কথা বললো তা বোধগম্য হলো না তার। ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে ম্লান কন্ঠে বলে উঠলো,
–নানী তুমি শান্ত হও। এমন উত্তেজিত হচ্ছো কেনো! কে আমাকে মারতে চাই?
— তোর মা।
আমেনার পরিষ্কার জবাব! সোহানা তাকে মে’রে ফেলতে চাই! স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সোহাগী। কেনো তার মা তাকে মে’রে ফেলতে চাই? মুহূর্তেই তার চোখ জোড়া আপনা আপনি বৃহৎ আকার ধারণ করে উঠে। কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।
সোহাগী কে স্তম্ভ হতে দেখে কান্না বন্ধ করেন আমেনা। পরপর কয়েক টা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সতর্ক হন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশেপাশে চোখ বুলান। না, ঘরে কেউ নেই। তিনি তো দরজা বন্ধ করে এসেছেন। অতঃপর ভীত কন্ঠে কয়েক দিন পূর্বে সোহাগীর সাথে ঘটে যাওয়া চরম ভয়ঙ্কর ঘটনায় কথা বর্ণনা করতে শুরু করেন। যা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সোহাগী।
— তোর মা তোরে মা’রতে চাই। কয়েক দিন আগে যখন সোহানা তোরে মারুনের লাইগা দাও লইয়া মাঝরাইতে ঘরে ঢুহে। আমি তোর পাশে শুইয়া ছিলাম তাও তোর মাইর হাত পা কাঁপে নাই। কিন্তু ওইদিন তোর মাই তোরে মারবার পারে নাই। মা তো তোর তাই তোর দিকে ঝুঁইকা কাইন্দা দিছিলো।
কথাগুলো বলা শেষ করে বার কয়েক নিশ্বাস ছেড়ে পুনরায় আমেনা বলতে শুরু করেন।
— মনে আছে ওইদিন রাইতে তুই কইছিলি আমারে, তোর গলায় কীসের যেন পানি পড়ছে। আমি তোরে ওই সময় কইছিলাম তোর গলায় বৃষ্টির পানি পড়ছে। ওই পানি ফুটা কোন বৃষ্টির পানির ফুটা ছিলো না। ওই পানি ছিলো সোহানার চোখের পানি। ওইদিন ও তোরে মারবার পারে নাই। তুই বল মা হইয়া মাইয়ারে মারা যায়! আমি ভাবছিলাম সোহানা ভালো হইয়া গেছে। তাই সেদিন ওরে কিছু না বইলা বুঝাইছি। কিন্তু না, আমি ভুল ছিলাম। সোহানা হইলো আমার গর্ভের কালি। ওই তোরে বাঁচতে দিবো না। তুই আর আসিস না।
আমেনার কথাগুলো শেষ হওয়ার পূর্বেই তারা শুনতে পেলো বাইরের কোলাহল! কোনো ঝামেলা হয়েছে বোধহয়। মুহূর্তেই দরজায় কেউ এসে বারি মারলো। আমেনা চোখের জল মুছে দ্রুত দরজার খুলে দিলেন।
মলিন মুখে কয়েক জন মহিলা তৎক্ষণাৎ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লেন। জামিলা ভেতরে ঢুকে সোহাগীর হাত ধরে মলিন স্বরে বলে উঠলো,
— আই সোহা বর আইসা পড়ছো। তোর ভাগ্য কী ভালা রে। বিয়াত্তা বেডারে তোর আর বিয়া করতে হইবো না
জামিলার কথা শুনে আমেনা উত্তেজিত হয়ে বলেন,
— মানে! কী বলিতেছাস তুই?
