#নূর💔
Writer-Moon Hossain
[Shabnaj Hossain Moon]
Part-36
অনন্তর যারা অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কাজ করে, অতঃপর তওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, আপনার পালনকর্তা এসবের পরে তাদের জন্যে অবশ্যই ক্ষমাশীল, দয়ালু।
(সূরাঃ নাহল, আয়াতঃ ১১৯)
মোম পিছনে তাকালো। মিনহাজ কে দেখতে পেলো।
মিনহাজ কোথায় যেন যাচ্ছে । লম্বা লম্বা পা ফেলে বাগানের ভেতর চলে যাচ্ছে । বাগানের ভেতরটা গাছপালা দিয়ে ভর্তি। দিনের বেলায় অন্ধকারে ছেয়ে থাকে। এখন তো রাত। চাঁদের আলো বাগানে প্রবেশ করতে পাচ্ছে না। বাগানের ভেতরটা গুমোটে অন্ধকার ।
ভাই কে অনুসরণ করলো মোম।
পেছনে পেছনে বাগানের ভেতর ঢুকে গেলো। চারদিক নিকষ অন্ধকার ।
ক্যাচ ক্যাচে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে পাখিদের। পাতায় হেঁটে যাওয়া শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। এক দিক থেকে নয়। বহু দিক থেকে।
মোম এদিক ওদিক তাকালো। কাউকে দেখতে পেলো না অন্ধকার । সুদূর থেকে কিছু ছায়া অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে । ছায়া গুলো আড়াআড়িভাবে মোমের দিকে আসছে। ছায়া গুলো মোমের উপর পড়তেই মোম জ্ঞান হারালো।
সে রাতে মোমের জ্ঞান ফিরলো না। প্রচন্ড জ্বরে শরীর গরম হয়ে গেলো।
মোমের ছোট মা পানি ঢালছে মেয়ের মাথায়। মিজানুর সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । ডক্টর এসে দেখেছেন মোম কে। জ্বরের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে কি করণীয় তা জানার জন্য ডক্টর কে আর যেতে দেওয়া হয়নি রাতে। পাশের ঘরে ডক্টরের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে ।
ডক্টরের জন্য আলাদা বাবুর্চি দিয়ে রান্না করানো হয়েছে।
মিজানুর সাহেব বাগানে যাওয়া সবার জন্য নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বাগান পরিষ্কার করাও নির্দেশ দিয়েছেন মালিদের। সারা রাত মোম জ্বরে ভোগলো। জ্বরের ঘোরে সে মিনমিন করে অনেক কিছু বললো। তার প্রায় কথায় স্পষ্ট। জ্বরের ঘোরে বার বার মেহেরাব কে দেখতে পেলো সে। মেহেরাব একটা খোলা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছে। তাকে ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই ধরতে পাচ্ছে না মোম কে মেহেরাব।
শেষরাতে মোমের জ্ঞান এলো। জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত মোমের বাবা সারা রাত নফল নামাজ পড়েছেন। বাকিটা সময় মেয়ের হাত ধরে বসে ছিলেন। এক পলকের জন্যও উঠেনি।
মোমের জ্ঞান ফিরতে দেখে মিজানুর সাহেব স্বস্তি ফেললেন।
-কেমন লাগছে মা?
মোম কোন রকম মাথা দুলাল। তারপর কেঁদে ফেললো হাউমাউ করে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে ।
মেয়ের মাথায় হাত রেখে মিজানুর সাহেব তাকে আশ্বাস দিলেন।
-আমি তো আছি। তোমার বাবা আছে তোমার সাথে ।
খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি?
-বাবা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে খুব। মোম ভোর পর্যন্ত শুধু কাঁদতে থাকলো। মোমের মতো শক্ত মেয়ের কান্নার আওয়াজে পুরো বাড়ি থমথমে হয়ে গেলো। অন্ধরমহলে কানাকানি হতে লাগলো।
ভোরের দিকে আসলাম কে মোমদের মফস্বলের রাস্তায় গাড়িতে বসে থাকতে দেখা গেলো। তিন প্রথম গাড়িতে আর তার লোকজনেরা পেছনের গাড়িতে বসে আছে।একটা বাইন কুলার দিয়ে আসলাম লক্ষ্য করছে মোমদের দালান বাড়িটার দিকে।
কিছু লোক ঠিক করেছে সে মোমদের সকল খবরাখবর পাওয়ার জন্য । তার লোকেরা কিছু বাজারে মানুষের সাথে মিশে গিয়েছে। কিছু মিশেছে মোমদের দাসদাসী মহলের সাথে। খুব সহজেই আসলাম মোমদের অন্ধরমহলের খোঁজও পাবে। এতে মোমদের গতিবিধি টের পাওয়া যাবে। সে মতেই আসলাম নিজের গতিবিধি ঠিক করবে আর তার জন্য বিপদজনক বাংলাদেশে যে উদ্দেশ্যে এসেছে তা পূরণও হবে।
মেহেরাব এই মুহুর্তে পত্রিকা অফিসে বসে আছে।পত্রিকা অফিসে আলামিনের কিছু চেনা পরিচয় রয়েছে । কিছু টাকা দিলেই মেহেরাবের নামে বিজ্ঞাপন বের করা যাবে। মোম পত্রিকা পড়ে থাকলে অবশ্যই মেহেরাবের কাজটা সহজ হবে। এপর্যন্ত পুরো ময়মনসিংহের রাস্তাঘাট অলিগলি হন্যে হয়ে খুঁজেছে মেহেরাবের চোখ মোম কে। মোমকে কি সে হারিয়ে ফেলেছে? আর কি কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না?
