#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_১৬
লেখনীতেঃভূমি
ক্যান্টিনে সামনাসামনি চেয়ারে বসে ছিল অদ্রিজা আর দিহান।নেহা দূর থেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।কি বলছে?কি এত গুরুত্বপূর্ণ কথা যে দিহান তাকে সরে আসতে বলল সেখান থেকে?নেহা কি তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি?বন্ধু হিসেবেই কি সেখানে তাকে রাখা যেত না?কি এমন কথা থাকতে পারে যে তাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিল?নেহা বুঝে উঠল না।দূর থেকেই বুকে হাত ভাজ করে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।অদ্রিজা উঁশখুঁশ করে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নেহা আর দিহানের দিকে তাকাল।নজরটা তীক্ষ্ণ করেই দিহানের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
‘ দিহান, কি কথা বলবে যে এভাবে নেহাকে দূরে দাঁড়াতে বললে? ও আমার ফ্রেন্ড। ওর সামনেই যা বলার বলতে পারো তুমি।আমি ওকে ডাকছি।’
দিহান শান্ত কিন্তু গম্ভীর ভারী গলায় বলল,
‘ না।’
অদ্রিজা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল।তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,
‘ কেন?ও কষ্ট পাবে। আমি চাই না আমার ফ্রেন্ড কষ্ট পাক। ‘
দিহান হাসল।শক্ত গলায় বলল,
‘ ও আমারও ফ্রেন্ড। কোন বিহেভিয়ারে কষ্ট পাবে না পাবে তা একটু হলেও বোধ হয় আমি জানি দ্রিজা।’
অদ্রিজা সরু চাহনিতে তাকাল।দিহানের কথাবার্তায় স্পষ্ট তার রাগের বার্তা ভেসে উঠছে।কিন্তু তার কারণ কি?অদ্রিজা কি কিছু করেছে? যা করেছে তার জন্য এতদিন কথা না শুনিয়ে আজ হঠাৎ এই রাগ কেন?অদ্রিজা ছোট শ্বাস ফেলল।কফির মগটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল।শান্ত গলায় বলে উঠল,
‘ কি বলবে?বলো। জলদি।’
দিহান শক্ত চাহনিতে তাকাল।সেই ধারালো চাহনির তাল সামলাতে না পেরেই কপাল কুঁচকে আসল অদ্রিজার। দিহান সেভাবেই তাকিয়ে বলল,
‘ আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে দ্রিজা।তার মানে এই নয় যে আমার আত্নসম্মান নেই।তুমি জানো নিশ্চয়, আমি বরাবরই আত্নসম্মান নিয়ে বাঁচতে ভালোবাসি।কোন সময় কারো দয়া নিতে পছন্দ করি না আমি দ্রিজা।’
অদ্রিজা থমকে গেল।ফাঁপা মস্তিষ্কে দিহানের বলা একটা কথার ও মানে খুঁজে না পেয়ে ক্রমশ সরু হলো চাহনি।ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখেই বলল সে,
‘ মানে?’
দিহান আগের মতোই গম্ভীর শক্ত চাহনিতে তাকাল।বলল,
‘ আমার এক্সিডেন্টটা আমার অসাবধানতার জন্যই হয়েছিল। তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে এই শোকে এতটাই আনমনে হাঁটছিলাম যে কখন মিঃ রক্তিমের গাড়ির সামনে এসে পড়েছিলাম আমার বুঝাই হয়ে উঠে নি।নেহার চিৎকার করা সতর্কবাণীগুলোও আমার কানে আসে নি সেইদিন।সেদিন এক্সিডেন্টটার জন্য আমিই দায়ী।তাহলে এসবের মানে কি দ্রিজা?আমি তো এতদিন এসব জানতেই পারিনি।আজ জানলাম। আর জানার পর থেকে কেবল একটা কথায় মনে হচ্ছে, তুমি আমায় দয়া করছো, তোমার হাজব্যান্ড আমায় দয়া করেছে।রাইট?’
অদ্রিজা কেঁপে উঠল।মিনমিনে চাহনিতে দিহানের দিকে তাকিয়ে থেকেই কাঁপা গলায় বলল,
‘ কো্ কোনসব?কোনসবের কথা বলছো তুমি?’
দিহান কপাল কুঁচকে তাকাল।মুখে চোখে তার স্পষ্ট বিরক্তি আর চাপা রাগ।পকেট থেকে ভাজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিয়েই অদ্রিজার সামনে মেলে ধরল।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ হসপিটালের বিল! এক লক্ষ পঁচানব্বই হাজার তিনশত টাকা।আমি জানি তোমার হাজব্যান্ডের টাকা আছে, সে ধনী লোক।কিন্তু তাই বলে আমায় দয়া করবে কেন?এর থেকে বোধ হয় সেদিন মারা গেলেই ভালো হতো।অন্যের দয়া নিয়ে বাঁচার থেকে মরে যাওয়াই শ্রেয় দ্রিজা। তাই না?’
অদ্রিজা অস্ফুট স্বরেই বলে উঠল,
‘ দি্ দিহান!’
