স্বপ্নের চেয়ে মধুর পর্ব -০৬

#স্বপ্নের_চেয়ে_মধুর❤️
লেখাঃ সুমাইয়া ইসলাম মিম

পর্ব-সাত

.
স্পর্শের এমন ধারা কথা শুনে বেলা তৎক্ষনাৎ চলে এসেছিল বাসায়। কিন্তু বাসায় ফিরেই যেন সে আসল ঝটকা খেয়েছিল! সে রুমে যাওয়ার সময় স্পর্শকে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। তাহলে নিচে কে ছিল? বেলা কি তাহলে আসলেই স্বপ্ন দেখেছে? কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? বেলার মনে হঠাৎই ভয় চেপে বসলো। এতোদিন স্বপ্নে দেখতো সেটা এক বিষয় তাই বলে বাস্তবে হ্যালুসিনেশন হওয়ার মতো তো হওয়ার কথা নয়! আর যেহেতু সে বাসায় ঢুকেছে আর আগে তো স্পর্শের বাসায় পৌঁছানোও সম্ভব নয়! বেলার হাত পা কাঁপছে। কি হচ্ছে তার সাথে? ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসে গেলো। তার মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এর উত্তর এখন স্পর্শই দিতে পারবে।

চট্টগ্রাম এসেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক হতে চললো। এখনো বেলা তার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে নি। তাই আজ সুযোগ বুঝে নতুন একটা সিম থেকে তার বাবার ফোনে ফোন দিলো। দু বার রিং বাজতেই রিসিভ হলো ফোনটা।

-“আসসালামু আলাইকুম!”

-“ওয়া-আলাইকুমুস সালাম, বাবা! আমি বেলা বলছি।”

বেলাল শেখ আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলেন যেন।

-“মা তুই কেন ফোন দিয়েছিস? রাফাত আমাদের দিকে কড়া নজরে রেখেছে। তোকে ট্র‍্যাকও করতে পারে।”

-“চিন্তা করো না বাবা। এই সিমটা আমি আমার নামে কিনি নি। আর তোমার সাথে কথা শেষ হতেই এটা নষ্ট করে দেব। তোমরা কেমন আছো বাবা?”

-“মা রে তুই আমাদের একটা মাত্র মেয়ে। তোকে ছাড়া কেমন থাকি বল! তার উপর রাফাতের নিরব অত্যাচার যেন বাড়ছেই। ছোয়াছুয়ি ছাড়াই ও আমাদের এক প্রকার ঘরবন্দী করেছে। আমাদের নিয়ে চিন্তা নেই। তুই নিজেকে সামলে রাখ। তোর চিন্তাই হয় শুধু। মা তুই ভালো আছিস তো?”

-“বাবা আমি যেখানে আছি আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। শীঘ্রই একটা চাকরি যোগার করে তোমাদের আমার কাছে নিয়ে আসবো। আমি তোমাদের সাথে এভাবেই কথা বলব। তুমি কল কেটে নাম্বারটা এখনই ডিলিট করে দিও।”

বেলাল শেখ নাম্বারটা টুকে রেখে যথাসম্ভব কথা শেষ করে নাম্বারটা ডিলিট করে দিলেন। এবং ওদিকে বেলাও সিমটা নষ্ট করে ফেললো। বেলা খুব ভালো করেই জানে রাফাত তার বাবার ফোন হ্যাক করতেই পারে। কিন্তু রাফাত যে এখানেই মস্তবড় ভুল করে বসলো। কিন্তু রাফাতের বুঝার আগেই বেলাল শেখ তার মেয়ের সাথে কথা বলা শেষ করেছিলেন। এবং তাদের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করছিলেন। বেলাল শেখ চেয়েছিলেন থানায় জিডি করে রাখতে কিন্তু রাফাত সেই পথটাও বন্ধ করে দিলো। বেলাল শেখ এবং আদ্রিতা জামানকে সর্বোচ্চ নজরে রেখেছে। রাফাতের মতে তারা অবশ্যই মেয়ের জন্য উতলা হয়ে মেয়ের কাছে যাবেন। বেলা আসবে না সেটা সে জানতো। বেলা যথেষ্ট কঠোর একটা মেয়ে। সে নিজের আবেগ কে বিবেক দিয়ে বশ করে ফেলে। কিন্তু রাফাতকে ভুল প্রমাণ করলো বেলার বাবা মা। তাদের ভাবমূর্তি এমন যেন কিছু ঘটেই নি। ইহকালে তাদের কোন মেয়েই ছিল না। এবার রাফাত বুঝতে পারলো কেন বেলার চরিত্র এতো কঠিন।

