#হঠাৎ_তুমি_এলে
#পর্ব_১৫
#সুলতানা_পারভীন
-কে কে কে? ছাড়ো, ছাড়ো, ছাড়ো। ছাড়ো আমাকে——-। ছাড়ো——?
সকালবেলা প্রত্যুষাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করে মেয়েটাকে নিয়েই বৃদ্ধ ডাক্তারের কেয়ারটেকার হামিদের বাসায় এসেছে প্রজ্ঞা। কেয়ারটেকারের ছোট্ট মেয়ে অদিতির সাথে প্রত্যুষার এক নিমিষেই বন্ধুত্বও হয়ে গেছে। প্রত্যুষা আর অদিতি দুজনেই দুই বোনের মতোই একসাথে খেলায় মেতেছে। তাই আর প্রত্যুষাকে নিয়ে কোনোরকম টেনশন করতে হয়নি প্রজ্ঞাকে। কেয়ারটেকার হামিদ আর তার স্ত্রী লতা দুজনেই অমায়িক ভালো মানুষ। একটা মিষ্টি হাসির রেখা সবসময়ই লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণে দুজনেরই। তাই হামিদের বাসাতেই প্রত্যুষাকে রেখে যেতে একটু হলেও ভরসা বোধ করেছে প্রজ্ঞা। তাছাড়া এই এতো বড় শহরে কার কাছে ভরসা করে মেয়েটাকে রেখে যেতে প্রজ্ঞা? সাথে যে নিয়ে যাবে সেই উপায়টাও কি আছে? যারা একজন বৃদ্ধ মানুষের শেষ সম্বলটুকু দখল করতে পারে তাদের কাছে প্রজ্ঞার ছোট্ট বাচ্চাটা কতটুকু নিরাপদ? কথাগুলো চিন্তা করেই প্রত্যুষাকে লতা আর অদিতির কাছেই রেখে এসেছে প্রজ্ঞা।
হামিদের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে ক্লাইন্টের সাথে দেখা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে প্রজ্ঞা। আজকে লোকটার সাথে দেখা না হওয়া মানে এই স্মৃতিঘেরা শহরে আরো একটা দিন ওকে বেশি কাটাতে হবে। অবশ্য প্রজ্ঞার এতো শত চিন্তার ছিঁটেফোঁটাও যেন স্পর্শ করতে পারে নি হামিদকে। সেই ভদ্রলোক দুনিয়ার বকবক করছে, রেস্টুরেন্টে বসে এটা ওটা অর্ডার করছে প্রজ্ঞার আর নিজের জন্য। এতো ভোজনপ্রেমী আর সদানন্দ লোক এর আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ছে না প্রজ্ঞার। এদিকে লাঞ্চের সময়ও প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে। লাঞ্চ করে আবার ওই লোকটার সাথেই দেখা করতে যেতে হবে। তাই অযথা সময় নষ্ট না করে রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য চলে গেল প্রজ্ঞা। সেখানেই বাঁধলো বিপত্তি। ফ্রেশ হয়ে চোখে মুখে পানি ছিঁটে দিতেই কারো শক্ত হাতের তালু প্রজ্ঞার নাকে মুখে চেপে বসলো। ভয়ে নাকি আতঙ্কে দু একটা আর্তচিৎকার গলা দিয়ে বের হলেও দুপুরের রমরমা রেস্টুরেন্টের উপচে পড়া ভিড়ে সেটা কারো কান পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা সেটাই সন্দেহ। অবশ্য সেসব ভাবার অবকাশও মেয়েটা পায়নি। সারাদিনের হাজারটা চিন্তার মধ্যেই এভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়াটা হয়তো মেয়েটার দুর্বল নার্ভগুলো ঠিক নিতে পারে নি। নিমিষেই চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।
