তুমি অতঃপর তুমিই
২৯
Taniya Sheikh
যত ছুটছে ততই মনে হচ্ছে কেউ পেছন থেকে তাড়া করতে করতে এগিয়ে আসছে। ভয়ে ঘাম ছুটে গেল। সামনে গাছের সারি। অসতর্কে সেগুলোরই একটার সাথে কপালে বাড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল ইমা। পায়ের নিচটা বন্য গুল্মলতায় ছাওয়া। তড়িঘড়ি উঠতে গিয়ে পড়ে থাকা চিকন শুকনো এক ডালের সরু কোনা বিঁধে গেল ডান’ হাঁটুর ইঞ্চি কয়েক নিচে। পাশে দাঁড়ানো মেহগনি গাছটা ধরে উঠে দাঁড়াতে দেখল হাঁটুর কাছের সালোয়ার ছিঁড়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে। এমন রক্ত দেখে আরও ভড়কে গেল ও। চিঁ চিঁ করে শব্দ শুনতে পেল এবার। সাথে আরও কিছু জীবের আওয়াজ। সেসব গাছে গাছে প্রতিধ্বনিত হয়ে অদ্ভুত শব্দের সৃষ্টি হতে লাগল। ভীত মন যাই শুনছে তাই ভয়ানক মনে হচ্ছে এইক্ষণে। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বনের মাঝেই ঘুরে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে পায়ের দিকে তাকাতেই। রক্তে ভিজে গেছে পা’টা। চারিদিকে স্বল্প আলোয় খুব বেশিদূর দৃষ্টি যায় না। কোনদিকে যেতে হবে বুঝতে পারল না ইমা। আল্লাহর নাম নিয়ে শেষ চেষ্টা করল।
” শান, শান। শান আপনি কোথায়?”
যত শক্তি ছিল সব ব্যয়ে শানকে ডাকছে ইমা। ইমার চিৎকারে গাছে গাছে ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে মুখর হয়ে ওঠে। ক্রমশ ভূতের ভয়টা কমে আসে। কিন্তু এখানে থেকে জীবিত উদ্ধার হতে পারবে কি’না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান সে। সূর্যের আলো পুরোপুরি উঠলে হয়তো সামনে কিংবা যে পথে এসেছিল তার দিশা পাবে- এই ভাবনায় মনকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এদিক ওদিক চে’য়ে নিরাপদ দেখে একটা গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা করার প্রচেষ্টায় জোরে জোরে শ্বাস- প্রশ্বাস ফেলছে। দেখতে দেখতে সূর্যের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। এবার স্পষ্ট সামনে, পেছনের অনেকখানি দেখা গেলেও সঠিকভাবে পথটা চিনতে ব্যর্থ হয়। কোন পথে এসেছিল সেটাও হারিয়ে ফেলে। ক্ষত পা টেনে টেনে গাছ ধরে সামনে এগোয়। ঝোপঝাড় এড়িয়ে এগোচ্ছে। একটাতে সাপের ফোঁস শব্দ স্পষ্ট শুনেছে ও। কিছুদূর এগোতেই খচ খচ আওয়াজ কানে এলো। শুকনো পাতা, গুল্মের উপর পা ফেললে যেমন আওয়াজ হয়- ঝপ, ঝপ। তেমন করে এগোচ্ছে। পায়ের ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছে তবুও থামল না। শব্দটা শুনে পেছন না ফিরে আরো দ্রুত পা চালিয়ে যাচ্ছে। এবার একটা নয়! আরো বেশি পায়ের আওয়াজ শুনে হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে এলো। ভীরু চোখে পেছনে তাকাতেই চোখ বিস্ফোরিত হলো ইমার। শেয়াল! শেয়াল গুলো শিকারী চোখে চেয়ে আছে। ওদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ইমার পায়ের দিকে একবার, আরেকবার মুখের দিকে। ইমা হুঁশ, হুঁশ করতেই ঘোঁৎ, ঘোঁৎ আওয়াজ তুলে মুখ বিকৃত করল ওগুলো। অবস্থা সুবিধার ঠেকছে না ইমার। হাতের কাছে সুরক্ষার কোনো বস্তু নেই,থাকলেও এই হিংস্র শেয়ালগুলোর সাথে একা পেরে উঠত না। তবুও যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। ইমা চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিল। শেয়াল গুলোর চোখে চোখ রেখে সভয়ে তাকিয়ে চট করে উল্টো দিকে ছুট দেয়। এই বন, আগাছা সমৃদ্ধ জঙ্গল খুব বেশি জায়গা নিয়ে ছিল না। ইমা ছুটে বেরিয়ে এলো বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে। অবাধে বেড়ে ওঠা বড়ো বড়ো ঘাসের আড়ালে উঁচু মাটির ঢিলার সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। কোনোদিকে তাকানোর পূর্বেই একটা শেয়াল ওর উপর লাফিয়ে পড়ে। ইমার আর্তচিৎকারের সাথে সাথে গুলির আওয়াজে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। ইমার একবার মনে হলো ও বুঝি মরে গেল। কিন্তু না, ও এখনো বেঁচে আছে। নিজের ভারী নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছে। সাথে ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি। ধীরে ধীরে সিক্ত চোখের পত্র পল্লব মেলল। শেয়ালের দল ইতোমধ্যে গুলির শব্দ পেয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছে। যেই শেয়ালটা ঝাপিয়ে পড়েছিল সেটাও কয়েক হাত দূরে সরে দাঁড়িয়ে আছে। ইমা উঠে বসে। শরীর এখনো অসম্ভব জোরে কাঁপছে। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। শরীর নাড়াচাড়া করার বলটুকুও হারিয়েছে ভয়ে। ঘোড়া ছুটতে ছুটতে কয়েক হাত দূরে দাঁড়াতেই সওয়ারী থেকে নেমে দৌড়ে এলো শান। ইমার চেতনা থেকেও নেই। দৃষ্টি স্থির সম্মুখে কিছুটা আড়ালে দাঁড়ান শেয়ালগুলোর উপর। রক্তিম, বিস্ফোরিত সে দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায় শান। ইমার আতঙ্কিত মুখটা বুকে লুকিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
” ভয় নেই,এই দেখো আমি তোমার কাছে আছি।” আজলা ভরে ইমার মুখটা তুলে স্বাভাবিক করতে লাগল।
” ইমা, ইমা কথা বলো।” উৎকণ্ঠায় কণ্ঠস্বর কাঁপে শানের। ইমা তখনো আতঙ্কিত দৃষ্টি মেলে শূন্যে তাকিয়ে। শান মৃদু চাপড় দিল ওর গালে। ফের ডাকল,
” ইমা, এই ইমা কথা বলো, প্লিজ।”
দু’হাতে ইমার বাহু ধরে ঝাকুনি দিতেই ইমা সচকিত হয়ে চিৎকার করে ওঠে,
” শান কোথায় আপনি?”
