৪+৫
ক্যাকটাস 🌵
পর্ব ০৪
Writer Taniya Sheikh – (Tanishq)
এতোপথ জার্নি করেও ঘুম আসছে না রাফসানের চোখে। পড়া,ক্যারিয়ার এই করেই যেন ত্রিশ বছর পার করলো সে। এর বাইরেও যে কিছু প্রয়োজন একজন পুরুষের।
সেটা বরাবরই উপেক্ষা করে এসেছে রাফসান। এই একঘেয়ে জীবনেই যেন সে অভ্যস্ত। শুধু মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে তার মন।
কৈশোরে পিতৃবিয়োগ তাকে বহু তিক্ততার মুখোমুখি করিয়েছে। আজকাল যেসব আত্মীয়, স্বজন বন্ধু, বান্ধব রাফসান! রাফসান করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। একদিন এরাই মুখ ঘুরিয়ে চলে যেত তাকে দেখে। বাবার অকাল মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠলেও মানুষের নির্মম স্বার্থপরতা এখনও ভোলে নি রাফসান। এই রইস ফুপার কথাই ধরা যাক। বাবা বেঁচে থাকতে আজকের মতোই আদর আপ্যায়ন করত। অথচ তার মৃত্যুর পর একটিবার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধও করেনি এরা। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল রাফসান ও তার মায়ের থেকে। সেই দিনগুলো খেয়ে না খেয়ে অনাদরে কাটিয়েছিল তারা। ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, রাফসানের মা রাহেলা বানু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ নিয়েছিল সেসময়। এসএসসি পাস করে রাফসানও টুকিটাকি টিউশনি করতে চাইল। কিন্তু তার মা তাকে সে’সবের অনুমতি দিল না। দিনরাত খেটে রাফসানকে উচ্চ শিক্ষিত করেছে। পাই পাই জমিয়ে, জায়গা জমি বিক্রি করে রাফসানকে ব্যারিস্টারি পড়িয়েছে বিদেশ থেকে। আজ রাফসানদের অভাব বলতে কিছুই নেই। সে এখন যথেষ্ট অভিজ্ঞ একজন ল’ইয়ার। নাম ডাকও তার চট্টগ্রামে যথেষ্ট আছে। এই যে রইস ফুপার এতো আতিথিয়তা, এর পেছনে যে বড় কোন স্বার্থ লুকিয়ে আছে তা রাফসান শতভাগ নিশ্চিত।
স্বার্থ যাই হোক! রাফসান অন্যায় কখনোই করবে না। প্রশ্রয়ও দেবে না। তাতে যা হয় হোক।
শূন্য আকাশে নির্বিকার চেয়ে রয় রাফসান। অর্থের অভাব ঘুচলেও কোথাও যেন একটা শূন্যতা বিরাজমান রাফসানের ভেতর। কিসের শূন্যতা সেটা রাফসান বোঝে। বুঝলে কি হবে? মনের সাথে মনও তো মিলতে হবে৷ এটাই পয়েন্টে পয়েন্টে কারও সাথে জমছে না রাফসানের। নিজেও উপলব্ধি করতে পারছে না তার কেমন ধরণের জীবনসঙ্গী চায়। গত পরশুই গিয়েছিল মায়ের পছন্দের একটা মেয়েকে দেখতে। যথেষ্ট আধুনিকা, উচ্চ শিক্ষিতা, স্মার্ট মেয়েটি৷ কথাবার্তাও বেশ। তবুও কেন যেন মন বেঁকে বসলো। নাক সিটকে বললো,” এ তোর টাইপ না বাছাধন! এই মেয়ে তোমার তালে তাল মেলাতে কক্ষনোই পারবে না। সো ভালোই ভালোই কেটে পড়।দ্যাটস বেটার ফর ইউ।”
আর কী? কোনোমতে চলে এসেছিল সেখান থেকে। রাফসানের মা ছেলের হাবভাব দেখে হতাশ হন। তার ছেলে আদৌ বিয়ে টিয়ে করবে কিনা তাতে তিনি সন্দিহান। পড়াশোনা শেষ হয়েছে সেই কবেই। চাকুরী সরকারি, মোটা বেতন। তবুও তার ছেলের বিয়েতে আগ্রহ নেই মোটেও। চেনাজানার মধ্যে কমসেকম শ’খানেকের কাছাকাছি মেয়ে দেখা শেষ। একটাকেও তার মনে ধরে নি। কেন ধরে নি জিজ্ঞেস করলেও নির্বিকার সে। খুঁত ধরা টাইপ ছেলে তার না সেটা রাহেলা বানু ভালো করেই জানেন। তবুও কিছুতো বলবে রাফসান! না কিছুই বলে না। মায়ের বকবকানিতে রাফসান অবশ্য মাঝে মধ্যে হেঁসে বলে,” আমার বউটা মনে হয় এখনও পৃথিবীতে আসে নি মা। আসলে কী আর এমন হয় আমার সাথে প্রতিবার?”
” তোর যতসব আধিখ্যেতা বাবু। তুই কী ভাবিস মা কিছুই বোঝে না? মা সব বোঝে। যখন শিশুকালে খাবি বলতে পারতি না, মা কী বুঝত না? মা তখনও বুঝত, এখনও বোঝে সব। তুই নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে চাস। আর সেজন্য বিয়েটা তোর পছন্দ না। ভাবিস বিয়ে করলে বুঝি তোর স্বাধীনতা খর্ব হবে। তোর ঘর দখল হবে, তোর এসব বই পত্তর ডুবে থাকাতে সমস্যা সৃষ্টি হবে, সবচেয়ে বড় ভয় তোর হঠাৎ প্রচন্ড রেগে যাওয়া বুঝি সহ্য করতে পারবে না সে। ভাবিস তখন হয়তো মামলা হবে। লোকে বলবে ল’ইয়ার হয়ে নিজেই আবার বউ পিটায়। মানসম্মান বুঝি সব যাবে তোর তখন।” রাহেলা বানু গাল ফুলিয়ে বলেন। মায়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ বিস্মিত চেয়ে শেষে ঘর কাঁপিয়ে হাসে রাফসান। বলে,
” এই না হলে রাফসান আহমেদের মা তুমি? আমার লক্ষী মা! রাগ করো না। কথা দিলাম যেদিন সত্যি সত্যি তোমার বউমাকে মনের নজর চিনে নেবে। টুপ করে বিয়ে করে নেব৷ নো হাঙ্কি পান্কি, নো লেট।”
রাহেলা বানু রেগে বললেন,” সর তো! এসব ছেলে ভোলানো কথায় আমাকে পটাতে পারবি না। বুঝেছি আমি তোর বিয়ে দেখা এজনমে আর হবে না আমার। আমি মরি তারপর যা খুশি করিস। আমার কী? আমি কে?”
