#হঠাৎ_তুমি_এলে
#পর্ব_১৯
#সুলতানা_পারভীন
-আহহহহহহহহহ। আবার ওই লোক, আবার ওই লোকটার কাছেই ফিরে যেতে হবে তোমার? আমি রাগ করেছি, অভিমান করেছি, বকেছি, কষ্ট দিয়েছি, মানছি। নিজেও যে এতোগুলো বছর তোমার জন্য তিলে তিলে পুড়ে মরেছি, তোমার অপেক্ষায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটেছে আমার সেসব কি কিছুই না প্রজ্ঞা? রাগ করে দূরে ঠেলে দিয়েছি বলে এতো সহজে চলে গেলে? একটাবার সামনে দাঁড়িয়ে কেন বললে না ‘আমি যা বলবো সব শুনতেই হবে’? পাঁচ পাঁচটা বছর ধরে বুকের ভিতরে যে যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরছি সেই কষ্টটা কি শুধু একা আমার? যদি ভুল করে ভুল বুঝে থাকি তবে সেই ভুলটা চোখে চোখ রেখে ধরিয়ে না দিয়ে কেন ওই লোকটার সাথে যেতে হবে তোমাকে? কেন কেন কেন? এতোদিন পর আমিই তোমাকে পাগলের মতো খুঁজে বের করেছি, তুমি নিজে তো ফিরে আসোই নি। তবু নিজেই জেদ দেখাবে আমাকে? কেন? কেন? কেন?
প্রজ্ঞাকে ফলো করতে করতে কালো রঙের গাড়িটার পিছু নিয়ে মার্কেট পর্যন্ত এসেছিল ধূসর। গাড়িটার ড্রাইভারটাকে একদমই সুবিধের মনে হয়নি ধূসরের। সেজন্য লোকটাকে ফলো করেছে, নাকি প্রজ্ঞার সেইফটির কথা চিন্তা করে, নাকি প্রজ্ঞার সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলে ভুল বোঝাবুঝিটা মিটিয়ে নিতে চাইছিল, সেটাও ধূসর জানে না। তবে কালো গাড়িটা প্রজ্ঞাকে মার্কেটের সামনে নামিয়ে দিতেই প্রজ্ঞা ভিড় ঠেলে হামিদের দিকে এগিয়ে যেতেই ধূসর নিজের গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়েছে। বিকেল থেকে সারাটা সন্ধ্যে পুরো শহরে পাগলের মতো গাড়ি ছুটিয়েও নিজের রাগটাকে কন্ট্রোলে আনতে পারে নি ছেলেটা। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে যখন অফিসে নিজের কেবিনে এসেছে ততক্ষণে ঘড়িতে আটটা বাজে। নিজের কেবিনটায় কিছুক্ষণ পায়চারি করে হাতের মোবাইলটা ফ্লোরেই সশব্দে ছুঁড়ে ফেললো। মোবাইলের ভাঙ্গা টুকরোগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে সেদিকেও হুঁশ নেই ধূসরের। কেবিনময় পায়চারি করতে করতে পাগলের মতো চিৎকার করেই কথাগুলো বলছে সে। ধূসরের চিৎকারের শব্দে প্রায় ঝড়ের বেগেই আদিব ছুটে এসেছে। কেবিনের দরজার বাইরে বাকি স্টাফরাও দল বেঁধে কি ঘটছে সেটা নিয়ে কানাঘুষা করছে তার শব্দও ভেসে আসলো দরজা খোলার সময়। খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দু একজন উৎসুক স্টাফ যে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে সেটা দেখেও কোনো অনুভূতিই যেন হচ্ছে না ধূসরের। ক্লান্ত, শ্রান্ত, পরাজিত সৈনিকের মতো সোফায় থপ করে বসে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে আছে ছেলেটা। আর আদিব? সে বেচারা কাঁপা কাঁপা হাতে একটা ফাইল শক্ত করে নিজের চেপে ধরে রেখেছিল এতোক্ষণ। সেটাই কোনোমতে ধূসরের সামনে এনে রাখলো।
-স্যার? এক-এক-একটা ইম্পর্ট্যান্ট ফাইলে-ফাইলে আপনার-আপনার সাই-সাইন লাগবে। আর্জেন্ট। একটা প্রজেক্টের কাজ শুরু হবে কাল থেকে। প্লিজ স্যার?
-মিস্টার আদিব? ফাইলটা রাখুন। আর আপনি এখন যান এখান থেকে। কতবার বলেছি আমি না ডাকলে আমার কেবিনে আসবেন না? আপনারা কি সামান্য এই বাংলা কথাটুকু বুঝতে পারেন না?
