#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ০২)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
বাড়িতে ঢুকে দেখি আম্মু রেগে আগুন হয়ে আছে। তার কারন আমি বাড়িতে দেরি করে ঢুকেছি। সামনে যেতেই রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
– পাখি তোমার ডানা দুটো কেটে রেখে দিবো আমি, স্বাধীনতা দিয়েছি বলে মনে করো না যখন খুশি তখন বাড়িতে ঢুকবে।
,
আম্মুর কথা শুনে মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলাম “আমার নাম পাখি হলেও আমার তো আর সত্যি পাখিদের মতো ডানা নাই, আর না আছে টাকা যে দ্রুত বাড়িতে ফিরবো। খুব দ্রুত একটা কাজের প্রয়োজন। আমার ধ্যান ভাঙ্গলো আম্মু চিৎকারে,
,
– আর কখনো যেন এতো দেরি করে বাসায় ঢুকার সাহস না দেখানো হয়।
,
মাথা টা নিচু করেই নিজের রুমে প্রবেশ করলাম,,, অন্য সব মায়েদের মতো আমার মাও চাই তার মেয়ে যেন ভালো থাকে। সুখের সংসার করে। আমার চিন্তায় আম্মু ও দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি ভাবছি আয়াতের কথা গুলো। ফ্রেশ হয়ে ভাবতে লাগলাম আমার সন্তান টা মিসক্যারেজ হয়ে গেল কেন ? ও অবৈধ ছিল তাই ? কিন্তু আমার কাছে তো ও আমার ভালোবাসার প্রমান ছিল। আমাদের পরিবার থেকেও কোনো ঝামেলা ছিল না। ফাহাদের পরিবার আমাকে আর আমাদের অনাগত সন্তানকে মেনে নিয়েছিল। আমাদেরও বিয়ে হতো, সুখের সাজানো সংসার হতো। একটা ছোট এক্সিডেন্টে সব কিছু এভাবে কেন শেষ হয়ে গেল ? এমটা হওয়া কি খুব জরুরি ছিল আমার ভাগ্যে ? এসব ভাবতে ভাবতে হৃদয়ের ব্যাথা গুলো দলা পাকিয়ে চোখ দিয়ে ঝরে যেতে লাগলো।
,
সকালে ফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ খুলে দেখি আমার বন্ধু রিজভি কল করছে। কলটা রিসিভ করে কানে নিতেই উচ্ছাসিত কন্ঠে সে বলে উঠলো,
,
-“তোর জন্য খুব কষ্টে একটা জব খুঁজে পেয়েছি। যেমন টা তোর প্রয়োজন। যা তোর অতীতের ঘাঁ-এ মলম লাগিয়ে দিবে। ”
,
-হুম, তা কিসের জব শুনি একটু। (ঘুম জরানো কন্ঠে)
,
-কেয়ার টেকার, একটা বাচ্চার।
,
– ওহ, কবে থেকে কাজ পাবো ? আর কোথায় এই জবটা?
,
-আমি তোর ফোনে টেক্সট করে দিচ্ছি কেমন? আজ সকাল ১০ টায় চলে যাস। ওখানে গেলেই সব জানতে পারবি। এখন রাখছি।
,
উঠে ফ্রেশ হয়ে আম্মুকে বললাম কাজের কথাটা। আম্মু বললো “নিজের মনকে সুস্থ করার জন্য যা ভাল মনে হয় করতে পারো।” নাস্তা করে এসে তৈরী হয়ে নিলাম। হালকা রং এর সুতি শাড়ি পরে লুজ করে চুল গুলো বেনি করলাম। হাতে ঘড়ি আর কানে টপ দুল। এইতো আয়নায় নিজেকে একজন মায়ের মতই দেখাচ্ছে। তাচ্ছিলের হাসিতে মাথাটা ফেটে পরছে, যে নিজের সন্তানকে জন্ম দিতে পারে না সে যাচ্ছে অন্যের সন্তানকে আগলে রাখতে।
,
হাটতে হাটতে কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌছে গেলাম। মাঝারি রকম দুতলা একটা বাগান বাড়ি। হয়তো কোনো দম্পতির টুকরো টুকরো সঞ্চয়ে গড়ে তোলা একটি জান্নাত। ভেতরে ঢুকে দেখি আমার মায়ের বয়সি এক ভদ্রমহিলা গাছে পানি দিচ্ছে। আমাকে দেখে কাছে এগিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ আমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকলেন। হঠাৎ তার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। মনে হলো চোখ দুটো আমারই অপেক্ষা করছিলো। হয়তো না আবার হয়তো হ্যা। কি জানি কি হবে। আমি তাকে সালাম দিলাম। সে প্রশস্থ একটি হাসি দিয়ে আমাকে উত্তর দিলেন। আমি বললাম “আমার নাম পাখি আহমেদ”
সে বললো
– “আমি ফাহমিদা বেগম, আমি এতক্ষণ তোমার অপেক্ষাই করছিলাম। তোমাকে আমাদের খুব প্রয়োজন। আমার নাতির খেয়াল রাখতে। আমার নাতির নাম আয়াত রেজওয়ান।
,
আয়াত নামটা শুনে কালকের ওই ছোট্ট ছেলেটার কথা মনে পরলো। আমি মনে মনে চাইলাম আমি যার খেয়াল রাখতে এসেছি সে যেন ওই আয়াত নামের ছেলেটায় হয়। কেন চাইলাম বুঝতে পারছি না।
,
মহিলা টার থেকে জানতে পারলাম আমাকে এখানে আায়াতে সব কাজ করতে হবে আর ওকে সময় দিতে হবে। ওর খাওয়ানো, পরানো, গোসল, ওকে খেলানো, ওর খেয়াল রাখা মানে ওর সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ। সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত। আমার মাসিক বেতন ১৬ হাজার টাকা। ভদ্রমহিলা আমাকে এটাও জানালেন যে আমি চাইলে তারা টাকার পরিমান বাড়িয়ে দিবে। আমি এতোটাও আশা করেছিলাম না। আমি বললাম,
-তার প্রয়োজন নেই।
,
– জানো মা আমি আায়াতকে ৪ বছর ধরে পালতেছি। কিন্তু আমার এখন বয়স হয়েছে। তাই তোমাকে আমাদের প্রয়োজন। তুমি কাল থেকেই কাজে আসতে পারো।
,
-ওর বাবা মা কি জীবিত নেই ?
