#স্বামী
#লেখনীতেঃ_নুসরাত_জাহান
#পর্বঃ_৭
সোহান বালিশ নিয়ে সোজা ড্রইং রুমে সোফার উপরে শুয়ে পড়ল।
মনে মনে জান্নাতকে গালি দিচ্ছে।
এটা কী বউ নাকি অন্য কিছু..? কত বড় বড় কথা বলে..? খালি কলস বাজে বেশি। এমন ভাব নিচ্ছে মনে হচ্ছে কোটিপতি বাবার একমাত্র সন্তান।
পুরুষরা যা ইচ্ছা তাই করবে তাতে মেয়েদের এত জ্বলে কেন বুঝি না..? সেক্সটা মেয়েদের জন্য আজকাল পান পাতার মতো সস্তা হয়ে গেছে। টাকা ছাড় তো মেয়ে হাজির। বিয়ে করে হাত পায়ে শিকল বাঁধার চেয়ে বিয়ে না করাই ভালো। সব কিছু তো আজকাল ফ্রিতেই পাওয়া যায়। বউ দরকার হলে ফ্রি তে আনতাম। ৬ মাস পর পর নতুন নতুন বউ পেতাম। পুরাতন জিনিস প্রতিদিন ভালো লাগে না। যেমন এক তরকারি প্রতিদিন স্বাদ লাগে না।
বালিশের ভেতরে মুখ গুজে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সোহান।
বাবার উপরে পাহাড় সমান অভিমাণ নিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছি। আজ বাবার কারণে আমাকে এতটা অপমান সহ্য করতে হয়েছে। মেয়ে বলে জন্ম হয়ে কী পাপ করেছি..? সমাজের মানুষগুলো খুব বাজে মেয়েদের কোন মূল্য নাই এদের কাছে। এরা শুধু মেয়েদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে জানে। যখন দরকার পড়বে বিছানায় নিয়ে গিয়ে নিজের চাহিদা মিটিয়ে শুয়ে থাকবে। সন্তান জন্ম দেওয়া পর্যন্ত তাদের দ্বায়িত্ব শেষ! তারা শুধু টাকা দিয়ে সব কিছু পরিমাপ করে। মেয়েদের প্রতি দয়া, মায়া, ভালোবাসা কিছুই নেই। জীবনটা এখন তেজপাতা হয়ে গেছে। নিজের ভবিষৎত চিন্তা করতে গেলে সামনে দেখি শুধুই পানি। পানিতে নামলে ডুবে যেতে হবে।
এতকিছু চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুম চলে আসে বুঝতেই পারলাম না।
সোহানের মা পানি খেতে উঠে সোহানকে সোফায় ঘুমাতে দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল তার। সোহান তো আগে এমন ছিল না বিয়ের পরে এমন করছে কেন..? কাল সকালে সোহানের সাথে কথা বলতে হবে।
বিষয়টা নিয়ে। অল্প থাকতেই সমাধাণ করা ভালো।
সূর্য্যের আলোয় পর্দা ভেদ করে চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল আমার। চোখ মুছতে মুছতে বিছানা দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখলাম সোহান সোফার উপরে ঘুমাচ্ছে। ডাইনিং রুম থেকে সোজা
রান্না ঘরে ঢুকলাম। মা সাথীকে নিয়ে নাস্তা বানাচ্ছে। সাথী আমাকে দেখে হেসে বলল,
– আসসালামু আলাইকুম ভাবী। কেমন আছ..? দাঁড়িয়ে কেন এদিকে আসো..?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।
– সাথী, জান্নাতের সাথে কিছু কথা ছিল তুই কিছুক্ষণ পরে আয়।
– ঠিকাছে।
– জান্নাত দাঁড়িয়ে কেন..? এদিকে আয়.?
আমি মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
– জান্নাত কী হয়েছে..? সোহানের সাথে রাগারাগি করেছিস..?
– নিশ্চুপ আমি।
– জান্নাত একটু ধৈর্য ধর মা দেখবি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
– জানি না মা কী ঠিক হবে…? তবে এতটুকু বুঝতে পারছি আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে।
রাহিমা বেগম নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
– জান্নাত তুই রুমে যা আমি নাস্তা সাথীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আমি রুমে চলে এসে আয়নার সামনে বসলাম।
রাহিমা বেগম সোহানের কাছে গিয়ে ডাক দিয়ে বলল,
– এই সোহান কত বেলা হয়ে গেছে জানিস না..? উঠ! ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নে।
আড়মোড়া দিতে দিতে সোফার উপরে উঠে বসল সোহান। হাই তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
– মা আজ তো শুক্রবার এত তাড়াতাড়ি ডাকলে কেন..? একটু ঘুমাতেও দাও না শান্তি মতো!
