#প্রহেলিকা
#পর্ব_০৫
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————-
ইনশিতা ফোন কানে নিয়ে বলল,
-“কিরে, পুচকু। কেমন আছিস? হঠাৎ এখন ফোন দিলি? সব ঠিকঠাক আছে তো?”
ওপাশ থেকে তুহিনের ক্রন্দনরত আওয়াজ শোনা গেল,
-“নয়ন আপুকে পাওয়া যাচ্ছে না আপু। কলেজ থেকে এখনও পর্যন্ত বাসায় ফিরেনি। তোমাদের বাড়িতেও খোঁজ করেছিলাম কিন্তু ওখানেও নাকি যায়নি।”
তুহিনের কথা শুনে আঁতকে উঠলো ইনশিতা। জেহেরকে দেখার পর সেই যে দৌড়ে এসেছিল এরপর থেকে নয়নিকা দেখেনি সে। বাসাতেও যায়নি, তাহলে কোথায় গেল মেয়েটা!
-“ভালো করে খোঁজ নিয়েছিস তো? দেখ হয়ত কোনো ফ্রেন্ডসদের বাসায় আছে।”
-“আমি সবার বাসায় খোঁজ নিয়েছি আপু, কিন্তু কোথাও নেই। এমনকি আপুর মোবাইলও বন্ধ। মা বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বাবাও শহরে নেই যে বলবো।”
বলেই কাঁদতে লাগল তুহিন। এদিকে ইনশিতার মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। বাড়িতে না গেলে কোথায়ই বা যাবে? তার মাঝেই আরেকটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। তুহিনকে শান্তনা দিয়ে ফোনটা কাটতে বলে আননোন নাম্বারটা কিছু না ভেবেই রিসিভ করে নেয়। হ্যালো বলতে নিবে তার আগেই বিপরীত দিক থেকে পরিচিত একটি কন্ঠ শোনা যায়।
-“হ-হ্যালো ইতু।”
ওপাশ থেকে নয়নিকার কন্ঠস্বর পেতেই ইনশিতা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
-“নয়ন! তুই! তুই কোথায়? সকলে তোকে কত খুঁজছে জানিস? আর তোর নাম্বার বন্ধ কেন? এটা কার মোবাইল থেকে ফোন দিয়েছিস? তুই কোথায় আছিস সেটা বল।”
-“ইতু ইতু, শোন। আ-আমি এখন আমাদের পুরোনো বাড়িটায় আছি।”
-“ওখানে কি করছিস? ওখানটা তো অনেক নির্জন। আর তোর কন্ঠ এমন কাঁপছে কেন? আমি তুহিনকে বলছি, ও তোকে গিয়ে নিয়ে আসবে।”
-“কাউকে বলা লাগবে না ইতু। ত-তোকে একটা কথা বলছি শোন। তুই যেখানে আছিস সেখান থেকে কোত্থাও…।”
-“হ্যালো, হ্যালো নয়ন। কি বললি? হ্যালো!”
ওপাশ থেকে ফোন কাটার আওয়াজ এলো। ইনশিতা ওই নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন দিল;তবে কেউ তুললো না। রাফিদসহ তার বাবা মা চেয়ে আছে ইনশিতার দিকে। ইনশিতা ঘটনাটা খুলে বলল। তার মাঝে আবারও হঠাৎ ওই নাম্বার থেকে ফোন আসল। বিলম্ব না করেই ফোন তুলল ইনশিতা। ওপাশ থেকে নয়নিকা বলল,
-“ইতু!”
-“নয়ন তুই প্লিজ বাসায় চলে যা। আমি তুহিনকে বলছি..।”
-“ইতু, ত-তুই একবার আসবি প্লিজ? পুরোনো বাড়িটায় একবার আসবি?”
বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল নয়নিকা। নয়নিকার হঠাৎ কান্নায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। কোনো বিপদ হয়নি তো নয়নের!
-“নয়ন। তোর কি হয়েছে? বল আমায়। তুই ঠিক আছিস তো।”
-“তুই এখানে চলে আয় ইতু।”
কথাটির পরে আরও একটি কথা ফিসফিসিয়ে বলল নয়নিকা। তবে কি বলল ধরতে পারল না ইনশিতা।
-“তুই চিন্তা করিস না, আমি এক্ষুনি আসছি।”
ফোন কেটে দিল ইনশিতা। রাফিদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“কোথায় যাওয়ার কথা বলছো তুমি?”
