গল্পঃ অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ৪
বাগানের ঘাসগুলো বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। না কাঁটলে জংলার মতো হয়ে যাবে। তাই ঘাসগুলো কাঁচি দিয়ে ছেটে দেবার চেষ্টা করছিল পিউ। এই কম্ম তার দ্বারা হবার নয়। তবু কসরত করছিল। এছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই। এত বড় বাড়ির দেখাশুনা করার মতো কঠিন কাজ এতকাল জুনায়েদ করেছে, ভাবতেই রীতিমতো ঘাম ছুটে যাচ্ছে তার। অথচ এতদিন সে ভাবত এগুলো কোনো কাজই না! অবশ্য জুনায়েদের জন্য এগুলো আসলেই কোনো কাজ নয়। শক্তসামর্থ মানুষ, ঘাস কাঁটার কাঁচিটা এমনভাবে ধরে যেন হালকা একটা জিনিস। আর সে দুই হাতে ধরেও কাঁচির ভার বইতে পারছে না। একটু ঘাস কাঁটতে গিয়েই জান খারাপ!
আচমকাই তার মনে হলো বাড়ির ভেতর ল্যান্ডফোনটা বাজছে। এক লাফে ভেতরে চলে গেল সে। বসার রুমে একটা কর্ডলেস, আরেকটা বেডরুমে। বসার রুমের দরজায় আবার লক। খালি বাড়িতে থাকতে গেলে এমনিতেই গা ছমছম করে। তার উপর রাতের বেলায় রুমগুলোর দরজা খোলা থাকলে আরো বেশি ভয় লাগে। মনে হয় এই বুঝি রুমের ভেতর থেকে অন্ধকার ফুঁড়ে উদয় হবে কিছু! তাই বেডরুম বাদে অন্য রুমগুলোর দরজা লক করে রেখেছে। বন্ধুবান্ধবরা বা পরিচিত কেউ এলে কিচেনেই বসায় তাদের। এই মুহূর্তে বসার রুমের দরজা খুলে ফোন রিসিভ করার মতো সময় নেই। ফোন বাজছে অনেকক্ষণ যাবত। তাই হুড়মুড় করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে গেল পিউ। বিধি বাম! ফোন রিসিভ করার আগেই লাইন কেটে গেল। হতাশ ভঙ্গিতে বেডসাইড টেবিলের পাশে, ফ্লোরের উপর বসে পড়ল সে। অপেক্ষা করতে লাগল আবার কখন বেজে উঠবে ফোনটা!
আজকাল প্রায়ই একটা কল আসে ল্যান্ডফোনে। রিসিভ করলে কথা বলে না কেউ। প্রথম দিকে কয়েকদিন পিউ কয়েকবার হ্যালো বলে ফোন রেখে দিত। এখন একবার কী দুইবার হ্যালো বলে চুপ হয়ে যায়। ওপাশ থেকেও কোনো সাড়াশব্দ আসে না। বরাবরের মতোই কয়েক মিনিট পর লাইন কেটে দেয় ওপাশ থেকে। কে এভাবে কল করে, পিউয়ের জানা নেই। তবে ওর মন বলে, ফোনটা জুনায়েদ করে। কল করে চুপচাপ ওর কন্ঠস্বর শোনে। এরকমটা মনে হবার পর থেকেই মনের মধ্যে ক্ষীণ আশার আলো জ্বলছে ওর। ল্যান্ডফোনে রিং বাজতে শুরু করলে বাড়ির যে প্রান্তে, যত জরুরি কাজেই ব্যস্ত থাকুক না কেন, ঝেড়ে দৌড় দেয়।
বেডরুমটায় কেমন ঠান্ডা পরিবেশ। গা শিউরে উঠছে পিউয়ের। শীত পড়তে শুরু করেছে একটু-একটু করে। গ্রীষ্মকালের আবহটা আর নেই। শরতের ঠান্ডা আর এলো বাতাসের দাপট চারদিকে। সেজন্যই হয়তো রুমটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাড়ির বাইরে বা নিচতলায় অতটা ঠান্ডা নেই অবশ্য। কাল সারারাত গায়ে লেপ জড়িয়েও শরীর উষ্ণ করতে পারেনি। লেপের তলায় শুয়েও শীত করছিল খুব। যার কারণে ঘুম হয়নি ভালো। হয়তো জ্বর এসেছে। বেশ কদিন ধরেই শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করে, শীত লাগে খুব। বাসায় হিটিং সিস্টেম অন করা দরকার। কীভাবে অন করে, থার্মোস্ট্যাটে টেম্পারেচার কত ডিগ্রীতে সেট করতে হয় কিছুই জানে না সে। এই কাজগুলো সবসময় জুনায়েদ করেছে। এই