হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব -৪২ ও শেষ

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪২
সময় যতো যায় সম্পর্ক ততো গাড়ো হয় নয়তো ফিকে হয়। সময়ের জোয়ারে নতুন সম্পর্ক গঠিত হয়। মুন্নি ও রাদিফের আজ বিয়ে। অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে। প্রকৃতিতে শরৎকালের শেষ সময়। দূর্গা পূজোর ছুটিতে বিয়ের আয়োজন করে ফেলেছে। ঢাকা থেকে জারিফরাও হাজির। জারিফ ও জায়ান গেস্টদের ওখানে দেখাশোনা করছে আর প্রিয়া ও তামান্না মুন্নির কাছে ওর ঘরে আছে। প্রিয়া মুন্নিকে বারবার দেখছে। মেয়েটা দেখতে মায়াবি। মায়াবি মুখশ্রীর অধিকারিণীকে জারিফ নজর-আন্দাজ করে দিলো! মুন্নি কয়েকবার লক্ষ্য করেছে প্রিয়ার তাকানো তাই তামান্নাকে বলে,

“ভাবী একটু মাকে ডেকে দিবে? সাথে আমার জন্য একটু পায়েস নিয়ে আসোনা। ভাইয়াকে বলো সে ব্যাবস্থা করে দিবে।”

তামান্না উঠে গেল। ঘরের ভিতর থাকা অন্যদের মুন্নি একটু বাহিরে যেতে বলে। ওরা বাহিরে যাচ্ছে তাই প্রিয়াও যাওয়া ধরলে মুন্নি ওর হাত টেনে ধরে।

“আপনি যাবেন না।”

প্রিয়া কিছুটা বিস্মিত হয়। সবাই বেরিয়ে গেলে মুন্নি প্রিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে ওঠে,

“এতক্ষণ যাবত আপনি আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন তাই না?”

প্রিয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। মুন্নি হেসে বলে,
“ভাবছেন আমি সুন্দরী হওয়া স্বত্বেও আপনার স্বামী আমাকে রিজেক্ট করল কেনো? জানেন? এই প্রশ্ন আমারও মন মস্তিস্কে ঘুরপাক খে*তো। তারপর আমার বাবা আমাকে বুঝালো। যার চোখে যে সুন্দর। আপনার স্বামীর চোখে আমি বোন তাই আমার রূপ-সৌন্দর্যে তার কিছু যায় আসত না। আপনি ভাগ্যবতী বটে। আপনাকে একসময় আমি ঈ*র্ষা করেছিলাম। এখন আর সেই ঈ*র্ষা নেই। যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে। আমার জীবনে এমন একজন এসেছেন, যিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। চারটা মাস বন্ধুর মতো তিনি আমার পাশে ছিলেন। আমাকে তার সাথে সহজ করেছেন। আমার না বলা অনেক কিছু বুঝে নিয়ে তা পূরণ করেছেন। তাছাড়া তিনি মাশাআল্লাহ্ অনেক সুন্দরও। জানিনা ভালোবেসে ফেলেছি কীনা? হয়তো তার জন্য ভালোবাসা জন্মে গেছে। তিনি আশেপাশে থাকলে মানুষিক শান্তি পাই। ভরসা পাই। আর কি চাই বলুন?”

প্রিয়ার ওষ্ঠকোণে প্রশান্তির হাসির রেখা ফুটলো। মুন্নির মনে যে তাকে নিয়ে তিক্ততা নেই সেটা জেনে স্বস্থি পেলো। ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করল। সেখানে একজোড়া ডায়মন্ডের টপ ইয়ারিং আছে। সেটা মুন্নির হাতে দিয়ে বলল,

“এটা আমার ও জারিফের পক্ষ থেকে। তোমার জীবনে রাদিফের সাথে সুখের মুহূর্তগুলো সর্বদা উজ্জ্বল হয়ে থাকুক। আমাদের জন্যও দোয়া করো।”

“এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি আপনাদের নিয়ে মনে কোনো অসন্তোষ রাখিনি।”

“অসন্তোষের জন্য না। আমাদের জন্য তোমার জীবনে কিছু সময়ের জন্য হলেও অন্ধকার ভর করেছিল। সেই অন্ধকার তোমার জীবনে আর না আসুক। বলতে পারো, আলোর দিশারী স্বরূপ দিলাম। তোমার জীবনের শুভ কামনা স্বরূপ।”

