তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব ১৮+১৯

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_১৮
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
শিহাব হুট করেই মাটিতে বসে হাত জোর করে বললো,
“বাবু ডাকো, জান ডাকো, জামাই ডাকো তবুও প্লিজ আঙ্কেল ডেকো না।”
“আরে আমি কাকে কি ডাকবো সেটা তো আমার বিষয়।”
শিহাব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“তাই বলে আঙ্কেল ডাকবে? ভাইয়া বললেও তো একটা কথা ছিল। অন্তত সাইয়্যা হওয়ার একটা আশা থাকে।”
“এজন্যই প্রথম থেকে রাস্তাটা বন্ধ করে দিলাম। আপনার ধান্দা আমি বুঝিনি ভেবেছেন? আপনাদের মত ছেলেদের আমি হারে হারে চিনি। আজ ভালোবাসার নাটক করবেন দুইদিন পরই সেই ভালোবাসা ফুড়ুৎ!”
“বাব্বাহ্! এতকিছু জানো তুমি?”
“আরো অনেক কিছুই জানি।”
“তা কি কি জানো একটু শুনি?”
“আপনাকে বলতে আমি ইচ্ছুক নই আঙ্কেল।”
“উফফ! আবার আঙ্কেল!”
“শুনুন আঙ্কেল, আপনার এইসব সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে হুটহাট ডেকে পাঠাবেন না।”
কথাগুলো বলেই প্রিয়া গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। শিহাবের বন্ধুরা সব হা করে তাকিয়ে আছে।
“দোস্ত, মেয়ে তো নয় এটা পুরা ঝাল মরিচ!”
শিহাব ভাবলেশহীনভাবে বললো,
“সেটাই তো দেখছি রে।”
.
ইদানীং রিহান ছেলেটা প্রিয়াকে খুব জ্বালাচ্ছে। রিহান প্রিয়ার এক ব্যাচ সিনিয়র। একই স্কুলে পড়ার সুবাদে ওরা পরিচিত। প্রিয়া যখন এইটে পড়ে তখন থেকেই রিহান প্রিয়াকে পছন্দ করে। ছয় মাস প্রচুর পিছন পিছন ঘুরেছে কিন্তু একদম পাত্তা পায়নি। এরপর রিহান এস.এস.সি পরীক্ষা শেষে কলেজে গিয়ে রিলেশনে যায়। এইসব খবরই প্রিয়ার কানে আসতো। প্রিয়া বড় বাঁচা বেঁচে যায় মনে মনে। এরমধ্যে রিহানের সাথে আর প্রিয়ার দেখা হয়নি। সবই তো ভালোই চলছিল। ঐদিন হুট করে কলেজে যাওয়ার সময় রিহানের সাথে দেখা হয়ে যায়। রিহানের পাগলামি তখন থেকেই। এরমধ্যে শুনেছিল রিহানের নাকি ব্রেকাপও হয়েছে কিন্তু খবর কতটা সত্যি সেটা জানেনা প্রিয়া। যাই হোক, প্রিয়ার জানার কোনো আগ্রহও নেই। ঐদিন দেখা হওয়ার পর থেকেই রিহান খুব জ্বালাচ্ছে প্রিয়াকে। হুটহাট করে ফোন দিচ্ছে, বাড়ির সামনে আসছে। কতগুলো নাম্বার যে ব্লাকলিস্টে ফেলেছে তার কোনো হিসেব নেই। পুরনো প্রেম জেগে ওঠেছে।
সন্ধ্যার সময় প্রিয়া একটু পড়তে বসেছিল তখনই আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে। প্রিয়া শিওর হয়ে যায় যে এটা রিহানেরই কাজ। আজ একটা রামধোলাই দিবেই দিবে। ফোন রিসিভড করেই প্রিয়া বললো,
“হারামজাদা আবার ফোন করছিস? ঐ তোর কি কোনো লজ্জাশরম নাই নাকি? এতগুলো নাম্বার ব্লক করেছি এরপরও অন্য নাম্বার থেকে ফোন করেছিস?”
ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কণ্ঠ ভেসে আসলো,
“আপু আমি তো আজই তোমাকে প্রথম কল দিলাম।”
প্রিয়া এবার থতমত খেয়ে বললো,
“কে তুমি?”
“আমি সুমা।”
“কোন সুমা? কোথাকার সুমা? আমি কি চিনি?”
মেয়েটা কোনো উত্তর না দিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
“রিহানের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?”