” এই তো আমি তোমার কাছে।” শান শক্ত বাহুডোরে বেঁধে নিল ইমাকে। শানের বুকে সভয়ে ফুঁপাচ্ছে ইমা। চোখজুড়ে আতঙ্ক।
ফজরের নামাজ শেষে কিছুক্ষণ হাঁটেন আমেনা বেগম। সাথে আশাও যেত ইদানীং মেয়েটার শরীর ভালো যাচ্ছে না৷ আমেনা বেগম জুতা পরে সবে দরজা খুলবেন তখনই দেখলেন মৌ দরজা খুলে ডাইনিংএর দিকে আসছে। চোখাচোখি হতেই মৌ মৃদু হাসল। বলল,
” কোথাও যাচ্ছেন আন্টি?”
” হু।”
” কোথায়?”
” হাঁটতে।”
” আপনি রোজ হাঁটেন?”
” হু, আর কিছু বলবে?” আমেনা বেগমের এমন রুক্ষ জবাবে মৌ-য়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ ডাইনিং থেকে পানি পান করে ফিরে গেল রুমে। যাবার আগে অবশ্য একবার আড়চোখে তাকিয়ে ছিল আমেনা বেগমের দিকে৷ আমেনা বেগম তাকে আর সবার মতো এ বাড়ি সহজ ভাবে মেনে নেয়নি এটা ক্লিয়ার মৌ-য়ের কাছে। মৌ রুমে ফিরে যেতেই ঠোঁটের কোনা শক্ত করে বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। তারপর হাঁটতে বেরিয়ে গেলেন আমেনা বেগম।
শায়লা খান গতরাতে সামিরার চিৎকার শুনেছে। তিনি ভেবেছিলেন সামিরা হয়তো বদলে গেছে। আগের মতো রগচটা,উচ্ছৃঙ্খল ভাব এখন আর নেই।কিন্তু এখন কেন যেন মনে হচ্ছে সামিরা বদলায়নি। এই মেয়ে বদলাবার নয়। খান বাড়িতে ব্রেকফাস্ট শুরু হয় দশটা বাজলে। শায়লা খান বরাবরই আগে নিচে নামেন। কর্তী হিসেবে এটা তার দায়িত্ব বলে মনে করেন। ন’টা বাজলে সবাই ঘুম থেকে ওঠে। যদিও শায়লা খান গত কয়েকবছর থেকে রুটিন পাল্টেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তার মধ্যে আংশিক পরিবর্তন ঘটে। পরকালের চিন্তা মাঝে মাঝে নাড়া দেয়। তখন অতীত কর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন নামাজে বসে। গতরাতেও বসেছিলেন৷ বেশিক্ষণ অবশ্য বসে থাকতে পারেননি। অস্টিওআর্থারাইটিসের কারনে বেশিক্ষণ কোথাও বসে,দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়। ব্যথায় কাতর হয়ে বিছানায় কাতরান। এতো সম্পদ, অথচ মনের শান্তি তিনি কোনোদিন পাননি। এককালে স্বামীর চারিত্রিক স্খলনে অতিষ্ঠ, চিন্তিত থেকেছেন আর এখন পুত্রের। মনে মনে নিজেকেই দোষেন। যে যা চায় তাই পায়। তিনি সম্পদ,দাপট চেয়েছিলেন, পেয়েছেন। সম্পদ মানেই সুন্দর জীবন নয়। আজকাল শানকে মনে করেন তিনি৷ পরের ছেলে হলেও মায়ের মতো সম্মান করত তাকে। বিনিময়ে তিনি শুধু লাঞ্ছনা, গঞ্জনা,ধোঁকা ছাড়া কিছুই দেননি৷ শানকে অত্যাধিক বিশ্বাস করতেন মঈন খান। শায়লা খানের সন্দেহ হতো শান মঈন খানের গোপনপক্ষের সন্তান। এই সন্দেহের বশেই শানকে সহ্য করতে পারতেন না। আপন সন্তানের ভবিষ্যত ভেবে বহুবার শানের ক্ষতির চেষ্টা করেছেন। শানের জীবন থেকে ওর বউকে সরিয়েছেন সামিরা,মাহিবের সাথে চক্রান্ত করে। এটা তিনি প্রতিহিংসা বশত করেননি। আপন সন্তানের মাথার উপর থেকে বিপদ কাটাতে করেছিলেন৷ শানের শ্যালিকার মৃত্যুর পেছনে মাহিব,সামিরার হাত আছে। শান যেন কিছুতেই একথা টের না পায় সেজন্যই মায়াকান্না করে সিঙ্গাপুর নিয়ে গিয়েছিলেন ওকে। সময়মতো ভালো সেজে নিজেই আবার দেশেও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন৷ ততদিনে সামিরা এদিকটা সামলে নিয়েছিল। শান আজ পর্যন্ত সে’কথা জানেনা। না জানলেও কী এক কারনে শান খান বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না মঈন খানের মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে থেকেই। মঈন খানের জানাজাতেও পর্যন্ত আসেনি সে। শায়লা খানের সে-সময় সন্দেহ হয়েছিল ওদের সম্পর্ক নিয়ে। যদিও এ সন্দেহ বড়োই নাজুক। আজকাল দুঃস্বপ্ন দেখেন খুব। যতদিন শান হাতের মুঠোয় ছিল ততদিন সব ঠিক ছিল। এখন ভয় পান, ভয় পান শান যদি সব সত্যি জেনে যায়! তবে মাহিব, সামিরা, তিনি কেউই রক্ষা পাবেন না। শুনেছিলেন বউটাকে বাকি খুব বেশি ভালোবাসে ছেলেটা। মনটা কেমন করে ওঠে শায়লা খানের। নিরপরাধ ছেলেটার বিষন্ন মুখটা মনে করে মনটা খারাপ হয়ে যায়। পরক্ষনেই নিজ সন্তানের ভবিষ্যত তাকে স্বার্থপর করে তোলে। শানের জন্য তখন আর মন খারাপ হয়না বরং শানের খারাপ চায়।