মুন্নি চোখে হাসল সাথে প্রিয়াও। ততক্ষণে মুন্নির মা হাজির। তিনি মেয়ের কী লাগবে তা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরেন। প্রিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে বিয়ে বাড়িতে জারিফকে খুঁজছে। এই ভারী লাল বেনারসি পড়ে সে ভাবছে আশেপাশের মানুষ আবার তাকে বউ ভেবে ভুল না করে! হলোও তাই। এক বয়স্ক মহিলা এসে কিছুটা সন্দেহের নজরে দেখে সুধায়,

“এই মেয়ে! কোথায় যাচ্ছ? একটু পর তোমার বিয়ে পড়াবে আর তুমি এখানে ঢেং ঢেং করে হাঁটছ! কোনো অন্য মতলব আছে নাকি?”

প্রিয়া ঠোঁট উলটে তাকায় অতঃপর করুণ স্বরে বলে,
“আন্টি আমি মুন্নি না। আমি ওর কাজিনের ওয়াইফ। মুন্নি ওইযে কোনার দিকের দ্বিতীয় ঘরটাতে আছে।”

মহিলাটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে চোখে চশমাটা ঠেলে বলে,
“অহ। এজন্যই বলি? মাথায় ওড়না কোথায়? এমন পাথরের গহনা কেনো? তা বাপু? তোমাকে কি বিয়েতে গহনাগাঁটি দেয়নি? কিসব পা*থর পড়ে আছ!”

প্রিয়া মহিলাটির কথায় বিরক্তই হলো বেশ।
“দিয়েছে আন্টি। সেই ঢাকা থেকে তো সব আনা যায় না। তাছাড়া আমি যদি সেসব পড়ি তবে আপনি তো আমার এই সাঁজেই বউয়ের সাথে গু*লিয়ে ফেলেছেন! তখন তো আমাকে জি**ম্মি করে আমার দ্বিতীয় বিয়েও সেরে ফেলতেন! আপনার মনের শান্তির জন্য পরশু বউভাতে আমি ওসব পড়বনে। চোখ দিয়ে দেখে নিবেন তখন।”

প্রিয়া এই বলে সরে গেলো। আরেকটু পর জারিফকে দেখল বরের বাড়ির মানুষদের সাথে কথা বলছে। প্রিয়া নিশ্চুপে জারিফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জারিফ একপলক দেখে হেসে আবার কথা বলছে। কথা বলা শেষে জারিফ প্রিয়াকে নিয়ে বাগানের দক্ষিণ পাশে যে শিউলি ফুল গাছটা আছে সেটার কাছে। গাছটার নিচে চাদরের মতো শিউলি ফুলগুলো বিছিয়ে আছে। জারিফ গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়াকে বলে,

“কী ব্যাপার? তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়ালে অথচ কিছু না বলে দাঁড়িয়েই ছিলে। মন বুঝি খুব খুশি?”

প্রিয়া জারিফের দিকে এগুলো। তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“মনে জমে থাকা মেঘ কে*টে গেছে। বুক ভরে প্রশান্তির শ্বাস নিতে পারছি।”

জারিফ প্রিয়ার গালে স্লাইড করে ঘোরলাগা স্বরে বলে,
“বাই দা ওয়ে! তোমাকেই তো বউ বউ লাগছে। কেউ আবার তোমাকে নিয়ে ধরে বেঁধে বিয়ে না দিয়ে দেয়! আমার একমাত্র বউকে আমি অকালে হারাতে পারব না। তুমি আমার সাথে সাথেই থাকবে।”

প্রিয়া লজ্জায় আড়ষ্ট হচ্ছিল তন্মধ্যে হেসে ফেলে।
“দিতো তো। ভাগ্যিস উনার এক্সপেক্টেশন অনুসারে আমি সাঁজিনি।”

দুজনেই হেসে উঠল। জারিফ এক মুঠো শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বলে,
“একদিন শিউলিমালা খোঁপায় গেঁথে আমার শরৎশশী সাঁজবে প্রিয়। আমি মুগ্ধ নয়নে দেখব।”