রাহেলা বানুও রাগ করে নিজের রুমে চলে এলেন। তাদের কথা সেদিন ঐ পর্যন্তই ছিল। এরপর মা ছেলেতে তেমন কথায় আর হলো না। খুব বেশী প্রয়োজনীয় কথা না হলে তিনি রাফসানের সাথে কথাই বলেন না। রাফসান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। সন্তান হিসেবে তার উচিত মা’কে খুশি করানো। তাই বলে অনিচ্ছা স্বত্বেও বিয়েতে রাজি হতে হবে তাকে? যার সাথে সারাটা জীবন অতিবাহিত করব তাকে মনে ধরা লাগবে না? এখনই দু’টো কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তাহলে ঐসব মেয়েদের কারো সাথে সারাজীবন কী করে মনের কথা বিনিময় হবে? রাফসান দ্বিধান্বিত তার সিদ্ধান্তে। মায়ের রুমে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাফসান মনের ইচ্ছা অনিচ্ছা একপাশ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।
” আসব মা?” দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করে রাফসান।
” আয়!” ভেতর থেকে জবাব দেয় রাহেলা বানু।
” ঘুমাও নাই কেন এখনও?” মায়ের পাশে বসে বলে রাফসান
” ঘুম আসছে না।”গম্ভীর গলায় জবাব দেয় রাহেলা বানু
রাফসান খেয়াল করল ওর মা একটিবারও ফিরে তাকাচ্ছে না। কথা বলার সময়ও তসবিহ নিয়ে নাড়াচাড়ায় ব্যস্ত। অথচ আগে রাফসান তার সামনে এলে সকল কাজ ফেলে ছেলের মাথাটা কোলে নিত। চুলে বিলি কেটে একগাল হেঁসে কথা বলত। ঐদিনের পর থেকেই অভিমান করে আছে তার মা। রাফসান মুচকি হেঁসে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। রাহেলা বানু আঁচলে মুখ লুকিয়ে ফেলেন সঙ্গে সঙ্গে। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাফসান তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে। চিন্তিত চেহারায় মায়ের মুখের আঁচল সরায়। দেখে তার মা জননী কাঁদছে। রাফসান মায়ের মাথাটা একহাতে ধরে বুকের উপর নেয়। ধড়া গলায় বলে,
” আ’ম সরি মা। আমার ভুল হয়েছে। আমি আর এমনটা করব না।”
” কেন করবি না? যা খুশি তাই কর তুই। আমার কী? আমি তো বুড়ি হয়ে গেছি। তুই এখন বড় হয়েছিস। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিস। আমার কথা কেন শুনবি?” ছেলের বুকে ফুঁপাতে লাগল রাহেলা বানু। রাফসান দু’হাতে মায়ের মুখটা তুলে বলে,
” বললাম তো ভুল হয়েছে আমার। এই কানে ধরছি, নাকেও ধরলাম।” রাফসানের চোখে জল ঠোঁটের কোনে হাসি। রাহেলা বানু রাফসানের হাসিমুখ দেখে ঠোঁট উল্টে কান টেনে ধরলেন। রাগমিশ্রিত স্বরে বললেন,
” সবসময়ই এমন করিস তুই। মা’কে কষ্ট দিতে ভালো লাগে তোর?”
” কোনোদিন না মা। তুমিই আমার সব। আমার পৃথিবী, আমার জান্নাত। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবি না।” রাফসান বললো
” মিথ্যা কথা। আমি তোর সব হলে আমার কথা মেনে নিতি তুই।”
” মানলাম তো।”
” কবে, কখন?” ভ্রুকুটি করে বলে উঁচু গলায় বলে রাহেলা বানু
” আজ, এখন।” রাফসান হাসে। রাহেলা বানু বিস্মিত চোখে চেয়ে দেখেন ছেলেকে। নিজের চোখ, কানে দেখা,শোনা কথা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। রাফসান মায়ের কোলে মাথা রেখে মায়ের আঙ্গুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলে,
” তুমি যেদিন, যাকে বলবে বিয়ে করতে। আমি টু শব্দ না করেই বিয়ে করে নেব মা। তোমার খুশির উপরে কিছুই নেই আমার কাছে।”
” আমাকে ছুঁয়ে বল।”
রাফসান মায়ের হাতে চুমু দিয়ে বলে,
” ওয়াদা করলাম মা। আমার ওয়াদার খেলাফ হয়না কোনোদিন, সেটা তুমি জানো।”
এতোক্ষণে স্বাভাবিক হলেন রাহেলা বানু । ঝুঁকে ছেলের কপালে,গালে চুমু দিলেন। চুলে বিলি কাটতে কাটতে উৎফুল্ল হয়ে বললেন,
” আমার লক্ষী বাবাটা। আমি জানতাম তো আমার বাবু আমাকে নিরাশ করবে না। কোনোদিন না। কাল থেকেই মেয়ে খুঁজব আমি। তোর উপযুক্ত মেয়ে। তোর মনমতো হবে এমন মেয়ে। আমার সোনা বাবাটা।” রাহেলা বানু নানান কথা বলতে লাগলেন। রাফসান মায়ের হাসিমাখা মুখটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার আনন্দ হচ্ছে মা’কে খুশি করতে পেরে। হাজার যুক্তিবাদী, প্রতিবাদী হোক তবুও কিছু জায়গায় মানুষ সেচ্ছায় নিরবে পরাজিত হয়, প্রিয়জনের খুশির খাতিরে।
মায়ের সাথে আরও কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে, মাকে ঘুম পাড়িয়ে বের হয়ে আসলো সে। পানির পিপাসা পেয়েছে, একগ্লাস পানি পান করার ইচ্ছায় বারান্দায় এলো রাফসান। পানি খেতে খেতে হঠাৎ চোখে সামনে একটা দৃশ্য এলো। তৎক্ষণাৎ রাফসান হাত ঘড়ি দেখে নেয়। রাত ১২: ২০ বাজে। বারান্দার শেষ রুমটা থেকে আহনাফ বেরচ্ছে। শার্টের বোতাম লাগাতে ব্যস্ত আহনাফ হেঁটে এদিকেই আসছে। এসবের অর্থ কী দাঁড়ায়? রাফসানের ধারনা অনুসারে ঐ রুমটা এ বাড়ির কাজের লোক জরিনা খালার। নাকি এই ধারনার বিপরীতে কিছু আছে? পুরোটা পানি পান করা হলো না রাফসানের। গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে ভাবছে সে। আহনাফের ঠোঁটের হাসি, এলোমেলো ভাব বলে দিচ্ছে আহনাফ কী করে এসেছে।
