#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_২৬
লেখনীতেঃ ভূমি
তখন গ্রীষ্মকালের পুরো দাপট।মাথার উপর সূর্যটা তীর্যকভাবে আলো ফেলছে।রোদের উত্তাপে পুরো শরীর ঘেমে চুপসে গেল কয়েক মুহুর্তেই।পরনের জামাটা সেই ঘামে লেপ্টে গেল শরীরে।অদ্রিজা ক্লান্ত শরীর নিয়ে কপালে হাত দিয়ে উপরের দিকে চাইল।দুপুরের সতেজ রোদে ক্লান্ত শরীরে আরো ক্লান্তি বোধ হলো তার।চারপাশে একনজর তাকিয়েই নেহাকে না দেখে ধীর পায়ে পা ফেলল ।অন্যদিন ভার্সিটি ফেরার পথে নেহাই সাথে থাকে।অত্রিয়া আর নেহা এই দুইজন পাশে থাকলে আর কিছু লাগে না। সবসময় আগলে রাখে তাকে।তাদের যত্ন নেওয়াও কমেনি এই কয়দিনে বরং বেড়েছে।সে দুইজনের কেউ একজন সাথে থাকলেও বোধহয় শরীরের এই ক্লান্তিটা তার বোধ হতো না।কিন্তু এখন হচ্ছে।পা জোড়া এগোতে মন চাইছে না।তবুও এগোতে হলো।জোর করে নিজের শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে রাস্তার মোড় পর্যন্ত গিয়েই ল্যাম্পপোস্টের পাশে দাঁড়াল সে।ভরদুপুরে রাস্তায় একটাও খালি রিক্সা না দেখে লম্বাশ্বাস ফেলল।কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করার পর কোন রিক্সা না পেলেও তার ক্লান্ত ভারী শরীরটার সামনে এসে দাঁড়াল বেশ চকচকে কালো রংয়ের একটা গাড়ি।আকস্মিক কারটা নিজের সামনে আসাতে বিস্ময় নিয়ে তাকাল অদ্রিজা।বার কয়েক জোরে জোরে শ্বাস ফেলে ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে তাকাতেই গাড়ির গ্লাস নামল।তৎক্ষনাৎ গাড়ির ভেতর থেকে যে মুখটা ভেসে আসল সেই মুখটা দেখার জন্য যেন একেবারেই প্রস্তুত ছিল না অদ্রিজা।না চাইতেও লোকটার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল অদ্রিজা।বেশ অনেকদিন পর এই লোকটাকে দেখছে সে।মাস খানেক আগে কোন এক রাতে সেই কল করা, তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে কিছু কথা বলা।ব্যাস!তারপর তো আর কথা হয় নি।তারপর আর কল আসেনি। তারপর আর মিস করছে বলে কোন আবেদনও জানায়নি সেই মানুষটা।অদ্রিজা হতাশ হলো।মিনমিনে চোখে রক্তিমের ভারী চাহনির দিকে তাকাল।মুহুর্তেই রক্তিম চোখ টিপল।মুখে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি। অদ্রিজা ফুঁসে উঠল।গা জ্বালানো রাগটা এবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শরীর মন উভয়েই।রক্তিমের থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে গেল।তাতে অবশ্য বিশেষ লাভ হলো না।রক্তিম গাড়িটা এগিয়ে আবারও অদ্রিজার সামনে রাখল।মুচকি হেসেই বলে উঠল,
‘ লাভ নেই।এই উত্তপ্ত দুপুরে রিক্সা পাবেন না।তার থেকে ভালো আপনাকে একটা সীমিত আকারে অফার দেওয়া হচ্ছে।গাড়িতে উঠে পড়ুন।ফ্রী তে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব।’
অদ্রিজা চরম বিরক্ত হলো।সেই বিরক্তের রেশ স্পষ্ট ফুটে উঠল তার চোখেমুখে।শক্ত গলায় বলে উঠল,
‘ লাগবে না।’
রক্তিম বাঁকা হাসল।ঠোঁট চেপেই বলল,
‘ লাগবে।আপনার জন্য না হলেও আমার বেবির জন্য লাগবে।উঠুন দ্রুত।’
অদ্রিজা দাঁতে দাঁত চেপে তাকাল।চমৎকার!কত সহজেই এখন “আমার বেবি” বলছে।যে কিনা সন্তানের নিশ্চয়তার সংবাদ শুনেই পালিয়েছিল সেই হঠাৎ একমাস পর এসে কত নির্দ্বিধায় সন্তানের অধিকার দেখাচ্ছে।অদ্রিজা বাহবা দিয়েই বলে উঠল,
‘ বাহ!আপনাকে না দেখলে জানতামই না একজন সন্তানের আদর্শ বাবা কেমন হতে পারে!’