-“আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে ভাইয়া। আমি শিওর নয়নিকা কোনো বিপদে পড়েছে।”
-“এত রাতে কিভাবে যাবে?”
-“আমি কিচ্ছু জানি না ভাইয়া। কিচ্ছু না, এখন আমাকে যে করেই হোক যেতে হবে।”
বলেই হু হু করে কেঁদে দিলো ইনশিতা। ইনশিতার কান্না দেখে না করতে পারে না চাচি। রাফিদকে ইনশিতার সাথে যেতে বলে। নয়নিকাদের পুরোনো বাড়ির ঠিকানা পেতেই সেদিকে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চলল রাফিদ। সারা রাস্তা কেউ একটা কথাও বলেনি। ইনশিতা শুধু ছটফট করছিল আর ঐ নাম্বারটাতে ফোন করছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো ঐ নাম্বারটা এখন বন্ধ দেখাচ্ছে।
আর রাফিদ আড়চোখে কয়েকবার ইনশিতাকে দেখে নিলো। ইনশিতা বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকায় জানালার কাঁচে ইনশিতার অবয়ব দেখে নিলো রাফিদ। কান্নার কারণে চোখ দুটি ফুলে উঠেছে। মুখ লাল হয়ে গেছে। রাফিদের মনে হচ্ছে এখন বের হয়ে ভালোই করেছে। কিছুটা সময় কাটানো যাবে ইনশিতার সাথে। এছাড়া বাকি সময়টা তো তার সাথেই কাটাতে হবে ইনশিতার। ভাবতেই মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। ইনশিতার সাথেই তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। যদিও এটা ইনশিতা জানে না। একমাত্র ইনশিতার বাবা মা আর তার বাবা মা-ই জানে। এছাড়া রাফিদও জানতো না। লুকিয়ে শুনে নিয়েছিল সে। এরপর থেকেই ইনশিতাকে দেখলে নিজের মনে অন্যরকম একটা অনুভূতির উপস্থিতি টের পেত সে। এক…এক অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি। কাউকে বোঝানো যায় না সেই অনুভূতি। বুকের ভিতর মনে হত দ্রিম দ্রাম করে বেজে চলছে। ইনশিতাকে দেখলে মনে হত এই মেয়েটাকে নিজের বুকের মাঝে বেঁধে রাখতে। কেন জানি না রাফিদের মনটা বারবার কু ডাকছে। তার মনে হচ্ছে তার ইনশিতাকে কেউ তার থেকে কেড়ে নেবে। ইনশিতাকে তার কাছ থেকে নিলে তো সে পাগল হয়ে যাবে। ইনশিতাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে যে সে!
নয়নিকাদের পুরোনো বাড়িতে এসে থামলো গাড়িটা। ইনশিতা দৌড়ে বাড়ির ভেতরটায় গেল। রাফিদও আসলো পিছনে। ধূলিময় বাড়িটা প্রায় তিন বছর ধরে খালি পড়ে আছে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে পুরো ঘরটা। মনে হচ্ছে ভুতের বাড়িতে প্রবেশ করেছে তারা। মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে নেয় রাফিদ। হঠাৎ করেই ইনশিতার ফোন বেজে উঠলো। দেখল ঐ নাম্বার থেকেই ফোন এসেছে।
-“উপরের কোণার রুমটায় চলে আয়।”
প্রচুর পরিমাণে অবাক হলো ইনশিতা। তারা যে এখানে এসেছে সেটা নয়নিকা কিভাবে জানলো? আর জানলে ডাক দিলো না কেন? বিস্ময় কাটিয়ে দুজনেই উপরে উঠর জন্য ছোট্ট সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। ইনশিতার ভয়ে পা কাঁপছে অনবরত। আচমকা রাফিদ ইনশিতার হাত নিজের এক হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। ইনশিতা অবাক হলেও কিছু বলল না। এই ছোঁয়া যেন তাকে বলছে‘ভয় পেয়ো না, আমি আছি তো।’
দুজনেই কোণার রুমটার সামনে পৌঁছলে দরজাটা হাট করে খুলে যায়। ভয় পেয়ে রাফিদের হাত জোরে খামচে ধরে ইনশিতা। রাফিদ ইশারায় শান্ত হতে বলল। তার কেন যেন মনে হচ্ছে তার ইনশিতা এখনি তার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে চেপে ধরল সে।
অন্ধকারের মাঝে হলুদ টিমটিমে ম্লান আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে রুমের মাঝখানটা। ঝাপসা আলোকিত। তার মাঝে মনে হচ্ছে কেউ একজন হাত চেপে মাথা নিচু করে বসে আছে। নয়নিকা!
