হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব -১৪+১৫

#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_১৪
লেখনীতেঃভূমি

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের শীত।রাতের আকাশটায় আজ একটু বেশিই আঁধার নেমেছে।অনেকক্ষন তাকিয়েও চাঁদের দেখা পাওয়া গেল না আকাশে।অদ্রিজা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল।রক্তিম নামক পুরুষটার জন্য অস্থিরতা টা যেন রাত হলেই হু হু করে বেড়ে উঠে।সেই অস্থিরতায় তার ছোট্ট মনটা যেন রোজ রোজ ভেঙ্গে চুড়মার হয়।অদ্রিজা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই আকাশের দিকে তাকাল।গভীর দৃষ্টিতে আকাশটাকে দেখতে মত্ত হতেই কানে আসল বেসুরা মোবাইলের রিংটোন।অদ্রিজা কপাল কুঁচকাল।রাত এগারোটা- সাড়ে এগারোটা হচ্ছে।এতোক্ষনে কে কল করবে তা বুঝে না উঠেই তৎক্ষনাৎ হাতের মোবাইলটা উল্টে চাইল।মোবাইলের স্ক্রিনে রক্তিমের নামটা জ্বলজ্বল করতে দেখেই অজানা অনুভূতি এসে ভীড় করল হৃদয়ে।অনুভূতিটা যেমন খুশির তেমনই অজানা ভয়ের।মোবাইলের স্ক্রিনে সময়টা দেখে হয়তো ভয়টা আরেকটু বাড়ল।বারোটা বাঁজার আর বিশমিনিট বাকি।এই সময়ে কেন কল করল রক্তিম?অদ্রিজা বুঝল না।কলটা রিসিভড করেই কাঁপা গলায় বলল,

‘ হ্ হ্যালো!’

রক্তিম কিছু বলল না।চুপ রইল।অদ্রিজার অস্থিরতাটা বেড়েই চলল।হাতের তালু বেলকনির গ্রিলে ঘষতে ঘষতেই আবারও বলল,

‘ হ্যালো রক্তিম?’

রক্তিম হালকা হাসল।বলে উঠল,

‘ আকাশের তারা কখনো বাবা মা হয় না।আপনি সেটা জানেন না?তাও আকাশপানে তাকিয়ে আছেন কেন?’

অদ্রিজা চমকে উঠল রক্তিমের কথা শুনে।সে আকাশ দেখছে তা রক্তিম কি করে জানল? বেলকনির গ্রিল ভেদ করে আশেপাশে তাকিয়েই রাস্তার ওপাশটায় বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো রক্তিমকে দেখেই শিউরে উঠল মুহৃর্তে।লম্বা চওড়া সাদা ধবধবে শরীরে ব্ল্যাক শার্ট, গুঁটানো হাতা, ব্ল্যাক জিন্স।মোবাইল কানে রেখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে ঘোর লাগানো চাহনিতে।সেই চাহনিতেই যেন নড়বড়ে হয়ে গেল অদ্রিজার ভেতরটা।অস্বস্থিতে হাঁসফাঁস করেই বলল,

‘ আপনি আমার বাসার সামনে রক্তিম?’

রক্তিম ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।অদ্রিজার দিকে ঠিক সেভাবেই তাকিয়ে রইল।ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘ তো?’

অদ্রিজা কি বলবে খুঁজে পেল না।রক্তিমের হাসি আর তাকানো দেখেই লজ্জ্বায় মিইয়ে এল যেন সে।মুহুর্তেই বোধগম্য হলো রক্তিম নামক পুরুষটাকে দেখে সে লজ্জ্বা পাচ্ছে।মুখ নামিয়ে মোবাইলটা কানে রেখেই লজ্জ্বা ভাবটাকে লুকোতেই কঠিন গলায় বলল,

‘ তো মানে?এতরাতে আপনি আমার বাসার সামনে আসবেনই বা কেন?মানুষজন দেখলে কি ভাববে!এই পাড়ায় নতুন আমরা।একটা বিবাহিত মেয়ে রাত বিরাতে বেলকনিতে এসে কোন ছেলের সাথে প্রেম বিনিময় করছে বিষয়টা মোটেই ভালো দেখায় না।’

রক্তিমের তেমন একটা ভাবাবেগ হলো না।বরং অদ্রিজাকে আরো লজ্জ্বায় ফেলতেই মুখে অন্যরকম দুষ্টুমিমাখা হাসি ফুটাল।ঠোঁট কাঁমড়ে চোখমুখের চাহনি অন্য রকম করেই অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে।অদ্রিজা সেই দৃষ্টির সম্মুখীন হতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল।জামার ওড়না ঠিকঠাক করে ওড়নায় হাত ঘষে অস্বস্তি কমাতে চেয়েই বলে উঠল,

‘ ছিঃ!তাকানোর কি ধরণ।এক্ষুনি বখাটে ছেলে হিসাবে রাস্তায় ঘনপিটুনি খেতে পারেন আপনি। ‘

রক্তিম আওয়াজ করে হাসল।চাহনিটা সেরকম রেখেই বলল,

‘ যাক বাবা!আপনিই বললেন প্রেম বিনিময় করছি আর প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকালেই অপরাধ?’

‘অপরাধ।খুব বড়সড় অপরাধ!’