প্রজ্ঞার যখন সেন্স ফিরে আসে ততক্ষণে সূর্যের তেজটা বেশ নরম হয়ে এসেছে। চোখ মেলে নিজেকে একটা গাড়িতে আবিষ্কার করেই ধড়ফড় করেই উঠে বসার চেষ্টা করলো। বাইরেই গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে দেখে ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো প্রজ্ঞার। কে লোকটা, কেন ওকে এভাবে ধরে এনেছে সেসব ভাবায় সময় নষ্ট না করে পালানোর চিন্তাটাই প্রথমে ভাবার চেষ্টা করলো মেয়েটা। গাড়ি থেকে পালানোর পথ খুঁজতে গিয়ে এতোক্ষণে প্রজ্ঞার খেয়াল হলো জোর করে ধরে আনার কোনো লক্ষণই বোঝা যাচ্ছে না। কিডন্যাপ করলে অন্তত ওর হাত পা গুলো তো বেঁধে রাখতো। উল্টো কেউ যেন যত্ন করেই সিটবেল্টের বাঁধনে প্রজ্ঞার সেইফটিই নিশ্চিত করেছে, এর বেশি যেন তার কোনো উদ্দেশ্যই নেই। ধীর হাতে সিটবেল্টটা খুলতে খুলতে আশ্চর্য হয়ে কথাগুলোই ভাবছিল প্রজ্ঞা। অবশ্য কি ঘটেছে সেটা নিয়ে বেশ কৌতূহল জন্মালেও বাইরের দিকে সতর্ক নজর রাখতে ভুলে যায়নি মেয়েটা। আততায়ী লোকটা কি ভেবে এই নিরব জনশূন্য রাস্তায় ওকে এভাবে ছেড়ে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেয়েও বড় চিন্তা হলো এখান থেকে ভালোয় ভালোয় বের হতে পারলেও হামিদের বাড়িতে যাবে কি করে? আধৌ নিজের মেয়েটাকে শেষ বারের মতো দেখতে পারবে তো?
প্রত্যুষার নিষ্পাপ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই একবার নিজেকে এই বিপদ থেকে বের করার শেষ চেষ্টাটা করলো প্রজ্ঞা। ততক্ষণে দেরি যা হওয়ার হয়েই গেছে। প্রজ্ঞা এক ধাক্কায় গাড়ির দরজাটা খুলে এক পা বাইরে রাখার আগেই পাশ থেকে আবার শক্ত হাতটা প্রজ্ঞাকে টেনে একদম নিজের সাথেই জাপটে ধরলো। হঠাৎ এভাবে টেনে ধরায় প্রজ্ঞা আঁতকে উঠলেও লোকটার কথাগুলো শুনে চমকে মুখ তুলে তার দিকে তাকালো।
-আবার পালানোর চেষ্টা করছ? ভয় নেই। তোমাকে আটকে রাখার জন্য ধরে আনি নি। আমার প্রশ্নের জবাবগুলো দিয়ে দিলেই আবার নিজের প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যেতে পারবে। জানি কেউ ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছে তোমার। হুট করে তোমার হারিয়ে যাওয়ায় ভয়ে পুরো শহর জুড়ে ছুটোছুটি করছে। বাট কি করবো বলো? আমার প্রশ্নগুলোর জবাব না জানা পর্যন্ত ছাড়া পাবে না। তাতে দুনিয়া উল্টে গেলেও আমার কিছু করার নেই। পাঁচটা বছর পাগলের মতো অপেক্ষা করেছি এই দিনটার। আজ অন্য কারো ব্যাকুলতা দেখে নিজের পাঁচ বছরের চাপা কষ্টটা তো ভুলে যেতে পারবো না।
-ধূসর?
প্রজ্ঞা কল্পনাতেও ভাবতে পারে নি পাঁচ বছর পর এভাবে ধূসরের সামনে পড়তে হবে, এভাবে চোরের মতো পালানোর চেষ্টা করতে হবে ধূসরের কাছ থেকেই পালানোর। প্রজ্ঞার স্তব্ধ নিরব চাহনিটা দেখে ধূসরের কি হলো কে জানে সে ধাক্কা দিয়ে প্রজ্ঞাকে সরিয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে প্রজ্ঞার সাইডের দরজাটা বন্ধ করে অটো লক করে দিলো। পুরো ব্যাপারটা তখনও প্রজ্ঞার কাছে কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে। এতোগুলো দিন যে মানুষটা ওকে খুঁজতে আসে নি কেন ভেবে যে অভিমানের পাহাড় জমেছিল প্রজ্ঞার মনে, সেই মানুষটাই ওর সামনে, একদম কাছে বসে আছে সেটা বিশ্বাস হতেও যেন কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার।
-যাক, তাহলে অন্তত চিনতে পেরেছ। আমি আরো ভাবলাম, তুমি হয়তো বলবে আপনি কে? আমাকে এভাবে এখানে ধরে নিয়ে এসেছেন কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। নাটকটা না করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ প্রজ্ঞা।
-ধূসর? কি বলছ এসব?
