স্বামী পর্ব ৬

#স্বামী
#লেখনীতেঃ_নুসরাত_জাহান
#পর্বঃ_৬

মধ্যরাতে কারও হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি রুমটা অন্ধকার। ভয়ে ওপাশ ফিরছি না। আমার ধারণা সোহান তো ঘুমিয়ে গেছে তবে কী আমি স্বপ্নে দেখেছি..? কিছুই বুঝতে না পেরে আবারও চোখ বন্ধ করলাম। তবে এবার মনের ভেতরে ভয় ঢুকে গেছে। কিছুক্ষণ এভাবে চুপ করে থাকলাম। এপাশে শুয়ে থাকার কারণে অন্য পাশ ফিরে দেখি সোহান আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তো ভয় পাবার মতো অবস্থা হয়ে কাঁপতে লাগলাম। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
– আপনি এখনও ঘুমাননি..?
– ঘুম আসছে না।
– তাহলে এভাবে পিছন থেকে আমার গায়ে হাত দিলেন কেন..? জানেন আমি কতটা ভয় পেয়েছি..?
– তুমি কী ভীতু নাকি..? আমার জানা মতে গ্রামের মেয়েরা খুব সাহসি হয় কারণ তাদের বাথরুম বাহিরে থাকে। যার কারণে রাতে একা একা যাওয়া লাগে। এটা সবার প্রতিদিনের অভ্যাস। আর তুমি ঘরে বসে ভয় পাচ্ছো..? এটা তো বিশ্বাস করার মতো না।
– কথাটা সত্যি হলেও ঘুমের ভেতরে তো আর কেউ ধরেনি..? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ২.৪৫ বাজে। আপনি এত রাত পর্যন্ত কী করেছেন..?
– কাজ ছিল।
– সারাদিন কাজ করার পরেও কাজ শেষ হয়নি আপনার..? বাহ্ ভালোই তো। এত কী কাজ আপনার যা রাত পর্যন্ত করতে হয়.?

– জান্নাত তুমি এত প্রশ্ন কর কেন..? আজ পর্যন্ত আমার মা আমাকে এত কিছুর হিসেব চায়নি আর তুমি কিনা.!
– মা চায়নি তো কী হয়েছে..? এখন থেকে আমি চাইব।
– আমি কাউকে কৈয়ফত দিতে বাধ্য নই।
– এদিকে এসো..?

আমি আর কোন কথা বলে না চুপচাপ শুয়ে থাকলাম।
– কী হলো তোমাকে কিছু বলেছি কোন রেসপন্স নাই কেন..?
– রাত অনেক হয়েছে ঘুমিয়ে যান। শুভরাত্রি।
সোহান শোয়া থেকে উঠে টেবিল লাইটা জ্বালিয়ে বলল,
– তোমার সমস্যা কী..? আমি তোমার স্বামী তাই আমার যখন ইচ্ছা তোমাকে ডাকব আর তোমার ইচ্ছা না থাকলেও আমার কাছে তুমি আসতে বাধ্য।
– আমি কোন কথা না বলে ওপাশ করে ফিরতে সোহান আরও ক্ষেপে যায়। জান্নাত তুমি কী আমার সাথে মজা করছ..? আমার এখন তোমাকে দরকার ব্যাস দরকার।

আমি না চাইতে আবারও শুরু হলো শরীরের খেলা।যতদিন যাচ্ছে ততই সে আমার উপরে ঝুঁকে পড়ছে। তার কাছে স্ত্রীর কোন মূল্য নেই। তার শুধুমাত্র শরীরকে দরকার। এটা হলেই দুনিয়ার দিকে কোন খেয়াল থাকে না।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা না করে বেরিয়ে যায় সোহান।
সোহানের প্রতিদিন এভাবে বেরিয়ে যাওয়াকে রাহিমা বেগম ভালো ভাবে নিচ্ছেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সোহানের সাথে তার কথা বলতে হবে। এদিকে জান্নাতের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সারাদিন চুপচাপ থাকে। রুমে বসে প্রায়ই একা একা কাঁদে। কারও সাথে তেমন কথা বলে না। প্রথম যেমনটা এসেছিল তার চেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছে।

এভাবে কেটে গেল ১ মাস।

রাহিমা বেগম এতদিন দেখছে কিন্তু কোন পরিবর্তন হয়নি জান্নাতের ভেতরে। এভাবে চলতে থাকলে সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। অবশেষে দিশাবিশা না পেয়ে রাহিমা বেগম সিদ্ধান্ত নিল যে জান্নাতকে বোঝাবে।