রক্তিম হাসল।বাইকের থেকে সরে এসেই রাস্তার একপাশে দাঁড়াল। অদ্রিজার দিকে চাহনি সরল না অবশ্য।ঠোঁটজোড়া গোল করে তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে শিষ বাঁজিয়ে উঠল।অদ্রিজা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল। রক্তিম বাঁকা হেসেই বলল,

‘ এই বখাটে ছেলের গর্হিত অপরাধে কেউ শাস্তি দিচ্ছে না অদ্রিজা।দেখুন।’

অদ্রিজা কিছুক্ষন চুপ থেকেই ছোট্ট শ্বাস ফেলল।সরাসরি বলল,

‘ কেন এসেছেন?’

রক্তিম নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল,

‘ সুইটহার্টের বার্থডে আজ।পিচ্চিরা পাঠাল আপনাকে নিয়ে যেতে।নিচে নামুন তো দ্রুত।’

রক্তিমের কথাগুলো শুনেই এতক্ষনকার স্বচ্ছ সুন্দর অনুভূতি, শিহরণ সবটাই মুহুর্তে রূপান্তরিত হলো বিশ্রী রাগ আর ক্ষোভে।রক্তিমের মুখপানে এক নজর চাইতেই রক্তিম মুচকি হাসল।বলল,

‘ এভাবে তাকালে ভয় পাব অদ্রিজা।’

‘ ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আপনি চলে যান।আমি এখন ঘুমাবো।আপনার সুইটহার্টকে আমার হয়ে জম্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে দেবেন রক্তিম।ওহ হ্যাঁ, একটু দাঁড়ান।আমি আপনার সুইটহার্টের জন্য গিফ্ট নিয়ে আসছি।ওটা দিয়ে দেবেন আমার হয়ে।’

কথাটা বলেই অদ্রিজা রুমে ডুকল দ্রুত।রক্তিম প্রায় মিনিট দুই বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই নিচে নামল অদ্রিজা রক্তিমের সামনে গিয়েই একটা তরতাজা গোলাপ আর একটা বক্স ধরিয়ে দিয়েই বলে উঠল,

‘ আপনার সুইটহার্টের জন্য উপহার। দিয়ে দেবেন।বাই।’

কথাগুলো বলে অদ্রিজা পেঁছন দিকে পা বাড়াতে নিলেই রক্তিম তার বা হাতটা ধরে হেঁচকা টান দিল।বাইকের পেঁছনে বসিয়ে দিয়েই নিজেও বসে পড়ল সামনে।বাইক চালানো স্টার্ট করার আগেই আয়নায় একনজর চাইল অদ্রিজার দিকে।বাঁকা হেসে বলল,

‘ আমায় ধরে বসুন।পরে পড়ে টড়ে গেলে জানা নেই।’

অদ্রিজা রক্তিমকে ধরে বসল না।ছটফট করে উঠে যেতে নিলেই রক্তিম বাইক চালানো শুরু করল।অদ্রিজা হুড়মুড় করে টাল সামলাতে না পেরেই রক্তিমের পিঠে শার্টটা খামচে ধরল।রক্তিম বাঁকা হাসল।মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ প্রথমেই বলেছিলাম। ‘

.

জায়গাটা বিশাল। খালি মাঠ।পাশেই রাস্তা। রাতের ঠান্ডা বাতাসে কোথাও থেকে ভেসে আসছে শিউলি ফুলের তরতাজা সুগন্ধ।অদ্রিজা পাশ ফিরে চারদিকটা ঘুরে তাকাল।রাস্তার পাশেই শিউলি গাছ।রাতের অন্ধকারেও শিউলি ফুলগুলোর সাদা আভা আবছা দেখা যাচ্ছে।অদ্রিজা মৃদু হাসল। মাঠের মাঝখানে তাকাতেই দেখা মিলল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলোর।লাল নীল বাতি, হরেক রকম বেলুন দিয়ে সাঁজানো হয়েছে মাঠটা।মাঠের মাঝখানে আরো লোক আছে।অদ্রিজা স্পষ্ট দেখতে পেল না তারা কারা।রক্তিমের দিকে ভ্রু কুঁচকেই প্রশ্ন ছুড়ল দ্রুত,

‘ আমাকে জোর করে আনলেন কেন রক্তিম?আমি আসতে চাইনি।আপনার প্রেমিকা আপনার প্রেম, আপনি আসবেন তার বার্থডেতে।আমাকে কেন?’

রক্তিম মুচকি হাসল।অদ্রিজার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই নিজের ডান হাতের তর্জনি আঙ্গুলটা রাখল অদ্রিজার ঠোঁটজোড়ায়।অদ্রিজা যেন মুহুর্তেই জমে গেল।রক্তিমের হাতের স্পর্ষ হঠাৎ ঠোঁটে পেয়েই চমকে গেল সে।চোখজোড়া বড় বড় করে তাকাতেই রক্তিম হাসল।ঘড়িতে বেশ মনোযোগ দিয়ে সময় দেখেই বলল,

‘ বারোটা বাঁজার আর চার মিনিট।আপনি আসলে আসুন। না আসলে এখান থেকে চলে যান।এজ ইউর উইশ!’

