তুমি অতঃপর তুমি পর্ব ১৯+২০

তুমি অতঃপর তুমিই (২য় খণ্ড শুরু)
Writer Taniya Sheikh

১৯.

“আমি স্বর্বস্ব বিলিয়ে তোমাকে চেয়েছিলাম,শুধুই তোমাকে। না তোমাকে পেলাম আর না তোমার ভালোবাসা। সব হারিয়েছি তোমার সাথে। স্বর্বস্বান্ত আজ আমি। না তুমি নেই, না অন্য কিছু। আজ বুঝেছি। হ্যাঁ, বুঝেছি। হৃদয়হীনা তুমি। তোমার হৃদয় নেই বলেই কী আমার হৃদয়টাও এভাবে দুমড়ে মুচড়ে টেনে ছিঁড়ে ক্ষত বিক্ষত করবে? হা! দূর্ভাগ্য আমার। তবুও বলব। হাসি মুখে বলব। ভালো থেকো প্রিয়তমা। অনেক ভালো। কভু সামনে এসো না ফের। ভালোবাসারা তো নিষ্প্রাণ আজ। যদি তোমাকেও নিষ্প্রাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠি? না! এসো না ফের।।”

চারবছর পর একই রকম ঝড় উঠেছে বহুবার। এই যে আজও তো প্রবল ঝড়ে অশান্ত প্রকৃতি,অশান্ত মন। শান স্থির চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঝাপটা দিয়ে বৃষ্টি এনে ভিজিয়ে দিচ্ছে বাতাস। ওদের প্রতি শানের তবুও কোনো অনুরাগ,অনুযোগ নেই৷ এই অশান্ত প্রকৃতির সাথেই তো ওর নিবিড় মিতালি। আজ চারবছর, তিনমাস, আঠারো দিন গত হলো ইমা নেই তার জীবনে। সময়ের সাথে সাথে নাকি মানুষ সব ভুলে যায়,মানিয়ে নেয়। কই শান তো পারছে না৷ কিছুতেই সে পারছে না৷ বরঞ্চ ইমা নামক মানবী অশরীরী হয়ে প্রতি মুহূর্ত তাকে অনুসরণ করে। প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা তাকে দেখতে পায় শান। শুধু ছুঁতে গেলেই হারায়। বুকে অসহনীয় এক ব্যথা সর্বক্ষণ পীড়িত করে। একাকিত্বের যন্ত্রণা নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীর রিক্ত হৃদয়ে ক্রমশ ঘুমের অতলে ডোবে। সেখানেও ইমার বিচরণ। অতীতের কিছু মধুর স্মৃতিচারণ।

কিছুদিন ধরেই দেশের সংবাদ মাধ্যমে একটা বিষয় নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ দেশের মানুষ সহজে চিন্তিত হলেও ঘাবড়ে যায় না। ইমার মনে হচ্ছে এবার এর ব্যতিক্রম ঘটবে। সুদূর চীন দেশে এক ভাইরাস ছড়িয়েছে। যার ধাক্কা পুরো পৃথিবীতে লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মৃতের এবং আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে আক্রান্ত দেশগুলোতে। গত কয়েকদিন ধরে ফ্যাক্টরিতে এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। সবাই বলছে, এই ভাইরাস বাংলাদেশে ছড়ালে এ দেশের মানুষ অনাহারে,বিনা চিকিৎসায় মরবে। উন্নত দেশগুলোর মত আটকে থেকে খাদ্যসংস্থান সম্ভব নয়। এ দেশের নিম্ন আয়ের মানুষদের কী হবে? তারা তো দিন আনে দিন খায়। গৃহবন্দী হয়ে থাকলে খাদ্য পাবে কোথা থেকে? ওদের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের কথাও স্মরণ হয় ইমার। পুরো দেশে কারফিউ জারি করলে তার অবস্থা তো শোচনীয় হবে। এই সামান্য বেতনের চাকরীটাও যদি না থাকে তবে না খেয়ে মরতে হবে তাকে। ইমার ভেতরে অস্থিরতা বাড়ে। এই অস্থিরতা চরমরূপ ধারণ করে দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ঘোষণায়। ফ্যাক্টরিতে তার মতো বাকি লেবাররাও চিন্তিত। ফ্যাক্টরি এমনিতেও বন্ধ হওয়ার পথে ছিল। এসব কারনে মালিক যেন একেবারে মুষড়ে পড়লেন৷ ভেতরে ভেতরে কানাঘুষা চলছে অতি শীঘ্রই ফ্যাক্টরি বেঁচা হবে৷ সেদিন ফ্যাক্টরির কাজ শেষে ফেরার পথে রাহেলার সাথে কথা হলো। রাহেলা ওর সহকর্মী। গত তিনবছর ওরা একসাথেই এই বুটিকের ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে এবং রুম শেয়ার করে থাকছিল। মাস দুই হয়েছে রাহেলা আরেক সহকর্মী ইকবালকে বিয়ে করে আলাদা বাসায় উঠেছে। ইমার তাতে অসুবিধায় হয়েছে বলা যায়। এখন একাই পুরো বাসা ভাড়ার খরচ তাকে বহন করতে হচ্ছে। মাসের শেষে আগের মতো টাকা জমানো হয়না৷ তার উপর আসন্ন এই করোনা ভাইরাসের থাবা! রাহেলা ইমাকে ওর সাথে নতুন কাজে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিল। কাজটা হলো মানুষের বাসায় পার্মানেন্ট কাজের লোক হয়ে থাকা। এই যেমন,মালি, ঝাড়ুদার। এদের জন্য ধনীদের বাড়ির পেছনে ছোটো ছোটো রুমও করা আছে। রাহেলার কথা, টাকা না হোক দু’বেলা খেয়ে পড়ে তো বাঁচা যাবে এর মধ্যে। আর যদি ভাইরাস তেমনভাবে না ছড়ায় তবে আবার এই জীবনে ফিরে আসবে ওরা। বুদ্ধিটা খারাপ না৷ ইমার মনে ধরে রাহেলার বুদ্ধি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কর্মস্থল ঢাকায়। অনাহারে মরে যাবে তবুও ঢাকা যাবে না ইমা৷ রাহেলা ইমার অতীত কিছুটা হলেও জানে। এই অনাথা মেয়েটার প্রতি ওর দরদও খুব৷ একসাথে এতটা দিন থেকেছে, খেয়েছে একটা মায়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওদের মধ্যে। পরদিন স্বামীর সাথে কথাবার্তা বলে ইমার জন্য ঢাকার বাইরে আশুলিয়ায় কাজ ঠিক করে। তবে সেখানে কিছু শর্ত থাকবে। সেটা কী, রাহেলা বা যে ব্যক্তি কাজ যুগিয়ে দিচ্ছে সেও জানে না৷ ইমা একবার ভেবেছিল নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে যাবে না৷ কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে দেখে রাজি না হয়ে পারল না সে। অবশেষে তিনজন দ্রুত ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে, বাড়িওয়ালার ভাড়া চুকিয়ে রওনা হলো ঢাকা এবং আশুলিয়ার উদ্দেশ্যে। এই চেনা স্থান ছেড়ে যেতে কষ্ট হলো খুব ইমার৷ ওর মা মরেছে এই শহরেই। মায়ের কবরটাও এখানে। শেষবারের মতো মায়ের কবরটা দেখতে গিয়েছিল ইমা। কবরস্থানের অদূরে দাঁড়িয়ে দু’ফোটা অশ্রু ঝরিয়ে দোয়া করে মায়ের জন্যে। ইমা এবং রাহেলাদের গাড়ি আলাদা হলো। ইমার ভেতরকার শূন্যতা জানান দেয় সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত তার কেউ নেই। আশুলিয়াগামী বাসের জানালার পাশের সিটে বসেছে ও। শোঁ শোঁ করে জনপদ,প্রান্তর, গঞ্জ আড়াল হচ্ছে। চেয়ে চেয়ে শুধু সেই সামান্য কিছুক্ষণ স্থির স্থানগুলো দেখছে ইমা। দুপুর হয়ে এলো। অভুক্ত পেটটা বিদ্রোহ শুরু করেছে। ইমার সাথে বিদ্রোহ করে তারা কখনোই পেরে ওঠেনা৷ বিশেষ করে গত চার বছরে। ইমা চুপচাপ বসে আছে। বাস কয়েকস্থানে থামল। আশুলিয়া কি’না জিজ্ঞেস করতেই হেল্পার বলল,