রাহিমা বেগম রুমে এসে আমার পাশে বসে গায়ে হাত দিয়ে বলল,
– মা তোর কী শরীর খারাপ..?
– নাহ্ মা। আমি ঠিকাছি।

– জান্নাত তুই আমাকে যতই বলিস তুই ঠিকাছিস কিন্তু আমি জানি তুই ঠিক নাই। তোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, দিনদিন শুকিয়ে কালো হয়ে যাচ্ছিস। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছিস না। এভাবে চলতে থাকলে তোকে তো হসপিটালে ভর্তি করা লাগবে।
– আপনি যেসব ভাবছেন সেসব কিছু না।
– আমি জানি তোর উপরে শারীরিক এবং মানসিক দু’টোর প্রেশার পড়ছে তুই সত্যিটা গোপন করছিস।
মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। চোখ পানিতে টলটল করছে। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুলগুলো আলত করে টেনে বলল,
– মা তোর বয়স কম। তোর বয়সে আমারও বিয়ে হয়। কিন্তু জানিস উনি আমাকে এতটা কেয়ার করেছে যেনো আমি কখনও কষ্ট কী জিনিস উপলদ্ধি করতে পারিনি। কম বয়সে বিয়ে হলে মেয়েদের শারীরিক অনেক সমস্যা হয়। আমি জানি তোর উপরে অনেক ঝড় বইছে। স্ত্রীর চেয়ে স্বামীর বয়সের পার্থক্য যদি ৫ বছরের ভেতরে হয় তাহলে খুব ভালো হয়। যখনই বয়সটা অনেক গ্যাপ হয়ে যায় তখনি দুজনের ভেতরে আন্ডারস্ট্যান্ডিং কম থাকে। কিন্তু আবার কথা আছে সরকারী চাকরী করতে গেলে ছেলের বয়স অনেকটা বেশী হয়ে যায়। স্বামীর মন রাখতে গেলে নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিতে হয়। কিন্তু সব কিছুকে মানিয়ে নিয়ে চলার নামই জীবন জান্নাত। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর দুজন দুজনকে বুঝতে হবে না হলে মিলটা কখনও সম্ভব না। মা হয়ে তোকে এত কিছু বলা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না কথাটা বলে চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে যায় রাহিমা বেগম।

সোহানের কথাবার্তা ইদানিং অন্য রকম হয়ে গেছে। মুখে যা আসছে তাই বলছে। আমার দিকটা এই এক মাসে কখনও উঁকি দিয়েও দেখেনি শুধু রাতের বেলা শরীরটা দেখেছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাত করে বাসায় ফেরাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সোহানের। কিছু বলতে গেলেই চড়, থাপ্পর খেতে হয়। সব মিলিয়ে আমার জীবনটা এখন বিষাদময়।

রাত ১১ টায় বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডিনার শেষ করে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে সোহান। এটা এখন প্রতিদিনকার কাজ হয়ে গেছে। ল্যাপটপে চ্যাটিং করা, ঘন্টারপর ঘন্টা ফোনে কথা বলা। আমি শুধু দেখে যাই প্রতিবাদ করি না। শুরুতে করলেও এখন আর করি না।

আমি বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।
সোহান একবার দেখে ল্যাপটপ চালাচ্ছে আর বলছে, জান্নাত কিছু বলবা.?
– নাহ্।
– তাহলে এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন..? যাও নাইটি পড়ে আসো।
– আসলে আপনাকে আমার কিছু বলার ছিল।
– হ্যাঁ বলে ফেল। এতে অনুমতি নেওয়ার কী আছে..?
– আপনি যদি আবার বিরক্ত ফিল করেন..? তাই সাহস পাচ্ছি না।
– জান্নাত এত্ত ঢং কোথায় পাও শুনি..?
– আচ্ছা আমার কথা কী আপনার সহ্য হয় না..? সব কিছুতেই বিরক্ত ফিল করেন।
– তোমার কথাগুলো না সব গ্রামের মানুষদের মতো! তারা যেভাবে রাজনীতি করে তুমিও ঠিক তেমনি রাজনীতি কর। শোন আমার সাথে এসব ন্যাকামী করতে আসবে না। তোমাদের গ্রামের মানুষদের আমার চেনা আছে। সবগুলো হলো লোভী। এই যে দেখো না তোমার বাবা আমাদের সম্পত্তি আর আমার সরকারী চাকরী দেখে তার মেয়েকে তুলে দিল। কিন্তু বিয়েতে একটা লাল সুতাও দেয়নি। তুমি দুইদিন কল করে খোঁজ নিলে কিন্তু তোমাকে যে ১ মিনিট কল করে খোঁজ নিবে সেই টাকা খরচ করার মনমানসিকতা তার নেই। শোন টাকা খরচ করতে বুকের জোড় লাগে তোমার বাবার মতো কৃপ্টা আমি আমার লাইফে দেখিনি।

