#স্ত্রী
পর্বঃ৫
লেখিকাঃ #তাওহীদা
জিনাত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।রায়ান পেছন থেকে এসে হালকা কাশি দিলো।জিনাত ঘুরে দাড়ালো।
– আমি বেরুচ্ছি।তুমি মায়ের কাছাকাছি থেকো।মায়ের সাথে গল্প করো,,আর কিছু প্রয়োজন হলে শিমুকে বলো।
জিনাত কিছুই বললো না,,শুধু শুনলো।জিনাত কিছু বলছে না দেখে,,রায়ান আস্তে বাইরে চলে গেলো।
রায়ান চলে যেতেই ওর মা আসলো, জিনাতের কাছে।
-জিনাত,,কি করছো মা,,একা একা বসে আছো কেনো?চলো চা বা কফি খেতে খেতে মা মেয়েতে মিলে গল্প করি।তা তুমি কি পছন্দ করো ,,চা না কফি?
-আসলে আমি একা থাকতেই বেশি পছন্দ করি,,বিশেষ করে যখন আমার মন মেজাজ ভালো থাকে না।
রায়ানের মা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।বুঝলেন,, জিনাত তার সাথে কথা বলতে চাইছে না।
-ঠিক আছে মা,,তোমার যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই থাকো।কোনো সমস্যা নেই।
এই বলে উনি চলে গেলেন।
রাতে রায়ান বাসায় এসে মায়ের ঘরে গেলো।গিয়ে মায়ের মুখটা মলিন দেখে ওর মনটা অস্থির হয়ে উঠলো।
— কি হয়েছে মা,,তোমার মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন? আবারো নিশ্চয়ই উল্টোপালটা চিন্তা করে মন খারাপ করে বসে আছো?
-নারে বাবা,,ওসব কিছু না।
-তবে?
-আমার অনেক বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে।জিনাত আর ওর পরিবারের উপর এতটা জোর খাটানো একদমি উচিত হয় নি।
-কিন্তু মা,এতে তুমি অনুতাপ করছো কেনো।জোর করেছি তো আমি।তুমি তো আর আমাকে শিখিয়ে দাও নি।
-কিন্তু আমি জানতাম,, তুই কি করতে পারিস।তারপরও তো তোকে নিষেধও করি নি।
-এসব বাদ দাও মা।যা হবার তা হয়ে গেছে।এই নিয়ে এখন মন খারাপ করো না।আর তুমি তো অন্তত জানো,,,আমি কেমন! তাই জিনাতকে নিয়ে এতো ভেবো না।
মায়ের সাথে কথা বলে রায়ান নিজের রুমে এলো।এসে দেখলো জিনাত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।ও চেঞ্জ করে আস্তে আস্তে জিনাতের পাশে গিয়ে দাড়ালো।জিনাত চিন্তার জগতে ডুবে ছিলো,,তাই রায়ানের উপস্থিতি টের পায়নি।রায়ান হালকা কাশি দিলো।জিনাত চমকে উঠে,, ওকে দেখেই গায়ের ওড়না ঠিক করে, একটু সরে দাড়িয়ে অন্য দিকে তাকালো।
-রাতের খাবার খেয়েছো?
—
–মায়ের সাথে গল্প করেছিলে?
—
–দুপুরে খেয়েছিলে?
—
–আমি তোমার সাথে কথা বলছি জিনাত,,উত্তর দিচ্ছো না কেন?
—
–তুমি কি কথা বলবে না ঠিক করেছো?
—
–কি সমস্যা তোমার?আমার মাথাটা বার বার গরম করাও কেন তুমি?
—
এবার রায়ানের মেজাজ গরম হয়ে গেলো।ও জিনাতের কাধ ধরে ওর দিকে ঘুরিয়ে বললো,,ভালো ব্যবহার গায়ে লাগে না?
তোমাকে বলেছিলাম মাকে সময় দিতে।
নিশ্চয়ই তুমি মার সাথেও কথা বলনি।তোমার জন্য মা মলিন মুখে বসে আছে।
এবার জিনাত কপাল কুচকে রায়ানের দিকে তাকালো।
–আমি আপনার মার সাথে কথা বলিনি,তাই উনি মলিন মুখে বসে আছে,,এই টুকুতেই এতো অস্থির হচ্ছেন আপনি।আর আমার বাবা মায়ের যে কাল থেকে আমার চিন্তায় কি অবস্থা হচ্ছে,,সেটা ভেবে আমার কেমন লাগছে,,তা সম্পর্কে কোনো আন্দাজ আছে আপনার?আপনজনের দূরত্ব কতটা কষ্টের আপনি কিভাবে বুঝবেন?