ইনশিতা দৌড়ে গিয়ে নয়নিকাকে ধরে বলল,
-“নয়ন! এই নয়ন! কি হয়েছে তোর? হাতে ব্যান্ডেজ কেন?”
রাফিদ গিয়ে ইনশিতার পাশে দাঁড়ালো। নয়নিকা হাত ধরে কাঁদছে। কেঁপে উঠছে তার শরীর। ম্লান আলোর মাঝেই আরেকজন মেয়ের অবয়ব দেখতে পেল তারা। হাতে কিছু একটার বক্স হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এটাতো জেবা! মুখটা কেমন পাংশু হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো অশুভ কিছু ঘটবে সেই আশঙ্কায় ভয় পেয়ে আছে।
-“তুমি এখানে? কি হয়েছে এখানে? নয়নিকার হাতে ব্যান্ডেজ কেন? আর এখানেই বা তোমরা কি করছো?”
জেবা কিছু না বলেই রুমের কোণাটার মাঝে চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। হলুন ম্লান আলোয় রুমের কোণাটা একদম অন্ধকারে ডুবে আছে। দেখা যাচ্ছে না কিছু। তবে চেয়ার দোলার আওয়াজ আসছে। ইজি চেয়ার দুলছে। কেমন অদ্ভুত আওয়াজ করে দুলছে। সেই চেয়ারে থাকা মানুষটাকে শত চেষ্টা করেও ইনশিতা দেখতে পেল না। হুট করেই দুহাতে কান চেপে ধরলো ইনশিতা। রাফিদও ধরলো নিজের কর্ণদ্বয়। হারমোনিকার সুর ভেসে আসছে ঐ ইজি চেয়ারে বসা লোকটার থেকে। তবে সুরটা অদ্ভুতের সাথে ভয়ঙ্কর। বিভিন্ন হরর মুভিতে কয়েকটা সুর থাকে যেগুলো শুনলে ভয়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়, শরীর শিউরে ওঠে তেমনি এই আওয়াজটা। এতটা ভয়ঙ্কর যে ইনশিতার মনে হচ্ছে সে এখানে না আসলেই ভালো হতো। এই ধরনের গা হিম করা সুর সে সহ্য করতে পারে না একদম। এমনকি এই ভয়ানক সুরটা রাফিদও সহ্য করতে পারেনি। যদিও সে এসব আওয়াজে ভয় পায় না তবুও এই আওয়াজটা এমন যে ভয় পেতে বাধ্য করে। নয়নিকা, রাফিদ, ইনশিতা কানে হাত দিয়ে রয়েছে একমাত্র জেবা ছাড়া। সে শুধু চোখ খিঁচে আছে।
প্রায় বেশ খানিকটা সময় পর সুরটা থামলো। ইনশিতার শরীর কাঁপছে। রাফিদ দ্রুত গিয়ে ইনশিতাকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরল। কারণ সে জানে এই ধরনের সুরে ইনশিতা প্যানিক হয়ে যায়। ভয়ে কান্না করে দেয়। তাইতো ছোট থেকে কোনো হরর মুভি দেখে না সে। দেখলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে। রাফিদ ইনশিতাকে শান্ত করার জন্য ইনশিতার দুই গালে হাত রেখে বলতে লাগল,
-“ইতু। ইতু.. তাকাও আমার দিকে। এই দেখো না, এই..এই ইতু।”
ইনশিতার শরীর কাঁপাকাঁপি যেন আরও বাড়ছে। সে কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। ঠিক সেই সময়ে ইনশিতার সামনে এসে দাঁড়াল কালো রঙের সু পরা একজোড়া পা। ইনশিতা মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল লোকটির এক হাতে ছোট একটি হারমোনিকা। আর অপর হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকানো। লোকটির মাথার উপরে দুলছে হলুদ লাইটটি। ইনশিতা কাঁপা কাঁপা পায়েই দাঁড়াল। রাফিদও দাঁড়িয়েছে। সে এখনো ইনশিতাকে ধরে রেখেছে।
তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জেহের। জেহেরকে দেখতেই চমকে গেল ইনশিতা। ঘাড় কাত করে তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। জেহেরকে দেখে শরীরে যেন আর শক্তি পেল না ইনশিতা। অবশ হয়ে আসতে লাগল। রাফিদ শক্ত করে ইনশিতার শরীর নিজের দিকে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। সামনে থাকা অচেনা এক হিংস্র চোখের অধিকারী মানুষটির দিকে আবদ্ধ তার দৃষ্টি।
.