অদ্রিজা সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল।চোখজোড়া দিয়ে মুহুর্তেই অগ্নির ন্যায় ফুলকি বের হলো।রক্তিমের তাতে তেমন হেলদোল ঘটল না।অদ্রিজার মুখে ফু দিয়েই পা এগিয়ে চলে গেল সামনে।অদ্রিজা ঠাই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।এত রাতে এখানে এনে তাকে একা ছেড়ে চলে গেল?আবার চলে যেতেও বলল?দুনিয়ায় অসভ্য, নিকৃষ্ট লোক থাকলে এই লোকটাই তার শীর্ষে অবস্থান করছে।রাগে হাঁসফাঁস করেই এগিয়ে গেল মাঠের মাঝখানে থাকা লোকজন আর বাচ্চাগুলোর দিকে।মাঠের এককোণায় গিয়ে মুখচোখ ভারী করে দাঁড়িয়ে থাকতেই বাচ্চাগুলো ঘিরে ধরল তাকে ঘিরে। সবাই একসাথেই বলল চেঁচামেচি করে,

‘ অদ্রিজা আপি?’

অদ্রিজা মুচকি হাসল।রক্তিমের প্রতি রাগ, ক্ষোভটা মুহুর্তেই যেন উবে গেল।মিষ্টি হেসেই বলল,

‘ হ্যাঁ ছোট্ট পিচ্চিরা।তোমাদের পিকনিক শেষ?’

ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর মাঝখান থেকে একজন মুহুর্তেই বলল,

‘ নাহ তো, এখনও তো সুইটহার্টের কেক কাঁটা বাকি আছে।ওটাই তো মেইন পার্ট ।’

অদ্রিজা অবাক হলো।কপাল কুঁচকে মেকি হাসল।ওরাও সুইটহার্ট ডাকে তাকে?কে সে?চোখ মুখ কুঁচকে নিয়ে ভাবতেই মাঠের মাঝখানে এসে উপস্থিত হলো রক্তিম। শুধু সে নয়।সাথে সাদা শাড়ি পরিহিত একজন বৃদ্ধা মহিলাও আছে।রক্তিম তার চোখজোড়া হাতজোড়া দিয়ে ধরে রেখেছে।অদ্রিজা কিছুই বুঝে উঠল না।পা বাড়িয়ে সামনে যেতেই চোখে পড়ল নেহাকেও।অদ্রিজাকে দেখেই ঝটফট এগিয়ে আসল তার দিকে।দাঁত কেলিয়ে বলল,

‘ তুই কবে আসলি দ্রিজা?এতক্ষন একা একা বোর হচ্ছিলাম।’

অদ্রিজা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল নেহার দিকে।রক্তিম আর বৃদ্ধ মহিলাটার দিকে আরেক নজর তাকিয়েই পুরা বোকার মতো চেয়ে রইল।নেহা খিলখিল করে হেসেই ঘড়ি দেখল।অদ্রিজার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ আর এক মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড দ্রিজা।’

অদ্রিজা থমকানো মস্তিষ্ক নিয়ে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।রক্তিমের সুইটহার্ট কে বুঝে না উঠেই কান্না পাচ্ছে তার।আর ঐ বৃদ্ধাই বা কে?রক্তিমের সুইটহার্ট কি সেই?বুঝে উঠল না।মস্তিষ্ককে বারবার প্রশ্ন করেও কোন উত্তর খুঁজে পেল না সে।বিধ্বস্ত মন নিয়ে একবার রক্তিম আর ঐ বৃদ্ধা মহিলা তো একবার নেহার দিকে তাকাল।শুকনো ঢোক গিলেই কাঁপা গলায় বলল,

‘ উ্ উনি? উ্নিই কি রক্তিমের সুইট….’

অদ্রিজা পুরো কথাটা শেষ করতে পারল না।সঙ্গে সঙ্গেই চারপাশ থেকে ভেসে আসল আনন্দ উচ্ছ্বাসিত মিশ্রিত হৈ- হুল্লুড়। ছোট্ট ছোট্ট পিচ্চি গলার তীক্ষ্ণ আওয়াজ সহ, রক্তিম, নেহার গলায়ও শোনা গেল,

‘ হ্যাপি বার্থডে সুইটহার্ট! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! ‘

অদ্রিজা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।রক্তিমের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল সে।রক্তিম সামনের বৃদ্ধা মহিলার চোখ থেকে সরিয়ে নিল হাতজোড়ার শক্ত বাঁধন।মুখটা বৃদ্ধার কাঁধে গুঁজেই মিষ্টি হেসে বলতে লাগল,” হ্যাপি বার্থডে সুইটহার্ট।”অদ্রিজা রক্তিমের থেকে নজর সরিয়ে বৃদ্ধার দিকে তাকাল।মুখটা পুরোপুরি নেহার মতোই দেখতে।গায়ের রং রক্তিমের মতোই ফর্সা ধবধবে।কুঁচকানো চামড়া। মাথায় সাদা পাঁকা কোঁকড়ানো চুল।রক্তিম সে চুলেই একহাত দিয়ে হাত বুলিয়ে মুখ ঘেষল বৃদ্ধ মহিলার মুখের কুঁচকানো চামড়ায়।টুপ করেই সাদা ধবধবে গালের কুঁচকানো চামড়ায় চুমু খেল।বৃদ্ধা হাসল।রক্তিম হাঁটু গেঁড়ে বসেই বৃদ্ধার বাম হাতের আঙ্গুলে পরিয়ে দিল চকচকে হীরার রিং।পেঁছন থেকে অদ্রিজার দেওয়া সেই গোলাপটাই এগিয়ে দিয়েই হেসে বলল,

