#হৃদ_মাঝারে_তুমি
#পর্ব_০৬
#Written_by_Mehebin_Nira (ছদ্মনামী)
‘আপনার হাজব্যান্ড’ কথাটা শুনে নিরার বুঝলো সিস্টার আদ্রাজ কে উদ্দেশ্য করেই বলেছে। তবে কি আদ্রাজ তাকে হসপিটালে নিজের স্ত্রীর পরিচয় দিয়েছে? হা হয়ে গেলো নিরা! তার যেনো বিশ্বাস ই হতে চাইলো না। সিস্টার তাকে চুপ দেখে আবারো বলে, ‘ম্যাম স্যুপ টুকু খেয়ে নিন!’
নিরার হুঁস ফিরে। সিস্টার তার সামনে স্যুপের বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিরা তাকে ঠিক কি বলবে নিজেও বুঝতে পারছে না। তার কাছে সব কিছু কেমন ঘোলাটে লাগছে। সিস্টার কে ফের জিঙ্গেস করা ঠিক হবে কি না তা নিয়ে সংকটে পড়ে যায় সে। পরে আর জিঙ্গেস করা হলো না। হালকা হেসে সিস্টারের হাত থেকে স্যুপের বাটি টি নিয়ে খেতে শুরু করে। সত্যি ই তার শরীর খুব দুর্বল লাগছে! সেই সন্ধ্যায় একটু চা খাওয়া হয়েছিলো সারারাদিন দৌড়াদৌড়ির উপরে থেকে আর খাওয়া হয় নি। আশার জোড়াজুড়ি তে ডিরেক্টলি প্রিয়াদের বাসায় আসতে হয়েছিলো। লজ্জায় আর বলা হয় নি কাউকে যে তার ক্ষুধা সামান্য চা’য়ে মিটবে না। না বলাই রয়ে গেলো কথাটা। টুকটাক কিছু খেতে খেতে আর পেট পুরে খাওয়ার সময় ও হয় নি। যখনি ভেবেছিলে এবার নিচে গিয়ে কিছু খেয়ে নিবে তখনি আদ্রাজ চলে আসে। আর তার সঙ্গে বাজে বিহেব করে! আচ্ছা তখন এতো খারাপ কথা ও অপমান করে এখন এইসব করুণা দেখানোর কি কোনো মানে হয়? নিরার ভাবনায় ছেদ পড়ল সিস্টারের চলে যাওয়ার সময়। মূলত পায়ের শব্দে তার ধ্যান ভাঙ্গে। স্যুপ টুকু খাওয়ার জন্য মনস্থির করে সে! দুই চামচ খেতেই কেমন একটা লাগলো! আরেক চামচ মুখে দিতে নিবে তক্ষুনি আদ্রাজ কেবিনে ঢুকে। চোখ তুলে তাকে দেখে স্যুপ নাকেে মুখে উঠে যায় তার। ফলস্বরূপ সে কাশতে থাকে। আদ্রাজ এটা দেখে হকচকিয়ে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুত গ্লাসে পানি নিয়ে নিরার দিকে এগিয়ে দেয়। নিরা নিচ্ছে না সেই পানি অথচ লাগাতার কাশছে।
‘পানি নাও!’
‘আমার পানি চাই না!’
নিরার তার কথায় অনড়। আদ্রাজ তা দেখে বলল,
‘জেদ ভালো রাগ ভালো নয়! নিজের ব্যাপারে এসব নিয়ে কৃপণতা করা আমি মনে করি মোটেও উচিত নয়!’
নিরা চুপ করে রইল। আদ্রাজ এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিরার কাছাকাছি এসে তার মাথার পেছনে একহাত রেখে অন্য হাতে পানির গ্লাস মুখের সামনে ধরে। নিরা চোখ বড় বড় করে রেখেছে তবে মুখে কোনো কথা নেই।
‘পানি পান করো। নাহলে কাশি থামবে না। ভেবো না এসব তোমার জন্য করছি! আমার কান যাতে ঠিকঠাক কানের জায়গায় থাকে তাই এসব করছি! ওকে?’