রক্তিম হালকা হাসল।গাড়ি থেকে নেমে পড়েই অদ্রিজার সামনাসামনি দাঁড়াল।বুকে হাত জোড়া গুঁজে নিয়েই বলল,
‘ জানলেন যখন গাড়িতে উঠে পড়ুন।নয়তো মুখ,হাত পা বেঁধে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাব বলে দিলাম।’
অদ্রিজার বিরক্তির পরিমাণ সময়ের সাথে বাড়তে লাগল পাল্লা দিয়ে। সামনের রক্তিম নামক মানুষটার প্রতি তীব্র বিরক্তি নিয়েই কপাল কুঁচকে বলল সে,
‘ কি সমস্যা আপনার?’
রক্তিম ভ্রু বাঁকিয়ে চাইল।অদ্রিজার দিকে ঝুঁকেই কানের সামনে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
‘ একমাস আগে সে রাতে বলেছিলাম তো, যদি আবার দেখা হয় তাহলে সুদে আসলে সবটা ফিরিয়ে দিব।সবটাই!যতটা যন্ত্রনা আমি পেয়েছি, যতটা কষ্ট পেয়েছি, ছটফট করে মরেছি ঠিক সেভাবে সবটুকু আপনাকে ফেরত দিব।ছারখার করে দিব আপনার জীবন।নাও রেডি ফর দিজ অদ্রিজা’
‘ ছারখার?ছারখার করতে বাকি কি রেখেছেন? যার জীবন একবার তছনছ করেই দিয়েছেন তাকে আর নতুন করে আর কি ছারখার করবেন ? ‘
রক্তিম হেসে উঠল। ফিসফিসিয়ে আবারও বলল,
‘ ধরুন ভিন্ন উপায়ে আপনাকে শেষ করব। এন্ড ইউ নো হোয়াট?এবারও আমার প্ল্যানটা চমৎকাররূপে আপনার উপর কাজ করবে। মিলিয়ে নিবেন।’
অদ্রিজা দ্বিধান্বিত চাহনিতে তাকিয়েই বলল,
‘মানে?’
‘ কিছু না।গাড়িতে উঠবেন কি উঠবেন না?এই উত্তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে থেকে ঘেমে একাকার হয়ে আমার লিটল কিডের কিছু হলে আপনি রেহাই পাবেন না।’
অদ্রিজা জ্বলে উঠল তৎক্ষনাৎ।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ জাস্ট ইরিটেটিং! ও আমার সন্তান। আমার!তার ভালো খারাপ আমি জানি, বুঝি।আপনার থেকেও ভালো বুঝি।পথ ছাড়ুন।আমাকে যেতে হবে।’
রক্তিম পথ ছাড়ল না।সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল অদ্রিজার সামনে।অদ্রিজা চোখেমুখে তীব্র বিরক্তি নিয়ে কয়েক সেকেন্ড রক্তিমের দিকে তাকিয়েই পাশ কাঁটিয়ে চলে যেতে লাগলেই রক্তিম আবারও তার পথ আগলে দাঁড়াল।মুখে চোখে তখন তার তীব্র রাগ দৃশ্যমান হলো।অদ্রিজার ডান হাতটা নিজের হাতে চেপে ধরেই বলে উঠল,
‘আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার সাহস কি করে হয় আপনার?কি করে?প্রত্যেকবার ছাড়া পেয়ে যাবেন ভাবছেন?একমাস আগে আমি আপনার থেকে অনেক দূরে ছিলাম বলে আমার চাওয়া প্রত্যাহার করাতেও আমি আপনাকে কিছু বলিনি।চাইলে আমি আপনাকে লোক দিয়ে ধরে বেঁধে রেখে ভিডিও কলে আপনার মুখটা দেখে নিতেই পারতাম। করিনি।কিন্তু এখন করব।লাস্টবার বলছি যাবেন কি যাবেন না?’