মেহেরাবের ভালোবাসা এভাবে হারিয়ে যেতে পারেনা। সে এখনো আশা হারায়নি। একটি বার মোমের খোঁজ পেলে হয়, পৃথিবীর কোন শক্তি এরপর মোমের কাছ থেকে মেহেরাব কে আলাদা করতে পারবে না স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া।
বিজ্ঞাপনের কাজ শেষ হলে মেহেরাব ফ্ল্যাটে এসে বারান্দায় দাঁড়ায় । এখান থেকে নদ দেখা যায়। নদের ঠান্ডা হাওয়া পাওয়া যায়।
মেহেরাব আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে – সুইট হার্ট হয়ার আর ইউ? ডো ইউ মিস মি? আই মিস ইউ ভেরি মাচ।
মেহেরাব রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোম কে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সে রোজা রেখে যাবে। মোম কে কখনো খুঁজে না পেলে আজীবন রোজা রেখে যাবে।
কড়া রোদে মেহেরাব রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছে পাগলের মতো।
প্রচন্ড রোদে দিনের পর দিন হাঁটার কারণে মেহেরাবের সাদা ধবধবে চামড়া কিছু জ্বলে পুড়ে গিয়েছে।রাতে ফ্ল্যাট ফিরলে তোয়ালে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে আলামিন গা মুছিয়ে দেয় মেহেরাবের। রাতেও এখন আর আগের মতো ঘুমোয় না৷ রাতের শহড়েও মেহেরাব হেঁটে খুঁজে বেড়ায় প্রানপ্রিয় স্ত্রী কে।
বোরখা পড়া কোন মেয়েকে দেখলেই সে মোম মনে করে। হাত দিয়ে স্পর্শ করতে চায় মেয়েটি কে। একবার তো না বুঝে বোরখা পড়া মেয়েকে স্পর্শ করতে চাওয়ার জন্য গণধোলাইয়ের হাতে থেকে আলামিনের কারণে বেঁচে যায় মেহেরাব।
আলামিন তাকে বুঝিয়ে বলে এটা বাংলাদেশ। এখানকার সংস্কৃতি অতি প্রাচীন। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো না। এখানে প্রকাশ্যে কোন মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া নিষিদ্ধ ।তার উপর এটা মুসলিম দেশ। পশ্চিমা সংস্কৃতি এখানে খাটবে না। এখানকার মেয়ে অতিশয় লাজুক, নম্র, সংবেদনশীল।
ইফতারে আলামিনের রান্না করা গরম গরম ভাতের সাথে ঘিয়েভাজা আলুভর্তা,ঘিয়েমাখা আলুভাজি এবং পাঁচফোড়ন দেওয়া ডাল নসিবে জুটলো মেহেরাবের।
মেহেরাবের কাছে মনে হচ্ছে এই খাবারের সাথে দুনিয়ার কোন খাবার টিকতে পারবে না। আলামিনের রান্নার হাত অত্যন্ত ভালো।
-দুলাভাই রান্নার স্বাদ কেমন বুঝলেন?
-ভালু ভালু। পারফ্যাক্ট ।
-এইতো অনেকটা পেরেছেন বাংলা বলতে।
-ইটস টু ডিফিকাল্ট।
-ধীরে ধীরে আয়ত্তে আসবে। সব সময় বাংলা বলে চর্চায় থাকবেন।
– থাকবে।
-থাকবে নয় থাকব। নিজের ক্ষেত্রে থাকব, করব, খাব, চলব, শোব ইত্যাদি ইত্যাদি হবে।আই এ্যাম ইউর টিটার। এ্যাম আই ক্লিয়ার?
-হু টিচার।
মেহেরাব কে বাংলা শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে আলামিন। প্রতিদিন রাতে নিয়মিত বাংলা অক্ষর, বাক্য শেখায় আলামিন মেহেরাব কে। আলামিন মেহেরাবের ভাষা শিক্ষক ।
মেহেরাব ইফতার শেষে আবার বের হলো। মোমের খোঁজ তাকে পেতেই হবে।
মিনহাজ দাড়িয়ে আছে একতলা একটি বাসার সামনে। প্রায় মিনহাজ কে বাসাটির সামনে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখা যায়। কোনদিন দিনে আবার কোনদিন রাতের বেলা।
গেইটের কাছাকাছি আসতেই একজন মেয়ে কে দেখা গেলো তিন বছর বয়সী একটি বাচ্চা কে নিয়ে বের হয়ে আসতে।
মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। বোরখা পরিহিতা।
মেয়েটি গেইট পেরিয়ে অটো তে উঠা পর্যন্ত মিনহাজ দাড়িয়ে রইল। রাতের আঁধারে মিনহাজ বাসাটির ঠিক জানালার সামনে এসে দাঁড়ায় । যতক্ষণ পর্যন্ত আলো দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত দাড়িয়ে থাকেমিনহাজ।
প্রায় মিনহাজ এই কাজটি করে।
মিনহাজ বাসাটির সামনে যতবার দাঁড়ায় ততবারই কিছু সৃতি মনে পড়ে যায়। সেদিন বৈশাখের তৃতীয় দিন ছিল। মিনহাজের বিয়ে ছিল গ্রামের একটি মেয়ের সাথে।মেয়েটির নাম রুবিনা। মহাকালী গার্সলে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। মিনহাজের পছন্দ করা মেয়ে। মেয়েটি মিনহাজদের দাস মহলের রমজানের মেয়ে। মেয়েটি কে একবারই দেখে ছিল মিনহাজ। প্রায় সে যখন বাগানে হাটতো তখন গুনগুন করে সুরেলা গজাল ভেসে আসতো তার কানে। গজাল গাওয়া না দেখা মেয়েটির জন্য তার মনে সুক্ষ্ম একটি জায়গা তৈরি হয়।
মিনহাজ মেয়েটি কে কখনো বলেনি তার পছন্দের কথা। মিনহাজ সরাসরি তার বাবা কে বলে কথাটি। মিনহাজ ভেবেছিলো বাবা প্রচন্ড রকমের সিনক্রিয়েট করবে। দেখা গেলো মিজানুর সাহেব স্বাভাবিক ভাবে নিলেন বিষয়টি । মেয়েটির বাবাকে ডেকে এনে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ঐ দিন ছিলো মিনহাজের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। এতো আনন্দ সে কখনো অনুভব করেনি।