এই নীরার মধ্যে কী আছে আহনাফ জানে না। চুম্বকের মতো টানে ওর দেহ সৌন্দর্য আহনাফকে। প্রতিনিয়ত আহনাফের টর্চার, লিবিডো পূরণ, এ বাড়ির খাটাখাটুনিতে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে নীরা। আগের মতো কোমল, তুলতুলে নেই ওর দেহটা। হাড্ডিসার দেহ হলেও আহনাফের ওকেই যেন চাই। প্রতিদিন, প্রতিরাত। আর তো দু’মাস। আচ্ছা দু’মাসে কী নীরার প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যাবে তার জীবন থেকে? জটিল লাগছে সবকিছু আহনাফের। নীরাকে এক সময় সে পেতে চেয়েছিল বৈধ ভাবে। কিন্তু এই মেয়ে তাকে ভাওই দিচ্ছিল না। গুন্ডা ভেবে সহ্যই করতে পারত না আহনাফকে সে। এই তল্লাটের সুন্দরী মেয়েরা আহনাফকে পাওয়ার জন্য পাগল। আর এই দুই টাকার মাস্টারের মেয়ের কিনা এতো তেজ? আহনাফকে প্রত্যাখ্যান করেছিল? কলেজে সবার সামনে চড় মেরেছিল শুধু হাতটা ধরার অপরাধে? আজ কোথায় সেই তেজ? আজ ওর সমস্ত শরীর দুমড়ে মুচড়ে খুবলে খেলেও কিছু করার সাধ্য নেই । এখন কী করে সহ্য করে? স্বামীর ট্যাগ পেয়েছি বলে? অযথায় মাথা গরম করিয়ে রেপিষ্ট বানিয়ে দিল। ধর্ষণ করেছি তাতে কী? বিয়ে তো করেছি না! ব্যস সাত খুন মাফ তাতেই। তিনমাস পরে তালাক দিয়ে ঝামেলা মিটবে। ওর কলঙ্ক মোচন হবে আর আমার পাপ। তারপর আবার আগের মুক্ত স্বাধীন জীবন আমার। কিন্তু এই মেয়েকেও যে চাই আমার। দেখা যাক কী হয়! আহনাফ ঠোঁট কামড়ে হাসে। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না এই হাসি। ভেজা গলা মুহূর্তে শুকিয়ে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাফসান ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। বারান্দার ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে চমকে যায় আহনাফ। মুখটা কাচুমাচু করে ভয়ে ভয়ে তাকায় রাফসানের দিকে। তোতলাতে তোতলাতে বললো,
” ভাই তুমি এসময় এখানে?”
” হুম আমি। কেন কোনো সমস্যা? ” তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে জবাব দেয় রাফসান।
” না! একদম না।” হাসার চেষ্টা করল আহনাফ। কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা মুছে নিচ্ছে বার বার সে। রাফসান আহনাফের ভয় পাওয়া দেখে চোখ ছোট করে। রাফসানকে এভাবে তাকাতে দেখে আহনাফ ঘাবড়ে যায়। অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকানোর এক ফাঁকে সতর্কতার সাথে খালার রুমটা দেখে নেয় সে। না কেউ নেই সেখানে। আহনাফ স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। কাঁপা গলায় বলে,
” ভাই যাই তাহলে?”
“তোর ইচ্ছা। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছিস?” রাফসানের গম্ভীর জবাব।
” না মানে,,। ” রাফসান আহনাফের দৃষ্টি অনুসরণ করে খালার রুমে দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে। এই সুযোগে আহনাফ দ্রুত চলে আসে রুমে। হার্টবিট বাড়ছে ওর। একটুর জন্য ধরা খেয়ে যেত আজ। না! এরপর থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কন্ট্রোল কর আহনাফ। কন্ট্রোল! নীরা তোর, মৃত্যুর আগপর্যন্ত তোরই থাকবে। এ’কটা দিন রেহাই দে। আহনাফ মনকে বোঝায়।
আহনাফের এভাবে চলে যাওয়ায় রাফসানের সকল ধারণা দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়। রাফসান এদিক, সেদিক তাকিয়ে চারপাশটা দেখে নিল। না কেউ নেই আশেপাশে। রাফসান ধীর পায়ে সাবধানে এগিয়ে এলো জরিনা খালার রুমটার পাশে। দরজা ভেতর থেকে দেওয়া নয়। অর্ধেক খোলা। জানালা দিয়ে ঢোকা বাইরের আলোয় ঘরের অন্ধকার ম্লান হয়েছে কিছুটা। আবছা আলোয় রাফসান দেখল, বিছানার উপর অর্ধনগ্ন এক নারীর দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মেয়েটির জীর্ণশীর্ণ ফর্সা পিঠের উপর আলো আঁধারের খেলা চলছে। এলোমেলো চুলে মুখটা ঢাকা। রাফসান দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।রাগে শরীর শক্ত হয়ে উঠেছে রায়হানের। তার ধারণা সঠিক। এই আহনাফ এখনও বদলায় নি। উল্টো দুশ্চরিত্রের খাতায় নাম লেখিয়েছে। আগে তো গুন্ডামি, মারামারি করত আর এখন! ছিঃ! সব হয়েছে বাপ মায়ের অতি আদরে। ছেলের সকল আবদার বিনা বাক্যে মেনে নেয় আহনাফের বাবা- মা। জীবনে ছেলেকে একটা ধমক দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে নি তারা। আহনাফের সকল অন্যায় ইগনোর করে আসার ফলেই আজ এই অবস্থা আহনাফের। এই ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিজ হাতে নষ্ট করে দিল তারা। বোকা গার্ডিয়ান! রাগে চোয়াল শক্ত করে উপরে চলে আসে রাফসান।
কাকের বেসুরো কা! কা! ডাকে ঘুম ভাঙে রাফসানের। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে। সেখানেই সবার সাথে দেখা মেলে আহনাফের। চোয়াল শক্ত করে হাত মুঠ করে রাফসান। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। আহনাফ ভেজা বিড়ালের মতো দৃষ্টি নামিয়েই খাচ্ছে তাকে দেখামাত্র। আহনাফের মা আঞ্জু বেগম ভাতিজার প্লেটে পছন্দের খাবারগুলো তুলে দেন। খুশিতে ডগমগ হয়ে বলেন,
” আমার সোনা আব্বা রাফসান। এই সব খাবার তোর পছন্দ মতো তৈরি করা। খেয়ে বল কেমন হয়েছে? ”
” ভালো হয়েছে ফুপি। তুমি তৈরি করেছ?”
