#স্বামী
#লেখনীতেঃ_নুসরাত_জাহান
#পর্বঃ_৩৪
জান্নাত মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে। এ কান্না যেন থামার না। শুভ জান্নাতকে থামানোর জন্য এবার মরিয়া হয়ে উঠে কারণ সোহান যদি এপরিস্থিতি দেখে তবে খুব ঝামেলা করবে। তাছাড়া শুভ কোন ঝামেলা চায় না যত তাড়াতাড়ি পারে সবকিছু স্বাভাবিক করাটাই মূখ্য উদ্দেশ্য।
সাথী এসে দরজার সামনে এসে খকখক করে কাশি দিয়ে গলাটা সেরে বলল,
– ভিতরে আসব?
শুভ আর জান্নাত পিছনে ফিরে তাকায়। সাথীকে দেখে শুভ বলল,
– কী তুই আমার নাটক শুরু করলি কবে থেকে? এখানে কী পরপুরুষ আছে যে পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হবে। তোর ঘর তুই যেখানে মন চায় সেখানে ঢুকবি।
সাথী ঠোঁট চেপে ধরে হাসল। কোনভাবে হাসি বলল,
– আপু তুমিও না খুব মজা কর। তোমাকে কে বলল যে এটা আমার ঘর? মেয়ের ঘর তো একটাই আর সেটা হয় বিয়ের পর। স্বামীর ঘরই মেয়েদের ঘর।
– বাব্বাহ, তুই তো দেখছি বড় হয়ে গেছিস। সবকিছু গুছিয়ে বলতে পারিস। তোকে দেখলে কেউ বুঝবে না যে তুই এতটা পাকনি।
– আপুপুপুপু, কী সব বলছ তুমি? আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে।
– সাথী তুই এখন রুমে গিয়ে বিশ্রাম নে আমার জান্নাতের সাথে জরুরি কথা আছে।
– কী জরুরি কথা আপু? আমি কী শুনতে পারি?
– না সাথী, ছোট মানুষদের বড়দের কথা না শোনাই শ্রেয়। তাই বলছি লক্ষ্মী বোন আমার চলে যা।
– তুমি আমাকে ছোট বলছ কেন? আমি কী ছোট নাকি? ছোট হলে তো ফিডার খেতাম। তাছাড়া ভাবীও তো ছোট তাইলে সে শুনলে কোন সমস্যা নাই কেন?
– উফফফ সাথী! এত কথা বলিস কেন? তাছাড়া আমি কী সোহানকে ডেকে আনব?
– না, না আমি নিজেই যাচ্ছি।
সাথী ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি এনে রুম থেকে চলে গেল।
সাথী চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে শুভ চলে যাওয়ার জন্য উঠতে নিলে জান্নাত দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ওয়াক ওয়াক করতে লাগল। শুভ ও জান্নাতের পিছনে ঢুকল দেখল জান্নাত বেসিনের উপরে হাত রেখে বমি করতে লাগল। তাই দেখে শুভ জান্নাতের পিঠ ডলতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে জান্নাত স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। শুভ জান্নাতকে বলল,
– হঠাৎ করে তোমার বমি আসল কেন? গ্যাস্ট্রিক বাড়ল নাকি!
– জানি না আপু।
– এরকম কী আরও হয়েছে?
– জি।
– ডাক্তার দেখিয়েছ?
– নাহ্।
– কেন? এসব নিয়ে কী কেউ অবহেলা করে?
– আমি গতকাল থেকেই বমি করতেছি তবুও আপনার ভাই আজকে আমাকে জোরজবরদস্তি করে নিয়ে এসেছে।
– আমিও জানতাম এমনি কিছু একটা হয়েছে। তুমি চিন্তা করও না আমি ডাক্তারকে বলে রাখছি কালকে সকালে তোমাকে নিয়ে তার চেম্বারে দেখাব।
– লাগবে না আপু।
– লাগবে না বললেই শুনছে কে? কথা বলতে বলতে জান্নাতকে ওয়াশরুম থেকে নিয়ে বিছানার উপরে রাখল। জান্নাত তুমি বিশ্রাম কর আমি মায়ের সাথে কথা বলে সিরিয়াল দিচ্ছি যাতে কালকে কোন সমস্যা না হয়।
– ঠিকাছে।
রাত ১২.০৫ মিনিটে রুমের লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে জান্নাত। মোবাইল লাইটের আলোয় ভিতরে এসে টেবিলের উপরে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিল সোহান। অনেকক্ষণ রুমের ভেতরে পায়চারি করছে সে। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলে সোহান কিছু জিজ্ঞেস না করে দরজয় খুলল। শুভকে দেখে অনেকটা বিস্মিত হল। আপু তুমি?