অদ্রিজা নরম হলো না।রক্তিমের কড়া কন্ঠে বলা কথাগুলোতে এটুকুও ভয় পাওয়া চাহনি দেখাল না।আগের মতোই শক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ যাব না।হাত ছাড়ুন এবার।’
রক্তিম ছাড়ল না হাতটা।বরং আরো জোরে চেপে ধরল হাতটা।নরম তুলতুলে হাতটা মুহুর্তেই ব্যাথায় তড়তড় করে উঠল অদ্রিজার।সেই ব্যাথার দাপটেই অদ্রিজার মুখচোখের চাহনির পরিবর্তন ঘটল দ্রুত । রক্তিম হাসল।হাতটা ছেড়ে দিয়ে দুইহাত দিয়ে কোলে তুলে নিল অদ্রিজাকে।আকস্মিক কোলে তুলে নেওয়াতে প্রথম দুয়েক সেকেন্ড বুঝে না উঠলেও পরমুহুর্তেই হাত পা ছুড়ল অদ্রিজা।নিজেকে রক্তিমের বাহুডোর থেকে ছাড়ানোর বিস্তর চেষ্টা চালিয়েও লাভ হলো না তার।রক্তিম তাকে কোল থেকে নামাল না।দাঁতে দাঁত চেপেই বলে উঠল সে,
‘ আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে কোলে তুলার?নামান। নিমিয়ে দিন আমায় রক্তিম।নয়তো ভালো হবে না।’
রক্তিম বাঁকা হাসল। সেই হাসিটা দেখে গা জ্বালা করল অদ্রিজার।তীব্র রাগ নিয়ে হাত পা ছুড়েই তীব্র গলায় বলল,
‘ নামিয়ে দিন রক্তিম।ভালো হবে না।’
রক্তিম ভ্রু নাচিয়েই বলল,
‘ তাই নাকি?তো কি করবেন? কি করবেন আমার? ‘
‘ মে*রে ফেলব।খু*ন করে ফেলব। আপনার মতে অসহ্যকর একটা লোককে।বিরক্ত লাগে আমার আপনাকে।চরম বিরক্ত!’
রক্তিম দাঁত কেলিয়ে হাসল।পা বাড়িয়ে গাড়ির সামনে এসেই কোল থেকে নামিয়ে গাড়ির ভেতর বসিয়ে দিল অদ্রিজাকে। নিজেও উঠে পড়ে অদ্রিজার সিট বেল্ট বেঁধে দিয়েই অদ্রিজার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ কবেই খু*ন হয়েছি আমি আপনার হাতে।খু*ন হওয়া মানুষকে আরো খু*ন করতে চান বুঝি?’
অদ্রিজা কিছু বলল না।থমথমে মুখচোখ নিয়ে বাইরের রাস্তায় তাকিয়ে রইল।রক্তিম নামক মানুষটার প্রতি রাগ, ক্ষোভ তড়তড় করে বাড়ল সময়ের সাথে।বিরক্তিতে মুখচোখে ফুটে উঠল তিক্ত এক চাহনি।
.
অত্রিয়া কলেজ শেষে বাড়ির পথে ফিরতেই চোখে পড়ল সেই শ্যামপুরুষের মুখ।তীব্র ব্যস্ততা নিয়ে রাস্তা পার হয়েই গাড়িতে উঠল সে।ব্যস্ত নগরীর রাস্তায় তখন ভীষণ ভীড়।একের পর এক গাড়ি সেভাবেই স্থির হয়ে রইল রাস্তায়।মিনিট পনেরো সেই জ্যামের মাঝে আটকে পড়েই অতিষ্ঠ হয়ে উঠল অত্রিয়া।রিক্সায় বসে এদিক ওদিক তাকাতেই কিছুটা সামনে চোখে পড়ল সেই লোকটিকে।অত্রিয়া মুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে রইল।পরমুহুর্তেই সেই পুরুষটির প্রতি সবটা অনুভূতি কৈশোরের আবেগ ভেবেই উড়িয়ে দিল অত্রিয়া।বিরক্তি নিয়ে রিক্সা থেকে নেমে পড়েই কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়াল ।কপাল কুঁচকে রিক্সাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করেই বলল,
‘ জ্যাম কখন ছাড়বে বলুন তো মামা।’
আধপাঁকা দাঁড়িওয়ালা লোকটা হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তাকাল।সামনের পিচ্চি মতো মেয়েটার প্রশ্নের সঠিক উত্তর না জেনেই হতাশ হয়ে বলল,
‘ ঐডা তো জানি না আম্মা।ছাইড়তে সময় লাগব। ‘
অত্রিয়া বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকাল।ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ আচ্ছা আপনি এখানেই থাকুন।আমি একটু হাঁটি মামা।অনেকক্ষন ধরে বসে বসে হাত পা ব্যাথা করছে আমার। ‘
লোকটা মৃদু হাসল। অত্রিয়া হাত পা নাড়িয়ে হাঁটতে লাগল।একের পর এক গাড়ি পরখ করল।রায়মানের গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েই মুখ ফুলাল।মাথা ঝুকিয়ে হালকা উঁকি দিয়ে দেখল রায়মান নেই।অত্রিয়া অবাক হলো।এই মাত্র দেখল রায়মানকে গাড়িতে উঠেছে অথচ এখন নেই?হাওয়া?
