#স্বামী
#লেখনীতেঃ_নুসরাত_জাহান
#পর্বঃ_৩৩
জান্নাত জানালার পাশে সিটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বাহিরে দিকে তাকিয়ে আছে। বাতাসে তার সামনের চুলগুলো উড়ে উড়ে চোখের সামনে পরছে। সোহান অপলোকভাবে তাকিয়ে হাসছে। গাড়ি চলছে। হঠাৎ সোহান জান্নাতের হাত ধরল। জান্নাত চমকে উঠে সোহানের দিকে তাকায়। কিছু বলবেন?
– তুমি কী এখনো আমার উপরে রেগে আছো? আমি যে অন্যায় করেছি সেটা হয়তো ক্ষমার যোগ্য নয় তবুও মন দিয়ে ক্ষমা চাইছি। জান্নাত আমি আমার ভুলের জন্য অনুতপ্ত। তুমি একটিবার আমাকে ভালো হওয়ার সুযোগ দাও।
-“………..”
– এভাবে চুপ করে থেকো না প্লিজ বলো যে আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিয়েছ।
– আপনি কী পাগল হয়ে গেছেন? পাব্লিক প্লেসে বসে এসব ঝামেলা করার মানে কী বলুন তো? সবাইকে জানাতে চাচ্ছেন যে আমরা ঝগড়া করে বাসে উঠেছি। এতে কী আপনার সম্মান বাড়বে না কমবে?
– কী হবে সেটা মূখ্য বিষয় নয়। তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ কিনা সেটাই কথা! প্লিজ জান্নাত, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। তুমি ক্ষমা না করলে মনের ভেতরে শান্তি পাচ্ছি না।
-“……….”
– এভাবে চুপ করে থেকে আমাকে কষ্ট দিতে কী তোমার ভালো লাগে? জানো আমি কতটা কষ্ট পাচ্ছি।
-“……..”
– জান্নাত আমার জন্য কী তোমার একটুও মায়া লাগে না? আমি কতটা কষ্ট পাচ্ছি একটু অনুভব কর? প্লিজ এভাবে চুপ করে থেকো না কথা বল?
– আমার ভালো লাগছে না।
– তুমি আমার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে পর।
– নাহ্। জান্নাত মাথাটা কাৎ করে সিটের উপরে শুয়ে পরল।
সোহান দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
বাস গিয়ে স্টেশনে থামল। জান্নাতের এখনো ঘুম ভাঙেনি। সোহান জান্নাতের হাতের উপরে তার হাত রাখতেই জান্নাতের ঘুম ভাঙল। আড়মোড়া দিয়ে সোহানের দিকে তাকায়।
– আমরা এসে গেছি। নামবে উঠ।
জান্নাত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। সোহান লাগেজ হাতে নিতে বাস থেকে নিচে নামল। জান্নাত সোহানের পিছনে নামল।
বাস ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে। দুপুরের প্রখর রৌদ্রে কপাল বেয়ে তরতর করে ঘাম পরছে। সোহান এক পলক জান্নাতের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল।
জান্নাত সোহানকে বলছে, শুনুন আমি হাঁটতে পারছি না। পায়ে প্রচুর পেইন করছে।
মুখটা ঘুরিয়ে একটু পিছনের দিকে তাকিয়ে বলল,
– রিক্সা তো পাচ্ছি না। একটু অপেক্ষা কর এখুনি পেয়ে যাব। জান্নাত কথা বলাতে সোহান মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছে।
একটুপরে কারও কণ্ঠস্বর শুনে পিছনে ফিরে তাকায় সোহান। রহিম চাচাকে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। চাচা আপনি? কেমন আছেন?
– আল্লায় যেমনি রাখছে তেমনি আছি। তা তুমি এই রৌদ্দুরে কই যাইতাছ? লগে মাইয়াডা কেডা?