.
বিকেলে জেহের ইনশিতাকে খুঁজে না পেয়ে নয়নিকাকে তুলে এনেছিল এই বাড়িটায়। যদিও সে জানতো না যে এটা নয়নিকাদের পুরনো বাড়ি। পরে জেনেছে। নয়নিকা তো চরম রকমের অবাক। তবে নিয়ে আসার সময় সে টু শব্দ টুকুও করেনি। কেন করেনি সে নিজেও জানেনা। সে তখন জেহেরের মত সুদর্শন পুরুষকে দেখায় ব্যস্ত ছিল। বাড়িটাতে এনেই সর্বপ্রথম নয়নিকার গালে ঠাটিয়ে একটা চড় মেরেছিল জেহের। সেই চড়েই যেন হুশ ফিরেছিল নয়নিকার। তবে কিছুই বলতে পারছিল না কারণ তার হাত, মুখ আগেই বেঁধে দিয়েছিল জেহের। তারপর ভাঙ্গা কাঁচ নিয়ে নয়নিকার হাতে টান মেরে দিল যে হাতে ইনশিতাকে ধরেছিল। সেই হাতেই আরো অনেক পোচ দিল সে। নয়নিকার হাত থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে, চিৎকার দিতে চেয়েও পারছে না। জেহেরের রাগ বেড়েই চলেছিল। তার মাথায় ঘুরছে কেন মেয়েটা তার রোজের হাত ধরবে।
এক পর্যায়ে ক্ষান্ত হয়ে থেমে গেল সে। তার রোজকে নিজের কাছে আনার জন্যই নয়নিকাকে নিয়ে আসা। তাই আগেই নিজের রাগ মিটিয়ে নিল। জেবাকে ফোন করে এইড বক্স আনতে বলল। জেবা আসতেই হতবাক হয়ে যায় নয়নিকাকে দেখে। জেহের ইশারায় করলো নয়নিকাকে ব্যান্ডেজ করিয়ে দিতে। সেও কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ নয়নিকার হাত ব্যান্ডেজ করে দিল। কারণ কোনো প্রশ্ন করলেই যদি জেহের তাকেও নয়নিকার মতো অবস্থা করে দেয় সেই ভয়ে। সে তো চিনে তার ভাইকে।
তারপর নয়নিকাকে জেহের নিজের মোবাইল দিয়ে ইনশিতাকে ফোন করতে বলে। নয়নিকা অনেকবার বারণ করলে তার গালে আরো কয়েকটা চড় পড়ে। পুরুষালী হাতের চড় খেয়ে নয়নিকার ঠোঁট ফেটে যায়।
নয়নিকাকে দিয়ে ইনশিতাকে ফোন করানোর সময় নয়নিকা বলতে নিয়েছিল যাতে ইনশিতা ঘর থেকে কোত্থাও না বের হয়। যেখানে আছে সেখানেই থাকতে। কারণ নয়নিকা ইনশিতাকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে। আর সে চায় না জেহেরের মতো কোনো সাইকোর হাতে তার বোনকে তুলে দিতে। তাই কৌশলে ইনশিতাকে বের হতে বারণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই কথাটা বলার আগেই জেহের মোবাইল টান মেরে নিয়েছিল। ইনশিতাকে যদি কোনো রকমে বারণ করা হয় তাহলে জেহের তার ভাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। না চাইতেও ইনশিতাকে আবার ফোন করে আসতে বলেছিল। শেষে ফিসফিস করে বলেছিল যাতে না আসে তবে সেই কথাটা এতই আস্তে ছিল যে ইনশিতা শুনতে পায়নি। তারপর জেহের গিয়ে একটি পুরোনো ইজি চেয়ারে বসে পড়ে। আর জেবা নয়নিকার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে।
.
.