— তুমি জানো না দাদি। ওই আমিরুল বেডার নামে কি খবর রটছে! ও বেডা নাকি শহরে জাইয়া ঝামেলায় পড়ছে। টিভি, রেডিও তে বেডার নামে কতো কী কওয়া শুরু করছে। তাই বর পালটায়া গেছে। এখহ সাফিদ ভুঁইয়ার লগে আমাগো সোহার বিয়া হইবো। আমার এহন হিংসা হইতেছে সোহারে। অবশ্য সাফিদ ভুঁইয়া নিজেগো সম্মান বাঁচাইতে বিয়া করতেছে।
কথাগুলো শুনে আমেনা আনন্দিত হলেন। সত্যিই তাদের উপর সৃষ্টিকর্তা অশেষ রহমত রয়েছে। সাফিদ ভুঁইয়ার মতো সৎ লোক কে গ্রামের কে না চিনে? পুলকিত তবে তা প্রকাশ করলেন না। সোহাগী পূর্বের ন্যায় ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। বর পাল্টে কীই বা হবে! পরিশেষে বিয়ে তো তাকে করতেই হচ্ছে।
______________
তিন সিটের প্রাইভেট ক্যার শো শো করে ছুটে চলছে ভুঁইয়া বাড়ির উদ্দেশ্যে। খানিক পূর্বে সাফিদ ভুঁইয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সোহাগী। সাফিদ ভুঁইয়া যে তাদের পরিবারের সম্মান বাঁচাতে বিয়ে করেছে কারোই অজানা নয়।সোহাগী বিদায়ের সময় কারো সাথেই আর কথা বলেনি। সোহানা আনন্দের সহিত তাকে বিদায় দিয়েছেন। সাফিদ ভুঁইয়ারা কিছু খান নি। বিয়ের কাজকর্ম সেরে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে তারা। বিদায়ের পথে রফিক এবং তামিম অবস্থা দেখে সোহাগীর বুকের ভেতর রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়। উঠেনের এক কোণে গেটের আড়ালে লুকিয়ে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে ফেলে রফিক। তামিম গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে গৌধুলির আলোতে দৌড়ে সরে যাই। যা লক্ষ্য করতেই দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সোহাগীর গাল বেয়ে। ইশ, তাদের কী আর কোনদিনই কথা হবে আগের মতো! আজ থেকে তাদের মাঝে পুরো দেয়াল তৈরি হলো।
আপন মনে ছুটে চলছিলো গাড়ির চাকা। তবে হঠাৎ মানুষ জনের ভিরের ফলে গাড়িটা থেমে গেলো। আশেপাশে মানুষ জনের কোলাহল! সোহাগীর ডান পাশে বসে রয়েছে আসমা। মহিলাটা ছেলের শোকে অঝরে কেঁদে চলছেন। এবং সোহাগীর বা পাশে বসে রয়েছে সাফিদ। ছেলেটার দিকে একপলকের জন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করেনি সোহাগী। তার কাছে স্বামী মানে একরাশ পীড়িত বিষাদ! কোনো কিছুই ভালো লাগছে না তার।
— কী হয়েছে ড্রাইভার? এখানে ভির কেন?
হঠাৎ সাফিদের কন্ঠস্বর পেয়ে শীতল হলো সোহাগীর হৃদয়। গম্ভীর, ভারী শ্রুতি মধুর কন্ঠস্বর! সাফিদের প্রত্যুত্তরে ড্রাইভার বলে উঠেন,
— জানি না স্যার।
–ওকে, ওয়েট আমি গিয়ে দেখছি।
কথা শেষ করে সাফিদ গাড়ি থেকে নামার জন্য ড্রোর খুললো সাফিদ। গাড়ির ড্রোর খুলতে সামনে একজন বয়স্ক লোক এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ালো। সাফিদ গাড়ি থেকে নামার পূর্বে লোকটি কে জিজ্ঞেসা করে,
— ভাই, কী হয়েছে এখানে?