– কোথাও যাচ্ছি না। শ্বাশুড়বাড়ি থেকে মাত্রই আসলাম।
– কও কী এইসব? তুমি বিয়া করলা মুই তো এট্টুও হুনলাম না। চুপিচাপি বিয়া করলা।
– চাচা রাগ করবেন না। আসলে বিয়েটা এত ফাস্ট হয়েছে যার কারণে আমি কাউকে বলতে পারলাম না।
– হইছে বাবা, এহন তোমরা রিক্সাডায় উঠে পর আমি তোমাগো বাসায় পৌঁছাইয়া দিয়া আহি।
– তাইলে তো ভালোই হয়।
সোহান লাগেজ তিনটা রিক্সায় তুলে জান্নাতকে উঠিয়ে তারপর নিজে বসল।
একটুপরে রিক্সা গিয়ে দরজার সামনে থামল। দোতালা থেকে সাথী দেখতে পেয়ে দৌঁরে নিচে নামল। জান্নাতের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। জান্নাতের কাছে যেতে আনইজি ফিল করছে সাথী ।
জান্নাত রিক্সা দিয়ে নামতেই সাথী জান্নাতকে জড়িয়ে ধরে জান্নাতও কাঁদল।
– সাথী কেমন আছো?
– আমি কেমন আছি সেটা জেনে তোমার কী হবে? তুমি কেমন আছো তাই বলো?
– আমার ভালো দিয়ে কী করবা? আমাকে তো বেশ করে রেখে গেছে? আজকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞাস করছো আমি কেমন আছি। তাইলে শোন, আমি ভালো আছি।
– এভাবে বলছো কেন? আমার শুনে ভীষণ খারাপ লাগছে।
– সত্যি খারাপ লাগছে ভাবী? তুমি জানো তোমার কারণে মা কতটা চিন্তিত ছিল। তোমাকে মা আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসতো আর তুমি তার কথাটাও একটিবার ভাবলে না? তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে মা ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে না। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তুমি কী ভাবছো তোমাকে ছেড়ে ভাইয়াও ভালো আছে? একদম না। ভাবী তুমি যাওয়ার পরে ভাইয়া পাগলের মতো ছটফট করেছে কিন্তু অসুস্থতার জন্য সে তোমার কাছে যেতে পারেনি।
জান্নাত মুখটা পিছনে ঘুরিয়ে সোহানকে দেখতে না পেয়ে অবাক হয়ে যায়। জান্নাতকে বলল,
– আমাকে কী এখানে দাঁড় করিয়ে রাখবা নাকি ভিতরে আসতে বলবা! শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।
– স্যরি ভাবী, আসো ভিতরে। দরজা আটকে দিয়ে রুমে ঢুকলাম। সম্পূর্ণ রুমটা তার পছন্দের ফার্নিচার, ওয়ালমেট, দেয়ালের দু’পাশে বাচ্চাদের ছবি টানানো। জান্নাত দেখছে আর অবাক হচ্ছে।
– ভাবী আমি গিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করছি তুমি ততক্ষণে বিশ্রাম নাও।
– চা নয় কফি দিও। বর্তমানে চায়ের থেকে কফিটা ভালো লাগে।
– হুম। ওহ্ হ্যাঁ, শুভ আপু গতকালকে সকালে এসেছে। একটু আগে তার একটা বান্ধবী কল দিয়েছে তাই সেখানে দেখা করতে গেছে। দুলাভাই ছুটি পায়নি তবুও আপু মায়ের অবস্থা দেখে চলে এসেছে। এটাই তো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
সাথীর কথা জান্নাত ভালো করে শুনল। এবাড়ির সবাই ভীষণ আন্তরিক। শুধুমাত্র একজন বাদে। যাকে ঘিরে সারাজীবন সংসার করতে হবে সে ঠিক না থাকলে সেখানে সংসার করা যায় না। মানুষটার প্রতি ঘৃণা জন্ম হয়ে গেছে।
দরজায় কলিং বেল বাজলে সাথী গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। শুভ আপু ভিতরে আসল। সাথী জান্নাত কী এসেছে?
