#প্রহেলিকা
#পর্ব_১৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————–
ইনশিতা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল। মাথাটা ভার হয়ে আছে। গলা, পিঠও খুব জ্বলছে। উঠে বসে আশেপাশে চোখ বুলাতে নিলেই দেখল জেহের দূরে থাকা সোফায় বসে এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দুই হাঁটুতে হাতের কনুই রেখে হাত জোড় করে তার উপর থুতনি ভর দিয়ে রেখেছে। রক্তবর্ণ চোখ দুটো দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করছে ইনশিতাকে। ইনশিতা গতকালকের কথা মনে পড়লে নিজের দিকে একবার তাকিয়ে নিলো। একটা টিশার্ট আর জিন্স পরে আছে সে। হতভম্ব হয়ে গেল সে। গতরাতে কী হয়েছিল? জেহের তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে অনেক্ষণ ভিজল, তারপর! সে কী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল? তারপর জেহের তার ড্রেস চেঞ্জ করে দিল? জেহের নিজ হাতে জামা খুলেছে? ইনশিতা বড়বড় চোখ করে তাকাল জেহেরের দিকে। অথচ জেহের আগের ভঙ্গিতেই তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ইনশিতা পুরো শরীরে চাদর পেঁচিয়ে দাঁড়াল কারণ টিশার্ট আর জিন্স কখনোই পরেনি সে, কেমন আনকম্ফোর্টেবল লাগে। আর জেহেরের সামনে তো এভাবে থাকলে সে মরেই যাবে।
কোনোরকমে উঠে জেহেরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কন্ঠে তেজ ঢেলে বলল,
-“আপনার মধ্যে কী কমনসেন্স বলতে আসলেই কিছু নেই না কি? একটা মেয়ের অজ্ঞান হওয়ার সুযোগ নিয়ে নিজের চক্ষুক্ষুধা মেটালেন? আর না জানি কী কী করেছেন? আমার জামাকাপড় নিজ হাতে চেঞ্জ করার সাহস কোথায় পান; যেখানে আমার আর আপনার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই?”
জেহের হাত জোড় খুলে সোফায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসল, তবে মুখভঙ্গি অপরিবর্তনীয়। শান্ত কন্ঠে বলল,
-“সম্পর্ক বানাতে আমার এক সেকেন্ডও লাগবে না।ওয়ানা সি?”
ইনশিতা ভয়ে দুকদম পিছু হটল। জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দিলো। জেহের একবার ঘাড় এদিক ফিরিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। ইনশিতার সামনে এসে গালে হাত রাখল। ইনশিতা মুখ সরাতে গিয়েও সরাল না। জেহের শক্ত গলায় বলল,
-“আমি তোমার ড্রেস চেঞ্জ করিনি। গতরাতে তুমি অজ্ঞান হওয়ার সাথে সাথেই রুমে নিয়ে এসে মেইড দিয়ে চেঞ্জ করিয়েছি। সো, আমাকে ব্লেইম করা বন্ধ করো। আর আমি চাইলেও তোমার জামা কাপড় চেঞ্জ করতে পারি। বাট তুমি যেহেতু এসব পছন্দ করো না তাই বিয়ের আগে এসব করবো না। আর হ্যাঁ, বিয়ের পর তোমাকে একদিনের জন্যও নিজ হাতে চেঞ্জ করতে দেব না।”
বলেই দ্রুত পদে বেরিয়ে গেল জেহের। ইনশিতা জেহেরের কথা শুনে প্রথমে অনেক শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাইল। কিন্তু শেষ কথাটা শুনে সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কী বলে গেল জেহের! ছিঃ!