‘শুভ জম্মদিন সুইটহার্ট।তোমায় অনেক ভালোবাসি সুইটহার্ট।সবসময় আমার পাশে এভাবেই থাকবে।’

বৃৃদ্ধা মুচকি হাসল। রক্তিমের হাত ধরে উঠিয়েই হাত উঁচিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিল।মুচকি হেসেই বলল,”পাগল!”অদ্রিজা মুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে রইল।রক্তিমের হাত ধরে কেক কাঁটতে গিয়েই চারপাশে একবার ফিরে চাইল বৃদ্ধা।অদ্রিজার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের চাহনি।অদ্রিজা সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল।মৃদু হেসে নেহার কাছাকাছি দাঁড়িয়েই কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ উনি তোর দাদীমা?মানে রক্তিমের নানী?রুহানা চৌধুরী যেমন তোর কার্বন কপি তেমনটা না হলেও তোর চেহারার সাথে অনেক মিল আছে উনার চেহারার।তাই মনে হলো।’

নেহা মুচকি হাসল।বলল,

‘ হ্যাঁ।আমার দাদীমা।’

অদ্রিজা চকচকে চাহনিতে তাকাল।সঙ্গে সঙ্গেই অস্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠল,

‘ তার মানে রক্তিমের সুইটহার্ট উনিই?উনাকে সুইটহার্ট ডাকে রক্তিম?’

নেহা খিলখিলিয়ে হাসল।ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ উহ!কেবল সুইটহার্ট না তো।প্রেমিকাকে যতরকম সম্বোধন করা যায় সবই ডাকে রক্তিম ভাইয়া দাদীমাকে।’

অদ্রিজা মুচকি হাসল।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রক্তিমের হাসিমাখা মুখটার দিকে।এই যুবকটির মাঝেই যে কতশত দুঃখ লুকায়িত আছে তা কি কেউ বলবে তার এই মারাত্মক ঘায়েল করা হাসি দেখে?

.

তখন খাওয়ার পর্ব শেষ। বিশাল মাঠের মাঝখানেই খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে।অদ্রিজা আর নেহা ও খাবার শেষ করে দুটো চেয়ারেই বসে ছিল।বাচ্চাগুলো যে যার মতো খাওয়া শেষ করে খেলছে হাত পা ছড়িয়ে। সামনের টেবিলটাতে আরো বেশ কয়েকজন। নেহার মা বাবা সহ, চাচা চাচি। অদ্রিজা মিনমিনে চাহনিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল তাদের।ঠিক তখনই পেঁছনে এসে দাঁড়াল নেহার দাদীমা।মাথায় হাত রেখেই মুখ নিচু করে অদ্রিজার মুখটা দেখল।মিষ্টি হেসে বলল,

‘ তুমি নেহার ফ্রেন্ড বুঝি? চিনলাম না তো। ‘

অদ্রিজা মাথা ঘুরিয়ে তাকাল।মুচকি হেসে উঠে দাঁড়াল।টিস্যু পেপারে দ্রুত হাত মুঁছে মিষ্ট হেসেই জবাব দিল,

‘ জ্বী হ্যাঁ। আবার রক্তিমের ওয়াইফ…..’

বাকিটা বলতে দিল না রক্তিম।তার মুখ থেকে কথাটা একপ্রকার কেঁড়ে নিয়েই বলল,

‘ উহ!রক্তিমেন ওয়াইফ না, লিটল ওয়াইফের ফ্রেন্ড তুমি অদ্রি…জা। ভুলে গেলে আমি নেহাকে লিটল ওয়াইফ ডাকি। ওয়াইফ না ‘

অদ্রিজা বিষম খেল।রক্তিমকে গিরগিটির মতো রং বদলাতে দেখে বিস্ময়ে চোখমুখ চকচক করে উঠল।রক্তিমের মুখ থেকে তুমি ডাকটা শুনে আরো বিস্ময় খেলে গেল চোখমুখে।হালকা কেঁশেই অস্ফুট স্বরে বলল,

‘ জ্বী।’

রক্তিম অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই বাঁকা হাসল। নিজের নানীকে কিছু একটা বুঝিয়েই অন্য পাশে পাঠিয়ে দিল।অদ্রিজা হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝেই ডানহাতটা চেপে ধরে হেঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে গেল অন্য দিকে।পেঁছনে কোন গাছের সাথে হাতজোড়া চেপে ধরেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

‘ সুইটহার্টের সামনে আপনাকে আমার ওয়াইফ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিলেন কোন সাহসে অদ্রিজা?আমার আর আপনার সম্পর্কটা শুধুমাত্র একমাসের সম্পর্ক। মিস্টার মাহমুদের সাথে চুক্তি করেই বিয়েটা করেছিলাম।আপনি যেমন আপনার বাবার ঋন বা পাওনা মিটারোর জন্য বিয়ে করেছেন।তেমনই আমিও এই যে বিশাল জায়গাটা দেখছেন? এই জায়গাটার জন্যই চুক্তি করে আপনাকে বিয়ে করেছি।শুধু এইটুকুই।সুইটহার্ট এই বিষয়ে কিছু জানে নাহ।আমি চাই না জানুক।আপনিও কিছু বলবেন না।আপনার চুক্তি তো মিটেই গিয়েছে।এবার আমার চুক্তিটাও মিটে যাওয়ার অপেক্ষা। তারপর সবটা শেষ!আর কিছুই থাকবে না আমাদের মাঝে।মাইন্ড ইট!’