কথার অর্থ হলো নিরার কাশির শব্দ আদ্রাজের কানে সমস্যা করছে। রেগে তাকায় নিরা। আদ্রাজ সেই মুড নিয়ে চেপে ধরে জোড় করে পানি খেতে বাধ্য করলো নিরা কে। উপায়ান্তর না দেখে নিরার ও দিব্যি তা গিলতে হলো। কেননা তার পক্ষ সম্ভব না এই জলহস্তীর মতো মানুষ টা কে নিজের থেকে সরানোর! তার উপর পানি খাওয়া টাও জরুরি ছিলো!
নিরার পানি খাওয়া শেষ হলে আদ্রাজ খুব সাবধানে সরে আসে। নিরা এক আকাশ রাগ নিয়ে বেডে বসে ফ্লোরে নখ ঘসছে। আদ্রাজ বলল,
‘চলো এবার যাওয়া যাক!’
‘কোথায়?’
‘কেন বাসায়!’
‘আমি আপনার সাথে কোত্থাও যাবো না!’
‘সিরিয়াসলি?’
নিরা এবার নাক মুখ খিচে বললো,
‘কেন এখন এসব করছেন? কাকে দেখানোর জন্য? তখন কি বলেছিলেন মনে নেই ওকে ওয়েট আমি মনে দিচ্ছি! আমার পরিবার…
‘স্টপ… লিসেন এখন আমার কাছে এসব শোনার কোনো টাইম নেই। বাসায় যেতে হবে কুয়িকলি!’
‘বললাম তো আমি যাবো না! কথা কানে যাচ্ছে না আপনার?’
নিরা নিজের এক কথায় অনড়। সে কিছুতেই আদ্রাজের সঙ্গে যাবে না। আদ্রাজ বুঝলো তখন তার কথা গুলোর জন্য ই নিরা এতো রেগে আছে। রাগ করা টা অস্বাভাবিক কিছু না! তাই বলে আদ্রাজ কি এখন নিরার সামনে কান ধরে বলবে,
‘আসলে তোমাকে ঐ ছেলে টার সাথে দেখে খুব রাগ হয়েছিলো। তাই রাগের মাথায় উল্টা পাল্টা কথা গুলো বলেছি। প্লিজ রাগ করো না। এই দেখো সরি কান ধরলাম!’
ইমপসিবল এই স্টুপিড গার্লের সামনে এই কথা তো ভুলেও বলবে না সে। নিরা বলল,
‘এখনো আমাকে বেহুঁশ অবস্থায় রাস্তা থেকে তুলে এনে হসপিটালে নিয়ে এসে অনেক বড় উপকার করেছেন। এর জন্য ও কি আমাকে খোটা দিবেন? দেন! কথা শোনাবেন শোনান! তারপর প্লিজ এখান থেকে চলে যান। বাকি টা আমি বুঝে নিবো! তার চেয়ে বড় কথা এখন তো সেন্সে আছি সো নিজের ঠিকানায় নিজেই চলে যেতে পারবো!’
আদ্রাজ বুঝলো এই মেয়ে তো তার থেকে ও বড় ঘাড়ত্যাড়া। তার কথা হাড়ে হাড়ে তাকেই ফেরত দিচ্ছে! আদ্রাজ চুপ করে কি করা যায় ভাবতে থাকলো।
‘এখন আর আপনার কিছু বলার নাই তাই তো? ঠিক আছে আমি ই যাচ্ছি আপনার যেতে হবে না!’
নিরা চলে যেতে নিলে আদ্রাজ খপ করে তার হাত টা ধরে ফেলে।
‘আমার হাত ধরলেন কেন?’
‘আমি কি তোমাকে যেতে বলেছি?’
‘আশ্চর্য তো!’
‘ঠিক তাই! আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি মানে তোমাকে আমার সাথেই এখান থেকে যেতে হবে!’
‘যদি না যাই?’
‘এই আদ্রাজ একবার যা বলে তাই করে ছাড়ে। হোক না সেটা জোড় করে। ওয়েট এন্ড সি!’
