#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_২০
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
প্রিয়ার অঝোর চোখের পানি শিহাবের হৃদয় স্পর্শ করতে পারছেনা। শিহাব কিছুই ক্লিয়ার করে বলছেনা। সবকিছুই রাহার সাথে শেয়ার করে ফোন দিয়ে। সব শুনে রাহা বেশ রেগে যায়। এমন করার তো কোনো মানে নেই। কিছু তো একটা ক্লিয়ার করে বলতে পারে। প্রিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। ফোনের ওপাশ থেকে রাহা বললো,
“একটা সময় আমরা যখন কষ্টে কাঁদতাম তখন তুই আমাদের বুঝাতি। হাসাতি। আর আজ এভাবে ভেঙ্গে পড়ছিস তুই? তুই না অনেক শক্ত মনের মেয়ে? এভাবে কাঁদিস না প্লিজ। আমারও এমন একটা সময় যে, তোর কাছে গিয়ে যে তোকে বুকে জড়িয়ে নিবো সেটাও পারছিনা। আমার শ্বাশুরী খুব অসুস্থ।”
প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা রাহা।”
“শোন, তুই আজ ফোন দিয়ে ক্লিয়ারলি জিজ্ঞেস করবি, সে কি চায়। হয় সারাজীবনের মত একসাথে থাকবে নয়তো ছেড়ে দিবে। এভাবে ঝুলিয়ে রাখার তো কোনো মানে হয়না।”
“হুম।”
রাহা আরো অনেক কিছু বুঝালো। প্রিয়াও সিদ্ধান্ত নিলো যা হবার আজ হবেই। ফোনের ওপর ফোন দিতে থাকে কিন্তু রিসিভড করেনা শিহাব। সাথে ম্যাসেজও দেয়,
“প্লিজ শিহাব ফোনটা ধরো। তোমার সাথে ইম্পোর্ট্যান্ট কথা আছে।”
ম্যাসেজ সীন করে কিন্তু রিপলাই করেনা। প্রিয়া আরো ম্যাসেজ দেয় সাথে ফোনও দিতে থাকে। প্রিয়া ভেবে পায়না, যে ছেলে প্রিয়ার একটা ফোনকলের আশায় চাতকপাখির মত বসে থাকতো সেই ছেলে এখন পুরো দমে প্রিয়াকে ইগনোর করছে। তবে কি শিহাবের ভালোবাসা পুরোটাই নাটক ছিল। ভাবতে পারছেনা প্রিয়া। ওপাশ থেকে শিহাবের রিপলে আসে,
“আমি অফিসে ব্যস্ত আছি।”
“শুধু একটাবার কথা বলবো।”
অবশেষে শিহাব কল ধরে।
“তুমি এমন কেন করছো শিহাব? আমায় নিয়ে যেই সমস্যা সেটা তো আমি সমাধান করেই দিলাম। আমি পড়বোনা। তাহলে আর কিসের সমস্যা বলো? কেন ইগনোর করছো আমায়?”
“আমি বুঝতেছিনা আমি কি করবো।”
“এরকম ভাবলেশহীন উত্তর দিয়ো না শিহাব। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। প্লিজ আমায় ছেড়ে যেয়ো না। কেন বুঝো না আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি।”
কথাগুলো বলতে বলতেই প্রিয়া কেঁদে দেয়।
“কান্না করো না প্লিজ। আমি দেখি কি করতে পারি।”
“তোমার কথা সব ছন্নছাড়া। তুমি সত্যিই আমায় ভালোবাসো তো? নাকি সবটা নাটক ছিলো?”
“ভালোবাসি আমি।”
“কেমন ভালোবাসা এটা? যেখানে দিনের পর দিন তুমি আমায় কষ্ট দিচ্ছো। ইগনোর করছো।”
“কি করবো আমি জানিনা।”
“সেই এক কথা। ভালোবাসি অনেক শিহাব।”
“আমি পরে ফোন দিচ্ছি। বস আসতেছে।”
শিহাব ফোনটা রেখে দিলো। প্রিয়া ফ্লোরে বসেই জোরে জোরে কান্না শুরু করলো। বাড়িতে কেউ নেই। লামিয়া আর মা ওর নানির বাসায় গেছে। বাবা অফিসে। পুরো বাড়িতে প্রিয়া একা। কষ্টে দম আটকে আসছে প্রিয়ার। আবারও ডায়াল করে শিহাবের নাম্বারে। এবার কল ওয়েটিং। কষ্টে বুকটা ফেঁটে যাচ্ছিলো। শিহাবের বন্ধুকে ফোন দিয়েও কিছুই জানতে পারেনা প্রিয়া। অসহায় হয়ে পড়ে। শেষমেশ শিহাবকে ম্যাসেজ করে,
“অনেক হয়েছে এই অবহেলা। আজ ক্লিয়ার করে একটা কথা বলো তুমি কি চাও? আমাকে কি তুমি সত্যিই ভালোবাসো? ভালোবাসলে ভালোবেসে হাতটা ধরো নয়তো ছেড়ে দাও। তবুও এভাবে কষ্ট দিয়ো না প্লিজ। আমাকে যদি তোমার আর ভালো না লাগে তাহলে সেটা সোজাসুজি বলে দাও। বিশ্বাস করো একটুও কষ্ট পাবো না। যতটা কষ্ট পাচ্ছি তোমার এহেন আচরণে।”
ম্যাসেজটা সেন্ড করে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে চোখের পানি ঝড়ায়। প্রিয়ার বিশ্বাস শিহাব প্রিয়াকে ভালোবাসে, চায়। শিহাব নিশ্চয়ই প্রিয়াকে ছেড়ে দিবেনা। ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। শিহাবের ম্যাসেজ। প্রিয়া তাড়াতাড়ি ম্যাসেজটা ওপেন করে। ম্যাসেজ দেখে প্রিয়ার সব বিশ্বাস মুহুর্তেই ভেঙ্গে যায়। বিশ্বাসই করতে পারছেনা। ম্যাসেজটা ছিল,
“আমায় তুমি ক্ষমা করে দিয়ো প্রিয়া। আমার কিছুই করার নেই। আমি আমার বাবা-মাকে কষ্ট দিতে পারবোনা। আমি নিরুপায়। ভালো থেকো।”
