হঠাৎ_হাওয়া পর্ব ১৬

#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ১৬

রাত আটটা বাজে। নিরু পড়ার টেবিলে বসে আছে। বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিকই তবে পড়া মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই। শত চেষ্টা করেও মন বসাতে পারছে না। নিধির জন্য চিন্তা হচ্ছে তার। মেয়েটা কেন এমন করছে? কেন বেরিয়ে আসছে না সম্পর্কটা থেকে? ফারহানও এখনো আসছে না। কল করে অবশ্য বলেছে রাস্তায় আছে। তবুও নিরুর ধৈর্যে কুলোচ্ছে না। মনে হচ্ছে কখন ফারহান আসবে আর কখন ওকে সবটা বলবে। যদি ফারহান কোনো সমাধান দিতে পারে এই ভেবেই বলার জন্য এত উশখুশ করছে। যদিও এটা সম্পূর্ণই নিধির ব্যক্তিগত ব্যাপার তবুও বান্ধবী তো। কীভাবে তার খারাপ পরিস্থিতি সহ্য করতে পারবে নিরু?

মিনিট দশেক বাদেই ফারহান চলে এলো। ফ্রেশ হয়ে এসে নিরুকে এমন মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করলো, “কী হয়েছে নিরু? তোমাকে এমন মনমরা দেখাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে?”

নিরু এতটাই মনমরা ছিল যে ফারহানের কথা শুনে খানিকটা চমকে উঠেছে। একটু সময় নিয়ে ধাতস্থ হয়ে বললো, “তোমাকে কিছু বলার আছে।”

ফারহান বিছানায় বসে নিরুকে ওর পাশে বসতে ইশারা করে বললো, “হুম, বলো।”

নিধির সাথে হওয়া সব কথাই নিরু ফারহানকে বিস্তারিত ভাবে বললো।

ফারহান সব শুনে কিছুটা থম মেরে রইলো। সিয়াম যে জেদ ধরে আছে এটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না তার। ফারহান নিরুর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কেউ আলাদা করতে পারবে না আমাদের। কখনো না। সম্পর্কে যতই ঝামেলা আসুক না কেন যতই ভুল বুঝাবুঝি হোক না কেন আমরা কখনো একে অপরকে ছাড়বো না। একজন ঝগড়া করলে অপরজন শান্ত থাকবো। কখনো অভিমান বাড়তে না। অভিমান বাড়িয়ে রাগের কারণ সৃষ্টি করবো না। সারাজীবন একে অপরকে ভালোবেসে যাব।”

নিরু ফারহানকে আলতো স্পর্শে জড়িয়ে ধরলো।

ফারহানও নিরুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “কিন্তু নিধি কেন এখনো সম্পর্কটায় আটকে আছে? ডিভোর্স কেন দিচ্ছে না?”

“ও ডিভোর্স দিতে চাইছে না। ওই লোকটাকে বোঝাতে চাইছে কিন্তু কীভাবে সম্ভব সেটা। আমি তো আর ওর বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলতে পারি না।”

“এটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।”

নিরু ফারহানকে ছেড়ে বললো, “তবুও। নিধির জন্য টেনশন হচ্ছে আমার।”

“আমার মনে হয় আমাদেরও সিয়াম ভাইকে বোঝানো উচিত।”

“কীভাবে বোঝাবো আমরা? ওই লোকটা শুনবে আমাদের কথা? ওনার মাথায় জেদ চেপে আছে। পরিস্থিতির কথা চিন্তা না করে জেদ ধরে আছে। এটা ভাবছে না যে আমি বিবাহিতা আমার স্বামী আছ। তারও একটা বউ আছে। ওনার মতিগতিই বুঝতে পারছি না আমি। কী চাইছেন টা কী উনি?”

“সেটা জানতেই আমাদের তার সাথে কথা বলা উচিত৷ নিধির জন্য এটা আরো ভালো হবে যদি আমরা তাকে বোঝাতে সক্ষম হই।”

“কীভাবে কথা বলবো? দেখা করে না-কি ফোনে?”

“সামনা-সামনি কথা বলাটাই সবচেয়ে বেটার হবে। ফোনে সব বলা যায় না।”

নিরু উঠে বললো, “আচ্ছা, এসব কথা আবার পরে হবে। আসতে না আসতেই চিন্তায় ফেলে দিয়েছি। চলো আগে খেয়ে নেবে। বাবা-মায়েরও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।”

ফারহান ভ্রু কুঁচকে বললো, “খেয়ে নেবে মানে? তুমি খাবে না?”

