স্বামী পর্ব ৮

#স্বামী
#লেখনীতেঃ_নুসরাত_জাহান
#পর্বঃ_৮

কিছুক্ষণ পরে বসা থেকে উঠে আস্তে আস্তে ড্রয়ারের উপরে মোবাইলটা রাখতেই হাত-পা সমানে থরথর করে কাঁপতে লাগল। মনে হচ্ছে পায়ের নিচের মাটি সরে গিয়েছে। মাথাটা হঠাৎ করে ব্যথা করতে লাগল। এত চিন্তা করলে কী কোন মানুষ সুস্থ থাকতে পারে..? হাজারও চিন্তায় মনটা গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে।
মাথা ঘুরিয়ে ফ্লোরে পরে যাওয়ার আগে কোনভাবে পাশে থাকা চেয়ারের উপরে ধপাস করে বসে পড়লাম। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পানি খাওয়াটা খুব জরুরী।
চেয়ার ধরে বিছানার পাশে রাখা জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে আস্তে করে বিছানার উপরে বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। এভাবে ঘন্টাখানেক শুয়ে থাকার পরে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। বাহিরে হালকা হালকা করে বাতাস বইছে।
সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হল।
এখন অনেকটা ভালো লাগছে তাই রান্না ঘরে মায়ের কাছে গিয়ে দেখি তার মুখ ভার হয়ে আছে। বুঝতে পারলাম ছেলের জন্য চিন্তায় পড়েছে। তার ছেলের কর্মকান্ডের কথা যদি জানতে পারে তবে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না সে। সমস্ত কষ্ট বুকের ভেতরে চাপা দিয়ে মাকে বললাম,
– মা আজকে কী রান্না করবেন..?
– সোহানের জন্মদিনে কোন কিছুর আয়োজন তো করিনি যার কারণে সাথী বলল, বিরিয়ানি, রোস্ট, কাবাব আর ফিন্নি রান্না করতে।
– আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই তাই বলুন কী করব..?
– তোর কিছু করা লাগবে না তুই গিয়ে টিভি দেখ।
– একা একা টিভি দেখতে ভালো লাগে না।
– নতুন জায়গাতো তাই এমন লাগছে তবে কিছুদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে।
জান্নাত আমি তোর বাবাকে কল করে বলে দিয়েছি বোর্ডে গিয়ে যেনো তোকে টান্সফার করে আমাদের এখানের কলেজে করিয়ে দেয়। যত টাকা লাগে আমি দিব তাকে।
– আপনার ছেলে কিছু বলবে না..?
– সেটা আমি ম্যানেজ করে নিব তুই শুধু পড়াশুনাকে নিয়ে ভাব।
মায়ের কথা শুনে আনন্দে চোখের কোণে পানি চলে এসেছে। মা দেখার আগেই চোখের পানি মুছে নিয়ে নিরবে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে টিভি অন করে বসলাম।
রিমোট দিয়ে একের পর এক চ্যানেল ঘুরাচ্ছি কিন্তু দেখার প্রতি কোন আগ্রহ পাচ্ছি না। তবুও চ্যানেল ঘুরিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ ঘুরানোর পরে টিভি অফ করে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ঝরণার নিচে হাত-পা মেলে দিয়ে বসে আছি পানির নিচে।
আধা ঘন্টা ভেজার পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ভালো করে চুলগুলো মুছে দিয়ে বেলকুনিতে টাওয়ালটা মেলে দিলাম। বেলকুনিতে ছোট ছোট টব রাখা আর তাতে টাইম ফুল গাছ, লজ্জাবতী, গোলাপ আর একটা বড় টবে লেবু গাছ। গাছগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
ওয়াশরুম থেকে বালতি ভরে পানি এনে প্রতিটা গাছে দিলাম। সাথী ভাবী ভাবী করে সমস্ত রুম খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গিয়ে অবশেষে বেলকুনিতে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– ভাবী তুমি এখানে আর আমি তোমাকে সমস্ত রুম খুঁজে বেড়াচ্ছি।
– আমি তোমার ডাক শুনিনি গাছে পানি দিচ্ছি তো যার কারণে এদিকেই খেয়াল ছিল।
– বেশ তো আমি কী তোমাকে কিছু বলেছি..?
– নাহ্।
– তোমার গাছের পরিচর্যা শেষ হলে আমার সাথে চল তোমাকে একটা জিনিস দেখাব।
– হুম চলো।