প্রিয়া সাথে সাথে শিহাবকে ফোন দেয়। নাম্বার ব্যস্ত। যতবার ফোন দেয় একই কথা। তার মানে নাম্বারটা ব্লাকলিস্টে ফেলেছে। ম্যাসেজ টাইপ করার মতও শক্তি পাচ্ছেনা প্রিয়া। ফেসবুকে লগিন করে দেখে সব আইডি ব্লক করে দিয়েছে। এমনকি হোয়াটসএপ এবং ইমো থেকেও। সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে শিহাব। কি করে করতে পারলো এটা শিহাব। প্রিয়া এবার চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। এভাবে হারিয়ে যাবে শিহাব, এভাবে ঠকাতে পারে বিশ্বাসই হচ্ছেনা প্রিয়ার। ঐসময়েই প্রিয়ার মা ফিরে আসে। প্রিয়াকে এভাবে কাঁদতে দেখে তিনি ভয় পেয়ে যান। দৌঁড়ে মেয়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে।
“কি হয়েছে মা? এভাবে কাঁদছিস কেন?”
প্রিয়া কান্নার জন্য কথা বলতে পারছেনা। কান্নার শব্দে পাশের ফ্লাট থেকেও লোকজন এসে পড়েছে। মা কোনোরকমে তাদের বুঝ দিলো অন্য কথা বলে। তারা চলে যেতেই মা বললো,
“শিহাবের সাথে কিছু হয়েছে?”
কান্নারত অবস্থায় বললো,
“শিহাব আমায় ঠকিয়েছে মা। শিহাব আমায় ঠকিয়েছে। ও আমায় বিয়ে করবেনা। ওর বাবা-মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে।”
প্রিয়ার মা স্তব্ধ হয়ে যায়। যেই ছেলে এত ভালোবাসতো সে কি করে এটা করতে পারে। তাহলে কি সবটাই নাটক ছিল। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে তিনি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারেনি। মেয়ের সাথে সাথে কান্না করেন। মেয়েকে বুঝানোর মত মানসিক অবস্থাও তার নেই। এদিকে প্রিয়ার প্রায় পাগল পাগল অবস্থা। কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা খুবই খারাপ। প্রিয়াকে একদমই সামলানো যাচ্ছেনা। ঐমুহুর্তেই লামিয়াকে ফোন দেয় মা। তখনই নানু, খালামনিরা আর লামিয়া ছুটে আসে। প্রিয়ার অবস্থা দেখে কেউই চোখের পানি আটকাতে পারেনি। এভাবে কেউ ভালোবাসতে পারে সেটা প্রিয়াকে না দেখলে কেউ জানতোই না। প্রিয়ার কান্নায় মনে হচ্ছে আকাশ-পাতাল এক হয়ে যাচ্ছে।
সেরাতে আর প্রিয়াকে জোর করেও খাওয়াতে পারেনি কেউ। কি করে খাবে প্রিয়া, ভালোবাসার মানুষটার কাছে যে খুব জঘন্যভাবে ঠকেছে। শিহাব ঠকিয়েছে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা প্রিয়া। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছে । পাশেই নানু আর লামিয়া আপু বসে নিরবে কাঁদছে। প্রিয়া প্রচুর হার্ট হয়েছে। কখন কি পাগলামি করে বসে বলা যায়না। হয়তো নিজেরই কোনো ক্ষতি করে ফেলবে। তাই কেউ প্রিয়াকে একা ছাড়েনি। সেদিনই প্রিয়ার বাবা সব জানতে পারেন। কিন্তু আদরের মেয়েকে কিছুই বলেনি। সারারাত ঐদিন কেউই ঘুমায়নি।
.
দিন যায় দিন আসে। প্রিয়ার খারাপ সময়গুলো আর যায়না। প্রিয়ার সবেচেয়ে বড় সাপোর্ট হয়ে দাঁড়ায় ওর মা। তারপর পরিবার। এই সময়টাতে মানসিক সাপোর্ট সবচেয়ে বেশিই দরকার। ওর ফ্রেন্ডসরাও ওকে প্রচুর সাপোর্ট করে। কিন্তু যে যাই বলুক না কেন, প্রিয়ার অবাধ্য মন সেটা মানতে নারাজ। শিহাবের শূন্যতা কুঁড়েকুঁড়ে খায় প্রিয়া। সবার এত বোঝানো কথাও প্রিয়ার মনকে ধরে রাখতে পারেনা। এদিকে মা প্রতিদিনই কাঁদে। চোখের সামনে মেয়ের এমন অবস্থা সহ্য করতে পারবেনা কোনো মা’ই। কারো সাথেই কথা বলেনা প্রিয়া। নামাজে বসে শুধু চোখের পানিই ফেলে। এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়। কেন এত বিরহ! টেষ্ট পরীক্ষাও চলে আসে। এমন মানসিক অবস্থায় পরীক্ষা দেওয়া কঠিন। কোনো প্রিপারেশনই নেই। কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে পরীক্ষা দেয়। নিজের কষ্টগুলোকে লুকিয়ে সবার সাথেই হেসে কথা বলার চেষ্টা করে। বুকের ভেতর পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও মুখে মিথ্যা হাসি ফোঁটাতে ভুলেনি প্রিয়া।
প্রিয়া ভাবে, নিজের কষ্টের জন্য এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। মাকে কাঁদাচ্ছে। ঠকিয়েছে শিহাব অথচ কষ্ট পাচ্ছে প্রিয়া আর ওর পরিবার! প্রিয়া সিদ্ধান্ত নিলো যত কষ্টই হোক আর কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবেনা। তাই বুকের কষ্টগুলো বুকে রেখেই সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। নিঁখুত ভালো থাকার অভিনয় কেউ ধরতেও পারেনা। কিন্তু রাত হলেই কষ্টগুলো আর আটকে থাকতে চাইতো না। চোখের পানি হয়ে বেড়িয়ে আসতো। এমন কোনো রাত নেই যে রাতে ও কাঁদেনি।
.