-কি বলছি? কি বলছি, কি করছি সেটা তো নিজেই গত পাঁচটা বছর ধরে বুঝতে পারছি না। গত পাঁচটা বছর, একটা দুটো নয় প্রজ্ঞা, পাঁচ পাঁচটা বছর সবার হাজার বক্তব্য শুনেছি তোমাকে নিয়ে। আমার এক্সিডেন্টের পর অন্য কারো সাথে তুমি শহর ছেড়ে চলে গেছ, অন্য কারো সাথে সংসার করছ, সুখে আছো, এমন হাজার হাজার অভিযোগের ফাঁকেও আমিও বিশ্বাস করেছিলাম আমার প্রজ্ঞা আমাকে ফেলে চলে যাওয়ার মেয়েই নয়। আর যা ই হোক, আমাকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে দেখেও ডিভোর্স চেয়ে নতুন সংসার শুরু করবে এমন দুর্বল ছিল না আমার ভালোবাসা এই একটা কথা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, এই বিশ্বাসটা বুকে আঁকড়ে পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছিলাম প্রজ্ঞা। আর আজ সেই ভরসার দারুণ প্রতিদান দিলে তুমি। আমি যে কত বড় গাধার মতো সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে খোঁজার চেষ্টা করেছি সেটা আজ তুমি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তোমার কাছে আমার একটাই প্রশ্ন প্রজ্ঞা। কেন? কেন কেন কেন? কেন হঠাৎ তুমি আমার জীবনে এলে? কেনইবা দমকা হাওয়ার মতো এসে আমার জীবন থেকে সমস্ত সুখ, হাসি, আনন্দগুলো মুছে দিয়ে চলে গেলে? তোমাকে ভালোবাসার এটাই কি পুরস্কার?
-ধূসর? প্লিজ আমার কথাগুলো শোনো একবার? আমি সব কথা তোমাকে বলছি, তুমি প্লিজ একবার শোনো প্লিজ?
-এখানে বলা বা শোনার কিছু নেই প্রজ্ঞা। কাল রাত পর্যন্তও আমি পাগলের মতো ভাবছিলাম তোমার কোনো বিপদ হলো কিনা, তুমি কোথায় আছো, সুস্থ আছো কিনা, হাহ। এখন কথাগুলো ভেবেও হাসি পাচ্ছে আমার। যার জন্য আমি অপেক্ষার প্রহর গুনেছি এই পাঁচটা বছর সে আমার শহরেই নেই, অন্য কোথাও নিজের স্বপ্নের আশিয়ানা সাজিয়েছে। বাহ! আর আমি গর্ধব হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়েই বাড়ির সবার কথাকে অবিশ্বাস করেও ছুটে গিয়েছিলাম পুলিশ স্টেশনে। কেন জানো? তোমাকে ফিরে পেতে। গত পাঁচটা বছর ধরে সবাই চিৎকার করে আমাকে যে সত্যিটা দেখানোর চেষ্টা করছিল সেটা কাল উপরওয়ালা আমাকে নিজেই দেখিয়ে দিলেন। এটাকে কি বলবো বলো তো প্রজ্ঞা? আমার দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য?
-ধূসর বিশ্বাস করো আমার আর কিছুই করার ছিল না সেদিন। আমি তোমাকে ওভাবে ফেলে যেতে চাই নি।।
-থ্যাংকস মিস প্রজ্ঞা। নিজেই অন্তত স্বীকার করেছেন যে আপনি আপনার হাজবেন্ড মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে জানার পরেও চলে গিয়েছিলেন সেদিন। ওপস সরি, এক্স হাজবেন্ড। এখন তো নিজের একটা সুন্দর সংসার হয়েছে আপনার। সেই ভদ্রলোক আশা করি আমার মতো পাগলামিভরা রাগের নাটক করে না, এনিভার্সারির দিনটা আমার মতো বিব্রত করে না।
-ধূসর?