সাথীর সাথে ওর রুমে ঢুকলাম।
– ভাবী তুমি বিছানার উপরে বসো আমি আসতেছি।
– ঠিকাছে।
আমি বিছানার উপরে বসে রুমটার দিকে চোখ বুলালাম।
সাথী এসে বলল,
– ভাবী চোখ বন্ধ কর..? তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে..?
– সারপ্রাইজ..!
– হ্যাঁ। আগে চোখ তো বন্ধ কর তারপর দেখ।
আমি চোখ বন্ধ করতেই সাথী আমার গলায় কিছু একটা পড়িয়ে দিল।
চোখ খুলে দেখি স্বর্নের চেইন।
– সাথী চেইনটা কার..?
– আগে আমার ছিল এখন তোমাকে গিফট করলাম। বিয়েতে তো আমি কিছু দেইনি যার কারণে এতদিন এটা সযত্নে রেখে দিয়েছে। ওয়েট করছিলাম তুমি ছোট ভাবীর মতো কিনা! যখন দেখলাম তুমি তার মতো না তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এই চেইনটা একমাত্র তুমি পাওয়ার যোগ্য।
– তুমি তাহলে কী পড়বে..? তাছাড়া বড় ভাবী হয়ে ছোট ননদিনীরটা নেওয়াটা কী ঠিক হবে..?
– চুপপপপ একদম কোন কথা শুনছি না। আমার বেশ কয়েকটা চেইন আছে তাছাড়া এটা আমার ভাবীর জন্য রেখে দিয়েছি।
সোহানের মা এসে বলল,
– জান্নাত তুই এত ফাজলামি করিস কেন..? সাথী যদি সখ করে কিছু দিয়ে থাকে সেটা তুই অমত করার কে..? একদম কথা বলবি না।

আমি উঠে গিয়ে মাকে সালাম করে রুমে চলে গেলাম।

বিকাল ৪.৪০ মিনিটে সোহান বাসায় এসে রুমে ঢুকে প্রথমে মোবাইলটা হাতে নিল। কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটির পরে আমার দিকে রাগান্বিত ভাবে তাকায়।
জান্নাত তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছ কেন…? তুমি জান না বিনা অনুমতিতে কারও মোবাইল ধরাটা ঠিক না।
– ধরছি বলে কী হয়েছে আপনার মোবাইলটা ক্ষয় হয়ে গেছে..? আজকে সারাদিন দিবার সাথে কোথায় বসে কাটিয়েছেন..? হোটেলে নাকি পার্কে..?
– এসব কী বলছ তুমি..?
– ভুল বললাম নাকি..?
– জান্নাত তুমি কিন্তু সব কিছু নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছ। আমার পার্সোনাল জিনিস নিয়ে তুমি ঘাটাঘাটি কম করবে। তুমি তোমার ভাত, কাপড় পেলেই তো হয়।
– ভাত, কাপড় দিলেই কী স্বামীর দ্বায়িত্ব শেষ..?
– হ্যাঁ শেষ।
– আপনি বললেই হবে নাকি! আপনি স্বামী হয়েছেন তো কী হয়েছে..? আপনার যা মন চাইবে তাই করবেন..? আর আমি সেটা মেনে নিব..? আচ্ছা দিবা কী আমার চেয়েও হট..? যার কারণে বিয়ে করার পরেও তাকে ভুলতে পারছেন না।

সোহানের মেজাজ চরমভাবে গরম হয়ে যায়। কথাটা বলে আমার হাতটা চেপে ধরল।
– তোমার এত সাহস..? তুমি আমার সাথে তর্ক কর..? এত সাহস কোথায় পাও..? যার বাবা ফকিরন্নির মতো মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে তার মেয়ের আবার এত দেমাগ কেন..? শোন আমাকে দেওয়ার জন্য তোর শুধু এই শরীরটাই আছে এছাড়া আর কিচ্ছু নেই। আমাকে খুশি করাই তোর কাজ। তোকে বিয়ে করেছি তাই তুই আমার সম্পত্তি। আমার যেমন ইচ্ছে ভোগ দখল করব। যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করব।
– আমার লাগছে সোহান।
– লাগুক। এরপর যদি কখনও আমার মুখে মুখে তর্ক করিস তাহলে তোর খবর আছে।
– আপনার ব্যবহার এত খারাপ..? তুই করে কথা বলাটা কী একজন স্বামীর মুখে শোভা পায়.? আপনি বলুন..?
– জান্নাত আমি কোন কথা শুনতে চাই না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। জান্নাত রেডী হওনি কেন..? আমরা বের হব।
– আমি যাব না।
– তুমি যাবে সাথে তোমার বাপ যাবে।
– দেখেন আমাকে যা ইচ্ছা তাই বলেন কিন্তু আমার বাপ মাকে নিয়ে কিছু বলবেন না। খুব কষ্ট হয়।
– ঠিকাছে বলব না। তাহলে তুমি রেডী হও আমি এখানে আছি।
– আচ্ছা এতো জোড়াজুড়ি করেন কেন..?
– আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না।
– আচ্ছা আপনি একটু বাহিরে অপেক্ষা করেন আমি রেডী হয়ে আসছি।
– আমি বের হব কেন..? তুমি আমার সামনে রেডী হও।

আমি আর কোন উত্তর না দিয়ে আলমারী খুলে সোহানকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা শাড়ি পড়ব না থ্রি-পিচ।
– থ্রি- পিচ পড়।
– ঠিকাছে।