” আপা, চিন্তা কইরেন না। আপনার সাথে যারা ছিল তারা কইছে আশুলিয়া আইলে আপনেরে যেন নামাই দেই।”

ইমা কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বসল। কয়েক রাতের অপরিণত ঘুম কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের পাতা ভেঙে নেমে আসে। বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারেনা বাইরের রৌদ্র তাপের কারনে। তাছাড়া পাশ থেকে মানুষের ঘামের উৎকঠ গন্ধ নাকে এসে লাগতেই পেট গুলিয়ে যাচ্ছে। বমি বমি ভাব আসছে ইমার৷ হিজাবের উপরে হালকা হাত চেপে বসে রইল। এভাবে আরও ঘণ্টাখানেক সময় অতিবাহিত হতেই হেল্পার আশুলিয়া,আশুলিয়া বলে গলা ছাড়ে। বাসের গতি তখনো চলন্ত। ইমা তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ায়। হ্যান্ডব্যাগটা হাতে নিয়ে পায়ের কাছের বড়ো দু’টো ব্যাগ আর জিনিসপত্রের বস্তাটা টানাটানি করে এগিয়ে সিটের বাইরে রাখে। বাস থামতেই একে একে সব নেমে যায়। এতোগুলো ব্যাগ দেখে হেল্পার এগিয়ে এসে বস্তা আর ব্যাগ নামাতে সাহায্য করে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে আলেয়া খালার জন্য। এই আলেয়া খালায় কাজ যুগিয়ে দিচ্ছে ওদের। কড়া রোদ মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে ইমা। ক্ষুধার্ত পেটটায় ইতোমধ্যে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। সব উপেক্ষা করে পাশের বড়ো গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। চার্জ না থাকায় মোবাইলটাও বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর নির্ধারিত স্থানে এসে চোখ বুলিয়ে নেয় আলেয়া বেগম। এতো মানুষের মধ্যে অদূরে দাঁড়ান খয়েরী রঙের চেক বোরকা পরা মেয়েটির তার চোখ এড়ায় না৷ ছবিতেও একই বোরকা পরা ছিল বলেই সহজে চিনে যান আলেয়া বেগম। এতোক্ষণের কুঞ্চিত ভ্রু এবার স্বাভাবিক হয়। সামনের দোকান থেকে একটা খিলিপান কিনে মুখে পুরে নেন। তারপর হাস্যোজ্জ্বল মুখে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যান মেয়েটির দিকে। ক্লান্ত,অবসন্ন ইমা সম্পূর্ন শরীরের ভর মেহগনি গাছটার সাথে দিয়ে আবছা চোখে চেয়ে আছে। চক্ষু জ্বলছে কড়কড়ে রোদে। আলেয়া পাশ থেকে এসে দাঁড়ায় ওর সামনে। আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বলে,

” ইমা?”

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকা ইমা সচকিত হয়ে তাকায়। আলেয়া বেগমের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখে সহসা সকল ক্লান্তি দূরীভূত হলো। নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় বলল,

” জি, আপনি আলেয়া খালা? ”

” হ, তোমার শরীর কী খারাপ? মনে হইতাছে অসুস্থ তুমি।”

” না, খালা। আসলে এভাবে জার্নি করার অভ্যাস নেই তো তাই কিছুটা ক্লান্ত লাগছে।”

” তাই কও। আমি তো ডরাই গেছিলাম গা। বুঝোই তো দিনকাল ভালা যাইতাছে না। কিছু মনে করছনি আবার?”

” না।” ইমা মাথা নেড়ে বলে। আলেয়া আগের মতো হেসে হেসে নিচ থেকে বস্তা আর ব্যাগটা হাতে তুলে নেয়। যেতে যেতে বলে,

” রাহেলা আমার দূর সম্পর্কের বোনঝি লাগে। সম্পর্ক দূরের হইলেও আমরা ঘনিষ্ঠ। ঐতে তোমার কথা কইল,তুমি নাকি ঢাকা যাইবার চাও না। সত্য কথা বলতে আমি তোমার কাম জুটায় দিতাম না৷ কেমনে দিতাম কও? কী আইতাছে জানোয় তো। শুনছি সাংঘাতিক ভাইরাস নাকি সেইটা। তা হোক। আমরা গরিব, আমাগো কোনো ভাইরাস ভুইরাসে ধরত না৷ ওসব বড়োলোকি ভাইরাস বড়োলোক গো অয়। আর তোমরা তাগো কাছেই থাকতে যাইতাছ। এইডা কোনো বুদ্ধির কথা অয়ল? আমি তো সাফ মানা করছিলাম কিন্তু রাহেলা ছেরিডাই শুনল না। না শুনলে কোনো জোর আছে? নাই। তুমি ভাইব না তোমার উপকার করতাছি। উপকার আমি আলেয়া নিজের ছাড়া কারো করি না। এই যে যেহানে তোমারে লইয়া যাইতাছি হেই বাড়ির লোক কামের বেডি লাগব,কামের বেডি লাগব কইয়া কান খাইয়া ফালাইছে আমার৷ ছেরি নিজে হইল ডিরাইভারের বউ। আর কথাবাত্তা শুনলে মনে অয় হেইতেই বাড়ির মালকিন। আমার তো রাগ লাগে কিন্তু গরিবের রাগের মূল্য কয় আনা? সিকি আনাও না৷ এই যে তোমারে কাম ঠিক কইরা দিমু বিনিময়ে হাজার খানেক টাকা দিব কইছে।” টাকার কথা মনে পড়তেই আলেয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায়।পেছনে তাকিয়ে ইমার দিকে চেয়ে বলে,

” ভালা কতা, আমার পাওনা কহন দিবা তুমি? অহন না মাস শেষের টাকা পাইলে। আমার মনে অয় অহন দিলে ভালা হইব।”

” এখনি দিচ্ছি।” ইমা হ্যান্ডব্যাগের চেন খুলতেই আলেয়ার চোখ চকচক করে ওঠে। তারপর এদিক ওদিকে তাকিয়ে মানুষজন দেখে মুখ কালো করে বলে,

” অহন থাক৷ ঐ বাড়ি পৌছায় গেলে দিয়ো।”