ন’টা বাজতেই বাড়ির বড়োরা খাবার টেবিলে আসে। অপেক্ষা এবার সামিরা, মাহিবের জন্য। প্রথমে মাহিব নামে। মায়ের পাশে নির্বিকার ভঙ্গিতে গিয়ে বসল। শায়লা খান চেয়ে চেয়ে ছেলেকে দেখেন৷ মাহিব তাকে আজকাল চেনেও না যেন৷ রাতের পর রাত ব্যথায়, দুশ্চিন্তায় তিনি ঘুমাতে পারেন না৷ কাওকে মনের কষ্ট গুলো বলে হালকা হতে চান । কিন্তু তেমন মানুষ এ বাড়ি নেই। থাকলেও শায়লা খানের কষ্ট ভাগ করার জন্য নেই। ক্ষমতা, অহংকারের কারনে সবাইকে তিনি দূরে সরিয়েছিলেন এককালে। এখন তারা আসবে কেন? চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। মাহিব সে শব্দ শুনতে পায়।আড়চোখে দেখেও উপেক্ষা করে মা’কে। একটু পর সামিরা নেমে এলো। মাহিবের পাশের চেয়ারটা ওর জন্য বরাদ্দ থাকে৷ সামিরা সেখানে বসে না। তবে আজ মঈন খানের চেয়ারটায় গিয়ে বসল। টেবিলে সবাই চকিতে তাকাল৷ শায়লা খান রাগত গলায় বললেন,
” সামিরা, সাহস কী করে হলো ওখানে বসার? রাতের নেশা কী এখনো কাটেনি? নিজের স্থানে গিয়ে বস।”
সামিরার মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে। এক চিলতে হাসি হেসে ছোট্ট করে বলল,
” সেটাই তো বসেছি।” সামিরার একপেশে জবাবে শায়লা খান আরও রেগে যান৷ তিনি আর কিছু বলবেন তার পূর্বে মাহিব গিয়ে টেনে তুলল সামিরাকে। নিজেকে ছাড়িয়ে সবার সম্মুখে মাহিবের গালে চড় বসিয়ে দেয় সামিরা। খাবার ছেড়ে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে। সামিরার বাবা- মা মেয়েকে শান্ত করতে গেলে সামিরা চেঁচিয়ে ওঠে,
” ছাড়ো আমাকে।” নিজেকে ছাড়িয়ে মাহিবের দিকে আঙুল তুলে বলে,
” তোকে আমি এমন শাস্তি দেবো যা তুই ভাবতেও পারবি না। ডন ভাবিস নিজেকে? ডন, ওহ গড।” সামিরা হাত তালি দিতে দিতে হাসতে লাগল অকারণে। হুট করে থাবা মেরে মাহিবের কলার টেনে ধরে বলল,
” তোকে স্বামী হিসেবে সামিরা কোনোদিন গ্রহণ করবে না। তুই আমার জুতারও যোগ্য না। তুই একটা হিপোক্রেট, বাস্টার্ড।”
” সামিরা!” মাহিব একহাতে মাহিবের চুলের মুঠি টেনে অন্যহাতে রিভলভার ওর কপালে ঠেকিয়ে বলে,
” অনেক অপমান করেছিস তুই। আর না৷ আমাকে হিপোক্রেট বলিস! চল তোকে আজ দেখিয়ে দেই আমি কী।” মাহিব মুখ নামাতেই সামিরা হো হো করে হেসে ওঠে৷ মাহিব সোজা হয়ে শক্ত করে ঠেসে ধরেছে রিভলভার ওর কপালে। মন চাচ্ছে এক্ষুণি ট্রেগার টিপে দিতে। বাড়ির বাকিরা গার্ডদের ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। এই ফাঁকে সামিরা গত রাতের ক্ষোভ ঝেড়ে নিল। ” বজলু” বলে ডাক দিতেই মাহিবকে হাওয়ায় তুলে আছড়ে মারল সামিরার বডিগার্ডটি। মাহিব উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কপাল,ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে তবুও ব্যথা পাচ্ছে না৷ মনের ব্যথার কাছে এ ব্যথা কিছুই না। আজ শামীম থাকলে এতো অপমানিত হতে হতো না সবার সামনে। মাহিব ভেতরে ভেতরে অসহায়বোধ করে। শায়লা খান অভিশাপ, গালাগালে সামিরাকে বিদ্ধ করতে করতে ছেলের কাছে ছুটে গেলেন৷ সামিরা সবাইকে শুনিয়ে,শুনিয়ে মা ছেলেকে বলল,
” তুমি,এবং তোমার ছেলে আমাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছ তা কোনোদিন পূরণ হবে না। আমি আগেও শানের হব বলেছি এখনো তাই বলছি। সামিরা শুধু শানের আর শান সামিরার। আমাদের মাঝে না মাহিব আসবে আর না অন্য কেউ।”
সামিরা চুলগুলো ঠেলে পিঠে ছড়িয়ে উপরে চলে যায়। পিছু পিছু গেল ওর বডিগার্ড এবং বাবা-মা। শায়লা খান ছেলের গায়ে স্নেহের হাত বুলাতেই ঝটকা মেরে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় মাহিব। রাগে গজগজ করতে করতে সেও কোথায় বেরিয়ে যায়। শায়লা খান কাজের লোকদের সামনে কাঁদেন না। নিজের অসহায়ত্ব কাওকে বুঝতে দেননা তিনি। ব্যথায় টনটন করা হাঁটু তুলে উঠে দাঁড়ান। তারপর বহুকষ্টে পার করতে থাকেন সিঁড়ি। চোখের জল অবাদে গড়ায় সবার অলক্ষ্যে।
জ্ঞান ফেরার পর থেকে শানের বুকে ঘাপটি মেরে আছে ইমা। ব্যান্ডেজ করা হাঁটুটা সামনে সোজা করা। শানের চোয়ালের পেশি টান টান হচ্ছে। কপালের রগ ফুলে ফুলে ওঠে। ইমা নাক ফুলিয়ে বলে,
” আপনি এখনো রাগ করে আছেন?”