আদ্রাজ হুট করে নিরা কে কোলে তুলে নেয় যা দেখে নিরা টোটালি শক্ড হয়ে যায়। রেগে আগুন সে।
‘কি করছেন নামান বলছি!’
নিরা অলরেডি হাত পা ছোড়াছুড়ি শুরু করে দেয় কোল থেকে নামার জন্য। আদ্রাজ দেখলো অবস্থা বেগতিক। এভাবে করে কেবিন থেকে বের হলে মানুষ জনের মুখোমুখি হতে হবে। অনেকেই তাদের দেখবে যা আসলে তাদের চোখে মোটেও ভালো দেখাবে না। তাই আদ্রাজ বলল,
‘শান্তি তে কোলে চড়বা নাকি এক্ষুনি মাথার উপর তুলে ঠাস করে নিচে ফেলে দিবো?’
‘কিহহহ..!’
‘কানে কি সাইলেন্সার লাগানো? শুনতে পাও নি কি বলেছি?’
‘আমি কিন্তু..!’
‘তুমি না আমি হবে! আমি কিন্তু এভাবে আর হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে থাকলে সত্যি সত্যি নিচে ফেলে দিবো। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই এটা বুঝেছো আমার মনে কোনো মায়া দয়া নাই!’
‘তো?’
‘তো ফেলে দিবো নাকি? ঠিক আছে তাহলে সরিয়ে নিলাম আমার হাত!’
আদ্রাজ নিরা কে নাড়াতে দেখে সত্যিই ফেলে দিচ্ছে মনে করে ভয় পেয়ে যায় সে। ভয়ে চোখ মুখ বন্ধ করে ফেলে অসহায় ভবে বলল,
‘না না। প্লিজ নিচে ফেলবেন না এতো উপর থেকে ধফাস করে নিচে পড়লে আমার হাড্ডি গুড্ডি যে একেবারে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে!’
‘গুড গার্ল। এইতো বুঝেছো এবার! সো চুপচাপ থাকো!’
নিরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলো কেননা এই মানুষ টার উপর কোনো বিশ্বাস নাই তার। দেখা গেলো সত্যি সত্যি ই ফেলে দিয়েছে তখন তার কি হবে? ভয়ে চুপটি করে থাকে সে। তবে চোখ খোলা রাখার সাহস পেলো না। রাগ টা তো আছে ই। আদ্রাজ নিজের কথা রাখছে দেখে তা আরো বেশ গাঢ় রূপ ধারণ করেছে!
আদ্রাজ নিরার কান্ড দেখে মুচকি হাসে। রাগলে মনে হয় কখনো এই মেয়েটা একটা বাঘিনী আর এখন ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আছে। ঠিক যেনো অসহায় এক বাচ্চা! হাহাহা! আদ্রাজ নিরা কে কোলে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হওয়ার সিন টা সেই সিস্টার আর আরো কয়েক জনের নজর এড়ালো না। সবাই কানে কানে ফিসফিস করে বলছে,
‘ওয়াও। ইশ কি ভালোবাসা!’
‘হাউ কিউট! এরকম ভালোবাসার মানুষ কয়জন পায়?’
‘কিউট কাপল!’
ফিসফিস করে বলা কথা গুলো বেশ জোড়ে বলায় আদ্রাজের কানেও এলো। সে তাদের দেখানোর জন্য হালকা হাসে। তবে মনে মনে বলে,
‘এই ইডিয়েট টাইপের মেয়ে কে নিয়ে এনারা আমার সঙ্গে মিলায় কিভাবে? আমি আর ও হাজব্যান্ড ওয়াইফ? ইমপসিবল! আমি নিশ্চিত এই মেয়ে যার কপালে আছে তার লাইফ হেল করে ছাড়বে! হাহ..!’
আদ্রাজ হসপিটাল থেকে বের হয়ে গাড়ির সামনে আসে। দেখে এখনো নিরা আগের ন্যায় আছে।
‘কি হলো এভাবেই সারারাত কাটিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করে ফেললে নাকি? এতো বড় আলুর বস্তা নিয়ে আর যাই হোক আমি থাকতে পারবো না! অলরেডি হাত ব্যথা হয়ে গেছে!’