‘ এই পিচ্চি? এখানে কি করছো?কি দেখছো আমার গাড়িতে?’
অত্রিয়া আরেক ধপা অবাক হয়ে পেঁছন ফিরে চাইল।রায়মানের শ্যামলা, লম্বা চওড়া শরীরটা তার ঠিক পেছনেই দেখে মুখ কালো করল।দু পা পিছিয়েই মৃদু গলায় বলে উঠল,
‘ ওহ।এটা আপনার গাড়ি বুঝি?জানতাম না আমি।জ্যামের মাঝে বসে থেকে থেকে হাত পা অবশ হয়ে আসছিল তো তাই একটু হেঁটে হেঁটে গাড়ির ভেতর মানুষজন কিভাবে এই সময়টা কাঁটাচ্ছে দেখছিলাম।’
রায়মান ভ্রু বাঁকাল।তীক্ষ্ণ চাহনি ফেলে বলল,
‘ সত্যি?নাকি মিথ্যে বলছো?এমনিতে তো হ্যাবলার মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে প্রতিবার।কে জানে আমাকে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতে উঁকি দিচ্ছিলে কিনা।’
অত্রিয়া ফুঁসে উঠল।রায়মানের বলা কথা গুলো মিথ্যে নয় জেনেও অহেতুক রাগ দেখাল।সুচাল গলায় বলে বসল,
‘ কি এমন দেখতে আপনি?যে আমি আপনার দিকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকব?আমার বয়ফ্রেন্ডকে দেখেছেন? আপনার থেকে শতগুণ হ্যান্ডসাম সে।দেখতেও অসাম।’
‘ এইটুকু পিচ্চি মেয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছো তোমার ফ্যামিলি জানে?আন্টি জানে?জানাব?’
অত্রিয়া দাঁতে দাঁত চেপেই বলে উঠল এবার,
‘ আপনার কাজই কি মানুষের সংসার ভাঙ্গা?মানুষের ভালোবাসা সহ্য হয় না আপনার তাই না?নাকি কারো থেকে এত বড়সড় ছ্যাঁকা খেয়েছেন যে অন্য কারো ভালোবাসা দেখলেই আপনার জ্বলে উঠে।হুহ?আপুর সংসারটাও আপনার জন্য ভাঙ্গতে বসেছে।আপনার জন্য।ওদের সংসারটার আপনি ইচ্ছে করেই আজ এই দশা করেছেন।আর আজ যখন আমার প্রেমের কথা শুনলেন সাথে সাথে প্রেমকে বিচ্ছেদে পরিণত করার স্টেপ নিচ্ছেন?আসলে সমস্যাটা কি আপনার রায়মান ভাইয়া?’
রায়মান ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘ বাকি কথাগুলোয় মাইন্ড করছি না আপাদত।কিন্তু ভাইয়া?ভাইয়া বললে কেন?কোন জম্মের ভাই আমি তোমার?’