অদ্রিজার চোখজোড়া টলমল করে উঠল।নিজের এতটা কাছে রক্তিম অথচ রক্তিমের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না তার।কান্না আসছে চোখজুড়ে।এই যুবকটিকে সত্যিই কি তবে ভালোবেসে ফেলল সে?নাহলে এতটা কেন কষ্ট হয়? এত কেন অস্থিরতা তার জন্য?একবার যদি সবকিছু ভুলে বলে দেয়, ” ভালোবাসি।” রক্তিম কি মেনে নিবে সম্পর্কটা?নাকি ফিরিয়ে দেবে?#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_১৫
লেখনীতেঃ ভূমি

রাত প্রায় একটা কি দুটো।শুনশান নিরবতা চারদিকে।দূরে কোথাও গাড়ির অল্প আওয়াজ এসে কানে লাগছে।অদ্রিজা টলমলে চোখজোড়া নিয়েই ঐ বিশাল মাঠটা থেকে বেরিয়ে আসল।গভীর রাতের নিরব রাস্তায় হেঁটে চলতেই অজানা ভয় এসে ঘিরে ধরল মনকে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে রাস্তায় নিজের ছায়াটা চোখে পড়ল কেবল। আর কেউ নেই কোথাও।ভয়ে ক্রমশ জমে গেল সে।শুকনো ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকাল। না কেউ নেই।তার বাসা থেকে রক্তিমের বাইকে করে এখানে আসতে দশ মিনিটের মতো লেগেছে। তার মানে হেঁটে গেলে বিশ কি পঁচিশ মিনিটের পথ হবে।কিন্তু এই নিরব, অন্ধকার, রাতের রাস্তায আদৌ কি একা একা যাওয়া উচিত?তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল,”হ্যাঁ উচিত।রক্তিমের কাছে যদি তুমি কিছু নাই হও তবে তার সাথে বাসায় যাওয়াটাও অন্যায়।চরম অন্যায়!’অদ্রিজা রাগে জ্বলজ্বল করে আশেপাশে চাইল।টলমল করা লাল টকটকে চোখ যেন রক্তিমকে এক্ষুনি পেলে শেষ করে ফেলত।ভস্ম করে দিত তার শরীর মন।অদ্রিজা হাঁসফাঁস করল।দ্রুত পা বাড়িয়ে কয়েক মিনিট পথ এগিয়ে যেতেই কিছুটা দূরে দেখা মিলল চারটা ছেলের।টলতে টলতে হাঁটছে। বয়স হয়তো বিশ একুশ বছরেরই হবে।অদ্রিজা ভীত চাহনি নিয়ে তাকাল।হৃদয়ের ভেতর অদ্ভুত ভয় জেঁগে উঠল মুহুর্তেই।শুকনো ঢোক গিলে ভীত চাহনি নিয়ে আশেপাশে তাকিয়েই দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল সে।ছেলেগুলোকে পাশ কাঁটিয়ে যেতে যাবে ঠিক তখনই তাদের মধ্যে থাকা একজন বলে উঠল,

‘ বাহ! এতরাতে মাইয়ামানুষ?এতরাতে রাস্তায় কেন তুমি ললনা?’

অদ্রিজার ভীত চাহনি এবার আরো তীক্ষ্ণ হলো।অজানা ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগল তার।ছেলেটার কথাকে কোনরকম পাত্তা না দিয়ে ধুকবুক করা হৃদয় নিয়ে হাঁটতে লাগল অদ্রিজা।কিন্তু রক্ষা হলো না।ঐ চারজন ছেলে এসে ঘিরে ধরল চারপাশটা।মুখচোখে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করে তারই মধ্যে একজন বলে উঠল,

‘ কি মামনি?কোথায় যাও?’

অদ্রিজা মিনমিনে চোখে মুখ তুলে তাকাল ছেলেটার দিকে।ভয়ে হাত পা কাঁপছে।চারপাশে শীত শীত ভাব থাকলেও ঘামে হাত পা ভিজে উঠল তার।কপালের ঘামে চুপসে লেপ্টে গেল ছোট ছোট চুল গুলো।অদ্রিজা কিছু বলল না ছেলেটার কথার বিনিময়ে। চোখমুখ কালো করে তাকিয়ে রইল।তা দেখেই হয়তো সামনের ছেলেগুলো সাহস চওড়া হলো।একজন তার বাম হাতটা ছট করেই ধরে বসল।অদ্রিজা তৎক্ষনাৎ হাত ছাড়িয়ে নিল।অন্য হাত দিয়ে ছেলেটার স্পর্ষ মুঁছে ফেলতেই ঘষতে লাগল।কাঁপা গলায় বলল,

‘ এ্ এক্ একদম না।একদম টাচ করবেন না। ‘

ছেলেগুলো তার কথাটা তেমনভাবে নিল বলে মনে হলো না।মুখে বিশ্রী হাসি ঝুলিয়েই প্রথমজন বলল,

‘ টাচ করব না?’