আবার দুজনে হাঁটতে থাকে। এভাবে কিছুদূর গিয়ে ওরা অটোতে ওঠে। অটো এসে পৌঁছায় বাজার মতো আরেকটি স্থানে। সেখান থেকে ওরা ভ্যানে চড়ে বসে। পিচ রাস্তা শেষ হয়ে ইট বিছানো রাস্তা ধরে ভ্যান এগোয়। দু’পাশে সবুজ ক্ষেত,পতিত জমি, মাঝে মাঝে ইটের দেয়াল দেওয়া কয়েকটি স্থান। ভ্যান যত এগোচ্ছে ততই ইমা বুঝতে পারছে তারা লোকলয় থেকে দূরের কোনো জায়গার দিকে যাচ্ছে। আগের ইমা হলে প্রশ্ন করত। এই ইমা নির্বিকার। ঘণ্টার দুই পরে ওরা এসে হাজির হলো একটা বড়ো দ্বিতল পুরোনো খামারবাড়ির বাড়ির গেটের সামনে। এই বাড়িটা ছাড়া আশেপাশের কয়েক মাইলের মধ্যে কোনো বাড়িঘর নেই৷ ইমার বুক দুরুদুরু করতে লাগল আশেপাশের তাকিয়ে। মাঝ বরাবর সরু রাস্তা চলে গেছে এঁকেবেকে। দুপাশে যতদূর চোখ যায় আবাদি এবং কিছুটা অনাবি জমি। লোকালয়ের কোলাহল,কৃত্রিমতা ছাড়া সবই আছে। ইদানীং কালে মানুষের মাঝে এক টুকরো প্রকৃতি খুঁজি আমরা। এখানে যেন তার ভিন্ন চিত্র। প্রকৃতির মাঝে মানুষ খুঁজে ফিরতে হবে। আলেয়া খালা বাড়ির দারোয়ানকে কী যেন বললেন দূরে দাঁড়িয়ে। ইমা এতোদূরে দাঁড়িয়ে তাদের কানাকানি শুনতে পেল না। মনটা কেমন আনচান আনচান করছে এমন অদ্ভুত রকমের জায়গায় এসে। যদিও অদ্ভুতের সাথে সৌন্দর্য কথাটা না বললেই নয়। সবুজের এই সমারোহে তাকিয়ে ভাবতে বাধ্য হয় পৃথিবী এতোসুন্দর না জানি স্বর্গ কত সুন্দর! অদেখা স্থানটার প্রতি বুঝি এভাবেই টানটা বাড়ে মানুষের। প্রচন্ড ক্ষুধা পেটে এর বেশি প্রকৃতি প্রেম ইমার আর হলো না। তৃষ্ণায় জিহ্বা অসাড় হয়ে আসে। গেটের একটু দূরে বসার জন্য বেঞ্চি বানানো। ইমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বসবে বলে সামনে এগোতেই আলেয়া হাত টেনে ধরে।

” যাও কই?”

ইমা নিস্প্রভ চাহনীতে আলেয়ার দিকে চেয়ে বলল,

” না, কোথাও না।” মিথ্যা বলল ইমা। নিজের দূর্বলতা ফের আর প্রকাশ করতে চায় না সে।

” চলো, ভেতরে যাই।”

” জি।”

গেটের ভেতর প্রবেশ করতেই চক্ষু চড়কগাছ। বাইরের নির্জনতা একেবারেই ভেতরটা ছুঁতে পারেনি। আলিশান বাড়ির অদূরের ডানদিকে হাস,মুরগির ফার্ম, গোরুর গোয়াল,ঘোড়ার আস্তবল। সেখান থেকে ভেসে আসছে সেসবের ডাক। বাড়িটিকে ঘিরে কৌতূহল যেন বেড়েই যাচ্ছে। ঠিক যেন রূপকথার কোনো খামার বাড়ি। পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি করে সাজানো গুছানো সব। এ বাড়ির পাশের নানান বাহারী ফুলের সুবাস দখিনা বাতাস সঙ্গে করে উড়ছে। ক্ষুধার্ত ইমার অর্ধপেট তাতেই যেন ভরে গেল সেই মুহূর্তের জন্য। ইমার ঘোর কাটে অচেনা মেয়েলী গলার স্বরে।

” খালা, এতোদিন বাদে কী মনে করে?”

ইমার দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রমণীটি এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। ভেজা হাত দু’টো ওড়নার আঁচলে মুছতে মুছতে ইমার ভারী ভারী ব্যাগ আর বস্তার দিকে তাকিয়ে আবার বলে,

” এসব কী?”

আলেয়া বিগলিত স্বরে বলে ওঠে,

” ঐ দেহো, তুমিই না কইছিলা তোমাগো সাবের জন্য কামের বেডি লাগব।তাইতো নিয়া আইলাম।”

রমণী এবার বেশ চমকিত চোখে তাকাল ইমার দিকে। আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে আলেয়ার বাহু টেনে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। ইমা ওদের ফিসফিসের মধ্যে কিছু ভাঙা শব্দ শুনতে পেল। এসব শব্দ এক করলে দাঁড়ায়, ইমা যুবতী, তার সাহেব যুবতী কাজের লোক চায় না। আলেয়া ইমার অনাথা হওয়ার ঘটনার সাথে নতুন করে মিথ্যা কতগুলো ঘটনার সংমিশ্রণ করে রমণীটিকে দয়াপরবশ হতে বাধ্য করল। এই রমণীর নাম আসমা বলে সম্বোধন করে আলেয়া। আসমার মনে ইমার জন্য দয়া হলেও সে নিশ্চিয়তা দিতে পারল না। সাহেবকে বুঝাতে সমর্থ হলেই ইমার চাকরী ওকে। নয়তো ইমাকে ফিরে যেতে হবে। এই জনপদ বিচ্ছিন্ন বাড়িতে থাকতেও মন সায় দিচ্ছেনা ইমার, কিন্তু এই কাজ ছেড়ে যাওয়া মানেই যে পথে নামা। মনটা উদ্বিগ্ন ভীষণ ইমার। আসমা নামক রমণীটি আলেয়াকে আগামীকাল আসতে বলে বিদায় করে। আলেয়া যেতে যেতে ইমাকে অভয় দেয় সাথে কানেকানে বলে যায় তার পাওনা সে আগামীকালই এসে নেবে। যেই ভ্যানে এসেছিল তাতে করেই আলেয়া চলে গেল। সরাসরি এই বাড়িতে ঢোকার অনুমতি কারো নেই। দারোয়ান ডেকে ইমার মালপত্র পাশের ছাউনির নিচে রাখা হয়। আসমা ইমাকে সাথে করে নিয়ে চলল তার নীড়ে। যেতে যেতে ইমা আরো অনেক কিছু দেখল। এই বাড়ির পেছন দিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এই প্রাচীরের পাশ দিয়ে টাইলসের রাস্তা ধরে ওরা হাঁটছে। ঐতো আরেকটা কটেজ মতো ছোট্ট বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ইমা খেয়াল করেছে এই বাড়িগুলো এদেশীয় স্টাইলে বানানো না। কিছুটা পাশ্চাত্য ধাঁচের। সামনের কটেজটিও ঠিক তেমনই। যত এগোচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে শিশুর কান্নার শব্দ। পাশে হাঁটতে থাকা আসমার সেটা কর্ণগোচর হতেই ছুটে গেল ভেতরে। ইমা কটেজের সামনের উঠোনে দাঁড়ানো। পায়ের নিচে মাটি নয়, এখানেই টাইলস। ইমার ক্রমেই মনে হচ্ছে এই সম্পত্তির মালিক কোনো বিদেশী। স্বদেশী হলেও সে উচ্চবিলাসী,দুর্নীতিবাজ। একদিকে মানুষ না খেয়ে মরে আর অন্যদিকে কেউ কেউ স্বপ্নের অট্টালিকা গড়ে। ইমার দীর্ঘশ্বাস আটকে আসে সামনে দাঁড়ানো আসমার কোলের বাচ্চাটি দেখে। গুমরে মরা মাতৃত্ব ফের জেগে ওঠে। আজ ওরও এমন একটা সন্তান থাকার কথা ছিল। একটা ছোট্ট প্রিন্স অথবা প্রিন্সেস। বর্তমান ভুলে কলের পুতুলের মতো এগিয়ে গেল ওদের দিকে। দু’হাত মেলে ধরতেই বাচ্চাটি কিছুক্ষণ অশ্রুভেজা চোখে চেয়ে নুয়ে এলো ওর দিকে। বাচ্চার মা বাধা দিল না এই দুই অপরিচিতের মায়ার আলিঙ্গনে। ইমা যখন আপন সন্তান মনে করে বাচ্চাটিকে আদর করছিল তখনই আসমা বলে ওঠে,