” না।”
” মিথ্যা বলবেন না। আমি জানি আপনি রাগ করে আছেন। ভালো হতো শেয়ালগুলো আমাকে ছিঁড়ে খেলে। মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো।” অভিমানে সরে বসে ইমা। আচমকা কোলে তুলে নেয় শান। ইমা শঙ্কিত মুখে বলে
” কী করছেন?”
” তোমাকে শেয়ালের সামনে ফেলে দিয়ে আসতে যাচ্ছি।”
” মানে!”
” মানে তোর মাথা। বেশি বুঝিস সবসময়। কে বলেছিল এমন বোকামি করতে। যদি কিছু হয়ে যেত।” শানকে রাগতে দেখে মনে মনে হাসল ইমা। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
” হলেই ভালো হতো। আপনি ঐ সামিরাকে বিয়ে করে সুখে সংসার করতেন। আমি তো আপনাকে শুধু কষ্টই দিয়েছি। ঐ সামিরা সুখে ভাসিয়ে দিত একেবারে।” দুষ্টুমি করে বলতে গিয়েও শরীর জ্বলতে লাগল ইমার। মনে মনে সামিরাকে যখন একশ এক বকা দিচ্ছিল তখনই জোরে করে ধমক দিয়ে ওঠে শান। ইমা ভয়ে চমকে উঠে বলে,
” এতো জোরে ধমক দিলেন কেন?”
” চুপ! আর একটা কথা বলবি তো খবর আছে।” শান রুম ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। ইমা গলা জড়িয়ে বলল,
” আপনি আমাকে তুই তোকারি করছেন কেন? আপনিই তো বলছেন, তুই তোকারী করা বেয়াদবী। নিজেই শিখায় আবার নিজেই ঐ কাজ করে,হু। ”
” তোমার মতো তারছিড়া বউ কপালে জুটলে মানুষ কত কী করবে। আমি শুধু তুই তোকারীতে নেমেছি।”
” তারছিড়া! আপনি আমাকে তারছিড়া বললেন?”
” তারছিড়াকে তারছিড়া বলব না তো কী তারজোড়া বলব?”
” শানের বাচ্চা, নামা আমারে তুই। আমি আজই চলে যাব। নামা।” ইমা ছটফট করতে করতে চেঁচাতে লাগল। শান ইমাকে কোলে করে এগিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের দিকে। পেছনে ঈমাম চাচা, মোবারক অবাক হয়ে দেখছেন। মোবারক গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” স্যার কি বাসায় ফিরছেন?”
” না, জঙ্গলে যাচ্ছি। তোর ভাবির আফসোস শেয়াল তাকে কেন খেলো না। বেচারীর আফসোস মিটিয়ে দিয়ে আসি। তাড়ছিড়া বেচারী।”
শেষ কথাটা চাপা স্বরে বলল শান। ইমা রাগে মুখ লাল করে ফুসছে। দাঁত কটমট করে কাঁদতে কাঁদতে শানের গলা ছেড়ে হাত গুটিয়ে বলল,
” দিয়েই আসুন শেয়ালের সামনে। খেয়ে ফেলুক আমাকে। তারছিড়া মেয়ের বেঁচে থেকে কী হবে! শেয়াল খেলে ওদের পেট ভরবে। দিয়ে আসুন।”
” পেট ভরবে না ছাই। বদ হজম হবে। দেখা যাবে ওদের পেটে গিয়েও উল্টো পাল্টা কিছু শুরু করে দিয়েছ।”
” তাহলে নিচ্ছেন কেন?”