বিয়েরদিন যা রান্না করছে তা আমাদের দারোয়ানের বাসায়ও করে। একটা মাত্র মেয়ে কোথায় দশ হাজার টাকা খরচ করে গরুর গোশত, রোস্ট, কাবাব খাওয়াবে তার না করে বয়লার মুরগি, সাদা ভাত, পঁচা রুই মাছ এসব দিয়ে চালিয়ে দিয়েছি। আমাকে যে পাঞ্জাবি দিয়েছি ৫০০ টাকার হবে। আমাদের ঘর মুছতে এরচেয়ে বেশী টাকা খরচ করি। আমার বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলে আমি লজ্জায় বলতে পারি না শ্বশুড়বাড়ি থেকে কী দিয়েছে..? আচ্ছা জান্নাত যার বাবা একটা স্কুলের হেডম্যাস্টার তার কী এমন ভিক্ষারী স্বাভাবটা মানায়..?
– সোহানের কথাশুনে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। সত্যি বাবার কী টাকা নেই..? তাদের নিজেদের ভুলের কারণে আজ আমাকে এতগুলো কথা শুনতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে না হলে এর প্রতিটা জবাব কড়ায় গন্ডায় উসুল করতে পারতাম।

– এই জান্নাত কী ভাবছ…? ল্যাপটপটা বন্ধ করে, ঘুমাবে না..?
– কিছু ভাবছি না। ঘুমাব একটু পরে আপনি ঘুমান।
– আমি একা ঘুমাব না। তুমি আসো।
– ভালো লাগছে না। আপনি আজকে একাই ঘুমান। আজকে আর তোমার খোড়াক মেটাতে পারব না। একদমই মন নেই। যদি ভালো লাগবে কালকে।
– মানে..?
– মানেটা সহজ। আজকে আপনার সাথে সেক্স করতে পারব না। আমাদের বিয়ের পরে পিরিয়ডের কয়েকদিন বাদে প্রতিদিনই না চাইতেও আপনার ভোগের স্বীকার হয়েছি। কিন্তু আজকে আর পারব না স্যরি।
– স্যরি বললেই সব কিছুর সমাধান হয়ে যায় না। কাছে আসো।
– ছিঃ সোহান ছিঃ। লুচ্চামির একটা সীমা থাকে। তুমি তো সেক্স ছাড়া কিছুই বুঝ না দেখছি। এত শরীরের ঝাঝ তোমার..? যদি এতই ঝাঝ থাকে তাহলে পতিতালয়ে যাও। নতুন নতুন মেয়েদের শরীর পাবে।

সোহান এবাব ক্ষেপে গিয়ে আমার গালে থাপ্পর বসিয়ে দিয়ে বলল,
– পতিতালয়ে গেলে কী তোকে বিয়ে করতাম..? সেখানের বেশ্যাদের ২০০ টাকা দিলেই সারারাত কাভার করে দেয়। আর তোর পিছনে এত টাকা খরচ করছি তবুও তুই এসব বলছিস..? শোন তোর শরীরটা কী সোনায় বাঁধানো যে কাছে যেতে গেলে ন্যাকামি করিস..? গেলাম না তোর সোনায় বাঁধানো শরীরের কাছে কথাটা বলে বালিশ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে আমি বললাম,
– এক মিনিট দাঁড়ান।
সোহান থমকে দাঁড়ায়। সামনে তাকিয়ে কী বলবে জলদী বলো..?
– আপনার তোর বেশ্যাদের সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান আছে দেখছি..? তাদের কাছে যাতায়াত আছে বুঝি.? না হলে বেশ্যাদের রেট কত জানলেন কী করে..? আসলে আপনারা পুরুষ জাতটাই হলো নোংরা। নিজের বউ থাকতেও অন্যের বউকে সুন্দর মনে হয়। ঘৃণা লাগছে এটা ভেবে আপনার মতো একটা বাজে মানুষ আজ আমার স্বামী। আপনার ভাগ্য ভালো আমার বাবা ভালো মানুষ না। কারণ আমি ছিলাম তাদের গলার কাঁটা তাই যার তার হাতে তুলে দিয়ে এখন তারা শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। তবে আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম আমার সাথে যে যতটুকু করবে তার ফল সে আজ না হোক কাল পাবেই। একটা কথা মনে রাখবেন আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না।

কথাটা শুনে সোহান রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here