ইনশিতা ওয়াশরুমে ঢুকতে নিলে চোখে সব অন্ধকার দেখতে লাগে। মাথায় হাত দিয়ে দেখে এক সেট জামা কেউ ছুঁড়ে মেরেছে তার দিকে যার ফলে চোখ ঢাকা পড়েছে। জামা হাতে পাশ ফিরতে দেখে জেহের দাঁড়িয়ে।
-“পনের মিনিট টাইম দিলাম। চেঞ্জ করে আসো। উই হ্যাভ টু গো ব্যাক।”
বলে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। গটগট করে হেটে চলে গেল। ইনশিতা দশ মিনিটে চেঞ্জ করে এসে দেখে একজন বাঙালি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে খাবারের ট্রে। এমনভাবে কাঁপছে মনে হচ্ছে একটু পরেই তার গর্দান হবে। হাতে থাকা খাবারের ট্রেটাও নড়বড় করছে। তবে হাত ব্যান্ডেজ করা। সদ্য লাগানো ব্যান্ডেজ। ইনশিতা আসতেই সে বলল,
-“ম্যাম। ব্রেকফাস্ট করে নিন। স্যার আপনার জন্য ওয়েট করছেন নীচে।”
খেতে গিয়ে ইনশিতার মনে হলো এনাকে বলা যাক জামা চেঞ্জের কথা। জেহের মিথ্যে বলেছে কি না কে জানে? ইনশিতা বলেই ফেলল,
-“আচ্ছা, গতরাতে কী আপনি আমার জামা চেঞ্জ করেছিলেন?”
-ই-ইয়েস ম্যাম।
ইনশিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবুও আরেকটু যাচাই করা যাক।
-“দরজা কী খোলাই ছিলো না কি…”
-“নো ম্যাম। বাহির থেকে বন্ধ ছিলো। চেঞ্জ করিয়ে দেয়ার পর স্যার নিজেই দরজা খুলেছেন।”
-“ওহ। আচ্ছা, আপনার হাতে কী হয়েছে? কীভাবে কাটল? দেখে তো মনে হচ্ছে, বেশ গভীর করেই কেটেছে।”
মেয়েটা এবার কেঁদে দেবে দেবে অবস্থা।
-“আসলে…গতরাতে স্যার ছুরি দিয়ে হাতে…
-“কীহ! জেহের?”
মেয়েটি মাথা নিচু করে বলে,
-“ইয়েস ম্যাম।”
-“কিন্তু কেন?”
-“আ-আপনার জামা চেঞ্জ করার সময় আমার হাতের ঘড়ির কোণার সাথে লেগে আপনার গলার অনেক নিচে আঘাত লাগে। বিশ্বাস করুন ম্যাম, আমি ইনটেনশনালি কিছুই করিনি। ঘড়ির কাছের ধারটা খুব সুঁচালো ছিলো, আমি খেয়াল করিনি সেটা, তার সাথে লেগে কিছুটা কেটে যায়। আর-আর সেটা দেখে স্যার আমার হাতে ছুরি দিয়ে…”
মেয়েটা কান্নার কারণে আর কিছুই বলতে পারল না। বেরিয়ে গেল মেয়েটা। ইনশিতার খারাপ লাগল। সামান্য একটু ব্যথা লাগায় মেয়েটার হাত কাটল আর নিজে যখন নখ দিয়ে আঁচড় কেটে দিলো সেটা কিছুই না? অন্যের দোষ ঠিকই দেখে অথচ নিজেরটা দেখেনা! এক মিনিট! টিশার্ট পরার কারণে তো ঐ ক্ষত দেখা যাচ্ছে না। তাহলে জেহের কীভাবে জানল যে কাটা গেছে? জেহের তো চেঞ্জের সময় ছিল না, আর দরজাও বন্ধ ছিল। তাহলে? ইনশিতা একপাশে চোখ নিতেই দেখল সিসি ক্যামেরা ফিট করা। একদম দেয়ালের কোণায়। তারমানে জেহের সিসি ক্যামেরায়…! ও মাই গড! ও মাই গড! ইনশিতা বোধহয় দ্বিতীয়বারের মতো অজ্ঞান হলো।
.
.