সোহানের সামনে না চাইতেও ড্রেস চেইঞ্জ করে থ্রি-পিচ পড়লাম। হালকার উপরে সাজলাম।
আমাকে দেখে সোহানের ভিমরি খাওয়ার মতো অবস্থা। সোহানের ইচ্ছা হচ্ছে জান্নাতকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে।

আমি সোহানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– আমি রেডী চলেন।
– দাঁড়াও তোমাকে একটু ভালো করে দেখতে দাও।
– আমার কী নতুন রুপ গজিয়েছ..?
– দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।
– চলেন।

আমায় বুঝলেন না সোহান, যখব বুঝবেন তখন হয়তোবা আমি থাকব না।

সোহান রেডী হয়ে নিচে অপেক্ষা করছে। আমি মা আর সাথীকে বলে সিঁড়ি বেয়ে নামছি। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সোহান সিগারেট টানছে। দূর থেকে দেখার পরে সামনে আর পা চলছে না। মানুষটার সাথে চলাফেরা করতেও লজ্জা লাগছে। নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা লাগছে। নিজের বউ রেখে অন্য মেয়ের সাথে ছিঃ ভাবতেও পারছি না সোহানের চরিত্র এতই খারাপ..? কিন্তু কী করব বুঝতে পারছি না।

আমাকে দেখা মাত্রই সোহান সিগারেটটা ফেলে দিল। সোহান ঢ্যাব ঢ্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ভ্রু কুঁচকে সোহানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন..? সমস্যা কী আপনার..?
– বাহ্ রে আমি আমার বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছি অন্য কারও দিকে তো আর তাকাইনি!
– বউ..? আমি কী আপনার বউ হই..?
– বউ নয় তো কী হও..?
– সত্যি আমি আপনাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। আপনি কোন ধাচের প্রাণি সেটা আমি জানি না তবে এতটুকু জানি আপনার মতো বাজে নোংরা চরিত্রের মানুষ আমি কখনও দেখিনি।

সোহান ভ্রু কুঁচকাতে কুঁচকাতে বলল,
– জান্নাত এটা রাস্তা তাই এখানে বসে ঝগড়া করাটা শোভা পায় না।
তোমার মানসম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে তাই যা বলার বাসায় গিয়ে বলবে।

আমি কোন কথা না বলে পিছনের দরজা খুলতে নিলে সোহান আমার হাতটা চেপে ধরল।
– কী ব্যাপার আপনি আমার হাত ধরলেন কেন..?
– ইচ্ছা হয়েছে তাই ধরেছি। কেন ধরেছি তোমাকে কী কৈয়ফত দিতে হবে..?
– যেহেতু আমার হাত তাই কৈয়ফত তো আমাকেই দিতে হবে।
– দেখ জান্নাত, তোমাকে একটু আগেই বলেছি রাস্তায় বসে ঝগড়া না করতে তবুও তুমি প্যানপ্যান করেই যাচ্ছ!
– বেশ তো কিছু বলব না। আগে বলেন পিছনে দরজা খোলার সময় হাত কেন ধরলেন.?
– হাত ধরব না তো কী করব..? তুমি সামনে না বসে পিছনে বসলে কেন..? আমি কী তোমার ড্রাইভার..? তুমি আমার পাশে সামনের সিটে বসবে ওকে।
আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উঠতে নিলে সোহান দরজা খুলে দিল।
সিটের উপরে বসলাম। সোহান আমার সিট বেল্টটা বেঁধে দিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।

গাড়ি চলছে তার নিজস্ব গতিতে। কিছুদূর যাওয়ার পরে সোহান গাড়ি ব্রেক দিয়ে এক সাইড করে দাঁড় করাল। সামনে নিলয়কে দেখতে পেয়ে ডাকল দিল,
– এই নিলয় কই যাচ্ছিস..?
– আরে সোহান যে..?
– হ্যাঁ দোস্ত কেমন আছিস..?
– যেমন তুই রেখেছিস তেমনি আছি..?
– আমি আবার কেমন রাখলাম..?
– এই যে আমার সামনে বিয়ে করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস আমারও তো বিয়ে করতে ইচ্ছা করে।
– এটা তো ভালো কথা তবে আর দেরী কেন বিয়ে করে নিলেই তো হয়!
– হুম কিন্তু কয়েকদিন ঘোরাফেরা করে তারপর না হয় বিয়েটা করতাম। মেয়েটি ভার্জিন কিনা এসব বিষয়ের তো একটা ব্যাপার স্যাপার আছে।
– বিয়ের আগে তুই জানবি কেমনে মেয়েটা ভার্জিন কিনা!
– ওটা তুই বুঝবি না।
– আয় গাড়িতে বস। আমরা মার্কেটে যাচ্ছি তুই ও সাথে চল।
– ভাবী কী বলেন আমি আপনাদের সাথে যাব..?
রাগে কটমট করতে করতে নরমাল ভাবে বললাম,
– আপনার বন্ধু যখন চাচ্ছে আপনি সাথে যাবেন তাহলে আসেন।
– ঠিকাছে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here