মিনহাজ তার বাবার আদেশে ঢাকা গিয়েছিল বিয়ের কেনাকাটা সারতে।এদিকে ময়মনসিংহের মফস্বলে রুবিনা অপেক্ষা করছিল মিনহাজের জন্য । মিনহাজ যেদিন বাড়ি ফেরে সেদিনই রুবিনার বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামের এক স্কুল মাষ্টারের সাথে।
এর সমস্ত ব্যবস্থা করেছেন স্বয়ং মিনহাজের বাবা মিজানুর খন্দকার।
মিজানুর সাহেব ছেলের বাড়ি ফেরার পর স্বাভাবিক ভাবে কথা চালিয়ে গেলো। মিজানুর সাহেবের এতোটুকুও পরিমাণ অনুতাপ হলো না।কষ্ট টা এতো বেশি ছিলো যে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না মিনহাজ।
রুবিনার এখন অন্যের স্ত্রী । অন্যের বাড়ির বউ। পাঁচ বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ের মা। ফের পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। রুবিনার কাঁধে দায়িত্ব । পুরোপুরি সাংসারিক স্ত্রী হয়ে উঠেছে রুবিনা।
মিনহাজ রুবিনার বিয়ের দিন থেকে থেকে সবার মধ্যে থেকেও একেবারে একা হয়ে যায়। যেমনটদ আদরের বোন মোমের সাথে হয়েছে । সবার মধ্যে থেকেও মোম একাকীত্ব নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে ।
মোম কিশোরী ছিল। নিজের ভালো নিজে বোঝার মতো বয়স ছিলো। ছোটবেলার একটা ভুল তার সারাজীবনের কষ্টের মাশুল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ছেলেমেয়েরা ভুল করবে। ভুলটা শুধরানোর দায়িত্ব বাবা-মায়ের থাকে। মিজানুর সাহেব ভুল শুধরানোর জায়গায় প্রশ্রয় দিয়েছিল। মোম অবুঝ ছিল। না জেনে নিজের মনের অনুভূতির কথা শুনেছে সে। শুনতে বাধ্য । কিন্তু মিনহাজ সাহেব সবকিছু জেনেশুনে এমন এক ব্যাক্তির হাতে নিজের আদরের মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন যেটা কোন বাবা তার মেয়ের সাথে করবে না। হ্যাঁ মিজানুর সাহেব ভুলটা শুধরাতে পেরেছিলেন কিন্তু সেটা মেয়ের কষ্টের বিনিময়ে।
মোমের জীবনটাও মিনহাজের মতো একাকীত্বের ভুবনে ডুবেছে। কেউ কি নেই এই দুঃখী দুই ভাই-বোনদের নূরের আলোয় আলোকিত করবে।
মোম আগের থেকে কিছুটা সুস্থ । দিঘির সিঁড়ি তে বসে আছে সে।
আজকের আবহাওয়া টা বেশ আরামদায়ক৷ মোমের পাশে ছয় বছরের একটি গ্রামের রূগ্ন মেয়ে দাড়িয়ে আছে। দাসী মহলের মেয়ে।মোমের সার্বক্ষণিক সঙ্গী । মেয়েটি কে মোমের জন্য মোতায়েন করেছে মিজানুর সাহেব।
মিজানুর সাহেবের কামরার দোতলার বারান্দা থেকে দিঘির পাড় বেশ ভালো দেখা যায়। তিনি বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছে।
মেয়েকে দেখছেন। মেয়েটি তার মায়ের মতো রুপ গুন পেয়েছে। মিজানুর সাহেবের পাশে আসিয়া দাঁড়িয়ে আছেন নিঃশব্দে । অবশ্য উনি সব সময় নিজের অস্তিত্ব নিঃশব্দ রেখেছেন এই বাড়িটিতে। উনাকে মিজানুর সাহেব ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ের দেখাশোনার জন্য বিয়ে করেছেন।আসিয়া মনে করেন মোমের মায়ের মতো মিজানুর সাহেবের স্ত্রীর মর্যাদা কখনো পান নি মিজানুর সাহেবের কাছ থেকে। হ্যাঁ উনি গরীব একটি মেয়েকে মান সম্মান সব দিয়েছেন কিন্তু মোমের মায়ের জায়গা কখনো নিতে পারেনি। মোমের মা মারা যাওয়ার পরও মিজানুর সাহেবের জীবনের অংশ থেকে গিয়েছেন।সতীনের ছেলে-মেয়েকে নিজের ছেলে মেয়ের মতো ভালোবাসলেও সতীন কে প্রচন্ড হিংসে করেন। মোমের মা কে চোখে না দেখলেও সতীন হিসেবে সবচেয়ে বেশি হিংসে করে গোপনে আসিয়া বেগম। তার মনে অতি সুক্ষ্ম ক্ষোভ রয়েছে ।
দিঘির পানি প্রচুর শ্যাওলা । দিঘির পানি শ্যাওলার কারণে সবুজ আকৃতি ধারণ করেছে। মোমের মুখখানা ভেসে উঠেছে স্বচ্ছ সবুজ পানিতে। ছোট ছোট মাছ জাঁক বেঁধে খেলা করছে পানিতে। মোমের মনে হলো মাছেরা মানুষের চাইয়ে সবচেয়ে বেশি স্বাধীন। মোমের মনে হচ্ছে সে কোন কারাগারে বন্দিনী হয়ে আছে। জীবনের কারাগারে, কষ্টের কারাগারে। যার কোন মুক্তি নেই। প্রথমবারের কষ্টটা মানুষ জীবনের শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে কিন্তু দ্বিতীয় বারের কষ্টটা কি হিসেবে গ্রহণ করা হয়?
মোম প্রথমবারের কষ্টে অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলো সেখান থেকে নূরের আলোর মতো মেহেরাব কঠোর হাতে তাকে আলোয় নিয়ে আসে।
নিয়তি আবারও নিজের রুপ দেখিয়ে দিলে মোম কে।
মোম কখনোই নিজের ভালোর জন্য অন্যকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারবেনা। মেহেরাব কে কখনো নয়।মোমের কালো অতীত বারবার হানা দিচ্ছে মোমের জীবনে। মোম বুঝে গিয়েছে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তার অতীত পিছু ছাড়বেনা।
কালো অতীত যা পেছনের তা কেন রঙিন বর্তমানের সামনে আসতে চায়?