হেলিকপ্টারে ওঠার সময় ইনশিতার মনে পড়ল রাফিদের কথা। বেচারা কোথায় এখন? তার জন্যই তো রাফিদ এত বড় বিপদে পড়েছে। জেহেরকে জিজ্ঞেস করতে নিলেই জেহেরকে দেখে চোখ আটকে যায় ইনশিতার। স্যুট পরা জেহেরকে এত হ্যান্ডসাম লাগছিল না! তার উপর আলাদা এক অ্যাটিটিউড। এরকম একটা ড্যাশিং ছেলে তার মতো ক্ষ্যাত মেয়েকে ভালোবাসলো কীভাবে? বাতাসে চুলগুলো এমনভাবে উড়ছিল যে ইনশিতার ইচ্ছে করল নিজ হাতে চুল সরিয়ে দিতে। জেহের মোবাইলের দিকে তাকিয়েই বলল,
-“আই নো হাউ হ্যান্ডসাম আই অ্যাম। সব মেয়েই আমার জন্য পাগল। তবে আমি পাগল শুধু তোমার জন্য। এভাবে লুকিয়ে না দেখে সরাসরি দেখলেই পারো। আমি তো সবটাই তোমার। রোজের জেহের।”
ইনশিতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নিজের মুখে নিজের প্রশংসা করা এমন লোক দুনিয়াতে কমই দেখেছে সে। তার উপর জেহের কিভাবে বুঝল যে সে তার দিকে তাকিয়েছিল? পরক্ষণেই মনে পড়ল জেহের কত বড় লুচু। মহান মহান কথা বলে ঠিকই কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে কত লুচু টাইপ সেটা ইনশিতা ছাড়া আর কেউ জানে না। সিসি ক্যামেরার ঘটনাটা নিয়ে এখনো ইনশিতা রেগে আছে। কিন্তু রাগ ঝারতে পারবে না সে। তার অধিকার নেই। ইনশিতা মিনমিন করে বলল,
-“রাফিদ কোথায়?”
জেহের সেই মিনমিনে আওয়াজ শুনল না বোধহয়। ইনশিতা জেহেরের বাহুতে খোঁচা দিলো। জেহের ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“হোয়াট?”
-“ইয়ে মানে, রাফিদ কোথায়?”
-“কী বিড়বিড় করছ? গলায় শক্তি নেই?”
ইনশিতা এবার জোরেই বলল,
-“রাফিদকে কোথায় রেখেছেন? ও কে দেখছি না কেন?”
জেহের মোবাইল থেকে চোখ তুলে তাকাল। সেই দৃষ্টি দেখে ইনশিতা আর কিছুই বলতে পারল না। চোখ নামিয়ে ফেলল। জেহের বলল,
-“ও তোমার ভাই। ওকে নাম ধরে না ডেকে ভাই ডাকবে।”
ইনশিতা ভেঙচি কেটে মনে মনে বলল,
-“আজ আপনি না থাকলে ও আমার হাজব্যান্ড হতো। হুহ…”
-“ওকে নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। ওকে নিয়ে পরে আসবে গার্ডরা। হি ইজ অ্যাবসলুটলি ফাইন।”
কথার ধরন শুনে ইনশিতা বার কয়েক ঢোক গিলল। বলার সময় জেহেরের মুখে অদ্ভুত হাসি লক্ষ্য করেছে সে। তার মানে রাফিদ ভালো নেই।
-“আ-আচ্ছা, একটা কথা বলি?”
-“হুম।”
-“আপনি কীভাবে জানলেন যে আমি এখানে আছি?”
প্রত্যুত্তরে জেহের বাঁকা হাসল। ইনশিতার চুল নিয়ে এক আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল,
-“তোমাকে খুঁজে পাওয়া কোনো ব্যাপারই না। রোজ যেখানে জেহের সেখানে।”
-“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সোজা করে বললে হয় না?”