– হ্যাঁ, জান্নাত কী ঘুমিয়ে পরেছে?
– জানি না আপু, কোন দরকারি কথা আছে?
– জান্নাতের শরীর নাকি ভালো না তাই একটু আগে খুব কষ্টে সিরিয়াল দিলাম। কালকের সিরিয়াল আগে থেকেই বুকিং করা ছিল শুধুমাত্র পরিচিত বলে সুবিধেটা পেলাম। পরিচিত হলে যা হয়।
– আপু জান্নাতের কী হয়েছে? বেশি অসুস্থ? আমাকে জানালে না কেন?
– তোকে কী জানাব? আসার পর থেকে তোর তো কোন পাত্তাই নেই। তাছাড়া তুই তো জানিস গতকাল থেকে জান্নাত অসুস্থ। বমি করছে তবুও তুই জোর করে আজকেই জার্নি করালি। শোন সব বিয়েটা কোন ছেলে খেলা না যে ইচ্ছে হলে খেলবি না হলে ভেঙে ফেলবি। তুই না জান্নাতের স্বামী তাইলে ওর ভালো মন্দ দেখার দ্বায়িত্ব তো তোর? কিন্তু তুই সে দ্বায়িত্ব পালন করিস না।
– আমি খুব লজ্জিত আপু। আমার খুব বড় অন্যায় হয়ে গেছে যার কারণে আমি অনুতপ্ত।
– আরেকটা কথা যেটা তুই মন দিয়ে শোন, জান্নাতের শরীরের কান্ডিশনে কিন্তু খুশি সংবাদটাও থাকতে পারে এই ব্যাপারে কিন্তু সিরিয়াসভাবে নিতে হবে।
– আপু যা হওয়ার হয়ে গেছে। পিছনে যে অন্যায় করেছি সেটা তো আর সংশোধন করা যাবে না কিন্তু এখন আমি নিজেকে সংশোধন করতে পারব। আপু জান্নাত কী খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পরেছে?
– হুম অনেক। মেয়েটার বমি করতে করতে
দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম তৈরি হয়েছিল।
আচ্ছা শোন, রাত অনেক বেশি হয়ে গেছে তুই এখন ঘুমতে যা।
– ঠিকাছে আপু।
সোহান রুমের দরজাটা আটকে তারপর বিছানার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কিন্তু পা কোনভাবেই যাচ্ছে না তবুও টেনে টেনে এগিয়ে গেল। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে তবুও জান্নাতের পাশে শুয়ে পরল।
সকালে সূর্য্যের আলোয় ঘুম ভাঙল সোহানের। আড়মোড়া দিতে হঠাৎ চোখ পরল জান্নাতের দিকে। কী নিঃষ্পাপ চেহার। দেখলে ভীষণ কষ্ট লাগে। আচমকাই সোহানের ফোন বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আননোন নাম্বার দেখে কিছুটা সংকোচ প্রকাশ করে কলটা রিসিভ করে।
– আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনি কী সোহান?
– নিজের নামটা শুনে অনেকটা অবাক হয় তারপর গলার স্বরটা নিচু করে বলল, জি আমি সোহান। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না। কে আপনি?
– আমাকে আপনার চেনা লাগবে না। আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল যদি সময় হয় সামনাসামনি বলতে চাচ্ছি।
অপরিচিত লোকের কথায় কেমন জানি সন্দেহ লাগছে তবুও ইতস্তত হয়ে বলল,
– আপনি তো শুরুতে বললেন আপনি নাকি আমাকে চিনেন না তাইলে আমার সাথে দেখা করে কী বলতে চাচ্ছেন? যদি খোলাসা করে বলতেন তাইলে উপকৃত হতাম।
– সব কথা যদি ফোনে বলা যেত তাইলে তো কোন কথাই থাকত না কিন্তু কিছু কিছু কথা আছে যেটা সামনাসামনি বলতে হয়।
তবুও যখন জানতে চাচ্ছেন কোন বিষয়ের উপরে তাইলে বলি, আপনি যে নিলয়কে খুন করেছেন তার ডুকুমেন্ট আমার কাছে আছে। পুরো সিসিটিভি রেকর্ডের হার্ড ডিক্সের ফুটেজ এখন আমার কাছে। আমি চাইলে এটা মিডিয়াতে ফ্লাশ করতে পারি কিন্তু তাতে আমার কোন লাভ হবে না। তাই ভাবতাম ছোট্ট একটা ডিল করি তাতে আপনারও মঙ্গল আর আমারও কথাটা বলে কুৎসিত একটা হাসি দিল সে।
সোহান তো এখন গ্যারাকলে ফেঁসে গেছে।
কপাল বেয়ে তরতর করে ঘাম পরছে। এদিকে জান্নাত সোহানের পাশে বসল।
– আপনি বসে আছেন কেন? অফিসে যাবেন না?