-আমমম। স-স্যা-স্যার। আমমমম। আর্জেন্ট সাইনটা লাগবে স্যার। আমি ফাইলটা নিয়ে আপনার বাড়িতেই-বাড়িতেই যাবার জন্য বের হচ্ছিলাম। আসলে কালই ফাইলটা সাবমিট করতে হবে——।
-আর ইউ ডাম্ব মিস্টার আদিব? আমার কথা কি শুনতে বা বুঝতে পারেন না আপনি? জাস্ট গেট আউট। গো।
-স্যার জাস্ট ২ মিনিট সময় লাগবে। আপনি সাইনটা করে দিলেই আর প্রবলেম থাকবে না। আমিও চলে যাবে। জানি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন। বাট বিলিভ মি স্যার অনেক কাজ পেন্ডিং এখনও। বড় স্যারও টাউনে নেই। কবে ব্যাক করবেন সেটাও জানি না আমরা। স্যারের অবর্তমানে কাজগুলো চালিয়ে নিতে হবে না স্যার? বিশ্বাস করুন জাস্ট ২ মিনিট সময় লাগবে, কয়েকটা সাইন জাস্ট—। প্লিজ স্যার।
আদিব কথাগুলো বলতে বলতে ধূসরের সামনে ফাইলটা মেলে ধরেছে ততক্ষণে। এই ছেলেটাকে এর আগে এতোটা মরিয়া হয়ে উঠতে কখনো দেখেনি ধূসর। রাগের মাথায় আদিবের এমন কাজে রীতিমতো বিরক্তই হচ্ছে ধূসর। কিন্তু সবসময় শান্ত এই ছেলেটা, যে কিনা ধূসরের একটা ধমক শুনলে কেঁপে উঠে সারাদিনে ধূসরের কেবিনের ধারেকাছেও আসে না, আজ হঠাৎ সেই ছেলেই এতো সাহস করে ধূসরের অর্ডার ডিনাই করছে কেন? ধূসর তীক্ষ্ম চোখে ভ্রু কুঁচকে আদিবের মুখের ভঙ্গিটা বোঝার চেষ্টা করছিল, এমন সময় আদিবের ডাকেই বাধ্য হয়ে ফাইলের দিকে তাকালো ধূসর। ধূসর যে সোফাটায় হেলান দিয়ে বসেছিল সেখানেই ফাইলটা বেশ খানিকটা বাঁকা করেই প্রায় ধূসরের মুখে কাছে ধরে রেখেছে ছেলেটা। আর নিজেও কেমন একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে ধূসরের দিকে ঝুঁকে এসেছে। ধূসর খানিকটা বিরক্ত হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতেই আদিব ব্যস্ত হাতে ফাইলের পাতা উল্টে কিছু একটার দিকে ইশারা করলো।
-এই যে স্যার, এখানটায় সাইন করতে হবে। এই যে এই লাইনটার ঠিক উপরে——-।
আদিবের এমন বাচ্চাদের মতো পয়েন্ট করে কোথায় সাইন করতে হবে সেটা দেখিয়ে দেয়ার ভঙ্গি দেখে ধূসর বিরক্ত হয়ে ফাইলটা আদিবের হাত থেকে টেনে নিয়ে সোজা হয়ে বসে ফাইলটা টি-টেবিলের উপরে রেখে টেবিলের উপর থেকে সাইন করার জন্য কলম নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই আদিব আবার আঙ্গুল দিয়ে লাইনটার দিকে পয়েন্ট করলো। ধূসর এবারে চোখ মুখ লাল করে আদিবের ফ্যাকাশে মুখটার দিকে তাকালো।
-এই যে স্যার? এই যে এই লাইনটার নিচে, এই যে এখানে সাইন করতে হবে।
-হোয়াটস দা প্রবলেম আদিব? আমাকে কি গণ্ডমূর্খ মনে হয় তোমার? আমি জানি না কোথায় সাইন করতে হয়? গাধা ভাবো আমাকে? এক কাজ করো, টিপসই দিই? চলবে? আমি তো পড়তে পারি না স্যার। সিগনেচার না দিয়ে টিপছাপ দিলে চলবে না?
-আমমমমম। স্যার আসলে—–। আসলে স্যার হয়েছে কি এই প্রজেক্টটা আগের প্রজেক্টগুলো থেকে একটু আলাদা। বেশ কিছু ক্লজ—-ইয়াপ কন্ডিশন- কন্ডিশন দেয়া আছে বেশ কিছু। তাই বলছি যে একটু যদি চেক করে সাইন করতেন তাহলে পরে কোনো প্রবলেম হতো না। এই আর কি—-।
-নো থ্যাংকস। যদি কন্ডিশন ফুলফিল করতে পারবে না মনে হয় তাহলে প্রজেক্ট নিচ্ছ কেন? ডিজগাস্টিং!
-স্যার। বেশি না স্যার। কয়েকটা কন্ডিশন জাস্ট। চেক করে নিন প্লিজ?
-ওকে ফাইন। শো মি। কি এমন কন্ডিশন যে তুমি আমাকে না দেখিয়ে থাকতে পারছ না?
