হিমাংশুর জলপদ্ম পর্ব -শেষ

#হিমাংশুর_জলপদ্ম [শেষ পর্ব]
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

পা চালিয়ে কাঠের বেড়া অতিক্রম করার পরই থেমে গেল হিমাংশু।পুরো শরীর না ঘুরিয়ে শুধু মাথাটাকে হেলিয়ে দৃষ্টি ফেললো ঘরের দরজায় দেওয়া তালা বরাবর।তালার রংটা চটে গিয়ে কালচে রং হয়েছে।হিমাংশু ভ্রু কুঁচকে এবার নজর ফেললো উঠানের দড়িতে নাড়া সুপ্রিয়ার শাড়িতে।যদি সুপ্রিয়া তার বাবার বাড়িতেই যায় তবে এ শাড়ি বাইরে কেন রেখে গিয়েছে সে?এটি হয় সে সাথে করে নিয়ে যাবে আর নাহয় ঘরের ভিতরে রেখে যাবে।এতো দূরে যাবে তাহলে অবশ্যই সে শাড়ি বাইরে নাড়বে না।হিমাংশু এবার সম্পূর্ণ শরীরটাকে ঘুরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বিড়বিড় করে বললো,

– আশে পাশেই আছে নাকি?তাহলে তো এতক্ষণে চলে আসার কথা।সন্ধ্যা হয়ে গেল প্রায়।আরেকটু বসবো?

হিমাংশু আবার হেঁটে ভিতরে ঢুকলো। আবারও সেই একই জায়গায় পা ঝুলিয়ে একই ভঙ্গিতে বসলো।পিছন ফিরে দরজার তালার দিকে একপলক তাকিয়ে হাতে থাকা থলে থেকে কুমুদের জন্য আনা লাল শাড়িতে তার মোলায়েম হাত বুলালো।অতঃপর বোনের জন্য আনা শাড়িটা বের করে তাতেও হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলো।আবার গোমড়া মুখে তাকালো ঘরের দরজার দিকে।দেখতে দেখতে রাত বেশ হলো তবু সুপ্রিয়া আর কুমুদ এলো না।হিমাংশুর চোখে ঘুমও এসে ভর করেছে।তবে সে জোর করে তার চোখ খুলে রাখলো।হিমাংশু এবার কি ভেবে তালা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল।তাই বসা থেকে উঠে উঠানে ঢিপ দিয়ে রাখা ইটের টুকরো থেকে একটি বড় ইটের টুকরো নিয়ে এগিয়ে গেল ঘরের দরজায় দেওয়া তালার উদ্দেশ্যে।কয়েকটা বারি দিতেই সে সফল হলো তালা ভাঙতে।দরজা খুলতেই নাকে এলো এক বিদঘুটে গন্ধ। হিমাংশু হাত দিয়ে নাক চেপে ধরলো।অন্ধকার নেমে আসায় ঘরের কিছু দেখা যাচ্ছে না।হিমাংশু অনুমান অনুযায়ী কদম মেপে ঘরের ভিতরে দশ কদম ডানে গিয়ে বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ড পেল।সেখানের দ্বিতীয় সুইচে দুইটা চক্কর দিতে ঘরে জ্বলে উঠলো স্বল্প আলোর একটি বাল্ব।বাল্বটি জ্বলতেই হিমাংশুর চোখ সবার প্রথমে গেল ঘরের মেঝের দিকে। যেখানে রয়েছে কালো জমাট বাঁধা রক্ত। হিমাংশু চমকে উঠলো জমাটবদ্ধ রক্ত দেখে।পরমুহূর্তে বুঝতে পারলো এতোক্ষণ যে বিদঘুটে গন্ধটা নাকে বারি খাচ্ছিল তা হলো রক্ত পঁচা গন্ধ। হিমাংশু আবারও নাকে হাত দিয়ে গন্ধটি নাকে যাওয়া থেকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলো।তবে সে ব্যর্থ হলো নাকে সে গন্ধ পৌঁছালো কোনো বাধা না মেনে।হিমাংশু তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে জমাটবদ্ধ রক্তের সামনে।মুহুর্তেই তার চোখ লাল হয়ে গেল।হাতের থলিটা নিচে পরে গেল।ভেঙে গুড়িয়ে গেল কুমুদ আর সুপ্রিয়ার জন্য আনা কাঁচের চুড়িগুলো।হিমাংশু এবার জোরে জোরে ডাকতে লাগলো তার দিদিকে,

– দিদি.. দিদি… দিদি কই তুমি?কুমুদ…

দিশেহারা হয়ে সারা ঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো তার দিদি আর কুমুদকে।কিন্তু কোথাও খুঁজে পেল না সে।হিমাংশু চোখে জমা হলো এক পর্দা যা পানি দিয়ে তৈরি।চোখের পলক ফেললেই সেি পর্দা ভেঙে যাবে।হিমাংশু চোখের পলক ফেললেই তার ডান চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার সাদা পাঞ্জাবির গলার অংশে।শুঁকনো ঢোক গিলে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।বাড়ির উঠানে এসে জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকতে থাকলো তার দিদিকে আর কুমুদকে।তার চিৎকারে অদূরে থাকা কয়েকটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো কিছু মানুস দৌড়ে হিমাংশুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

– হিমাংশু কি হয়ছে এমন করতাছো ক্যান?তোমার দিদি কই?