পায়েস দু’চামচ মুখে দিয়ে বলে রাফসান।
রাফসানের কথা শুনে হাসে আঞ্জু। বলে,
” শোনো ছেলের কথা। আমি তৈরি করব না তো কে করবে? তোর ফুপা তো যতসব আক্কাইম্মা কাজের লোক রেখেছে বাড়িতে। তাদের দ্বারা কিছু হয় নাকি?” আঞ্জুর কথা শুনে আহনাফ, রইস চৌধুরী চোখাচোখি করে। জরিনা শব্দ করে হেঁসে রান্না ঘর ছেড়ে বেরোয়। বলে,
” আজকাল মাইনষে নাকে মুখে মিছা কথা লো নীরা। আর বেশিদূর না কিয়ামত।”
” নীরাটা কে খালা?” রাফসানের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় কথাটা। গতরাতের ঘটনার পর এই নামটা শোনামাত্রই রাফসানের কৌতুহল বাড়ল। জরিনা খালাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ছাড়ে। আশ্চর্য হওয়ার ভান ধরে বলে,
” ওমা! সেকি তুমি জানো না? ”
” আমার জানাটা কী অাবশ্যক ছিল খালা?
রাফসান এবার আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ ভীরু চোখে এক নজর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে যায়। সোজা বাড়ির গেট পেরিয়ে বাইরে। জরিনা আহনাফের যাওয়ার পথে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাঁসে। রইস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
” তোমার ফুপু তো দুনিয়ার সব সুনাম নিজের করতে পারলে খুশি হয়। আর তোমার ফুপা,, থাক কমু না কিছু। আমি কিছু কইলেই তো আবার আমি ভালা না।”
” যা বলার ক্লিয়ার করে বলো খালা।” রাফসান গম্ভীর স্বরে বলে
জরিনা আঞ্জুর কালো হওয়া মুখটা দেখে দাঁত পেষে। সেদিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আঞ্জু। স্বামীকে উদ্দেশ্যে করে মনে মনে হাজারটা বকা বকলো সে। রাফসানের কৌতুহলী চোখে তাকানো দেখে হেঁসে ফেললো। বললো,
” আরে পাগল ছাগলের কথা কানে তুলিস না তো আব্বা। জরিনার কী মাথা ঠিক আছে? পোলাডা পানিতে ডুবে মরার পর থেকেই তো ওর মাথা ছিট। ওর কথার কোনো দিক পশ্চিম আছে নাকি? তুই খা আব্বা। ভাবি তুমি চুপচাপ বসে আছ কেন? খাও তো।”
জরিনা দাঁত কটমট করে তাকায় আঞ্জুর কথা শুনে। হঠাৎ তার চোখের কোনা জলে ভরে ওঠে। রইস চৌধুরীর দিকে চেয়ে আঁচল ঝাড়া দেয় সে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গেটে কাছে চলে আসে। ঘুরে তাকিয়ে কান্নাজরিত কন্ঠে চিৎকার করে বলে,
” আমারে যারা পাগল বানাইছে তাগো পাগল না বানানো পর্যন্ত এই জরিনা মরণ হইব না।”
কথাটা বলে রইস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে থু ফেলে জরিনা। রইস চৌধুরী দ্রুত উঠে ঘরে চলে যান। রইস চৌধুরীকে চলে যেতে দেখে জরিনা খিলখিল করে হেঁসে ওঠে। বিড়বিড় করতে করতে গেট পার হয়ে কোথায় যেন চলে যায়।
অতীত স্মৃতি ভাসছে আঞ্জুর চোখে। রাফসান কিছুটা হলেও জানে সেসব৷ দু’জনই নিরব এই মুহূর্তে। জরিনার ব্যবহারে রাহেলা বিরক্ত হয়। এই জরিনার ঔদ্ধত্য তার একদম পছন্দ না। আঞ্জুটা কেন যে এমন সমীহ করে জরিনাকে, বোঝে না রাহেলা। খাবার টেবিলে নিরবতা নেমে আসে। রাহেলা নিরবতা ভেঙে ফের প্রশ্ন করে,” আচ্ছা নীরাটা কে ছিল?এই মেয়েকে নিয়ে এতো কিছু হওয়ার অর্থ কী?”