-“ওয়েল। অ্যাকচুয়ালি, তোমাকে খুঁজে পেতে একজনের সাহায্য যদিও নিতে হয়েছে। আই ডোন্ট নো হার। বাট মেয়েটি আমায় বলেছিল যে রাফিদ তোমাকে নিয়ে এখানে এসেছে। আর গতরাতে আমি তোমাকে খুঁজতে বের হলে রাস্তায় দেখি একটা মেয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। ভালো করে দেখি তুমি। তারপর আর কি! আমিও তোমার পিছু নেই।”
ইনশিতা লুকিয়ে আকাশ সমান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জেহেরের থেকে বোধহয় এ জীবনেও দূরে যেতে পারবে না সে।
.#প্রহেলিকা
#পর্ব_১৮
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————–
জেহের আর ইনশিতার বিয়ে কিছুক্ষণ আগেই হয়ে গেছে। একদম ঘরোয়াভাবে। নরমাল ড্রেসেই বিয়ে হয়েছিল। ইনশিতার পরিবার আর জেহেরের পরিবার ছাড়া বাড়তি কেউ ছিল না বিয়েতে। কবুল বলার সময় ইনশিতার গলার স্বর কাঁপছিল। জেহের ইনশিতার হাত শক্ত করে ধরে শুধু শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল ইনশিতার পানে। তা দেখে ইনশিতা কাঁপা গলায় গড়গড় করে কবুল বলে দিয়েছিল। আর সবটা উপর থেকে জিহাদ দেখছিল। অথচ কিছুই করতে পারেনি সে। পারেনি বললে ভুল হবে, করতে চেয়েছিল, তবে জেহেরের ভয়ে আর কোনো প্ল্যান করেনি। জেহের পুরোটা সময় এমনভাবে ইনশিতার হাত চেপে ধরেছিল যেন ইনশিতা দুদিনের বাচ্চা। ছাড়লেই হারিয়ে যাবে। আর সেই কারণে একটাবারও জিহাদ ইনশিতার কাছে আসার সাহস পায়নি। উপর থেকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে গেছে পছন্দের মানুষটির বিয়ে। ইনশিতা কবুল বললে জিহাদ আর সেখানে দাঁড়ায়নি। চলে গিয়েছিল নিজের রুমে। পছন্দের মানুষটিকে অপরের সাথে দেখাটা হৃদয় পোড়ানোর মতো কষ্টের।
তখনও পড়ন্ত বিকেল। ইনশিতা বসে আছে জেহেরের আলিশান রুমের আলিশান বিছানায়। জেহের রুমে নেই। কোথায় গেছে ইনশিতা জানে না। এমনকি জানতেও চায় না। জেহের না আসলেই ইনশিতার কাছে ভালো লাগবে। একদম দেশে ল্যান্ড করেই বিয়ের ব্যবস্থা করাতে ইনশিতা অবাকের সাথে সাথে রাগও হয়েছিল। তবুও জেহেরের ক্রোধ থেকে সবাইকে বাঁচাতে বিয়েটা করে ফেলেছিল। জেহেরের কথা ভাবতে না ভাবতেই জেহের হাজির রুমে। ইনশিতা চোখমুখ কুঁচকে বিড়বিড় করল,
-“শ্যায়তান কা নাম লিয়া, অর শ্যায়তান হাজির।”
জেহের সোজা এসেই ইনশিতাকে অবাক করে দিয়ে কোলে তুলে সোফায় বসিয়ে দিলো। তারপর ইনশিতার খুব কাছাকাছি মুখ এনে দুষ্টু হেসে বলল,
-“রাতের জন্য অপেক্ষা করতে পারব না। বাসর রাত হবে না, হবে বাসর বিকেল।”
বলেই ইনশিতাকে ছেড়ে বিছানার কাছে চলে গেল। হাতে আনা কয়েকটি গোলাপের পাপড়ি ছড়াতে লাগল বিছানায়। শুভ্র চাদরে গোলাপের লাল টকটকে পাপড়ি গুলো খুবই স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল। জেহের আরেকটা গোলাপের পাপড়ি নিয়ে ইনশিতার উপড় ফেলতে লাগল ধীরে ধীরে। চোখেমুখে দুষ্টু চাহনি।
ইনশিতার হার্টবিট ক্রমশ বাড়ছিল। জেহেরের এমন চাহনির সাথে সে অপরিচিত। বেশ বিব্রত বোধ করছিল সে। কীভাবে জেহেরকে এখন দূরে রাখা যায় সেই চিন্তা করছে সে। জেহের আবারও ইনশিতাকে এসে পাঁজকোলে তুলে নিলো। বিছানার মধ্যিখানে বসিয়ে জেহের দরজা আটকে জানালাগুলোয় পর্দা টেনে দিলো। পুরো রুম অন্ধকার এখন। জেহের দেয়ালে ঝুলানো কয়েকটি হালকা আলোর ল্যানটার্ন অন করে দেয়। ইনশিতার হাত পা কাঁপছে ভয়ে। মনে মনে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছে এমন পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে। জেহের আচমকা এসে ইনশিতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ইনশিতার অধরযুগলে নিজের ওষ্ঠাধর চেপে ধরে। ইনশিতা হঠাৎ আক্রমণে হতবিহ্বল হলেও জেহেরের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়ানোর প্রয়াস চালাতে থাকে। তবে জেহেরের বলিষ্ঠ শরীরের কাছে তার ক্ষীণ শরীরের শক্তি কাজে আসে না। জেহের খানিকবাদে ইনশিতাকে ছেড়ে অস্থির হয়ে নিজের শার্টের বোতাম খোলা শুরু করে। জেহেরের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। ইনশিতা নিঃশব্দে কাঁদছে। জেহের শার্ট ছুঁড়ে মারে বিছানার এক প্রান্তে। ইনশিতার দু’হাত নিজের একহাতের মধ্যে চেপে গলায় মুখ গুঁজে জেহের। এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে ইনশিতা। সে ভেবেছিল সময় চেয়ে নিবে নিজেকে তৈরি করার জন্য। কিন্তু তার আগেই জেহের নিজের অধিকার আদায় করার কাজে নেমে পড়বে কে জানতো? জেহের ইনশিতার কান্না দেখে গলা থেকে মুখ তুলে তাকায়। তার চোখে তখনো ঘোর নেশা। ইনশিতা চোখ বন্ধ রেখে কান্না জড়ানো গলায় বলে,
-“আমার সময় চাই জেহের। আ-আমি এসবের জন্য তৈরি নই, প্লিজ।”
-“তুমি আমাকে বলেছিলে তুমি বিয়ের আগে আনকম্ফোরটেবল, এখন তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাহলে?”