মেহেরাবের বাবা পরিষ্কার ভাবে, স্বাভাবিক ভাবে মোম কে মেহেরাবের জীবন থেকে বের করে দিয়েছে। ভালো থাকুক মেহেরাব।
মোমের জীবনের এখন একমাত্র চাওয়া মেহেরাব যেন আল্লাহর দ্বীনি নিয়ে জীবনযাপন করতে পারে একজন মুমিন হয়ে।
মোমের সাথে মিনহাজেরও প্রতিবিম্ব ভেসে উঠেছে দিঘির পানিতে।
মিনহাজ বোনের কপালে হাত রাখলো।
-জ্বরে তো দেখছি তোর শরীর পুড়ে যাচ্ছে । চল রেস্ট নিবি।
তোর কন্ডিশন আমার মোটেও ভালো লাগছে না মোম।
মোম হাসলো।
-তোমার কন্ডিশনও আমার ভালো লাগছেনা ভাইয়া।
তুমি রাত-বিরেতে ঘুরে বেড়াও সেদিনের পর থেকে। কখনো তোমাকে রাতে কামরায় পাওয়া যায়না।সেদিনের পর থেকে একরাতও তুমি ঘুমুতে পারোনা। আমার তো শরীরে অসুখ। যেটার ঔষধ আছে। তোমার তো মনের অসুখ যার ঔষধ নেই। বাহ্যিক অসুস্থতার ঔষধ আছে কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতার কোন ঔষধ আবিষ্কার হয়নি এখনো।
তুমি কি জানো তুমি আমার থেকেও প্রচ্ড বেশি অসুস্থ মানসিকভাবে।
-লন্ডনে গিয়ে তোর উন্নতি হয়েছে বলতে গেলে। ভালো ফিলোসোফি বলতে পারিস।
মোম আর মিনহাজ দুই ভাইবোন একে-অপরের হাত ধরে দিঘির পাড় ঘেঁষে হাঁটছে । দুঃখী দুই ভাইবোনের দুঃখ পৃথিবীর কারও সাধ্য নেই অনুভব করার?
মিজানুর সাহেব দুঃখী দুই ভাই বোনদের অভজার্ভ করছেন।
মিজানুর সাহেব আসিয়া কে লক্ষ্য করে বললেন – আচ্ছা আমি কি আমার ছেলেমেয়েদের প্রতি কোন ভাবে অন্যায় করেছি?
আসিয়ার ধারনা মিজানুর সাহেব আসলে চান না আসিয়ার নিজের কোন সন্তান হোক। আল্লাহ মিজানুর সাহেবের আশা পূরণ করেছেন তাই তো আসিয়া বন্ধ্যাত্ব উপাধি পেয়েছে সবার কাছ থেকে। একারণেই মিজানুর সাহেবের ছেলেমেয়েদের কপালে এতো দুঃখ, দূর্দশা । সামনে আরও কি হয় সেটাই নিঃশব্দে দেখার বিষয় আসিয়ার।
তিনি মনের ক্ষোভ লুকিয়ে মুখে বললেন,
– না। আপনি তো ওদের ভালোর জন্য সিদ্ধান্ত গুলো নিয়েছিলাম। আল্লাহর ইচ্ছে তে যা হওয়ার তা হয়েছে । সবই আল্লাহ তায়ালার মর্জি।
.
আসলাম এখন ময়মনসিংহ-ভালুকা রোডের মাঝামাঝি জ্যামের মধ্যে আটকে রয়েছে। মোমও সেখানে রয়েছে। গোপন সূত্রে খবর এসেছে মোমের বাহিরে বের হওয়ার।
মিনহাজ মোমকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ডক্টের পরামর্শে তাকে হাওয়া বদলের জন্য ভালুকার বাংলো বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ।
আসলাম আটঘাট বেঁধে নেমেছে।
আগে থেকেই এই রোডে তার ছেলেরা ভেজাল বাঁধিয়ে জ্যামের সৃষ্টি করে রেখেছে।
রোডের দুই প্রান্তে ভয়াবহ মুখোমুখি সংঘর্ষ ।
মেহেরাবও আলামিনের সাথে টেক্সি নিয়ে ওপর সাইডে ভালুকা থেকে ময়মনসিংহ আসছিল। মাঝপথে এমন সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে। মোমদের গাড়ির পাশে তাদের টেক্সি। মোম জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে। শরীর দূর্বল।
মেহেরাব টেক্সি থেকে বের হয়েছে।
সংঘর্ষ মেটানো যায় কিনা তার চেষ্টা করতে শুরু করেছে।
দুই-ঘন্টা ধরে ঝামেলা সংঘর্ষ শুরু হয়েছে ভয়ংকর ভাবে।কথা-কাটাকাটি থেকে ভাঙচুরে পরিণত হয়েছে। মোমের কোনও ক্ষতি যেন ভুল ক্রমেও না হয় তা আসলাম বার-বার বলে দিয়েছে তার ছেলেদের।
ঘটনাক্রমে সংঘর্ষে মোমদের গাড়িতে ইট-পাথর ছোড়াছুড়ি করা শুরু হচ্ছে । মোমের গা ঘেঁষে গাড়ির কাঁচ ভেঙে পড়ছে। মিনহাজ সংঘর্ষ ঠেকানোর চেষ্টা করছে বোন কে বাঁচানের জন্য,যেন বোনের গায়ে এতোটুকুও আচর না লাগে ।
#নূর💔
Writer-Moon Hossain
[Shabnaj Hossain Moon]
Part-37
[সাইলেন্ট রিডার দেখতে চাইনা ]
মোমদের গাড়ির চারপাশে ভীড় জমেছে। মিনহাজের সাথে ধস্তাধস্তি চলছে। ভয়ানক সব ছেলেপুলে। দাগী চোর ডাকাত টাইপ। এদের কাজ হচ্ছে তাদের নেতাদের হুকুম তামিল করা। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। ডাকাতি,মার পিট,রক্তারক্তি,খুন-খারাবি ইত্যাদি তাদের জন্য প্রতিদিনের ডাল-ভাত। যেগুলো না করলে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