.
আর মাত্র একমাস বাকি আছে প্রিয়ার এইচ.এস.সি পরীক্ষার। মাঝখানে অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়ে যায় শিহাবের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে। এক ঘন্টা যে মানুষটার সাথে কথা না বলে থাকতে পারতো না সেই মানুষটার সাথে এখন কথা না বলেই সময় কেটে যায়। প্রিয়ার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। মানুষ বদলাতে সত্যিই সময় লাগেনা। গিরগিটিও মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে হার মানবে। শিহাবের বন্ধু খবর দিলো মার্চের ১৫ তারিখে শিহাবের বিয়ে। শিহাবের বিয়ে শুনে প্রিয়ার বুক মোচর দিয়ে ওঠলো। মানতেই পারছেনা কথাটা। আজ ১১ তারিখ। তাহলে আর চারদিন বাকি ওর বিয়ের! অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে বুকে। আবার পাগলামি শুরু হয়ে যায়। যেই স্বপ্নগুলো প্রিয়াকে দেখাতো সেই স্বপ্নগুলো অন্য কাউকে নিয়ে পূরণ করবে! আবার সেই আগের মত কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এবারের কষ্টটা আরো বেশি। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে কেউই সহ্য করতে পারেনা। সেখানে প্রিয়া পাগলের মত ভালোবাসে শিহাবকে। প্রিয়ার কান্না মা কিছুতেই সহ্য করতে পারেনা। তিনি আর্তনাদ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“আল্লাহ্ আমার মেয়েটারে আর কত কষ্ট দিবা? ঐ ছেলে তো দিব্যি সুখে আছে। তাহলে আমার মেয়েটারে ক্যান এভাবে কষ্ট দিচ্ছো। ওরে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দাও আল্লাহ্। ওর সব কষ্ট তুমি আমায় দাও। তবুও আমার মেয়েটাকে আর কাঁদাইয়ো না।”
.
চৌদ্দ তারিখ গায়ে হলুদের দিন শিহাব প্রিয়াকে ফোন দেয়।
“হ্যালো।”
“ভালো আছেন?”
শিহাবের মুখে আপনি ডাক শুনে তাচ্ছিল্যর হাসি হাসলো প্রিয়া। উত্তরে বললো,
“যেমন রেখেছো।”
“আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কি করতাম বলো? আমার যে কিছুই করার নেই।”
“আজ তোমার গায়ে হলুদ না?”
“হুম।”
“খুব আনন্দ হচ্ছে তাইনা?”
“আমি জানি আমার কেমন লাগছে।”
“মিথ্যা নাটক আর করো না প্লিজ। তুমি অনেক খুশি আমি জানি, অথচ আমার সামনে এমন ভাব ধরছো যে তুমি আমাকেই ভালোবাসো। কেন ঠকালে আমায় শিহাব? কি দোষ ছিল আমার?”
“আমি তোমায় ঠকাইনি। আমি পরিস্থিতির স্বীকার।”
“হাহ্! নিজের দোষগুলো আর পরিস্থিতির ওপর চাপিয়ে দিয়ো না। তোমার বউ নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর?”
“জানিনা।”
“বলো না। আমিই তো।”
প্রিয়া নিঃশব্দে কাঁদছে। শিহাব সেটা বুঝতে পারছে। প্রিয়ার কথা গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো,
“তোমার অনেক কিছুই করার ছিল শিহাব। তুমি করোনি কারণ তুমি তো আমায় কখনো ভালোইবাসিনি। এভাবে না ঠকালেও হয়তো পারতে। যেই স্বপ্নগুলো তুমি আমায় দেখিয়েছিলে সেই স্বপ্নগুলো কাল থেকে অন্য একটা মেয়ের সাথে পূরণ করবে। যেখানে আমার বউ সাজার কথা ছিল সেখানে অন্য একটা মেয়ে বউ সাজবে। যেই রাতটাকে ঘিরে আমাদের দুজনের স্বপ্ন ছিল সেই রাতের স্বপ্ন অন্য একটা মেয়ে পূরণ করবে। তোমার যেই হাতের স্পর্শ আমার পাওয়ার কথা ছিল সেই স্পর্শে অন্য মেয়ে মোহিত হবে। তবুও বলবো তুমি সুখী হও। আল্লাহ্ তোমাকে অনেক সুখী করুক। ভালো থেকো আমার ভালোবাসা।”
প্রিয়া ফোন কেঁটে বন্ধ করে দেয়। শব্দ করে কাঁদতে থাকে। আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছেনা। একদম না। যেই জীবনে শিহাব নেই সেই জীবন রেখে কি হবে!
মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে। একবার বিবেকে তাড়া দেয়, শিহাবের জন্য নিজের পরিবারকে কষ্ট দিবে! আবেগে বলে, বেঁচে থাকতে শিহাব অন্য কারো হবে এটা কিছুতেই মানতে পারবেনা। আবেগের তাড়নায় আর কষ্টে মায়ের একটা কাপড় নিয়ে ফ্যানের সাথে বাঁধে। গলায় কাপড় পেঁচিয়ে পায়ের নিচ থেকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে টুলটা সরিয়ে দেয়। তখনই রুমে প্রবেশ করে প্রিয়ার বাবা আর লামিয়া। নিজের চোখে মেয়েকে এভাবে ঝুলে থাকতে দেখে তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়। লামিয়া সাথে সাথে চিৎকার দেয়। প্রিয়ার মা, খালামনি, নানুরা দৌঁড়ে আসে।…..
.
প্রিয়া অতীত থেকে ফিরে আসে।
সাথে সাথে চোখ মেলে তাকায়। অতীতের কষ্ট এখন প্রিয়ার গলা চেপে ধরেছে। গলাটা শুকিয়ে এসেছে। একটু পানি খাওয়া দরকার। ঘরে ওয়াটার বোতলে পানি নেই। তাই ভেতরের রুমে যেতে হবে। দরজা খুলতেই দেখে ফাহাদ দরজার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভোর চারটা বাজে। একটুপরই মা রান্না করতে উঠবে। আর উনি এখানে ঘুমাচ্ছে।
“এইযে শুনছেন!”
এক ডাকেই ফাহাদ ধড়ফড়িয়ে ওঠে। প্রিয়ার দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,
“এই তুমি এভাবে চলে আসলে কেন? কি হয়েছে বলো? আমি কত ভয় পেয়েছি জানো?”
প্রিয়া ফাহাদের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ধূসর বাদামি চোখগুলো ভয়ের জানান দিচ্ছে। আচ্ছা সব ছেলেই কি এক? ফাহাদও কি কখনো ঠকাতে পারে? ভয় পেয়ে কি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি? সত্যিই কি ভালোবাসা বলতে কিছু আছে? প্রিয়াকে আলতো করে ধাক্কা দেয় ফাহাদ।
“কি ভাবছো?”
“কিছুনা। বাড়ি যাবেন না?”
“তাড়িয়ে দিচ্ছো?”
“মোটেও না।”
“বিয়েটা শুধু আগে করি তারপর দেখিয়ো পুরো শ্বশুরবাড়িটা কিভাবে দখল করে নিই হুহ। তখন তুমি তোমার শ্বশুরবাড়ি থাকবে আর আমি আমার শ্বশুরবাড়ি।”
ফাহাদের কথা শুনে প্রিয়া হেসে দেয়।
“ইশ! এভাবে হেসো না গো। বুকে লাগে আমার।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চলেন এগিয়ে দেই।”
মেইন দরজা পর্যন্ত যেতেই ফাহাদ থেমে যায়।
“আর যেতে হবেনা। রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
“হুম।”
ফাহাদ দু পা এগিয়ে আবার ফিরে আসে।
“কিছু বলবেন?”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“শিওর।”
“অতীতের মানুষটাকে এখনো ভালোবাসো?”
“না।”
“তবে কি ঘৃণা করো?”
“তাও না।”
“তাহলে?”
“তাকে আমি ভালোওবাসিনা। ঘৃণাও করিনা। তার প্রতি আমার সব অনুভূতি ফিকে হয়ে গিয়েছে।”
“তার ওপর রাগ হয়না?”
“না।”
“কেন? আমি হলে তো মেরেই ফেলতাম।”
“রাগ করবো কেন? আর আমি মারারই বা কে? যার যার শাস্তি সে সে পাবে। রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলতে একটা কথা আছে জানেন তো?”
“হুম।”
“এটাই যথেষ্ট আমার জন্য।”
ফাহাদ প্রিয়ার গালে হাত রেখে বললো,
“অতীতগুলোকে আর হাতছানি দিতে দিয়ো না। অনেক বেশিই ভালোবাসি তোমাকে।”
চলবে……
#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_২১
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
প্রিয়া অফিসে গিয়েই ফাহাদের কাছে যায়। কিন্তু ফাহাদ প্রিয়াকে দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। ফাহাদের এমন ব্যবহারে প্রিয়া অবাক হয়। চোখ পিটপিট করে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার দিকে তাকাচ্ছেন না কেন?”
ফাহাদ হাতের কলমটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,
“তুমি কি রাণী ভিক্টোরিয়া? তোমাকে এত দেখার কি আছে বুঝলাম না।”
“ফাহাইদ্দা!!!!”
প্রিয়া তেড়ে যায় ফাহাদের কাছে। দু’হাত দিয়ে গলা চেপে ধরে বলে,
“আমি কি? কি আমি বলেন?”
প্রিয়ার হাত সরিয়ে ফাহাদ কাঁশতে কাঁশতে বলে,
“বাবারে! বউ তো নয় যেন অগ্নিকন্যা!”
“জেনেশুনে আগুনে পা রাখলেন কেন শুনি?”
ফাহাদ প্রিয়াকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের কোলে বসায়।
“আরে আরে কি করছেন?”
“চুপ! তোমার ভালোবাসার আগুণে পুড়তে চাই। তাই জেনেশুনেই ভালোবেসেছি।”
“পুড়ে যদি ছাই হয়ে যান?”
“কবি বলেছেন, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন!”
“ঢং।”
“আমি কি সবার সাথে ঢং করি?”
