#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ১৭)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
আমি ঘরে চলে আসলাম। ভাবছি এই উন্মাদ প্রেমিকের উন্মাদনা কিভাবে থামাবো ? ওকে থামানোর দ্বায়িত্ব কি আমার ? আমার হলেও আমি ওকে থামাবো না। বিছানায় শুতে গিয়েও, ঘর থেকে বের হয়ে নিচে গেলাম। একটা ছাতা হাতে করে আমার পা দু’টোকে নির্দেশ দিলাম, তোমার প্রেমে উন্মাদ সেই পাগলের কাছে যাও।
.
বাগানের মাঝে কিছু রঙিন লাইট আছে। যেগুলো এই বৃষ্টির মাঝেও জ্বলজ্বল করে বাগানের ফুল গুলোর সাথে প্রনয় আলাপে ব্যাস্ত। তবে ওদের রঙিন আলোয় আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা কোনো বাগান নয়, এ যেন কোনো রংধনুর দেশ। আর এই বৃষ্টি ভেজা রাত, এ দেশটাকে ভিষন আবেদনময়ী করে তুলেছে। ওহ্ আরিয়ান,,,,, সে তো এই দেশের রাজাধিরাজ। আর আমি সে রাজাধিরাজের রাধা হয়ে তাকে ঘরে নিতে যাচ্ছি।
.
আসলেই তাই,,, ওকে এই বৃষ্টিতে ভিজে কি যে সুন্দর লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না। আমি ধীর পায়ে ওর কাছে গেলাম। ওর মাথায় আমার ছাতা ধরলাম। এক ছাতার মাঝে আমার দুজন। হুম এমনই তো হয় প্রেমিক দম্পতি।
.
আমি ওকে আস্তে করে বলালাম,
— এভাবে বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন ? জ্বর ঠান্ডা লেগে যাবে। আসুন আমার সাথে ঘরে।
.
আমার দিকে শান্ত চোখে তাকালো। ওর চোখ দুটো এতো লাল কেন ? এ কোন ভাষা ওর চোখে এঁকে রেখেছে ? আমি পড়তে পারছি না যে। সে আমার হাত আলতো করে ধরে কাঠের সোফায় বসালো। তারপর আমার সামনে ঘাসের উপর হাঁটু ভাজ করে বসে পরলো। আমার এক হাত ওর দুই হাতের মাঝে বন্দী করে নিলো। তারপর ওর ওর হাত দুটো আমার কোলের মধ্যে রাখলো। আমার অন্য হাত দিয়ে ছাতা ধরে রেখছি।
.
আমাকে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— তুমি এতো নির্দয় কেন পাখি ?
আমার পুরো শরীরে বৃষ্টি বিনা অনুমতিতে ঝাপটা মারছে। কাঁপতে কাঁপতে বললাম,
— কি বলছেন এসব ? আর, আর, আর, ঘরে চলুন। আয়াত একা ঘুমিয়ে আছে।
সে আমার কথায় হেসে ফেললো। আবার শান্ত কন্ঠেই বলতে লাগলো,
— রুমের দরজা বন্ধ করেছিলে আসার সময় ?
— হুম
— তাহলে চুপ করে আমার সামনে বসে থাকো। আর এসব কি হ্যা ? (এটা বলেই ছাতাটা কোথায় জানি টান মেরে ফেলে দিলো)
.
এইবার তো বৃষ্টিরা অনুমতিও পেয়ে গেলো আমাকে ভিজানোর। আরিয়ান ওর মাথাটা আর একটু এগিয়ে নিয়ে আমার কোলের কাছে নিয়ে আসলো। আর আমার মাথা, চুল, নাক, ঠোঁট থেকে বৃষ্টির পানি চুয়িয়ে চুয়িয়ে ওর সারা মুখে পরতে লাগলো। ও নিজের চোখ বন্ধ করে খুব সুন্দর একটা হাসি দিলো। তারপর চোখ খুলে আমাকে বলতে লাগল,
— আচ্ছা তোমার মায়া হয় না তাই না ! আমি যে তোমার প্রেমে তোমারই চোখের সামনে অনবরত পুড়ছি, তোমার হৃদয়ের এক ফোটা প্রেমের জন্য তরপাচ্ছি। তুমি তাতে খুব মজা পাও তাই না ! বলো !
— ………… (নিশ্চুপ)
— এই নিষ্ঠুর মেয়ে আমার উত্তর দাও !
— আমি আপনার বিয়ে করা স্ত্রী। আমার উপর আপনার অধিকার আছে। (চোখটা খিঁচে বন্ধ করে বললাম)
.
ও আমার কথায় হাসতে লাগলো। আর হাসতে হাসতেই বললো,
— জানি অধিকার আছে, কিন্তু অনুমতি ?