একটা অচেনা ছেলের সাথে তার রোজ আসায় প্রচন্ড রেগে যায় জেহের। আর যখন ছেলেটি রোজকে জড়িয়ে ধরে তখন জেহের রাগ সপ্তমে। ঘাড় কাত করে তাকায় তাদের দিকে। কপালের রগ ফুলে উঠেছে তার। রাগে সারা শরীর রি রি করছে। ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। তবে নিজেকে শান্ত করলো। কারণ এখন তার সবচেয়ে জরুরী কাজ হলো তার রোজকে নিয়ে যাওয়া। তারপর না হয় এই বেয়াদব ছেলেটাকে শাস্তি দেওয়া যাবে।
জেহের একটু এগিয়ে গিয়ে ইনশিতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। একদম সামনে। তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব বোধহয় দুই কি তিন ইঞ্চি হবে। তারপর ঘাড় অন্যদিকে কাত করে ফু দেয় ইনশিতার মুখে। শীতল বাতাসে ইনশিতা কেঁপে ওঠে। মুখের সামনে থাকা চুল গুলো উড়ে পেছনে ঠেকে সেই বাতাসে। রাফিদ ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে একহাত দিয়ে সজোরে ধাক্কা দেয় জেহেরের বুকে।
আচমকা ধাক্কা সামাল দিতে ইনশিতাকে টেনে ধরলো জেহের। ইনশিতার সরু দেহ জেহেরের শক্তিশালী দেহের টান সামলাতে পারলো না। দুজনেই পড়লো নিচে। জেহেরের উপর ইনশিতা। জেহেরের বিশালাকার দেহের উপর পড়লো ইনশিতা। পড়ার সাথে সাথেই ইনশিতা উঠে দাঁড়াতে চাইলো। উঠতে পারলো না জেহেরের জন্য। সে তার শক্ত হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে ইনশিতার কোমড়। ইনশিতার মাথা নিজের কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“তুমি আমার উপর পড়ায় একটুও ব্যাথা পাইনি রোজ। তোমার শরীরে একটুও ওজন নেই। টেনশন নট, কয়দিন পর তোমার ওজন এমনিতেই বেড়ে যাবে।”
বলেই ঠোঁট কামড়ে হাসলো জেহের। জেহেরের এমন কথায় দ্রুত উঠতে গিয়েও উঠতে পারলো না, কারণ জেহের ধরে আছে। মিনতি করে ইনশিতা বলল,
-“লাগছে আমার, ছাড়ুন।”
ইনশিতার কথা শুনে জেহের দ্রুত ইনশিতাকে উঠিয়ে দিল। অস্থির হয়ে বলতে লাগল,
-“কোথায় লেগেছে রোজ? বেশি ব্যথা করছে? বলো..বলো আমায়। রোজ।”
বলেই জেহের ইনশিতার কোমড়ে হাত দিতে নিল। ইনশিতা তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে রাফিদের পেছন দাঁড়াল। ইনশিতাকে রাফিদের কাছে যেতে দেখে জেহের আরও বেশি রেগে গেল। রেগে ইনশিতাকে ধরতে গেলেই বাঁধ সাধে রাফিদ। রাফিদ নিজেও রেগে আছে এই অচেনা ছেলেটার উপর। নয়নিকা আর জেবা শুধু ভয়ে তটস্থ। যেদিকে নয়নিকা মেয়ে হয়ে ইনশিতাকে ধরায় এত ভয়ানক কাজ করেছে তাহলে রাফিদকে কি করবে সেটা ভাবতেই দুজনে ভয়ে শিউরে উঠল।
জেহের ঘাড় কাত করে তাকিয়ে রইল রাফিদের দিকে। দৃষ্টিটা ইনশিতার কাছে ভালো ঠেকলো না। তার মনে হল জেহের খুব খারাপ একটা কিছু করবে। তখন তার মাথায় আসলো জেহের রাফিদকে মেরে দিতে পারে। কারণ নয়নিকা সামান্য ছোঁয়াতেই এমন করেছে আর রাফিদ তো তাকে জড়িয়ে ধরেছে। না না, তার জন্য রাফিদের কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। ইনশিতা রাফিদকে ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। জেহের আগের ন্যায় ঘাড় কাত করেই তাকাল ইনশিতার দিকে। তারপর একটা বাঁকা হাসি দিল। কারণ সে বুঝতে পেরেছে যে তার রোজ তার ভয়েই রাফিদের থেকে দূরে সরে গিয়েছে।