“আমি কি জানি?”
“কে জানে?”
“আপনি জানেন।”
“আচ্ছা শুনো।”
“কি?”
“একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি সারপ্রাইজ?”
“বলে দিলে কি সেটা সারপ্রাইজ থাকবে নাকি পাগলি!”
“তাও তো ঠিক।”
“হুম। চলো।”
“কোথায়?”
“সারপ্রাইজ দেখবে না? নাকি কোলেই বসে থাকবে? শুধু তুমি কোলে থাকলেই হবে? একটা বাবুও আনি চলো।”
“নির্লজ্জ।”
ফাহাদ হাসলো। প্রিয়ার চোখ ধরে বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে।
“আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
“চলো তো তুমি।”
এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে প্রিয়ার চোখ ছেড়ে দিলো। সবকিছুই কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। চোখ কচলিয়ে সামনে তাকাতেই প্রিয়া হা হয়ে যায়। পৃথা এসেছে! পৃথা প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।
“তোর হানিমুন শেষ পৃথা?”
“সারা বছর কি হানিমুনই করে যাবো?”
“যাহ্ ফাজিল। তুই যে আজ থেকেই
অফিসে জয়েন করবি। বলিসনি তো।”
“তোকে কেন বলবো? তুই কি আমায় সব বলিস?”
“আমি আবার কি লুকালাম?”
“ডুবে ডুবে জল খাও আর এখন বলো কি লুকালাম?”
পৃথার ইঙ্গিত বুঝতে পারে প্রিয়া। কান চুলকে বলে,
“আসলে…মানে..কি বলতো আমি না তোর হানিমুনের সময় নষ্ট করতে চাইনি তো তাই ফোনে বলিনি। বাট আমি ভেবেছিলাম পরে তোকে বলবো পাক্কা।”
“হয়েছে হয়েছে তোকে আর বলতে হবেনা। স্যার আমায় সব বলেছে।”
“রাগ করেনা আমার পৃথা সোনা!”
“যা সর। আগে বল বিয়ে কবে করছিস?”
বিয়ের কথা শুনতেই প্রিয়ার মুখটা মলিন হয়ে যায়। যতদিন’না ফাহাদের বাবা মেনে নিবে ততদিন তো বিয়েও করতে পারবেনা। পৃথা হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
“এমন চুপসে গেলি কেন?”
“হ্যাঁ? খুব শিঘ্রয়ই করবো বিয়ে।”
কথার মাঝে প্যাঁচ কেটে ফাহাদ বলে,
“আমি বুড়ো হয়ে গেলে তখন বিয়ে করবে?”
“হ্যাঁ করবো। তখন আপনি হবেন আমার বুড়ো বর।”
সবাই প্রিয়ার কথায় হেসে ফেললো।
.
প্রতিদিনই ফাহাদ প্রিয়াকে বাড়িতে এগিয়ে দেয়। কিন্তু আজ আর্জেন্ট কাজ থাকায় অফিসের একটা গাড়িতে ওঠিয়ে দিলো। আজ অফিসও ছুটি হয়েছে দেড়ি করে। মাঝ রাস্তায় হুট করেই গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। বিপদের ওপর বিপদ। হাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ১১:৩৯ বাজে। এতরাতে তো গাড়ি পাওয়াও মুশকিল। ড্রাইভার বাহির থেকে বলে,
“ম্যাম গাড়ির ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছে।”
“তাহলে এখন কি হবে?”
“আপনি গাড়িতে বসেন। আমি দেখি কোনো গাড়ি পাই কি না।”
“ঠিক আছে।”
প্রিয়া ফাহাদকে ফোন দিলো। কিন্তু ফোন সুইচড অফ। অদ্ভুত তো! আজ হচ্ছে কি এসব। এভাবে গাড়িতে বসে থাকতেও বোরিং লাগছে। আবার ভয়ে বেরও হতে পারছেনা। বলা তো যায়না মানুষরূপী পশু আবার কখন ঝাঁপিয়ে পড়ে। এত সময় ধরেও কোনো গাড়ির হদিস পেলো না। কিছুক্ষণ পরই কিছু লোক হুড়মুড়িয়ে গাড়ির কাছে এলো। প্রিয়াকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়ি থেকে বের করলো। কারোরই মুখ দেখতে পারছেনা। কারণ সবারই মুখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা। একজন লোক প্রিয়ার নাকের কাছে কিছু একটা চেপে ধরতেই প্রিয়া সেন্সলেস হয়ে যায়।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন প্রিয়াকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে ওরা রাস্তায় আছে। দুপাশেই বড় ঘন জঙ্গল। এখানে মেরে ফেলে রাখলেও কেউ টেরই পাবেনা। একদম মানবশূন্য জায়গা। প্রিয়া ফাঁকা ঢোক গিললো। তবে কি আজই জীবনের শেষ দিন! প্রিয়ার সামনে একজন চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। হাতে ছুড়ি। প্রিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“ক…কে… আ…আপ…নি?”
লোকটি উত্তরে কিছু না বলে মুখের কালো কাপড়টা সরিয়ে ফেলে। প্রিয়া পুরো শকড হয়ে যায়।
“আপনি!!!!!”
লোকটা অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। প্রিয়া ভয় পেয়ে যায়। লোকটি আর কেউ নয়। ফাহাদের বাবা।
“আঙ্কেল আপনি? আপনি এটা করেছেন? কিডন্যাপ করেছেন আমায়?”