দিহান কানে নিল না।আবারও চাপা স্বরে বলে উঠল,
‘ সত্যিই তোমার আর তোমার হাজব্যান্ডের এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না দ্রিজা।তবে টাকাগুলো আমি শোধ করে দেব।প্রত্যেক মাসে টিউশনি করিয়ে যা টাকা পাই তা জমিয়ে আস্তে আস্তে শোধ করে দিব।জানো দ্রিজা? যেদিন তুমি বিয়ে করেছিলে সেদিন কেবল মনে হচ্ছিল মধ্যবিত্ত হওয়া জম্মানোটা বোধ হয় পাপ।না নিজের ভালোবাসা পাওয়া যায় আর না কোন ইচ্ছে পূরণ হয়।আজ আবারও মনে হচ্ছে মধ্যবিত্ত হয়ে জম্মানোটা ভুল। আমার অপরাধও তো এটাই ছিল। তাই না দ্রিজা?তাই তো আমায় একবারও সুযোগ দিলে না।সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও প্রতিশ্রুতি রাখো নি তুমি।’
অদ্রিজা তপ্তশ্বাস ফেলল।দিহানের বলা প্রত্যেকটা কথাই যেন তার ভেতরে চরম আঘাত করছে। কেবল এটাই মনে হচ্ছে, সে লোভী।টলমল করে উঠল চোখজোড়া।ঘনঘন শ্বাস ফেলেই বলল সে,
‘ দিহান?তুমি কি এটাই বলতে চাইছো আমি লোভী?হ্যাঁ। আমি লোভী দিহান।নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য আমি লোভী হলে হলাম লোভী।ক্ষতি কি?তুমি আমার কাছে সময় চেয়েছিলে যতদিন না চাকরি পাও।ভালোবাসার প্রস্তাব রেখেছিলে।আমি বলেছিলাম, সম্পর্কটা প্রেমিক প্রেমিকার হোক চাই না, স্বামী স্ত্রীর হোক।আমি তোমায় সেদিন ফিরিয়ে দিই নি এটাই বোধ হয় সবথেকে বড় পাপ ছিল আমার দিহান।আমি তোমায় সময় দিয়েছিলাম।আর সেই সময়টা আসার আগেই নিজেই সেই প্রতিশ্রুতি থেকে পালিয়ে এসেছি।এই অপরাধটার জন্য আমি কিভাবে কষ্ট পাচ্ছি তা বোধ হয় তুমি জানো না।তবে সত্যি বলব?তুমি আমার থেকেও ভালো কাউকে পেয়েছো, পাবে দিহান।যে তোমাকে এতটা ভালোবাসে, যে তুমি নিজেই জানো না তোমার মূল্য টা কতটুকু।কে সে জানো?নেহা।ও তোমায় অনেক ভালোবাসে দিহান।আমাকে তুমি ভালোবাসলেও আমি কোনদিন তোমায় ভালোবাসতে পারিনি দিহান।সত্যি এটাই।তাই ঐ বিষয়টা চাপা দিয়ে নেহাকে ভালোবাসো।মেয়েটা তোমায় অনেক ভালোবাসে। এটুকু ভালোবাসা দিলেই সে ভালোবাসার সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দিবে।মানিয়ে নিবে।দেখো।’
দিহান চুপচাপ শুনল কথাগুলো।অদ্রিজার কথাগুলো শুনেই নেহার দিকে তাকাল।তার দিকেই তাকিয়ে ছিল নেহা।চোখাচোখি হতেই দ্রুত নজর সরাল নেহা।দিহান মুচকি হাসল।বলল,
‘ থেংক্স দ্রিজা।আসছি।’
অদ্রিজা ক্লান্তিমাখা চাহনিতে তাকিয়ে হালকা হাসল।মাথায় ঘুরছে রক্তিম নামক মানুষটার ভাবনা।সে যখন তাকে ভুল বুঝে বলেছিল, দিহানের এক্সিডেন্টের জন্য সেই দায়ী। কেন কিছু বলল না?মেনে নিল কেন অপবাদটা?অদ্ভুত!
.
সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাস।আকাশে ডুবুডুবু সূর্য।লালচে আকাশের দিকে তাকিয়েই চোখ ঘুরিয়ে তাকাল অদ্রিজা।সকাল থেকে রক্তিমকে কল করতে করতে পাগল বানিয়ে দিয়েছে সে।প্রায় আশিবার কল করার পর অবশেষে দুপুরে কল রিসভড করেছিল রক্তিম।অন্যদিনের মতো হাসিখুশি কন্ঠ শোনা যায়নি মোবাইলের ওপাশে তার কন্ঠ।অদ্রিজা যখন একের পর এক কথা বলছিল তখন সে কেবল হু, হা উত্তর দিয়েছিল ।অবশেষে যখন দেখা করার জন্য অনেকবার অনুরোধ করল তখন কেবল গম্ভীর গলায় হ্যাঁ উত্তর দিল।অদ্রিজা সরু চাহনিতে আশপাশটায় তাকাল।সেদিনের পার্কটাতে এসেই বসে আছে।কিন্তু আজ ফুলের মতো চটফটে, সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট দুলে উঠা, চঞ্চল মুখগুলো নেই।নেই সে মানুষটিও। যাকে একবার দেখার জন্য তার এতটা আকাঙ্খা। এতটা অস্থিরতা।অদ্রিজা মৃদু শ্বাস ফেলল।অত্রিয়াকে পাশে বসে থাকতে দেখেই আনমনে বলে উঠল,
‘ অত্রি?কাউকে কোনদিন ভালোবেসেছিস?’