” আলেয়া খালা বলল আপনি অবিবাহিতা কিন্তু আমার মনে হচ্ছে,, ” আসমার কথা থেমে যায় ইমার অশ্রুছলছল দু’চোখের চাহনীতে। ইমা আরেকবার বাচ্চাটার মুখের দিকে চেয়ে আসমার কোলে তুলে দেয়। হঠাৎ যেন প্রচন্ড অসুস্থ বোধ করে সে। এলোমেলো পায়ে সামনের চেয়াটায় বসে বলে,

” আমাকে একটু পানি দেবেন?”

আসমা কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল ইমার দিকে চেয়ে। সে নিশ্চিত এই মেয়ে অবিবাহিতা নয় আর যদিওবা হয় তবে সে সতী নয়। এমন একটা মেয়েকে কাজে রাখা কী ঠিক হবে? অনিচ্ছা মনে এক গ্লাস পানি এনে দেয়। পানি পান করার সময়ই ইমার মুখটা দেখতে পায় সে। চেহারাটা চেনা চেনা লাগছে। কোথাও কী দেখেছে এই মেয়েকে? মেয়েটির শুকনো,মলিন মুখটা বলছে অনেকক্ষণ যাবত সে অভুক্ত। কোলের মেয়েটা কান্না জুড়ে দেওয়া এসব উপেক্ষা করে ভেতরে চলে গেল আসমা। মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে গেল ছেলের রুমে। মোবাইলে গেমস খেলতে খেলতে ছেলেটাও ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলের গায়ে চাদর টেনে বেরিয়ে এসে দেখল অচেনা মেয়েটা চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে দু’হাত পেটের উপর রেখে। মৃদু গলা ঝেড়ে আসমা বলল,

” নাম কী আপনার?”

আসমার গলার স্বরে চকিতে সোজা হয়ে বসল ইমা। লজ্জিত চোখে বলল,

” ইমা।”

” ইমা!” চমকিত হয়ে ইমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিল আসমা। ক্ষুধার্ত ইমার মাথা কাজ করছে না। ঝাপসা চোখে সে তাকিয়ে আছে নিরুপায় হয়ে। সামনের মেয়েলোকটির বিস্মিত গলার স্বরে তার মধ্যে কোনো হালচাল ঘটল না। দূর্বল শরীর বার বার শক্ত করার চেষ্টা করতে ব্যস্ত ইমা। সে খেয়ালই করেনি বিস্মিত মুখে মহিলার ছুটে রুমে চলে যাওয়া। বিরবির করে নিজের বোকামিকে দুষছে। এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে খেলেও তো একটু বল পেত। আশেপাশে এখন দোকানের বালাইও নেই। এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে নির্ঘাৎ মাথা ঘুরে পড়বে। সামনের টেবিলে ফল সাজান। মন বলছে, একটা খাই, একটা,না হয় এক কামড়। ইমা মনের কথা শোনা ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। দু’চোখ বন্ধ করে আগের মতো বসে রইল।

স্ত্রীর মুখে ইমা ভাবীর নাম শুনে ছুটে এসেছে মোবারক। ঘণ্টার রাস্তা সে কয়েক মিনিটে শেষ করেছে। তার জন্য বরাদ্দ শানের এই পৈতৃক কটেজের সম্মুখে থমকে দাঁড়ায় সে। ঐতো চেয়ারে বসা ইমা ভাবী। মোবারকের চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে ভেসে ওঠে পুরোনো স্মৃতি। ইমা ভাবীর সেই দস্যিপনা, খুটশুটি আর শান স্যারের রগচটা মেজাজ। কত বদলে গেছেন ইমা ভাবী। এখন আর সেই পুরুষালি পোষাক পরনে নেই। তার বদলে পুরোপুরি মেয়েলী পোষাক। হঠাৎ কী মনে করে মোবারক আবার গেটের কাছে ফিরে আসে। স্ত্রীকে কল করে ডেকে আনে সেখানে। এতোক্ষণ ইমার সাথে থাকা রমণীটিই মোবারকের স্ত্রী আসমা আক্তার। শান আগামীকাল ফিরবে। ততক্ষণে কিভাবে ইমাকে এ বাড়ি রাখতে হবে মোবারক স্ত্রীকে সব বুঝিয়ে বলে। সাথে এও বলে দেয় এসবের কিছুই যেন ঘুর্ণাক্ষরেও টের না পায় ইমা। মোবারকের স্ত্রী আসমা স্বামীর সব কথা মেনে আবার ফিরে আসে। ইমাকে বলে, সে সাহেবের সাথে কথা বলেছে। তার চাকরি এখানে কনফার্ম। ইমাকে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসতে বললে ইমা আগে খেতে চায়। আসমার মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে ইমার করুন দশা দেখে। কোনোমতে হাত ধুয়ে চাট্টিখানি খেয়ে পেটটা শান্ত করে ইমা। তারপর আসমা তাকে সাথে করে নিয়ে আসে তার কর্মস্থানে। যা হওয়ার ছিল তার সংসার কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ হয়ে গেল কাজের স্থান। গৃহকর্ত্রীর বদলে হয়ে গেছে গৃহকর্মী। সদর দরজা খুলতেই এই বাড়ির কারুকার্য শৈলীর সৌন্দর্য্য ইমার চোখে পড়ে। বিমুগ্ধ হয়ে যায় সে। লিভিং রুম পেরিয়ে ওরা চলে আসে একটা রুমের সামনে। রুমটাতে ইমাকে থাকতে দেওয়া হয়। আসমা যাওয়ার আগে বলে যায়, সাহেব আজ আসবে না। তাই ইমা যেন আজকের দিনটা বিশ্রাম করে নেয়। কাল সাহেব এসে নিজেই সব কাজ বুঝিয়ে দেবেন। আসমার কথা মতো সদর দরজা বন্ধ করে ইমা নিচতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখে। ভেতরের আসবাবপত্রেও বাঙালিয়ানার ছাপ নেই বললেই চলে। সব আসবাবপত্রই বেশ পুরানো হলেও তাতে নতুন করে বার্নিশ করা হয়েছে। মনে হচ্ছে এই ঘরের জন্য পুরোনোই ঠিক নতুন ততটা মানানসই হতো না। লিভিং রুমের এক পাশে কিচেন, অপরপাশে দু’টো রুম, যার একটাতে জায়গা হয়েছে ইমার। লিভিং রুম থেকে সামনের সুইমিংপুল দেখা যাচ্ছে। ইমা সেদিকে গেল। সুইমিংপুলের চারপাশে উঁচুু প্রাচীরে ঘেরা। কিছুক্ষণ সুইমিংপুলে পা ডুবিয়ে রুমে ফিরে আসে। বোরকা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে সাথে সাথেই ঘুমে তলিয়া যায়। আজ বহুদিন পরে সে শানকে স্বপ্নে দেখছে। ঘামছে সমস্ত শরীর। ঘৃণায় ঘুমন্ত মুখটা বিকৃত হতে লাগল ইমার। বিরবির করে বলল,