কথাটা বলেই আবারও হাসল সবাই আওয়াজ করে।অদ্রিজা ভয়ে ছোট ছোট চোখ করে তাকাল।বার বার শুকনো ঢোক গিলেই এপাশ ওপাশ চাইল।কিছুটা দূরে সরু আলোর ফুলকি দেখে নিজের ভেতর একটু হলেও সাহস সঞ্চয় হলো এবার।কোনভাবে সামনের ছেলেটাকে ঠেলেই দৌড় লাগাল সামনে।বেশিদূর যাওয়া হলো না।তার আগেই সামনে এসে দাঁড়াল একটা বাইক।অদ্রিজা হাঁপাতে হাঁপাতেই হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়াল।বাইকের সামনের তীক্ষ্ণ আলোয় পেঁছনের মানুষটাকে দেখা না গেলেও ওটা যে রক্তিম তা বেশ বুঝতে পারছে। অদ্ভুত ভাবে ভয়টা মুহুর্তেই কেঁটে গেল তার।এই মানুষটার প্রতি এত কেন বিশ্বাস তার?বুঝে উঠে না সে।তবুও তাকেই মন থেকে বিশ্বাস করে সে। ভরসা করে।অদ্রিজা হাঁপাতে হাঁপাতেই
রক্তিমেন সামনে গিয়ে দাঁড়াল।রক্তিম মুচকি হাসল।মৃদু গলায় বলল,

‘ এই না হয় মিসেস রক্তিম মাহমুদ?তেজ, আত্নসম্মান এতটাই প্রখর যে মাঝরাতে এই নিরব, জনশূণ্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন?আপনি এতটা নির্বোধ নন অদ্রিজা যে এইটুকু জ্ঞান ও আপনার নেই। জাস্ট ডিসগাস্টিং!’

অদ্রিজা ড্যাবড্যাব করে তাঁকাল।রক্তিমের রাগে লাল হওয়া চেহারাটা দেখেই থমকে গেল সে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাতে লাগল।রক্তিম একপ্রকার বিরক্তি নিয়েই বলল,

‘ এইটুুকু পথ এসেই আপনি হাঁপিয়ে গেলেন অদ্রিজা?’

অদ্রিজা টলমলে চাহনিতে তাকিয়ে রইল রক্তিমের দিকে।হাত দিয়ে ইশারা করে পেঁছনে দেখিয়েই কাঁপা কন্ঠে বলল,

‘ র্ রক্তিম?পেঁছনে কয়েকজন ছেলে, আ্ আমায়…’

অদ্রিজাকে বাকি কথাটা না বলতে দিয়ে রক্তিম ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে হাতের ইশারায় সেদিক পানে তাকাল।গম্ভীর গলায় বলল,

‘ বাইকে উঠুন।’

অদ্রিজা সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।রক্তিম এবার ধমকে বলল,

‘ কথা কানে যায় না আপনার?উঠুন।’

অদ্রিজা এবার উঠে বসল।ভয়ে দুই হাত দিয়ে খামচে আঁকড়ে ধরল রক্তিমকে।মুখটা রক্তিমের পেঁছনে একপ্রকার লুকিয়ে রেখেই ছোট ছোট শ্বাস ফেলল।রক্তিম আগের মতোই গম্ভীর রইল।বাইকটা আরেকটু এগিয়েই নিয়ে ছেলেগুলোর কাছে গিয়ে থামাল।হাত দিয়ে ইশারা করেই ছেলেগুলোকে দেখেই বলল,

‘ হাই ব্রো।’

ছেলে গুলো বোকার মতো তাকাল।একবার রক্তিম তো একবার অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে থাকল।টলতে টলতে আরেকটু এগিয়ে এসেই চোখ কচলাল।আবারও রক্তিম আর অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই বলল,

‘ কে ভাই? ‘

রক্তিম দাঁত কেলিয়ে হাসল।বলল,

‘ তোর বস!’

ছেলেটা ঝাপসা চাহনি সরাতেই আবারও চোখ কচলাল।রক্তিমকে ভালো মতো দেখে নিয়েই বলল,

‘ আরেহ ঐদিনের ভাইটা না?’

রক্তিম বাঁকা হাসল। বলল,

‘ ইয়েস!মনে পড়ল? তো প্রথমে ঐ জায়গায়টায় তোরা তোদের আস্তানা করলি, ড্রিংক করা, জুয়া খেলা ইত্যাদি ইত্যাদি।ওসব ছিল তোদের প্রাথমিক অন্যায়।ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর বাসস্থান তোরা জোর করে দখল করতে চাইলি আমি তার জন্য যা শাস্তি দিয়েছি তোদের তা বোধ হয় কম পরে গেল বল?তার জন্যই এবার বড়সড় অন্যায় করে বসেছিস?জানিস এর শাস্তি কি হতে পারে?ওর সাথে কি করেছিস বল!’