,
-আছে তো। আমার ছেলে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত আর আয়াতের মা তার নতুন স্বামী কে নিয়ে ব্যস্ত।
,
-মানে?
,
-আয়াতের জন্মের পর আমরা জানতে পারি মিরার অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক আছে যা এখনো বর্তমান। তারপর সে আমার ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। আর আমিই আয়াতকে বড় করতে থাকি। আমার ছেলেও আর দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। হয়তো নিজের জীবনে এমন কিছু আশা করেনি।
,
আমাকে নিয়ে ভেতরে গেলেন। বাইরে থেকে বাড়িটাকে মাঝারি রকম ভেবে যে ভুল করেছিলাম তা আমার ভেঙ্গে গেল। মাঝখানে বড় ড্রইংরুম। একপাশে কিচেন এবং এডজাস্ট ডাইনিং রুম। আর বিপরীতে উপরে উঠার সিঁড়ি। আমাকে উপরে আয়াতের রুমে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমার মনের আশা সত্যি করে কাল বিকালের আয়াত বিছানায় উবুত হয়ে ঘুমে আছে। আয়াতের দাদী বললো “ওই হলো আমার নাতি, আয়াত। তোমাকে ওরই খেয়াল রাখতে হবে। ” আমি প্রশান্তির এক হাসি দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে আসার জন্য পিছন ঘুরলাম। চলে আসতে নিতেই আঁচলে টান পরলো। পিছন ঘুরে দেখলাম আয়াত জেগে গেছে এবং আমার আঁচল মুট পাকিয়ে ধরে রেখেছে। হঠাৎই মাম্মাম বলে আমার কোলে ঝাপিয়ে পরলো। আমি ওর দাদীর দিকে তাকালাম। সে আমাকে প্রথম দেখে যে হাসিটা দিয়েছিল, এখন তার থেকেও চওড়া একটা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমাকে বললো “তুমি চাইলে আজ থেকেই তোমার কাজ শুরু করতে পারো।”
,
-“অবশ্যই”(মুচকি হেসে)
,
আয়াতের দাদী নিচে চলে গেল আমাকে ওর কাছে রেখে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ করে এনে কাপড় বদলে দিলাম। ওর সোনালী চুলে চিরুনী দিয়ে বুলিয়ে দিতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো আয়াত। আমার গলা জরিয়ে ধরে বলতে লাগলো,
,
-মাম্মাম একন থেকে তুমি আমাল কাছে থাববে তোও?
,
-হ্যা আয়ু সোনা আমি থাকবো তোমার কাছে। তবে আমি তোমার মাম্মাম না। আমি তোমার ফ্রেন্ড। আমাকে তুমি পাখি বলে ডাকবে কেমন?
,
-না না না, তুমাকে আমি মাম্মাম বলেই দাতবো। (জিদ দেখায়ে)
,
-তাহলে কিন্তু আমি থাকবো না তোমার কাছে।
,
-আত্তা আত্তা, তুমি আমাল ফেলেন্দ। তুমাকে পাখি বলেই ডাকবো। (সব গুলো দাঁত বের করে হেসে দিয়ে)
,
ওকে কোলে করে নিচে যাওয়ার জন্য এগুতে লাগলাম, ওউ আমার গলা জরিয়ে ধরে চুপটি করে থাকলো। কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ করে কোল থেকে নেমে দাদুন ভাই দাদুন ভাই করতে করতে দৌড় দিলো নিচে। আমি ওকে ধরতে যেয়েও পারলাম না। আস্তে আস্তে নামতে লাগলাম। সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রাখতেই পিছন থেকে ভারি গম্ভীর কোনো পুরুষ কন্ঠে কেউ বলে উঠলো “আপনিই কি আয়াতের কেয়ার টেকার ? ”
,
পিছনে ঘুরে তাকাতেই শাড়ির আঁচলেে পা বেঁধে পরে যেতে নিলাম আর সাথে সাথে একটা বলিষ্ঠ শক্ত হাত আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরলো।
,
বিষয়টা এমন ভাবে ঘটলো যে আতংকে আমি আমার চোখ বন্ধ করার সুযোগ টাও পেলাম না। দেখলাম চওড়া কপালের উপড় কালো ছোট ছোট কোঁকড়া চুলের এক সুন্দর চেহারা আমাকে দেখছে। তার চোখের মাঝের সুক্ষ রক্ত নালি গুলো আমি যেন গুনতে পারবো। চোখ গুলো হয়তো কাল রাতে নির্ঘুম ছিল। তার বরফ শীতল চাহনি একদম স্থীর। কী অদ্ভুত ব্যাপার। তার ওই বরফ শীতল চাহনিতেও আমি ঘামতে শুরু করলাম।
·
·
·
চলবে……………………