ধূসরের কথায় এতোক্ষণে যেন মুখের ফ্যাকাশে ভাবটা কিছুটা দূর হয়েছে আদিবের। লোকটা বেশ উৎসাহ নিয়ে লাইনটার দিকে আবার পয়েন্ট করলো। এতোক্ষণে লেখাটা স্পষ্ট খেয়াল করে পড়ে আদিবের দিকে তাকালো ধূসর। ইংরেজি লাইনটাকে বাংলা অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় সেটা পড়ে আপনাআপনিই ধূসরের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেছে।
“কিছু না বলে আমার দেখানো লাইনগুলো পড়ে যান স্যার। লাস্ট লাইনটা পড়া হয়ে গেলে আপনি কিছু না বলে শুধু সাইনটা করে দিবেন।”
ধূসরের লাইনটা পড়া শেষ হয়েছে বুঝতে পেরে এবারে আদিব এক এক করে আরো বেশ কয়েকটা লাইনের দিকেই পয়েন্ট করে দেখাচ্ছে। ধূসরও একটু অবাক হলেও চুপচাপ আদিবের কথাটাই মেনে নিয়ে শুধু লেখাগুলো পড়ে চলেছে। পুরো ইংরেজিতে তৈরি একটা প্রজেক্টের ফাইলে এসব ঢোকানোর মানে কি সেটাই বুঝতে পারছে না লোকটা। শুধু লাইনগুলোর কথাগুলোই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ধূসরের।
“আমাদের এই চেষ্টাটা কাজে লাগবে কিনা জানি না স্যার। আপনি এখান থেকে বেরিয়ে সোজা স্বপ্নকুটিরে চলে যান। আপনার গাড়িতে নয়, পার্কিংয়ে আপনার জন্য সাদা একটা গাড়ি অপেক্ষা করে আছে। যে কাজটা করার সাহস এতোদিন কারো হয়নি, আজ সবাই মিলে সেটাই করতে চলেছি স্যার। জানি না সফল হবো কিনা। কিন্তু জানবো অন্তত আপনাকে সত্যিটা জানানোর চেষ্টা তো করেছি।”
‘স্বপ্নকুটির’ নামটা পড়তেই ধূসর কিছুটা অবাক হয়েই আদিবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলেটা ছাড়া স্বপ্নকুটিরের কথা আর কেউ জানে না। এমন কি বাবা মা শুভ্রা কেউ না। গত পাঁচ বছরে একবারের জন্যও বাড়িটায় পা ফেলে নি ধূসর। কিন্তু আদিব স্বপ্নকুটিরে কেন যেতে বলছে? বলছে না ঠিক। এমনভাবে লিখে লিখে কিছু বুঝাতে চাইছে যেন এই রুমে ধূসর আর আদিব ছাড়াও অন্য কেউ আছে, কেউ যেন ওদের কথাগুলো লুকিয়ে শুনছে এমন কেন মনে হচ্ছে ছেলেটার হাবভাব দেখে?
-স্যার কন্ডিশনগুলো মে বি ঠিকই আছে। তবু আপনি একবার ভালো করে চেক করে নিয়েছেন তো? স্যার সাইনটা?
ধূসর এবারে চুপচাপ কিছু না বলেই সাইনটা করে দিল। আদিব ততক্ষণে ফাইলটা বন্ধ করে একটা কার কিজ টি-টেবিলের উপরে রেখে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টানলো।
-হ্যাভ এ সেইফ জার্নি স্যার।
আদিব বেরিয়ে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ পুরো ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করলো ধূসর। আসলে ঘটছে টা কি? এর আগে আদিব কি কখনো এমন অদ্ভুত বিহেভ করেছে? মনে পড়ছে না ধূসরের। করলেও হয়তো ততটা গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করে নি ধূসর। তবে আজ ছেলেটা কি বলতে চাইছে সেটা জানার বেশ কৌতূহলই হচ্ছে ধূসরের। তাই আদিবের রাখা গাড়ির চাবিটা তুলে নিয়েই প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল। গন্তব্য স্বপ্নকুটির।
অন্যদিকে, সকাল হতে না হতেই আলিশান একটা অফিসের ওয়েটিং রুমে বসে কারো অপেক্ষা করছে প্রজ্ঞা। পাশে হাসিহাসি মুখে হামিদ সাহেব ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। ভদ্রলোকের হাসিটায় আজ কেমন একটা নার্ভাসনেসের ছোঁয়া টের পাচ্ছে প্রজ্ঞা। ওর নিজের কাছে যে একটু ভয় ভয় লাগছে না তাও নয়। তবু অপেক্ষা করছে কারো সাথে দেখা করার। বেশ কিছুক্ষণ পরেই একটা মেয়ে এসে প্রজ্ঞাকে একটা কেবিন দেখিয়ে সেটায় গিয়ে বসতে বললো। হামিদ সাহেব সাথে যেতে চাইলে মেয়েটা সোজা বারণ করে দিলো। প্রজ্ঞা একটু হেসে হামিদ সাহেবকে অপেক্ষা করতে বলে কেবিনটার দিকেই এগিয়ে গেল। এক পা দু পা করে কেবিনটায় গিয়ে দাঁড়ালো প্রজ্ঞা। দরজার মুখোমুখি ডেস্কে উল্টোদিকে চেয়ার ঘুরিয়ে কেউ একজন বসে আছে। প্রজ্ঞা কেবিনের দরজায় হালকা আঙুলের টোকা নিয়ে নক করলো একবার।
-মে আই কাম ইন প্লিজ?