অত্রিয়া চোখমুখ সরু করে তাকাল।ষোল বছর বয়সী কিশোরী সে। ছোট্ট তুলতুলে দেহের ভেতর থাকা কোমল মনটা ভালোবাসা শব্দটা শুনেই যেন লাফিয়ে উঠল।সদ্য কিশোরী মনে কারো জন্য অনুভূতির জম্ম ঘটেছে কিনা জানা নেই তবে মুচকি হেসেই বলল,
‘ জানি না আপু। ক্লাস নাইনে একটা ছেলেকে দেখেছিলাম।সুন্দর, শ্যামবর্ণের, লম্বা চওড়া শরীর। তারপরও দুইবার দেখা হয়ে ছিল অবশ্য।কিন্তু কে সে জানি না।দেখলেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।চোখ সরানো যায় না।এটা ভালোবাসা? ‘
অদ্রিজা হালকা হাসল।মৃদু গলায় বলল,
‘ জানা নেই।কখনো কাউকে ভালো টালো বাসি নি তো তাই তার সংজ্ঞাও জানা নেই।এই এখন এসে মনে হচ্ছে, তোর মতো কিশোরী থাকাকালীন কয়েকটা প্রেম করা উচিত ছিল। প্রেম বিষয়ক বেদনা, অস্থিরতা এসব হজম করতে সুবিধা হতো বল?’
অত্রিয়া হেসে উঠল খিলখিলিয়ে।ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ তুই কি এখন প্রেম বিষয়ক ছ্যাঁকা ট্যাঁকা হজম করছিস আপু?’
অদ্রিজা হাসল।মাঠের ওপাশের রাস্তায় তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টিতে রক্তিম কবে আসবে সেই প্রতীক্ষায়।এতক্ষণে সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটল।দেখা মিলল সেই অদ্ভুত যুবকটির।ঘন পাঁপড়িতে ঢাকা চোখজোড়া রাস্তার এপাশ ওপাশ ঘুরিয়েই রাস্তা পার হয়ে আসল সে।মুখে চোখে গম্ভীরতার ভীড়। কেমন অদ্ভুত ঠেকাল।চোখজোড়া যেন কেমন লাল হয়ে আছে।অগোছাল চুলের কিছু অংশ ঝুঁকেছে কপালে।অদ্রিজা মুচকি হাসল।রক্তিমকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই ফিসফিসিয়ে অত্রিয়াকে বলল,
‘ চরম লেভেলের ছ্যাঁকা হজম করছেরে তোর আপু।তোর ছোট্ট মাথা সে ছ্যাঁকা বিশ্লেষণ করতে পারবে না বুঝলি!’
অত্রিয়া ফিক করর হাসল।অদ্রিজা সেভাবেই তাকিয়ে রইল রক্তিমের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর নিজের সামনে এসেই হাতজোড়া বুকে ভাজ করে দাঁড়াল রক্তিম।ভ্রু নাচিয়েই অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কি সমস্যা?এভাবে হা হয়ে তাকিয়ে আছেন কেন অাপনি?অদ্ভুত!’
অদ্রিজা ইতস্থত করে চাহনি সরাল। মুখ কাঁচুমুচু করে কিছু বলবে ঠিক তার আগেই রক্তিমের কল আসল।রক্তিম কল রিসিভড করেই মুচকি হাসল।মোবাইলটা কানে নিয়েই বলল,
‘ উহ সুইটহার্ট, চিন্তা করো নাহ তো।মাথা ব্যাথা কমে গিয়েছে ‘
ওপাশ থেকে কি বলল শুনতে পেল না অদ্রিজা।তবে তার কিছুটা সময় পরই রক্তিম কলটা কেঁটে রেখে দিল।হাতজোড়া বুকে ভাজ করে দাঁড়িয়েই অত্রিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
‘ হ্যালো অত্রিয়া।কেমন আছো?’
অত্রিয়া মুচকি হাসল।ছোট্ট মুখটাতে একরাশ চঞ্চলতা নিয়ে বলে উঠল,
‘ভালো।আপনি?’
রক্তিম হাসল।অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই বলল,
‘ তোমার বোনের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম।এত কাজ, এত যন্ত্রনার মাঝেও ছুটে আসতে হলো।ভালো আর কিভাবে থাকি বলো?’
অত্রিয়া খিলখিলিয়ে হাসল।অসহায় মুখ করে বলল,
‘ আপনাকে দেখছি আমার আপু অনেক প্যারা দেয় ভাইয়া।আহারে!’