” আরে ভাবি কিসের আবার অর্থ টর্থ? জরিনা তো এমনই। আর নীরার কথা জিজ্ঞেস করছ? নীরা তেমন কেউ না। জরিনার দুঃসম্পর্কের ভাগ্নি হয়। গত মাস থেকেই কাজ করছে এ বাড়ি। টুকিটাকি রান্না বাড়া করে আরকি? অসহায়,এতিম ভেবে আমিও রেখে দিয়েছি। কে জানত এতোকিছু হবে? ” আঞ্জু পূর্বপকল্পিত ভাবে মিথ্যা বলে নির্দিধায়।
” ওহ! তা তুমি এই জরিনাকে বাড়ি থেকে বিদায় করো না কেন? চরম বেয়াদব একটা। কথাবার্তা খুবই অশোভন ওর। যার বাড়ি থাকছে,খাচ্ছে তাকেই কিনা চোখ গরম দেখায়?” রাহেলা তীক্ষ্ম স্বরে বলে
” আহ মা! থামো তো। ফুপি বাদ দাও এসব। বসে খেয়ে নাও। বসো।”
রাফসান আঞ্জুকে বসতে বলে ফুপার কথা ভাবছে। এতোকথার মধ্যে কিন্তু একটা শব্দও করেনি রইস চৌধুরী। কারন তিনি জানেন এসব তারই কর্মফল। অপরাধীর পরিনাম এমনই হয়। পুরো এলাকার লোককে ভয় দেখিয়ে চললেও জরিনার সামনে তার কোনো ভয়ই কাজে দেয় না। উল্টো নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে জরিনা মাঝেমাঝে তাকে। এই এখন যেমন করল। রাফসান পুলি পিঠায় এক কামড় দিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে। এ রান্না তার ফুপির না। তার ফুপি ঠিকমতো কোনো রান্নায় পারদর্শী নয়। দাদাজানের বড় আদরের ছিল আঞ্জু ফুপি। দাদিজান কোনোদিন রান্নাঘরে ফুপিকে ঢুকাতে পারেন নি দাদাজানের ভয়ে। বিয়ের পর ফুপাকে বলে জরিনা খালাকে রাখিয়েছিলেন। তারপর থেকে জরিনা খালায় এ বাড়ির সব কাজ করে। খালার হাতের রান্নাও এমন নয় তবে কী ঐ নীরার রান্না এসব? নীরা! তাহলে ঐ মেয়েই নীরা! ছিঃ অরুচি আর ঘৃণা জন্ম নিল এসব খাবার দেখে রাফসানের। মুখের পিঠা টুকু মুখে রেখে বাকিটা প্লেটে ফেলে চলে এলো উপরে। রাহেলা কিংবা কেউ বুঝলো না রাফসানের হঠাৎ উঠে যাওয়ার কারণ। রাহেলা অবশ্য ছেলের যাওয়ার একটা কারন আন্দাজ করে বললো,
” হয়ত জরুরি কাজ মনে পড়েছে তাই চলে গেল। অনেক ব্যস্ত তো আমার ছেলে। সকালে যায় আর আসে সেই রাতে। হবেই বা না কেন ব্যস্ত বলো? কতবড় ব্যারিস্টার আমার রাফসান।”
আঞ্জুকে শুনিয়ে শুনিয়ে ছেলের সুনাম করে নিল আকারে ইঙ্গিতে রাহেলা। এটা সে অন্য কারো সামনে তেমন একটা করে না। আঞ্জুর সামনে করল। কারন আঞ্জু একসময় তাকে খোটা দিয়েছিল। স্বামীর সম্পদ, ক্ষমতা নিয়ে কতো কথাই শুনিয়েছে তাদের এই আঞ্জু। আজ সুযোগ বুঝে রাহেলাও শোধ নিল। আঞ্জু উপরে উপরে হাসলেও মনে মনে স্বামীর উপর রাগ ঝাড়ে। তার কারনেই আঞ্জু আজ ছোট হলো। কী দরকার ছিল এদের এ বাড়ি আনার? আসছি বলে খাবার টেবিল ছাড়ে আঞ্জু। রাহেলা মুচকি মুচকি হাসে আঞ্জুর যাওয়ার পথে চেয়ে।
কড়িডোরের শেষ মাথায় এসে রাফসান মুখের পিঠা টুকু থু থু করে ফেলে দিল। রাফসানের একদম পছন্দ নয় দুশ্চরিত্র গোছের লোক। সেটা হোক ছেলে কিংবা মেয়ে। প্রচন্ড ঘৃণা হয় তাদের উপর। আজও হচ্ছে এই আহনাফ আর নীরার উপর। সামনাসামনি একসাথে পেলে হয় দু’টোকে আবার। আচ্ছামতো শায়েস্তা করে ছাড়বে। পাক পৃথিবীটা নাপাক করে ছাড়ে এসব দুশ্চরিত্রের দল। রাগে রাফসানের কপালের রগ দপদপ করছে।
চলবে,,,
ক্যাকটাস🌵
পর্ব ০৫
Writer Taniya sheikh -Tanishq
রাফসান যা ভেবেছিল তাই হলো। রইস চৌধুরী রাফসানকে এখানে ডেকেছে তার ডান হাত বাবলুর জামিনের ব্যাপারে। রাফসান তৎক্ষণাৎ হা না কিছু বলে নি। স্থানীয় থানায় খোঁজ নিতে এসে জানতে পেরেছে বাবলু দাগী আসামী। তার নামে খুন, বলপ্রয়োগ,ভাঙচুর সহ কয়েকটি মামলা রয়েছে। রাফসান চুপচাপ থানার বাইরে এসে দাঁড়ায়। মনে মনে একপ্রকার ঠান নিয়েছে আজই চলে যাবে চট্টগ্রাম। রইস চৌধুরী বা তার পরিবারকে রাফসানের কোনোকালেই পছন্দ ছিল না। আজ তো নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। কেন সে এলো এখানে। মায়ের কথায় এখানে আসা উচিত হয় নি তার। থানার ডান দিকে দৃষ্টি সরাতেই অদূরে একটা মেয়ের উপর চোখ পড়ে। মেয়েটা ক্ষিপ্ত মেজাজে কনস্টেবলের সাথে তর্ক করছে। তাদেরকে ঘিরে উৎসুক জনতার ভীর। রাফসান এগিয়ে যায় সেদিকে। যতো এগোয় ততই মেয়েটির কথা স্পষ্ট শুনতে পায়।
” দেখুন সহজভাবে বলছি মেয়েটির ঠিকানা আমাকে দিন।” মেয়েটি তর্জনী তুলে বলে
” আমি কোনো মাইয়্যা,টাইয়্যা চিনি না। যান তো। হুদাই ডেলি ডেলি আইয়্যা ক্যাচাল করে।” কনস্টেবল বিরক্ত প্রকাশ করে।
” তাহলে আপনি দেবেন না ঠিকানা? ” মেয়েটি বললো
” বললাম তো কার কথা কন চিনি না আমি। থানার সামনে এমনে গ্যাঞ্জাম করলে জেলে ভরে দেব।” কনস্টেবল রেগে গিয়ে বললো। মেয়েটি তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে সে রাগ মোটেও পাত্তা দিল না। দ্বিগুন তেজে বললো,