– হ্যাঁ আপু, একটু আগেই এসেছে।
– ঠিকাছে।
শুভ গিয়ে মায়ের দরজার কাছে দাঁড়ায়। মা নামাজ পরছে। অনেকক্ষণ মায়ের রুমের সামনে অপেক্ষা করছে শুভ। নামাজ পড়া শেষ হলে সালাম ফিরে শুভকে দেখে জায়নামাজ তুলে তসবি হাতে নিয়ে বিছানার উপরে বসল।
কী রে শুভ তুই কখন আসলি? জান্নাত কী এসেছে?
– এই তো আসলাম। এসেই তোমার কাছে এলাম। মা আমার কাছে জান্নাতের আসাটা স্বাভাবিক লাগছে না।
– আমার কাছেও তাই মনে হচ্ছে। হয়তো সোহানের চাপে পরে আসতে বাধ্য হয়েছে কিন্তু এভাবে জোর করে তো সংসার করা যায় না। জান্নাতের সাথে এ ব্যাপারের খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত।
– আলোচনা করতে তো সমস্যা না কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সোহান। ছেলেটা রাতদিন একাকার করে জান্নাতকে গিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন এসব করে লাভ কী বল? সময় তো অনেক গড়িয়ে গেছে। শুরুতে যদি নিজের খামখেয়ালি ভাবে মা করত তাইলে আজকে এমনদিন দেখা লাগত না। তাছাড়া যারা সংসার করে শুধুমাত্র তারাই নিজেদের সমস্যা জানে। যখন দেখে সমস্যা সমাধান করার কোন রাস্তা নেই তখনি ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে যায়। তবে মা, ডিভোর্সই কিন্তু সব সমস্যর সমাধান না।
– তা তো ঠিক। এখন আমাদের কী করণীয়?
– কিছুই না। সোহান যদি নিজে থেকে সংশোধণ হয় তাহলে আমরা জান্নাতকে রিকুয়েস্ট করতে পারি আর সেটা না হলে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার কোন রাইট নেই। আচ্ছা মা তুমি থাকো আমি জান্নাতকে দেখে আসি। বিয়ের পরে একবারও সামনাসামনি দেখা হয়নি।
– যা, তবে এখনি কিছু বলিস না। সোহান জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।
– আচ্ছা।
শুভ মায়ের রুম থেকে জান্নাতের রুমে ঢুকল। রুমে ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
– জান্নাত আসব?
– আপু, আসেন।
– হুম। কেমন আছো জান্নাত?
– এই তো আছি কোন রকম। আপনি কেমন আছেন?
– ভালো আর থাকতে দিলে কোথায়? তোমার দুলাভাই ছুটি পায়নি তাই বাধ্য হয়ে আমাকে আসতে হল।
– স্যরি আপু। আমার জন্য মা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে জানি কিন্তু কী করব আমি তো বাধ্য হয়েছি স্টেপ নিতে। প্রতিটা মেয়ে বিয়ের পরে স্বামীর সাথে সংসার করতে চায় কিন্তু দেখেন আমার কপালটাই খারাপ। না পেলাম স্বামীর ভালোবাসা না পেলাম মা-বাবার কাছে মেয়ের সম্মান। কথা বলার এক পর্যায়ে জান্নাত কেঁদে ফেলে। হাউমাউ করে কাঁদছে। চিৎকার দিয়ে কাঁদলে বোঁধহয় বুকের ভেতরো চাপা কষ্টটা হালকা হত। জান্নাতের কান্না দেখে শুভ নিজেকে সামলাতে পারল না সে ও জান্নাতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
জান্নাতকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। নিজের ভাইয়ের এত বড় অন্যায়টা মেনে নিতে রিতীমত হিমশীম খাচ্ছে। একটা মেয়ে হয়ে কীভাবে এমন সিচুয়েশনে আরেকটা মেয়েকে সান্ত্বনা দিবে ভেবেই অস্থির হয়ে যায় শুভ।
চলবে………