জিনাতের কথা শুনে রায়ান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো,,,
–আপনজনের দুরত্বের কষ্ট টা তো বোঝো,আপনজনকে হারানোর ভয় টা কত ভয়াবহ সেটা কি তুমি জানো জিনাত?
রায়ানের কথা শুনে জিনাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে,,,
রায়ানের চোখজোড়া টলমল করে উঠলো। করুন দৃষ্টিতে জিনাতের দিকে চেয়ে বললো,,,
-আমার মায়ের আয়ু আর বেশিদিন নেই জিনাত।ডাক্তার বলেছে,,আর বড়োজোর ৩ মাস,,তারপরই সব শেষ!
জিনাতের বুকটা ধক করে উঠলো, রায়ানের কথা শুনে।
–কি হয়েছে ওনার?
–ব্লাড ক্যান্সার! একদম লাস্ট স্টেজে ধরা পরেছে।এখন আর কিছুই করার নেই।
জিনাত চুপ হয়ে গেলো এই কথা শুনে।সকালে রায়ানের মাকে ওভাবে বলেছিলো ও,,এটা ভেবে এখন খারাপ লাগছে ওর।
–মায়ের খুব ইচ্ছে ছিলো,,মা বেচে থাকতে আমাকে সংসারী করে যাবে।একটা ভালো লক্ষী মেয়েকে আমার বউ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলো মা।মায়ের শরীর বেশি খারাপ এর দিকে যেতেই,,মা আমার বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো।কিন্তু তেমন কোনো মেয়েই মায়ের ভালো লাগছিলো না।কারণ মা একটা সংসারী আর ভালোমনের মেয়ে খুজছিলো,,যা এই যুগে বিরল। তাই যখনি মা তার দেখতে যাওয়া পাত্রীদের সাথে কিছুক্ষণ আলাদা বলতো,,তখনই তার মন উঠে যেতো,তাদের উপর থেকে,,কি জিজ্ঞেস করতো মা,,তা আমিও জানি না।
এমন করে হঠাৎ একদিন মা আর আমি ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরছিলাম,,তখন মা তোমাকে দেখে গাড়ি থামাতে বললো,,তুমি তখন একটা বৃদ্ধা ভিক্ষুক মহিলাকে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিচ্ছিলে।এই ব্যাপারটা মায়ের খুব ভাল লাগে।মা ফারদিনকে তোমার ব্যাপারে সব খোজ খবর নিতে বলে।ফারদিন তখনই তোমাকে ফলো করে তোমাদের বাসা চিনে আসে।আর আশেপাশের মানুষের থেকে তোমার সম্পর্কে খোজ খবর নিয়ে আসে।
তোমার সম্পর্কে সব কথা শুনে মায়ের তোমাকে খুবি পছন্দ হয়।মা পরদিনই তোমার জন্য বেশ কিছু শপিং করে তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়।কিন্তু তোমার বাবা সেদিন আমাকে দেখেই চিল্লাপাল্লা শুরু করে,,কারন সে কয়েকদিনি আমাকে রাস্তায় মারপিট করতে দেখেফেলেছিলো।
তাই সে আমার ব্যাপারে আর কিছু শুনতেই নারাজ। মায়ের কোনো কথাই সেদিন তোমার বাবা শুনলো না।আজেবাজে কথা শুনাতে লাগলো তোমার বাবা আমাদেরকে।শেষে টিকতে না পেরে তোমার বাবার কলার চেপে ধরেছিলাম।তখন মা আমাকে ছাড়িয়ে একটা থাপ্পড় দেয়।তোমার মা অবস্থা বেগতিক দেখে আমাদের কাছে ভাবার জন্য কিছুদিন সময় নেয়।
আমরা সেদিন চলে এসেছিলাম।এসে মা আমাকে খুব বকাবকি করে, কেনো আমি তোমার বাবার সাথে বেয়াদবি করেছি তাই।