প্রিয়ার মাথা এবার রাগে ফেঁটে যাচ্ছে। কোনো সম্পর্কে না জড়িয়েও একটা অপরিচিত মেয়ের কাছে শুনতে হচ্ছে কি সম্পর্ক! এরচেয়েও অপমানের কিছু হয়না প্রিয়ার কাছে। নিজের রাগকে সংযত করে প্রিয়া বললো,
“আগে তোমার পরিচয় দাও। তারপর আমি সব বলছি।”
“আমি রিহানের গার্লফ্রেন্ড।”
“কিহ্? তুমি ছেচ্চড়টার গার্লফ্রেন্ড? অথচ ঐ ছেচ্রা কাল পর্যন্তও নিজেকে সিঙ্গেল বলতে বলতে মুখ দিয়ে ফ্যানা তুলে ফেলেছিল।”
“আমি জানি আপু। এটা নিয়ে ওর সাথে আমার খুব ঝগরাও হয়েছে।”
“তুমি কোন কচুটা জানো? জানলে হুট করেই এই প্রশ্ন কেন করলে যে রিহানের সাথে আমার কি সম্পর্ক? কেমন ছেলেকে ভালোবাসো যার চরিত্র খারাপ! একটা পাগলকে নিয়ে সারাজীবন থাকা যায় কিন্তু চরিত্রহীন কাউকে নিয়ে থাকা যায়না।”
“আমি বুঝতে পারছি ওর ওপর তোমার অনেক রাগ। আমি ওকে অনেকবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু বলেনি। এটাও বলেছি যে, ও যদি তোমাকে চায় আমি নিজেই তোমাকে ওর হাতে তুলে দিবো।”
“হোয়াট দ্যা…. তুমি কে আমাকে ওর হাতে তুলে দেওয়ার? তোমার কি মনে হয় আমি রিহানকে ভালোবাসি? নো ওয়ে। এমন ক্যারেক্টারলেস ছেলে কখনো প্রিয়ার ভালোবাসা ডিজার্ভ করেনা। আদারওয়াইজ আমি আগে রিহানকে ভালো না বাসলেও ভালো মানুষ ভাবতাম। কিন্তু এখন তো দেখছি সে একটা চরিত্রহীন ছেলে। গার্লফ্রেন্ড থাকতেও অন্য মেয়ের প্রতি যার ভালোবাসা জন্মায় সে নিঃসন্দেহে একজন খারাপ লোক। আর তুমি আগে কেন যোগাযোগ করোনি আমার সাথে? তাহলে সামনে থেকে ছেচ্রাটাকে একটা উচিত শিক্ষা দিতাম।”
“আসলে অনেক ট্রাই করেছি কিন্তু পাইনি। আমার ভাইয়াকে বলেছিলাম তোমার কথা। ভাইয়া ওর বন্ধুদেরও বলেছে। তারা আপনার কলেজেই অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। বলেছে যে কয়েকদিনের মধ্যেই খুঁজে জানাবে। কিন্তু তার আগেই আমি রিহানের ফোন নিয়ে তোমার নাম্বার নিই।”
“খুব ভালো করেছো। যার সাথে জীবন জড়িয়েছো তাকে বলিয়ো শুধু তোমাতেই যেন মত্ত থাকে। আর পার্সোনালি একটা কথা বলি তোমায়। আমি রিহানকে ঘৃণা করি, খুব বেশি ঘৃণা করি।”
ঠুস করে লাইনটা কেটে কেলো। কি হলো? টাকা শেষ নাকি ফোন রেখে দিলো? ফোনটা হাতে নিয়ে খেয়াল করলো ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। শিট! প্রিয়া ফোনটা চার্জে বসিয়ে পড়তে বসলো।

পড়া শেষ করে সবার সাথে রাতের খাবার খেতে বসলো। প্রিয়াদের বাড়িতে অত বিলাসিতা নেই। কিন্তু মনের সুখটাই তো আসল। যেটা ওদের মধ্যে ছিল। দুই ভাইয়া বউ নিয়ে অন্য জায়গায় থাকে কাজের সুবাদে। এখানে শুধু প্রিয়ার বড় বোন লামিয়া, বাবা-মা আর প্রিয়া থাকে। লামিয়া পড়াশোনার পাশাপাশি হাসপাতালে রিসিপশনে জব করে। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে খেতে বসেছে ওরা। রাতের খাবারের মেন্যুতে ছিল ইলিশ মাছ ভাজা, আলু ভর্তা আর ডিমের তরকারি। ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে প্রিয়া বললো,
“বুঝলে মা, ভাবছি কয়েকটা মুরগী পালবো।”
“হঠাৎ এই ভাবনা কেন?”
“এইযে ডিম রান্না করো। এই ডিম কেনার টাকাটা বেঁচে যাবে।”
লামিয়া বললো,
“এত উন্নতির কথা কবে থেকে ভাবা শুরু করলি?”
“যবে থেকে তোকে বিদায় করার ভূত মাথায় এসেছে।”
“আমি কি তোর পাকা ধানে মই দিয়েছি যে আমায় বিদায় করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিস?”
“আমার ধানের ক্ষেত থাকলে তো মই দিবি। কথা তো ওটা নয়, তোর বিয়ের জন্য ডিম বিক্রির টাকা জমিয়ে তোকে বিয়ে দিবো।”
“তোর খুব বেশি তাড়া থাকলে তুই বিদায় হ।”
“তুই কি এখন বিয়ে করবি না আপু?”
“না।”
“না করলে না করবি। সেটা তোর ব্যাপার। কিন্তু আমার ইচ্ছে আছে আমি একটা ডিমের দোকান খুলবো। যেই দোকানে শুধু ডিম বিক্রি হবে। দোকানের নাম কি দিবো জানিস?”
“কি?”
“লামিয়ার ডিম ষ্টোর। শত হোক, তুই আমার বড় বোন। তোর প্রতি তো আমার আলাদা একটা টান আছে বুঝিস না।”
লামিয়া জোরে একটা ধমক দিয়ে বললো,
“ঐ লামিয়ার ডিম ষ্টোর মানে কি রে হ্যাঁ? ডিম কি আমি পারবো নাকি?”
“আমি এটা কখন বললাম?”
“নামটা তো তেমনই শোনায়।”
“দেখেছিস তোর থিংকিং কতটা নিচু? আচ্ছা তোর পুরো নাম যেন কি? লামিয়া ইসলাম মীম তাই না? হোল স্কুল-কলেজ লাইফে তো তোকে সবাই ডিম বলেই ডাকতো। ডিম থেকেই তো ছানার জন্ম। ছানা থেকে বড় মুরগী। আর তুই তো এখন বড় হয়েছিস। তাহলে লামিয়ার ডিম ষ্টোর নামটা কোন দিক দিয়ে খারাপ রে?”