” নিষ্ঠুর, বর্বর,বিশ্বাসঘাতক। আমি তোকে ঘৃণা করি,ঘৃণা করি।”
তুমি অতঃপর তুমিই
Writer Taniya Sheikh

২০.

করোনার আশঙ্কায় দেশে লকডাউন দেওয়ার সম্ভবনা প্রবল হওয়ায় সেদিন রাতেই ফিরে আসে শান। রাত তখন আনুমানিক একটা। দারোয়ান গেট খুলতেই শানের গাড়ি ঢুকল। দারোয়ান মতিন শানের বিশ্বস্ত লোক। শানের কথার বাহিরে একটা কথাও সে বলে না,একটা কাজও করেনা। এই যে এতো রাত করে বাড়ি ফিরল দারোয়ান চাচ্ছিল মোবারকে খবর দিতে কিন্তু দিল না। শান যেহেতু বলেনি সুতরাং ঐকাজ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দারোয়ান করবে না। এমনকি বাসায় যে নতুন মেয়েলোক ঢুকেছে সেটাও তার মুখ দিয়ে বের হলো না৷ নত মুখে গেট লাগিয়ে ফিরে গেল তার ছোট্ট কুটিরে। এখান থেকে বাইরেটা ভালোভাবেই নজর রাখতে পারে সে।

শান গাড়ি গ্যারেজে রেখে চাবি হাতে সদর দরজার সামনে এলো। দরজা কয়েকবার নাড়াচাড়া করেও খুলতে ব্যর্থ হয়ে ফের ডাকল দারোয়ানকে। তখনই দুপুরে আগত কাজের মেয়েটি সম্পর্কে বলল মতিন। শান মাঝে মাঝে বেশ বিরক্ত হয় মতিনের উপর। কোনোকিছুই অতিরিক্ত ঠিক না৷ হোক সেটা ভালোবাসা কিংবা প্রভু ভক্তি। বিবেক বর্জন করে নত হওয়ার মধ্যে কেবলই গ্লানি, আত্মসম্মানহীনতা থাকে। মতিনকে বিদায় করে শান পেছনের সিকিউরিটি ডোর খুলে ভেতরে ঢোকে। এতোপথ জার্নি করে রাত দুপুরে এসব ঝামেলার কারনে মেজাজ তুঙ্গে শানের। রুমে ঢোকামাত্রই গায়ের ব্লেজার ছুঁড়ে ফেলে কাউচে বসে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে সোজা চলে আসে উপরের রুমে। লম্বা একটা শাওয়ার শেষে বার্থরোব গায়ে, নগ্ন পদে নামে নিচে। গোসল করায় অবসন্নতা খানিকটা কেটে গেছে। শ্রান্ত শরীরে ঝটপট কর্ণ স্যুপ তৈরি করতে লেগে গেল এক কাপ কবোষ্ণ কফিতে চুমুক দিতে দিতে। এক কাপ উষ্ণ কফি শরীরটা চাঙা করতে যথেষ্ট। স্যুপ রেডি, স্যালাড চপিং করে সামান্য অলিভ ওয়েলে মাখিয়ে বসল কাউচে। সামনের টিভিটা অন করল। সাথে সাথে টিভিস্ক্রিনে ভেসে ওঠে হরর মুভির কিছু ভায়োলেন্ট দৃশ্য । স্যুপ গলায় আটকে যায় ঘটনার আকস্মিকতায়। কাশতে কাশতে কিচেনে ছোটে।

বাইরের টুংটাং আওয়াজে ইমার ঘুম ভেঙে যায়। টিভি চলার শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। কেউ কাশছে! কে? আসমা নামক মেয়েটি তাকে বলল সাহেব আজ ফিরবে না। তাহলে? চোর! ইমা দ্রুত বিছানা ছেড়ে সতর্ক পায়ে বেরিয়ে এলো। হাতে নিয়েছে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার হাতিয়ার একটা ছোট্ট ছুরি।এটা সবসময়ই কাছে রাখে সে। লিভিং রুম ছাড়া সম্পূর্ণ নীচতলা অন্ধকার। লিভিং রুমের টেবিলটায় খাবার ভর্তি বাটি ছাড়া আর কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। টিভিতে এখনো চলছে মুভিটা। দৃশ্য পটে এডাল্ট সিন চলছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সে দৃশ্য দেখে। লজ্জায় অবনত হতেই আবার শব্দ শুনতে পেল৷ এবার শব্দের উৎস রান্নাঘর। ইমা পা টিপে টিপে সেদিকে গেল। শোকেজের পাশ থেকে উঁকি দিতেই বার্থরোব গায়ে একজন লম্বাটে, বলিষ্ঠ দেহের পুরুষকে দেখল। ঝুঁকে ঘুরে দাঁড়ানোয় কেবল পেছনটায় দেখতে পাচ্ছে ইমা৷ সে কিছুক্ষণ ভাবল, এই লোক কে হতে পারে? বেশ পোশাকে চোর তো লাগছে না মোটেও। তবে? এই বাড়ির মালিক নয় তো! ইমার গলা শুকিয়ে এলো ভয়ে। এই এত বড়ো বাড়িতে কেবল ওরা দু’টো প্রাণী। তার উপর এই লোক ঐসব বাজে মুভি দেখছিল। আচ্ছা, সদর দরজা তো বন্ধ করেছিল ঘুমানোর আগে। এই লোক ঢুকল কী করে? ইমার ভেতরে ভয় ভয় করলেও ইমা তো ইমায়। তার অতীত ম্লান হলেও পুরোপুরি মুছে যায়নি। সেই সাহস,চঞ্চলতা আজও আছে গুমোট মেরে। ইমা ঘুরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে রুমে ফিরে আসে। দরজা ভালো করে বন্ধ করে ছুরিটা বালিশের তলে লুকিয়ে রাখে। বালিশে মাথা রেখে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে,

” আসুক না ছুঁতে। ছুড়ি ঢুকিয়ে ব্যাটার ভুঁড়ি বের করে দেবো না। ইমাকে চেনে না তো!”