লোকটা ভীত কন্ঠে যা বলে তা শোনার জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিলো না। বিশেষ করে লোকের কথাগুলো সোহাগীর কর্ণকুহুরে পৌঁছানো মাত্রই উন্মাদ হয়ে উঠে সে।
— খু’ন হইছে ভাই। আমাগো রাশেদ মিয়ারে কেরা যেন মাইরা নদীর পাড়ে ফালাইয়া রাখছে। ওর লা’শ দিয়া বিছরি পচা গন্ধ করিতেছে। মনে হইতেছে কেউ যেন ওরে পাথর ছুইড়া ছুইড়া মারছে। মাথা ফাইটা ঘিলু আলাদা হইয়া পইড়া আছে।
লোকটা কথা শুনে চমকে উঠে সাফিদ। দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ে মাটিতে পা রাখে। লোকটা পুনরায় বলে উঠে,
— ওইখানে জায়েন না ভাই। কী যে গন্ধ বমি পাইবো আপনার। খুব খারাপ লাগতেছে রাশেদের জন্যে। শুনছিলাম আইজ ওর মাইয়ার বিয়া আছিলো। আর এই দিনেই! আহারে। কেরা যে ওরে মা’রছে। খুনীর মনে মায়া দয়া নাই।
লোকটার কথাগুলো শেষ হওয়ার পরপরই হুমড়ি খেয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো সোহাগী। লোকটা কী বলছে? তার আব্বা কী সত্যিই এই পৃথিবীতে আর নেই? হাত পা অবস হয়ে আসে সোহাগীর। তার হাত পা কাঁপতে থাকে বিরতিহীন! গাড়ি থেকে বেরিয়ে লোক সমাজ কে উপেক্ষা করে আশেপাশে না তাকিয়ে আলতা রাঙা পায়ে ছুটতে থাকে সোহাগী। সোহাগীর শাড়ির আঁচল এলোমেলো হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। মেয়েটার চুরির ঝনঝন ধ্বনি তার অশ্রুর সাথে পালা করে ঝনঝন শব্দে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। সোহাগীর হাঁটু অবস হয়ে এসেছে। বাবার সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো ভেসে উঠছে তার চোখের পাতায়। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরে রাশেদ কোনদিনই আর বলবে না ‘সোহা মা কোথায় তুই’। তাহলে কে তাকে খাইয়ে দিবে আদুর করে, কে তাকে গল্প করতে করতে স্কুলে নিয়ে যাবে ভ্যানে করে, কেই বা তার হাজারো আবদার পূরণ করবে শূন্য পকেটে! সোহাগীর অনুভব হচ্ছে সে এই পৃথিবীতে নেই! তার আশেপাশে কেউ নেই। এ যেন এক অদ্ভুত মায়াজাল। সে একা বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে ছুটছে।
সোহাগী কে দৌড় দিতে দেখে সাফিদ দ্রুত পা চালালো। সোহাগী ভির ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই তার চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। গৌধুলির ঝাপসা আলোতে দৃশ্যমান হলো, চোখের সামনে পড়ে রয়েছে তার আব্বার নিথর দেহ। কেউ চরম ভয়ঙ্কর ভাবে লোকটার সারা শরীর আঘাত করছে। রাশেদের মুখের বিবরণ বুঝা যাচ্ছে ঠিকই তবে সমস্ত শরীর জুড়ে পোকার দলের ভির জমেছে! আশেপাশের লোকগুলো কেউ হাত দিয়ে কেউ আবার লুঙ্গির কাপড় তুলে নাক চেপে ধরেছে। বাজে দুর্গন্ধ! কিন্তু মেয়েটার নাকে কোনো গন্ধের ছোঁয়া নেই। সোহাগীর উপস্থিতি লক্ষ্য করে লোকজন নানান কথা বলতে শুরু করে।
সোহাগীর পৃথিবী থমকে গিয়েছে। মাথা শূন্য হয়ে পড়েছে। মিনিট খানিক সে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলো রাশেদের ক্ষত মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলে। তার আব্বা পরম শান্তিতে চোখ বুজে রয়েছে। আশেপাশের মানুষের হাহাকার সোহাগীর কান অবধি পোছালো না। হঠাৎ মেয়েটা ‘আব্বা’ বলে চিৎকার করে এলোমেলো পায়ে পা বাড়ালো রাশেদ কে জড়িয়ে ধরার উদ্দেশ্যে। ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ এসে সোহাগীর হাত টেনে ধরলো। সোহাগী কিছু বুঝে ওঠার আগে মেয়েটা কে যত্ন সহকারে আগলে নিয়ে নিজ বাহু ডোরে। নিজের বুকের সাথে সোহাগীর মাথা চেপে ধরলো সাফিদ। সে নিজেও অবাকের চরম সীমান্তে! এলাকায় এমন নৃশংস মৃত্যু সত্যিই অপ্রত্যাশিত তার নিকট। রাগে সাফিদের চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে উঠলো।
সাফিদের বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সোহাগী। সে যে পৃথিবীতে একা হয়ে পড়েছে! সোহাগীর মাথা হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কী বলে সান্তনা দেবে এই বাচ্চা মেয়েটা কে? তার যে কিছু বলার ভাষা নেই। তাও বিনীত গলায় বললো,
— নিজেকে শক্ত করো। পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। একদিন সবাই কে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। এই ধরণীতে কেউ কারো জন্য বাঁচে না। সবাই নিজের জন্য বাঁচে! একদিন তোমাকে ও চলে যেতে হবে তোমার আব্বার কাছে। একেই বলে ধরণীর নিয়ম।
(সমাপ্ত)