আমি বুঝতে পারি,,মা তোমাকেই তার বউ মা হিসেবে চায়।আর আমি এও জানতাম তোমার বাবা মা ভেবে দেখার জন্য সময় নিলেও তারা কিছু একটা করবেই।তাই আমি লোক দিয়ে তোমাদের উপর নজর রাখি।আমি শুধু আমার অসুস্থ মাকে খুশি দেখতে চেয়েছিলাম,,তার জীবনের শেষ সময়ের ইচ্ছে গুলো পূরন করতে উদগ্রীব হয়ে গিয়েছিলাম,, তাই তখন ভালো-মন্দ, উচিত -অনুচিত আমার মাথায় কাজ করেনি।
বিশ্বাস করো জিনাত, আমি যা করেছি তাতে আমার মায়ের কোনো হাত নেই।সে এসব কিছু জানতোই না।কিন্তু হয়তো ভেবেছিলো আমি এমন কিছু একটাই করবো,,তাই সেদিন তোমাকে আনার পরে মা অতোটা অবাক হয়নি।
কিন্তু সেদিন আমি মায়ের চোখেমুখে যে খুশির ঝিলিক দেখেছিলাম,,,আজ তোমার এই মলিনতার জন্য,, তা হারিয়ে যাচ্ছে।
আমি জানি তোমার এই বিমর্ষতা, মলিনতার জন্য একমাত্র আমিই দায়ি।একেতো তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি,,তার উপর কাল রাতে,,,,
আমি স্বীকার করছি,,আমি তোমার সাথে যে অন্যায় করেছি,তা ক্ষমার অযোগ্য। আসলে বিশ্বাস করো,, কাল রাতে তোমার ওসব কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো,,তারপর রাগের মাথায় কি থেকে কি হয়ে গেলো,,,,
এইটুকু বলে রায়ান চুপ হয়ে গেলো। জিনাতও চুপ করে মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে।
-আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো না জিনাত,,কারণ আমি জানি,আমি যা অন্যায় করেছি তোমার সাথে,,তা এই জীবনে তুমি ক্ষমা করতে পারবে না।
তুমি আমাকে শাস্তি দিও,,তোমার মনের মতো করে আমাকে কষ্ট দিও।শুধু এইটুকু অনুরোধ,, আমার মা যতদিন বেচে আছে,,শুধু সে কয়টা দিন আমার শাস্তিটুকু স্থগিত রাখো।শুধু সে কয়টা দিন আমার মায়ের সামনে সুন্দর করে সংসার করার অভিনয়টা করো।আমি কথা দিচ্ছি,,আমি সবসময় তোমার থেকে অনেক দূরে থাকবো।তোমাকে অযথা বিরক্ত করবো না।এই রুমের ভিতর তুমি তোমার ইচ্ছেমতো থাকবে।একজন মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের দিকে চেয়ে তুমি কয়েকটা মাস আমায় একটু সহ্য করো।তারপর যদি তুমি চাও,,,তুমি আমাকে ছেড়ে,এই জীবন ছেড়ে,,নতুনভাবে জীবন শুরু করো,আর তাতে আমি তোমাকে সর্বাত্মক সাহায্য করবো।ওয়াদা করছি(টলমল চোখে বললো রায়ান)।
এতক্ষণ জিনাত চুপ করে ছিলো।এবার চোখটা মুছে রায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,,,,
আপনি ঠিক বলেছেন,,আপনি যা করেছেন,,তা এই জীবনে তো ভালোকথা,, আখিরাতেও আমি আপনার উপর দাবি ছাড়বো না।আপনি শুধু আমার জীবন টাই নষ্ট করেননি,,সেই সাথে আমার পড়াশোনা, আমার স্বপ্ন , ভবিষ্যত সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন।আপনাকে তো আমি শাস্তি দিবোই, তা সে যেভাবেই হোক।
কিন্তু,, একজন মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের দিকে তাকিয়েই আমি ধৈর্য ধরবো,,সেই দিনটার জন্য।
এই বলে জিনাত ভিতরে চলে গেলো।আর রায়ান,,চোখের কোনের পানিটুকু মুছে,,একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকালো।
(চলবে)