-“…………”
– আজব তো! কিছু জিজ্ঞাস করছি সেটারও উত্তর দিচ্ছেন না। ঠিকাছে দেওয়া লাগবে না। আচ্ছা আমাকে ডাক্তার কখন দেখাবেন?
-“………..”
– আপনার সমস্যা কী? কথা জিজ্ঞাস করলে উত্তর দিচ্ছেন না। সোহান এবারও উত্তর না দেওয়াতে রাগান্বিত হয়ে বিছানার দিয়ে নেমে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকল জান্নাত। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে সোহানের দিকে একনজর তাকাল। সোহানকে ঘুম থেকে উঠে যেভাবে বসে থাকতে দেখল ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ঠিক সেভাবেই বসে থাকতে দেখল। জান্নাতের এখন কিছুটা হলেও টেনশন লাগছে কিন্তু কী করবে বুঝতে পারছে না। এবার সাহস করে সোহানের গায়ে হাত দিয়ে ঝাকি দিলে এএএএএ করে বলল, কী কী?
– কিচ্ছু হয়নি আপনি এমন ঘামছেন কেন? আপনার কী সমস্যা হয়েছে?
– মনে মনে কিছু একটা ভেবে আবারও চুপ হয়ে গেল সোহান। কিছু হয়নি। জান্নাত মায়ের নাস্তা বানানো কী শেষ?
– জানি না।
– তাইলে দেখে আসো। যদি বানানো হয়ে থাকে তাইলে আমাকে ডাক দিও।
– হুম। জান্নাত রুম থেকে বেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকল। রান্নাঘর খালি কেউ উঠেনি এখনও। জান্নাত মায়ের রুমে ঢোকার কথা চিন্তা করেও আবারও সোহানের কাছে গেল। জান্নাত রুমে ঢোকার পরে সাথী আসল। ভাবি আজকে মায়ের শরীরটা তেমন ভালো না তাই আমি উঠতে নিষেধ করেছি। চলো আমরা দুজনে মিলে নাস্তা বানাই।
– হুম চলো।
জান্নাতকে সাথে নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকার জন্য পা বাড়বে তখনি শুভ এসে হাজির।
– আপু কিছু বলবে?
– জান্নাত তুমি রান্নাঘরে কী চাও?
– মায়ের শরীরটা ভালো না তাই নাস্তা বানাতে সাথীকে সাহায্য করতে এসেছি।
– একদমই না। তোমার শরীরটা কী সুস্থ?
– হ্যাঁ আপু, সুস্থ।
– আগে ডাক্তারের কাছে যাবে রিপোর্টে কী আসবে তারপর সিদ্ধান্ত নিব তুমি সুস্থ কী অসুস্থ বুঝলে।
– আআআআ,,,
– চুপ কোন আপু নাই। একটা কথাও বলবে না এখন রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।
– ঠিকাছে যাচ্ছি।
ত্রিশ মিনিট পরে শুভ নাস্তার ট্রে হাতে নিয়ে রুমে ঢুকল। সোহান বিছানায় বসে পেপার পরছে। গলাটা সেরে নিয়ে রুমে ঢুকল শুভ। আপুকে দেখে পা ভাঁজ করে বসে বলল,
– আপু তুই নিয়ে আসলি যে, সাথী কোথায়?
– ওহ্ রান্নাঘরে নাস্তা বানায়। যে কয়েকটা রুটি ভাজা হয়েছে তাই আমি তোদের জন্য নিয়ে আসলাম।
– তুমি খেয়েছ?
– নাহ্ তোরা খেয়ে নে আমি পরে খাব।
– পরে কেন আপু?
– মা খায়নি, সাথী খায়নি ওদের রেখে কী একা খাওয়া যায় তুই বল?
– হুম তা ঠিক। আচ্ছা আপু তুমি পরে খেয়ে নিও।
– আরেকটা কথা তুই জান্নাতকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে কখন যাবি?
– বিকালে।
– সকালে নিলে হয় না।
– ম্যানেজার স্যার কল করেছেন আজকে ব্যাংকে যাওয়া লাগবে। যাকে ক্যাশের দ্বায়িত্ব দিয়েছিলাম তার জরুরি কাজ পরেছে তাই সে ছুটিতে চলে গেছে।
– ওহ্। আচ্ছা শোন তাইলে নাস্তা করে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিস। আমার মন বলছে নিশ্চয়ই খুশির সংবাদ আসতে চলেছে।
শুভ আপুর কথা শুনে জান্নাত হা হয়ে তাকিয়ে রইল। কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে কী ভাবছে এটা ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় জান্নাত।
চলবে…………..