অত্রিয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলেই বলল,
‘ ভাই না আপনি আমার?আপনি চাচুর শালির ছেলে।তো?আমার আপনার সম্পর্কটা তো ভাই বোনেরই। তাই না?আপু যদি আপনার বোন হয় তো আমিও আপনার বোন।’
‘ না।’
অত্রিয়া ভ্রু কুঁচকাল।ততক্ষনে জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে।রায়মানের শক্ত দৃঢ় কন্ঠে ” না” শব্দটা শুনেও আর কিছু বলল না সে।দ্রুত পা এগিয়ে সেই রিক্সাটার কাছে গেল।তড়িঘড়ি করে রিক্সায় উঠে বসতেই রিক্সাটা চলতে শুরু করল।অত্রিয়া মুখ টিপে হাসল।মাথা ঘুরিয়ে একনজর দাঁড়িয়ে থাকা রায়মানের দিকে তাকিয়েই হাসিটা চওড়া হলো।
#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_২৭
লেখনীতেঃভূমি
রক্তিম যখন গাড়ি থামাল তখন চারদিকে অন্ধকার।রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুলো সবেমাত্র জ্বলে উঠছে। ক্লান্ত শরীরটার ক্লান্তিতে গাড়ি চালানোর মাঝে কখন যে চোখে ঘুম নামল বুঝেই উঠেনি অদ্রিজা।গাড়ি থামানো মাত্রই ঘুমটা ভাঙ্গল তার।সদ্য ঘুম ছাড়া ফোলা চোখ নিয়ে গোধুলীর আকাশে একনজর তাকিয়েই অদ্রিজার মুখচোখে তেঁতো চাহনি ফুটল।শরীরটা বড্ড বেশি ক্লান্ত অনুভব হলো।গাড়ির সিটেই চোখজোড়া বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে পারলেই যেন ডের ভালো হতো।তবুও ক্লান্ত শরীরটাকে আরো কিছুটা মানিয়ে নিয়েই গাড়ির বাইরে নজর ফেলতেই আকাশসম বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকাল।তার বাসার সামনে গাড়ি থামায়নি রক্তিম।রক্তিমের বাসার সামনে এসেই থেমেছে।চটচটে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট ফুটিয়েই অদ্রিজা বলল,
‘ এখানে?কি হলো এটা?আমি বাসায় যাব।’
রক্তিমের ভাবলেশহীন উত্তর,
‘ বাসায় ই তো এনেছি।আশ্চর্য!’
অদ্রিজার বিরক্তি ভাবটা তড়তড় করে বাড়ল।দৃষ্টি হলো সুচালো।কপালের সাদা ধবধবে ঐটুকু চামড়ায় বেশ কয়েকটা ভাজ পড়ল মুহুর্তেই। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বেশ কয়েক সেকেন্ড গম্ভীর দৃষ্টি ফেলল রক্তিমের মুখে। ছোট্ট শ্বাস ছেড়েই বলল,
‘ সমস্যা কি আপনার?এমন করছেন কেন?’
রক্তিম পাত্তা দিল না তার বিরক্তির।তার গম্ভীর দৃষ্টিটাকে এটুকুও মূল্য না দিয়ে উপেক্ষা করল চমৎকার হাসি দিয়ে। মুখের খোঁচা দাঁড়িটায় গাড়ির ছোট আয়নায় দেখতে দেখতেই হাত বুলাল।মুখে চমৎকার হাসিটা ছাপিয়ে এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে অদ্ভুত রকম হাসল।অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই সে হাসিটা আরো বাঁকিয়ে গভীর নয়নে তাকাল।সেই নজরেও মুখের বাঁকানো দুষ্টু হাসির ঝলক স্পষ্ট।ভ্রু নাচিয়েই বলে বসল,
‘ কেমন করছি অদ্রি?ওফফস!অদ্রিজা!’
