#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ১০
ফারহানের কথায় নিরু মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। নিধির জন্যই মন খারাপ হচ্ছে তার। কতটা দিন হয়ে গেল মেয়েটার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। কোথায় আছে, কেমন আছে কিচ্ছু জানা নেই।
ফারহান আর কিছু না বলে নিরুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
নিধি নিরুর ছোট বেলার বান্ধবী। স্কুলে ভর্তি হয়েছে থেকে নিধির সাথে তার বন্ধুত্ব। স্কুল, কলেজ, কোচিং সব জায়গায়ই দুইজন একসাথে পড়ালেখা করেছে। বাড়িও পাশাপাশি। একজনের এমন কোনো কথা নেই যা অন্যজন জানতো না। বোনের মতো ছিল একদম। দুজনে সবসময় একসাথেই থাকতো। অন্যরকম একটা টান ছিল দুজনের মাঝে। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতেই নিধি পালিয়ে গেল তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে। ছেলেটা মোটেও ভালো নয়। নিরু বাঁধা দিয়েছিল ওকে কিন্তু শোনেনি। পালিয়ে যাওয়ার সময় ফোনটাও বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগই হয়নি। নিরুর তো মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয় যে ছেলেটা ওর কোনো ক্ষতি করে দেয় নি তো?
ফারহান নিরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্বান্তনার স্বরে বললো, “মন খারাপ করো না প্লিজ। দেখো একদিন নিধি ঠিকই ফিরে আসবে।”
নিরু ভেজা স্বরে বললো, “কবে আসবে ও? ওই লোকটা ওর কোনো ক্ষতি করেনি তো? ও ঠিক আছে তো?” বলতে বলতেই নিরুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
“নিধির ক্ষতি করবে কেন?”
“ওই লোকটা একটা গুন্ডা। একদম ভালো ছেলে নয়।”
“যদি সে নিধিকে ভালোবেসে থাকে তাহলে কখনো কোনো ক্ষতি করবে না আর যদি ভালোই না বাসে তাহলে ক্ষতি করতে দু’বার ভাববে না।”
“ওর মামারা শুনেছি অনেক ক্ষমতাবান তারা কী ওকে খুঁজতে চেষ্টা করেনি? আপনাদের বাড়ির কাছেই না-কি বাসা। আপনি কিছু জানেন না?”
“ওইসব কথা কী আর কেউ জনসম্মুখে বলে বেড়ায়? খুঁজলেও হয়তো গোপনে খুঁজেছে। কাউকে জানায়নি। নিধির পালানোর কথাটাই শুধু শুনেছিলাম। এর বেশি কিছু না।”
“ওহ।”
ফারহান নিরুর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো, “হুম,এবার একটু শান্ত হও। চলো ঘুমাবে। অনেক রাত হয়েছে। একদম কাঁদবে না।”
ফারহান নিরুকে শান্ত করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
__________________
পরেরদিন সকালে ফারহান অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আর নিরু বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে।
ফারহান টাই বাঁধতে বাঁধতে একটু রাগী স্বরে বললো, “তোমাকে বলেছি না দাঁত দিয়ে নখ কাটবে না। আবারো একই কাজ করছো।”
নিরু মুখ থেকে হাত সরিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো বসে রইলো।
ফারহানের রেডি হওয়া শেষ হলে নিরু উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আজকে আসবেন আপনি?”
“না আসার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা কালকে সকালে একটা মিটিং আছে। আর এখান থেকে গেলে মিটিংয়ে দেরি হয়ে যাবে।”
নিরু মন খারাপ করে বললো, “ওহ, আচ্ছা।”
ফারহান নিরুর কপালে একটু সময় নিয়ে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বললো, “মন খারাপ করো না। কালকে আসবো।”
“আচ্ছা।”
ফারহান নিরুকে বিদায় জানিয়ে অফিসে চলে গেল আর নিরু তার মায়ের রুমে গেল। মায়ের সাথে বসে গল্প করবে এখন। দিন তো পেরিয়েই যাচ্ছে। ওবাড়ির কথাও মনে পড়ছে।
নিরুর মা ওকে সংসার সামলানোর বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দিচ্ছে। মাকে বারণ করা স্বত্তেও বলেই যাচ্ছেন তাই নিরু আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সেগুলো শুনছে আর হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলাচ্ছে।
___________________
আজ ফারহান আসবে না তাই নিরু তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম পাচ্ছে তার। ফারহান আসলে তবুও জেগেই থাকতো।
রাত এগারোটায় ফোন করলো ফারহান। নিরু ঘুম থেকে জেগে রিসিভ করতে করতেই প্রথমবার কল কেটে গেল। পরেরবার কল আসতেই নিরু রিসিভ করে ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো, “হ্যালো?”