ইনশিতার কন্ঠস্বর রোধ হয়ে আসছে। কান্নার পরিমাণ বেড়েই চলছে। জেহের নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইনশিতার দিকে। রোজের কান্না তার সহ্য হচ্ছে না। বুকের বাঁ পাশটায় চিনচিন ব্যথা করে। ইনশিতার গালে হাত রেখে বলে,
-“ওকেহ! রোজ, ডোন্ট ক্রাই। আমি তোমার অনুমতি ছাড়া কিছু করব না। সত্যি। প্লিজ, কান্না বন্ধ করো এখন।”
জেহের উঠে বসে। জানালার পর্দা সরিয়ে শার্ট পরে নেয়। বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে ইনশিতার মাথা বুকে উঠিয়ে নেয়। ইনশিতা তখনো কাঁদছে। জেহের ইনশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
-“আই রিকোয়েস্ট ইউ, ডোন্ট ক্রাই। ইট হার্টস মি রোজ।”
ইনশিতা কাঁদতে কাঁদতে জেহেরের বুকে মাথা দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। জেহের ইনশিতার কপালে অধর ছুঁইয়ে দেখতে লাগে তার রোজের ঘুমন্ত কান্নামাখা চেহারা। এই মেয়েটি এখন থেকে তার। সবসময়ের জন্য। এখন আর তার থেকে দুরে কোথাও যেতে দেবে না রোজকে। সবসময় নিজের কাছে রাখবে।
.
রাত আটটায় ঘুম ভাঙ্গে ইনশিতার। নিজেকে কারো বুকে আবিষ্কার করে সে। মনে পড়ে, এটা জেহের ছাড়া আর কেউ না। মাথা উঁচু করে দেখে জেহের তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ দু’টো প্রচন্ড লাল। ইনশিতাকে জাগতে দেখে মিষ্টি হাসি দিলো জেহের। লাল চোখের মিষ্টি হাসি ইনশিতার কাছে কেমন যেন লাগল। নিজেকে ছাড়িয়ে ইনশিতা খাট থেকে নেমে পড়ল। জেহের শোয়া থেকেই বলল,
-“কাবার্ডে তোমার জামা-কাপড় সহ প্রয়োজনীয় সব জিনিস রাখা আছে।”
বলেই একটা বড় হাই তুলল জেহের। তারপর চোখ বুজে ফেলল। ইনশিতা কাবার্ড খুলে নিজেকে বিস্মিত হওয়া থেকে সামলালো। প্রায় সব রকমেরই জামা কাপড় আছে। অর্ধেক আলমারি জুড়ে ইনশিতা আর বাকি অর্ধেকে জেহেরের জামা কাপড়। একটা থ্রি পিস নিয়ে ইনশিতা ওয়াশরুমে চলে যায়। গোসলটা করে নিলেই ফ্রেশ ফ্রেশ লাগবে। গোসল শেষে বের হতেই দেখে জেহের ঘুমিয়ে আছে। ইনশিতা ভাবল সে এখন কী করবে? নীচে যাবে? এখন তো সে এই বাড়ির বউ। দরজা যেই না খুলবে তখন জেহেরের আওয়াজ আসে,
-“এক পাও রুমের বাহিরে রাখবে না রোজ।”
ইনশিতা পেছন ফিরে দেখল জেহের সেই আগের মতোই ঘুমে। তবে কথা বলল কখন? জেহের সেই অবস্থায় থেকেই আবার বলল,
-“টি-টেবিলে খাবার রাখা আছে। খিদে পেলে খেয়ে নাও। তবে আমি না ওঠা পর্যন্ত বাহিরে পা ফেললে খবর করে ছাড়ব তোমার।”