অদ্রিজা ভেতরে থাকা জ্বলন্ত রাগটা দেখাতে চেয়েও থেমে গেল।শরীর বড্ড্ ক্লান্ত।এই লোকটার সাথে কথা বলে বেশ একটা লাভ হবে বলেও মনে হলো না তার। ক্লান্ত ভারী শরীরটা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েই রাস্তার একপাশে গিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়াল।চোখজোড়া ঘুমে হেলদোল করলেও জোর করে মেলে রাখল চোখজোড়া।বিচক্ষন চাহনি ফেলে কিছুটা সামনে খালি রিক্সা দেখেই ডাকতে যাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ মুখ চেপে ধরল।অদ্রিজা চমকাল না।মানুষটা কে হতে পারে তা বুঝে উঠেই ক্ষোভে বিষিয়ে গেল ছোট্ট মন।মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে তখন রাগ, ক্ষোভ টনটনে করছে।নিজের হাতজোড়া দিয়ে রক্তিমের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করেই ক্লান্ত দেহটা আরো ক্লান্ত হলো।ভারী লতানো রূপময় শরীরটা এবার এলিয়ে এল।চোখজোড়া হালকা মিনমিনে করেই রক্তিমের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো মাত্রই রক্তিম ছেড়ে দিল মুখটা।ঠোঁট টিপে মুচকি হেসেই বলে উঠল,
‘ আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন অদ্রিজা।চলুন ঘুমোবেন।’
অদ্রিজা ঘুমুঘুমো চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল রক্তিমের দিকে।হাই তুলেই বুকে হাত গুঁজে আগের মতোই দাঁড়াল।শক্ত গলায় বলল,
‘বাসায় গিয়ে ঘুমাব।’
‘ তো আমি কি আপনাকে রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়তে বলছি অদ্রিজা?চলুন বলছি।ঘুমোবেন। ‘
অদ্রিজা দাঁতে দাঁত চেপেই বলল,
‘ আমার বাসা!আই মিন আম্মুদের বাসা।আপনার বাসায় নয়।গট ইট?’
রক্তিম কপাল প্রসারিত করে ঠোঁট চওড়া করল। আঙ্গুল দিয়ে ভ্রু চুলকাতে চুলকাতেই বলে উঠল,
‘ইট’স মাই হোম।এন্ড ইউ আর মাই ওয়াইফ।সো কারেন্টলি,মাই হাউজ ইজ ইউর’স হাউজ।রাইট?’
অদ্রিজা তেঁতো চাহনি ফুটাল মুখে।রক্তিমের সাথে আর একটাও কথা না বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। কত সহজেই ওয়াইফ ক্ষেতাব দিয়ে দিয়েছে তাকে। অথচ দুইদিন আগেও এই নিয়ে কত দ্বিধা ছিল লোকটার।কেবলই পরিচিত ছিল সে।কাউকে নিজের ওয়াইফ বলে পরিচয় না দিয়ে কেবল পরিচিত কেউ বলে পরিচয় দিয়েছে।আর এখন?অদ্রিজা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।রক্তিমের দিকে তাকিয়েই বলল,
‘ হঠাৎ এই পরিবর্তন আপনার মিঃ রক্তিম?এতটা দায়িত্ব, এতটা কর্তব্য, অবাক হওয়ার মতো না?আ’ম রিয়েলি শকড!’
রক্তিম বাঁকা হাসল।চুল গুলোতে হাত বুলিয়েই বলে উঠল,
‘ ধরে নিন এর পেঁছনে বিশাল এক কারণ আছে।এখন বলুন যাবেন কি যাবেন না?সুইটহার্ট অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।’
অদ্রিজা মুখ ফুলিয়ে রক্তিমের দিকে তাকাল।শক্ত গলায় জেদ ধরে বলল,
‘ যাব না।আপনার আশেপাশে তে দূর, আপনার থেকে কিলো কিলো পথ দূরে ও থাকব না।’
‘ ফালতু জেদ ধরছেন আপনি অদ্রিজা।তখন যেভাবে জোর করে গাড়িতে উঠিয়েছি সেই স্টেপ নিতে হবে? তো সোজাসুজিই বলতে পারেন।এত বাহানা দেখাচ্ছেন কেন আমার কাছাকাছি আসার জন্য?আপনি আমাকে চান সেটা আমিও জানি আপনিও জানেন।ফালতু জেদ দেখাচ্ছেন! ‘
অদ্রিজা চোখ বড়বড় করেই চরম রাগল।ফোঁসফাঁস করেই বলে উঠল,
‘ জাস্ট এ্যা ইরিটেটিং ম্যান!আজগুবি কথা একদমই বলবেন না রক্তিম।কোন বাহানা দেখাচ্ছি না আমি।আপনার বাসায় জীবনেও আর প্রবেশ করব না আমি।’
রক্তিম বাঁকা হাসল। আকস্মিক দুই হাত দিয়ে অদ্রিজার কোমড় চেপে ধরল।কপালে কপাল ঠেঁকিয়েই বাঁকা হেসে বলল,
‘ যদি করেন?তবে?’
‘ প্রবেশ করব না যখন বলেছি তখন করব না।এটাই শেষ কথা!’