তারপর আবারও হাসতে লাগলো। হাসির ভাবখানা ঠিক এমন ভাব প্রকাশ করছে যে, সে তার পুজোর প্রসাদ নিজে হাতে তুলে নিবে না যদিও প্রসাদের সম্পূর্ণ অধিকার তার আছে, পূজারী যদি প্রসাদটা তার সামনে তুলে ধরে তবেই সে গ্রহণ করবে।
.
তারপর আমাকে বলতে লাগলো,
— জানো পাখি আমি তোমাকে ছাড়া অন্যকিছুই ভাবতে পারি না। ভালোবাসি তোমাকে। তোমাকে নিজের করে পেতে আমি মরিয়া হয়ে গিয়েছি। কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করি তা আমার এই হৃদয় জানে। (একটু থেমে) আচ্ছা পাখি তুমি আমাকে ভালোবাসো না তাই না ? এই বলো না, তুমি আমাকে কবে একটু ভালোবাসবে ?
— ……. (নিশ্চুপ)
— একটু দেখো তাকিয়ে আমাকে। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমাকে একটু ভালোবাসো না প্লিজ। আমার বুকে খুব ব্যাথা করছে। অসহ্য এ ব্যাথা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে পাখি খুব।
.
তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখ দুটো। মনে হলো ওর চোখে পানি, আর আমি বৃষ্টির পানির মাঝেও ওর চোখের পানিকে আলাদা করে গুনতে পারছি। বুকটা জ্বলছে। আর ব্যাথাও করছে।এমন ব্যাথায় কি আরিয়ানের হচ্ছে ? না কি আরও বেশি। আমি পারছি না আর সহ্য করতে। ওর হাত থেকে আমার হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে পরলাম। চার পাঁচ কদম দৌড়ে ওর থেকে দূরে চলে আসলাম।
.
পিছন থেকে শুধু একবার ওর ভেজা কন্ঠে আমার নামটা শুনলাম, “পাখি”। আমার মস্তিষ্ক বললো, দৌড়ে চলে যাও ওই উন্মাদের প্রেমের বলয় ভেদ করে। কিন্তু কেন জানি আজ আমার মস্তিষ্ক হেড়ে গেলো আমার মনের কাছে। আমি দৌড়ে চলে গেলাম আরিয়ানের কাছে। ওকে দু’হাত দিয়ে জরিয়ে ধরলাম। আমি ওর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকলাম। ও আমাকে আরো শক্তো করে জরিয়ে ধরলো। যেন আমাকে ওর বুকের খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে চাই।আমি ওর মুখ দেখতে পারছি না। তবে আমি জানি ওর চোখে পানি। বেশ কিছুক্ষন আমরা সেভাবে থাকলাম। ধীরে ধীরে বুকের ব্যাথাটা মিলিয়ে যেতে লাগলো।
.
ও নিজের দু’হাতের আজলায় আমার মুখটা উঁচু করে আমাকে দেখতে লাগলো। আমাকে খুব ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
— আমি তোমার অনুমতি পেয়েছি তাই না জান ?
আমি বৃষ্টিতে ভিজে থাকা ওর জবজবে সার্টটা মুঠ পাকিয়ে শক্ত করে ধরলাম। চোখটা বন্ধ করলাম। সে হাসলো। হঠাৎ করে আমার কপালে ওর ঠোঁটের ছোয়া পেলাম। তারপর গালে। মনে হলো, আমার মেরুদণ্ড বেয়ে কয়েক টুকরো বরফ নেমে গেলো। আমাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে ঘুরাতে লাগলো। আর বলতে থাকলো, “দেখো বৃষ্টি আমি পেয়ে গেছি আমার পাখিকে। এখন আর আমার হৃদয় জ্বলবে না। আমি পেয়ে গেছি আমার ভালোবাসাকে।”
.
তারপর আমাকে কোলে করেই বাড়িতে ঢুকলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আয়াতের রুমে নিয়ে গেলো। আমাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে আমার উপর উবু হয়ে আমার ঠোঁটে গভীর চুম্বনে অধীর হয়ে গেল। আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দৌড় দিলাম দরজার কাছে। কিন্তু আরিয়ান আমাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে আমার পিঠে ওর মাথা ঠেকিয়ে বলতে লাগলো, “আর কতো তরপাবে আমাকে।”
.
বৃষ্টির গন্ধে আর বিদ্যুৎ এর আলোয় চারিদিক আবেদনময়ী ছিলো সারা রাত। ঝোড়ো হাওয়া যেমন বাইরে বয়েছিলো, ঠিক তেমনই সারারাত ঐ ঝোড়ো হাওয়া আমাদের বুকেও বয়ে গেছে। আমাকে নিজের করে নিয়ে, আমার উপরেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো আরিয়ান। ফজরের আজান শুনে সে উঠে বসলো আমার উপর থেকে। আমরা একসাথে গোসল করে অজু করে নিলাম। আর একসাথেই নামাজ আদায় করলাম। যেন ভালোবাসার নতুন এক অধ্যায় শুরু হলো।
.