” তোমার আফসোস ঘুঁচাতে।” ইমা দেখল শান সত্যি, সত্যি ওদিকে যাচ্ছে। মনে মনে ভয় পেলেও বাহিরে সাহসী ভাব দেখিয়ে বলল,
” আপনি কি ভেবেছেন আমি ভয় পাব? মোটেও ভয় পাব না আমি।”
” ভেরি গুড।”
” সত্যি বলছি কিন্তু।”
” ওহ রিয়েলি!” শান নিরসভঙ্গিতে হাসল। তারপর আবার মুখ শক্ত করে সামনে ফিরিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর এগোতেই শিষ বাজায়। তখনই কোথা থেকে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এলো চার পাঁচটা কুকুর। শানকে ঘিরে ওগুলো মুখ নাড়িয়ে নাড়িয়ে ডাকছে। ইমা ভয়ে শিটে গেছে শানের বুকে। শান সেই সুযোগে ইমার ওড়নার কোনা ইশারায় কুকুরের দিকে মেলে দেয়। ব্যস! কুকুরটা যেইনা ওড়না কামড়ে টান দেয়। ইমা শানের গলায় জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,
” আল্লাহ গো,কুত্তায় আমারে খাইয়া ফালাইলো৷”
” ওয়াও। দারুন আইডিয়া দিয়েছ তো। এক কাজ করি,কুকুরের সামনে ফেলে দিয়ে যাই। কুকুরের পেটে যাওয়া আর শেয়ালের পেটে যাওয়া একই কথা।”
” আল্লাহ গো, কী হারামি মার্কা স্বামী আমার। আমারে কুত্তার পেটে দিতে চায়। আমারে নিয়া যাও আল্লাহ। এই জীবন রাইখা কী লাভ।” শান হাতের ইশারায় কুকুর এগিয়ে আনতেই ইমা চিৎকার করে শানকে বলে,
” আপনি এতো শয়তান আমার জানা ছিল। আমি একটু অভিমান করে বলেছি বলেই এমন করবেন। আচ্ছা আর বলব না। আমারে নিয়ে চলেন।” ইমা নাকে কাঁদে। শান বহুকষ্টে হাসি চেপে গম্ভীরমুখে বলে,
” না।”
” না! তাহলে আমারে নামান।”
শান নামিয়ে দিয়ে কুকুরগুলোকে ইশারা করতেই সেগুলো আরো জোরে ঘেউ ঘেউ জুড়ে দেয়। ইমা লাফিয়ে গলা জড়িয়ে বলে,
” নামাবেন না, নামাবেন না।”
“তুমি অনেক ভারী। আর কোলে রাখতে পারব না। ”
” আপনি আমাকে মোটা বললেন।” শান ইশারা করতেই কুকুরগুলো আবার শব্দ করে ডাকে। ইমা নাকে কেঁদে চোখ বন্ধ পরে বলে,
” আচ্ছা আমি তাই। মোটি,কালি, ডায়নি,পেত্নী,শাকচুন্নি সব সব। আমাকে নিয়ে চলুন এখান থেকে।” মনে মনে বলে, ” তোরে আমি কী যে করুম শানের বাচ্চা,দেখন ছাড়া কোনো উপায় থাকব না তখন। আল্লাহ গো।”
শান কোল থেকে নামিয়ে সাবধানে বসিয়ে দেয় কুকুরগুলোর সামনে। ইমা চোখ বন্ধ করে গলা ছেড়ে বলে,
” আপনি এতো নিষ্ঠুর, পাষাণ কেন? আমাকে সত্যি, সত্যি ফেলে দিচ্ছেন ওদের সামনে। আল্লাহ গো আমাকে মৃত্যুর পর শাকচুন্নি বানাবা৷ এই শানের ঘাড় না মটকালে আমি শান্তি পাবো না মরে।” ইমা অনুভব করে লোমশ কিছুর উপর ওর হাত ধরে রেখেছে শান। পিটপিট করে চোখ মেলতেই একটা কুকুর ওর গাল চেটে দিল।
” ছিহ-ই-ই।” চোখ খিচে বন্ধ করে দাঁত কামড়ে বসে আছে ইমা৷ শান চাপাস্বরে বলল,
” একসময় ভাবতাম তুমি এমন কেন! এখন ভাবি থ্যাংক গড তুমি এমন। একটা পাগলী! আমার ভালো থাকার চাবিকাঠি। আমার একমাত্র প্রিয় ভালোবাসা। আমার তোমাকে ছাড়া আর কিছুই চাইনা,কাওকে না। আমার জীবনে তুমি অতঃপর তুমিই আছো,থাকবে।” শানের ওষ্ঠস্পর্শ পেয়ে দু’চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলে ইমা। দু’হাতে খামচে ধরে শানের চুল।
তুমি অতঃপর তুমিই
৩০
Taniya Sheikh
কয়েকদিনের মধ্যেই নিজেকে ইমরোজের বাসার একজন করে নিয়েছে মৌ। এক ইমরোজের মা ছাড়া সবার কাছে সে প্রিয় হয়ে উঠেছে। সবার কাছে! না, ইমরোজের মনের খবর সে জানে না। মানুষটা যেন কেমন। চোখের দিকে তাকালে মনে হয় বড়ো আপন,আবার কথার রুক্ষতায় মনে হয় ওর মতো পর কেউ হয়ই না। মৌ মাঝে মাঝে ভুলে যায় নিজের লক্ষ্য। এই আশা যখন আপু,আপু বলে ডাকে,আহসান আঙ্কেল যখন মা, মা বলে মাথায় হাত রাখে। মৌ সব ভুলে যায়। ভুলে যায় সে আর স্বাভাবিক জীবন কাটাতে চায়না,ভুলে যায় প্রতিশোধস্পৃহা। মনের কোনে খুব করে জাগে একটা ছোট্ট সংসারের সাধ। লুকিয়ে কাঁদে তখন। প্রতিশোধস্পৃহার আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে কালো না করলে এই সবই চাইতে পারত। ইমরোজকে সাহস করে বলতে পারত। আমি আপনার মতোই পুরুষকে পাবার স্বপ্ন দেখতাম। মৌ হঠাৎই কেমন বদলে যায় এসব ভাবতে ভাবতে। চুপচাপ হয়ে বসে থাকে শূন্যে চেয়ে। ইমরোজ দুপুরে বাসায় ফেরে। খাবার টেবিলে মৌ-য়ের অপেক্ষা করছে। আশা গিয়েছে তাকে ডাকতে। তাতে যেন কারো মনেই বিরক্তি নেই। বরঞ্চ উদ্বিগ্ন মৌ-য়ের না আশায়। কিছুক্ষণ পর মুখ ভার করে আশা ফিরে এলো। সকলের দৃষ্টি তখন ওর পেছনে। না,কেউ নেই। সকলের আগে আমেনা বেগম অধৈর্য্য হয়ে বলে ওঠে,
” কী হ’য়েছে আশা? ও মেয়ে কি খাবে না?”