লামিয়া দাঁত কটমট করে তাকিয়ে আছে। প্রিয়া খাওয়া শেষে তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললো,
“আজকাল কারো ভালো চাইতে নেই। দুনিয়ায় ভালো মানুষের কদর কেউ করেনা কখনো। একদিন বুঝবি।”
“যা ভাগ।”

প্রিয়া ঘরে গিয়ে মোবাইল নিয়ে সোজা বারান্দায় গেলো। কানে হেডফোন গুঁজে প্লে লিস্ট থেকে নিজের ফেভারিট গানগুলো শুনতে লাগলো। এরমধ্যে একটা গান একটু বেশিই ভালো লাগে প্রিয়ার। প্রিয়া সবসময় মাঝখান থেকেই শোনে গানটার।
“চুরাবালির পিছুটানে, বুঝিনা এই ভাষার মানে
অশান্ত মন, কি উচাটন খোদা জানে!
ঘরের কাজে, সকাল সাঝে
জিওমিতির ভাঁজে ভাঁজে,,
কিসের ছায়া, এ কোন মায়া
বুঝি না যে..!”
গানটা শুনতে শুনতে প্রিয়া ভাবে জীবন কি অদ্ভুত। একটু ভুল বুঝাবুঝি জীবন শেষ করে দিতেও দ্বিধাবোধ করেনা। যেটা এই “বখাটে” শর্টফিল্ম দেখলেই বোঝা যায়।
রাত একটা পর্যন্ত বারান্দায় বসে বসে গান শোনে প্রিয়া। এরপর ঘুমাতে চলে যায়। লামিয়া একটা শোয়ার বালিশ বুকে জড়িয়ে অন্যপাশ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। প্রিয়া গিয়ে পেছন থেকে লামিয়াকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। প্রিয়ার এক হাত, এক পা লামিয়ার ওপর। সারাদিনে যত ঝগড়াঝাঁটি যাই হয়ে যাক না কেন রাতে কেউই কাউকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। বিশেষ করে প্রিয়া। যতই মুখে বলুক তোকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করবো কিন্তু মনে মনে চায় বোন সারাজীবন ওদের কাছে থাকুক। সুন্দর এসব ভাবনা নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে প্রিয়া।
.
.
সকালঃ ৯:১১ মিনিট
ঘুমঘুম চোখে মোবাইলে টাইম দেখেই প্রিয়া ধড়ফড়িয়ে বিছানায় বসে। দশটায় প্রিয়ার ক্লাস শুরু। তাও প্রথমেই ইংলিশ ক্লাস। এই ক্লাসে লেট করা মানে ম্যামের ক্লাসে পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা। উফফ! আর ভাবতে পারছেনা প্রিয়া। কখন রেডি হবে আর কখন খাবে। আজ তো কপালে শনির দশা আছেই। আপুর ওপর খুব বেশিই রাগ হচ্ছে প্রিয়ার। ইচ্ছে করে ডাক দেয়নি। রাতের শোধটা এভাবে নিলো। প্রিয়া মনে মনে একশো টা গালি দিয়ে ফেলেছে। ঝটপট প্রিয়া ফ্রেশ হয়ে কলেজের ইউনিফর্ম পড়ে নেয়। আজ হিজাব বাঁধার একদম সময় নেই। তাই সাদা জর্জেট ওড়নাটা গলায় সুন্দর করে পেঁচিয়ে নেয়। লম্বা চুলগুলো একটা ঝুটি করে। বাহিরে প্রচুর ধুলাবালি থাকায় একটা মাস্ক পড়ে নেয়। এরপর না খেয়েই ব্যাগ নিয়ে দৌড় দেয়। মাঝ রাস্তায় পথ আটকে ধরে শিহাব ও ওর বন্ধুরা। প্রিয়ার মেজাজটা বিগড়ে যায়। এদের কি এখনই আসতে হলো! প্রিয়া ওদের সাইড কাটিয়ে চলে যাওয়া ধরলে শিহাবের বন্ধু পথ আঁটকে বলে,
“আরে দাঁড়াও মামণী! এত তাড়া কিসের?”
প্রিয়া কিছু বললো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। শিহাব চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বললো,
“রিহানের সাথে কিসের ইটিশপিটিশ চলছে হ্যাঁ? আমাদের ছোট বোনের বয়ফ্রেন্ড হয় রিহান। কয়েকদিন পর ওদের বিয়ে জানো? আর ওর পিছনে ঘুরঘুর করছো?”
প্রিয়া এতক্ষণে বুঝলো ওদের আসার কারণটা অন্য অর্থাৎ রিহানঘটিত। সুমা বলেছিল ওর ভাইয়াকে আমায় খোঁজার কথা। মেয়েটার সাথে কথা বলে একবারের জন্যও মনে হয়নি থ্রেড দিতে বলেছে। কিন্তু এইগুলো একটু বেশিই লাফাচ্ছে মনে হয়।
শিহাব এবার ধমক দিয়ে বললো,
“চুপ করে আছো কেন? বোবা? কথা বলতে পারোনা? আর মুখে মাস্ক লাগিয়ে ঘুরছো কেন? খুলো বলছি এক্ষুণী মাস্ক খুলো।”
পাশ থেকে শিহাবের বন্ধু বললো,
“দোস্ত মামনী মনে হয় ব্রান্ডের লিপস্টিক ইউজ করেছে তাই মাস্ক দিয়ে ঢেকে রেখেছে।”
“আরে তাহলে ঢাকবে কেন? সবাইকে তো দেখানো উচিত।”
এবার প্রিয়া ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
“জ্বী আঙ্কেল ঠিক বলেছেন। আমি ব্রান্ডের লিপস্টিক ইউজ করেছি। আপনি দিবেন ঠোঁটে? লাগিয়ে দিবো? আমি ব্যাগে করে নিয়ে এসেছি।”
প্রিয়ার এমন কথায় সকলে হকচকিয়ে গেলো। শিহাব ধমক দিয়ে বললো,
“এই মেয়ে এত্ত সাহস তোমার? দেখি মুখটা দেখাও দেখি। মাস্ক খুলো।”
“মাস্ক আমি খুলতেই পারি। কিন্তু নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা আছে তো?”