রক্তিম হালকা হাসল।ক্লান্তিমাখা মুখটায় দুর্বল চাহনি।অদ্রিজা এতক্ষন চুপ থাকলেও এবার বলল,
‘ আপনাকে কিছু বলার ছিল রক্তিম।’
রক্তিম মুচকি হাসল।চোখ টিপে বলল,
‘ আপনি আমায় ভালোবাসি বলবেন নাহ তো অদ্রিজা?আপনার হাবভাব ভালো ঠেকছে না আমার কাছে।’
অদ্রিজা চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল।অত্রিয়াকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বলতেই সে সরে গেল।অদ্রিজা এবার রক্তিমের দিকে কড়া নজরে তাকাল।বলল,
‘ আপনি দিহানের চোখে আমাকে খারাপ করে দিয়েছেন রক্তিম।সবটাই আপনার জন্য।শুরু থেকে শেষ।আপনি যে ওর এক্সিডেন্টের জন্য দায়ী নন আমায় বলেন নি কেন রক্তিম?’
অদ্রিজার কথাগুলো শুনেই হাসল রক্তিম।হাসিটা তাচ্ছিল্যের। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ আমার বলার কি কোন দরকার ছিল অদ্রিজা?’
অদ্রিজা ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়েই বলল,
‘ নেই?’
রক্তিম গম্ভীর গলায় শুধাল,
‘ নাহ।’
অদ্রিজা থমকে গেল।কি বলবে বুঝে না উঠেই চুপ করে রইল।রক্তিমের দিকে নিরব চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখেই রক্তিম হাসল।বলল,
‘ এই কথাটা বলার জন্য আমায় ডেকেছেন এখানে?আর কিছু বলবেন কি? আমায় যেতে হবে অদ্রিজা।’
অদ্রিজার চোখমুখে অন্ধকার নামল দ্রুত।অস্পষ্ট গলায় বলল,
‘ আপনার সাথে আমার অনেক ইম্পোর্টেন্ট কথা আছে।এখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।’
রক্তিম বোধ হয় বিরক্ত হলো।অদ্রিজার পাশে বসে পড়েই মাথাটা হাতজোড়া দিয়ে চেপে ধরল।চুলগুলো হাত দিয়ে বুলিয়ে পেঁছনে ঠেলে দিয়েই বলে উঠল,
‘ জলদি বলুন। আমি এখানে থাকার মতো সময় কিংবা ধৈর্য্য কোনটাই নিয়ে আসিনি।’
অদ্রিজা বিরক্তে ছটফট করে কঠিন গলায় বলল,
‘ আপনি অনেক খারাপ রক্তিম।পৃথিবীর সবথেকে খারাপ।আপনি চাইলে আমায় বলতে পারতেন সবটা।বলেননি। আপনার কোন মেয়ের সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল না।তাও আপনি বলেছেন মেয়েদের শরীর ছাড়া আপনি কিছুই বুঝেন না।কেন?আমার সামনে নিজেকে খারাপ প্রমাণ করার এই প্রতিযোগীতা কেন রক্তিম?কেন?’
‘ প্রমাণ করা?যে খারাপ তাকে খারাপ প্রমাণ করা লাগে নাকি অদ্রিজা?’
‘ মিথ্যে। আপনি খারাপ নন রক্তিম।আমার সামনে খারাপ হয়ে আছেন কেন?কেন খারাপ সাঁজছেন আমার সামনে?উত্তর দিন আমায়।’
রক্তিম এবার কড়া চাহনিতে তাকাল অদ্রিজার দিকে।উঠে দাঁড়িয়েই ঘড়িতে সময় দেখে তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,
‘ ডিসগাস্টিং!বারবার একই কথা বলছেন কেন আপনি?অদ্ভুত!আমি খারাপ তা আপনার কাছে কেন প্রমাণ করব আমি?কি লাভ? এসব ফালতু কথা বলার জন্য ডেকেছেনই বা কেন?আপনার কোন ধারণা আছে কতটা মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি আমি।আপনি বাচ্চা নন।ষোল বছরের কিশোরীও নন যে কারণে অকারণে ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে দেখা করতে চাইবেন,আবদার করবেন। আমি আপনাকে আগেও বলেছি, প্লিজ আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করবেন না অদ্রিজা।আমায় নিয়ে কোন ভালো ধারণা রাখবেন না।নিঃস্ব হয়ে যাবেন আপনি।আপনার মন এবং মস্তিষ্ককে এটাই বুঝানো ভালো হবে যে, আপনার ভেতর আমাকে নিয়ে জম্মানে সদ্য অনুভূতিটা ভালোবাসা নয়।শুধুই ভালো লাগা অথবা সাময়িক দুর্বলতা।সত্যি বলতে এটা কি জানেন অদ্রিজা?সহানুুভূতি।শুধুই সহানুভূতি।আপনি যখনই জানলেন রক্তিমের জীবনটা এতটা নিঃস্ব, একা, কষ্টের তখনই আপনার ভেতর শুধু এটুকু সহানুভূতি জম্মেছে।এছাড়া কিছু নয়।আপনি সেটাকে অন্যকিছু ভেবে আমি নামক যুবককে কাছে টানবেন না।’