সমীরণে আজ প্রেমের ছোঁয়া। হৃদয়ে প্রখর অনুভূতিরা ঠিকরে পরছে।

____________

মুঠো ভর্তি কাশফুল হাতে নিয়ে পিহুর উচ্ছাসতা দেখছে আয়ান। বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হাসছে। পরী ও রাদ এদিকে কিছুটা দূরে কাশফুলের সাথে ছবি তুলতে ব্যাস্ত। নিশি, মিম, অর্ষা, অন্যপাশে ছবি তুলছে তাদের ক্যামেরাম্যান সাদ! আয়ান দেখল পিহুর ঝাঁকানোর কারণে কাশফুলের রেণু অনেক ছড়িয়ে পরছে তাই দ্রুত ওর হাত থেকে ফুলগুলো ফেলে দিয়ে বলে,

“এই রেণু কিন্তু চোখের জন্য ক্ষ*তিকর। অনেক লা*ফালে এবার চলো।”

পিহু আয়ানের ধরা হাতের দিকে তাকালো। এতোদিনে ওদের বন্ধুত্ব আরও সুন্দর হয়েছে। পিহুর ভালোবাসা আরও গাড়ো হয়েছে আর আয়ানের মনে হচ্ছে সে এই বাচ্চা স্বভাবের মেয়েটির ভালোবাসায় আটকে গেছে। আয়ান পিহুর নজর দেখে হাতটা আরও জোড়ালো ভাবে ধরল। পিহু মুচকি হাসে। সূর্যরশ্মি মৃদু আঁচ দিচ্ছে। সূ্র্যের দিকে তাকিয়ে কদম বাড়াতেই হোঁ*চট খেতে নিলে আয়ান সামলে নেয়।

“পরে যেতে তুমি।”

“আপনি আছেন তো।”

এই ভরসাস্বরূপ জবাবে আয়ান স্নিগ্ধ হাসলো। কিছুটা দূরে এক হাওয়াই মিঠাইওয়ালা দেখলে পিহু বলে ওঠে,
“ওই দেখুন। ওখানে নিজেদের পছন্দ মতো শেইপে হাওয়াই মিঠাই বানানো যায়। চলুন খাব।”

আয়ান পিহুকে নিয়ে গেল। বেচারি শাড়িতে বারবার পা পেঁচিয়ে যাচ্ছিল। একটা লাভ শেইপ হাওয়া মিঠাই বানাতে বলল। সেটা নিয়ে পিহু আয়ানের সাথে সেলফিও তুলল। আয়ান মনে মনে ভাবে,

“আমার যাওয়ার দিন তোমাকে উপহারস্বরূপ দেওয়ার আরও একটা কিছু যুক্ত হলো। তোমার মুখের বিষাদময়তায় এক টুকরো হাসির কারণ হবে।”

________
দেখতে দেখতে জারিফ ও প্রিয়ার এনিভার্সিরি চলে আসে। বসন্তসাঁজে প্রিয়া নিজেকে সাঁজিয়েছে। খোঁপায় তার বেলিফুল। সাদার মধ্যে হরেক রঙের ফুলের সমাহার শাড়িতে। জারিফকেও ম্যাচিং পাঞ্জাবি পড়িয়েছে। আজ ওরা রবীন্দ্র সরোবরে এসেছে। জারিফ বেলিফুল ও কাঠগোলাপের মালা কিনে প্রিয়ার দুহাতে পড়িয়ে দিয়েছে। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসেছে ওরা। প্রিয়া বলে,

“কীভাবে একটা বছর পেরিয়ে গেলো বলুন? সব কেমন দ্রুত চলে গেল না? এইতো সেদিন আমাদের পরিচয় হলো।”

জারিফ একটা কৃষ্ণচূরা প্রিয়ার কা*নের পিঠে গুঁজে বলে,
“একদিন আমরা বুড়ো হবো। তখন দুজনে আবার আসব এখানে। সাথে নাতি-নাতনী থাকলে মন্দ হয় না বলো?”

“ইশ! এখনও বাচ্চাই হলো না আর সে নাতি-নাতনীর চিন্তা করে!”

“হবে তো। তোমার গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট হোক।”

প্রিয়া আফসোস করে বলে,
“ভেবেছিলাম, বিয়ে হবে আর পড়ব না। কিন্তু কপালে তো শান্তি নাই। স্যারের সাথে বিয়ে হলো।”

জারিফ হেসে উঠল যার দরুন প্রিয়া ওর বাহুতে থা-*প্প**ড় দিলো। জারিফ রম্যস্বরে বলে,
“আমার আরও দূরদর্শী চিন্তা আছে। তোমাকে নিয়ে কানাডা যাব। আমি পিএইচডি করব আর তুমি মাস্টার্স ও পিএইচডি করবে।”