“এছাড়া তো আমার আর কিছুই করার ছিলনা মামণী। সেদিন তো ভালোভাবেই তোমায় বোঝালাম। কিন্তু তুমি তো বুঝলেনা। তাই আরকি! বাধ্য হলাম।”
“ছিহ্ আঙ্কেল! এসব করে কি লাভ? ফাহাদের লাইফ থেকে আমায় সরানোর জন্য এতকিছু?”
“ঐ কে আছিস? একে নিয়ে যা তো। আর কাজটা জলদি সেড়ে ফেল।”
প্রিয়া এবার প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়। কি করার কথা বলছেন উনি। একটা লোক এসে প্রিয়ার হাত পায়ের বাঁধণ খুলে প্রিয়াকে টেনে নিয়ে যায় জঙ্গলের দিকে। প্রিয়া লোকটার সাথে ধস্তাধস্তি করেও পারছেনা। মনে মনে আল্লাহ্ কে ডেকে যাচ্ছে। আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউই এখন বাঁচাতে পারবেনা। প্রিয়া আর্তনাদ করে বলে,
“কি ক্ষতি করেছি আমি আপনাদের? কেন আমার ক্ষতি করছেন?”
জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে প্রিয়াকে ছেড়ে দিলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। প্রিয়া ভাবে, এই সুযোগ। যেভাবেই হোক এই অন্ধকারেই পালাতে হবে। প্রিয়া দৌড় দিতে গেলে কিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। আর তখনই সাথে সাথে চারদিকে লাইট জ্বলে ওঠে। ঝাড়বাতিতে চারপাশ আলোকিত হয়ে ওঠেছে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ফাহাদ প্রিয়াকে ধরে রেখেছে। ভূত দেখার মত ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে প্রিয়া। চারপাশ থেকে অনেকের স্বরে ভেসে আসে,
“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ প্রিয়া। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।”
প্রিয়া এবার চারপাশে তাকায়। ফাহাদের বাবা-মা, ফুল, প্রিয়ার মা, ভাইয়ারা, পৃথা,আকাশ সবাই উপস্থিত। প্রিয়া যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সবাই জোরে জোরে হেসে বললো,
“সারপ্রাইজ!!!”
প্রিয়া কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
“এটা কেমন সারপ্রাইজ? আর একটু হলেই তো আমি ভয়ে মরে যেতাম।”
ফাহাদ চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
“তোমার ছোট ভাইয়ার কাছে শুনেছিলাম, তুমি নাকি সারপ্রাইজ পেতে পছন্দ করো? আর তাই তো তোমার জন্মদিনে এই ছোট্ট সারপ্রাইজ?”
“এটা সারপ্রাইজ? একটু হলেই তো মরতাম। তখন আমার জন্মদিন আর মৃত্যুবার্ষিকী একসাথেই পালন করতেন।”
“চুপ পাগলী। আমি ছিলাম তো।”
“হ্যাঁ। এজন্যই তো ভয় পেয়েছিলাম।”
“কিহ্?”
“চিল্লান ক্যান? ভয় তো আপনারাই দেখিয়েছেন তাহলে দোষ আপনার না?”
“এই আইডিয়া কিন্তু আমার না। ফুলের আইডিয়া এটা।”
চোখ কচলাতে কচলাতে প্রিয়া ফুলের দিকে তাকালো।
“কাজটা ভালো করোনি ননোদিনী। তোমার জন্মদিনে যদি তোমায় নাকানিচুবানি না খাইয়েছি তো আমিও তোমার ভাবী নই হুহ।”
ফুল প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“স্যরি ভাবী। এই নাও তোমায় একটা কিসি দিয়ে দিলাম। তবুও রাগ করো না প্লিজ। আর আমি তো শুধু আইডিয়া দিয়েছিলাম। কাজে তো লাগিয়েছে বাবা আর ভাইয়া।”
বাবা কথাটা শুনে প্রিয়া থমকে যায়। ভয়ের কারণে এতক্ষণে খেয়ালই ছিলনা ফাহাদের বাবা এখানে। তাও আবার সবার সাথে মিলে প্রিয়াকে সারপ্রাইজ দিলো! হোক ভয়ংকর সারপ্রাইজ তবুও! প্রিয়া ফাহাদের বাবার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। তিনি তাড়াহুড়োয় বললেন,
“আমার কোনো দোষ নেই মা। আমি প্রথমে ওদের প্রস্তাবে রাজি ছিলাম না। ওরা জোর করে আমাকে দিয়ে এটা করিয়েছে। বিশ্বাস করো আম্মু।”
সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনিও চমকে যান। প্রিয়ার মাথায় তিনি হাত বুলিয়ে দিলেন। প্রিয়াকে কাঁদতে দেখে বললেন,
“বাবা হই না আমি? এবারের মত ক্ষমা করে দাও। আর কখনো ওদের কথা শুনবো না।”
কান্নারত অবস্থায় প্রিয়া বললো,
“আপনি যদি আমার প্রতিটা সারপ্রাইজে থাকেন তাহলে আমি হাজারও ভয়ংকর সারপ্রাইজ পেতে চাই বাবা। আমার বার্থডের বড় সারপ্রাইজ’ই তো আপনি বাবা। আমি ভাবতেও পারিনি এত সহজে আপনি আমায় মেনে নিবেন।”