-এই পাঁচটা বছরে এতো বড় শহরের হসপিটাল, ক্লিনিক, মর্গ, রেলস্টেশন, বাস স্ট্যান্ডে কখন কোথায় কি ঘটছে সব বলতে গেলে মুখস্ত হয়ে গেছে আমার। ডিভোর্স লেটারটা হাতে পেয়েও এক সেকেন্ডের জন্যও যে মানুষটাকে আমি অবিশ্বাস করতে পারি নি, তাকে নতুন জীবনে দেখার পর কি ইচ্ছে হয়েছিল জানো প্রজ্ঞা? পুরো পৃথিবীটাই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করে দিই।
-ধূসর? আমার কথা শোনো প্লিজ?
-কি শুনবো কি আমি? কালও তোমাকে কোথায় খুঁজবো সেটাই ভাবছিলাম। রাতের শহরের নিরবতা, মেইন রোডের শত শত গাড়ির কোলাহল সব ছাপিয়ে একটা ডাক আমাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া একটা গাড়ির দিকে তাকাতে বাধ্য করে। তোমার ছোট্ট মেয়ে পরম আদরে নিজের বাবাকে ডাকছে। সেই দৃশ্যটা দেখার পর থেকে একটা কথাই মাথায় ঘুরছে আমার প্রজ্ঞা। পাঁচ বছর আগে সেইদিনের সেই এক্সিডেন্টে আমি মরে কেন গেলাম না?
-ধূসর?
প্রত্যেকটা মিনিট এগোনোর সাথে সাথে ধূসরের রাগটা আরো এক ধাপ করে বাড়ছে সেটা বেশ টের পাচ্ছে প্রজ্ঞা। লোকটার উপরে রাগ হওয়ার বদলে এখন কেমন ভয়ই লাগছে প্রজ্ঞার। গত রাতে ধূসর কি দেখেছে প্রজ্ঞা ঠিক বুঝতে না পারলেও প্রত্যুষা যে সত্যিই ধূূসরকে দেখেই পাপার কাছে যাওয়ার বায়না ধরেছিল সেটা এখন বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। ধূসর নিজের মেয়েকে না চিনলেও প্রত্যুষা তো নিজের বাবাকে চিনে। তাহলে সত্যি সত্যিই কাল এতো রাতে ধূসরকে দেখেই ‘পাপা’ বলে ছটফট করছিল মেয়েটা। শুধু কয়েকটা ছবি দেখেই যে মেয়েটা ধূসরকে চিনতে পারবে সেটা কি প্রজ্ঞা ভাবতে পেরেছিল?! আর এদিকে ধূসর? লোকটার প্রত্যেকটা কথায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রজ্ঞার। পাঁচ বছর ধরে হাজার ছলনায় যে ভালোবাসাটা বিশ্বাস হারায় নি, আজ এক রাতের মধ্যে কি এমন হলো যে প্রজ্ঞাকে এতোটা ঘৃণা করতে শুরু করেছে ধূসর? #হঠাৎ_তুমি_এলে
#পর্ব_১৬
#সুলতানা_পারভীন
-হসপিটালের বেডে সেদিন চোখ খোলার পর প্রথম যে কথাটা আমার মনে পরেছিল সেটা কি জানো প্রজ্ঞা? কথা বলতে গিয়ে মনে হচ্ছিল কেউ বুঝি গলায় ছুরি চালাচ্ছে। হাতের ইশারায় নার্সকে কোনোমতে জিজ্ঞেস করলাম তোমার কথা। নার্সের হতভম্ব মুখটা দেখেও সেদিন কতোটা হতাশ হয়েছিলাম নাকি গতকাল পাঁচ বছর পরে তোমাকে ওই মাঝরাতে গাড়িতে দেখে। গাড়িতে দেখে? নাকি স্বপরিবারে তোমার এই শহরে ফিরে আসা দেখে?