ফারহান নিরুর ঘুমন্ত কণ্ঠস্বর শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। নিরুর ভারী শ্বাসগুলো অনুভব করছে।
নিরু আবারো বললো, “হ্যালো? শুনতে পাচ্ছেন?”
ফারহান এবার কোমলভাবে বললো, “ঘুমিয়ে ছিলে?”
নিরু একটা হাই তুলে বললো, “হুম। এতরাতে কল করলেন যে?”
“এতরাত কোথায়? সবেমাত্র এগারোটা বাজে। কালকের মিটিংয়ের জন্য সব কাজ শেষ করে একটু আগে ফ্রি হলাম। বউয়ের কথা মনে পড়ছিল তাই কল দিলাম কিন্তু বউ তো আমার ঘুমে ব্যস্ত।”
“আসলে প্রচুর ঘুম পেয়েছিল তাই তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ খেয়েছেন আপনি?”
“না।”
“এখনো খান নি কেন?”
“কাজ করছিলাম তো।”
“এখন গিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে আসুন। রাখছি আমি।”
ফারহান অসহায় স্বরে বললো, “একটু কথা বলে যাই। আমি জানি এখন আমি খেতে গেলে তুমি আবার ঘুমিয়ে পড়বে।”
“ঘুমাবো না আমি। আপনি যান।”
“আমি জানি তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। তোমার ঘুমের উপর একদম বিশ্বাস নেই আমার। একটু কথা বলে তারপরে খেতে যাবো।”
ফারহানের জেদের কাছে হার মেনে নিরু আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখলো।
_________________
নিরু আজ একটা হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়েছে। ফারহান সেদিন বলেছিল ওকে না-কি হালকা গোলাপিতে বেশি মানায়। সাথে হালকা একটু সেজেছেও। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখে কাজল। বাড়িতে কী আর এরচেয়ে বেশি সেজে থাকা যায় না-কি। রাত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ফারহান আসবে।
নিরু শাড়ি পড়ে বিছানায় চুপচাপ বসে আসে। বাইরে বেরোচ্ছে না। অজানা কারণেই লজ্জা লাগছে তার। বিছানায় বসে বসে নখ কামরাচ্ছে। পরমুহূর্তেই ফারহানের কথা মনে পড়তে নখ নামিয়ে ফেললো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। মানুষটার অনুপস্থিতিতেও তার ভালোবাসা, শাসন, বারণ গুলো খুব মনে পড়ে।
নিরু মনে মনে বলছে, “আমিও ভালোবাসি একজনকে। খুব ভালোবাসি। সে আর কেউ নয় আমার স্বামী। একান্তই আমার নিজের। তার উপর কোনো পরনারীর অধিকার নেই। সে শুধু আমার। আমার ভালোবাসা।”
ফারহান রুমে প্রবেশ করতে দরজা পর্যন্ত আসতেই দেখলো নিরু মনে মনে কী যেন ভাবছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। ফারহান ওকে শাড়িতে দেখায় কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। পরমুহূর্তেই দুষ্টু হেসে রুমে ঢুকে বললো, “কী হলো একা একা হাসছো কেন?”
নিরু একটু থতমত খেয়ে গেল। মেকি হেসে বললো, “না, কিচ্ছু না। এমনি হাসছিলাম।”
ফারহান পূর্বের মতোই বললো, “হঠাৎ শাড়ি পড়েছো যে? আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য বুঝি?”
নিরু আঁড়চোখে তাকিয়ে বললো, “আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্য কেন পড়বো? আমার এমনি ইচ্ছা করছিলো তাই পড়েছি। আপনার জন্য শাড়ি পড়তে আমার বয়েই গেছে। হুহ।”
ফারহান মুখ চেপে হেসে বললো, “জানি আমি।”
“কচু জানেন আপনি। যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
“উঁহু। আমি এখন আমার বউকে দেখবো। শাড়িতে কত্ত সুন্দর লাগছে আমার নিরুপাখিকে।”
নিরু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
ফারহান ওর মাথা উপরে তুলে বললো, “এত লজ্জা পাও কেন বলোতো? লজ্জা পেলে তো তোমাকে একদম চেরি ফলের মতো লাগে।”
নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “চেরি ফল!”