“তোমার কথাগুলো সেদিন আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম এই মেয়ে কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। এটা তো সাক্ষাৎ মায়াবিনী। তোমাকে হারাতে দেওয়া যাবেনা। আমার ফাহাদ সঠিক মানুষকেই জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছে। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য টাকা পয়সার প্রয়োজন আছে। কিন্তু মনের শান্তির জন্য ভালোবাসা প্রয়োজন। যেটা তোমার চোখে দেখেছিলাম। ঐদিন বাড়িতে গিয়েই আমি বলে দেই আমি রাজি। তারপর তুমি অফিসে থাকা-কালীন তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই। যেটা ফাহাদও জানতো না শুধু ফাহাদের মা ছাড়া। কাল যখন ফাহাদ ফুলের সাথে ডিসাইড করছিল কিভাবে তোমাকে সারপ্রাইজ দিবে তখনই আমি ওদের সবটা জানাই। আর আমিও সারপ্রাইজ দিতে অংশগ্রহণ করি।”
প্রিয়ার চোখের পানি আজ বাঁধা মানছেনা। এটা সুখের অশ্রু। সত্যিই মানুষের সব সময়টা খারাপ যায়না। একটা সময় সুখ ঠিকই হাতছানি দেয়।
কেক কাটার জন্য এগিয়ে যেতেই দেখে মায়ের চোখে পানি। এই মানুষটার চোখে প্রিয়ার সব মুহুর্তেই পানি থাকবে। তবে প্রিয়া জানে মায়ের চোখের পানিও আনন্দের। প্রিয়া মায়ের কপালে একটা চুমু খেলো। কেক কাটার পর সবাই মিলে কিছুটা সময় কাটালো। তারপর যে যার মত শুয়ে পড়লো। ওরা যেই বাগানে গিয়েছিল তার পাশেই ফাহাদদের বাংলো বাড়ি। এখানেই সব আয়োজন করা হয়েছে। রাত দুইটা বাজে। বাংলো বাড়িতে সুন্দর একটা ফুলের বাগান আছে। তার পাশেই ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুর আর ফুলের বাগানের মাঝামাঝি একটা দোলনা। ফাহাদ আর প্রিয়া পাশাপাশি দোলনায় বসে আছে। আজও আকাশে থালার মতন সম্পূর্ণ একটা চাঁদ ওঠেছে। সাথে তো অজস্র তারা আছেই। প্রিয়া আকাশের দিকে তাকিয়েই বললো,
“একটা কথা বলি?”
“বলো।”
“আপনার কোলে একটু মাথা রাখি?”
“না।”
প্রিয়া অবাক হয়ে ফাহাদের দিকে তাকালো।
“না কেন?”
“কারণ আমি তোমার ওপর রেগে আছি।”
“কি করেছি আমি?”
“এক. তুমি এখনো আমায় আপনি করে ডাকো। দুই.বার্থডেতে কোনো গিফ্ট পেলাম না।”
“প্রথমত আমার তুমি ডাকতে লজ্জা লাগে। তবে চেষ্টা করবো। আর দুই, বার্থডে তো আমার ছিল তাহলে আমি গিফ্ট দিবো কেন?”
“এত কষ্ট করে সবকিছুর আয়োজন করেছি। আমি তো একটা গিফ্ট পাই’ই।”
“আচ্ছা কি গিফ্ট চান?”
“আবার আপনি?”
“আচ্ছা কি গিফ্ট চাও?”
ফাহাদ প্রিয়ার মুখের কাছে নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে বললো,
“চুমু।”
“ধুর।”
“ধুর না। আমি আমার গিফ্ট চাই।”
“আমি পারবোনা।”
“যাও তোমার পারতে হবেনা।”
ফাহাদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। প্রিয়া ফাহাদের গালে হাত রেখে বললো,
“ঠিক আছে দিচ্ছি। তবে একটাই।”
গালের কাছে ঠোঁট এগিয়ে নিতেই ফাহাদ বললো,
“এই দাঁড়াও দাঁড়াও। গালে দিচ্ছো কেন?”
“তাহলে কোথায় দিবো?”
“ঠোঁটে।”
“না, না, না। আমি পারবোনা এটা।”
“পারতে হবে।”
“না।”
“হ্যাঁ।”
“না।”
“ওকে যাও। লাগবেনা।”
ফাহাদ মুখ গোমড়া করে বসে রইলো প্রিয়ার খুব আনইজি লাগছে। মুখটা মলিন করে বললো,
“দিচ্ছি।”
অনেক কষ্টে নিজের মধ্যে সব জড়তা কাটিয়ে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ফাহাদের ওষ্ঠদ্বয়ের কাছে এগিয়ে নিতেই ফাহাদ প্রিয়ার ঠোঁটে আঙ্গুল রাখলো। প্রিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ফাহাদ হেসে বললো,
“আজ নয়। বাসররাতের জন্য সব তোলা রইলো। তোমার আনইজি লাগবে এমন কিছুই আমি চাইনা।”
প্রিয়ার চোখে পানি চিকচিক করছে।
মনে মনে বলছে,
“এই মানুষটা আমায় এত বুঝে কিভাবে।”
ফাহাদ প্রিয়ার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
“এখন থেকে শুধু তুমি করে ডেকো।”
প্রিয়া ফাহাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফাহাদ বললো,
“কোলে মাথা রাখবে না?”
