পুনম পর্ব ২

গল্প ঃপুনম
২য় পর্ব
(গল্পটির অার একটা পার্ট বাকী)

এর অনেক বছর পরের কথা, অামি তখন ভিয়েতনামে একটা প্রজেক্ট দেখতে গিয়েছি। অামার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেখানে খবর পেয়ে যে সাথে সাথে চলে অাসবো সে উপায় ও ছিলোনা। সরকারি জরুরি কাজে এসেছি৷ অার সেই ট্যূরে বাংলাদেশের পুরো টিমের হ্যাড অামি।

চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লাম, কে দেখবে এখন বাবাকে??খবর পেলাম বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।সাথে অারো একটা বিস্ময়কর খবরও পেলাম, বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করেছে পুনম!

পুনম???

অামার জীবনের সবথেকে বড় পাজল! সবচেয়ে কঠিন শব্দের নাম।
ভিয়েতনামে থাকা অবস্থায়ই জানলাম, বাবা চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে।
অামি অার ইচ্ছে করেই ফিরলাম না। এখন অার গিয়ে কি লাভ??অামার মৃত বাবাকে দেখার মানসিক শক্তিও অামার ছিলোনা। তাছাড়া
এত বছর পরের পুনমকে দেখে অাগুন বাড়ানোর মানে হয়না!

অামি ধীরে সুস্থে কাজ শেষ করে মাস দেড়েক পর ফিরলাম।

দেশে ফিরে সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজটা ছিলো পুনম অামার বাসায় থাকছে এতটা দিন ধরে। বাবার চল্লিশার বেশ বড়সড় পালনও সে করেছে!
বাসায় এসে
পুনমের সাথে অামার শুধু দৃষ্টি বিনিময় হলো। তাও অল্প, কথা একেবারেই হয়নি…….

পুরো সপ্তাহ এমন কাটলো, অামি ঘুম থেকে উঠে নাশতা খাই, অফিস যাই, মিটিং করি বাসায় ফিরি, খাবার খাই… ঘুমোতে যাই ব্যস! মাঝেমধ্যে পুনমের সাথে দেখা হয়, সে অামার গেস্ট রুমেই নিজের মত করে থাকছে, বই পড়ছে, লিখালিখি করছে। বাজার করছে, রান্না করছে, ইলেকট্রিসিটি বিল পে করছে, কাজের লোকদের বেতন দিচ্ছে, সন্ধ্যায় ছাঁদে কফি খেতে খেতে পায়চারী করছে। সবই যেনো স্বাভাবিক তাঁর কাছে। প্রায়ই সারারাত ও’র ঘরে বাতি জালানো থাকে! কি করে সে???

অামি কথা বলতে চেষ্টা করেছি বহুবার, কথা অাসেনা; গলায় কি একটা জমাট অাটকে অাছে, বেশ শক্ত হয়ে। কথা,,অভিযোগ,, অভিমান অার কষ্ট সব জমে কেমন একটা হয়ে গিয়েছিল যেনো! কাঁটা বাঁকা হয়ে গলায় অাটকালে যেমন হয় সেরকম।
অার পুনম?? সে তো ……..

একদিন অফিস থেকে ফিরে অামি ডিনারে বসিনি, শরীর খারাপ লাগছিলো। ঘরে এসে চেঞ্জ না করেই বিছানায় শুয়েছি,
পুনম অামার ঘরে এলো।

নক না করেই, খুব স্বাভাবিকভাবে, অামার বিছানায় পাশে বসলো।
সেই কফিমগ হাতে।
অার তখনি পুনমের দিকে ভালো করে তাকালাম অামি।
সোনালী পাড়ের সবুজ অার কালোর মিশেলে চমৎকার বুনোফুলের কাজ করা শাড়ি পড়া। একহাতে দারুণ একটা সবুজ পাথরের ব্রেসলেট, চুল একপাশে করে গুঁছিয়ে খোলা, কানে, হাতের ব্রেসলেটের সাথে মিলিয়ে সবুজ পাথরের দুল।
অামার কষ্ট এবার শতগুণ হলো। পুনম এত ভালো অাছে, সেই অাগের মতই অাছে সে। কিচ্ছু বদলায়নি তাঁর! অার অামি??
অামার সব বদলে গেছে, অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। সে কি জানে?? কি ক্ষতিটাই না…..

——–অাপনার জানতে ইচ্ছা করে না, অাপনার বাবা মৃত্যুর অাগে অাপনাকে বিশেষ কিছু বলে গিয়েছেন কিনা?? অামি তো উনার পাশে ছিলাম, মানে ফিরে এসে অাপনি তো অামার কাছে কিছু জানতে চাননি??