“খেতে ইচ্ছে করছে না।”

ফারহান চোখ গরম করে বললো, “ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে।”

নিরু আর প্রতিত্তোরে কিছু বলতে পারলো না। কখন না জানি ফারহান এক ধমক মেরে দেয়।

_____________

ডিনার করে এসে ফারহান অফিসের কিছু কাজ নিয়ে বসলো আর নিরু পড়ার টেবিলে। সন্ধ্যা থেকে একটুও পড়া হয়নি। এখন যদি একটু মাথায় ঢুকে।

ফারহান কাজ শেষ করে দেখলো নিরু পড়তে পড়তে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথাটা আরেকটু সরলেই পড়ে যাবে। ফারহান দ্রুত গিয়ে নিরুকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। আরেকটু দেরি হলে হয়তো পড়েই যেত।

ফারহান বেডসাইড টেবিল থেকে পানি খেয়ে নিজেও ওর পাশে শুয়ে পড়লো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিরুর মুখের দিকে। ঘুমিয়েছে তবুও কপালে ভাজ পড়ে আছে। হয়তো আবারো কিছু নিয়ে ভাবছিল আর ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।

ফারহান নিঃশ্বব্দে হেসে হাত দিয়ে নিরুর কপালের ভাজ সোজা করে দিল। নিরু একটু নড়েচড়ে উঠে ফারহানের হাত জড়িয়ে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো। ফারহান এখনো নিরুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে সে-ও ঘুমিয়ে পড়লো।

_____________________

প্রতিদিনকার মতো আজও ফারহানের সাথে ভার্সিটিতে গিয়েছিল নিরু। ক্লাস শেষ হতেই যথাসময়ে আবার ফিরেও এসেছে। ফারহানের সাথে ফোনে কথা হয়েছে একবার। রায়হান সাহেব বাড়িতে নেই। বাড়ির পাশের চায়ের দোকানে গেছেন। আর মিসেস মুক্তা ঘরে শুয়ে আছেন। সকালে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে বেকায়দায় পা ফেলায় ব্যথা পেয়েছে অনেকখানি। নিরু এতক্ষণ তার কাছেই ছিল। উনিই একটু আগে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছেন একটু রেস্ট নেওয়ার জন্য। ভার্সিটি থেকে এসে নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে গেছে।

নিরু বারান্দায় বসে আজকেও নিধিকে কল করলো। আজ প্রথমবারেই রিসিভ করলো নিধি। কুশলাদি বিনিময় করে নিরু বললো, “তুই আবারো ভেবে দেখ নিধি। এখনো সময় আছে কিন্তু।”

ওপাশ থেকে নিধির রুগ্ন স্বর ভেসে এল, “আমি প্রেগন্যান্ট।”

নিরু বিস্ময় নিয়ে বললো, “কী? ঠিক বলছিস তো তুই? মানে সিউর তো?”

“আমি ঠিকই বলছি। আমি সিয়ামের বাচ্চার মা হতে চলেছি। এখন ডিভোর্স দিলে আমার বাচ্চার ভবিষ্যৎ জীবনটা কী সুখের হবে?”

“আগের যুগের মানুষের মতো কতা বলিস না নিধি। ডিভোর্স হলেই যে বাচ্চা মানুষ করতে পারবি না এমন তো নয়।”

নিধি কিছু না বলে চুপ করে রইলো।

খানিকক্ষণ বাদে নিরু নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে বললো, “সরি রে। একটু রাগ উঠে গিয়েছিল। ডিভোর্স দেওয়া না দেওয়া তোর ব্যাপার। তবে খুশির খবর তো পেলাম। খালামণি হতে যাচ্ছি আমি। ভাইয়াকে জানিয়েছিস?”

“উঁহু। আমি দু’দিন আগে জানলাম। এখনো জানানোর সাহস হয়নি। যদি রেগে যায়?”

“রেগে যাবে কেন? বাবা হবে শুনে কেউ রাগ করতে পারে? হতেই তো পারে এই খবর শুনেই তোদের সব ঝামেলা মিটে গেল। সব ঠিক হয়ে গেল। দেরি না করে বলে ফেল।”

“ও আমাদের বাড়ি থেকে আসার পর থেকে আগের মতো অতটাও খারাপ ব্যবহার করে না। তবে কোনো কারণে রাগ উঠে গেলে ভাঙচুর করে প্রচুর।”

“তুই তো তোর সিদ্ধান্তেই অটল। দেখিস আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“হুম।”