আহসান সাহেব,ইমরোজ বিস্মিত আমেনার মুখের দিকে চেয়ে। এরা সবাই জানে আমেনা বেগম মৌকে মনে মনে পছন্দ করেনা। তবে এই চিন্তা কিসের! ইমরোজ, এবং আহসান সাহেব মনে মনে এসব ভাবলেও বাহিরে তারা নিশ্চুপ। আশা এগিয়ে আসে। অভিমান করেছে সে মৌয়ের উপর। এতোবার করে ডাকার পর মৌ এলো তো নাই ই উল্টো তাকে কড়া কথা শুনিয়েছে। বলেছে একটা বাইরের মেয়েকে নিয়ে কিসের এতো আদিখ্যেতা তাদের। আশার খুব লেগেছে সে কথা। এতো ভালোবাসে মৌ আপুকে সবাই। অথচ তার কাছে এসব আদিখ্যেতা! আমেনা বেগম মেয়েকে চুপ দেখে ধমকে ওঠেন,
” কি রে! বলছিস না কেন কিছু? ”
” কী বলব?” আশা তেজে ওঠে। আমেনা বেগম সহ বাকিরা চোখ বড়ো বড়ো করে দেখল আশাকে। সুন্দর মেয়েটা রাগে লাল হয়ে উঠেছে। বাকিরা ভ্রুকুটি করলেও আমেনা বেগম মেয়েকে তিরস্কার করে বলেন,
” কিছুই হয়না তোর দ্বারা। একটা মেয়েকে ডেকে আনবি সেটাও পারিস না।” আশা সচারাচর মায়ের সাথে তর্ক করে না। বাবা- ভাইয়ের সামনে তো নয়ই। আজ সব রেকর্ড ভেঙে গর্জে ওঠে,
” এতো আদিখ্যেতা কিসের ঐ মেয়েকে নিয়ে। চেনা নেই, জানা নেই বাসায় আনার কী দরকার ছিল তাকে? যত্তসব।” আশার কণ্ঠস্বর কাঁপে। কান্না লুকাতে দ্রুত পায়ে চলে যায় মায়ের ঘরে।সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ওর দিকে চেয়ে। আমেনা বেগম লজ্জিত হলেন। সবাই চোখ মৌয়ের রুমের দিকে। মেয়েটা এসব শুনলে কী কষ্টটাই না পাবে! দুপুরে কেউ ই খেল না। ইমরোজ না খেয়ে চলে গেল। আমেনা বেগম একা একা অনেক্ক্ষণ ভাবলেন। তারপর ইতস্তত ভাবে এগিয়ে গেলেন মৌ যে রুমে আছে সেদিকে। মায়ার টান বড়োই কঠিন টান। এ টানের কাছে সবই যেন হার মানে।
ইমার পায়ের অবস্থা এখন ভালো। শানের কারনে এ’কদিনে পা-টা নিচে নামাতে পারেনি সে। আজ যখন পা নাড়িয়ে বলল, ” শান দেখুন,আমার পায়ের ব্যথা গায়েব।” শান গাল টেনে বলেছে,” তো।”
” তো আবার কী? আমি নিচে নামব। কতদিন হলো যাই না।”
” কতদিন!”
” কতদিনই তো। আপনি কোলে করে নিচে বসিয়েছেন,ছাদে ঘুরিয়েছেন। ওটা তো আর আমি নিজে যায়নি। নিজ পায়ে হেঁটে যাবার মজাই আলাদা।”
” এতো মজা ভালো না। পা”য়ের ঘা পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে তারপর যেখানে খুশি যেয়ো।”
” উহু! প্লিজ,প্লিজ।”
” পুরাই ড্রামাবাজ একটা। ওয়েট তোমার এই মুখাভঙ্গির একটা পিক তুলে রাখি। আমি একা কেন দেখব? সবাই দেখুক।”
” না।” শানের হাত টেনে সামনে বসায়।
” না কেন?” ইমার নাকটা টেনে জিজ্ঞেস করতেই ইমা ওর বুকে মাথা রাখে। বলে,
” আমার যত ন্যাকামি, বাঁদরামি সব তো আপনার জন্য। আপনি ছাড়া এসব দেখার হক আর কারো নেই।”
” আচ্ছা!” শান মুচকি হেসে ইমাকে দু-হাতে জড়িয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। ইমার মুখে এসে পড়া চুলগুলে আলগোছে সরিয়ে পুনরায় বলে,
” ইমা।”
” হুমম।”
” আর ছেড়ে যাবে না তো?”
” কোনোদিন না।”
” ভুল বুঝবে না তো?”
” কোনোদিন না।”
” সত্যি?”
” অযুত,নিযুত, কোটিবার সত্যি।” ইমা গলা জড়িয়ে শানকে খুব কাছে টেনে নেয়। বাহিরের একফালি রোদ এসে ঢুকেছে এই রুমে। সাথে করে এনেছে শিহরণ জাগানো মধুর পবন। এই দু’টো মানব মানবীর কাছে মর্ত্য এখন স্বর্গ তুল্য।
বেশ কয়েকদিনের ঝামেলা শেষে আজ খান বাড়ির লোকেরা সবাই একসাথে খেতে বসেছে। সেখানেই শায়লা খান জানান,
” আগামি শুক্রবার মাহিব,সামিরার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। হাতে মাত্র সাতদিন রয়েছে। এরমধ্যেই সকল কাজ শেষ করতে হবে।” মাহিব, সামিরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রয় অপলক। প্রতিবাদ আজ কেউই করেনা। কেন করেনা তার খবর কেবল এদের অন্তর জানে। শায়লা খান সহ বাকিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে এদের নীরবতা দেখে। তবুও শায়লা খান মনের খচখচানি দূর করতে আরেকবার জিজ্ঞেস করে।
” তোমরা কী সত্যি এ বিয়েতে রাজি আছ?”