হিমাংশুর গলা আঁটকে আসছে সে কিছু বলতে পারছে না।তবু একটু চেষ্টা করে বললো,

– দিদি…রক্ত.. ঘরে..

হিমাংশুর এমন এলোমেলো কথা শুনে কেউ কিছু বুঝতে পারলো না।তাদের মধ্যে একজন ঘরে গিয়ে রক্ত দেখে চিৎকার করে উঠলো।সবাই তার চিৎকারে ঘরে গিয়ে রক্ত দেখে অবাক হয়ে গেল।একজন গ্রামবাসী বললেন,

– একি এইহানে রক্ত ক্যান?দ্বীপ কই? ওরে তো দুইদিন হইলো খুঁজতাছি আমি।আমার পাওনা টাকা দেয় না ও।

তার কথা শুনে সবাই অবাক হলো।একটু ভেবে দেখলো আসলেই দুইদিন ধরে দ্বীপের কোনো দেখা নেই।ও কোথায় গেল?আর এখানে রক্ত কেন?তাদের মধ্যে একজন বললেন,

– চল আশেপাশে একটু খুঁইজা দেখি কিছু পাইলেও পাইতে পারি।

সবাই মিলে আশেপাশে খোঁজার জন্য এক একজন এক একদিকে ছড়িয়ে পড়লো।হিমাংশু উঠানে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।কি থেকে কি হয়ে গেল কিছু তার মাথায় আসছে না।হঠাৎ একজনে চিৎকারে সবাই বাড়ির পিছনের ঝোপের দিকে চলে গেল।হিমাংশুও তার দূর্বল পায়ে গেল সেদিকে।সেখানে ঝোপগুলো পরিষ্কার করা আর মাটিটাও কেমন আলগা ভাব।হয়তো একদিন আগেই খোঁড়া হয়েছে মনে হচ্ছে। সবাই ধারণা করলো এখানেই হয়তো কিছু পাওয়া যাবে তাই কোদাল দিয়ে সবাই মিলে খোঁড়া শুরু করলো জায়গাটা।এ দৃশ্য দেখতে পারলো না হিমাংশু। কে হবে ঐ গর্তে কুমুদ?নাকি! আর কিছু ভাবতে পারলো না সে অসম্ভব বিশ্রী গন্ধে মুখে হাত দিয়ে উটানে এসে হর হর করে বমি করে দিলো হিমাংশু।গর্তের কিচু মাটি সরাতেই দৃশ্যমাণ হলো সুপ্রিয়ার অর্ধগলিত মরদেহ।সবাই আঁতকে উঠলো সুপ্রিয়ার লাশ দেখে।গ্রামের একজন তার বিস্মিত কন্ঠে উচ্চারণ করললো,

– সুপ্রিয়া!

নিজের দিদির নাম শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো হিমাংশু। সে ভেবেছিল তার দিদিকে তার দেওয়া নতুন শাড়িতে দেখবে কিন্তু এখন এমন অর্ধ গলিত অবস্থায় দেখতে হবে সে কল্পনাতেও ভাবেনি।দিদির লাশের সামনে বসে অঝরে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে হিমাংশু।হঠাৎ করে তার মাথায় এলো কুমুদ!কুমুদ কোথায়?সে কান্না থামিয়ে অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করলো,

– কুমুদ?

গ্রামবাসী নিজেদের মুক চাওয়াচাওয়ি করলো কিছুক্ষণ। তা দেখে একজন বললেন,

– কুমুদ ওর বউ।ওই ও নিখোঁজ নাকি?ওরে আবার কোনহানে পুইত্তা রাখছে ভগবান জানে?চল খোঁজ সবাই।

সবাই আবার খোঁজ খুঁজিতে লেগে পড়লো।সুপ্রিয়ার লাশ এনে রাখা হলো বাড়ির খোলা উঠানে।কুমুদকে পুঁতে রেখেছে বাক্যটি শুনে আঁতকে উঠলো হিমাংশু।যদি কুমুদকেও এভাবে দেখতে হয় তবে সে আর বেঁচে থাকতে পারবে না।তাই সেও যোগ দিল খোঁজখুঁজিতে।কোথাও খুঁজে না পেয়ে সবাই যখন হতাশ হয়ে বাড়ির পিছন দিকটা থেকে ফিরে আসবে ঠিক তখনই একজন বলে উঠলো,

– এ গুদাম ঘরে নাই তো?

সবার পা থেমে গেল।তার কথায় সায় দিয়ে বললো,

– থাইকতেও পারে। চল দেখি গিয়া।

গুদাম ঘরের তালা ভেঙে প্রবেশ করলো সবাই। হারিকেনের আলোই দেখা গেল লাল শাড়িতে অচেতন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে কুমুদ।তার থেকে একটু দূরে মরা ইঁদুর। হিমাংশু দৌড়ে এলো কুমুদের কাছে কুমুদে মুখে থাবা দিতে দিতে বললো,

– কুমুদ?কুমুদ চোখ খোলো, কুমুদ?