প্রিয়া চোখ রসোগোল্লার মতো বড়ো বড়ো করে বলে,
“কিহ! গ্রাজুয়েশনের পর আমি অতো প্যা*রা নিতে পারব না। আপনার মন চাইলে ডাবল ত্রিপল পিএইচডি কইরেন। আমাকে টানবেন না। আমি তো রিল্যাক্স করব।”

“আচ্ছা! তখন দেখা যাবে।”

সন্ধ্যার বাতায়নে রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে। জীবনের প্রহর থেকে আরও একটি বাৎসরিক সন্ধ্যা বিদায় জানাচ্ছে ওদের।
#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৩(অন্তিম পাতা)
“প্রিয় পিহু,
তোমার সাথে পরিচয় হয়েছিল এক বসন্তে সবুজেঘেরা পাহাড়ের কো*লে। উড়নচ*ণ্ডী তোমাকে দেখে প্রথমে বি*র*ক্তি এসেছিল। মন ভালো করার জন্য একটু নিরবতা চেয়ে ঘুরতে এসে বি*র*ক্তি যেনো পিছু নিলো এরকমটাই মনে হয়েছিল। সেই থেকে পরিচয় অতঃপর সময়ের ব্যবধানে বন্ধুত্ব ও হয়তো অদৃশ্য প্রেমও! আজ আমি বহুদূরে চলে যাচ্ছি। কিছু কারণ আছে। বলতে গেলে বংশগতিয়! আমার দাদা যেই কারণে তার শেষ সময়ে এসা*ইলে*মে ছিলেন। আমি নিজের মধ্যে সেরকম কিছু উপলব্ধি করতে পারছি বিধায় অতিসত্তর চিকিৎসা প্রয়োজনে ও সেই সাথে স্টাডির জন্য যেতে হচ্ছে। আমি চাইনা আমার কারণে আমার ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডরা আঘা**ত পাক। তোমাকে আমি অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার ভালোবাসা আমাকে দ্বিতীয়বার ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। আমি যাকেই ভালোবাসি নিয়তি তাকে আমার থেকে কেড়ে নেয়! অ*দ্ভুত না? যাইহোক, আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে তা নিয়ে আমি চিন্তিত নই কিন্তু আমার দাদী ভিষণ চিন্তিত। তিনি তার স্বামীর মতো আমাকেও সেই স্থানে ও সেই যন্ত্রনায় দেখতে চান না। তোমার ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক দোয়া রইল। অনেক অনেক সুখী হও।
ইতি একজন হৃদয়হীন ব্যাক্তি!”

চিঠিটা হাতে নিয়ে শূণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে পিহু। তার ভালোবাসার জবাব এতোদিন পর পেলেও বুকের ভিতর ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার অদৃশ্য শূণ্যতায় খাঁ খাঁ করছে। চিঠির সাথে একটা করে লাল, হলুদ, সাদা গোলাপ, বেলিফুলের মালা ও হাওয়াই মিঠাই। সাদ, রাদ, নিশি ও প্রিয়ারা দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধুদের সবার জন্য একটা চিঠি রেখে গেছে।
“প্রিয় লাকি সেভেন!
আমরা সাতজন ভার্সিটি লাইফের দুই বছর নিজেদের ব্যাক্তিগত কোনো কারণকে বন্ধুত্বের মধ্যে আনিনি। তোদের ভীষণ মিস করব। অবশ্য আমি মিস করার মতো অবস্থায় থাকলে! জানিনা কখনও আবার দেখা হবে কীনা! তবে মনে রাখিস, আমি তোদের প্রতিটা আড্ডায় সবসময়কার মতো নিরব ভূমিকা পালন করব। যদি ফিরে আসি তবে আমি আমার লাকি সেভেনকে অটুট দেখতে চাই।
বন্ধুমহলের নিরব মানব!”

গতকাল রাত সাড়ে বারোটার ফ্লাইটে আয়ান আমেরিকা চলে গেছে। ক্রেডিট ট্রান্সফারটাও সেমিস্টার ব্রেকে করে ফেলেছে। চোখের কোণে জমা অশ্রুকণা মুছে নিয়ে পিহু চিঠিটা হাতে উঠে দাঁড়ালো। পরীকে বলল,

“আপু চলো।”

পিহু কথাটা বলে নিজে একাই সামনে অগ্রসর হলো। এরকমটা তার সাথে না হলেও পারত!