নিরু কল কেটে এবার ফারহানকে কল করলো। সিয়ামকে কিছু বলার আগেই ফারহানকে মানা করতে হবে। না-হয় সিয়াম যদি জানে যে নিধি ওকে সবকিছু বলে দিয়েছে তাহলে হিতে বিপরিত হতে পারে। তখন আবার আরেক ঝামেলা। তারচেয়ে কিছুদিন বরং আগের মতোই চলুক। ক’টা দিন যাক তারপরে দেখা যাবে কী হয়।

নিরু ফারহানকে সব কথা বুঝিয়ে বলতেই ফারহানও সায় জানালো। আর আরেকটা খুশির খবর দিল যে তারা দুই দিন পর বান্দরবান ঘুরতে যাবে। ফারহান ছুটি নিয়েছে দুই দিন পরে থেকে। নিরু তো মহাখুশি। কত্তদিন পর দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে। ভাবতেই আনন্দ উপচে পড়ছে।

_____________

নিরুর গোছগাছ করতে ব্যস্ত। পুরো ট্রলি ভর্তি শুধু জামা-কাপড়ে ঠাঁসা। ফারহান বসে বসে নিরুর কাজকর্ম দেখছে। আজ বৃহস্পতিবার। আগামীকাল তারা ঘুরতে যাবে। সন্ধ্যা থেকেই নিরু জামা-কাপড় গোছানো শুরু করে দিয়েছে। কোন শাড়ি ছেড়ে কোন শাড়ি নেবে তাই বুঝতে পারছে না। ফারহান একবার সিলেক্ট করে দিতে গিয়েছিল তবে তার এত কম জামা-কাপড় সিলেক্ট করা নিরুর পছন্দ হলো না৷ একটু চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ফারহান আবারো চুপচাপ বসে আছে। কিছুই বলবে না সে। লোকের ভালো করতে নেই। ভালো করতে গেলে উল্টো ঝারি খেতে হয়।

নিরু তার মনমতো গোছগাছ করে হাফ ছেড়ে বিছানায় এসে বসলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কত বড় কাজ সে করে ফেলেছে। ফারহানকে চুপ থাকতে দেখে নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কী হলো এমন চুপ করে আছো কেন?”

“ও আমার দিতে তোমার নজর পড়লো তাহলে? এতক্ষণ তো আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিলে না। মনে হচ্ছিলো আমার সাথে নয় তুমি তোমার এই ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে একা একাই বান্দরবান চলে যাবে।”

ফারহানের কথায় নিরু শব্দ করে হেসে ফেললো।

ফারহান আঁড়চোখে তাকাতেই নিরু হাসি থামিয়ে বললো, “সেই প্ল্যানই করছিলাম কিন্তু আমি একা গেলে তো তোমার ছুটি নেওয়া বৃথা যাবে তাই তোমার সাথেই যাবো ভাবছি।” কথা শেষে নিরু আবারো হেসে ফেললো।

নিরুকে এত হাসতে দেখে ফারহান এবার ওকে কাতুকুতু দিতে শুরু করলো। নিরু এবার একটু চেঁচিয়ে বললো, “ফারহান থামো বলছি। থামো। আর না। প্লিজ। আমি কিন্তু খাট থেকে পড়ে যাবো এবার। তখন তোমার কোলে চড়ে ঘুরবো। বলতে পারবে না আমার কোমড় ব্যথা করছে।”

ফারহান না থেমে বললো, “তাহলে তো আরো বেশি করে দিতে হবে। কোলে নিয়েই ঘুরবো তোমাকে। তখন আবার তুমি বলো না যে তোমার লজ্জা লাগছে।”

“থামো।”

“উঁহু।”

দু’মিনিট বাদেই দুজনে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নিরু এখনো হাসছে। ফারহানও তার সাথে সাথে হাসছে। হাসি যেন মুখ থেকে সরছেই না।

নিরু হাসি থামিয়ে বললো, “আমি যে চিৎকার করলাম। বাবা-মা শুনলে কী ভাববে?”

“কিছুই ভাববে না। কারণ তুমি এতটাও জোরে চিৎকার করোনি যে বাবা-মায়ের রুম অবধি শব্দ যাবে।”

“তাহলে ঠিক আছে।”

“হুম, এখন ঘুমাও তো। সকাল সকাল উঠতে হবে আবার। দেরি হলে কিন্তু বাস মিস।”

“আমার তো ঘুমই আসছে না।”

“চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। এসে যাবে।”

নিরু ফারহানের কথামতো চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। সকালে কিছুতেই দেরি করে উঠতে চায় না সে।

#চলবে__??

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here