প্রজ্ঞা স্তব্ধ হয়ে বসে কিছু একটা ভাবছে দেখে ধূসর স্টিয়ারিংয়ে একটা ঘুষি দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল। কথাগুলো শুনে প্রজ্ঞা কি রিএকশন দিচ্ছে সেটা দেখার চেয়ে বাইরের জনশূন্য রাস্তা দেখাতেই যেন ধূসরের বেশি আগ্রহ। রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুম থেকে ফেরার সময় হঠাৎ করে প্রজ্ঞার মুখটা চেপে ধরতেই মেয়েটা যখন সেন্সলেস হয়ে গেল তখন কোনো চিন্তা না করেই প্রজ্ঞাকে গাড়িতে নিয়ে কোনদিকে এসেছে ধূসর নিজেও জানে না। এতোগুলো দিন পর প্রজ্ঞাকে দেখে খুশি হয়েছে, নাকি প্রজ্ঞার পাশে ওই হাসিতে মেতে থাকা লোকটাকে দেখে জেলাস হয়েছে সেটা ধূসর নিজেও জানে না। বেশ অনেক্ষণ পরও প্রজ্ঞার সেন্স আসছে না দেখে গালে হাত ছুঁইয়ে দিতে গিয়ে ধূসরের হাতটা থেমে গেছে আপনাআপনিই। অজান্তেই চোখের সামনে একটা দৃশ্যই ভেসে উঠতেই ধূসরের চোখ জোড়া ভিজে এসেছিল। দৃশ্যটা আগেরদিন মাঝরাতের প্রজ্ঞার আর ছোটো বাচ্চা মেয়েটার দুষ্টুমিভরা খুনোশুটির দৃশ্য।
-অন্য দিনের মতো কালও অফিসের কাজ শেষ করে তোমাকে খোঁজার জন্য বেরিয়েছিলাম জানো প্রজ্ঞা? দেখো, এতোদিনে ভাগ্যও মুখ তুলে চেয়েছে আমার দিকে। নইলে একবার ভাবো, মাঝরাতে শত শত গাড়ির মধ্যেও তোমার গাড়িটা যখন জাস্ট আমার গাড়িটাকে ক্রস করলো তখন তোমার মুখটা কি করে দেখতে পেলাম? হয়তো নিয়তি আমার হেরে যাওয়াটা মানতে পারছিল না। যখন তোমাকে ফিরে পাওয়ার সমস্ত আশাই ছেড়ে দিয়েছি সেই মূহুর্তে তুমি আমার সামনে চলে এলে। কি অদ্ভুত তাই না প্রজ্ঞা? যেখানে তোমাকে দেখাটাই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা, সেখানে শত শত গাড়ির হর্নেট শব্দের মাঝে তোমার মেয়ের ‘পাপা’ বলাটা আমার কান পর্যন্ত আসাটাকে কি বলবো ভেবেই পাচ্ছি না।
-ধূসর? আমার কথাটা একবার শোনো? প্রত্যু——-।
-মেয়ের নাম প্রত্যুষা রেখেছ জানি। আমার দেয়া নামটাই রাখতে হলো তোমাকে? হাহ। ভালোই করেছ। পরীর মতো মেয়েটার সাথে নামটা ভিষণ মানিয়েছে। তোমার গাড়িটাকে ফলো করে তোমাদের হোটেলটা খুঁজে বের করতে কি কষ্ট করতে হয়েছে তার কোনো আইডিয়া আছে প্রজ্ঞা? নো। কোনো আইডিয়াই নেই তোমার। গত পাঁচটা বছরে কোনো একটা দিন ছয় ঘন্টার যে বেসিক স্লিপ কোর্স সেটাও পূরণ হয়নি। আর কাল? আগের রাতে তিন/চার ঘন্টা ঘুমিয়েছিলাম বড়জোর। সেই নির্ঘুম ক্লান্ত শরীরে তোমাদের গাড়িটা ফলো করা, কোন হোটেলে উঠেছ, হোটেলের লবিতে তোমার আর তোমার মেয়ের কথা, এতো কিছুর পরেও কেন তোমাকে এসে বিরক্তি করছি নিজেও জানি না।
-ধূসর? তুমি যা ভাবছ তা সত্যি নয় বিশ্বাস করো?