গন্ডগোল এখন আসলামের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গিয়েছে। আসলাম দিয়াশলাই দিয়ে ছোট একটা আগুনের ফুলকি ধরিয়ে ছিল যেটা কিছু মুহুর্তের মধ্যে দাবানলের রুপ ধারণ করেছে।আসলামের মূল টার্গেট ছিল ছোট-খাট একটা ঝামেলা বাঁধানো। ঝামেলার সময় এক ফাঁকে টুক করে মোম কে নিয়ে যাবে সে। ছোট খাট ঝামেলা থেকে এখন লুটপাট,রক্তারক্তি, মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া শুরু হয়েছে। আসলাম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার মূল নেতা কে বলেছিল মেয়েদের যেন কোন ক্ষতি না হয় বিশেষ করে বোরখা পড়া পর্দা করা মেয়েদের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন।
ডাকাত টাইপ এক লোক মোমের সাইটের জানালার কাঁচে ঢিল মেরে কাঁচ ভেঙে ফেলেছে ইতোমধ্যে ।
মোমের গায়ে বৃষ্টির মতো কাঁচের গুঁড়ো ঝরে পড়েছে। তার মধ্যে এক লোক মোমের হাতে বড়সড় একটা থাবা দিয়ে বসেছে। মোম হতভম্ব ।
মোম ঠিক বুঝতে পাচ্ছে না তার করনীয় কি। মোমের মনে হচ্ছে সে কোন ঘোরের মধ্যে আছে। ঘোর কাটলেই সে দেখবে মিনহাজের সাথে দিঘির সিঁড়িতে বসে সরিষাবাটা মাখানো ঝাল দেওয়া কাঁচা আমের ভর্তা খাচ্ছে। খুব ঝাল।
মোমের হাতে চাপ অনুভব হচ্ছে । মোম শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে।
মোমের দু’দিকে দু’টো লোক।
১ম লোক বলল- এই মেয়ে কে ছেড়ে দে। মেয়েটা আমার জন্য।
২য় লোক বলল- আমি প্রথম দেখেছি।
মোম ভাবলেশহীন চোখে ভাই মিনহাজের দিকে তাকিয়ে আছে। মিনহাজের শরীর রক্তাক্ত। গায়ে শার্ট রক্তে ভিজে আছে। মাথা ফেটেছে বোধয়।
”
মেহেরাব রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
চারপাশে হট্টগোল, চিৎকার-চেঁচামিচি, আহাজারি, ডাকাতি, রাহাজানি। ছোট্ট শিশুদের কান্না শোনা যাচ্ছে।
মেহেরাব যতটা পাচ্ছে সাহায্য করে যাচ্ছে তার সামনে বিপদে পড়া লোকজনদের। মেহেরাব দেখতে পেলো একটি প্রাইভেট কার কে কেন্দ্র করে কিছু লোক তার বয়সী একটি ছেলে কে মারধর করছে। প্রাইভেট কারে নিশ্চয়ই কোন মেয়ে/মহিলা। মার খাওয়া ছেলেটি মিনহাজ। প্রাইভেট কারের মেয়েটি মোম।
মেহেরাব মিনহাজ কে সাহায্য করলো। মোমকে টিজিং করা লোকেরাও মেহেরাবের ভয়ে চলে গেলো আপাতত। মেহেরাব চলে গেলে এই সুন্দরী মেয়েটির জন্য আবার আসার প্ল্যান রয়েছে তাদের।
মেহেরাব মিনহাজ কে মাটিতে বসিয়ে দিলো। রুমাল দিয়ে মাথা বেঁধে দিলো। রুমাল টি কাকতালীয় ভাবে মোমের সৃতি স্বরুপ মেহেরাবের কাছে রয়ে গেছে।
মেহেরাব এবং মিনহাজের মধ্যে ছোট একটি কনভারসন হলো ইংরেজিতে।
মিনহাজ খুব কষ্টে বলল-আমার বোন। আমার বোন কোথায়?
-কথা বলবেন না। আপনি গুরুতর আহত।
মিনহাজ আকুল গলায় বলল- আমার বোন? বোন কেমন আছে?
-শান্ত হোন। উনি ঠিক আছেন। গাড়িতে আছেন।
-আল্লাহ তায়ালা আপনার হেফাজত করুক।
আপনার প্রিয় জনেরা আপনার কাছে থাকুক। এটি একটি বোনের অসহায় ভাইয়ের দোয়া। অবশ্যই ফলবে আসবে।
মোম গাড়ি থেকে নেমে ভাইয়ের কাছে আসতে আসতেই মেহেরাব মিনহাজ কে পানি সংগ্রহ করে পান করিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটা দিলো। আবারও নিয়তি তাদের এক সাথে এনে আলাদা করলো।
মেহেরাবের পায়ে কারও স্পর্শ অনুভব হলো।
সে নিচে তাকালো। ছোট ফুটফুটে একটি মেয়ে শিশু। বয়স তিন বছরের মতো। মেহেরাবের পা ধরে মেয়েটি ভয়ে কান্না করছে।মেয়েটি একা। তার বাবা মা তাকে হারিয়ে ফেলেছে। মেহেরাব মেয়ে শিশুটি কে কোলে তুলে নিলো। আতংকে মেয়েটি কাঁপছে থরথর করে। মেহেরাব শক্ত করে জরিয়ে ধরলো মেয়েটিকে। মেয়েটির বাবা মা কে খোঁজতে হবে। আলামিনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বিপদ হলো নাতো।
মাথায় হাত বুলিয়ে বলল- ক্লেইম ডাউন। আই এ্যাম হিয়ার উইথ ইউ বেবি।
মেহেরাব কে কিছু করতে হবে। নইলে কিছুক্ষণের মধ্যে চারপাশে কান্নার সমুদ্র বয়ে যাবে। সবকিছু মূলে একজন মূল নায়ক থাকে। যার নেতৃত্ব কাজ করা হয়।
গন্ডগোলের মূল হোতা কে খুঁজে পেলেই এই ঝামেলা মেটানো সম্ভব। আসলামের কাছে খবর এসেছে মোমের শ্লীলতাহানির। আসলামের পাশে কেউ নেই। সে ফোনেও কাউকে পাচ্ছেনা।আসলাম কে মূল নেতা চেনে কিন্তু নেতার ছেলেপেলেরা চেনে না। কেউ তার ধমকা ধমকি শুনছে না। বরং উল্টো ধমক দিচ্ছে।
চারপাশে ভীড়। ভীড়ের মধ্য থেকে সে কোন ভাবেই বের হয়ে মোমের বিপদে দাঁড়াতে পাচ্ছে না। কথায় আছে নিজের খোঁড়া কুয়োয় নিজের পড়তে হয়। আল্লাহ তায়ালা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।
এই দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী মরীচিকা, শ্রেফ মরীচিকা!