জোড়ে জোড়ে উস্কানিমূলক বার্তা গুলো নিরার কানে বেশ জোড়েসোড়ে ঢুকেছে। নামার জন্য এবার হাত পা আগের মতো ছোড়াছুড়ি করতে থাকলে আদ্রাজ তাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে নিরা বলল,
‘আমি কি আপনাকে কানে কানে বলছিলাম আমাকে কোলে নিতে? আর আমি আলুর বস্তা হলে আপনি তো একটা হাতি!’ [উইথ এংরি রিয়েকশন]
‘আমি হাতি ইউ মিন হাতির মতোই শক্তিশালী। আর তুমি তো একটা ছুঁচো ইঁদুর! হাহাহা!’
আদ্রাজ গাড়ির সিটে গিয়ে বসলো। নিরার পাশে দরজা খোলা রেখে বলল,
‘উঠো! লেট হচ্ছে আমার!’
‘আমি যাবো না!’
আবারো জেদ দেখে আদ্রাজ এবার ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
‘একবার বলেছি উঠো! এক কথা দুইবার বলা আমার মোটেও পছন্দ না! এতোক্ষণ ধরে তোমার সব কিছু সহ্য করছি আর না। নাউ এনাফ!’
আদ্রাজের কথা গুলো গম্ভীর আর কঠিন ছিলো। নিরা কিছু টা ভয় পেয়ে যায়। গাড়ি তে উঠে বসতে বাধ্য হয়। এই মানুষ টা কে সে বুঝতে পারে না! এই হাসি তো এই রাগ! এই রোদ্দুর তো এই বজ্রপাত! আসলে মানুষ টা কেমন?
নিরার রাগ দেখানোর কথা উল্টো এখন নিজে রাগ দেখাচ্ছে দেখে নিরার খুব জ্বলছে। মুখে অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছা করছে তবে প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছে না সে।
আদ্রাজ মনে মনে হাসছে। এতোটা সময়ে একটা বার ও নিরা নিজের রাগ দেখিয়ে জিততে পারলো না। মেয়েটা এতো ভিতু কেন? ভেবে পায় না আদ্রাজ! যেভাবে বাঘে মহিষে ঝগড়া লাগে মনে হয় যেনো কত সাহসী আর এখন? ভিতুর ডিম একটা!
আদ্রাজ ড্রাইভ করতে শুরু করে। নিরা নিশ্চুপ। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে যায়। হঠাৎ ই আদ্রাজ খেয়াল করলো কেমন একটা শব্দ হচ্ছে। সামনে তাকিয়ে দেখলো নিরা কাঁদছে! বুকটা ধ্বক করে উঠলো আদ্রাজের। হঠাৎ ই গাড়ি ব্রেক করে সে।
নিরা আদ্রাজের বলা তখকার কথা গুলোর জন্য কাঁদছে। সেই কঠিন বাক্য গুলোই অনেক টা কষ্ট লুকিয়ে ছিলো নিরার জন্য! আদ্রাজের থেকে এমন কথা শুনতে হবে আশা করে নি সে। তাকে নিয়ে আদ্রাজের এতো বাজে ধারতা জেনেই হয়তো এতো কষ্ট লাগছে। ফলে নিজেকে সামলাতে না পেরে নিশ্চুপে কান্না করতে থাকে নিরা। হঠাৎ ই গাড়ি ব্রেক করায় সে চমকে উঠে। পাশে তাকিয়ে দেখলো জ্বলজ্বল করা চোখ জোড়ার মালিক আদ্রাজ তার দিকে কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে। নিরা কান্না জড়িত কন্ঠে ফুঁপিয়ে বলল,
‘এখন কি আমাকে এই মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে যেতে বলবেন? অবশ্য বলতেও পারেন! আপনার মতো মানুষের থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা আমার জন্য খুব বড় বোকামি হবে! বললে বলুন নেমে যাই! আপনাকে আর কষ্ট দিবো না। এমনিতেই অনেক করেছেন আমার জন্য! তার ঋন ও শোধ করতে পারবো না!’
চলবে———————