“কেন? তুমি কি কুইন এলিজাবেথ?”
“তা নই। তবে আপনার মাথা ঘুরানোর কথা। কাকে থ্রেড করতে আসছেন দেখেন।”
বলেই প্রিয়া একটানে মাস্কটা খুলে ফেললো। শিহাব লাফ দিয়ে বাইকে বসে পড়লো।
“লা হাওলা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউর আজিম।”
“কি হলো আঙ্কেল? ভয় পেলেন?”
“ছিহ্ এসব কি বলো! আর ঐ সোহানের বারোটা আমি বাজাচ্ছি। আমাকে দিয়েই আমার হবু বউকে থ্রেট দেওয়ানো।”
“আঙ্কেল…”
শিহাব বুকের বামপাশে হাত রেখে বললো,
“উফফ আল্লাহ্। বুকে মোচর দেয়। প্লিজ আঙ্কেল ডেকো না। হার্টএটাক করে মরেই যাবো।”
“বেশ! তবে মামা ডাকি কেমন?”
” এভাবে আহত-নিহত কেন করছো প্রিয়া?”
“আমি কি করলাম মামু?”
“শেষ আমি শেষ! ওরে তোরা কে কই আছিস আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল। পোস্টমর্টেম করতে হবে। তখন রিপোর্টে স্পষ্ট আসবে “প্রিয়ার কথার আঘাতে শিহাবের মৃত্যু।” বিয়ের আগেই বিধবা হবে তখন বুঝবে মজা।”
“পাগল।”
বলেই প্রিয়া কলেজে চলে গেলো।…

চলবে….
#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_১৯
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
ফাহাদ প্রিয়ার কোলে মাথা রেখে বেমালুম ঘুমাচ্ছে। প্রিয়া হেসে দিলো। কাকে শোনাচ্ছে তার অতীতের কথা। প্রিয়া ফাহাদের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ডাকলো,
“শুনছেন?”
ফাহাদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। প্রিয়া আবার ডাকলো,
“আপনি ঘুমাচ্ছেন?”
ফাহাদ এবার একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“না, না তুমি বলো। আমি শুনছি।”
“আপনার ঘুম পেয়েছে। আপনি বাড়ি যান।”
“না। আমি তোমার কাছেই থাকবো। তুমি বলো।”
“খুব বেশি ঘুম পেলে ভাইয়ার রুমে গিয়ে ঘুমান।”
ফাহাদ এবারও কোনো সাড়াশব্দ করলো না। আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রিয়া আর ডাকলো না। ঘুমাক। আজ এমনিতেও প্রিয়ার আর ঘুম আসবেনা। পুরনো ক্ষত যে জেগে ওঠেছে। কিন্তু যাকে শোনানোর জন্য এত আয়োজন সেই তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আচ্ছা ফাহাদ কেন ওর অতীত শুনতে চায় না? কেন সিরিয়াস হয়না? এর উত্তর ভেবে পায়না প্রিয়া। ছাদের রেলিং-এর কাছে লম্বা সরু একটা বেঞ্চ পাতা আছে। ওটার ওপরই প্রিয়া বসে আছে। আর ফাহাদ প্রিয়ার কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। প্রিয়া রেলিং-এ মাথা ঠেকিয়ে আকাশ পানে তাকায়। বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে। বিশাল চাঁদ আকাশে আর অজস্র তারা। কতই না স্বপ্ন বুনেছিল শিহাবের সাথে আকাশের চাঁদ আর তারা দেখতে দেখতে। কত ভালোবাসা ছিল একটা সময় দুজনের মধ্যে। সব শেষ হয়ে গেলো।

আকাশের দিকে তাকিয়েই প্রিয়া আবার অতীতে ফিরে যায়।

শিহাবের ওমন পাগলামিকে বেশিদিন এড়িয়ে যেতে পারেনি প্রিয়া। সারাক্ষণ পিছে ঘুরঘুর করা, ওর ক্লাস না থাকা সত্ত্বেও প্রিয়ার জন্য কলেজের সামনে অপেক্ষা করা এসব খুব ভাবাতো প্রিয়াকে। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয়েছিল। এমনটাই হয়েছিল।
রাত থেকে প্রিয়ার খুব জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছিলো জ্বরে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ওষুধও আনে। পরেরদিন আর জ্বর নিয়ে কলেজে যেতে দেয়নি প্রিয়ার মা। সেদিন সারাদিন ছটফট করেছে শিহাব। প্রিয়াকে একটা নজর দেখার জন্য উন্মাদ হয়ে যায়। কারো কাছেই প্রিয়ার কোনো ইনরফরমেশন পায়না। প্রিয়ার বাড়ির এড্রেসও জানেনা শিহাব। পরক্ষণেই শিহাবের মনে হলো সুমার কাছে তো প্রিয়ার নাম্বার আছে। ওর নাম্বারটা নিলেই তো পারে। শিহাব তাড়াতাড়ি সুমাকে কল দেয়।
“হ্যালো শিহাব ভাইয়া।”
“একটা হেল্প করবে?”
“কি?”
“প্রিয়ার নাম্বারটা দিবে প্লিজ?”