-বিশ্বাস করবো? পাঁচটা বছর বিশ্বাস করেছিলাম তো প্রজ্ঞা? তুমি ফিরে এসেছিলে? উঁহু। তোমার সাইন করা ডিভোর্স লেটারটা নিজের সাথে নিয়েই ঘুরছি, সাইনটা তোমার নিজের করা, জেনেও তোমাকেই বিশ্বাস করেছি। কাল তোমার কাছে প্রত্যুষা যখন ‘পাপার কাছে যাবো’ বলে বায়না ধরলো, তখন ওই বাচ্চা মেয়েটাকে তার পাপা কালকে আসবে বলে শান্তনা দিচ্ছিলে শোনার পরও বিশ্বাস করেছিলাম যে তুমি আমার কথাই বলেছ। সারা রাত গাড়িতে নির্ঘুম একটা রাত পার করে দিয়ে সকালে তোমাকে আর মেয়েকে তোমার মিস্টার পার্ফেক্টের সাথে যেতে দেখে আমার বিশ্বাস নামের ভুলটা ভেঙ্গে গেছে।
-তুমি যেমন ভাবছ তেমন কিচ্ছুই হয় নি ধূসর। প্রত্যুষা তোমার মেয়ে, বিলিভ মি। আমার লাইফে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, কেউ নেই।
-শশশশশশশ। পাঁচ পাঁচটা বছর ধরে এই একটা কথায় বিশ্বাস করে কি ফল পেয়েছি সেটা তো নিজেই দেখতে পাচ্ছি। প্রত্যুষা আমার মেয়ে? ওকে ফাইন। আমার মেয়েকে এতোগুলো বছর তুমি আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলে কেন? তোমার লাইফে আমি ছাড়া আর কেউ নেই তাহলে ওই লোকটা? সকালে যে তোমাকে আর তোমার ভাষ্যমতে আমার মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল কেন? ওই লোকটা তোমার কেউ নয়, তাহলে তোমাকে খুঁজে না পেয়ে পাগলের মতো খুঁজছে কেন?
-হামিদ আমাকে খুঁজছে কজ আমাদের একটা আর্জেন্ট মিটিংয়ে যাওয়ার কথা ছিল লাঞ্চের পর। আমার কথাগুলো শোনো তুমি? তাহলে বুঝতে পারবে কে করছে কাজগুলো বা কেন এতোগুলো দিন আমাকে তোমার থেকে তোমার সন্তানকে দূরে রাখতে হয়েছে।
-ওহ আই সি। তুমি আর্জেন্ট মিটিং এটেন্ড করতে অন্য একটা শহর থেকে এখানে আসতে পারো, অথচ এই পাঁচ বছরেও আমাকে একটা কল করে জানাতে পারো না তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো। মেরে গেছি ভেবে ফেলে চলে গিয়েছিলে রাইট? এখন বেঁচে আছি দেখে কাহিনী শোনাচ্ছ আমাকে?
-তুমি আমার কথাগুলো শোনো একবার প্লিজ? তারপর যা ইচ্ছে বলো? যা শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নিবো।
-একটা সাইন সব কথা শেষ করে দিয়েছে প্রজ্ঞা। তোমার চোখে চোখ রেখে সেটাই জানিয়ে দিতে এসেছি আজ।
-আমি কোনো ডিভোর্স লেটার সাইন করি নি ধূসর। বিশ্বাস করো প্লিজ?
-শশশশশ। চুপ। বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা এই শব্দগুলো ভুলেও উচ্চারণ করবে না প্রজ্ঞা। যাই হয়ে যাক না কেন তুমি যদি নিজের জায়গায় ঠিক হতে তাহলে সবার আগে আমার কাছে আসতে। পাঁচ বছর কেন, পঞ্চাশ বছর পরে হলেও তোমাকে ভালোবেসে বুকে টেনে নিতাম। কিন্তু যে স্বেচ্ছায় চলে যায় তাকে বিশ্বাস করার মতো বিশাল মনও আমার নেই, অতটা বোকাও আমি নই।
-ধূসর?