প্রজ্ঞার প্রশ্নটা শেষ হওয়া মাত্রই পরিচিত একটা মেয়েলি কণ্ঠের হাসি আর কথা শুনে চমকে সামনের দিকেই এগিয়ে এলো প্রজ্ঞা।
-ওয়েলকাম মিসেস ধূসর আহমাদ। উপস সরি। ওয়েলকাম, ওয়েলকাম, ওয়েলকাম মিস প্রজ্ঞা, এক্স ওয়াইফ অফ মিস্টার ধূসর আহমাদ।
-শুভ্রা! তুমি?
প্রজ্ঞা থতমত খেয়ে সামনে ডেস্কের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে চেয়ার ঘুরিয়ে ফিরে তাকিয়ে আবার শব্দ করেই হাসছে শুভ্রা।
-এতো ভালো টাইমিং তোমার আমার একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না জানো প্রজ্ঞা? উফ! বাট ইউ বিট্রেইড মি। তুমি বলে গিয়েছিলে আর ধূসরের লাইফে আসবে না। অথচ দেখো? এতো বেহায়া মেয়ে তুমি মাত্র পাঁচ বছরেই নিজের দেয়া কথাটা বেমালুম ভুলে গেলে? তা ধূসরকে বিদায় দিয়ে ওই বুড়ো ডাক্তারের কাছে চলে গেলে কি করে? কি সিন বলো তো ওই বুড়োর সাথে? আমার জানা মতে লোকটা তো বিয়েও করে নি। অথচ তার সম্পত্তি পুনরোদ্ধারে তুমি হঠাৎ মাসিহা হয়ে এলে কি করে?
-একদম বাজে কথা বলবে না শুভ্রা। এতোটা নিচ মেন্টালিটি কেন তোমার হ্যাঁ? ডাক্তার সাহেব আমাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করেন? উনার কারণেই সেদিন সব হারিয়ে মরতে মরতেও বেঁচে গিয়েছিলাম আমি। হয়তো আজ তোমার মুখোমুখি হবো বলেই আল্লাহ সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। যাতে তোমার মতো একটা অসভ্য নরকের কিটের আসল রূপটা সবার সামনে আনতে পারি আমি।
-ও রিয়েলি? আমি যতদূর জানি তুমি ধূসরের এক্সিডেন্টের পর ওকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের পুরোনো কোনো প্রেমিকের সাথে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছিলে।
-জাস্ট শাট আপ। মাকে বোকা বানিয়ে সেদিন আমাকে ধূসরের থেকে দূর করেছিলে তুমি। তুমি তুমি শুভ্রা। আর আমি ধূসরকে ছেড়েও যাই নি।
-তাই নাকি? বাট পুলিশ তোমার সাইন করা ডিভোর্স লেটারটা পাঁচ বছর আগেই পেয়েছে প্রজ্ঞা। আর ধূসরকে দেখছ না? সে তো জানে তুমি বাড়ির সব ক্যাশ, গয়না, এসব নিয়ে জাস্ট পালিয়ে গেছ। কাল বিকেলে বলে নি বুঝি? তা খবর পেলাম নতুন সংসারে একটা মেয়েও আছে তোমার? ভারি মিষ্টি নাকি দেখতে মেয়েটা? কার মতো হয়েছে গো? তোমার? নাকি ওই যে তোমার ডাক্তার ———-।
-জাস্ট শাট আপ।
-কি মুশকিল! আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? গত পাঁচ বছর ওই লোকটার সাথে, এক বাড়িতে রয়েছ কথাটা আমি কিন্তু ধূসরকে বলি নি এখনও বিশ্বাস করো? বাইরে বসা তোমার দারোয়ানকে দেখে তোমার এক্স হাজবেন্ড এতোটা জেলাস হয়েছে যে আমার আগুনে ঘি ঢালার দরকারই হয়নি। বিলিভ মি।
-তোমার কষ্ট করে কিছু বলতে হবে না শুভ্রা, যা বলার ধূসরকে আমি নিজেই বলবো। কি করে সেদিন তুমি আমাকে বাধ্য করিয়েছিলে চলে যেতে, কি করে আমার হসপিটালের পেপারে করা সাইনটাকে ডিভোর্সপেপারে দেখিয়েছ, আর কিভাবে এখনও একজন বৃদ্ধ মানুষের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিতে চাইছ।
-উপস। সেই বৃদ্ধ মানুষের দারোয়ানের সাথে তোমাকে দেখে আমাদের ধূসর সাহেব এতোটা রেগে গেছে যে তোমার কোনো কথা শুনবে বলে আমার তো মনে হয় না। ওকে, তুমি যদি ধূসরকে কনভেন্স করতে পারো সব দোষ আমার, তাহলে আমি সব ফিরত দিয়ে দিবো তোমাকে। তোমার সংসার, তোমার শ্বশুর, শাশুড়ি, তোমার বৃদ্ধ মানুষটার জমি, সব।
-মানে?