ইনশিতা একপলক খাবারের দিকে তাকাল। সোফায় গিয়ে বসে খেতে লাগল আর রুম পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। এই রুমটা এত বড় যে দৌড় খেলাও খেলা যাবে। এতবড় রুমে জেহের একা থাকে কী করে? এখন তো আর একা না, তাকেও থাকতে হবে জেহেরের সাথে। ইনশিতা খেয়ে বারান্দায় গেল। ঘরের দেয়ালের একপাশ জুড়ে নিচ থেকে সিলিং পর্যন্ত পুরোটা কাঁচ দেওয়া। অর্থাৎ বারান্দা আর রুমের মধ্যবর্তী দেয়ালটা কাঁচের। আর কাঁচের ওপাশে মিনি ছাদের মতো বারান্দা। দোলনা সহ ছোট চেয়ার টেবিল ও সেখানে রয়েছে। কাঁচ হওয়ায় বারান্দা থেকে পুরো রুম আর পুরো রুম থেকে বারান্দার সব দেখা যায়। ইনশিতা বারান্দায় গিয়ে একবার বিছানার দিকে তাকাল। দেখল জেহের এবার তার দিকে ফিরে শুয়েছে। ইনশিতা চোখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদের আলো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। কিছুক্ষন বাদেই নিজের পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেল। পেছন ফেরার আগেই জেহের ইনশিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা রাখল। জেহের ইনশিতার কাধে মাথা দিয়ে চুল নিয়ে খেলতে লাগে। আর ইনশিতা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘের আড়ালে হঠাৎ চাঁদ ঢেকে গেল। এখন আর চাঁদের আলোটুকুও নেই। মনটাই খারাপ হয়ে গেল ইনশিতার।
.
.
জিহাদ ডিভানে গা এলিয়ে বসে আছে। চেহারায় কষ্টরা উপচে পড়ছে। তাকে দেখে জেবার মনটা কেমন করে উঠল। ভাইদের মধ্যে একমাত্র জিহাদের সাথেই তার ভাব আছে। তাই জিহাদকে তুই আর জেহেরকে ভয়ে তুমি বলে। জিহাদকে কখনোই এতটা কষ্টে দেখেনি সে। সবসময় হাসিখুশিই দেখেছে। তাহলে হঠাৎ এত শোকের ছায়াই বা নামল কেন তার মুখে? জেবা জিহাদের পাশে বসে গলা নামিয়ে বলে,
-“ছোট ভাই, তোর কী হয়েছে? মনটা কী ভালো নেই?”
জিহাদ হাসল। কষ্টপূর্ণ হাসি।
-“নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হতে দেখে কার মনটাই বা ভালো থাকে?”
জেবার বোধগম্য হলো না কথাটা। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে বিষণ্ণতায় ঢাকা জিহাদের মুখপানে। জেবা বলল,
-“ঠিক বুঝলাম না ভাই। কীসের কথা বলছিস?”
পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়ল এমনভাবে বলল,
-“ভাই, তুই কি ঐ মেয়েটার কথা বলছিস যাকে তুই দুইবছর আগে দেখেছিলি? যার কথা আমায় বলেছিস? সেই মেয়েটা?”
জিহাদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। জেবা অবাক হয়ে বলল,
-“মেয়েটার কী হয়েছে? অন্যের হয়ে গেছে মানে?”
-“বিয়ে হয়ে গেছে তার?”
-“তুই হতে দিলি? তুই তো চাইলেও আটকাতে পারতি।”
-“পারতাম না কখনোই।”
জেবা মজা করে বলল,
-“তাহলে তুই তুলে নিয়ে আসতি?”
জিহাদ তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি হেসে বলল,
-“অলরেডি তুলে নিয়েও গিয়েছিলাম। তবে প্ল্যান সাক্সেসফুল হয়নি।”
জেবা কৌতুহল নিয়ে বলে,
-“পরে?”