পুনমের এমন প্রশ্নে অামি চমকে উঠলাম।
শোয়া থেকে উঠে বিছানার উল্টো পাশ দিয়ে নামলাম।
চেঞ্জ করা দরকার!শরীর ঘামঘাম হয়ে অাছে।

———এত যে রাগ করে সব তছনছ করে বেঁচে যাচ্ছেন, এটা কি অাপনি ডিজার্ভ করেন?? এই জীবনটা কি সত্যিই অাপনার প্রাপ্য ছিলো???
অামি পুনমের এই কথাটারও জবাব দিলাম না।

পুনম কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো, অামি ওয়াশরুম গেলাম, চেঞ্জ করলাম। বের হয়ে একটা স্লিপিং পিল নিলাম। পুনম বেশ শান্তভঙ্গিতে সেসব দেখলো,

তারপর একটা সাদা খাম টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল,
——–অামার ছুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে নেক্সট বারো তারিখে। অামি অাসার পর অবধি বাবার ওখানে যাইনি, কাল ওখানে যাচ্ছি।যাওয়ার অাগে অবশ্য অাসবো এখানে। এখান থেকেই ফ্লাইট ধরবো!

পুনম উঠে বেড়িয়ে গেলো। অামি বিছানায় তাঁকালাম।পুনম তাঁর কফিমগ ফেলে গেছে।

অামার কেনো জানি পুনমের রেখে যাওয়া খাম খুলতে ইচ্ছে করলোনা।
বাবা অামাকে বিশেষ কিছু যে বলে যাননি তা অামি জানি। কারণ অামার বিয়ের পর থেকে তিনি অামার উপর রাগ করে ছিলেন, অামি কেনো পুনমকে ফিরিয়ে অানছি না?? কেনো পুনমের খোঁজ নিচ্ছি না, একজন চলে গেলো বলে তাঁকে ছেড়ে থাকা কেনো?? পুনমকে যেতে দিলাম কেনো?? কেনো চলে গেলো জানতে চাইনি কেনো?
এতই যদি ভালোবাসা তাহলে পাশে ডাকছিনা কেনো??

এসব নিয়ে তিনি অামার সাথে রাগের স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়েছিলেন।বাবাকে অবশ্য বারবার একই উত্তর দিয়েছি অামি। পুনম অামাকে ভালোবাসতে পারেনি, এটা তাঁর সীমাবদ্ধতা।অপরাধ নয়! অামি পুনমকে ভালোনা বেসে থাকতে পারছিনা এটাও অামার সীমাবদ্ধতা।

তবে বাবার উপর অামি রাগ করে ছিলাম, বাবা জেনে-বুঝেও কেনো অামার জীবনে পুনমকে অানলেন! জানতেনই যদি পুনমের অন্য টান অাছে, অামার জীবন কেনো এমন টানাপোড়নে ফেলে দিলেন??অামি কি চেয়েছি এমন একটা অনুভূতি বয়ে বেড়াতে??
বাবা-ছেলের এত অভিমানের জায়গায় বিশেষ কোনো কথা থাকতে পারেনা। পুনম ছাড়া অার কোনো বিশেষ কথা বাবার ছিলোই না।

খামে হয়তো পুনম নিজের দরকারি কিছু রেখে গিয়েছে, যেটা অামাকে জানানো তাঁর দরকার। অনেক বছর অাগে এরকম একটি খাম খুলে অামাকে অাৎকে উঠতে হয়েছে। মনে অাছে সেই খামের জন্য অনেক রাত অামার ঘুম হয়নি! সেই খামে করে পুনম অামায় ডিভোর্স নোটিশ পাঠিয়েছিলো!সাংঘাতিক রকম দুঃস্বপ্ন ছিলো সেটা….

এবার হয়তো??? অামি অার ভাবতে পারলাম না।
পরদিন
পুনম চলে গেলো ও’র বাবার ওখানে।
অামার নিঃসঙ্গ জীবন অামার মতই কাটতে লাগলো৷ বারো তারিখে ফ্লাইটের অাগে পুনম অামার এখানে অার এলোনা। ও’র ফ্লাইটের সময়টা অামি জানতাম, কোনো টান থেকে নয়, ও’র কিছু দরকারি জিনিসপত্র অামার এখানে ফেলে গিয়েছিল, যা নিয়ে অামি সোজাসুজি এয়ারপোর্টে গেলাম।