ছেলেগুলোর এতক্ষনকার মাতলামে করা চাহনি এবার যেন সতেজ হয়ে উঠল।ভয়ে থতমত খেয়েই একজন মাথায় হাত রেখে বলে উঠল,

‘ নিজের দিব্যি ভাই!কিচ্ছু করি নাই এই মাইয়ার সাথে।শুধু হাতটাই ধরছিলাম।আর কিছ…’

ছেলেটাকে বাকিটা বলতে না দিয়েই রক্তিম বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল।ছেলেটার কলারটা দুই হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরেই বলে উঠল,

‘ হাত? হাত ধরেছিস?কে ধরেছিস ওর হাত?কোন হাত দিয়ে ধরেছিস।গিভ মি আন্সার ফার্স্ট!’

ছেলেটা ভীত চাহনিতে তাকাল রক্তিমের দিকে।ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘ ভাই?মাইরেন না দয়া করে।আমিই ধরছিলাম।’

রক্তিম ক্ষ্রিপ্ত চাহনিতে তাকাল।চোয়াল শক্ত হয়ে এল মুহুর্তেই।কলারটা আরো শক্তভাবে চেপে ধরেই বলল,

‘ তুই?তুই ধরেছিস ওর হাত?কোন হাত দিয়ে ধরেছিস?’

ছেলেটা ডানহাতটা এগিয়ে দিল। হাতটাও কাঁপছে তার।ভয়ে থতমত খেয়েই বলল,

‘ এই হাত দিয়াই ভাই।এবারের মতো ক্ষমা কইরা দেন ভাই।আর জীবনেও এমন কিছু করুম না আমি ভাই।প্লিজ!’

রক্তিম হাসল।ছেলেটাকে ভদ্রভাবেই ছেড়ে দিল।বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েই বাকি তিনজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

‘ আর তোরা তিনজন?কিছু করিসনি তোরা?’

ছেলেগুলো ছোট ছোট চোখ করে তাকাল।মাথা নাড়িয়ে বুঝাল তারা কিছু করেনি।রক্তিম মুচকি হাসল।ঠোঁটজোড়া গোল করে শিষ বাঁজাতে বাঁজাতেই হাতজোড়া বুকে ভাজ করে দাঁড়াল।বলল,

‘ ওকে সবাইকে মাফ করে দিলাম।কিন্তু তোদের নিজস্ব কাজ দিচ্ছি।কাজ করলে ক্ষমা করে দিব।রাজি?’

চার চারটা ছেলেই সঙ্গে সঙ্গে মাথা দুলাল যে তারা রাজি।রক্তিম মুচকি হাসল।বাইকে উঠে বসেই বলল,

‘ তোরা তিনজন ওর ডান হাতটাকে ইচ্ছেমতো আঘাত করবি।যতোটা আঘাত না করলে ও বুঝতে না পারে অদ্রিজাকে স্পর্ষ করার শাস্তি কতোটা ভয়ানক ঠিক ততোটাই আঘাত করবি।এন্ড প্রুফ হিসেবে আমাকে কাল ওর আহত হাতসহ দেখাতে আসবি।আর তুই?ওরা যখন হাতটা আঘাত করা শেষ করবে? তখন তুই নিজ দায়িত্বে গিয়ে হাতের ব্যান্ডেজটা করিয়ে নিবি।ওকে?চারজনই মিলে কাল সকালে প্রুভ দিয়ে আসবি অফিসে।আমার সন্দেহ হলে আমি ব্যান্ডেজ খুলে আবার দেখব।যদি সন্দেহ সত্যি হয় তোদের চার চারজনকেই এমন কেলাব যে জীবনেও ভুলবি না।’

ছেলেগুলো বাধ্য ছেলের মতো মাথা দুলাল।রক্তিম বাঁকা হাসল।বাইক চালাতে চালাতেই অদ্রিজার ভয়ার্ত, ঘামে ভেজা মুখটা বারংবার বাইকের আয়নায় দেখল।অদ্রিজাও সেভাবেই রইল।রক্তিমের সাথে কথা বলার সাহস পেল না।হঠাৎ মোবাইলে রিংটোনের আওয়াজ শুনেই কপাল কুঁচকে চাইল সে।বোনের নাম্বার দেখেই কল রিসিভড করে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ হ্যালো অত্রি?আমি এই তো চলে আসছি। আর অল্প একটু।তুই আম্মুকে আরেকটু বুঝিয়ে রাখ প্লিজ!আমি চলে আসছি।’

ওপাশ থেকে অত্রিয়া মৃদু গলায় বলল,

‘ তুই সেই গেলি, দুই তিন ঘন্টা হচ্ছে আপু।আম্মু হঠাৎ জেগে গেলে আমি কি বলব?’

অদ্রিজা হতাশ হলো।কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই রক্তিম জোরে জোরে বলে উঠল,

‘ বলবে তোমার জিজুর সাথে ঘুরতে বের হয়েছে।আর অদ্রিজা তো তোমাদের বাসায় ফিরছে না এখন।কাল সকালে ফিরবে।তুমি বুঝিয়ে নিও অত্রিয়া।’

অদ্রিজা ড্যাবড্যাব করে তাকাল।অস্ফুট স্বরে বলল,

‘ মানে?কি বলছেন রক্তিম?এখন বাড়ি না ফিরলে আমার আম্মু রাগ করবে রক্তিম।’

রক্তিম গম্ভীর গলায় বলল,

‘ যেভাবে একা একা মাঝ রাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন তখন মনে ছিল না বাড়ি না ফিরলে আপনার আম্মু রাগ করবে?তখন যদি বাড়ি না ফিরতে পারতেন আপনার আম্মু বুঝি রাগ করত না অদ্রিজা?’