কথার জোরে সাহস বাড়েনা। ছুরিটার কারনে অতিরিক্ত ভীতও হয়না। সে রাতটা ওভাবেই চিন্তায় চিন্তায় পার করে আধোঘুমে। ভোরের আজান দিতেই অযু করে নামাজ পড়ে নেয়। যেই পাপ ইমা না চাইতেও করেছে তার ক্ষমা চায় প্রতি প্রার্থনায়। দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।

টিভি দেখতে দেখতে রাতে কাউচেই ঘুমিয়ে পড়েছিল শান। খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস ওর। স্বভাবতই সঠিক সময়ে ঘুম ভাঙল। উপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নামল নিচে। পরনে কালো জগিং স্যুট। লিভিং রুম পার হতেই থমকে দাঁড়ায়। পাশের রুম থেকে পায়ের শব্দ শুনে এগিয়ে গেল সেদিক। রাতে বলা দারোয়ানের কথা মনে পড়তেই বুঝল এই রুমেই হয়তো গৃহকর্মী মেয়েটা আছে। শান দরজায় কড়া নাড়ে। বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ শুনে কেঁপে ওঠে ইমা। রক্ত হিম আসে। দ্রুত বালিশের নিচ থেকে ছুরিটা বের করে হাতটা পেছনে লুকিয়ে এগিয়ে যায় দরজার কাছে। বার কয়েক দরজা নক করে শান বলে ওঠে,

” আপনি কী জেগে আছেন?”

চার বছর কেন? চার সহস্র বছর পার হলেও এই গলার স্বর চিনতে ভুল করবে না ইমা। সমস্ত শরীর জমে গেল ওর। অবশ অবশ অনুভূতি হতে লাগল। দরজার ওপাশে ধীরে ধীরে আগের মতো নিস্তব্ধতা নামে। ইমার ক্রমেই মনে হলো ওর ভ্রম ছিল। গতকাল শানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাতেই হয়তো এমনটা হয়েছে। ঘৃণার আবরণে আজও যে প্রবল ভালোবাসা সুপ্ত। ভ্রম না সত্যি যাচাই করার জন্য ইমা নিজেকে সামলে দরজা খোলে। ভ্রম হলেই খুশি হবে ইমা। শানকে সে দেখতে চায়না আর। পেছনে লুকানো ডান হাতটায় এখনো ছুরি ধরা। এবার লক্ষ্য শান। সত্যিই যদি শান হয়, এই ছুরির ফলা তার বুকে গেঁথে দেবে। তারপর নিজের বুকে। আজ সকল জ্বালা যন্ত্রণার অবসান ঘটাবে সে। লিভিং রুমের দিকে কয়েক পা এগোতেই পেছনে শুনল সেই সে গলার স্বর,

” এক্সকিউজ মি.” শান সু কেবিনেটে ময়লা দেখে সেটা পরিষ্কার করতে লেগে গিয়েছিল। এই বাড়ির সমস্ত কাজ সে একাই করে। তবে মাঝে মাঝে শানের নিষেধ উপেক্ষা করে মোবারক এসেও সাহায্য করে কাজে। গত দুই দিন বাসায় না থাকাতেই ময়লা জমেছে সু কেবিনেটে। ইমা যখন পা টিপে টিপে লিভিং রুমে উঁকি দিচ্ছিল শান সেটা সদর দরজার পাশে বসে দেখতে পায়। তবে ওটা যে ইমা সেটা শান টের পায়না। ইমা ছুরিসহ হাতটা সামনে নিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কোনোদিন শান তার ভালোবাসার মানুষ ছিল সেই মুহূর্তে ইমা ভুলে বসে। মনে থাকে কেবল শানের দেওয়া ধোঁকা আর নিষ্ঠুরতা। ক্ষুব্ধতায় রক্তে আগুন জ্বলে ওঠে।

ওদিকে বার বার প্রশ্ন করে জবাব না পেয়ে বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ায় শান। লিভিং এরিয়ায় নেমে টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে এক পা এক পা করে এগোয়। যত এগোচ্ছে ততই যেন এই রমণীর শারীরিক গঠন তাকে অন্য কারো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ইমা, ইমা! অস্ফুটে উচ্চারণ করে ঠিক ইমার পেছনে দাঁড়ায়। দুজনের দূরত্বের তফাৎ মাত্র কয়েক ইঞ্চি। এই ইঞ্চি পরিমাপ অতিসত্বর কমে আসে ইমা ঘুরে দাঁড়াতে। ক্ষুব্ধ ইমার ছুরি সহ হাতটা তড়িৎ গতিতে ছুটে আসে শানের দিকে। ঘোর কাটতে শানের সময় লাগল। এই কালক্ষেপনের সুযোগে ধেয়ে আসা ছুরিটা ঠিক বুকের নিকটে এলো চলে। শত্রুকে পরাস্ত করতে তার জুড়ি নেই। আর সেই শত্রুটি যদি হয় পরম ভালোবাসার মানুষ, তবে তো শান আরও এক কদম এগিয়ে এতে। আজ হয়তো অবলীলায় প্রিয়তমার ছুরি বুকে পেতে নিত।কিন্তু ঐ মিথ্যা অপবাদের কী হবে? এই স্বেচ্ছায় মৃত্যু তাকে সত্যিই বিশ্বাসঘাতকে পরিণত করবে। যা আদৌতে সে নয়। বা’হাতের ছুরির ফলা ধরে ফেলল শান। ততক্ষণে ছুরির ফলার সামান্য অংশ বুকে গেঁথে রক্তাক্ত অবস্থা। গত চার বছর ধরে যে দাবানল বুকে চেপে আছে, আজ ইমাকে কাছে পেয়ে কিছুটা হলেও শান্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হলো উল্টো, সেটা অবশ্যই ইমার এহেন আচরণে। ইমার হাতটা সজোরে মুড়ে ধরতেই ছুরি নিচে পড়ে যায়। পায়ের সাহায্য সেটা ঠেলে ফেলে আরও দূরে শান। হাতের ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে ইমা। চেঁচিয়ে বলে,

” হাত ছাড় বলছি, বর্বর, বিশ্বাসঘাতক।”

শেষের শব্দ দু’টো শানের মগজ পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়। পেছনে মোড়া হাতটা সহ ইমাকে একদম নিজের কাছে টেনে আনে। ইমার অবগুন্ঠন আগেই মাথা থেকে সরে ঘাড়ের কাছে পড়েছে। অবিন্যস্ত চুল সরিয়ে মুখ নামিয়ে আনে শান। কাঁধে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করে ইমা। ঐ ঠোঁটের স্পর্শ কাঁধে পড়তেই শিওরে ওঠে সর্বাঙ্গ। দু’চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সর্বশক্তি দিয়ে শানের বুকে ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছা হলো ওর। ঠিক তখনই সেই ইচ্ছার উপর ভর করে গত চার বছরের সকল কষ্ট। আপন সহোদর ও পিতৃ হত্যাকারী এই বর্বরকে এককালে ভালোবাসত ভাবতেই ঘৃণায় বিষিয়ে উঠল সারা দেহ। নিজেকে ছাড়ানোর সকল চেষ্টা করে একসময় ক্লান্ত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,

” আমাকে ছেড়ে দিন।”