বাড়ির কোথায় কী আছে, সব জুনায়েদের নখদর্পণে। বাড়ির ভেতরটা সে নিজ হাতে সাজিয়েছে। কখনো কিছু দরকার পড়লে তাকেই জিজ্ঞেস করেছে পিউ। কখনোবা না চাইতেই পেয়ে গেছে হাতের নাগালে। তাই কিছু জানবার দরকার মনে করেনি। হিটিং সিস্টেম অন করার সুইচটা সম্ভবত বেসমেন্টে। কিছুদিন আগে বেসমেন্টের দরজা খুলে উঁকি মেরেছিল। ঘন নিকষ কালো অন্ধকার আর ভুতুড়ে পরিবেশ দেখে পা বাড়াতে সাহস পায়নি। তার জানামতে, বেসমেন্টে লাইট আছে। সেটার সুইচ বেসমেন্টের সিঁড়ির দেয়ালে। সবসময় দেখেছে জুনায়েদ সিঁড়ি বেয়ে বেসমেন্টে যাবার সময় খট করে সুইচ অন করে দিয়েছে। পিউ উপর থেকেই সিঁড়ির দেয়ালে হাতড়ে সুইচ খুঁজেছে দুবার। পায়নি খুঁজে, সুইচটা মনে হয় সিঁড়ির মাঝামাঝিতে। আর আলো না থাকলে নিচের পরিস্থিতি বুঝার কোনো উপায় নেই। যতদুর জানে, বাড়ির নিচে পুরোটা জুড়ে এই বেসমেন্ট। আরেকটা ফ্লোর বলা যায় ওটাকে। এত বড় বেসমেন্টের কোথায় কী আছে, কোথায় কোন সুইচ কে জানে! পিউয়ের ভয় করে, নিচে নামলে যদি হুট করে বেসমেন্টের দরজা আটকে যায়, ভয় আর আতঙ্কে ওখানেই হার্টফেল করে মরবে সে। কেউ আসবে না উদ্ধার করতে। কেউ যে নেই বাড়িতে!
ফোনকলটা মনে হয় আর আসবে না। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। বেলা পড়ে যেতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। আজকাল সুর্য ডোবে আগেভাগে। দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। বেলা গড়িয়ে যাবার আগেই বাগানের কাজ সারতে হবে। নাহ, থাক ওভাবে। আজ আর হবে না কিছু। শরীর টানছে না। ক্লান্ত লাগছে খুব। সকাল থেকে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও এখন আবার জ্বর আসতে শুরু করেছে মনে হয়। চোখ বুজলে ভেতরের গরমটা টের পাচ্ছে। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপা দরকার। প্যারাসিটামলও খেতে হবে। কিন্তু কোথায় সেসব? যতদূর মনে পড়ে, কিচেনেরই কোনো একটা কাবার্ড থেকে মেডিসিন বক্স বের করতে দেখেছিল জুনায়েদকে। ওটায় প্যারাসিটামল পাওয়া যেতে পারে। আশপাশে থার্মোমিটারও পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। কিচেনের ওই কাবার্ডটায় খুঁজতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, কাবার্ডটা উঁচুতে। ওখানে ওর হাত পৌঁছায় না। চেয়ার টেনে উপরে উঠতে হবে। ধ্যাত! এত ঝামেলা করবে কে? তার চেয়ে বরং বাড়ি থেকে দুই কদম হাটলেই “বুটস”। সেখানেই প্যারাসিটামল আর থার্মোমিটার পাওয়া যাবে। নতুন করে কিনে আনলেই হয়! নাহ, বাড়ির বাইরে বের হতে গেলেও জ্বালা! পরনের বাসি জামাকাপড় পালটে, পরিপাটি হতে হবে। শরতের এই সময়ে জ্যাকেট বা ট্রেঞ্চ কোট পরতে হয়। শীতের জামাকাপড়গুলো ক্লজেটের কোথাও গুছিয়ে রেখেছে জুনায়েদ। সেটাও খুঁজতে হবে। তাছাড়া, বাড়ির বাইরে পা দেবার ইচ্ছেটাও নেই। কেন যেন পিউয়ের মনে হয়, সে বাড়ির বাইরে গেলেই ফোনকল আসবে। আবার কখনো মনে হয়, জুনায়েদ হয়ত আসবে। একদিন হুট করে চলে আসবে। তখন সদর দরজায় নক করে যদি সাড়া না পায়, তাহলে কী হবে? জুনায়েদ কি অপেক্ষা করবে ওর ফেরার? নাকি ফিরে যাবে নিজ গন্তব্যে?