“ইশ! ভাইয়া রিহান আমার ফোন থেকে প্রিয়া আপুর নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছে। স্যরি ভাইয়া।”
শিহাবের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ফোন কেটে দিয়ে চুপ করে বসে রইলো। রিহানের ওপর রাগ হতে লাগলো।
“রিহান! রিহান! হ্যাঁ রিহানের থেকেই তো প্রিয়ার বাড়ির এড্রেসটা নিতে পারি।”
যেই ভাবা সেই কাজ। রিহানের থেকে এড্রেস আর ফোন নাম্বার নিয়েই বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।
বাহিরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এই জ্বর নিয়েও বৃষ্টিতে ভেজার জন্য মায়ের কাছে বায়না ধরেছে প্রিয়া। মা তো এক কথায় বারণ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়। বাহির থেকে তালা দিয়ে রেখেছে। এই মেয়েকে দিয়ে একদম বিশ্বাস নেই। কখন জানি ফুড়ুৎ করে ছাদে চলে যাবে। মন খারাপ করে প্রিয়া বিছানায় শুয়ে রইলো। জ্বর তো অনেকটাই কমে গিয়েছে। একটু ভিজলে এমন কি ক্ষতি হবে? ঐদিকে বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা প্রিয়াকে আহ্বান করছে। আর পারছেনা প্রিয়া। বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় চলে গেলো। বৃষ্টির পানি এসে বারান্দার ফ্লোর ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে। বাহিরে প্রচন্ড বাতাসও বইছে। বারান্দার গ্রিল ধরে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির স্বাদ নিচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে প্রিয়ার চোখমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। আচমকা চোখ খুলে তাকাতেই প্রিয়া ভয় পেয়ে যায়। রাতের বেলায় বাড়ির সামনে ভূত আসলো নাকি! প্রিয়া ভালো করে তাকিয়ে দেখলো নিচে শিহাব দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে আর কি যেন বলছে। কথা শোনা যাচ্ছেনা তবে শিহাবকে ল্যামপোস্টের আলোয় দেখা যাচ্ছে। প্রিয়া মনে মনে ভাবে,
“এই ছেলেকি পাগল নাকি! আমার বাড়ির সামনে কি করছে? তাও আবার বৃষ্টির মধ্যে।”
শিহাব হাতের ইশারায় কি যেন বুঝাচ্ছে। প্রিয়া ঠিক বুঝতে পারলো না। ভালো করে হাতের ইশারা লক্ষ করতেই বুঝতে পারলো শিহাব ফোনের কথা বলছে। প্রিয়া তৎক্ষণাৎ রুমে এসে ফোন খুঁজতে লাগলো।
“কাজের সময় কোথায় যে যায় ফোন।”
সারা বিছানা খোঁজার পর ফোন পেলো। ৩৮টা মিসডকল। তাও আননোন নাম্বার থেকে। নিশ্চয়ই শিহাব কল করেছে। প্রিয়া অবাক হলো। বাড়ির লোকজন ছাড়া আর গুটি কয়েক ফ্রেন্ডস ছাড়া কেউ প্রিয়াকে ফোন দেয়না। এতবার তো নয়’ই। প্রিয়ার মনে কেমন জানি ভালোলাগা শুরু করে। ভাবনার ঘোর কাটার আগেই শিহাব আবার ফোন দেয়। রিসিভ করবে নাকি করবেনা ভেবে রিসিভড করেই ফেললো। প্রিয়া চুপ করে আছে। হার্টবিট কেমন যেন বেড়ে যাচ্ছে। ওপাশ থেকে শিহাব বললো,
“প্রিয়া।”
প্রিয়া চুপ।
“প্রিয়া শুনছো? হ্যালো….হ্যালো। শুনছো তুমি?”
“হ্যাঁ শুনছি।”
“তুমি এত স্বার্থপর কেনো প্রিয়া?”
“কি করেছি আমি?”
“আজ কলেজে কেন এলেনা? জানো কত কষ্ট হচ্ছিলো আজ তোমায় না দেখতে পেয়ে। মনে হচ্ছিলো দম আটকে মরেই যাবো।”
“একদিন কলেজ যাইনি তাতেই এই অবস্থা?”
“একদিন কি কথা? আমি এক সেকেন্ডও তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না। অনেক ভালোবাসি তোমায়।”
“কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসিনা।”।
“তোমার বাসতে হবেনা। আমি একাই ভালোবাসবো।”
“পাগলামো বাদ দিয়ে এখন বাসায় যান।”
“না। তুমি বারান্দায় আসো তোমাকে দেখবো।”
“পারবোনা।”
“কেন?”
“আমি তো আপনাকে ভালোবাসিনা। তাহলে কেন শুনবো আপনার কথা?”
“তুমি কি আমায় সত্যিই ভালোবাসো না প্রিয়া?”
“না।”
“আচ্ছা বেশ। আজ আমি সারারাত তোমার বাড়ির সামনে বৃষ্টিতে ভিজবো।”
প্রিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শিহাব ফোনটা কেটে দেয়। প্রিয়া কলব্যাক করে কিন্তু শিহাব রিসিভড করেনা। প্রিয়া বারান্দায় গিয়ে হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে কিন্তু শিহাব সেকথার পাত্তা না দিয়ে অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়া রাগে গজগজ করতে করতে রুমে এসে পড়ে। কাঁথা গায়ে জড়াতে জড়াতে আপনমনেই বলে,
“যা ইচ্ছে করুক আমার কি তাতে! যখন ঠান্ডা লাগবে তখন একাই চলে যাবে। এসব উটকো ঝামেলায় একদম জড়ানো যাবে না। সেঁধে সেঁধে বাঁশ খাওয়ার কোনো মানেই হয়না।”
.
সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গতেই প্রিয়া আড়মোড়া ভাঙ্গলো। রাতের কথা মনে পড়ায় দৌঁড়ে বারান্দায় গেলো কিন্তু শিহাবকে দেখতে পেলো না। আজ অনেকটাই সুস্থ প্রিয়া। তাই মায়ের বারণ না শুনেই প্রিয়া কলেজে গেলো। কলেজে গিয়েই প্রিয়া চমকে গেলো। আজ কোথাও শিহাবকে দেখতে পেলো না। প্রিয়ার তো খুশি হওয়ার কথা কিন্তু মনের এক কোণায় কোথাও যেন শূন্যতা বিরাজ করছে। তবে কি প্রিয়া শিহাবকে ভালোবেসে ফেলেছে! কলেজ ছুটির পর শিহাবের বন্ধু প্রিয়ার কাছে যায়।
প্রিয়াই বললো,
“কি খবর মামু?”