“হুম, লাল টুকটুকে চেরি ফল।”
নিরু কিছু না বলে লজ্জামিশ্রিত হাসলো।
ফারহান ওর একদম কাছে গিয়ে বসলো। নিরু একটু ইতস্তত করে বললো, “ফ্রেশ হবেন না আপনি?”
“উঁহু।”
“তাহলে?”
“তোমাকে দেখবো।”
নিরু আর কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। ফারহান মোহাচ্ছন্ন কণ্ঠে বললো, “তোমাকে ভালোবাসার অনুমতি দেবে আমায়? একটু ভালোবাসবে৷ নিরুপাখি?”
নিরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ওঠা-নামা করছে। কিছু বলতে পারছে না সে। ফারহানের বুকে মুখ গুঁজে রইলো সে। ফারহান মুচকি হেসে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিল ওকে। ভালোবাসা পূর্ণতা পেল তাদের।
_________________
রাত বারোটা। ফারহানের বুকে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে নিরু। ফারহান তাকে আলতো স্বরে ডেকে বললো, “নিরু? উঠো। খাবে না? এই নিরু? উঠো। রাতে তো কিচ্ছু খাওনি মনে হয়।”
নিরু ঘুমের ঘোরে বললো, “একটু ঘুমাতে দিন প্লিজ।”
“তুমি তো এত ঘুমকাতুরে ছিলে না। এত ঘুমকাতুরে হলে কবে?”
“জানেন এখানটায় না অনেক শান্তি। ঘুম আপনা-আপনি এসে যায়। আপনি…।”
নিরু আর কিছু বলার আগেই আবারো ঘুমিয়ে পড়লো। ফারহান এবার বুঝতে পারলো যে নিরু এতক্ষণ ঘুমের ঘোরে কথা বলছিল। নাহলে কিছুতেই বলতে পারতো না। লজ্জায় মিইয়ে যেত।
ফারহান ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে নিরুকে আবারো জড়িয়ে ধরে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো।
______________________
পরেরদিন সকালে নিরু ঘুম থেকে দেরি করে উঠলো। বেশ বেলা হয়েছে। বিছানা হাতড়ে ফারহানকে কোথাও পেল না। দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাতে আরো একটু চমকে গেল নিরু। নয়টার বেশি বাজে।
নিরু বিড়বিড় করে বললো, “উনি কী তাহলে অফিসে চলে গেছেন? এত বেলা করে কেন যে ঘুমালাম। উনি আমাকে না বলেই চলে গেলেন?”
নিরু মন খারাপ করে উঠে শাওয়ার নিতে চলে গেল।
শাওয়ার নেওয়া শেষে চুল মুছতে মুছতে বিছানার কাছে আসতেই দেখলো পাশের টেবিলে একটা চিরকুট রাখা। তখন বেখেয়ালিতে চোখে পড়ে নি।
নিরু চিরকুটটা হাতে তুলে নিল। তাতে লেখা-
“তোমার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হচ্ছিলো দেখে চিরকুটটা লিখে রেখে গেলাম। মন খারাপ করো না তোমাকে না বলে চলে এসেছি বলে। আসলে তুমি শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলে দেখে আর জাগাই নি। রাতে আসতে পারলে ফোন করে জানিয়ে দেব। এখন খেয়ে নেবে। রাতে তো মনে হয় কিছুই খাও নি। ডাকলাম তাও উঠলে না।”
—-ফারহান
নিরু মুচকি হেসে চিরকুটটা ডায়েরির ভাজে রেখে খেতে চলে গেল।
পেরিয়ে গেছে আরো তিনটে দিন। ফারহানের উপস্থিতি কখনো অনুপস্থিতিতে দিন কেটেছে নিরুর। কাল ও শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাবে। আরো দু’দিন থাকতে চেয়েছিল কিন্তু ফারহান রাজি-ই হলো না। অনেকদিন থাকা হয়েছে। আবার না-কি কয়েকদিন পর নিয়ে আসবে।
সকাল এগারোটা বাজে। নিরু অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিল আজ নিধিদের বাড়িতে যাবে। নিধি পালিয়ে যাওয়ার পর আর ওবাড়িতে যাওয়া হয়নি। ওর বাবা-মা মুখে কিছু না বললেও তারা নিরুর উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাই নিরুও যেতে ভয় পেত। কিন্তু আজ কেন যেন খুব যেতে ইচ্ছা করছে।
#চলবে__??
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন।]