.
সকাল থেকে সেই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে থামার কোন নাম গন্ধ নেই। বেলা আজকেও দু’জায়গায় ইন্টারভিউ এর জন্য যাবে ভাবছিল কিন্তু এই মুশলধারে নামা বৃষ্টি সব ভেস্তে দিচ্ছে যেন। সকালে তাড়াতাড়ি বের হতে চেয়েও ঝুমার বকুনি খেয়ে সে তাদের বাসায় সকালের নাস্তা সারলো। খাওয়ার সময় সে স্পর্শকে দেখে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল,

-“আচ্ছা স্পর্শ সাহেব আপনি কখন ঘুম থেকে উঠেছেন?”

স্পর্শ বেলার দিকে বেশ বিরক্তিতে তাকিয়ে বলেছিল,

-“মাত্রই তো ঘুম থেকে উঠে এলাম। দেখেন নি?”

বেলা হকচকিয়ে গিয়েছিল। সে খেয়াল করেছে স্পর্শ ইদানীং তার সাথে বেশ রুডলি কথা বলে। কারণ টা তার অজানা। সে তো স্পর্শকে ভালো করে চেনেও না। প্রতিদিন এর মতোই সে আজও চোখে গাঢ় কাজল লেপ্টেছে। বাসা থেকে বের হবার সময় সে শুনতে পেল স্পর্শর আওয়াজ,

-“তন্নি তোমাকে কতবার বলেছি চোখে কাজল দেবে না? দেখতে কি বিশ্রী লাগে। সেই কাজল দেওয়া ছবি আবার তুমি আমাকে কিভাবে দেও?”

বেলা এবার যেন খুব বেশিই অবাক হলো। সে জানে বাস্তব আর কল্পনা ভিন্ন হয়। তাই বলে এতোটা? তার স্বপ্নপুরুষ এর সাথে স্পর্শের কোন মিলই নেই। আর সে কিনা এক মরিচিকার পিছনে ছুটে চলেছে এতোদিন? সেদিনই তো সে ঝুমার থেকে জানতে পারলো স্পর্শের প্রেমিকার কথা। চার বছরের প্রেম তাদের। বিয়ের কথাও মোটামুটি পাকা। তবে বাধ সেধেছেন ঝুমার মা। সে তন্নি মেয়েটাকে একদমই পছন্দ করে না। তার উপর ছেলেটাও তার ছোট। এখন সে কিছুতেই বিয়ে দিবেন না। বেলার বুঝে আসে না এই দামড়া ছেলে ছোট কি করে হয়! ঝুমা আরো কিছু বলতো কিন্তু তার আগেই ঝুমার স্বামীর ফোন আসায় সে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সেদিনই বেলা বুঝতে পারে স্পর্শের সাথে তার স্বপ্নপুরুষের চেহারা মিলে যাওয়া টা একটা মিরাকেল ছাড়া কিছুই নয়। তাই বেলা সবটাই ভুলতে চাইলো। অবাধ্য মনটাকে বশে আনতে চাইলো। কিন্তু স্বপ্নপূরুষ যে তাকে ভুলতে দিচ্ছে না। বাস্তবে স্পর্শকে পাওয়া একদমই অসম্ভব। স্পর্শ অন্য কাউকে ভালোবাসে। এই একটা বিষয়ে সে বাধা। আর যাইহোক অন্য কারো ভালোবাসা ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ছ্যাচড়া মেয়ে সে নয়।