“দেখো মজা কিন্তু পরেও করতে পারবা। এখন আমার সাথে চলো।”
“কোথায় যাবো?”
“শিহাবের ম্যাসে।”
“না।”
“শিহাব অনেক অসুস্থ।”
শিহাব অসুস্থ শুনে প্রিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
“কি হয়েছে?”
“কাল সারারাত তোমার বাড়ির সামনে বৃষ্টিতে ভিজছে। ফোন দিয়া জিজ্ঞেস করতেই বললো তোমার বাড়ির সামনে। ভোরে গিয়া দেখি ও সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে। পরে সবাই মিলে ও নিয়া আসি। এখন অনেক জ্বর। বারবার খালি তোমার নাম নিতাছে।”
প্রিয়া আর কোনোকিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যায়। হাজার হোক, ওর জন্যই তো শিহাব আজ অসুস্থ।
ছোট্ট একটা ম্যাসের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা। প্রিয়া বাড়িটা দেখে থমকে যায়। ব্যাচেলর বাড়ি। সব ছেলে মানুষ। প্রিয়ার কি যাওয়া ঠিক হবে? যদি কোনো ক্ষতি করে ফেলে! ছেলেদের দিয়ে তো একদম ভরসা নেই। প্রিয়াকে চুপ থাকতে দেখে ছেলেটা বললো,
“কি হইলো? আসো। তুমি কি ভয় পাইতাছো? ভিতরে আমার গার্লফ্রেড আর ওর কয়েকটা বান্ধবীও আছে। ভয়ের কিছু নাই।”
বলতে বলতেই দরজার সামনে কয়েকটা মেয়ে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়া সস্তির একটা নিঃশ্বাস নিলো। যেতে যেতে বললো,
“উনি ম্যাসে থাকে কেন?”
“ওর বাবা-মা, ভাই-ভাবি সবাই রাজশাহী থাকে। ও এখানে পড়াশোনা করে। পরীক্ষাটা শেষ হলেই জব নিবে। আগে অবশ্য জব করতো। কিন্তু কয়েকদিন পর পরীক্ষা তো তাই ছাইড়া দিছে।”
“ওহ।”
ভিতরে গিয়ে দেখলো ছোট্ট একটা খাট পাতা আছে। খাটের পাশেই পড়ার টেবিল। জামা-কাপড় রাখার জন্য একটা ছোট্ট ট্রলি আর মাথার ওপর একটা সিলিং ফ্যান। ঘরটা বেশ পরিপাটিই বলা চলে। শিহাব বিছানায় শুয়ে আছে। প্রিয়া রুমে যেতেই সবাই বেড়িয়ে গেলো। প্রিয়ার খুব ভয় করছিল। এভাবে একা ঘরে, শিহাবের সাথে। যদি কোনো অঘটন ঘটে প্রিয়া তো মরেই যাবে। প্রিয়া মনে মনে বললো,
“নো প্রিয়া নো! তুই না ব্রেফগার্ল? এভাবে ভয় পেলে চলবে? ভয়কে জয় করতে হবে।”
প্রিয়া আস্তে করে ডাকলো শিহাবকে। শিহাব চোখ মেলে প্রিয়াকে দেখে খুশি হয়ে বললো,
“তুমি এসেছো?”
“হু। কিন্তু এগুলা কেমন পাগলামি বলেন তো? এভাবে নিজের ক্ষতি করার কোনো মানে হয়?”
“তুমি শুধু আমায় একটাবার ভালোবাসো প্রিয়া।”
“ভালোবাসা কি জোর করলেই হয়? আমার ভালোবাসা আসেনা। পেইন ভালোলাগে না। কষ্ট সহ্য করতে পারিনা একদম।”
“আমি তোমায় একটুও কষ্ট দিবো না।”
“ওটা আমার বান্ধবীদের বয়ফ্রেন্ডরাও বলতো। তারপরও দেখতাম আমার বান্ধবীরা কাঁদে। আমি বাবা এসব সহ্য করতে পারবো না।”
শিহাব হাসলো। বললো,
“বেশ। তবে আমরা বন্ধু হই?”
“বন্ধু হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।”
তখন থেকেই শিহাব আর প্রিয়া বন্ধু। একসাথে কলেজে যাওয়া, বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, কলেজ ক্যাম্পাসে আড্ডা দেওয়া, একসাথে কফি খাওয়া, ফুসকা খাওয়া সবকিছু জুড়েই শুধু শিহাব জড়িয়ে গেলো। কে যেন বলেছিল, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনোই বন্ধু হতে পারেনা। এদের মধ্যে যেকোনো একজন তো প্রেমে পড়বেই। শিহাব তো আগে থেকেই প্রিয়াকে ভালোবাসে। এবার প্রিয়াও ভালোবেসে ফেলে শিহাবকে। শিহাব ইচ্ছে করেই ফ্রেন্ডশিপ করেছিল যাতে ভালোবাসার একটা সুযোগ পায়। হলোও তাই। শিহাব পরীক্ষার জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে পড়াশোনা নিয়ে। এখন আর তেমন সময় দিতে পারেনা প্রিয়াকে। তখন থেকেই প্রিয়া উপলব্ধি করতে পারে যে প্রিয়াও শিহাবকে ভালোবেসে ফেলেছে। দুজনের ভালোবেসে একসাথে পথচলার শুরুটা তখন থেকেই। এই ভালোবাসাটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় প্রিয়ার জীবনে।
.