– সবাইকে অশান্তিতে রেখে তুই শান্তি মতো ঘুমাতে চাস কেন..? আগে সবাইকে শান্তি দিস তারপর নিজের শান্তি খুঁজতে আসবি।
– মা তুমি এই সকালবেলা কীসব শুরু করছ…? আমি আবার তোমাদের অশান্তিতে কখন রাখলাম..?
– নাহ্ তুই তো খুব শান্তিতে রেখেছিস। আচ্ছা তোকে একটা কথা বলি যদিও মা হিসাবে বলাটা আমার ঠিক না তবুও তোর কৃত্তি কলাপে বলতে বাধ্য হলাম। তোর বয়সের সাথে জান্নাতের বয়সের অনেকটা তফাৎ। জান্নাতের বয়সটাও অনেক কম তার উপরে ও খুবি দূর্বল। তাই তোকে অনুরোধ করছি মেয়েটির সাথে কখনও জোড় করিস না। পারলে ভালো করে বুঝিয়ে নিজের করে নিস দেখবি জীবনটা ভালো হবে। মা হিসাবে আমার যতটুকু দ্বায়িত্ব ছিল তোকে বললাম, আসা করি তুই কোন বাচ্চা না অবশ্যই বুঝতে পারবি।
সোহান মায়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে ঢুকে আড়চোখে জান্নাতকে দেখছে।
আমি জানালার গ্রীল ধরে বাহিয়ে তাকিয়ে আছি। সোহান এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
– জান্নাত তোমার আর আমার সাথে কী হচ্ছে না হচ্ছে এসব মা জানল কীভাবে..? নিশ্চয়ই তুমি বলেছ..?
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,
– আপনার কী মনে হয় মাকে আমি বলেছি..? কেন মায়ের কী চোখ নাই নাকি আপনার মতো অন্ধ..? আপনি কী করতে চাচ্ছেন একটু বলবেন প্লিজ..? আমার প্রতিদিন এসব ঝামেলা, ঝগড়া এসব ভালো লাগছে না। আপনি আপনার মতো করে থাকেন আর আমি আমার মতো। আপনি অনেক টাকা-পয়সা ওয়ালা পরিবারের সন্তান আর আমি সামান্য একজন স্কুল মাস্টারের সন্তান। গ্রামের পরিবেশে বড় হয়েছি তাই শহরের কার্লচার সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণা নেই আর নেওয়ারও দরকার মনে করি না।
সোহান একটা কথারও উত্তর না দিয়ে রেডী হয়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় সাথী বলল,
– ভাইয়া আজ তো শুক্রবার কোথায় যাচ্ছো..?
সোহান কোন কথা না বলে চলে যায়।
আমার শরীরটা ভালো লাগছিল না তাই শুয়ে পড়েছি রুমের লাইট অফ করে। সাথী এসে দু’বার ডেকে যাওয়ার পরেও খাইনি। সাথীকে বলেছি খিদে নেই যখন লাগবে খেয়ে নিব। চোখ বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করে চোখের জল ফেলছি।
আচমকাই সোহান এসে পাশে শুয়ে পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। অনেকক্ষণ ধরে গায়ের ভেতরে ঢুকে গলায় চুমু দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে সোহানকে বললাম,
– কী হয়েছে..? এভাবে বিরক্ত করছেন কেন..?
– বিরক্ত করছি মানে..?
– তো কী করছেন..? দেখছেন না আমি শুয়ে আছি তাহলে পিছন থেকে…. সোহান কথাটা শেষ করার আগে আমার ঠোঁটে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল,
– চুপপপ, একদম চুপ। আমার যা ইচ্ছে তাই করব তাতে তোমার কী..?