-“পরে আর কী? তাকে নিয়ে চলে যায় অন্য কেউ।”
একটু থেমে জিহাদ বলল,
-“তবে জানিস, আমি কিন্তু তাকে তখন নিয়েও আসতে পারতাম যদি জানতাম তাকে কোথায় নিয়ে রেখেছিল।”
-“ভাই, আমি একটা কথাও বুঝতে পারছি না আমি। মানে কীভাবে…”
জিহাদ মাথাটা একটু হেলিয়ে জেবার দিকে তাকাল,
-“কেন করলি এমনটা?”
জেবার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আমি আবার কী করলাম?”
-“ইনশিতা যে রাফিদের কাছে ছিল সেটা তুই জেহেরকে কেন বলতে গেলি? আমাকে কেন বললি না?”
জেবা চমকে দাঁড়িয়ে গেল।
-“ম-মানে।”
জিহাদ তর্জনী আর বুড়ো আঙুল কপালে ঠেকাল। চোখ বন্ধ করে বলল,
-“আমাকে যদি বলতি রাফিদ ইনশিতাকে নিয়ে যাবে তাহলে তোর রাফিদের আজ এত ক্ষতি হতো না।”
জেবা দ্বিতীয়বারের মতো আবার চমকাল,
-“আমি জেহের ভাইকে শর্ত দিয়েছি রাফিদের ক্ষতি না করতে। আর ভাই শর্তটা মেনেছেও।”
জিহাদ উচ্চশব্দে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল,
-“তোর কী মনে হয়? ইনশিতাকে নিয়ে যে পালিয়ে যাবে, তাকে জেহের ভাই এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? হাউ ফানি!”
জেবা ধপ করে বসে পড়ল ডিভানে। তড়িৎ গতিতে জিহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এক মিনিট, তার মানে ইনশিতাই সেই দুবছর আগের দেখা মেয়েটা, যাকে তুই ভালোবেসেছিলি?
জিহাদ এবার নড়েচড়ে বসল। হাতে পেপার ওয়েট ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
-“দু’বছর আগে আমি ইনশিতাকে দেখি রাস্তায় একটি ভ্যানের সামনে দরদাম করতে। আমি সেখানেই গাড়ি থামিয়ে দেখছিলাম তাকে। প্রায় আধঘন্টা ঝগড়া করে যখন বাজার করে ফিরছিল তখন আমার গাড়ির সামনে আসলো। রেগে গিয়ে বলল, চিপা জায়গা থেকে গাড়ি সরাতে, তার নাকি হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। এত তেজ মেয়েটির যে পারে না আমার সাথে ঝগড়া করে। শ্যামলা রঙের হলেও মেয়েটির চেহারায় যেন সৌন্দর্যের অভাব নেই। সেই রাগী রাগী মেয়েটার প্রেমে তখুনি কাত হয়ে পড়ে গেছি আমি। তোকে এসে বলেছিলাম মেয়েটির কথা যে আমি ও কে ভালোবেসে ফেলেছি। তারপর থেকে খোঁজ নিলাম মেয়েটির। ইনশিতা নাম। সবসময় লুকিয়ে দেখতাম। একবছর এভাবে লুকিয়ে দেখলেও পরে আর সম্ভব হতো না। কাজের ব্যস্ততার কারণে তাকে দেখাটা মিস হয়ে যেত। তবে তার ছবি মোবাইলে রাখতাম সবসময়। তবুও হাসফাঁস লাগত একপলক দেখার জন্য। এভাবেই চলল আরও এক বছর। তারপর একদিন দেখলাম কালো শাড়ি পরনের আমার সেই ভালোবাসা আমাদেরই ঘরে। তবে জেহের ভাইয়ের হাতে বন্দী তখন। আমার এত রাগ হলো। তারপর আস্তেধীরে জানলাম জেহের ভাইও ইনশিতাকে ভালোবাসে। আর বিয়েও করবে। আমি অনেকবার সাবধান করেছিলাম ইনশিতা আর ইনশিতার বাবাকে। তবুও কাজে দিল না। বিয়ের দিন যখন ও কে নিয়ে পালাবো তখন কে যেন গাড়ির সামনে বাইক নিয়ে এসে ক্লোরোফর্ম দিয়ে আমায় অজ্ঞান করে