-যাও যাও। বাড়িটা এখনও সেইম জায়গাতেই আছে। আমিও অপেক্ষা করছি ধূসর কেমন করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তোমাকে বাড়ির চৌকাঠ থেকেই ছুঁড়ে বাইরে ফেলে সেটা দেখার।
-কখনোই না। ঘাড় ধাক্কা যদি পাওয়ার হয় তবে সেটা পাবে তুমি শুভ্রা। আমি নই।
-ওকে, লেটস সি। বাট ধূসর যদি তোমার কথা বিশ্বাা না করে তাহলে তোমাকে কিন্তু তোমার ওই বুড়ো ডাক্তারের কাছেই ফিরে যেতে হবে। কথাটা মাথায় রেখো। নইলে এই শহরে কত কিছু যে হয় রাস্তাঘাটে, বলা মুশকিল। তাছাড়া এতো ছোট বাচ্চাকে অন্য কারো ভরসায় রেখে এভাবে বাইরে বাইরে ছুটোছুটি করতে হয় না প্রজ্ঞা। কখন কি হয়ে যায় বলো তো?
-শুভ্রা? প্রত্যুষার কিছু করার কথা ভাবলেও তোকে খুন করে ফেলবো আমি।
-আমি কি করলাম? এজন্যই বলে কারো ভালো চাইতে নেই। ধ্যাত।
-এই ন্যাকামিগুলো না ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখ। তোর এতোদিনের কৃতকর্মের শাস্তি তোকে আমি নই, ধূসর নিজে দিবে।
-আআআআআআ। সো সুইট। আই উইল ওয়েট ফর হিম। বাট তুমি ফিরে এসো কিন্তু প্রজ্ঞা। ধূসর আসুক না আসুক, তুমি কিন্তু এসে পেপারে সাইন করে দিয়ে যেও। আমার সুপারশপের কাজটা শুরু করতে হবে তো? তাই না?
প্রজ্ঞা রাগের চোটে আর কিছু না বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকেই দ্রুত পায়ে ছুটলো। হামিদ সাহেব প্রজ্ঞাকে এভাবে ছুটে বের হতে দেখে নিজেও জোর পায়ে প্রজ্ঞার সাথে সাথেই চললো হাতের ম্যাগাজিনটা ফেলে রেখে। প্রজ্ঞাকে ভদ্রলোক হাজারটা প্রশ্ন করে চলেছে ঠিকই, কিন্তু প্রজ্ঞার সেসব যেন কানেই ঢুকছে না। ছুটতে ছুটতে বিশাল অফিসটা থেকে বেরিয়ে রোডের দিকেই পা বাড়িয়েছে প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার এতো তাড়াহুড়োর কারণ না বুঝলেও ভদ্রলোক নিজেও ছুটছেন প্রজ্ঞার সাথে। হঠাৎই আশেপাশের মানুষেরা উচ্চস্বরে কিছু একটা বলছে শুনে হামিদ সাহেবও মুখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল জিনিসটা। আর গলা দিয়ে একটা চিৎকারই বের হলো ভদ্রলোকটির।
-ম্যাডাম, গাড়ি——।
#হঠাৎ_তুমি_এলে
#পর্ব_২০
#সুলতানা_পারভীন
-তোমার সাহস হলো কি করে আবার এই বাড়িতে আসার? কি দেখতে এসেছ প্রজ্ঞা? কি দেখতে এসেছ? তোমার ছেড়ে যাওয়া বাড়িটা আগের মতো আছে কিনা সেটা দেখতে এসেছ? নাকি নতুন কেউ এসে সেই জায়গাটা দখল করেছে কিনা সেটা চেক করতে এসেছ? ডোন্ট ইউ ওয়ারি প্রজ্ঞা। তুমি নতুন করে, নতুন কারো সাথে সবটা নতুন করে শুরু করেছ যখন এবার আমিও করবো। এতো বছর তো জানা ছিল তুমিও নিজের জীবনে এতোটা এগিয়ে গেছ, এবার আমার নতুন করে জীবনে শুরু করতে তো কোনো বাধা রইলো না আর তাই না? সো তোমার নতুন জীবনে শান্তিতে থাকো, আমাকেও আমার মতো শান্তিতে থাকতে দাও।
শুভ্রার আলিশান অফিস থেকে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে আসার সময়েই আরেকটু হলেই কালো রঙের গাড়িটা প্রায় ধাক্কাই দিয়েছিল প্রজ্ঞাকে। হামিদ সাহেব ছুটে এসে প্রজ্ঞার হাত টেনে পিছনের দিকে টেনে নিতেই গাড়িটা শাঁ করে প্রজ্ঞার সামনে দিয়ে চলে গেল। আশপাশে একটা জটলা মতো পাকিয়ে গেছে ততক্ষণে। সবাই কিছুক্ষণ এতো কেয়ারলেসভাবে চলার জন্য প্রজ্ঞাকে লেকচার দিলেও প্রজ্ঞা সেসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাচ্ছে না। ওর মাথায় তখনও চলছে ধূসরের কাছে কিভাবে নিজের নির্দোষিতার প্রমাণ দিবে। ভিড় করে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর কথার খোঁচা গায়ে না মেখে আবার রাস্তার দিকে পা বাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে থামতে হলো প্রজ্ঞাকে। হামিদ নামের সদাহাস্য লোকটা প্রজ্ঞার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পথ আটকে দাঁড়াতেই প্রজ্ঞা হামিদ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাকই হলো। লোকটার হাসিটা ঠোঁটের কোণ থেকে হারিয়ে গিয়ে সেখানে বিন্দু বিন্দু করে জমা হয়েছে রাজ্যের ভয়, আতঙ্ক। কিন্তু লোকটা কাকে ভয় পাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না প্রজ্ঞা। হামিদ সাহেব রাস্তার ডানে বামে ভালো করে দেখে প্রজ্ঞার হাতটা ধরে টেনে জায়গাটা থেকে বেরিয়ে এসে সামনে থেকে আসা একটা সিএনজিতে উঠিয়ে দিয়ে নিজে সিএনজির বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। হামিদ সাহেবের এমন কাজে বিস্ময়ের চোটে কোনো রিএক্ট করতেই ভুলে গেছে বেচারি। ব্যস্ত শহরের হাজার শোড়গোলের মধ্যেও হামিদ সাহেবের কথাগুলো কানে এসে ধাক্কা খেল প্রজ্ঞার।
-ওদের লোকজন আমাদের অনেক আগে থেকেই ফলো করছে ম্যাডাম। কাল আপনাকে ওই কালো গাড়িটা থেকে নামতে দেখেই আমার কেমন সন্দেহ লেগেছিল। এখন দেখলেন তো ওই গাড়িটা অফিস কম্পাউন্ডেই আরেকটু হলেই কিভাবে আপনাকে এক্সিডেন্ট করে চলে যেত? কেউ বুঝতেও পারতো না এটা যে একটা প্রি-প্ল্যানড এক্সিডেন্ট ছিল।
হামিদ সাহেবের কথাগুলো শুনে রীতিমতো শকড হয়ে হা করেই লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো প্রজ্ঞা। ভদ্রলোক কি বলছে সেটাও যেন মেয়েটা বুঝতে পারছে না। ব্যস্ত রাস্তার হাজার গাড়ির শব্দও কানে না পৌঁছে কেমন একটা ঝাঁ ঝাঁ শব্দ হচ্ছে মাথার ভিতরে। শুভ্রা ওকে ধূসরের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিবে এটা ভাবাটাই আসলে ভুল ছিল প্রজ্ঞার। প্রজ্ঞার ভাবনার তারটা কেটে গেল হামিদ সাহেবের হাতের ঝাঁকানোয়।
-ওই লোকগুলো আপনার কোনো ক্ষতি করে দেয়ার আগে আপনি প্রত্যুষা মামনিকে নিয়ে ডাক্তার সাহেবের কাছে ফিরে যান ম্যাডাম। আমি দেখি এ দিকটা কিভাবে ম্যানেজ করা যায়। মালিক পক্ষের কেউ না থাকলে ওরা জায়গাটা দখল করতে পারলেও বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না।
-হামিদ সাহেব?! আপনি বাড়ি ফিরে যান। আমি জরুরি একটা কাজে যাচ্ছি। আপনার এখন প্রত্যুষা, অদিতি আর লতা ভাবির পাশে থাকা প্রয়োজন। আমি এদিকটা সামলে নিতে পারবো। চলুন ভাই। একটু দেখবেন যেন কেউ আমাদের ফলো করতে না পারে—–।
-কিন্তু ম্যাডাম? ওরা আপনার কোনো ক্ষতি করে ফেললে আমি ডাক্তার সাহেবকে কি জবাব দিব? প্রজ্ঞা ম্যাম?
হামিদ সাহেবের কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই প্রজ্ঞার কথায় সিএনজি অটোরিকশা চালক গাড়ি ছুটিয়েছে। হামিদ সাহেবের চিন্তিত মুখটা পিছন থেকে রাজ্যের আতঙ্ক নিয়ে সেখানে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে প্রজ্ঞা সোজা চলে এসেছিল ধূসরের বাড়িতে। পাঁচটা বছর পর বাড়িটায় পা দিতেই যেন একটা দমকা হাওয়া সমস্ত স্বত্তাটা কাঁপিয়ে দিয়ে গেল প্রজ্ঞার। বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে পাঁচ বছর আগে ঠিক যেভাবে বাড়িটা ছেড়ে গেছিল প্রজ্ঞা, বাড়িটা ঠিক যেন সেভাবেই রয়ে গেছে। একটুও যেন বদলায় নি বাড়ির একটুকু একটা অংশও। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে প্রজ্ঞা একটা একটা জিনিস হাতে ছুঁয়ে দেখছিল এমন সময়ই মেয়েটার বাম হাতটা কেউ পিছন থেকে টেনে ধরে কথাগুলো বলে। হাতের স্পর্শ আর কথা দুটোই যে ধূসরের সেটা বুঝতে দেরি হয়নি প্রজ্ঞার। তাই ধূসরের অপমানগুলো গায়ে না মেখেই ধূসরের দিকে ফিরে এক পা এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই ধূসর নিজের বাম হাতটা উঁচু করে প্রজ্ঞাকে সামনে আসতে বাঁধা দিল।
-নতুন করে তোমার আর কোনো নাটক দেখার মতো সাহস বা মনের জোর কোনোটাই অবশিষ্ট নেই আমার। তুমি নিজের জীবনে ভালো থেকো, এটাই প্রার্থনা করি। নাউ ক্যান ইউ প্লিজ গেট আউট? আমার জীবন থেকে, এই বাড়িটা থেকে এতোটা দূরে যাও যেন তোমার আর তোমার মেয়ের মুখটা আমাকে কখনো দেখতে না হয়। এই দয়া টুকু করতে পারবে প্লিজ প্রজ্ঞা? প্লিজ?