এই কাতর কণ্ঠ শান উপেক্ষা করতে পারল না। ভুলে গেল সকল মান,অভিমান,যাতনা। হাত ছেড়ে দিতেই ইমা আসল রূপে ফিরে আসে। ঘুরে দাঁড়িয়ে শানের ডান গাল বরাবর কষিয়ে দেয় এক চড়। রাগে কাঁপছে ইমার শরীর। শান বিস্মিত,ক্ষুব্ধ চোখে ইমার দিকে তাকাতেই দেখল সামনে অগ্নিবিচ্ছুরিত দু’টো চোখ। এই চোখেই একদিন ছিল অপার ভালোবাসা, অপত্য মায়া। চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে ইমার বাহু চেপে ধরে। ইমার চোখে ভালোবাসা খোঁজে। কিন্তু কোথায় ভালোবাসা! এ যে কেবল ঘৃণা আর ঘৃণা। বিরহে ব্যাকুল শান আর্তচিৎকারের সাথে প্রশ্ন করে,

” কেন এমন হলে তুমি ইমা? কী দোষ আমার? এই নিষ্ঠুরতা কোন পাপে? খুলে বলো আমাকে। সত্যিই আমি দোষী হলে নিজের জীবন নিজে শেষ করে ফেলব। একবার শুধু বলো আমাকে।”

ক্রোধে কণ্ঠরোধ হয়ে আসে ইমার। ঘৃণা ভরা তীক্ষ্ণ চাহনীতে শানের চোখে চোখ রাখে।এভাবে কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ রইল। শান দু বাহুতে পরম ভালোবাসায় ইমাকে বেষ্টন করে নেয় সেই সুযোগে। ধড়া গলায় বলে,

” আমি তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতগতা করিনি ইমা। বিশ্বাস করো তুমি।”

ঘৃনার পাথরে খোদাই করা ইমার মন,চোখ সেকথা বোঝে না, শোনে না। দুহাতে শানের রক্তাক্ত বুকটায় আঘাত করে দূরে ঠেলে দেয়।

” বিশ্বাস! আর তোকে? একবার করেছিলাম তো। তার শাস্তি আজ পর্যন্ত পাচ্ছি। এই ইমা মরে যাবে তবুও তোর মতো শয়তানকে বিশ্বাস করবে না।” ইমা ছুটে চলে যায় রুমে। শান হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী অপরাধ না জেনেই শাস্তি পাচ্ছে সে। এই শাস্তি যে মৃত্যুর যন্ত্রণা সম। ইমা ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বের হয়ে দেখল শান বুকে হাত দিয়ে ঝুঁকে বসে আছে। ঘৃণা পারেনা ভালোবাসা রুখতে। সে আপন শক্তিতে ঠিকই প্রকাশিত হয়। এই যেমন এখন হলো ইমার দু’চোখ বেয়ে। যে হাতে ছুরি বসিয়েছিল সেই হাতটা এতো জোরে মুষ্টিবদ্ধ করে যে,রগে রগে টান ধরে যায়। এই হাতকে ইমা যোগ্য শাস্তি ঠিক দেবে। তার আগে এখান থেকে বেরোতে হবে তাকে। তা না হলে ঘৃণার আগুনে ভালোবাসা জ্বলবে। ঝলসে যাবে ভালোবাসার মানুষটা। শানের চোখে পড়ার আগেই বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয় সে চেষ্টা। মিথ্যা অপবাদের আঘাত ছুরির আঘাত থেকেও বহুগুণ বেশি ছিল শানের জন্যে। সে ইমার কাছে স্পষ্ট জবাব চায়। হয় মরণ নয় জীবন! অনেক হয়েছে সহ্য। শান ইমাকে টেনে ধরে কাউচে বসায়। ইমার ওড়না দিয়েই ওর দু’হাত বাঁধে। অঙ্গশক্তি যখন বেষ্টনে আবদ্ধ ইমার কণ্ঠধ্বনিই তখন ভরসা। চেঁচিয়ে, তিরস্কার করে একাকার করে সে। অগত্যা শানকে ওর মুখে টিস্যু গুঁজে দিতে হয়। ক্রোধে লাল হয়ে ওঠে ইমার মুখ। শান ঝুঁকে ইমার চিবুক ধরে বলে,

” তোমার রাগ কমানোর ওষুধ শান নিহান খান বেশ ভালোভাবেই জানে।” এক চোখ টিপে উঠে দাঁড়ায় শান। এক টানে গায়ের জগিং টিশার্ট খুলে ফেলতেই ইমা চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলে। শান ভ্রু নাচাতেই বড়োসড়ো ঢোক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ভেতরে ভেতরে একধরনের শিহরণ অনুভব করে ইমা। সেটা সহসায় কমে আসে শানের প্রস্থানে। শান সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। মিনিট পাঁচেক পর সে ফিরে আসে একটা কাগজ হাতে। ইমার সামনের টেবিলে ফেলে মুখোমুখি বসে বলে,

” সাইন ইট।”

ভ্রুকুটি করে কাগজটার দিকে তাকায় ইমা। ইংলিশে লেখা পুরোটায়। কপাল কুঁচকে শানের দিকে তাকাতেই শান ঝুঁকে ওর মুখের টিস্যু ফেলে দেয়। মুখ ঝেড়ে ইমা রাগত স্বরে প্রশ্ন করে,

” এটা কী?”

” কাগজ।”

” ফাজলামি করবি না আমার সাথে। ঠিক করে বল এটা কী?”

” আমার বাসায় আজীবন কাজ করার এগ্রিমেন্ট। সাইন ইট।”

” ওরে মোর আল্লাহ, সাইকোর বাচ্চা সাইকো, বদের বদ, তোর ঘটে বুদ্ধি কম? তুই ভাবলি কী করে এই কাগজে ইমা সাইন করবে?”

” উফ,আপনার এই ভাষা মিসেস নিহান। আই রিয়েলি মিস ইট।”

ইমা আবার বকবে বলে মুখ খুলতেই শানের উৎসুক চাহনী দেখে থেমে যায়। স্পষ্ট ভাষায় বলে,

” দ্যাখ শান নিহান খান, ভালোয় ভালোয় বলছি আমাকে যেতে দে। আমি এই কাগজে মরে গেলেও সাইন করব না।”

” ওহ, রিয়েলি। আর যদি পুলিশে দেই? ওহ! আমিও কী বোকা। মৃত্যুর কাছে পুলিশে ধরা কোনো ফ্যাক্ট হলো। আচ্ছা যাও, যাও।” ইমা পুলিশের কথা শুনে থ মেরে বসে থাকে।শান ওর অলক্ষ্যে মুচকি হাসে। ইমার দু’হাতের বাঁধনের এক গিঁট খুলে শান পুনরায় চাপা স্বরে বলল,

” বুকে ফের ছুরি বসানোর ইচ্ছা নেই তো?”