আজ আমারা মুসলিমরা দুনিয়া নামের মরীচিকার মোহে অন্ধ হয়ে গেছি।দুনিয়ার কাছে আমারা আমাদের আখেরাত বিক্রি করে দিয়েছি।এই দুনিয়ার চাকচিক্য, খেল-তামাশাই আমাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের সমাপ্তি টেনে যে আমাদের এক অচেনা অনন্তকালের জীবনে পদার্পণ করতে হবে সেই ভাবনা সেই চিন্তা আমাদের মস্তিস্ক থেকে উবে গেছে।
এই দুনিয়া হচ্ছে রবের দেওয়া আমাদের জন্য পরিক্ষাক্ষেত্র।যাঁরা রবের দেওয়া আদেশ-নিষেধ গুলো নিষ্ঠার সাথে পালন করে ঈমাণ নিয়ে দুনিয়ার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারবে, তাঁরাই রবের দয়ায় চিরস্থায়ী শান্তির স্থান জান্নাত লাভ করবে।
আর যাঁরা দুনিয়ায় রবের দেওয়া আদেশ-নিষেদ গুলো না মেনে দুনিয়ার লোভ-লালসায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে আল্লাহর নাফরমানি করে ঈমাণ হারা হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে। তাঁরাই রবের ক্রোধের স্বীকার হয়ে চিরস্থায়ী শাস্তির স্থান জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
তাই সময় থাকতে ফিরে আসুন আপনার রবের দিকে। আজই নিষ্ঠার সাথে তাওবাহ করুণ।হয়তো আজকের পর তাওবাহ করার মতো সময় নাও পেতে পারেন,হয়তো আজই শেষ সুযোগ। রবের দরবারে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা প্রার্থনা করুন আপনার কৃত খারাপ কাজ গুলোর জন্য।রাব্বে কারীম হয়তো আপনার তাওবাহ কবুল করে আপনাকে তাঁর রহমতের চাদরে জড়িয়ে নেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে চেয়ে আছেন।কখন আপনি তাওবাহ করে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করবেন।দয়াময় রব কোরআনে কারীমে এরশাদ করেন “নিশ্চই আল্লাহ তাওবাহকারীদের ভালোবাসেন।”(সূরা বাকারা:-২২২)
যদি রাব্বে কারীমের ভালোবাসায় নিজেকে ধন্য করতে চান তাহলে আজই ত্যাগ করুন এই মরীচিকাময় দুনিয়ার মোহ,ফিরে আসুন দয়াময় রবের দোয়ারে।আজই প্রতিঙ্গাবদ্ধ হোন রবের সন্তুষ্ঠিতে জীবন পরিচালনা করার।
”
মেহেরাব দূর থেকে দেখলো একটি লোক বাইকের উপর বসে আছে। পান খাচ্ছে আর একই সাথে সিগারেট টানছে আরাম করে। চেহার নির্লিপ্ত।এতো বড় ঘটনা তাকে আকর্ষিত করছেনা যেন এটা হবারই ছিল এবং তাই হচ্ছে।
টিভিতে যেন লাইভ টেলিকাস্ট চলছে। সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্য দেখে লোকটা নির্বিকার। লোকটি পান খেয়ে ঠোঁট লাল টুকটুকে করেছে।ঠোঁট কতটুকু লাল টুকটুকে হয়েছে সেটা দেখার জন্য বাইকের আয়নাতে ঠোঁট দেখছেন। লোকটির চেহেরা কঠোর। চেহেরায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ। নেতৃত্বের ছাপও আছে অনেকটা যা ভাবসাবে ফুটে উঠেছে।
মেহেরাব লোকটির কাছে গেলো।
লোকটি দেখলো একজন ইংরেজ সাহেব এগিয়ে আসছে।
মেহেরাব কঠিন গলায় বলল- স্টপ ইট।
-জ্বি?