” কাকে ভয় দেখান আপনি? জানেন আমি কে? সাংবাদিক। লুক। ” গলায় ঝুলানো আইডিপ্রুভ দেখিয়ে বলে।গলা চড়িয়ে আবার বলে, “নেক্সট টাইম জেলে ভরার থ্রেট অন্য কাউকে দিয়েন৷ কতবড় শয়তান এইগুলো ভাবা যায়? একটা অসহায় মেয়েকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। ঠিকানা লুকিয়ে আপনার ঐ বাপ গুলো বাঁচতে পারবে আইনের হাত থেকে? নো ওয়ে। এই মেহের সবকটাকে খুঁজে কোটে তুলবে। মেয়েদের ভোগবিলাসের বস্তু ভাবা তাই না? তিন দিন! এই তিনদিনের মধ্যে খুঁজে বের করবো ঐ মেয়েকে আমি। তারপর দেখবেন কী করি আপনাদের? ” মেয়েটা তুড়ি বাজিয়ে বলে। এমন মারকুটে সাহসী মেয়ে জীবনে প্রথম দেখলো রাফসান। মেয়েটির পার্সোনালিটি বেশ মুগ্ধ করল তাকে। মেয়েটি রাস্তার উল্টো পাশে রাখা বাইকে চড়ে বসলো। জিন্স,টপস আর গলায় ঝুলানো ওড়না পরিহিতা মেয়েটি হেলমেট, কালো সানগ্লাস পড়ে বাইক ছুটিয়ে চলে গেল দৃষ্টি সীমানার বাইরে।
রাফসান এ বিষয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করবে ভেবে একটা চায়ের টংএ গিয়ে বসল। চায়ের টংটা থানার মুখোমুখি। রাফসানকে কিছু জিজ্ঞেস করা লাগল না আগ বাড়িয়ে। সে চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুনলো সেই ঘটনা। একজন মুরুব্বি গোছের লোক টংএ বসে সবাইকে উদ্দেশ্যে করে ঘটনাটা এভাবে বর্ণনা করল,” পাশ্ববর্তী মহল্লার এক স্কুল মাস্টারের মেয়েকে গত মাসে তুলে নিয়ে যায় কিছু গুণ্ডারা। গুণ্ডা বলতে ঐ মহল্লার প্রভাবশালীর পুত্র। মেয়েটাকে বেশ ক’মাস ধরে নাকি উত্ত্যক্ত করে আসছিল ছেলেটা। মেয়েটা একদিন ধৈর্য হারা হয়ে চড় বসিয়ে দেয় গালে। ব্যস হয়ে গেল মহাভারত অশুদ্ধ ছেলেটার জন্য। একটা চড় খেয়ে তার জাত গেল, জাত গেল অবস্থা। জাত কী করে ফিরাবে? মেয়েটাকে রেপ করে? ভালোবাসার এই নমুনা। এই নাকি ভালোবাসা বুঝছ তোমরা? আমাদের জামানায় ভালোবাসা মানেই চোখাচোখি, মুচকি হাসা,প্রত্যাখ্যানেও মধুর বেদনা ছিল। আর এখন মুখেও আনা যায় না এদের কথা। যাক যেটা বলছিলাম,মেয়েটা ধর্ষণ হলো তো হলো আবার সমাজের যত লাঞ্ছনা সব তার মাথায় ঢালা হলো। মেয়েটার বাবা শিক্ষক হয়েও সম্মান বাঁচাতে হাতে পায়ে ধরে ঐ পশুদের কাছেই মেয়েকে দিয়ে এলো। প্রভাবশালী লোক বলে ভয় দেখিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে রেখেছে। এসব আমার শোনা কথা। তবে সত্য একশ ভাগ। এই যে সাংবাদিক মেয়ে দেখলে। এরা গোপনে খবর পেয়েছিল মেয়েটার ব্যাপারে। কিন্তু সত্যিটা উৎঘাটনের আগেই মেয়েটা গায়েব৷ মেয়েটাকে যেহেতু পাওয়া যাচ্ছে না তাই আসল অপরাধীও আড়ালে। সব মানুষ স্বার্থ পর না বুঝলা মিয়ারা। সব যদি স্বার্থ পর হবে তাহলে এই মেয়েটা কেন এতোদূর থেকে ছুটে এলো? রেপ হওয়া মেয়েটাকে তো ও চেনেও না। তবুও দেখ কত মায়া। আর আমরা সব চেয়ে চেয়ে ভবের লীলাখেলা দেখছি।” বয়স্ক লোকটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রাফসান আরও কিছুক্ষণ নিরবে বসে তাদের কথা শোনে। কেউ মেয়েটার সঠিক ঠিকানা বলতে পারল না। সবাই বলছে এর কাছে শুনেছি ওর কাছে শুনেছি। হতাশ হয়ে চলে আসে সেখান থেকে রাফসান। তার নিজেরও যথেষ্ট খারাপ লাগছে মেয়েটির জন্য। মেয়েটি কী অবস্থায় আছে কে জানে?
সন্ধ্যার আজান দিচ্ছে মসজিদের মাইকে। চারপাশে ধীরে ধীরে নামছে আঁধার আগমনের নিস্তব্ধতা। রান্নাঘরে বসে আছি জ্বলন্ত চুলার সামনে। গতকাল রাতের পর শরীরটা বুঝি চলছেই না আমার। আহনাফের সাথে দুপুরে দেখা হয় খাবার টেবিলে। হাবভাবে বুঝাল রাতের ঘটনার জন্য সে অনুতপ্ত। আমি মনে মনে হাসলাম। তার এসব উতলে ওঠা ভালোবাসা দেখলে ঘৃণা হয় আমার, প্রচন্ড ঘৃণা। কিন্তু বলতে পারি না নিজের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে। গত রাতে যে পাশবিকতা দেখিয়েছিল, তা পশুতেও করে না সমগোত্রীয় কারো সাথে। অথচ তার দাবী আমি তার স্ত্রী। স্বামী স্ত্রী তো একে অপরের আভূষণ! তবে আমাকে বার বার লাঞ্ছনায় বিবস্ত্র করতে তার কেন লজ্জা হয় না। মনে মনে ক্ষিপ্ত হলেও বাহ্যিক ভাবে ঠান্ডা টলমলে জল হয়ে রইলাম। দুপুরে তার ভাই ছিল না বাসায়। মামিও রুমে বসেছিল শ্বাশুড়ির সাথে। আর আমার শ্বশুর তো সারাদিন বাড়িতে তেমন থাকেন না। সেই রাতে আসেন। আহনাফ এই সুযোগে খাবার টেবিলে ডেকেছিল তার অনুতপ্ততা বোঝাতে। আমিও জাহির করলাম বুঝেছি, ক্ষমাও করেছি। নিজ হাতে খাবার বেড়ে দেওয়ার সময় আমার হাতটা ধরে সে। দয়াপরবশ হয়ে বলে,
” অনেক শুকিয়ে গেছিস রে তুই নীরা। কষ্ট মনে হয় বেশিই দিয়ে ফেলেছি। কী করব বল? তোর অতীত ব্যবহার মনে পড়লে মাথা ঠিক থাকে না। বুঝিসই তো কেন এমন করি?”