” জি।” প্রথমে সামিরা বলে। ঠোঁটের কোনে একচিলতে ক্রুর হাসি ঝুলন্ত। মাহিবও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। সে একপ্রস্ত হেসে বলে,
” আমারও আপত্তি নেই।”
শায়লা খান সহ সামিরার বাবা-,মা নিশ্চিন্ত হয়। এদের সকলের ধারণা গত কয়েকদিনের বুঝানোতে সামিরা,মাহিবের আচরণের এই পরিবর্তন। শায়লা খান সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন এ দুজনের উপর। সামিরাকে তিনি শাসিয়েছেন শানকে সব বলে দেবার ভয় দেখিয়ে। ব্যস, তাতেই এই বাঘিনী বিড়াল বনে গেছে। নিজের মধ্যে শক্তি ফিরে পান শায়লা খান। এখন মনে হয় তিনি একাই পারবেন স্বামীর রেখে যাওয়া রাজত্ব সামলাতে। ছেলেটাও তার বশ মেনেছে। সবই হয়েছে ইরার মৃত্যুকে পুঞ্জি করে। খুশি মনে রুমে ফিরে আসেন। তিনি কল্পনাও করেননি তার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পার করছেন। যে সর্প দুটোকে বশ করেছেন ভেবে আনন্দিত হয়েছেন- একটু পর এরাই তার জীবন নাশের কারন হবে। শায়লা খান রাতে কিছুক্ষণ বাথটবে শরীর ভিজিয়ে আরাম করেন। এতে নাকি মাইণ্ড রিলাক্স হয়। আর সবার কথা জানেন না। তবে তার হয়। তিনি আজও তাই সেখানে গেলেন। পানি ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভ্যাস বশত নিজেকে খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দেখলেন। কত সাধের শরীর খানা তার। কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় করেছেন এই সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য। দিনশেষে সবই যেন ব্যর্থ হয়। নেতিয়ে,কুচিয়ে যায়। বাথটব পানিতে ভরে গেছে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটা পা রাখেন পানির ভেতর। সাথে সাথে তার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। কেউ সজোরে টেনে ধরেছে তার শরীরের রগ। চিৎকার করে ওঠেন৷ চারদেয়ালের বাইরে খুবই আস্তে শোনা যায় সে শব্দ। যে দুজনের কানে যায় তারা হাসে। অদ্ভুত নিষ্ঠুর সেই হাসি। শায়লা খান পুরোপুরি বাথটবে পড়ে যান। অচিরেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় তার। শরীর শক্ত হয়ে আসে।
হাতে হাত রেখে নির্জন অন্ধকার মেঠো রাস্তা ধরে হাঁটছে শান, ইমা। পা’টার জন্য এতোদিন বাইরে বেরোতে পারেনি। আজ তাই এশা পড়েই দুজনে হাঁটতে বেরিয়েছে। শানের এক হাত ধরে হাঁটছে আর গুন গুন করছে ইমা। শান মুচকি হেসে বলে,
” জোরে গাও।”
” জোরে গাইলে শিয়াল ছুটে আসবে।” বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। শান বিমুগ্ধ চোখে চেয়ে রয়। ইমার সেটা চক্ষুগোচর হতেই লজ্জায় মুখ নামিয়ে বলে,
” এভাবে তাকাবেন না।”
শান ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে,
” কেন?”
” আমার লজ্জা করে।”
শান ইমার চিবুক ধরে ঠোঁট স্পর্শ করতেই ইমা লজ্জা রাঙা হয়ে বলে,
” ধ্যাৎ! আপনি না।”
একহাতে ইমার গলা পেঁচিয়ে কাছে টেনে শান হাসতে হাসতে বলে,
” আমি না কি?”
” ঘোড়ার ডিম।”
” আমি ঘোড়ার ডিম না, আমাদের ডিমের বাবা হতেই চাই।” ইমার মুখটা গম্ভীর হয়ে ওঠে। সাথে শান নিজেও। ইমার কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। দুজনের কেউ কিছুক্ষণ কথা বলে না। নীরবে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরে আসে। শান এড়িয়ে যেতেই ইমা ওকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে কেঁদে ওঠে। শান সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায়না। চুপচাপ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে সে। ইমা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
” আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ।” বলেই আবার কাঁদে। শান কোনো কথা বলছে না দেখে কান্না যেন থামলোই না। শান অনেক্ক্ষণ পর অনুভব করে ওর চোখের কোনা গড়িয়ে জল পড়ছে। চট করে জলটুকু মুছে ইমার মাথায় হাত রাখে।
” তোমার কোনো দোষ নেই ইমা। সব দোষ আমার। আমার পাপের শাস্তি আমি সন্তান হারিয়ে পেয়েছি।”
ইমা দু কদম সরে দাঁড়ায়। বিস্মিত সিক্ত চোখে চেয়ে বলে,
” এসব কী বলছেন আপনি?”
” ঠিকই তো বলছি। তোমার ভাই,বাবাকে আমিই তো ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। না জেনেই দেই কিন্তু দিয়েছি তো। এটা তো পাপ। তোমার মা সন্তান হারিয়েছে, তুমি বাবা হারিয়েছ। তবে আমি কেন হারাব না। ঠিকই হয়েছে আমার সাথে। আমার পাপের শাস্তি এরচেয়ে ভালো আর কী হতো।” শান কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই কাঠিন্য ভেদ করে সমস্ত মুখ ভিজে যাচ্ছে নোনাজলে। ইমা ছুটে এসে জাপটে ধরে শানকে। কথা বলার ভাষা ইমার নেই। কি বলবে কিছুই সে জানে না। শান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,
” আমার সন্তান ইমা,অথচ আমি তাকে দেখতে পেলাম না,ছুঁতে পেলাম না। যেদিন থেকে তার কথা তুমি বলেছ আমি ওকে ভুলিনি। মাঝে মাঝে আমার ভাবনা দখল করে নেয় ও। আমি মরতে গিয়েছিলাম কয়েকবার। ও মরতে দেয়নি৷ কোনো অবয়ব না,একটা মাংস পিণ্ড আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
” বাবাই, ওরা আমাকে মেরে ফেলল কেন? বাবাই তুমি আমাকে বাঁচালে না কেন? ও বাবাই,বাবাই। তুমি শুনছ। শুনছ আমি কাঁদছি।” আমার কলিজা ছিঁড়ে যায় ইমা। আমি তখন বুঝি তোমার মায়ের কষ্ট। সন্তান হারানোর কষ্ট। আমার সকল প্রতিশোধস্পৃহা ভঙ্গুর হয়ে যায়। অপরাধবোধ কুঁড়ে, কুঁড়ে খায় আমাকে। বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। ঘৃণা হয় নিজের উপর,প্রচন্ড ঘৃণা।” ইমাকে জড়িয়ে ধরে নিচে বসে পড়ে। দু’জনই শব্দ করে কাঁদছে। শান ঝাপসা চোখে দেখে একটা মাংসপিণ্ড। আজ হঠাৎই সেটা একটা ছোট্ট শিশুর অবয়ব নেয়। ঠোঁটের কোনে তার কী মিষ্টি হাসি! আজ দুঃখ নেই,কান্না নেই। ইমা অচেতন হয়ে পড়ে সাথে সাথে। শান ভয়ে কোলে তুলে নেয়। কাউচে শুয়ে দিয়ে ল্যান্ডফোনে ডাক্তারকে কল করে। রিসিভার নামাতেই সামনে সেই শিশুটিকে দেখে। এগিয়ে এসে শানের আঙুল ধরে নিয়ে এসে বসায় ইমার সামনে। ইমার পেটের উপর হাত রেখে মিষ্টি হেসে বলে,
” আমি আসছি তো বাবাই। এই দেখো।” শান অনুভব করছে আজ সেই স্পর্শ। একটা নরম হাতের স্পর্শ। যে হাতটা ওর হাতের উপর। চমকিত, হতবিহ্বল শানের দু-চোখ গড়িয়ে ফের জল পড়ে। সেই জল মুছে শিশুটি বলে,
” তুমি কী জানো বাবাই, অনুশোচনায় সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়। ভুল তো সবাই করে- সেখান থেকে যারা শিক্ষা নেয়, নিজেকে পুড়িয়ে সোনা বানায় তারাই তো সত্যিকারের মানুষ। আশরাফুল মাকলুকাত তাদেরই তো বলে। তুমি ক্ষমা চাইবে না বাবাই? সে তো গাফুরুর রাহিম। নেক দিলে চাইলে তিনি কাওকে ফেরান না। তুমি চাইবে ক্ষমা,ক্ষমা করবে তাই না বাবাই, বলো বাবাই?”
” হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি চাইব ক্ষমা,করবও। আমি নিজেকে পুড়িয়ে সত্যিকারের মানুষ হব,তোমার বাবাই হব।” শান শিশুটির হাস্যজ্বল মুখটা ছুঁতেই সেটা গায়েব হয়ে যায়। একদৃষ্টে সেই শূন্যে চেয়ে চোখ মোছে। ইমাকে কোলে তুলে উপরে চলে আসে।
ডাক্তার এসে ইমাকে পরীক্ষা করে মুচকি হাসেন। শান জানে কী হতে চলছে। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছে সে। ডাক্তার ফারজানা জানায় ইমা অন্তঃসত্ত্বা। তবুও একবার বিষয়টা নিশ্চিত হতে কিছু চেকাপ করা জরুরী। শান সম্মতি দেয় তাতে। ডাক্তার ভিজিট নিয়ে চলে যায়। সাথে সাথে মোবারকও যায়। তার আজ খুশির সীমা নেই। মিষ্টি আনতে বাজারে ছুটেছে সে। এই নিভৃত স্থানে হঠাৎই খুশির আমেজ তৈরি হয়। ইমা খুশি হলেও মন ভার করে শুয়ে আছে বিছানার এক কোনে। সব ঠিক হয়েও যেন হচ্ছে না৷ অতীত ওদের মাঝে দেয়াল হয়ে ঠিকই দাঁড়াচ্ছে ঘুরে ফিরে।
” ইমা ভাবি, ওঠেন, ফলগুলো খেয়ে নেন।” ইমা ফিরে তাকায়না। নিচু গলায় বলে,
” আমি খাব না আসমা।”
” স্যার খেতে বলেছে আপনাকে।”
” বলুক। আমি খাব না।” আসমা মন খারাপ করে ট্রে হাতে নিচে নেমে আসে। শান কাইচে বসেছিল। আসমা ওর সামনে এসে বলল,
” ভাবি খেলো না।”
শান কিছুক্ষণ চুপ করে আসমার হাত থেকে ট্রেটা নিয়ে উপরে চলে আসে। বিছানার সাইড টেবিলে রেখে বলে,
” ইমা,ওঠো।”
ইমা ওঠেনা,ফিরেও তাকাইনা। শান ওর শিওরে গিয়ে টেনে তুলে মুখোমুখি বসায়।
” কী হয়েছে? ”
ইমা নাক ফুলিয়ে কাঁদছে। শান ঝুঁকে বলে,
” রাগ করেছ বউ। ও বউ,বউ।” ইমার নাক,গাল টেনে মুচকি হাসে শান। ইমা দু’হাত ছুঁড়ে শানের বুকে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
” আমাদের অতীত কেন বার বার আমাদের মাঝে দুরুত্বের দেয়াল তৈরি করে? কেন আমরা আলাদা হয়ে যাই?”
” আর এমন হবে না।”
” সত্যি বলছেন?”
” হুমম।” শান ইমার কপালে চুমু খায়। তারপর বলে,
” এখন খাও।”
” আপনি খাইয়ে দিন।”
” আহ্লাদী একটা।” একপিছ কমলা মুখে তুলে দিলে ইমা মুখে পুরে অস্ফুটে বলে,
“বউগত অধিকার এটা আমার।” শানের গালে চুমো দিয়ে মুখ নামিয়ে হাসে। শান এক হাতে গাল টেনে ঠোঁট স্পর্শ করতেই ইমা ঠোঁট উল্টে বলে,
” ধ্যাৎ! আপনি যা তা।”
” তুমি দিলে আহা! আমি দিলেই যা তা। বাহ! রে দুনিয়া। পুরুষ মানুষের তো শুধুই বদনাম।”
” ফাজিল একটা।” শানের কলার টেনে গলা জড়িয়ে ধরে ইমা বলে,
” আপনি খুশিতো শান।”
” অনেক।” দু’বাহুতে ইমাকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলায়। গুন গুন করে গায়,
” আমার যা কিছু সবই তোকেই ঘিরে,
আমার যত সুখ সবই তোর নামে।
তুই ছাড়া এই আমি,আমি নই,
এ জীবন তুই, শুধু তুই।
তোর নামেতে ফোটে হৃদয়বাগে প্রসূন,
তুই আমার বসন্ত, তুই ফাগুন।।
চলবে,,,,
চলবে,,,
মোবাইলটা নিয়ে পেরেশানিতে আছি। ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।