.
স্বামীর অবহেলা নিয়েও এক ভরা সংসার সামলাচ্ছে হুমায়রা। শ্বশুর শাশুড়ির সময় মতো খাওয়া, ঘুমানো, বাড়ির কাজ সবটাই এক হাতে সামলায় সে। তবে এ বাড়ির বড় মেয়ে রাফিয়ার স্বামীর নজর তার একদমই সহ্য হয় না। বেহায়ার মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ননাশের স্বামী বলে কিছু বলতেও পারে না। কাকে বিচার দিবে? যাকে সবটা বলা উচিত সে নিজেই তো হুমায়রাকে সহ্য করতে পারে না। সময় কোথায় তার হুমায়রার জন্য? এই যে দুইদিন হলো রাফিয়া তার স্বামীকে নিয়ে বাপের বাড়িতে এসেছে। এসে থেকেই খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে সে হুমায়রাকে। মাঝে মাঝে হুমায়রা আফসোস করে। সে কেন বেলার মতো সাহসী হতে পারলো না? সে মনে মনে ক্ষোভ পুষে রাখলেও সামনাসামনি কোন প্রতিবাদ করতে পারে না। অন্যায় দেখেও সে কিচ্ছুটি বলতে পারে না। মুখটা যেমন অসাড় হয়ে আসে। আর ঠিক এটার জন্যই রাফাত তাকে দেখতে পারে না। সেদিন রাতেও তো তাই ঘটেছিল! না চাইতেও হুমায়রার চোখ দিয়ে পানি পড়লো। মনে হয় যেন বুকে কেউ পাথর চেপে ধরছে।

.
তীব্র অপরাধবোধে মাথা নত হয়ে এসেছিল হুমায়রার। সে অজান্তেই কি করে ফেললো। সে কেন তার অনুভূতিটাকে আটকাতে পারলো না? অস্থিরতা তাকে অনুভূতিহীন করে দিচ্ছিল। রাফাতের কাছে ক্ষমা না চাওয়া অবধি সে শান্তি পাবে না। ভালোবাসার জন্য না হোক বন্ধুত্বের খাতিরে সে ক্ষমা চাইবে রাফাত এর কাছে। এবং এক্ষুনি! হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য হয়ে গেল হুমায়রার। ঘড়ির দিকে তাকালে দেখতে পেতো এখন বাজে রাত দুটো!

রাফাতের রুমে এসে কড়া নাড়তে লাগলো সে। বেশ অনেকক্ষন কড়া নাড়ার পর দরজা খুললো। রাফাত উকি দিতেই দেখলো হুমায়রা। কেমন কাচুমাচু করছে। রাফাত আশপাশ তাকিয়ে বলল,

-“কি চাই?”

হুমায়রা অস্থির ভঙ্গিতে বলল,

-“রাফাত ভাইয়া আপনার সাথে কিছু কথা ছিল!”

রাফাত ভ্রু কুঁচকে বলল,

-“যা বলার সকালে বলো, রাত হয়েছে, ঘুমাতে যাও।”

হুমায়রা অবাধ্য হয়ে রাফাতকে ঠেলে রুমে নিয়ে গেল।

-“কথাটা জরুরি। তাই এখনই বলতে হবে নয়তো আমার চোখে ঘুম আসবে না।”

বলতে বলতেই সে রুমে তাকিয়ে তাজ্জব বনে গেলো। রাফাতের নেশা করার অভ্যাস আছে সে তো তা জানে না! অবাক হয়ে রাফাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

-“আপনি এগুলো..”

কথা শেষ হওয়ার আগেই রাফাত তাড়াহুড়ো করে বলল,

-“যা বলার জলদি বলে বিদেয় হও।”

হুমায়রা আবার কাচুমাচু করে বলল,

-“আসলে আমি মাফ চাইতে এসেছি। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিন। আমি আসলে তখন নিজের মধ্যে ছিলাম না।”

রাফাত হুট করে এসে হুমায়রার গাল চেপে ধরলো। তার চোখ দুটি ভীষণ লাল হয়ে আছে। উষ্কখুষ্ক চুলগুলো আর লাল চোখ দুটো যেন তার ভয়ের মাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল।

-“এই ক্ষমা চাইলেই কি সবটা আগের মতো হবে? তুমি জানতে না আমি বেলাকে ভালোবাসি! ও আমাকে আর কখনোই মানবে না। কি ভাবছে ও আমাকে?”

কথাটা বলতে বলতেই সে গিয়ে খাটে বসে পড়লো। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে তার। হুমায়রা দাঁড়িয়ে কান্না করছে শব্দবিহীন। বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হতেই রাফাত কান্নার জন্য বিরক্ত হয়ে হুমায়রার দিক তাকালো। নেশাটা যেন বেশ ঝেকেই ধরেছে। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বলল,

-“বেলাহ!”