চোখটা বারবার বুজে আসছে। ঝিমুনিতে ধরেছে পিউকে। ক্লান্তি এমনভাবে ছেঁকে ধরেছে যে, শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে যাবার শক্তিটুকু নেই। তাই বেডসাইড টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে চুপচাপ। এমন সময় আবার ফোন বাজল। পিউ ধড়মড়িয়ে উঠে ফোন রিসিভ করল। ওপাশের কথা শোনার আগেই হড়বড় করে বলতে লাগল,
– কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি আসো প্লিজ। আমি মরে যাচ্ছি। আমি সত্যিই মরে যাচ্ছি। আমার জ্বর আসছে। আমি কাঁপতে কাঁপতে শেষ। হিটার কীভাবে অন করতে হয় জানি না। তুমি আসো। হিটারটা অন্তত অন করে দিয়ে যাও। প্লিইইইজ, যেখানে থাক, তাড়াতাড়ি চলে আসো। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ…
– হ্যালো… এক্সকিউজ মি…
আচমকা মেয়েলি গলা শুনে থমকে গেল পিউ। তার ধারণা ছিল, ফোনটা করেছে জুনায়েদ। এজন্যই ওভাবে একটানা কথা বলে যাচ্ছিল, যাতে করে জুনায়েদ কল কেটে দেবার সুযোগ না পায়। ওপাশ থেকে আবারো মেয়েলি গলার আওয়াজ,
– হ্যালো পিউ, আমি সুজান।তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?
– হ্যাঁ, সুজান। বলো।
– কী হয়েছে তোমার? কল রিসিভ করে কীসব বলছিলে। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।
– ও কিছু না। বাংলায় কথা বলেছি। আই থট ইট ওয়াজ জুনায়েদ! সো…
– ওহ নো, তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ। জুনায়েদ কেন তোমাকে ফোন করবে?
– জানি না। তবে তোমার কথাই ঠিক। আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি। আর কিছুদিন পর তোমরা আমাকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে রেখে আসবে। বাকিটা জীবন আমি ওখানেই থাকব।
– বাজে কথা বলো না।
– বাজে কথা নয়, জুনায়েদকে খুঁজে না পেলে আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাব।
– কাম অন পিউ! পাগল হলে তাকে খুঁজবে কীভাবে? তাকে খুঁজে বের করার জন্য হলেও তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে। মেন্টালি স্ট্রং হতে হবে। এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না।
– আর কত খুঁজব? এতগুলো দিন ধরে খুঁজে যাচ্ছি।একটু ক্লু পাইনি। এমনকি পুলিশের কাছেও গিয়েছিলাম।
– কেন?
– মিসিং কমপ্লেইন করতে।
– পুলিশ কমপ্লেইন নিয়েছে?
– না। বলল, আমরা যেহেতু সেপারেশনে আছি আর তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে আমার আশপাশে যেন না থাকে, সেজন্য সে অন্য কোথাও মুভ করেছে। হারিয়ে যায়নি।
– স্বাভাবিক!
– তাহলে কী করব আমি? আর কোথায় খুঁজব ওকে? লইয়ারও জানে না সে কোথায়। একটা মানুষ হুট করে বাতাসে মিলিয়ে তো যায়নি! আর কী করব আমি?
– আপাতত রেডি হও।আমি আধঘন্টার মধ্যে তোমাকে পিক করব।
– আমি কোথাও যাব না, সুজান। আমার জ্বর এসেছে। শরীর খারাপ।
– ওটা কোনো প্রবলেম না। তুমি আমার গাড়িতে যাবে। হেঁটে তো যাচ্ছ না। দুটো প্যারাসিটামল খেয়ে নাও।
– প্যারাসিটামল খুঁজে পাচ্ছি না বাসায়। জুনায়েদ কোথায় রেখেছে…
– আচ্ছা, আমি নিয়ে আসব। তুমি জাস্ট রেডি হয়ে দরজার কাছে থাক।আমি হর্ন দিলেই বেরিয়ে আসবে। ওকে?
– নট ওকে! কোথায় যাব?
– এয়ার। ওখানে বিচে বনফায়ার ক্যাম্প করব। রাতে ওখানেই থাকব। কাল ফিরব।
– আমি যাব না।
– ট্রাস্ট মি, পিউ। এয়ারে পা দিলেই তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।
– নাহ! জুনায়েদ ফোন করবে আবার…
– জুনায়েদের থেকে কি জুনায়েদের ফোনকল বেশি ইম্পরট্যান্ট? তুমি কি ওকে সামনাসামনি দেখতে চাও না?
– চাই…
– তাহলে কোনো কথা না বলে রেডি হয়ে নাও।
কথা না বাড়িয়ে কল কেটে দিল পিউ। সুজানের কথাবার্তা শুনে প্রচন্ড বিরক্তি লাগছে তার। এই বন্ধুবান্ধবগুলোই যত নষ্টের মূলে। এদের জন্যই জুনায়েদ সরে গেছে ওর জীবন থেকে। জুনায়েদের হারিয়ে যাবার পেছনে এরাই দায়ী! (চলবে)