-ধূসর? প্লিজ আমার কথাটা বিশ্বাস করো? আমি তোমাকে এক সেকেন্ডের জন্যও ধোঁকা দিই নি। তোমাকে ফেলে আমি সত্যিই যাই নি ওইদিন। বিশ্বাস করো সেদিন এক্সিডেন্টটা আসলে এক্সিডেন্টও ছিল না। শুভ্রা প্ল্যান করে তোমাকে——। ডাক্তাররা আমাকে মিথ্যে বলেছে যে তোমার অপারেশনের জন্য বিশ পঁচিশ লাখ টাকা লাগবে। ওই পুরো ঘটনাটা শুভ্রার সাজানো নাটক ছিল ধূসর। আমি বুঝতে পারি নি কিভাবে ওদের পাতা ফাঁদে পড়ে আমি বোকার মতো——।
-বোকার মতো কি প্রজ্ঞা? বোকার মতো ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দিয়ে পালিয়ে গেছিলে? কি ভেবেছিলে? ডিভোর্স দিয়ে দিলে আইনতভাবেই আমার ভাগের সম্পত্তির ৫০% তো পেয়েই যাবে। এমনিতে তো আমি মরে গেলেও একটা কানা কড়িও আমার বাবার থেকে পেতে না, এটাই ভেবেছিলে তো তুমি?
-ধূসর? কি বলছ এসব? তুমিও শুভ্রার কথাটাই বিশ্বাস করেছ শেষ পর্যন্ত? জানো ওইদিন মাও ওর কথা বিশ্বাস করে আমাকে হসপিটাল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তুমি মাকে একবার জিজ্ঞেস করো, আমি সত্যি বলছি কি না—–।
-আমার কাউকেই জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। ইউ জাস্ট গেট আউট—-। যার নামে ফেইক এতোগুলো এলিগেশন দিলে সেই শুভ্রাই সেদিন মায়ের একটা কলে আমার অপারেশনের জন্য পঁচিশ লাখ টাকা নিয়ে অতো রাতে হসপিটালে এসে হাজির হয়েছিল। আর ওর জন্যই আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি কথাগুলো বলতে পারছ প্রজ্ঞা। গলা উঁচিয়ে তার দিকেই আঙুল তুলতে পারছ, যার জন্য আজ পাঁচটা বছর আমি সুস্থ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছি।
-সব সব সব মিথ্যে। সব ওই শুভ্রার সাজানো নাটক। তুমিও ওর সাজানো নাটকগুলো সত্যি মনে করে বিশ্বাস করে নিয়েছ ধূসর? আমি কি করে তোমাকে বুঝাই? আহহহহহ। বিশ্বাস করো ওই শুভ্রাই সব করেছে। তোমার এক্সিডেন্ট করিয়েছে, তোমার কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আজও তোমার কাছে ভালো হওয়ার নাটক করে চলেছে——।
-এনাফ ইজ এনাফ প্রজ্ঞা। যথেষ্ট বলে ফেলেছ তুমি। তোমার মুখ থেকে শুভ্রার নামে আর একটা বাজে কথাও আমি শুনতে চাই না। ওর নামে যদি আর একটাও বাজে কথা বলো তুমি তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না বলে দিলাম।
ধূসরের এমন অদ্ভুত ব্যবহার আর শুভ্রার জন্য এমন অন্ধ ভরসা দেখে প্রজ্ঞা ব্যাপারটা হজম করতে পারলো না। এক পা এগিয়ে এসে ধূসরের হাতটা ধরার চেষ্টা করতেই ধূসর ঝাড়া দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল।
-কেন এমন করছ ধূসর? আমার মুখেও যে মেয়েটার নাম তুমি সহ্য করতে পারতে না, সেই তুমিই কিনা ওই মেয়েটার হয়েই আজ সাফাই গাইছ? কেন ধূসর? কেন?