-আই সে স্টপ ইট।
লোকটি পানের পিক ফেললো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো মেহেরাবের মুখের উপর । মেহেরাব তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে।
লোকটা বলল-
পুলিশ বাহিনী যেখানে কিছু থামাতে পাচ্ছে না সেখানে আপনি একা থামাতে পারবেন? (ইংরেজি)
-আমি একা নই। আমার সাথে আল্লাহ তায়ালা আছেন (ইংরেজি)
-আল্লাহ তায়ালা সবার সাথেই আছে। তিনি সবকিছু দেখছেন। উনার হুকুমে দুনিয়াদারি চলে। উনি যখন চাইবেন তখন এসব থামবে আপনাআপনি।ছেলেপেলেরা সব জেলের ভাত খেতে খেতে মোটা হয়ে পড়েছে,আলসে হয়ে পড়েছে, শরীরে জ্যাম বাঁধিয়ে ফেলেছে। একটু হাত পায়ে জ্যামটা ছাড়িয়ে নিচ্ছে ছেলেপেলেরা।
লোকটা পকেট থেকে টুপি পড়ে নিয়ে বলল-
আজান দিচ্ছে। নামাজের সময় হয়েছে। আমি আবার এক ওয়াক্তও নামাজ কাযা করতে পছন্দ করিনা। ছোটবেলার অভ্যাস।
যাই ভাই। আল্লাহ হাফেজ।
মেহেরাব লোকটার আচার-আচরণ দেখে খানিকটা প্রভাবিত হয়েছে । কিছু অবাকও বটে।
দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা কত ধরনের মানুষ সৃষ্টি করেছেন তা তিনি জানেন। মেহেরাব মেয়েটিকে কোলে নিয়ে হাঁটা দিলো।
”
পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে পুলিশ।
মোম এখনো বিশ্বাস করতে পাচ্ছেনা তার সামনে মিনহাজের রক্তমাখা শরীর। মিনহাজ নড়াচড়া করছে না। রক্তে ভিজে উঠেছে মোমের হাত মিনহাজের রক্তে।
মোম ভাইয়ের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়েছে। মিনহাজের মখমলের মতো চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে মোম। ভাইয়ের মাথায় বাঁধা নিজের রুমাল টা চিনতে পেরেছে মোম। তাদের কে বাঁচানো লোকটা মেহেরাব ছিল। মোম মেহেরাবের অস্তিত্ব অনুভব করছে। হ্যাঁ খুব কাছ থেকেই অনুভূতি আসছে। মেহেরাব আশেপাশে কোথাও আছে। মেহেরাব কে খুঁজতে হবে। মেহেরাবের উপস্থিত ভাবতেই মোম একজোড়া শক্ত কঠোর হাতের ভরসা অনুভব করলো।
পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিকে এনেছে মেহেরাব কিছু আহত লোকজনের স্বজনদের নিয়ে। ময়মনসিংহ থেকে এম্বুলেন্স এসেছে কয়েকটা। মেহেরাব নিজ দায়িত্বে আহতদের এম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে পাঠাচ্ছে। মোমও মিনহাজ কে এম্বুলেন্সে তুলে দিলো। মিনহাজ গুরুত্বর আহত।গুরুতর আহতদের সাথে এম্বুলেন্সে থাকা নিষেধ স্বজনদের। জায়গা কম।তবুও মোম শক্ত করে ভাইয়ের হাত ধরে আছে। কিছুতেই ছাড়ছে না মোম মিনহাজের হাত।
”
“মোমের কাঁধে স্পর্শ অনুভব হলো। মোম কাঁধ স্পর্শ করা লোকের দিকে ঘুরলো। মেহেরাব স্বাভাবিক ভাবে মোমের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন মোমের সাথে বিচ্ছেদ ঘটেনি কখনো, একটু আগেই মেহেরাব মোম কে রেখে বের হয়েছিল।
মোম মেহেরাবের দিকে অসহায় ভাবে তাকালো।
মেহেরাব ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললো,
-সুইটহার্ট কিমুন আছু?
-খুব বাজে।একদমই ভালো না।
-কেঁদু না।আই এ্যাম হিয়ার উইথ ইউ সুইটহার্ট ।
মোম মেহেরাবের ভরসার সুরক্ষিত বুকে মাথা রাখলো।
মেহেরাব মোমের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলো।
নিয়তি মেহেরাব কে মোমের কাছে ফিরিয়ে দিলেও অপরদিক থেকে প্রিয় ভাই মিনহাজ কে নিষ্ঠুরভাবে কেঁড়ে নিয়ে গেলো। প্রকৃতি কিছু ফিরিয়ে দিলে, কিছু কেঁড়ে নেয়।
প্রকৃতি একদিক আলোকিত করলে, অন্যদিক অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
ময়মনসিংহে পৌঁছানোর আগেই মিনহাজ আদরের বোনের কোলে মৃত্যুবরণ করে। মিনহাজকে আহত দেখে যতোটা কেঁদে ছিলো মোম, মৃত্যুতে তার একফোঁটা চোখের লোনাপানি ঝরেনি। মিনহাজের ডেড বডি মর্গে রাখার ব্যবস্থা করেে মেহেরাব।মোম হাসপাতালের করিডরের শেষ মাথায় বসে আছে। গায়ে এখনো ভাইয়ের তাজা রক্ত লেগে আছে। মেহেরাব মোমের মাথায় হাত রাখলো।
মোম আগের মতোই চুপচাপ বসে থাকলো।
-সুইটহার্ট। টুমার গায়ে ব্লাড লেগেছে। টুমি ক্লিয়ার হয়ে নাও।
মোম কোন কথা বললো না।
মেহেরাব মোমের হাত ধরে বলল- চলো আমার সাথে।
হাসপাতালের ওয়াশরুমে মোম কে পরিষ্কার করা হলো।
-টুমার হাতে চোট। লুক এ্যাট ইউর হ্যান্ড।
মেহেরাব মোমের চোট লাগা হাত গুলো তে ঔষধ লাগিয়ে দিলো। ক্ষতস্থান ঔষধের ছোঁয়ায় জ্বালা করতে লাগলো। মোম মেহেরাবের হাঁটুতে খামচে ধরলো চোখ বন্ধ করে।
মেহেরাব ক্ষতস্থানে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছে আলতোভাবে। মোম মেহেরাবের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এলো। মাগরিবের আজান দেওয়ার কিছুটা সময় বাকি আছে।মোমদের বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে। মোম এখনো চুপচাপ বসে আছে।কিছুতেই তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। সে মিনহাজ কে রেখে কিছুতেই যেতে যাচ্ছে না। মিনহাজের পাশে থাকতে চাচ্ছে।