অদ্রিজা চুপ হয়ে গেল।শুকনো ঢোক গিলে কল কেঁটে দিয়ে সেভাবেই খামচে ধরল রক্তিমের শার্ট।হালকা কেঁশেই বলল,

‘ থেংক্স রক্তিম।আমাকে বাঁচানোর জন্য।’

রক্তিম হাসল। বলল,

‘ আমি মোটেই আপনার থেংক্সের জন্য আপনাকে বাঁচাইনি অদ্রিজা।’

অদ্রিজা কিছু বলল না।কয়েক মিনিট পর নিজের বাসার সামনে এসে থামল রক্তিমের বাইকটা।দ্রুত নেমেই মুচকি হেসে বলল,

‘ আবারও থেংক্স রক্তিম।আমাকে আম্মুর রাগের থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।জানতাম আপনি মজা করছেন।যেখানে আপনি নিজের ইচ্ছায় এখানে রেখে গেলেন আমায় মুক্তির জন্য, সেখানে আমার সাথে সময় কাঁটানোর ইচ্ছে বোধ হয় আপনার হবে না বলুন?নেহাৎ ঐ পিচ্চিগুলোর আবদার রক্ষার জন্য আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন আজ।তাই না?’

রক্তিম হাসল।বাইকের সামনে ঝুলিয়ে রাখা প্যাকেটটা থেকে বের করল দু দুটো বক্স।একটা সে বক্স যেটা অদ্রিজা তার সুইটহার্টের জন্য দিয়েছিল।গিফ্টটা দেওয়া হয় নি তাই ফেরত দিল অদ্রিজার হাতে।বলল,

‘ ঠিক বলেছেন।ঐ পিচ্চিগুলোই আমার সব। আমার জীবনে ওরা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ আপনি জানেন ও না অদ্রিজা।ওরা আমার মতোই নিঃস্ব।আমার মতোই রাতের আকাশে মা বাবাকে খোঁজে। আমার মতোই মা বাবা হীন জীবন কাঁটায় ওরা।জানি না ওদের মা বাবার শূণ্যতা পূরণ করতে পারব কিনা তবে আমি ওদের শূণ্য থাকতে দিতে চাই না ।সুইটহার্টের পরে আমার জীবনে ওরাই সব।তাই তো আমি ওদের জন্য সব করতে পারি।আপনাকেও বিয়ে করে নিলাম ওদের জন্য। ‘

অদ্রিজা মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ ওরাও আপনাকে অনেক ভালোবাসে মিঃ রক্তিম।’

রক্তিম মিষ্টি হাসল। হাতের অপর বক্স টা খুলে বের করল একটা পায়েল।বাইক থেকে নেমেই হাঁটু গেঁড়ে বসল অদ্রিজার সামনে। অদ্রিজার বাম পা টা একপ্রকার জোর করে ধরেই পরিয়ে দিল পায়েলটা।মুচকি হেসেই বলল,

‘ বাহ!বেশ মানিয়েছে আপনার পায়ে।’

অদ্রিজা হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইল।রক্তিম উঠে দাঁড়িয়েই মুচকি হেসে বলল,

‘ গিফ্ট বক্সটা ফেরত দিলাম কেন জানেন? ঐ গিফ্ট বক্সে সুইটহার্টকে আমার প্রেমিকা ভেবে কি না কি দিয়েছেন।তাই রিস্ক নিই নি।দি ও নি সুইটহার্টকে।আর ঐ পায়েলটা সুইটহার্টের জন্য গিফ্ট কিনতে গিয়ে চোখে পড়েছিল।ভাবলাম আমার টেম্পোরারি ওয়াইফের জন্য নেওয়াই যায় গিফ্টটা। ভালো করেছি না?’

অদ্রিজা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।বলল,

‘ ভালো করেছেন কি খারাপ করেছে তা আমি কি করে জানব।’

রক্তিম বাঁকা হাসল।অদ্রিজার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ সেটাও ঠিক।তবে পরিয়ে দিলাম বলে ভাববেন না আমি আপনাকে ভালোবাসি।পরিয়ে দিয়েছি কারণ অত্রিয়া বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ও যাতে ভেবে না বসে আমাদের মাঝে সম্পর্কটা ফেইক। তাই।’

অদ্রিজা এবারও তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।বলল,

‘ জানুক না।কি হবে তাতে?দুদিন পর তো জানবেই। তাই না রক্তিম?আমি তো আর জোর করে আপনার জীবনে থাকতে পারব না আপনি না চাইলে।একদিন না একদিন তো সেই জানতে হবে।’

কথাটা বলেই আর দাঁড়াল না অদ্রিজা।একনজর নিজের রুমের বেলকনিতে দাঁড়ানো অত্রিয়াকে দেখেই মৃদু হাসল।তারপর গেইট খুলে দ্রুত ঢুকে গেল বিল্ডিংয়ে।আর রক্তিম একনজর তাকিয়েই মুখ বাঁকিয়ে হাসল।

#চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here