– এসব কী সোহান..? আপনার যখন মন চাইবে জোড় করে অধিকার খাটাবেন আবার যখন মন চাইবে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন। ভালোই তো ন্যাকামি করতে পারেন।
– দেখ, জান্নাত রাত অনেক হয়েছে আজেবাজে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। সোহান পিঠের উপরে মুখ গুজে দিয়ে চুমু দিতে শুরু করলে আমার অনেকটা রাগ হয় কারণ সোহান যেটা করছে এটা ওর শরীরের চাহিদা পূরণ করার জন্য কিন্তু আমি কোন কাঠের পুতুল না যে, সে যা বলবে আমি তাই মেনে নিব। আমার নিজের ইচ্ছা, অনিচ্ছা বলে কিছু আছে। সোহান আমাকে ভোগ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলে আমি তাকে বাঁধ সাধলাম। বারবার সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই সোহান আমার উপরে আরও চড়াও হয়। অনেকক্ষণ সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হই তার শক্তির কাছে। না চাইতেও আবারও বৈধ ধর্ষণের শিকার হতে হয় স্বামীর কাছে।
সোহান যখন মরিয়া হয়ে উঠে তার চাহিদা মিটাতে তখন আমার চোখে তার প্রতি ঘৃণা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
হ্যাঁ সবাই বলবে স্বামী যদি কাছে যেতে চায় তাহলে তাকে বাঁধা দেওয়া যাবে না। স্বামীর প্রতি এক্সট্রা কেয়ার নিতে হবে যাতে তার কোন কিছুর কমতি না হয়। তাহলে আমি বলব, বিয়ে করলেই কী একটা মেয়ে তার স্বামীর ভোগের পাত্রী হয়ে যায়..? তার নিজস্ব কোন মতামত নেই..? মেয়েরাই কী শুধুই স্বামীর বিছানার পণ্য..? তার যখন ইচ্ছা হবে ঘুমাবে আর চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে গায়ে হাত তুলবে, খারাপ বিহেভ করবে..? এটা কেমন ভালোবাসা..? সমাজের চোখে যখন একটা মেয়ের বিয়ে হয় তখন তাকে সবাই বাহাবা দেয়। কিন্তু যখন কোন মেয়ে কুমারী হয়ে বাবার ঘরে থাকে তখন সবাই তাকে অপয়া, অলক্ষ্মী বলে গাল মন্দ করে। কী সুন্দর আমাদের সমাজ ব্যবস্থা..? কিন্তু এটাই কী মেয়েদের জীবন…? সব কিছু ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে পানি টলটল করছে।
সকালবেলা ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখি সোহান শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে।
– কী হলো আজকে শাওয়ার নিবে না..? নাকি এভাবেই শুয়ে থাকবে..?
– হ্যাঁ যাব।
– জান্নাত বিকালে তোমাকে নিয়ে মার্কেটে যাব। আমার পছন্দ মতো কিছু ড্রেস কিনে দিব। তুমি বিকাল ৫ টার ভেতরে রেডী হয়ে থেকো।
আমি কিন্তু দাঁড়াতে পারব না। এসেই তোমাকে নিয়ে যাব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটা সেটা হলো,
আজকের বেড শেয়ারের প্রেজেন্টেশনটা ভালো হয়নি। এর পরেরবার যেনো ভালো হয় সেদিকে খেয়াল রেখো।
সোহান কথাটা বলে চলে যায়।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি সোহানের মোবাইলটা ড্রায়ের উপরে রাখা। রুম থেকে বেরিয়ে সাথীকে জিজ্ঞেস করতে বলল, ভাইয়া তো চলে গেছে। কোন জরুরি প্রয়োজন ছিল..?
– মোবাইলটা রেখে গেছে।
– ওহ্। তাহলে আবার আসবে চিন্তা করো না।
রুমে ঢুকতে সোহানের মোবাইলে কল আসল। আমি কাছে গিয়ে মোবাইলটা হাতে নিতে স্ক্রিনের উপরে ভেসে আসল দিবা জামান। নাম্বারটা দেখে মনের ভেতরে প্রশ্ন জাগল কে এই দিবা জামান..? এর সাথে আবার কোন সম্পর্ক চলছে না তো..? সারারাত চ্যাটিং করে আবার ছুটির দিনে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যায়, রাত করে বাসায় ফেরে। সব কিছু ভাবতে ভাবতে মাথার এক পাশে চিনচিন করে ব্যথা শুরু হল।
মোবাইলটা জায়গা মতো রেখে দিলাম কিন্তু দিবা জামান নামে বারবার কল দিচ্ছে। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপর পাশ থেকে বলল,
– সোহান, কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছি তুমি এখনো আসছ না কেন..? কলটাও রিসিভ করতে এত সময় লাগছে কেন..? তুমি না আসলে আগে জানাবে তো আমি বাসা দিয়ে কত কাহিনী বানিয়ে বের হয়েছি। এমনিতেই বাসায় আমাকে সন্দেহ করছে।
কথাগুলো শুনে কলটা কেটে দিয়ে ধপাস করে বিছানার উপরে বসে পড়লাম। তার মানে সোহানের কারও সাথে চক্কর চলছে..? এত বড় প্রতারণা আমার সাথে..?
চলবে………..