অদ্রিজা হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইল রক্তিমের দিকে।হঠাৎ তার এই রূপ বোধগম্য হতে সময় লাগল কিছুটা।সঙ্গে সঙ্গে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল পানি।বিধ্বস্ত চেহারায় ফুটে উঠল এক ভেঙ্গে পড়া নারীর অবয়ব।রক্তিমের শার্ট খামচে ধরেই জড়ানো কন্ঠে বলল,
‘ না রক্তিম।সহানুভূতি নয়।আমি আপনাকে ভালোবাসি রক্তিম।আপনার সাথেই পুরোটা জীবন কাঁটাতে চাই আমি।’
রক্তিম ক্ষ্রিপ্ত চাহনিতে তাকাল।দুই হাত দিয়ে তীব্রবেগে ছাড়িয়ে নিল অদ্রিজার হাতজোড়া।অদ্রিজার কান্নামাখা চাহনি, বিধ্বস্ত চেহারা কোনকিছুই যেন তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না।অদ্রিজার ঠোঁটজোড়ায় তর্জনি আঙ্গুল রেখেই দাঁতে দাঁত চেপেই বলে উঠল,
‘ জাস্ট শাট আপ অদ্রিজা।মিথ্যে বলবেন না আপনি।আমি আপনাকে মিথ্যুক রূপে দেখতে চাই না। আর শুনে রাখুন?আজকের পর আমাদের আরও কয়েকটা দিন একসাথে কাঁটাতে হবে।একমাস পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত।এই কয়দিনে কখনো আপনি আমার কাছে এসব সহানুভূতি দেখাবেন না।আপনার প্রেমিকের সাথে আপনার বিচ্ছেদ ঘটতেই পারে তা বলেই আমায় সহানুভূতি দেখিয়ে ভালোবাসি বলবেন। আমি মেনে নিব না।মাইন্ড ইট!’
অদ্রিজা এবারও হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে সেভাবেই তাকিয়ে রইল।অগোছাল চুল গুলো মুখের মধ্যে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।কান্নামাখা চোখজোড়া ফুলে উঠতেই ধপ করে বসে পড়ল মাঠের ইট সিমেন্টেরর বসার জায়গায়টায়।সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এল অত্রিয়া।দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখেছিল।রাগ, অভিমান ভেবে এগিয়ে আসেনি।কিন্তু বোনের এরূপ অবস্থা দেখে এবার নিজের ভেতরই কষ্ট হচ্ছে তার।দৌড়ে এসে দুই হাত দিয়ে অদ্রিজাকে আগলে নিতে নিতেই বলল,
‘ আপু?কি হয়েছে আপু।আমায় বল।’
#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_১৭
লেখনীতেঃভূমি
এক সপ্তাহ পেরিয়ে আরো দুই তিনদিন হলো।অদ্রিজা তবুও রক্তিমের বাসায় ফিরেনি।রক্তিম নামক মানুষটার আশপাশে তো থাকা দূর তার সামনাসামনি হওয়াটা ও যেন ভীষণ রকম অন্যায় কাজ তার জন্য।সেইদিনের পর রক্তিমের প্রতি জম্মেছে ঘৃণা, ক্ষোভ।যে ঘৃণা আর ক্ষোভে আত্নসম্মানের সেই অপমান স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে।দৃষ্টি হয়ে উঠে ক্ষ্রিপ্ত।অদ্রিজা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।মাসটা ফেরুলে হয়তো সত্যিই রক্তিমের সাথে আর কোন সম্পর্ক থাকবে না তার।তবুও কেন ঐ মানুষটাই?কেন ঐ মানুষটাকে নিয়েই রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা?ভাবনায় কেবল ঐ মানুষটাই কেন?নিজের মনকে নিজেরই বিরক্ত লাগছে তার।মনের ভেতর রক্তিমের উপস্থিতি বড্ড জঘন্য ঠেকছে। বিরক্ত নিয়ে কপাল কুচকাল সে।সকালের মৃদু ঠান্ডায় শরীরের উপর থাকা পাতলা কাঁথাটা সরিয়েই উঠে বসল সে।জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিতেই বদ্ধ ঘরে এসে ঠেকল এক পালি রোদ আসতেই বিরক্তিটা উবে গেল। আনমনেই হাসল সে।জানালাটা মেলে দিয়েই অগোছাল চুলগুলো দুইহাত দিয়ে খোঁপা করল।কিন্তু চুলগুলো মানল না।গোছাল হলো না।অবাধ্য তরুণীর মতো আবারও গড়িয়ে পড়ল মুখে চুখে।অদ্রিজা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো।কিন্তু বিরক্তিটা বেশিক্ষন টিকল না।সামনে ফুটে উঠল অত্রিয়ার হাসিখুশি তুলতুলে ফুলকো মুখটা।হাতে চায়ের ট্রে। দুই কাপ লেবু চা।সেখান থেকেই এক কাপ অদ্রিজার দিকে এগিয়েই বলে উঠল,