-তোমার যদি ফেরারই হতো প্রজ্ঞা তাহলে তুমি মেয়েকে নিয়ে হোটেলে না আমাদের বাড়িতে চলে যেতে। আসলে কি বলো তো? আজ আমি তোমাকে দেখে না ফেললে তুমি যেভাবে চোরের মতো লুকিয়ে এসেছিলে, সেভাবেই পালিয়ে চলেও যেতে। যেমনটা আগেরবার করেছিলে। আপসোস কি হচ্ছে আমার জানো প্রজ্ঞা? আফসোস হচ্ছে কেন কাল রাতে তোমাকে দেখলাম, কেন তোমার মেয়ের বলা ‘পাপা’ ডাকটা কানে শুনলাম। না শুনলে হয়তো আজও তোমাকে ভালোবাাতাম, পাঁচ বছর আগে যতটা পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম, তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি ভরসা নিয়ে তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকতাম।
ধূসরের কথাগুলো শুনে প্রজ্ঞা ব্যস্ত হাতে ধূসরের শার্টের কোণা টেনে ধূসরের রক্তলাল চোখ মুখটা দেখে কথা বলার ভাষাই যেন হারিয়ে ফেললো। পাঁচ বছরের জমা কথার চেয়েও গুরুতর যে কথাগুলো বলা উচিত সবই কেমন গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে প্রজ্ঞার মাথায়। ধূসরের রাগটা তো জানে প্রজ্ঞা। তাই কথাগুলো বলার আগেই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার।
-সেদিন তোমাকে রাস্তায় ফেলে আমি পালাই নি ধূসর। আমি হসপিটালে এসেছিলাম। তোমার মেয়েটাও তোমার মতো জেদী জানো ধূসর? ও যখন ছোটোবেলায় ‘পাপা যাবো’ বলে বায়না করতো তখন তোমার কোলে ওকে দেয়া তো দূর তোমার চেহারাটা যে দেখাবো সেটারই কোনো ব্যবস্থা ছিল না আমার কাছে। এরপর যত তোমার বিজনেস বাড়তে লাগলো, তত তোমাকে নিয়ে নিউজপেপারগুলোয় নানারকম চটকদার খবরও ছাপা হতে লাগলো। সেসব নিউজ পেপার থেকে তোমার নিউজের কাটিং থেকে, তোমার সোস্যাল মিডিয়ার প্রোফাইল থেকে।পিক কালেক্ট করে সেগুলো তোমার প্রত্যুষার হাতে তুলে দিয়েছি। কখনো কল্পনাও করতে পারি নি শুধু তোমার ছবিগুলো দেখেই তোমার মেয়ে তোমাকে চিনতে পারবে। জীবন আসলেই কখনো কখনো এতো সারপ্রাইজ দেয় বলা মুশকিল।
-আর একটাও নাটক নয় প্রজ্ঞা। শুভ্রা ঠিকই বলেছিল, তোমার মতো মেয়েকে ভালোবেসে যে ভুল করেছি সেটা জীবনেও শোধরানো সম্ভব নয়। যেই ধরা পড়েছ ওমনি নতুন গল্প বানানো শুরু করে দিয়েছ? বাহ!