.
শিহাবের পরীক্ষা শেষ। ভালো একটা চাকরীও করছে এখন। প্রতি শুক্রবারটা প্রিয়ার জন্য বরাদ্দ রাখে শিহাব। শুক্রবারে প্রিয়া তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে। গোসল হয়ে রেডি হতে হবে। ঘুমঘুম চোখে ওয়াশরুমে এগিয়ে যাচ্ছিলো প্রিয়া। পেছন থেকে প্রিয়ার মেজ খালামনি বললো,
“প্রেমে ট্রেমে পড়লি নাকি?”
খালামনির কথা শুনে প্রিয়ার ঘুম উধাও। ফাঁকা একটা ঢোক গিলে বললো,
“এমন মনে হলো কেন?”
“ফেসওয়াশ মনে করে স্নো নিয়ে যাচ্ছিস ওয়াশরুমে। প্লাজুর বদলে তোর মায়ের পেটিকোট নিয়ে যাচ্ছিস। কাহিনী কি হুম?”
প্রিয়া হাতের দিকে লক্ষ করে দেখলো আসলেই সে মায়ের পেটিকোট আর স্নো নিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়া জিভ কাটলো।
“ঘুমে উলটপালট হয়ে গেছে।”
“ঘুমে উলটপালট? প্রতি শুক্রবারে কোথায় যাওয়া হয়?”
এতক্ষণ শুধু মেজ খালামনি চেপে ধরলেও এখন যোগ দিয়েছে লামিয়া, মা, নানু আর ছোটখালামনি। মাঝখানে প্রিয়া একদম চ্যাপা শুটকি হয়ে যাচ্ছে। ওদের সবার সাথেই প্রিয়া অনেক ফ্রি। সব কথাই ওদের শেয়ার করে। কিন্তু ভালোবাসার কথা কিভাবে শেয়ার করবে? ইশ, কি লজ্জা! কিন্তু ওরাও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই না শুনে ছাড়বেনা। শেষমেশ সব লজ্জাশরম কাটিয়ে প্রিয়া সব বললো। সবাই তো খুশিতে গদগদ। প্রিয়ার মা বললো,
“আগে ছেলের ছবি দেখা। ছেলে ভালো তো?”
প্রিয়া ফোন থেকে ছবি বের করে দেখালো।
“মাশআল্লাহ্। এটা তো পুরা নায়ক। কিন্তু মা, যাই করিস না করিস একটু সাবধান থাকিস। আজকালকের ছেলেদের দিয়ে বিশ্বাস নেই। দুইদিন প্রেম করবে তারপর উধাও।”
“মা শিহাব ওরকম নয়। আমি ওকে তোমাদের সাথে কথা বলিয়ে দিবো।”
“আচ্ছা। তাহলে আজই আসতে বল।”
“আজ?”
“হু।”
প্রিয়া ফোন করে শিহাবকে সব বললো। শিহাবের তো ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
“প্রিয়া তুমি ঠিক বলছো? তোমার বাড়িতে আমার কথা জানিয়েছো?”
“হ্যাঁ। তুমি না সেদিন বললে যে, তোমার বাড়িতে আমার কথা বলেছো? তারাও তো রাজি। এখন আমার পরিবারও রাজি। এখন তো আমাদের বিয়েতে কোনো সমস্যাই হবেনা।”
“হুম।”
“তুমি তাড়াডাড়ি বাসায় আসো।”
“আমার ভয় করছে। সাথে লজ্জাও লাগছে।”
“আরে, আমি আছি তো। তাড়াতাড়ি আসো তুমি।”
প্রিয়া ফোন রেখে দিলো। আধঘণ্টার মধ্যেই শিহাব বাড়িতে আসে। বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করে।
সেদিন বাইকে করে ঘুরতে যায় শিহাব আর প্রিয়া। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো দেখে একটা ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয় ওরা। মেঘে মেঘে কালো হয়ে আছে আকাশ। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকায়। প্রিয়া ভয় পেয়ে শিহাবের হাত জড়িয়ে ধরে। প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে শিহাব একটা দুষ্টু হাসি দেয়। প্রিয়ার অনেক কাছে এগিয়ে যায় শিহাব। ঘোরের মধ্যে চলে যায়। প্রিয়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। প্রিয়া কেঁপে ওঠে। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে। একসময় প্রিয়া লজ্জা পেয়ে শিহাবকে জড়িয়ে ধরে। চোখের কোণা বেয়ে পানি ঝড়ে পড়ে প্রিয়ার। শিহাব প্রিয়ার হাত ধরে বলে,
“আমায় কখনো ঠকিয়ো না প্লিজ। খুব বেশিই ভালোবাসি তোমাকে। আমার চেয়ে বেশি তোমায় কেউ ভালোবাসতে পারবেনা।”
“কখনো ঠকাবো না।”
“ছেড়ে যাবে না তো কখনো?”
“না।”
“আমার খুব ভয় করে প্রিয়া। ছেড়ে যেয়ো না আমায়।”
কাঁদতে কাঁদতেই ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে প্রিয়া। প্রিয়ার চোখের পানি গাল বেয়ে ফাহাদের মুখে পড়ে। ফাহাদ তৎক্ষণাৎ উঠে বসে। দেখে প্রিয়া চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। প্রিয়ার বাহুতে ধরে ফাহাদ হালকা ধাক্কা দেয়। প্রিয়া চোখ মেলে তাকায়।
“কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন?”
“কই?”
“চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আবার বলছো কই?”
প্রিয়া চোখে হাত দিয়ে দেখে আসলেই সে কাঁদছে। পুরনো ক্ষত কেন এত পোড়ায় প্রিয়াকে।
“কি হলো?”
