রঙিন প্রজাপতি পর্ব ৫

#রঙিন_প্রজাপতি
লেখনীতে – Ifra Chowdhury

পর্ব- ৫
.
কেউ একজন আমার হাত চেপে ধরে আড়ালে নিয়ে গেলো। আমি তার বিরুদ্ধে জোর খাটাতে চাইলাম, কিন্তু তার শক্তির কাছে পেরে উঠলাম না। সে আমার সাথে টানাহেঁচড়া করতে লাগলো।
আমি তাকে মোটেও চিনতে পারলাম না। নিজের চেহারা লুকোনোর জন্য সে একটা অদ্ভুতুড়ে মুখোশ পরিধান করে রেখেছে। আমি চেঁচাতে চাইলাম। ঠিক তক্ষুণি সে আমার মুখটাও চেপে ধরলো।
অজানা মানুষটার মতলব একদমই ভালো ঠেকছিলো না আমার। মাথায় উল্টোপাল্টা চিন্তা ঘুরতে থাকলো। ইতোমধ্যে ঘামতেও শুরু করেছি আমি। মনেপ্রাণে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম।

সে আমার দু’হাত দেয়ালের সাথে চেপে ধরে কর্কশ ও ভারী গলায় বলতে লাগলো,
‘এত্তো দেমাগ তোর? হ্যাঁ? তোকে তো একটা চুনোপুঁটি ভেবেছিলাম! কিন্তু তুই দেখি আমার রাণী ইলিশটাকেই শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিস না।’
আমি ওর কথার কোনো অর্থই বুঝে উঠতে পারলাম না। চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালাম আমি। চিৎকার করে কিছু বলতেও চাচ্ছিলাম, কিন্তু পারছিলাম না।

সে আবারও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনি চোখ বুজে ওর হাঁটু বরাবর একটা লাথি মারলাম আমি। সুযোগ বুঝে আমার পাতলা হ্যান্ডব্যাগটা দিয়েই ওর চোখে মুখে সজোরে আঘাত করে বসলাম। শয়তানটা ব্যাথায় ও রাগে চেঁচিয়ে উঠলো। আমিও চিৎকার করে ওখান থেকে বের হতে যাচ্ছিলাম। ঐ মুহুর্তেই কোত্থেকে যেন প্রণব আর দুইটা ছেলে এসে হাজির!

ওরা হন্তদন্ত হয়ে এদিকে ছুটে এসেছে, বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু তারা এখানে কেন? আমি কিছুই বুঝলাম না। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,
‘প্রণব ভাইয়া!’
প্রণব আমার দিকে এগিয়ে দু’কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘তুমি চিৎকার করেছো? কী হয়েছে? ঠিক আছো তুমি?’

প্রশ্নটা করেই ও পেছনে তাকালো। আর ঐ ছেলেটাকে দেখতে পেলো। সে আমাদের ঠেলে দৌড়ে পালাতে চাইলে প্রণবের বন্ধু দুইটা ওকে ঝাপটে ধরে ফেললো। আমি ওর দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রণবকে বললাম,
‘ঐ ছেলেটা আমাকে… হ্যারেজ…’
কথাটা বলার আগেই আমি কেঁদে ফেললাম। প্রণবের চোখে রাগের স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেলাম আমি। ও মুষ্টিবদ্ধ হাতে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলো। দাঁত কটমট করে প্রশ্ন করলো,
‘ঘরে মা বোন নেই, তাই না?’

বলেই এক হাতে ছেলেটার গলা টিপে ধরে অন্য হাতে মুখোশটা খুলে নিলো প্রণব। সাথে-সাথেই আমরা সব্বাই চমকে উঠলাম। প্রণব স্তম্ভিত ও কম্পিত কন্ঠে বললো,
‘সোহাগ..তুই!’

আমরা সকলেই যেন আকাশ থেকে পড়লাম। ঐ ছেলেটা আর কেউ নয়, প্রণব ভাইয়ার বন্ধু সোহাগ। আমি কান্না নিয়েই ভ্রু কুচকে বললাম,
‘সোহাগ ভাইয়া, তুমি আমার সাথে…’
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলাম না আমি। এক গভীর চিন্তায় পড়ে গেলাম। সোহাগের এই কাজের পেছনে প্রণবেরও হাত নেই তো? ও কি সব জেনে গেলো? আর আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই প্রণবই ওকে পাঠিয়েছে? আমি চরম দ্বিধায় ভুগতে লাগলাম।

আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে প্রণব হুংকার দিয়ে উঠলো। সোহাগের কলার চেপে ধরে উত্তেজিত কন্ঠে বলতে লাগলো,
‘সোহাগ! তুই দিবার সাথে কী করতে যাচ্ছিলি? আর কেন ইয়ার? তোকে এতো ভালো ভাবতাম আমরা, আর সেই তুই-ই…’
ওর বন্ধুরাও অবাক হয়ে সোহাগকে ঘিরে আছে। তাদের মুখে কোনো কথা নেই। সবার চোখে মুখে আশ্চর্য হওয়ার ছাপ।

প্রণব সোহাগকে মারতে যাচ্ছিলো, সোহাগ তার আগেই হাতজোড় করে ভয়ভীত চেহারায় জবাব দিলো,
‘প্রণব, ভাই, বিশ্বাস কর্, আমি খারাপ কিচ্ছু করতে যাচ্ছিলাম না। ভাই…’
‘চুপ কর্ বেয়াদব। বিশ্বাস শেখাচ্ছিস আমায়? হ্যাঁ? সত্যি শিখিয়ে দিলি বিশ্বাস! তোকে যে কত্ত বিশ্বাস করতাম, সেটাই তুই আজ বুঝিয়ে দিলি আমায়। বিশ্বাসঘাতক কোথাকার!’

সোহাগ তোতলাতে তোতলাতে বলতে লাগলো,
‘প্রণব! আ-আমার কোনো খা-খারাপ মতলব ছিলো না, বোঝার চেষ্টা কর্..’
‘থাম তুই! খারাপ মতলব যদি না-ই থাকতো, তবে তুই দিবার সাথে এই নিরিবিলি জায়গায় কেন? সেই সাথে আবার মুখোশও পড়ে এসেছিস? বাহ রে। পাপ লুকোনোর কতো প্রচেষ্টা!’

সোহাগ এবার নীরব হয়ে গেল। ও প্রচন্ড ঘামছে। ওর চোখেমুখে অস্থিরতা। কোনো কথা বলছে না সে। হুট করেই সে দৌড়ে ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। সাথে সাথে প্রণব আর ওর বন্ধু নিখিলও ছুটলো। তার আগে ওর অন্য বন্ধুকে বলে গেলো,
‘শিহাব, তুই দিবাকে এগিয়ে দে। আমরা ওদিকে যাচ্ছি।’

ওরা সোহাগের পেছনে দৌড়ে গেল। এদিকে আমি আর শিহাব মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমি পুরো স্তব্ধ। সোহাগ ভাইয়ের এমন আচরণ করার কোনো কারণ খুজে বের করতে পারলাম না আমি। বড্ড অবাক লাগছে।

শিহাব আমার ধ্যান ভাঙিয়ে বললো,
‘দিবা চলো?’
আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। শিহাব আবারও বললো,
‘প্রণবেরা গেছে ওকে ধরতে। তুমি ভয় পেও না। আসো, বাসায় যাও। আমি এগিয়ে দিচ্ছি।’
আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। এই মুহুর্তে কারোর প্রতিই বিশ্বাস কাজ করছে না। আমি হতবাক।

আমি শিহাবকে বললাম,
‘না ভাইয়া। আমি নিজেই যেতে পারবো। ধন্যবাদ।’
বলেই আমি দ্রুত পা চালিয়ে একাই ওখান থেকে চলে এলাম। শিহাব পিছন পিছন ডাকলো আমায়। কিন্তু আমি জবাব দেওয়া তো দূর, ঘুরেও তাকালাম না। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রওনা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে।

______________________

ঐ ঘটনার পর আজ দু’দিন ধরে ভার্সিটি যাচ্ছি না। আজ তৃতীয় দিন। আজকেও যাবো না। ভালো লাগছে না কিছুই। বাসায় একা একা সময় কাটাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। জানি না কেন।

সকাল বেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিলাম আমি। তখনি আম্মু চেঁচিয়ে উঠলো,
‘দিবা কই রে? তোদের ছোট মামা আসছেন। যা দু’বোন নিচে গিয়ে নিয়ে আয় ওদের।’
আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও জবাব দিলাম,
‘যাচ্ছি আম্মু।’

দিয়া গোসলে গিয়েছে। তাই আমি একাই বের হয়ে নিচে গিয়ে মামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিরক্ত লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই। গেইটের সামনে কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম।

আচমকা প্রণবের সাথে দেখা হয়ে গেল আমার। এখন তো ওর ভার্সিটিতে থাকার কথা। ভ্রু কুচকালাম আমি। প্রণব এতক্ষণ খেয়াল করেনি আমায়। এবার আমাকে দেখেই অবাক হয়ে হা করে তাকালো। আমাদের চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম আমি। সাথে সাথেই ঐদিনের ঘটনাটাও মনে পড়ে গেল আমার। মুহুর্তেই অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগলাম আমি।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here