সকাল থেকেই আরিয়ান বেশ উৎফুল্ল। আয়াতকে নিয়ে সারা বাড়ি দৌড়ে দোড়ে খেলে বেরাচ্ছে। আমি সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিলাম। নাস্তা শেষে আরিয়ান ডিউটি তে যাওয়ার জন্য ওকে তৈরী হতে সাহায্য করলাম। এটা অবশ্য আমার প্রতিদিনের কাজ। কেননা এ বাড়িতে আশার পর থেকেই আমি ওর ঘর গোছায় তাই আমাকেই ওর সব জিনিস এগিয়ে দিতে হয়। কারণ নিজের জিনিস খোঁজার ক্ষেত্রে আরিয়ান অন্ধ। তবে ওর পাশে থাকতে আমার কেমন জানি অন্য অনুভুতি হচ্ছিলো। কেমন জানি,,,, কেন এমন হচ্ছে ? কাল রাতের জন্য ? হয়তো…
.
ডিউটিতে যাওয়ার আগে আরিয়ান আয়াতকে কোলে নিয়ে ওকে চুমু খেলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আমার গালেও একটা চুমু দিলো। আর সাথে একটা চোখ মেরে দিলো। যদিও এতে আয়াতের কোনো মাথা ব্যাথা নেই, সে তার বাবার ইউনিফর্মে লাগানো সাহসিকতার স্বর্ণ রৌপের ব্যাচ গুলো নিয়ে খেলতে ব্যাস্ত। কিন্তু আমার ঠোঁটে মুচকি হাসি চলে আসলো আপনা আপনি। আমার কোলে আয়াতকে দিয়ে সে তার গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে আমাদের বিদায় জানালো। আমরাও বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে বিদায় জানালাম। ও চলে যাওয়ার পর পিছন ঘুরে দেখলাম মা দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। বিড়াল যেমন মাছের গন্ধ শুকতে থাকে, ঠিক তেমন ভাবে মা আমার কাছে নাক কুঁচকে কুঁচকে আসলো। তারপর আমার গাল হাল্কা টেনে বলতে লাগলো,
— চারিদিকে কেমন জানি প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি। উম্ হুম্ বিষয় টা দেখতে হচ্ছে।
আমি সাথে সাথে তার গালে চুমু দিয়ে বললাম,
— আমি যে উপর তলার কর্নারের রুম থেকে রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা প্রেম প্রেম গন্ধ পায়। তার বেলায় ?
.
আমার কথা শুনে সে হাসতে লাগলো। মজা করতে করতে ভিতরে গেলাম।
.
এভাবেই হাসিতে খুশিতে কেটে গেলো সাত টা মাস। তবে আমি এখন ব্যপক চিন্তায় আছি। কি সিদ্ধান্ত নিবো বুঝতে পারছি না। কারন আমি পর পর দুই মাস আমার পিরিয়ড মিস করেছি। সন্দেহের বশে নিজেই বাড়িতে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করেছি যার রেজাল্ট পজেটিভ। আরিয়ানকে এ বিষয়ে কিছুই জানাই নি। সে কখনোই আমার পেটে থাকা তার বাচ্চাকে এবারোশান করতে দিবে না। কিন্তু আমি যে এই বাচ্চাকে জন্ম দিতে চাই না। এমন টা না যে আমি খুশি হইনি আমার মাতৃত্বের খবর জেনে। আসলে আমি চাই না যে আয়াতের সাথে কোনো অবিচার হোক। যদি আমি নিজের সন্তান জন্ম দিয়ে সার্থপর হয়ে যায়। যদি আমার নিজের সন্তানকে বেশি ভালোবাসি। যদি আয়াতকে অবহেলা করতে শুরু করি। যদি আরিয়ানও আয়াতের প্রতি কোনো অন্যায় করে। যদি, যদি, যদি,,,,,,।
.
তখন আমার আয়াতের কি হবে ? একা একা আমার কলিজা টা যে মরে যাবে। বাঁচতে পারবে না। নাহ্ আর ভাবতে পারছি না।
.
আমি মাকে বলে একাই বাড়ি থকে বের হয়েছি।বলেছি আম্মুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। কিন্তু আসলে আমি যাচ্ছি একটা প্রায়ভেট ক্লিনিকে। একজন গাইনোলজিস্ট এর কাছে। অনলাইনে এপোয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলাম এবারোশান করানোর জন্য। আমাকে আজকের ডেট দিয়েছে। আমি জানি আমি অনেক বড় পাপ করতে যাচ্ছি। কিন্তু আমার কাছে অন্য কোনো অপশন নাই। আরিয়ানকে তো জানায়নি। ওর যে রাগ, যদি একবার জানতে পারে আমি ওর সন্তানকে খুন করতে যাচ্ছি। তাহলে তো আমাকে মেরেই ফেলবে……
·
·
·
চলবে…………………..