রক্তিম কপাল সরিয়ে চোখ টিপল।বাঁকা হাসিটা আগের মতোই চোখেমুখে ঝলকিয়ে বলল,
‘ আর যদি একবার প্রবেশ করেই ফেলেন তাহলে?তাহলে কিন্তু আর বের হতে পারবেন না অদ্রিজা।দরকার পড়লে পা ভে*ঙ্গে বসিয়ে রাখব বাসায়!’
অদ্রিজা অবাক হলো।বিস্ময় নিয়ে চোখ বড়বড় করে রক্তিমের দিকে তাকাল।রক্তিমের চোখেমুখে কৌতুক মাখা গা জ্বালানো হাসি।ফুস করে বড়সড় নিঃশ্বাস ফেলেই বিরক্তি নিয়ে বলল সে,
‘ যাব না।আপনি এখান থেকে গেলে ভালো লাগবে।প্লিজ আপনার বাসায় যান।’
রক্তিম এত সহজেই ছেড়ে দিল না।অদ্রিজার সোজাসাপ্টা কথায় সহজ সরল মানুষের মতো মাথা দুলিয়ে রাজি ও হলো না।বরং চোখে মুখে তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ যাবেন কি যাবেন না?লাস্টবার বলছি!’
অদ্রিজা মুখ ফুলিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,
‘ কানে শুনেন না নাকি রক্তিম?যাব না।’
ব্যাস!অদ্রিজার ঐ কথাটা শেষ করল কি না করল অপেক্ষা করল না রক্তিম। ঠিক আগের পন্থা ব্যবহার করেই আকস্মিক কোলে তুলে নিল অদ্রিজাকে।চোখেমুখে স্পষ্ট রাগ নিয়েই অদ্রিজার কোমড় চেপে নিজের বুকে মিশিয়ে নিল।অদ্রিজা অবাক হয়েই চেয়ে রইল। রক্তিমের চোখেমুখের রাগটা দেখেই শিউরে উঠল এবার।নিজের কোমল , লতিয়ে যাওয়া শরীরটা রক্তিমের বাহুডোরে রক্তিমের শরীরের সাথেই লেপ্টে আছে ভেবেই অস্বস্তিতে ভারী হয়ে উঠল মুখচোখ।নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা বিশেষ করা গেল না।দুই হাত দিয়ে বেশ শক্তভাবেই চেপে ধরে রেখেছে রক্তিম।অদ্রিজা ছাড়ানোর চেষ্টা চালাতে নিলেও নিজের সাথে একেবারে লেপ্টে মিশিয়ে নিল অদ্রিজার শরীর।দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল,
‘ চেয়েছিলেন তো এমন কিছু হোক।খুশি না হয়ে ছটফট করছেন কেন হুহ?’
‘ আমি মোটেই এমন কিছু চাইনি।’
রক্তিমের রাগে টানটান মুখে এবার হাসি ফুটল। অদ্রিজার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ উহ!বুঝি তো আমি।’
অদ্রিজা বিরক্ত হলো।অস্বস্তিতে শরীরটা ঘেমে উঠল মুহুর্তেই।রক্তিমের বুকের সাথে মাথাটা লেপ্টে থাকায় স্পষ্ট শোনা গেল রক্তিমের বুকের ধুকফুক করা শব্দ।চোখ ছোট করে রক্তিমের দিকে চেয়ে থাকতেই রক্তিম পা এগিয়ে গেইটের ভেতর ডুকল।সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় এসেই বাসার সামনে নামিয়ে দিল অদ্রিজাকে।কলিংবেল বাঁজিয়েই অদ্রিজার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ বাসায় ডুকলে কিন্তু আর বের হতে পারবেন না।রেহাই পাবেন না। মনে করিযে দিলাম জাস্ট। ‘
অদ্রিজা রাগে ফোঁসফাঁস করে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই সুইটহার্ট দরজা খুলল।মাথার সাদা চুলগুলো আজ ছেড়ে দেওয়া।পরনের সাদা শাড়িটা আজ ভিন্ন নিয়মে যুবতীদের মতো পরা।কানের কাছে একটা শুভ্র সাদা গন্ধরাজ ও গাঁথা।সাদা কুচকানো চামড়ার মিষ্টি চেহারায় সেই শুভ্র ফুলটা চমৎকার রকম মিষ্টতা যোগ করল।অদ্রিজা মিষ্টি হাসল সুইটহার্টের ভিন্ন মিষ্টি সাঁজ পর্যবেক্ষন করেই।ঠোঁট টেনে হেসেই বলে উঠল ,
‘ কেমন আছো সুইটহার্ট?’