ইনশিতাকে নিয়ে চলে যায়। যখন জ্ঞানে ফিরি, তখন লোক দিয়ে খোঁজ চালিয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি। তারমধ্যে শুনি জেহের ভাই থাইল্যান্ড গেছে। তখনই বুঝলাম ইনশিতাকে কেউ থাইল্যান্ড নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই ‘কেউ’ টা কে সেটাই বের করতে পারলাম না। আমি নিজেও আর থাইল্যান্ড গেলাম না, কারণ আমি জানি জেহের ভাই ইনশিতাকে নিয়ে আসবে আর নিজের করে নেবে। তারপর লোক দিয়ে আরো খোঁজ খবর নিয়ে দেখি রাফিদ নিয়ে গিয়েছিল। আর ইনশিতা যে রাফিদের সাথে থাইল্যান্ড আছে সেই খবর জেহেরকে দিয়েছিল আমার বোন জেবা।”
জিহাদ এবার জেবার দিকে তাকাল,
-“কেন তুই জেহের ভাইকে বলতে গিয়েছিলি যে ইনশিতা রাফিদের কাছে আছে? আমাকে বলা যেত না? আমাকে বললে তো রাফিদের কোনো ক্ষতি না করেই ইনশিতাকে নিজের করে নিতাম। এতে তুই তোর রাফিদকেও পেতি, আর আমিও আমার ইনশিতাকে পেতাম।”
জেবার চোখে পানি টলমল করছে।
-“আমি জানতাম না ভাই, যে তুই ইনশিতাকে ভালোবাসিস। যদি জানতাম; তাহলে বিশ্বাস কর, আমি জেহের ভাইকে খবর দিতাম না। আমি রাফিদকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমিও সবসময় রাফিদের উপর নজরদারি রাখতাম। একদিন জানতে পারি রাফিদ ইনশিতাকে ভালোবাসে। এটা শুনে আমার মাথাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপর রাফিদ যে ইনশিতাকে নিয়ে থাইল্যান্ড পালাবার প্ল্যান করছে, আর বিয়ে করবে, সেটাও জানতে পারি। জেহের ভাইকে খবরটা জানানোর আগেই রাফিদ ইনশিতাকে নিয়ে চলে যায়। রাফিদকে আমি অন্যকারো সাথে সহ্য করতে পারতাম না। তাই পরদিন জেহের ভাইকে বলে দিই থাইল্যান্ডের কথা। তবে মোবাইলের অন্য সিমে, কন্ঠ বদলিয়ে। জেহের ভাই জানে না যে, সেই সকাল বেলায় আমি-ই কল করেছিলাম। তবে শর্ত দিয়েছিলাম রাফিদের যাতে কিছু না করে। আর ভাইও শর্ত মানবে বলেছে। যদি একবার জানতাম তুই ইনশিতাকে ভালোবাসিস তাহলে আমি জেহের ভাইকে জানাতাম না।”
জিহাদ উঠে দাঁড়াল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন। বাই দ্যা ওয়ে, তোর রাফিদের খোঁজ পেয়েছিস?”
জেবা মাথা নাড়িয়ে না বলল। জিহাদ বলল,
-“আর পাবিও না। রাফিদের অবস্থা বেহাল করে ছাড়বে জেহের ভাই।”
-“জেহের ভাই শর্ত মানেনি। মিথ্যে বলেছে।”
-“তোর আগেই এটা ভাবা উচিৎ ছিল, ইনশিতাকে যে জেহের থেকে দুরে সরাবে তার বেঁচে থাকা মুশকিল করে দিবে।”
-“এখন উপায়? কীভাবে রাফিদকে ফিরে পাব?”
-“জানি না। একমাত্র ভাই-ই জানে কী করবে। আমাদের চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। ভাইয়ের রাস্তায় বাঁধা দিলে আমাদের জানও যেতে পারে।”
জেবা কাঁদতে কাঁদতেই রুমে চলে গেল। জিহাদ বাহিরে তাকিয়ে আছে। বেশ বড় করে চাঁদ উঠেছিল আজ। কালো মেঘেরা আড়াল করে দিচ্ছে সেই চাঁদ। যেমনটা জিহাদ নিজের কষ্টগুলোকেও বুকের একপাশে আড়াল করে রেখেছে।
.
.
চলবে…