আমি ঘাড় নাড়ালাম। বললাম,” জি!”
আহনাফ বললো,” তাহলে আমার ব্যবহারে কষ্ট নিস না প্লীজ। যা হয়েছে ভুলে যা।এই তিনমাস কেন? পুরোটা জীবন আমি তোকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে কাছে রাখব। আব্বার সাথে কথা হয়েছে আমার। আব্বাও তোকে মন থেকে মেনে নিয়েছে। অতীত ভুলে যাওয়াটাই আমাদের জন্য ভালো হবে। কী বলিস?”
” আমার দেওয়া সামান্য একটা চড় ভুলতে পারেননি আজপর্যন্ত আপনি আহনাফ। আর আমি তো আপনার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত ভিতর বাহির। এতো সহজে ভুলে যাব সব? কী করে বলে দিন সে উপায়? এতো অসম্মান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা কী করে ভুলব?”
” কী রে চুপ করে আছিস যে? মন থেকে মেনে নিবি তো সব?”
” জি!” আমি শুকনো হাসি হেঁসে জবাব দিলাম। আহনাফ তা দেখে স্বস্তি ফেলল। বললো,” ছোটবেলা থেকেই রাগ আমার বেশি বুঝলি নীরা? তোকে কিন্তু মন থেকে চেয়েছিলাম আমি। এখনও চাই। তোর একটা ভুল আমাদের সবকিছু উলট পালট করে দিল। সেদিন যদি এমন করেই চুপচাপ সব মেনে নিতি। তবে এতোকিছু হতো না।”
আহনাফের কথা শুনে স্থির চোখে চেয়ে রইলাম নিচে। ভাবলাম সব দোষ কী আমার তবে? সেদিন কী প্রতিবাদ করে ভুল করেছিলাম? নাকি আজ ভুল করলাম সব নিরবে মেনে । কোনটা সঠিক? আহনাফ অনেক কিছু বলতে থাকল। তার সবই ছিল আমাকে আর তাকে ঘিরে। আমি নিরবে শুনছিলাম আর নিভৃতে জল মুছছিলাম চোখের। খাবার শেষে বাইরে যাওয়ার আগে তার তথাকথিত ভালোবাসা দিল আমাকে৷ দু’বাহুতে জড়িয়ে নিয়ে বললো বিকেলে আমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এখন। না তার আছে খবর, না তার কথার।
দুর্বল শরীরে রাতের রান্না শেষ করে টেবিলে সাজিয়ে রাখছিলাম সেসব। হঠাৎই মাথাটা ঘুরে উঠলো। পড়েই যেতাম আহনাফের মামি না ধরলে। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,
” এই মেয়ে পড়েই তো যেতে না ধরলে। অসুস্থ নাকি?”
আমি বললাম,” না।”
” মিথ্যা বলো কেন? তোমাকে দেখলে যে কেউ বলবে তুমি অসুস্থ।” তিনি বললেন
” না আমি ঠিক আছি। আমি আসি।”
” এই দাঁড়াও। কথার মাঝখানে যাও কই? জরিনার মতোই বেয়াদব দেখছি তুমি। এদিকে আসো।”
আহনাফের মামির ধমকে চুপচাপ তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। তিনি সূক্ষ্ম চোখে আমার আপাদমস্তক দেখে বললেন,” এসব রান্না তুমি করেছ?”
” জি!”
” সকাল এবং দুপুরের রান্নাও?”
” জি!” আমার দিকে ভ্রুকুটি তাকিয়ে বসলেন চেয়ারে। কপালে ভাঁজ ফেলে কিছু ভেবে ফের বললেন,
” তোমার নামই নীরা তাহলে?”
” জি!’
” এতো জি হুজুর, জি হুজুর করছ কেন? অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ জানো তো?”
এবার আর কিছুই বললাম না আমি৷ মাথা নিচু করে রইলাম। আহনাফের মামি সামনে রাখা খাবারের বাটি থেকে কিছু খাবার টেস্ট করলেন। খাবার মুখে দিতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিগলিত গলায় বললেন,
” বাহ! রান্নার হাত তো দারুন তোমার। কার কাছে শিখেছ?”
” আম্মুর কাছ থেকে।”
” তুমি নাকি এতিম? ওহ বুঝেছি! অনেক আগে থেকেই এসব শিখেছ তাই না?”
” আমি এতিম না,তেমন গরিবও না। মেয়েরা এতিম, গরিব হলেই কী রান্না আগেভাগে শেখে?” আমাকে এতিম বলায় রেগে গেলাম আমি। কী বললাম হুশও নেই। এতিম শব্দটা শুনে কান্নায় এলো। ফুঁপাতে লাগলাম। আমার ব্যবহারে জ্বলে উঠলেন তিনি। বললেন,
” আবার মিথ্যা বলো? সকালেই শুনলাম তুমি এতিম আর এখন বলছ তুমি এতিম নও। মিথ্যা শুনেছি আমি তাহলে?”
” হ্যাঁ! ” আমি জোর গলায় জবাব দিলাম। কষ্ট, ক্ষোভ সমস্ত আমার চোখে টলমল করছে। আমার চোখের ভাষা বুঝল কিনা জানি না। চুপ করে গেলেন তিনি ৷ কিছু সময় বাদে নরম সুরে বললেন,
” তাহলে তুমি এতিম নও?”
” না!”
” জরিনা তোমার কী হয়?”
” খালা।”
” আপন খালা?”
” না তো!” কপাল কুঞ্চিত করে জবাব দিলাম। আহনাফের মামি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি তার নিরবতা দেখে বললাম,” আমি কী যেতে পারি?”
” যাও!” দু’কদম এগোতেই আবার ডাকলেন তিনি। শীতল গলায় ডেকে বললেন,
” তুমি কী রাগ করেছ আমার উপর নীরা?”