‘ গুড মর্নিং আপু।বেশ লম্বা ঘুম দিলি তুই।’
অদ্রিজা মৃদু হাসল।চায়ের কাপটা হাতে নিয়েই চুমুক দিল।হালকা গরম লেবু চা টা মুখে নিয়েই মিষ্টি হাসল। বোনের দিকে তাকিয়েই মিষ্টি হেসে বলল,
‘ বাহ রে অত্রি!তুই তো বেশ ভালো চা বানাতে শিখে গেছিস।আগে কিন্তু পারতি না।’
অত্রিয়া খিলখিলিয়ে হাসল।দুই বেনুনি করা তরুণি মেয়েটির মুখে চাঞ্চল্যমাখা হাসিটা দেখেই মুগ্ধ হলো অদ্রিজা।বয়সে তার থেকে চার কি সাড়ে চার বছরের ছোট অত্রিয়া।রূপের দিক থেকে তার থেকেও অত্যাধিক রূপবতী এই মেয়েটা। দেখতে পিচ্চি পিচ্চি এই মেয়েটার ও বাবাকে মনে পরে।বাবার কথা মনে করে নিশ্চয় তার ও মন খারাপ হয়? কান্না পায়?যেমনটা অদ্রিজার হয়।অদ্রিজা আনমনেই বলল,
‘ আজ বাবা থাকলে তোর হাতের চা খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যেত অত্রি।’
অত্রিয়ার হাসিমুখটা মুহৃর্তেই যেন চুপসে গেল।ভাবলেশহীন চাহনি নিয়ে তাকাল অদ্রিজার দিকে।কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই ফ্যালফ্যাল চাহনিতে তাকিয়ে রইল সে। বলল,
‘ আব্বুকে অনেক মনে পরে আপু।তোর মন খারাপ হয় আপু?আমার ভীষণ রকম মন খারাপ হয়। ভীষণ মিস করি আমি আব্বুকে।সেই দিনগুলোকে।’
অদ্রিজা তপ্তশ্বাস ফেলল।চায়ের কাপটা টেবিলের পাশে রেখেই কপালে আসা চুলগুলো কানে গুঁজল।মৃদু গলায় বলল,
‘ মন খারাপ করছিস কেন?আব্বু আছে কোথাও না কোথাও।দেখছে আমাদের। আমি জানি।’
অত্রিয়া বোকা বোকা চাহনিতে তাকিয়েই বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করল,
‘ সত্যিই?’
অদ্রিজা আনমনেই শুধাল,
‘ জানা নেই অত্রি।তবে আমি অনুভব করি।’
অত্রিয়া হালকা শ্বাস ফেলল।দুই এক মিনিট নিরবতার পরই অদ্রিজা প্রসঙ্গ বদলাতেই বলল,
‘ তোর শ্যামপুরুষ বোধ হয় আজ পরশু আমাদের বাসায় আসবে।তুই কি জানিস?’
অত্রিয়া কপাল কুঁচকে তাকাল।অদ্রিজার কথার অর্থ না বুঝেই ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,
‘ মানে?’
অদ্রিজা মুচকি হাসল।বলল,
‘ তোর ক্লাস নাইনে দেখা সেই ছেলেটা?সে।’
অত্রিয়া মিনমিনে চাহনি নিয়ে তাকাল।সঙ্গে সঙ্গেই আকাশভাঙ্গা লজ্জ্বায় নুঁইয়ে পড়ল তার মুখ।অদ্রিজা মৃদু হেসেই বলল,
‘ রাইমা আপুও আসবে। পরশু সবাই আসবে।সেই হিসেবে ঐ ভদ্রলোকের আসারও চান্স আছে বল।যেহেতু চাচুর পরিবারের বিশেষ আত্নীয় কেউ , আম্মু নিশ্চয় তাকেও ইনভাইট করবে।তবে আপসোস!আমরা দুই বোন আজও সে কে এটাই জানলাম না।মুখ ফুটে কোনদিন জিজ্ঞেসই করা হলো না চাচুকে। ‘
অত্রিয়া কপাল চাপডিয়ে বলল,
‘ হু হু!জিজ্ঞেস করবি কেমনে? নিজের বেলায় তো ঠিকই চাচুরে দিয়ে বিয়ে টিয়ে ঠিক করে বিয়ে করে ফেললি এক সপ্তাহের মধ্যে।আমার বেলায় আজ দুই বছরেও ঐ ছেলেটার পরিচয় এনে দিলি না।’
অদ্রিজা হেসে উঠল।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘন্টার কাঁটাটা এগারোর ঘরে দেখে চকচক করে উঠল তার চোখজোড়া।এতক্ষন ঘুমিয়েছে সে?বিশ্বাস হলো না।অবিশ্বাসী চাহনি নিয়েই প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ ঘড়ির সময় ঠিক?আমি এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম?আম্মু ডাকল না যে?’
অত্রিয়া আরাম করে হাসল।মুখে বেশ একটা হাসি নিয়েই বলল,
‘ অবশ্যই ঠিকাছে।তুই রাত জেগে জামাইয়ের কথা চিন্তা করলে সকাল সকাল উঠবি আর কি করে বল? কাল রাতে তো কি যেন বিড়বিড় করে বলছিলি, ” রক্তিম আপনাকে ঘৃণা করি।” আরো কি কি যেন বলছিলি।বুঝা যাচ্ছিল না।তোদের বিষয়টা কি বলতো আপু।সেদিন জিজুও তোর সাথে অনেক রুড ব্যবহার করেছে।তুই আমায় কারণটা বললি না আপু।’
অদ্রিজা চাপা হাসল।প্রসঙ্গ বদলাতে দ্রুত বলল,
‘ ধুরররর!কোন কারণ নেই।’
.