“কিছুনা। এমনিই চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।”
“কি লুকাচ্ছো বলো তো?”
“লুকানোর মত কিছুই নেই।”
ফাহাদ প্রিয়ার গালে হাত রেখে বললো,
“অতীতের স্মৃতিগুলো মনে পড়েছে?”
প্রিয়া আর সেখানে বসলো না। এক ছুটে নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। হুট করেই কেন এত কষ্ট হচ্ছে। কেন মনে পড়ছে ওর কথা। তবে কি অতীত আবার ফিরে আসছে। কেন হলো এমন কেন! প্রিয়া মুখে হাত দিয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় প্রিয়া ক্লান্ত হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে ভাবে এত ভালোবাসার মানুষটা কি করে এমন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।..
সময়টা প্রিয়ার এইচএসসি এর টেষ্ট পরীক্ষার মাত্র পাঁচদিন আগের। মাঝখানে এত্তগুলো সময়, দিন, সপ্তাহ্, মাস পেড়িয়ে যায় শিহাব আর প্রিয়ার ভালোবাসায়। শিহাবের প্রচন্ড ইগো ছিল আর প্রিয়ার ছিল প্রচুর রাগ। কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিলনা কারোরই। কোনো আড্ডায় প্রিয়া থাকলেই সেখানে গর্ব করে বলতো শিহাবের কথা। কিন্তু হঠাৎ ভূমিকম্পের ন্যায় সব বদলে গেলো। ভূমিকম্প যেমন কোনো সংকেত দিয়ে আসেনা শিহাবের পাল্টে যাওয়াটাও ঠিক তেমন ছিল। আগের মত তো কথা বলেই না। দেখাও করেনা। যতটুকু কথা হয়, শুধু ঝগড়া হয় আর না হয় শিহাব চুপ করে থাকে। প্রিয়া ভেবে পায়না শিহাবের এমন পরিবর্তনের কারণ। তিনদিন এভাবেই কেটে যায়। যেখানে ঝগড়া করে শিহাব এক ঘন্টাই থাকতে পারতো না সেখানে তিনদিন প্রিয়ার সাথে কথা না বলেই থাকছে। প্রিয়াকে ইগনোর করছে। শিহাবের এমন আচরণ প্রিয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা। একা একাই কেঁদেকেটে বুক ভাসায়। ঠিকমত খায়না, গোসল করেনা। একদম পাগল প্রায় অবস্থা। কলেজে গিয়েও কাঁদতে থাকে। প্রিয়া ফোন দিলেই কেটে দিয়ে ম্যাসেজ দেয়, “আমি বিজি আছি।” অথচ পরে আবার কল দিলে দেখে শিহাবের নাম্বার ওয়েটিং। অবাক হয় প্রিয়া। এই কি সেই ভালোবাসার মানুষটা? যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতো?
কলেজে গিয়ে মনমরা হয়ে বসে আছে। বারবার ফোনে ট্রাই করছে শিহাবকে বাট নো রেসপন্স। ম্যাসেজেরও কোনো রিপলে নেই। স্যারের কোনো লেকচারও মাথায় ঢুকছে না। ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে শিহাবকে একটিভ পায়। ম্যাসেজ করে,
“কেমন আছো তুমি?”
সীন করেনা ম্যাসেজ।
“জান কথা বলো না কেন? কি করেছি আমি? কেন এমন করছো আমার সাথে?”
আকুতি-মিনতি করে একটাবার কথা বলতে চায় প্রিয়া। শিহাব রিপলে করে,
“চেষ্টা করবো।”
“প্লিজ জান একটাবার কথা বলো আমার সাথে।”
টিফিন টাইমে ফাঁকা ক্লাসে গিয়ে ফোন দেয় প্রিয়া। বারবার ট্রাই করেও লাভ হচ্ছে না। প্রিয়া জোরে আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে। অনেকবার ট্রাই করার পর শিহাব ফোন রিসিভড করে বলে,
“বলো।”
“আমার সাথে এমন কেন করছো?”
শিহাব চুপ।
“প্লিজ কিছু বলো।”
“আমি একটু সমস্যায় আছি প্রিয়া।”
“কেমন সমস্যা যেটা আমাকে বলা যায় না?”
“তোমাকে বললে তুমি কষ্ট পাবে।”
“কষ্ট তো তুমি এখনও কম দিচ্ছো না।”
“বাড়ি থেকে আমার বিয়ের কথা বলছে।”
প্রিয়ার বুকে মোচর দিয়ে ওঠে। বিয়ের কথা!
“তো এখানে সমস্যার কি আছে? তুমি না বলেছিলে তোমার বাড়ির সবাই জানে আমার কথা? মেনেও নাকি নিয়েছে।”
” তখন মেনে নিয়েছিল এখন নিচ্ছে না। বাবা অন্য জায়গায় মেয়ে দেখতে চাইছে। আমার মাথা কাজ করছে না।”
“এসব তুমি কি বলছো শিহাব? তুমি কি জানো তুমি কি বলছো? কেন মেনে নিবে না তারা?”
“শহরের মেয়ে তাদের পছন্দ না। এখন বিয়ে করলে তো তুমি পড়াশোনা করবে বিয়ের পরও তারা সেটা মানবে না।”
প্রিয়া কোনো কিছু না ভেবেই বলে ফেললো,
“আমি করবো না। আমি পড়াশোনা করবো না। তোমার জন্য আমি আমার স্বপ্ন স্যাক্রিফাইজ করতে রাজি আছি। তবুও প্লিজ আমায় ছেড়ে যেয়ো না।”
“দেখছি।”
“দেখছি? এরপরও তুমি বলছো দেখছি?”
প্রিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ওপাশ থেকে শিহাব ফোন কেটে দেয়……

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here