ইমার চোখ শানের দৃষ্টি থেকে ক্ষত বুকের উপর পড়ে। এখনো সেখান থেকে রক্ত পড়ছে। বুক বেয়ে সেই রক্ত ধারা ক্রমশ নিচে নামছে। শান এতোক্ষণ যা খুঁজছিল এবার সেটা পেয়ে গেল। ইমার ঐ চোখে ভালোবাসা। নিজেকে যেন কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারল না। শুষ্ক ঠোঁট বহুদিন পর যথার্থ অর্থেই সতেজ হলো। রাগ,অভিমান, ক্রোধ কিছুক্ষণের জন্যে আড়াল হয়ে সেখানে জায়গা করে নিল তৃষ্ণিত হৃদয় তিপ্ত করার আকুলতা।

ক্রোধ, ঘৃণা মানুষকে সহজেই নিষ্ঠুর করে তোলে। ইমার অবস্থাও কিছুটা তাই। হঠাৎ সে কামড়ে ধরল শানের ঠোঁট। ব্যথায় সরে বসে শান। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। না,ব্যথায় নয়। বার বার ইমার ঘৃণার সম্মুখীন হয়ে। চুলের মুঠি টেনে ধরে বলে,

” এতো ঘৃণা আমার প্রতি, কিন্তু কেন? জবাব দাও ইমা, জবাব দাও।”

মুখ সরিয়ে নেয় ইমা। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

” কেন? কেন! এই কেনর জবাব আমি কোনোদিন দেবো না। কেন দেবো না জানিস? কারণ তুই সব জানিস। জেনেশুনে প্রেমের ফাঁদে ফেলে আমার সর্বনাশ করেছিস তুই, আবার বলছিস কেন? লম্পট, ধোঁকাবাজ,সন্ত্রাস।” অপবাদের তীর বিদ্ধ শান হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ইমার চুল ছেড়ে ফের ইমাকে দু বাহুতে জড়িত ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,

” এমন অপবাদ দিও না ইমা। এরচেয়ে ভালো ছিল তখন তোমার হাতের ছুরি বুকের হৃদপিণ্ড ছেদ করত। আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না। প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করো তুমি। আমি এমন কিছুই করিনি যার কারনে তুমি কষ্ট পাবে। তুমি তো আমার স্ত্রী, আমার আভূষণ৷ তোমাকে কষ্ট দেওয়া আর নিজেকে দেওয়া একই কথা। আমি জেনেশুনে এমন কিছুই করিনি, না করব। তবুও যদি ভুল করে থাকি, একবার বিশ্বাস করে খুলে বলো আমাকে সব। প্লিজ ইমা। আমি সব ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি আছি।” ইমার মনকে এই কাতরতা নাড়া দিলেও প্রভাবিত করতে পারেনা৷ ধাক্কা দিয়ে শানকে নিচে ফেলে ফের চেঁচিয়ে বলে,

” ছুবি না আমাকে। একদম ছুবি না। আমাদের মধ্যে শত্রুতা ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই। তোর এসব নাটকে ইমা এবার ভুলবে না। পুলিশের ভয় কেন ফাঁসির ভয় দেখালেও আমি এখানে থাকব না। এক মুহূর্তের জন্যেও না।”

ইমা উঠে দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। দু’চোখ খিচে বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় শান। উচ্চৈঃস্বরে বলে,

” ইমা, আমি যদি কিছু করে থাকি তার শাস্তি আমাকে যথাযথ প্রমাণের সাথে দিয়ে তবেই যাবে তুমি। আর তা যদি না করো তবে আমার সাথে যা করেছ গত চার বছরে এবং আজ, তার শাস্তি পাবার জন্য হলেও তোমাকে এখানে থাকতে হবে।”

ইমা ঘুরে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলে,

” যদি না থাকি? যদি কেন বলছি। ইমা থাকবেই না এখানে। যা করার কর তুই। আমি কাওকে ভয় পাই না।”

শানের অশ্রুসিক্ত রক্তবর্ণের দু’চোখে শয়তানি হাসি ফুটে ওঠে দু ঠোঁটের সাথে তাল মিলিয়ে। এক পা এক পা করে ইমার দিকে এগোতে এগোতে বলে,

” তুমি ভালো করেই আমাকে চেন মাই লাভ। আমি কী করতে পারি, আর না পারি সেটা তোমার চেয়ে ভালো কে জানে বলো? আমার অপরাধের কারণ বলবে, নয়তো এক একটা সেকেন্ড তোমার জন্য যন্ত্রণাময় দিনের সমতুল্য হবে৷ আমি এও জানি তুমি সহজে বলবে না। আর তুমি ভালো করেই জানো, শান জেনেই ছাড়বে। তারজন্য যদি শত আঘাত সহ্য করা লাগে করব, শত আঘাত আঘাতে তোমাকে জর্জরিত করা লাগে সেটাও করতে বাধ্য হব। আমার তোমাকে চাই তোমার শত্রুতা নয়।”

ইমা ঘাবড়ে যায় শানের শ্যেন দৃষ্টি দেখে। বের হবার জন্য ছুটতেই শান ধরে ফেলে। দু’হাত পেছনে মুড়ে নিজের দেহের সাথে চেপে ধরে ইমাকে। ছটফট করছে ইমা। কামড় দেওয়ার জন্য মুখ এগোতেই শান অন্যহাতে ওর মুখ চেপে ধরে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে। একদিকে দেয়াল অন্যদিকের শানের শরীরের সম্পূর্ণ ভরে ইমার দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। কিছু বলবে সে উপায়ও রাখেনি শান। ইমার কানে আলত কামড় দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

” অনেক তো ভালোবাসা দেখলে এবার ভালোবাসার অত্যাচার দেখার জন্য রেডি হও ,মাই বিলাভড এনিমি।”

ইমাকে জোরপূর্বক এগ্রিমেন্টের কাগজে সই করিয়ে ইমরোজকে কল করে শান৷ ইমার নামে জিডি করতে বলে ইমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে। জিডির কথা শুনে ইমা মুষড়ে পড়ে ভেতরে ভেতরে। মোবাইলের ওপাশে ইমরোজের সবকিছু বুঝতে কিছুটা সময় লাগল। ইমাকে শান পেয়েছে এই খুশিতে সে লাফিয়ে ওঠে। শেষে শানের ইঙ্গিতেপূর্ণ কথায় নিজেকে সামলে নেয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ বলে বন্ধুর সব কথায় সায় দেয় সে। এখান থেকে ইমার যাওয়া পথ একপ্রকার রুদ্ধ। এই এতপথ হেঁটে জনপদে যাওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। পথটাও চেনা না। আসার পথে নির্জন প্রান্তর,বন পার হয়ে এসেছে। কিন্তু যাওয়ার পথে পায়ে হেঁটে একা কী করে ফিরবে যাবে? সেটারও না হয় একটা ব্যবস্থা করতে পারত কিন্তু এই শান। এ তো বাড়ির বাইরেও পা রাখতে দিচ্ছে না। না, একটু সময় নিয়ে ভাবতে হবে ইমাকে। ইমা এমন ভাবে বসে রইল যেন সে হার মেনে নিয়েছে। শান দূর থেকে সেটা দেখে মুচকি হেসে বিরবির করল,

” একবার যখন পেয়েছি আর ছাড়ছি না ইমা। কী কারনে আমাকে এতোটা বছর নির্বাসিত জীবন কাটতে হলো এর জবাব আমার চাই। যত খুশি ঘৃণা করো,আঘাত করো;কিন্তু দিনশেষে এই শানের বুকেই তোমাকে আসতে হবে। আমিও দেখব কে জেতে,তোমার ঘৃণা নাকি আমার ভালোবাসা?”

চলবে,,,

এই গল্পটায় বাস্তবতা কম কাল্পনিকতা বেশি। অতি সিরিয়াল আসক্তদের চোখে সিরিয়াল টাইপ মনে হলে জাস্ট ইগনোর ইট। আমি কখনোই বলিনা আমি আনকমন লিখি। বলি,যেন কারো গল্পের থিমের সাথে না মিলে যায় তেমন লেখার চেষ্টা করি। সুতরাং গল্প কমন হয়ে গেল, এই টাইপ কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকবেন। আর হ্যাঁ শান ইমা মানেই ক্যাটফাইট। ভালো লাগলে ওকে নয়তো🙂
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here