প্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফাহাদের কোলে মাথা রাখে। পুরো বিস্তৃত আকাশটা এখন প্রিয়ার সামনে। আকাশ সমান সুখ যেন আল্লাহ্ প্রিয়ার আঁচলে ঢেলে দিয়েছে। ফাহাদ প্রিয়ার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। ফাহাদের এক হাত প্রিয়া নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। হাতে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার সেই অতীতের পর আমি কাউকেই ভালোবাসতে পারিনি। চেষ্টাও করিনি কখনো। পরীক্ষা শেষে জব নিয়েছিলাম আর পাশাপাশি অনার্সে ভর্তি হই। সাত মাস চাকরী করার পর সবাই মিলে ভালো ছেলে দেখে আপুর বিয়ে দেই। আল্লাহ্ এর রহমতে আমার আপু অনেক সুখী হয়। আমার দুলাভাই অনেক ভালো একটা মানুষ। দুই ভাইয়া-ভাবিও তখন আমাদের সাথে থাকতো। সবার জীবনেই সুখ ফিরে আসে। শুধু সুখের দেখা মেলেনি আমার। অনেক প্রপোজাল পেয়েছিলাম কিন্তু আমার মন কাউকেই সায় দেয়নি। আমার শুধু মনে হতো এরা কেউই আমার জন্য নয়। এত অবিশ্বাসের মাঝেও আমার মন আপনার ভালোবাসার ডাকে সায় দিলো। আমি যতবার আপনার থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছি আমার মন ততবারই আপনার কাছে গিয়েছে। বারবার বলেছে একে বিশ্বাস করা যায়। সত্যি বলছি, না চাইতেও খুব বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে।”
“বিশ্বাসের সম্পূর্ণ মর্যাদা রাখবো আমি। এতবেশি ভালোবাসবো যে, অতীতের কথা মনে পড়লে তুমি হাসবে।”
“একটা গান শোনাবেন?”
“আগে তুমি করে বলো।”
“একটা গান শোনাও।”
ফাহাদ হেসে গান ধরলো।
“অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন,
পেলাম খুঁজে এ ভূবনে আমার আপনজন।
তুমি বুকে টেনে নাও না প্রিয়া আমাকে,,
আমি ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি তোমাকে।”
“এই গানে তো প্রিয় বলে, তুমি প্রিয়া বললে কেন?”
“গানটা তো আমি আমার প্রিয়াকে ডেডিকেটেড করেছি তাই প্রিয়া বলেছি। গানের প্রত্যেকটা কথার সাথেই আমার মনের কথা একদম মিল আছে।”
“পাগল।”
“হুম। তোমার পাগল।”
.
.
অবেশেষে প্রিয়া আর ফাহাদের বিয়ের দিন এসে পড়ে। অনেক সাধনার পর ফাহাদ আর প্রিয়া ভালোবাসার মানুষকে পেতে চলেছে। আজ ওদের গায়ে হলুদ। গাঢ় হলুদ শাড়ি পড়েছে প্রিয়া। সাথে ফুলের গয়না। ফুলের ঘ্রাণে প্রিয়ার শরীর মো মো করছে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরুর আগেই ফাহাদ ফোন দেয়। প্রিয়ার বুকটা ধক করে ওঠে। আগের গায়ে হলুদের কথা মনে পড়ে যায়। ফাহাদও কি মৃন্ময়ের মত একই কাজ করবে নাকি। অনেক চিন্তাভাবনার পর প্রিয়া ফোন রিসিভড করে। ওপাশ থেকে ফাহাদ বলে,
“ও বউ, বউ তুমি ফোন ধরো না কেন?”
ফাহাদের কথার ভঙ্গিতে প্রিয়ার জানে পানি ফিরে আসে।
“একটু পর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। আর আপনি এখন ফোন দিয়ে ঢং শুরু করেছেন?”
“আমার বউয়ের গায়ে হলুদ। আমি একশোবার ফোন দিবো। আর আমি কি তোমার পর? এখনো আপনি আপনি করে বলো কেন?
“কেন ফোন করেছো?”
“ইশ! তুমি করে বললে কি মিষ্টি লাগে।”
“এত মিষ্টি ভালো না। ডায়াবেটিস হবে।”
“হলে তোমার জামাইর হবে। আমার কি?”
“উফফ আল্লাহ্! তোমার কি তাই না? তাই তো তোমার কি! বিয়ে তো আমি পাশের বাড়ির কুদ্দুসকে করবো।”
“আমি থাকতে কুদ্দুস কেন বউ?”
“কেন ফোন দিছো বলবা নাকি রেখে দিবো?”
“রাগ করেনা বউটা আমার। কাল তো বিয়ে হয়েই যাবে। তাই বিয়ের আগে দুষ্টুমিষ্টি প্রেম করে নিচ্ছি।”
“হয়েছে প্রেম করা?”
“না। ভিডিও কলে আসো। তোমায় দেখবো।”
“পারবোনা এখন।”
“আমার বউ গায়ে হলুদে কেমন করে সেজেছে আমি দেখবো না? এত্ত মানুষ দেখবে আর আমি দেখলেই দোষ? তাড়াতাড়ি ইমোতে আসো।”
“ইমোতে আসবো কেন? আমার স্বামী কি বিদেশ থাকে নাকি?”
“ইমোতে আসার সাথে স্বামী বিদেশ থাকার কি সম্পর্ক?”
“আমার ওমোনি লাগে ইমোতে কথা বললে। সবাই বলে ইমোর আরেক নাম নাকি স্বামী বিদেশ এপস!”
প্রিয়ার কথা শুনে ফাহাদ হো হো করে হেসে দিলো।
“আমার বউ দেখি একটা বাচ্চা। সমস্যা নেই আদর-ভালোবাসায় বড় হয়ে যাবে। এখন তাহলে হোয়াটসএপে আসো।”
“আসতেই হবে?”
“হু। আমার পরীটাকে দেখবো।”
“ঠিক আছে।”
প্রিয়া ডাটা কানেক্ট করে হোয়াটসএপে যায়। ফাহাদ ভিডিও কল দেয়। প্রিয়া তো লজ্জায় তাকাতেই পারছেনা। আর ঐদিকে ফাহাদ চোখ সরাতেই পারছেনা। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়ার দিকে…
চলবে……