কুমুদ চোখ খুললো না।এতক্ষণে সারা গ্রাম জানাজানি হয়ে গিয়েছে।হিমাংশুর চোখে হাজারো স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।ভিড় ঠেলে একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা ঘরে ঢুকলো হিমাংশুকে সরিয়ে দিয়ে কুমুদের বুকে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো বেঁচে আছে কিনা।কুমুদের বুকে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে শান্ত স্বরে বললো,

– মনে হয় এখনও মরেনি।বাইরে নিয়ে চলো।

হিমাংশু কুমুদকে তুলে বাইরে নিয়ে এলো।তারপর কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা করা হলো। তবু যখন কুমুদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।তখন ডাকা হলো গ্রামের একমাত্র ডাক্তার মতি মিয়াকে।হোমিওপ্যাথি ভালো বোঝে সে।তাই তাকে সবাই ডাক্তার সাব হলে ডাকে। ইংরেজি ডাক্তারদের থেকেও কিছু ডাক্তারি বিদ্যা অর্জন করেছে সে।হিমাংশু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার অচেতন জলপদ্মের দিকে।তার চোখে আর এখন পানি নেই।আসলে তার মস্তিষ্ক বিকল হয়ে গিয়েছে।তার এখন কি করা উচিত তা কিছুই মাথায় আসছে না তার।একদিকে দিদি অন্য দিকে কুমুদ।সব যেন তালগোল পাকিয়ে গেল তার।মতি মিয়ার ওষুদের জোরে পিটপিট করে চোখ খুললো কুমুদ।সে কোথায় তা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরে অঝোর ধারায় কান্না করতে থাকলো।চোখের সামনে হিমাংশুর মুখটা দেখতেই দূর্বল হাতের ইশারায় হিমাংশুকে কাছে ডাকলো।শান্ত হিমাংশু ধীর পায়ে তার জলপদ্মের পাশে গিয়ে বসলো।কুমুদ খুবই আস্তে বললো,

– আপনি এসেছেন?আমি জানতাম আমার ভগবান আমাকে বাঁচাবে। আর আমার ভগবান তো আপনি।

হিমাংশুর ডান চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। আলতো হাতে কুমুদের হাতটি ধরলো সে। কুমুদ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে হিমাংশুকে বলল,

– লোকটা দিদিকে কুপিয়ে মেরে ফেললো আমি কিছু করতে পারলাম না।

কুমুদের কথা শুনে গ্রামের একজন বলে উঠলো,

– কোন লোকের কথা কইতাছ?কেডায় করছে এইসব?

– জামাইবাবু।

থমকে গেল হিমাংশুর সারা পৃথিবী।হিম শীতল হয়ে গেল সারা শরীর।তার জামাইবাবু তার দিদিকে এমনভাবে মেরেছে?কুমুদকে গুদাম ঘরে বন্ধি করে রেখেছে?মানুষ এমন নিষ্ঠুর কিভাবে হয়?

————————

সবে ভাতটা বসালো কুমুদ।ঠিক এমন সময় হিমাংশুর উচ্চ কন্ঠে তার নাম শুনে ভাত ফেলে দৌড়ে উঠানে গেল সে।হিমাংশু উঠানে দাঁড়িয়ে কুমুদকে ডেকে চলেছে,

– কুমুদ..কুমুদ।

– কি হয়েছে এভাবে চিৎকার করছেন কেন?

হিমাংশু কোনো কথা না বলে কুমুদের হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে কুমুদের কপালে একটি বড় লাল টিপ দিয়ে দিলো।তারপর তর্জনি আর বৃদ্ধ আঙুলের ব্যবহারে লাল সিঁদুরের রাঙিয়ে দিল কুমুদে সিঁথি। কুমুদ লজ্জায় মাথা নিচু করে বললো,

– কি করছেন?

হিমাংশু কুমুদের থুতনি ধরে কুমুদের মুখটাকে উপরে তুলে কুমুদের টিপের উপর এক দীর্ঘ চুমু খেল।তারপর আবেগি স্বরে বললো,

– আমার জলপদ্ম।

কথা শেষ করে হিমাংশু কাটের টেবিলের উপর রাখা তার দিদি ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ছবির সামনে লাল কাপড়ে মুড়ানো ঘটিটা দু’হাতে তুলে নিয়ে বললো,

– আজ তিন বছর পর তোমার খু’নির শান্তি হলো দিদি।তাই এবার এটি গঙ্গায় ফেলার সময় এসে গিয়েছে।

লাল কাপড়ে মুখ ডাকা হাতের ঘটিটাকে ডান হাতে শক্ত করে ধরে বাম হাতে কুমুদের ডানহাতের কব্জি শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো হিমাংশু।তারপর হাঁটা শুরু করলো গঙ্গার উদ্দেশ্যে।

~সমাপ্ত

(গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এটির দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দেওয়ার চেষ্টা করবো।ততক্ষণ সবাই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।আল্লাহ হাফেজ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here