-কজ শুভ্রা তোমার মতো ধোঁকাবাজ নয় প্রজ্ঞা। ও আমাকে ভালোবেসেছে, শুধু আমাকেই ভালোবেসেছে। আমার হাজার অপমান, অসম্মান করা স্বত্ত্বেও শুধু আমাকেই পেতে চেয়েছে। এর বেশি তো কিছুই ওই মেয়েটা কখনো চায় নি। কিছু পাবে না জেনেও এই পাঁচটা বছর আমার পাশে ছায়ার মতো হয়ে ছিল। আমার বিপদে, কষ্টে, হতাশায় আমার ঢাল হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, যতবার ভেঙ্গে পড়েছি ততবার বন্ধু হয়ে শান্তনার জন্য কাঁধ বাড়িয়ে দিয়েছে আমার কষ্টের ভাগিদার হতে। সেই মেয়েটাকেই অবিশ্বাস করি কি করে বলো তো? আর কার কথায় অবিশ্বাস করবো বলো তো? তোমার? যে আমাকে বিপদের দিনে একা ফেলে জাস্ট পালিয়ে গেছে। তার কথায়?
-আমি তোমাকে ফেলে পালিয়ে যাই নি ধূসর। সেদিন হসপিটাল থেকে বের হওয়ার পরই একটা এক্সিডেন্ট ঘটে। যে বয়স্ক ডাক্তারের গাড়ির সামনে আমি সেন্সলেস হয়ে যাই, উনিই আমাকে নিজের সাথে নিয়ে যায়। বিশ্বাস করো প্লিজ? আমি তোমার কাছে কিভাবে পৌঁছাবো সেটাই ভাবছিলাম তখনও। কতোগুলো ঘন্টা পর যখন সেন্স আসে তখন অন্য কোনো শহরে আমি। সেখানেই জানতে পারি তোমার ভালোবাসার অংশের অস্তিত্বের কথা।
-এনাফ ইজ এনাফ প্রজ্ঞা। অনেক গল্প শুনিয়েছ এতোক্ষণ ধরে। আর নয়। এতো নাটক না করে সোজাসুজি বলে দাও কি জন্য এসেছ আবার? কি চাইতে এসেছ? টাকা? কত টাকা লাগবে বলো? নো নো ওয়েট–আমি একটা ব্ল্যাঙ্ক চেক এ সাইন করে দিচ্ছি। তুমি তোমার পছন্দ মতো এমাউন্ট ফিলআপ করে নিও। ডোন্ট ওয়ারি। ব্যাংক থেকে কোনো ঝামেলা ছাড়াই টাকাটা উইথড্র করে নিতে পারবে তুমি। যে কাজটা গতবার করতে পারো নি, এবার সেটা হবে না। এই নাও চেকটা ধরো? এন্ড লিভ প্লিজ?
-ধূসর?
-প্লিজ টেইক ইট, এন্ড লিভ প্রজ্ঞা।
ধূসর রীতিমতো জোর করে প্রজ্ঞার হাতে নিজের সাইন করা ব্ল্যাঙ্ক চেকটা ধরিয়ে দিলেও প্রজ্ঞা শুধু ফ্যালফ্যাল করে ধূসরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাগ করে ধূসরের দেয়া চেকটা শত শত খন্ড করে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতে পারছে না ধূসরের চোখের দিকে তাকিয়ে। কেন জানি প্রজ্ঞার বারবার মনে হচ্ছে ধূসর ইচ্ছে করেই কথাগুলো বলছে যাতে প্রজ্ঞা কষ্ট পায়। ধূসরের চোখ আর মুখের ভঙ্গির সাথে ওর বলা একটা কথারও কোথাও যেন মিলই খুঁজে পাচ্ছে না মেয়েটা। প্রজ্ঞার কথাগুলো ভাবার ফাঁকেই প্রজ্ঞার মোবাইলটা শব্দ করে বেজে উঠতেই প্রজ্ঞা চমকে উঠে কলটা রিসিভ করতেই ধূসর প্রায় ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে ফ্লোরে আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে ফেললো। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে প্রজ্ঞা এক কথায় স্তব্ধ হয়ে ধূসরের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মূহুর্ত। ধূসর এবারে প্রজ্ঞার একটা হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে প্রজ্ঞাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিল। সরাসরি প্রজ্ঞার চোখে চোখ রেখে কয়েকটা কথা বলেই প্রজ্ঞার মুখের উপরেই দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করে দিল ধূসর। আর কথাগুলো মাথার মধ্যে টেপরেকর্ডারের মতো বাজতে বাজতেই প্রজ্ঞা কেমন একটা ঘোরের মধ্যেই রাস্তার দিকে পা বাড়িয়েছে। মেয়েটার কানে তখনও বেজে চলেছে ধূসরের কথাগুলো। আর তখনও প্রজ্ঞার হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা আছে ধূসরের জোর করে ধরিয়ে দেয়া ব্লাঙ্ক চেক টা।
-নিজের মেয়েকে নিয়ে এতোটা দূরে চলে যাও যেখানে কেউ তোমাদের খুঁজে পাবে না প্রজ্ঞা। এতোটা দূরে চলে যাও যেখানে তোমার স্বপ্নের স্বপ্ন ঘেরা কুটির থাকবে আর তোমার মেয়ে থাকবে, আর কেউ না। আমার লাইফে, আমার বাড়িতে ফিরে আসার ভুলটা ভুলেও আর করবে না কখনো। বাকিরা ছেড়ে দিলেও আমি কিন্তু তোমাকে মরে গেলেও ক্ষমা করবো না কোনোদিন। কোনোদিন না।
চলবে
((