রেস্টুরেন্টের কর্নারে একটা টেবিলে চেয়ার টেনে বসে আছে রক্তিম।দিহানের সাথে দেখা করার জন্যই এত উদ্গ্রিব হয়ে বসে থাকা।দিহানকে যে সময় দেখা করতে বলেছে তারও আরও দশ মিনিট আগে এসে উপস্থিত হলো রক্তিম। আনমনে ভাবল, জীবনটা তার এমন কেন?কেমন ছন্নছাড়া!এই জীবনে কেউ একজন সঙ্গী হলে খারাপ নয়।জীবনসঙ্গীর প্রসঙ্গেই মনে পড়ল অদ্রিজা নামক রমণীটির কথা।যার তীব্র কষ্টেও সে গলেনি।যার হতবিহ্বল চাহনি, বিধ্বস্ত চাহনিতেও সে চোখতুলে তাকায়নি।বুঝার চেষ্টা করেনি সেই টানাটানা চোখের ভাষা,কষ্ট,যন্ত্রনা।সত্যিই কি অনেক বেশি ভালবাসে অদ্রিজা তাকে?সেই ভালোবাসাকে মেনে নিয়ে অদ্রিজাকে ভালোবাসা কি তার উচিত?মুহুর্তেই আবার তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল রক্তিম।ভালোবাসা শব্দটায় তীব্র ঘৃণায় ভরে উঠল মন।আর ভালোবাসার মানুষ? মানুষ বদলাতে আর কয় সেকেন্ড লাগে?তার বাবা মায়েরও তো বিয়েটা ভালোবেসেই হয়েছিল।পালিয়ে বিয়ে করেছিল।তবুও কি টিকেছিল তার বাবা মায়ের ভালোবাসাটা?না টেকেনি।অর্থ, প্রাচুর্যতার লোভে অন্য একজনের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল তার মা।আর সেখানে অদ্রিজা?অদ্রিজা তো এমনিতেই টাকার জন্য করেছিল বিয়েটা।দ্বিতীয়বার যে তাকে তার মায়ের মতোই ঠকিয়ে চলে যাবে না কি এমন নিশ্চয়তা আছে? রক্তিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল।রেস্টুরেন্টে চিকন, লম্বা, চেইক শার্ট পরিহিত দিহান নামক ছেলেটিকে প্রবেশ করতে দেখেই মুখে চমৎকার হাসি ফুটাল। চোখজোড়ার তীক্ষ্ণ চাহনি নিয়ে দিহানের দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝেই সামনে এসে দাঁড়াল দিহান। মুখে মৃদু হাসি। সামনের চেয়ারটায় বসেই মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ বলুন, কেন ডেকেছেন মিঃ রক্তিম।’
রক্তিম হাসল।বলল,
‘ এজ এ ব্রাদার একটা কাজ করতে পারবে দিহান?তুমি করেই বললাম বলে আবার মাইন্ড করো না।’
দিহান মাথা নাড়িয়েই বলল,
‘ না, মাইন্ড করব কেন। আর দ্বিতীয় কথা হলো, আপনি সেইদিন আমার অপারেশনে পুরো টাকাটা পে করেছেন। আজ এই যে আপনার সামনে বসে কথা বলছি এটার পেঁছনেও আপনার অবদান যথেষ্ট।আপনি যখন ভাই হিসেবে কিছু করতে বলছেন, অবশ্যই করার চেষ্টা করব। আপনার করা সাহায্যের ঋণ শোধ করা হয়তো যাবে না তবে আপনাকে হেল্প করতে পারলে সত্যিই খুশি হবো আমি।’
রক্তিম মুচকি হাসল ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ সত্যি বলছো তো?’
দিহান মৃদু হাসল।মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়েই বলল,
‘ অবশ্যই সত্যি বলছি।এবার বলুন কি করতে হবে।’
রক্তিম নিঃশব্দে হেসে বলল,
‘ অদ্রিজাকে ভালোবেসে আগলে রাখকে পারবে দিহান?ওর জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখগুলো যাতে ওর অনুভূত না হয় ঠিক সেভাবেই ভালোবেসে সুখ দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারবে?ভালোবাসো তো অদ্রিজাকে। পারবে না?’
দিহান চমকে উঠল রক্তিমের কথা শুনে।হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে রক্তিমের দিকে তাকিয়েই রইল।কি বলবে বোধগম্য হলো না।বলার মতো কিছু খুঁজে ও পেল না।রক্তিমের দিকে ভাবলেশহীন ভাবে সেভাবেই তাকিয়ে রইল সে।রক্তিমের মুখে অদ্ভুত হাসি।ভ্রু নাচিয়ে আবারও বলল রক্তিম,
‘ কি হলো?পারবে না?যাকে দুদিন আগ পর্যন্ত এতটা ভালোবাসতে, এবং ভালোবাসোও। দুদিনেই ভুলে গেলে তাকে দিহান?সে বিবাহিত জেনেই তার প্রতি ভালোবাসাটা নিভে গেল?’