মোম কে মেহেরাব বাড়ি যাওয়ার জন্য তাগিদ করেছে। ভাইয়ের চলে যাওয়ার শোকে বোন পাথরে পরিনত হয়েছে।
মোমের সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। মেহেরাব মোমের জন্য কিছু খাবার নিয়ে এলো।
মোমের গালে হাত রেখে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল- সুইটহার্ট কিচু খাও নাও।
মোম এইবার কথা বললো,
-আপনি খেয়ে নিন। আপনার তো একটু পর পর ক্ষিদে পায়।
-আমি রোজা (কথাটা দুজন একসাথে বলল)
দুজন দুজনের দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রয়েছে অবাক চাহনিতে।
দু’জন দু’জনের জন্য রোজা রেখে চলেছে। যেদিন দু’জন দু’জনকে দেখতে পাবে সেদিন রোজার সমাপ্তি।
রোজাদারদের ইফতারের সময় হয়ে এসেছে। মেহেরাব মোমের দিকে পানির বোতল তুলে দিলো। মোম কিছুটা পানি পান করার পর মেহেরাবও একই বোতলের পানি দিয়ে রোজা ছাড়লো। চারপাশে লোকজনের আহাজারি। আহত স্বজনের কান্নাকাটি।দুঃখ যেন সবাইকে গ্রাস করে নিয়েছে।অস্বস্তিকর, ভয়ংকর মন খারাপের পরিস্থিতি। দূর্ঘটনায় তিনজন মারা গেছে। তার মধ্যে একজন মিনহাজ। মিনহাজের কবর খোঁড়া হচ্ছে। বাড়ির পাশের বাগানের একপাশে তার কবরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্দরমহল থেকে মাঝে মধ্যে জোরালো কান্না ভেসে আসছে। মুরুব্বিরা যতবার শুনছে ততবারই নিষেধ করছে কান্না করার।
বাড়িতে মফস্বলের লোকজন আর আত্মীয়স্বজনদের ভীড়। বিয়ে বাড়ি আর মরা বাড়ি এই সময়ে বাড়ি ভর্তি থাকে দূরের-কাছের লোকজনদের।
দূর-দূরান্ত থেকে আসা স্বজনদের বিশ্রামের জন্য একতলার বন্ধ কামরা গুলো দাসদাসীরা পরিষ্কার করা শুরু করেছে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাংলো ঘরের পাশে। ময়মনসিংহ থেকে এক ডজন বাবুর্চি আনানো হয়েছে। তারা হাঁড়ি হাঁড়ি রান্না করে যাচ্ছে ভোর থেকে। মেহেরাব কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে মফস্বলের বাড়ির কান্ডকারখানা দেখছে। ম্যানাজার টাইপ লোক বিদেশি সাহেব মেহেরাব কে শশুর মিজানুর সাহেবের প্রতিপত্তির সাথে আগ্রহ নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে । এি টাইপের লোকেরা মালিকের মেহমানদের প্রতিপত্তি দেখাতে পছন্দ করেন।
মোম বারান্দা থেকে মিনহাজের কবর খোঁড়া দেখতে পাচ্ছে। মোম ভাইয়ের সাথে বাগানে ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলেছে। বাবা মিজানুর সাহেব ব্যাবসায়ীদের সাথে বাগানের একপাশে আলোচনা করতেন আর ফাঁকে ফাঁকে দু’জন কে দেখে আনন্দ পেতেন। কখনো নিজেই যোগ দিতেন ছেলেমেয়েদের সাথে। লুকোচুরি খেলতেন।
দুই ভাই-বোন স্কুল থেকে ফিরেই বাগানে দৌড়ে বেড়াতো। বড় হয়েও দু’জন কত রজনী বেরিয়েছে, ভোরেবেলা হেঁটেছে তার হিসেব নেই। এসব শুধু সোনালী অতীত। আগের মতোই সবকিছু থাকবে, মফস্বল, দালানবাড়ি, দিঘির সিঁড়ি, বাগান,মোমও থাকবে। শুধু মিনহাজ থাকবে না।
মেহেরাব বসার বাংলো ঘরে বসে আছে। ম্যানাজার সাহেব তার দেখাশোনার লোকজন ব্যাবস্থা করেছেন। মিজানুর সাহেব অনুমতি এখনো অনুমতি দেন মেহেরাব কে অন্ধরমহলে ঢোকার। মোমের কাছে যাওয়ার। মেহেরাব অপেক্ষা করছে শশুর মিজানুর খন্দকারের সাথে সাক্ষাৎতের জন্য।
মোমের সাথে মেহেরাবের বিয়েটা কে তিনি ঠিক কিভাবে নিয়েছেন তা এখনো অস্পষ্ট । ছেলের মৃত্যু খবর শুনে তিনি কোন প্রতিক্রিয়া করেন নি। হাসপাতালে লোকজন পাঠিয়ে স্বাভাবিক ভাবে তিনি মসজিদে আজান দিয়ে নামাজ পড়েছেন।
তিনি একমাত্র ছেলের অকাল মৃত্যুতে মর্মাহত নাকি শোকাহত সেটাও স্পষ্ট নয়। ছেলের মুখ দর্শনও করেনি তিনি। ছেলের লাশ বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে ম্যানাজার কে সকল দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিজ কামরায় খিল দিয়েছেন।
মেহেরাব শশুরের গতিবিধি বুঝতে পাচ্ছে না। তাকে আপ্যায়ন করা হচ্ছে কিন্তু ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছে না। এই মুহুর্তে মোমের কাছে স্বামী হিসেবে তার পাশে থাকা উচিৎ ।মেহেরাব এতোটুকু সময়ে বুঝতে পেরেছে মিজানুর সাহেবের প্রভাব আর ক্ষমতা সম্পর্কে। দরজার পাশে একদল লাঠিয়াল বাহিনী দাঁড় করানো আছে। এই ব্যবস্থা কি মেয়ের জ্যামাই মেহেরাব কে পাহারা দেওয়ার জন্য ? মেহেরাব চুপচাপ নাশতা করছে। বাঙালি স্টাইলে চায়ে সমুচা ডুবিয়ে খাচ্ছে। আচ্ছা সে কি তার শশুর এই মফস্বলের জমিদার মিজানুর খন্দকারের নিষেধ ভঙ্গ করে স্ত্রীর কাছে যাবে? কাজটা কি খুব রিস্কি হয়ে যাবে?
.
❤