” আমি এখন কারো উপর রাগ করি না। রাগ করার অধিকার আমার আর নেই।” কথাটা বলে চলে এলাম রুমে। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। সবাই এমন কেন করে আমার সাথে? আমিও যে একটা মানুষ কেন সবাই ভুলে যায়? আমার কষ্ট কেউ দেখে না। কেউ না।
দরজায় খট আওয়াজে পাশ ফিরে চোখ খুললাম আমি। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়ালই নেই। খালাকে দেখে ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত শরীরে উঠে বসলাম। খালাকে এই মুহূর্তে দেখাচ্ছে ঝড়ে বিধ্বস্ত পালতোলা নৌকার মতো। শাড়ির আঁচল শরীরে এলোমেলো প্যাঁচানো, চুলের অবস্থাও উশকোখুষকো। চোখের তারাদুটো স্থির খালার। আমার পাশে বসে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো। অশরীরী ভর করলে যেমন ভয়ংকর হাসি হাসে মানুষ,ঠিক তেমন করে হাসছে খালা। আমার লোম দাঁড়িয়ে গেল তার সে হাসি দেখে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” কী হয়েছে খালা? কই ছিলে সকাল থেকে?”
” অনেক কিছু হইছে রে নীরা? শুনবি কী কী হইছে?” থমথমে গলায় বললো খালা। মনে মনে ভয় পেলাম কিন্তু খালাকে বুঝতে দিলাম না। বললাম,
“বলো! তার আগে কিছু খেয়ে নাও। সারাদিন তো কিছুই খাও নি তুমি। বসো খাবার নিয়ে আসছি।” আমি উঠতে পারলাম না। খালা শক্ত করে আমার শীর্ণ হাতের কব্জি ধরে রেখেছে। ব্যথা লাগছে তবুও হাসলাম। বললাম,
” কী হয়েছে খালা? কিছু বলবে?”
” হ! তুই না শুনতে চাইলি কী কী হইছে? শোন!” খালা চাপা স্বরে বললো
” খেয়ে নাও তারপর শুনি।” আমি বললাম
” কী খামু?” চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করল খালা।
” ভাত, মাছ, মাংসের তরকারিও আছে। যা বলবে এনে দেব। বলো কী খাবে?”
” রক্ত খামু। আহনাফের রক্ত খামু। আইনা দিবি? দিবি আইনা?” অপ্রকৃতিস্থের মতো হাত বাড়ায় খালা। ভয়ে দূরে সরে যায় আমি। একটু উঁচু গলায় বলি,
” এসব কী বলো খালা? ভয় দেখাচ্ছ কেন? আমার কিন্তু এসব ভাললাগছে না। সরো তুমি।”
খালা খিকখিক করে হাসে। আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,
” মোর জ্বালা! ভয় কিসের লো এতো? তোর তো সব শেষ করে দিছে এই শুয়ারের বাচ্চা। তাও ভয় পাস? কী হারানোর ভয় তোর? জীবন? হা! হা! হা! মরবি না কোনোদিন? মরতে তো হইবোই একদিন তাইলে ভয় পাস ক্যান লো ছেরি? আমারে দ্যাখ! আমিও তো আরেকটা নীরা। তয় তোর মতো ভীতু না। ওঁৎ পাইত্তা আছি। শিকার নাগাল মতো আইলেই ছিঁইড়া রক্ত বাইর কইরা খাইয়ালামু। রক্ত খামু কেন জানোস?”
খালা ড্যাবড্যাবিয়ে চেয়ে প্রশ্ন করে। খালার আচরণ আর কথা শুনে ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে এতোটুকু৷ ফ্যাকাসে মুখে আতঙ্কিত চোখে ঘাড় নাড়ালাম। খালার ভয়ংকর চেহারা হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে গেল। নাক টেনে টেনে কাঁদছে খালা। আমি অবাক চোখে চেয়ে আছি। অনেক্ষণ কেঁদে খালা রক্তবর্ণ চোখে ফের আমার দিকে তাকায়। রাগমিশ্রিত স্বরে বলে,
” আমি কাওরে ছাড়ুম না। কাওরে না। আমার ওট্টুকুনি দুধের পোলাডারে পানিতে চুবাইয়া মারল এরা। আমারে কী কয় ঐ শুয়ার বুইড়া খাটাশ জানোস? তুই কেমনে জানবি? তুই তো ছিলি না। আমার শরীলডা খুবলাইয়া খাইছে ই কুত্তার বাচ্চা। আমার এই পেডে একটা পোলা আইল ওর কারনে। ” খালা আঁচল সরিয়ে পেটে হাত বুলাতে লাগল। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে পুনরায় বললো,” আমি কী ইচ্ছা কইরা আনছি পোলাডারে ক নীরা?”
আমার কান্না আসছে খালার কান্না দেখে। কাঁদতে কাঁদতে আমি আবার ঘাড় নাড়ালাম। খালা খেঁকিয়ে উঠলো। বললো,” আমারে দিনরাত খাডাইয়া খাডাইয়া যখন পোলাডা মারতে পারল না জামাই বউ। তখন আরেক ফন্দি করল। আমার চান্দের লাহান পোলাডা। কী যে সুন্দর সুরৎ আল্লাহ দিছিল! তিনডা বছর যাইতে না যাইতে পানিতে ফালাইয়া চুবাইয়া মারল। সবাইরে কইল একলা একলা ডুইব্যা মরছে। পোলারে আমি ঘরে দরজা বন্ধ করে রাইখ্যা গেছিলাম। তাইলে পানিতে ডুববো কেমনে তুই ক? আমার পোলা আমারে কইছে। কী কইছে জানোস? কইছে ও মা, এরাই আমারে ডুবাইয়া মারছে গো। এরাই আমারে মারছে। এগো তুমি ছাড়বা না। শাস্তি দিবা। কঠিন শাস্তি। আমি আমার পোলারা কথা দিছি বুঝলি? কী কথা দিছি তোরে কমু না আমি। আমার পোলা মানা করছে কাওরে কইতে।”
খালা ঘর কাঁপিয়ে হাসছে। শুধু তার ঠোঁট দু’টোই হাসছে। চোখে বানের জল। বাঁধ ভাঙা বানের জল। কতকিছু ভাসিয়ে নেবে এ’ বানের জল তার আন্দাজ করা ভার!
চলবে,,,