এয়ারপোর্টে পুনম অামাকে দেখা মাত্রই ছুটে এলো। যেনো জানতো অামি অাসবো, অামার অপেক্ষায়ই যেনো সে ছিলো…
———তোমার কিছু এসেনশিয়াল পেপার রয়ে গেছিলো পুনম, নিয়ে এলাম। ভাবলাম তোমার ওখানে গিয়ে যদি দরকার হয়!? এই ব্যাগে সব অাছে…..
পুনম বিস্ময়ভরা ছলছল চোখে অামার দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে, অামার হাত থেকে ব্যাগটা নিলো।
সেই অনেক বছর অাগের মত কান্নায় ধরে অাসা অভিমানী গলায় বলল,
———ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অামার এক ফ্রেন্ড আছে। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে, টিচার। অহনা! সে নিজেও বেশ চমৎকার মেয়ে। অামি তার সাথে কথা বলেছি, তাঁরও অাপনাকে পছন্দ হয়েছে…..
অামি হেসে ফেললাম। পুনম মোটেও এতে বিচলিত হলোনা। খুবই স্বাভাবিক গলায় অাগের মতই বলতে লাগলো,

———একা অার বোকা সমান। অাপনি কাজের পর বাকী সময়টা অন্তত তাঁর সাথে গল্পও তো করতে পারবেন।

——–ঠিক অাছে, তোমার বান্ধবীকে পাঠিয়ে দিও, এসে থাকবে অামার সাথে।কাজের পর বাকী সময়টা অামি গল্প করবো….

———-এসে থাকবে মানে??? একটা প্রসেস অাছেনা?? এমনি এমনি কি করে??? একটা সিম্পল রেজিস্টৃ করে…..

———বিয়ে তো তুমিও করলে, থেকেছো পাশে পুনম???এবার যে থাকবে সে নাহয় বিয়ে না করেই থাকলো। দেখি কোনটা টিকে???
কি হলো?? তোমার বান্ধবী এভাবে রাজী হবে তো???
পুনম জবাব দিলোনা।

তাঁর চোখ ছলছল করছে, সে সেই বিয়ের দিনের মত নিচু হয়ে শাড়ি ঠিক করার অজুহাতে চোখ মুছলো!
অামি এইবার ভাবলাম, পুনম তিনটি মাস ছুটি নিয়ে কেনো এসেছে??? কোনো বিশেষ কিছু কি বলতে??বাবার অসুস্থতাই যদি মেইন কারণ হতো, তাহলে পরের সময়টা সে কি জন্যে থাকলো??

পুনম চলে গেলো!

অামি বাসায় এসে খাম খুললাম। পুনম হয়তো এতে ও’র বান্ধবীর সিভি রেখে দিয়েছে, অাহারে বেচারী!!
কিন্তু খাম খুলে অামি অবাক!
দুটো চিঠি…….একটি বাবার,অার একটি???
পুনমের…..

বাবার চিঠিটা অামি প্রথম খুললাম। কারণ ওটা স্টেপল করা। বাবা নাম সই করে বন্ধ করে দিয়েছেন।
সংক্ষিপ্ত ভাষার ছোট্ট চিঠি।

হিমেল,
যে কারণে তোমার মা’কে অামি অামার জীবনে এনেছিলাম। পুনমকেও ঠিক সেই কারণে অামি তোমার জীবনে এনেছিলাম। অামার ধারণা ছিলো, তুমি একদম অামার মত হয়েছো! তাই হয়তো অামি যেমন অসীম শক্তি দিয়ে তোমার মা’কে ভালোবেসে গেছি, তুমিও হয়তো বাসবে। কিন্তু….

থাক…

তারপর ও অামি মৃত্যুর পরও বিশ্বাস করতে চাই, যে তুমি অামার মতো হয়েছো! এবার থেকে,
নিজের ভালো থাকার সব ব্যবস্থা তুমি করবে, এটা তোমার কাছে অামার অাবদার রইলো।
ইতি
বাবা।

অপর চিঠিটা পুনমের। পুনমের হাতের লিখা অামি অাগে কখনো দেখিনি। তবু সেই চিঠিটা দেখে অামি বেশ চমকে উঠলাম। কারণ অামার মনে হয়েছিল, এই চিঠিটা পুনম এক বসায় লিখেনি, বা লিখতে পারেনি। একেকবার বসে সে শুধু একেকটি
অক্ষর লিখেছে! পুরো একটা শব্দও সে লিখে উঠতে পারেনি। প্রতিটা অক্ষরে স্পষ্ট দ্বিধা!

অামার চোখ ঝাপসা হয়ো এলো, এই চিঠি পড়ার অাগে একটু মুখ ধুয়ে নেয়া দরকার।

(শেষ পর্ব কাল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here