দিহান কাঁটকাঁট চাহনিতে তাকিয়ে রইল।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়েই প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ মানে!কিসব বলছেন? আপনি জানেন কি বলছেন আপনি!’
রক্তিম নিঃশব্দে তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।চোখে হাসির তেজ ফুটিয়ে বলল,
‘ কেন? অদ্ভুত লাগছে?অদ্ভুত লাগলেও কিছু করার নেই।বলো অদ্রিজাকে আগলে রাখবে?’
দিহান দৃঢ় গলায় বলে উঠল,
‘ না,তাকে আগলে রাখার মানুষ আছে এখন। আপনি আছেন তো রক্তিম মাহমুদ।’
‘ ধরো আমি নেই।আমি থাকলাম না।দুইদিন পর তুমি আর অদ্রিজার মাঝখানে আমি থাকলাম না।থাকব ও না। তবুও আপন করে নিবে না অদ্রিজাকে?’
দিহান চমকে গেল রক্তিমের ঠান্ডা গলায় বলা কথাগুলো শুনে।কিন্তু এবারও ঠিক ততটায় দৃঢ় গলায় উত্তর দিল,
‘ নাহ।আপনি অন্য কিছু করতে বললে আমি নির্দ্বিধায় করে ফেলতাম কাজটা মিস্টার মাহমুদ।কিন্তু এই কাজটা করতে পারব না।সম্ভব নয়।আর কিছু বলবেন? ‘
রক্তিম তাচ্ছিল্যমাখা হেসেই বলল,
‘ ভালোবাসা শেষ হয়ে গেল দিহান?প্রেমিকা এখন অন্য কারোর জেনেই ভালোবাসার অবসান ঘটে গেল?শুধু পেয়ে গেলেই যে ভালোবাসা কে বলল?না পাওয়ার মাঝে কি ভালোবাসা থাকতে পারে না দিহান?কেন ভালোবাসা কমে গেল অদ্রিজার প্রতি?তার শরীরে অন্য পুরুষের ছোঁয়া লেগেছে বলেই কি আবার আপন করতে পারবে না তাকে?এটাই কারণ? এটাই তোমার ভালোবাসা?হাস্যকর!’
দিহান চমকে গেল।রক্তিমের বলা কথাগুলো যেন ভেতরে দমবন্ধ এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করল মুহুর্তেই।সত্যিই কি অদ্রিজাকে এই কারণে সে আপন করতে পারবে না?চোখ বন্ধ করে নিল দিহান।লম্বা শ্বাস নিয়েই তপ্তশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমি দ্রিজাকে এখনও ভালোবাসি মিস্টার মাহমুদ।ওর প্রতি প্রথম থেকে যে অনুভূতিটা আমার ছিল সেই অনুভূতিটা আজও আছে।কিন্তু দ্রিজা?সে আমায় কোনদিন ভালোবাসে নি।সে এখন আপনার স্ত্রী দিহান। আমি তাকে আপন করতে পারব না।সম্ভব নয়।তার কারণটা আপনি যাই ধরুন।’
রক্তিম মুচকি হাসল। বলল,
‘ নিজের ভালোবাসার মানুষকে কষ্টে জ্বলেপুড়ে শেষ হতে দেখতে পারবে তুমি?কেন আগলে নেবে না তাকে?বললাম তো আমি থাকব না।তোমাদের মাঝখানে তৃতীয় কোন ব্যাক্তি থাকবে না দিহান।’
দিহান চুপ রইল।রক্তিম আবার ও বলল,
‘ তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছাকে আমি মূল্য দিচ্ছি না দিহান।দিব ও না।রক্তিম সবসময় নিজেরটাই বুঝতে শিখেছে।তুমি না চাইলেও অদ্রিজাকে তোমায় আগলে নিতে হবে।অদ্রিজার পাশে থাকতে হবে।এবার নিজেকে প্রিপেয়ার করাটা তোমার ব্যাপার।বাট এটাই হবে।’
কথাটা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল রক্তিম।ব্লেইজারের কলারটা ঝেড়ে নিয়েই মুচকি হাসল।পা বাড়িয়ে বেরিয়ে আসল সেখান থেকে।হৃদয় ভরা তপ্তশ্বাসে বিষিয়ে উঠল ভেতরটা। বুকটা ভারী হয়ে উঠছে ক্রমশ।আজ ড্রিংক না করলেই নয়।নিজের এই পাহাড় সমান বিষাদটাকে যে কমাতে হবে।নয়তো নিঃশ্বাস নেওয়া যে কঠিন হয়ে ঠেকছে তার জন্য।অদ্ভুত ভিন্ন যন্ত্রনায় ভেতরটা পিষে যাচ্ছে কালো অন্ধকারে।সেই অন্ধকার কালো হৃদয়ের কথা বোধ হয় আজও কেউ বুঝতে সক্ষম হয় নি।হবে না।
#চলবে….
[