জেহের হুট করেই রাফিদের কাঁধে হাত রাখলো। লম্বায় রাফিদের থেকে জেহের বেশ বড়। রাফিদের কাঁধে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে রইল। অথচ চেহারা একদম শান্ত। তারপর আচমকাই রাফিদের কাঁধ ধরে টান দিয়ে ভাঙ্গা চেয়ারটার দিকে ছুঁড়ে মারে। ঘটনাটা এতটাই দ্রুত ঘটেছে যে রাফিদ নিজেকে রক্ষা করার সুযোগ পেল না। ভাঙ্গা চেয়ারে লেগে রাফিদের পিঠ, হাত আর গলার বেশ খানিকটা অংশ ছিলে গেছে। রক্ত বইছে আঘাতকৃত অংশ হতে। জেহের ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। ইনশিতা আর জেবা তাড়াতাড়ি গিয়ে রাফিদকে ধরলো। ইনশিতা তো কেঁদেই দিয়েছে। জেহের গিয়ে ওদের থেকে রাফিদকে ছাড়িয়ে পেটের মধ্যে খুব জোরে একটা লাথি মারলো। পেট ধরে কুকিয়ে উঠলো রাফিদ। মুখ দিয়ে অঝোরে রক্ত বইছে। এবার ইনশিতা নিজের রাগ সামলাতে পারলো না। জেহেরকে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে খুব জোরে কষে একটা চড় লাগালো। ইনশিতা চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
-“আপনি আসলেই একটা পাগল। আরে আপনি মানসিকভাবে যে অসুস্থ সেটা কি আপনি জানেন?”
জেহেরের চোখমুখ ক্রমশ লাল হয়ে উঠল। জীবনের প্রথম চড় এটা, তাও আবার যাকে ভালোবাসে তার কাছ থেকে। জেহেরের রাগ যেন বাঁধ মানলো না, রাগে গজগজ করতে লাগলো। হুট করে ইনশিতার দুই বাহু ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“ভালোবাসি বলে একদম ছেড়ে দেবো ভেবো না রোজ, আমার দিকে কেউ কোনোদিন আঙুল তোলার সাহস পায়নি। সেখানে তুমি আমায় চড় মেরেছো, এর শাস্তি তো তোমায় পেতেই হবে।”
বলেই বৃদ্ধাঙ্গুল আর তর্জনী দিয়ে চেপে ধরলো ইনশিতার গাল। এত জোরে চেপে ধরেছে যে ইনশিতার মনে হচ্ছে জেহেরের আঙ্গুল তার গালে ঢুকে গেছে। রাগে আর ব্যাথায় সইতে না পেরে আরেকটা জোরেসোরে চড় লাগিয়ে দিলো জেহেরের গালে। এমন ঘটনাতে নয়নিকা সহ জেবাও হতভম্ব হয়ে গেছে। জেবা মনে মনে বলছে, এবার শেষ ইনশিতা। ভাই এবার তোমাকে কি করবে এটা তুমি নিজেও কল্পনা করতে পারবে না।
জেহের আর নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারলো না। গর্জন করতে করতে ইনশিতার দিকে তাকাল। ইনশিতা নিজের গাল ধরে আছে। প্রচুর ব্যাথা পেয়েছে সে। জেহের গিয়ে ভাঙ্গা কাঠের বড় টুকরো হাতে নিলো। তা দেখে নয়নিকা আর জেবার জান বের হবার উপক্রম। ইনশিতা তা দেখে ভাবল, অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে জেহেরকে চড় মেরে। এই কাঠ দিয়ে একটা বারি দিলে তো তার মৃত্যু অনিবার্য। ইনশিতা বড় বড় ঢোক গিলল। পালাবার উপায় নেই, রাফিদ নিজেও অজ্ঞান, নয়নিকা আর জেবা দুজনে আর কিইবা করবে! ইনশিতার মনে হচ্ছে সে কোনো সিংহের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাঁটু কাঁপছে, ঠিক মতো দাঁড়াতে পর্যন্তও পারছে না।জেহের ঘাড় কাত করে হাতে ভাঙ্গা কাঠ নিয়ে এগোতে লাগল ইনশিতার দিকে। তাকে চড় মারার চরম মূল্য তো দিতেই হবে তার রোজকে।
.
.
চলবে…
[জেহের কেন অতিরিক্ত সাইকো? এতটা কেন পাগলামি? এই প্রশ্নের উত্তর পরবর্তী পর্বগুলোতেই পেয়ে যাবেন ধীরে ধীরে।]