হুমায়রা শুনতে পেল না আওয়াজ। আর বুঝতেই পারলো না রাফাত তার মাঝেই বেলাকে দেখতে পারছে। আস্তে করে এগিয়ে এলো রাফাত। হুমায়রাকে জড়িয়ে ধরতেই হুমায়রা কেঁপে উঠলো। কি করছে রাফাত! অঘটন ঘটার আগেই রাফাতকে থামানো উচিত। সে নিজের মধ্যে না থাকলেও হুমায়রা ছিল সজ্ঞানে। কিন্তু পারলো না সে প্রতিবাদ করতে না পারলো নিজের অনুভূতি থামাতে! সঁপে দিল নিজেকে রাফাত এর কাছে।

সকালে উঠে রাফাতকে বেঘোরে ঘুমোতে দেখে তার গত রাতের কথা মনে পড়লো। অপরাধবোধ যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। সে তাড়াতাড়ি উঠে নিজেকে পরিপাটি করে ছুটলো নিজেদের কক্ষে। বেলা তখন মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। উঠে সে হুমায়রাকে দেখতে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেছিল কিন্তু তখনই হুমায়রা রুমে এসে গোসলে চলে গেল। বেলা বুঝতে পারলো না এই ঠান্ডার দিনে হুমায়রা এতো সকালে গোসলে কেন গেল।

আজকেই তাড়া সিলেট থেকে ঢাকায় চলে যাবে। সবাই তৈরি হয়ে জড়ো হতেই রিসেপশনের কাছে এক মহিলা বেশ রুষ্ট গলায় বলল,

-“ছেলেমেয়েদের কেন যে বাবা মায়েরা একা ছাড়ে বুঝি না বাপু! এইসব ট্যুরের নাম করেই তো এসে নষ্টামি করে। কাল রাতে করিডর দিয়ে হাটছিলাম তখন দেখি এই ফর্সা মেয়েটা ওই ছেলেটার রুমে ঢুকে গেল। ছিহ! কাল রাতে আবার সবার সামনে ঠোঁটে চুমুও দিয়ে বসলো। ছিহ! কি দিনকাল পড়লো!”

বেলা সহ সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো। বেলা হুমায়রার দিকে তাকাতেই দেখে সে কান্না করছে। তার গলায় থাকা দাগটিই প্রকাশ করলো কাল রাতের ঘটনার সত্যতা। কিন্তু কিভাবে কি? রাফাতের দিকে তাকিয়ে দেখে রাফাত নিজেও অবাক। সে বুঝতে পারছে না কখন হুমায়রা তার রুমে গেল। বেলা হুনায়রাকে জিজ্ঞাসা করতেই হুমায়রা কোন উত্তর দেয় না। কি জবাব দেবে সে? তার নিজের ভুলের জন্যই তো সে তার সতীত্ব হারালো। এখন কিভাবে মিথ্যে বলবে? এখানে রাফাতের দোষ ও সে খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ রাফাত তার কাছে যায় নি। বরং সেই গিয়েছে রাফাতের কাছে। হুমায়রার নিরবতা যেন বেলাকে আরও বিধ্বস্ত করে তুললো। রাফাত এসে হুমায়রার বাহু ধরে কঠোর গলায় বলল,

-“এইসব মিথ্যে তাই না? তুমি তো কালকে আমার রুমে আসো নি। তাহলে এই মহিলা কি বলছে? হুমায়রা প্লিজ সত্যি কথাটা বলো। এখানে আমাদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠছে! বুঝতে পারছো? কিছু বলো ড্যাম ইট!”

হুমায়রা এবারও চুপ। কথায় আছে না অতি শকে মানুষের বাকশক্তি লোপ পায়। হুমায়রার হলো সেই দশা। সে চেয়েও কিছুই বলতে পারলো না। রাফাত অনেক চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারলো না। ওখানে উপস্থিত মানুষেরা তাদের জোর করেই বিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু রাফাত কিছুতেই বিয়ে করবে না। এ নিয়ে আরো কয়েকদফা কথা চললো। অবশেষে বেলা রাফাতের কাছে এসে বলল,

-“রাফাত এই বিয়েটা তুমি করছো! তোমাকে আমার দিব্বি!”

ব্যস! রাফাতের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সে হুমায়রাকে বিয়ে করলো। না চাইতেও এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল রাফাত-হুমায়রা।

(চলবে)..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here