-ওই মেয়েটাই যত নষ্টের মূল ধূসর। এবার বুঝতে পারছি আমি আসলে ও ইচ্ছে করেই ওইদিন তোমার ট্রিটমেন্টের সব খরচ দিয়েছে যাতে আমাকে বাধ্য করে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। বিশ্বাস করো ধূসর, ওইদিন আমি হসপিটালে তোমার ট্রিটমেন্টের বন্ডে সাইন করেছিলাম। ওই পেপার থেকেই আমার সাইন——।
-জাস্ট শাট ইওর মাউথ। শুভ্রাকে দোষ দেয়ার আগে নিজের দোষ স্বীকার করতে শেখো প্রজ্ঞা। পুলিশ ইনভেস্টিগেশনে কনফার্ম করেছে তুমি আমাকে দেখতে হসপিটালে আসোই নি। হাহ। আর যার নামে দোষ দিচ্ছ সেই শুভ্রাই দিনের পর দিন হসপিটালে বলো, বাসায় বলো আমার দেখাশোনা করেছে। যে মূহুর্তটায় আমার সবচেয়ে বেশি তোমাকে প্রয়োজন ছিল, সেই সময়ে তুমি পাশে ছিলে না আমার প্রজ্ঞা, ছিল শুভ্রা। সো ওর নামে একটাও বাজে কথা বলার চেষ্টাও করবে না।
-বাহ! দারুণ নাটক করতে পারে তো তোমার মা, শুভ্রা এরা সবাই। আমি বুঝতেই পারি নি ওরা আমার কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়ে কি সুন্দর আমাকেই তোমার চোখে ভিলেন বানিয়ে দিল! আর তুমি! যাকে এক সময় আমাকে অপমান করত বলে ঘৃণা করতে, আর সেই শুভ্রা নামে আমার মুখ থেকেও কিছু শুনতে রাজি নও! বাহ! তা বলছি এজন্যই কি ওকে বিয়ে করছ? আমার জায়গাটুকু পূরণ করেছে বলে? নাকি এটাও তোমাদের সবার আগে থেকেই ঠিক করা ছিল?
-প্রজ্ঞা?
এতোক্ষণ ধরে নিজের রাগটাকে সংযত করতে পারলেও এবারে ধূসরের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গেছে। প্রজ্ঞার কথাগুলোয় ছেলেটা এতোটা রেগে গেছে যে ধাক্কা দিয়েই প্রজ্ঞাকে গাড়ি থেকে নিচে নামিয়ে দিয়েছে।
-সুযোগ পেয়েছ বলে যা ইচ্ছে বলবে আর আমিও শুনবে সেটা তো চলবে না প্রজ্ঞা। আর নিজের দোষটা অন্য কারো ঘাড়ে না চাপিয়ে কিছু দায় অন্তত স্বীকার করতে শেখো। আর যেদিন চলে গেছ সেদিনই আমি কি করবো, বিয়ে করবো নাকি মরে যাবো এসব ব্যাপার জানার অধিকারটাও তুমি হারিয়েছ প্রজ্ঞা। সো ডোন্ট ট্রাই টু ক্রস ইওর লিমিট। আর দোয়া করো যেন আজকের পর যে কয়টা দিন এই শহরে আছো যেন ভুলেও আমার সামনে না পড়ো। আর যত তাড়াতাড়ি পারো নিজের কাজ শেষ করে চলে যাও, নিজের নতুন দুনিয়াতেই ফিরে যাও আবার। ভুলেও আমার জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করো না। কজ আমার জীবনে আর তোমার কোনো অস্তিত্ব নাই, থাকবেও না।
ধূসর কথাগুলো শেষ করেই শাঁ করি পাশ কাটিয়ে নিজের গাড়িটা নিয়ে চলে গেল। আর প্রজ্ঞা খালি, জনমানবশূন্য রাস্তাটায় স্তব্ধ হয় দাঁড়িয়ে আছে। এই ফাঁকা রাস্তা থেকে প্রত্যুষার কাছে কিভাবে ফিরবে তার চেয়েও বেশি ভয় করছে ধূসরকে হয়তো চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলছে বলে। এই দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার আধো কোনো উপায় আছে কিনা সেটাই ভাবতে গিয়ে দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে মেয়েটার। আর ঝাপসা চোখেও ধু ধু রাস্তায় একটা গাড়িকে এগিয়ে আসতে দেখলো প্রজ্ঞা। নিজেকে সামলে সেই গাড়িটাকেই থামানোর ইশারা করলো প্রজ্ঞা। গাড়িটার থামার বিন্দুমাত্রও কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। উল্টো গাড়িটা যেন সোজা প্রজ্ঞার দিকেই তেড়ে আসছে, প্রত্যেক সেকেন্ডে যেন গাড়িটার গতি আরো কয়েক গুণ করে বেড়ে যাচ্ছে, আর সরাসরি এগিয়ে আসছে প্রজ্ঞাকে লক্ষ্য করেই।
চলবে, ইনশাআল্লাহ
চলবে, ইনশাআল্লাহ