___________
কেটে গেছে চারটা বছর! আজ নাহান ও ফিহার বিয়ে! পারিবারিকভাবে পছন্দ করে বিয়ে হচ্ছে ওদের। তাদেরকে নিজেদের পছন্দের কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এবং দুজনেই জানিয়েছে এমন কোনো পছন্দ নেই। ফিহা ক্রা*স খেলেও সেসবে সে অতোটা গুরুত্বও দেয়নি এবং কারও সাথে কখনও কমিটমেন্টেও ছিল না। আর নাহান! সেই যে প্রিয়ার বৌভাতের পরেরদিন এক ঝলক রাহাকে দেখে তাকে নিয়ে ভেবেছিল! তারপরে তো ওদের দেখা-সাক্ষাত হওয়া বা যোগাযোগ হয়ে উঠেনি। নাহান পড়াশোনা করতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাহার প্রতি এক ঝলক ভালোলাগাটা আর স্থায়িত্ব পায়নি নাহানের পড়াশোনা ও যোগাযোগ না হওয়াতে। বাবা-মায়ের পছন্দে ফিহাকে বিয়ে করছে সে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর দুই মাস যাবত ফিহার সাথে সময় কা*টিয়ে ফিহাকে নাহানের ভালো লেগেছে। নাহান এখন মাস্টার্স শেষ করে রেজাল্ট সেরা তিনজনের মধ্যে হওয়ায় সরাসরি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছে। ফিহা অনার্স প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই তবে ওদের ডিপার্টমেন্টটা আলাদা।

বধূবেশে কিছুক্ষণ আগে তিন কবুল বলে নাহানের স্ত্রী হয়ে গেছে ফিহা। বিয়েতে প্রিয়ার পরিবার সহ রাহাও এসেছে। রাহাকে ফিহা ইনবা*ইট করেছে যেহেতু ফিহার সাথে রাহার যোগাযোগ আছে। রাহা এখন ইশা ও প্রিয়মের ছেলেকে কোলে নিয়ে ফিহার পাশে বসে আছে। ফিহা লাজুক কণ্ঠে বলে,

“আমার জীবনের প্রথম ক্রা*স যে আমার বর হবে এটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। গো*ম*ড়ামু*খোর সাথেই আমি পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।”

রাহা ফিহার হাসিমাখা লাজুক মুখশ্রী দেখল। এখনি বর-কনেকে একত্রে বসানো হবে। রাহা অদূরে নাহানকে দেখে নিলো। তার প্রথম অন্যরকম অনুভূতির কারণ তো সেই মানুষটি। নাহ্! রাহা নাহানকে ভালোবাসেনি তার কারণও সেদিনের পর আর কোনো দেখা-সাক্ষাত, যোগাযোগ না হওয়া। পড়াশোনার যাঁ*তাক*লে সে ভুলেই বসেছিল। তবুও আজকে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর দেখে কিছুটা কস্ট হচ্ছে।

প্রিয়া ও তামান্নাসহ অন্যান্য ভাবীরা নাহানকে এনে ফিহার পাশে বসাল। প্রিয়া বলে,

“তো আপনাকে কি বলব বুঝতে পারছিনা। সম্পর্কে আপনি দেবর আবার ননদের বর!”

তামান্নাও প্রিয়ার সাথে তাল মিলায়। নাহান হালকা হেসে বলে,
“তাহলে আপনাদের ননদকে কী বলবেন ভাবীরা? সে কিন্তু দেবরের বউ!”

তামান্না নাহানকে চা**টা মেরে রম্যস্বরে বলে,
“ফিহার সাথে চলে চলে কি ফিহার কথার ধাঁচ আপন করেছ দেবরজি? হ্যাঁ বলো?”

সবাই হেসে ওঠে। আরেকজন ভাবী বলে ওঠে,
“তামান্না ভাবী ও প্রিয়া এইসব প্যাঁ*চে পরলেও আমরা কিন্তু পরছি না! আমরা মেয়ে পক্ষের। তাই ননদের বর হিসেবে তোমার থেকে আমরা দাবী রাখছি। দাবী মানলেই ননদ দিব।”

প্রিয়া বলে,
“আমি আর ভাবী তবে নাহান ভাইয়াকে দে*বরা*ই ডাকব! দেবর+নন্দাই=দে*বরা*ই!”