সুইটহার্ট মিষ্টি ভাবে হাসল।অদ্রিজার গাল টেনেই বলল,
‘ একদম ভালো।তুমি?’
‘ আমিও ভালো।অনেকদিন পর দেখা তোমার সাথে।ভেবেছিলাম আর কোনদিন দেখাই হবে না তোমার সাথে।’
সুইটহার্ট হেসে বলল,
‘ ভেতরে আসো।ফ্রেস হয়ে বিশ্রাম নাও কিছুটা সময়।কিছুক্ষন পর কিন্তু আর বিশ্রাম নেওয়া যাবে না বলে দিলাম।’
অদ্রিজা অবাক হলো।বিশ্রাম নেওয়া যাবে না মানে?কেন যাবে না বিশ্রাম নেওয়া?বুঝে উঠল না।পা ফেলে বাসায় ডুকতে যাবে ঠিক তখনই সেখানে হুড়মুড় করে এসে উপস্থিত হলো দিহান।মুখেচোখের চরম ক্লান্তি নিয়েই পায়ের জুতোজোড়া খুলতে খুলতেই ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল সুইটহার্টের উদ্দেশ্যে,
‘ দাদিমা?লেট হয়ে গেল বুঝি?টিউশনিটা শেষ করতেই দেরি হয়ে গেল। ‘
সুইটহার্ট চমৎকার হাসল।দিহানের দেরি হওয়ার জন্য তিনি কিছু না বললেও অদ্রিজা চোখমুখ কুচকে বলে উঠল,
‘ দিহান তুমি?এখানে?কিসের লেট হবে?বুঝলাম না।’
দিহান হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল।হালকা হেসেই বলল,
‘ দেরি হয়নি বলছো?’
‘ আমি কি করে জানি তা।কিন্তু তুমি এখানে?কেন?’
দিহান নিরাশ হলো।চোখে মুখে হতাশ হওয়া ভাব করে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ এইখানে আজ আমার আসাটা কি খুব অনুচিত নাকি দ্রিজা?তুমি বলতে চাইছো আমার আসা উচিত হয় নি। তাই তো?’
অদ্রিজা কিছুই বুঝল না দিহানের বলা কথাগুলোর।বোকার মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকার মাঝেই রক্তিম আর দিহান ভেতরে ডুকে গেল।সে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল।সুইটহার্ট তাকে ভেতরে ডুকিয়েই এগিয়ে নিল নেহার কাছে। নেহাকে দেখেই আরেক ধাপ অবাক হলো অদ্রিজা।নেহার শরীরেও সাদা শাড়ী।তারও চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া।কানের পেছনে তারও সাদা গন্ধরাজ গোঁজা।অদ্রিজা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল।নেহার ছোট্ট শরীরে এই সাঁজটা ভীষণ মানিয়েছে। মুচকি হেসে দুইজনের এই একই সাঁজের মানে খুঁজতে লাগল অদ্রিজা।সেই খোঁজাখুঁজির মাঝেই নেহা আরো একটা সাদা শাড়ি নিয়ে এগিয়ে এল।মুচকি হেসেই বলল,
‘ এই, ঘুমোবি এখন? ঘুমোলে ঘুমিয়ে নে তাড়াতাড়ি।তোকে শাড়ি পরিয়ে রেডি করাতে হবে আবার।তাড়াতাড়ি কর।’
অদ্রিজা ড্যাবড্যাব করেই চেয়ে রইল।তখনই পেছন থেকে অত্রিয়া বলল,
‘ উহ আপু।একটু বসে বিশ্রাম নে তো।ঘুমোলে রাত কাবার হয়ে যাবে তোর।’
অদ্রিজা আরেক ধাপ অবাক হলো।অত্রিয়া যে এখানে তা তো জানা ছিল না তার।এখানে কেন সে?ঘাড় ঘুরিয়ে পেঁছন ফিরে অত্রিয়াকে দেখতেই চমকে উঠল সে।তার থেকে চমৎকার রূপবতী মেয়েটার সাদা ধবধবে শরীরেও সাদা শাড়ি।ঠিক একই সাঁজ!অদ্ভুত তো!এরা কি আজ সাদায় সাদায় শুভ্রতা ছড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছে নাকি?
#চলবে….
#চলবে…….