হাসির রোল পরে গেল ওদের। আনন্দ উল্লাসের মধ্যে বিয়ের সমস্ত কার্যকর্ম শেষ হলো।

রাতে প্রিয়া জারিফের জন্য বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। ওরা দেশে এসেছে এক মাসের বেশি হলো। এরইমধ্যে ফিহার বিয়ে। প্রিয়ার মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর জারিফ তার পিএইচডি সুপারভাইজারের কাছ থেকে একটা লম্বা বিরতি চেয়ে এনেছে। এতো লম্বা বিরতি দেওয়া হয় না কিন্তু জারিফের গ্রাজুয়েশনের ইউনিভার্সটির শিক্ষক তিনি। জারিফ আজকের মতো সমস্ত কাজ শেষ করে রুমে আসল তারপর ফ্রেশ হলো। প্রিয়াকে পা ঝুলিয়ে পা না*চা*তে দেখে বলে,

“হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

প্রিয়া মিষ্টি হাসল বিনিময়ে জারিফও। জারিফ প্রিয়ার পাশে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলে প্রিয়া জারিফের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পরে। জারিফ প্রিয়ার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে থাকে। প্রিয়া এমতাবস্থায় চোখ বন্ধ করে বলে,

“দুইটা গুড নিউজ আছে। কোনটা আগে শুনবেন?”

“টাইপ বলো।”

“উুঁহু। ধরণ আমি নিজেই নির্ধারণ করতে পারছি না।”

জারিফ মজা করে বলো,
“তবে জিজ্ঞেস করলে যে? এক কাজ করো। টস করো।”

প্রিয়া টস করল তারপর বলল,
“পরশু আয়ান দেশে ফিরছে।”

জারিফ অবাক হয়ে বলে,
“রিয়ালি? ওয়াও! দ্যাটস অ্যা রিয়ালি অ্যামিজিং নিউজ। ছেলেটা তবে সুস্থ হলো।”

“হুম। পিহুকে কেউ এখনও জানায়নি। রাদ ও পরীর বিয়ে সপ্তাহখানেক পরে। পিহুর বাবা-মায়ের সাথে পিহুর অগোচরে সব ঠিকঠাক করা হয়ে গেছে। আয়ানের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে দুই পরিবার। পরশুদিন সারপ্রাইজ পিহুর জন্য। তারপর রাদ ও পরীর বিয়ের দিন ওদেরও বিয়ে।”

জারিফ প্রিয়ার চুলে ঠোঁট ছোঁয়ালো। প্রিয়ার এবার লজ্জা লাগছে বিধায় আরেকটক গুড নিউজটা জারিফকে বলতে পারছে না। প্রিয়ার চুপ করে থাকা দেখে জারিফ সুধালো,

“সেকেন্ডটা বললে না?”

প্রিয়া যেনো গুঁ*টিশুঁ*টি মে** রে জারিফের বুকের ভিতর লুকালো। জারিফ কিঞ্চিত ভ্রুঁ কুঁচকালো। আবারও জিজ্ঞাসা করলে প্রিয়া একহাত দিয়ে বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা কার্ড বের করল এবং সেটা জারিফকে দিলো তারপর আবার জারিফের বুকের সাথে মিশে গেল! জারিফ ভ্রুঁ কুঁচকে কার্ডটা খুলে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রিয়াকে নিজের থেকে সরিয়ে উঠে বসল। প্রিয়ার মুখমণ্ডল নিজের দুহাতের আঁজলাতে নিয়ে অবাক কণ্ঠে বলে,

“ইজ ইট ট্রু প্রিয়া?”

লাজুকতার ন্যায় মিইয়ে গিয়ে হ্যাঁ বোধক ইশারা করে। জারিফ খুশিতে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। প্রিয়াকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

“আপনাকেই প্রথম জানালাম।”

“অ্যাই ডোন্ট নো হাউ টু রিয়াক্ট! বাট অ্যাই ফিল দ্যাট অ্যাই অ্যাম দ্যা মোস্ট হ্যাপিয়েস্ট ম্যান ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।”

প্রিয়া আচ্ছন্ন স্বরে বলল,
“এন্ড অ্যাই অ্যাম দ্যা মোস্ট হ্যাপিয়েস্ট ওম্যান ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। কনগ্রেটস টু আস।”

নতুন সদস্যের আগমন সুখের হোক ওদের জীবনে। সবার হৃদয়ে লুকানো প্রেম পূর্ণতা ও সুখের হয়তো হয়না কিন্তু যাদেরটা হয় তারা ভাগ্যবান/ভাগ্যবতী।
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here