#আবর্তন
#তাজরীন_খন্দকার
#পর্বঃ০৮
এই অরুণ তো তার চেয়েও বড় নাটকবাজ!
চন্দ্রা তার মায়ের পিছু ছেড়ে অরুণের দিকে তাকালো। দেখলো অরুণ তার বাবার সাথে কতো কতো আলাপ জুড়ে দিয়েছে।
সে সামনে এগিয়ে গিয়েও আবার পেছনে ফিরে গেলো। তার মা বলছিলো অরুণ অফিস থেকে এসেই তারাহুরোয় তাদের বাসায় চলে আসছে, তার মানে সে কিছুই খায়নি।
চন্দ্রা রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো যা কিছু রান্না আছে তা অরুণের খুব একটা পছন্দের নয়। কে জানতো সে এভাবে হুট করে আসবে? নাহলে তো অনেককিছু রান্না করে রাখতো।
আর কিছু না ভেবে চন্দ্রা খুব দ্রুত তার জন্য খাবার তৈরি করতে লাগলো। চন্দ্রার মা আর ভাবী কতক্ষণ তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। জীবনে খুব অল্প সংখ্যকবারই চন্দ্রাকে এভাবে কাজ করতে দেখেছে।
আজকে নিজের স্বামীর জন্য তার ছুটাছুটি দেখে তারা দুজনেই অবাক। তবে চন্দ্রার ভাবীর মুখে বিজয়ের হাসি। তিনি ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন চন্দ্রা সব মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু এতো দ্রুত হবে সেটা উনার ধারণারও বাইরে ছিল।
অল্প সময়ের মধ্যে চন্দ্রা কয়েক রকম খাবারের আয়োজন করে ফেললো, সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু এতো রান্না চন্দ্রা কীভাবে শিখলো সেটাই তার মায়ের মাথায় যাচ্ছেনা।
তিনি কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে সেটা জিজ্ঞাসা না করেই চলে গেলেন।
চন্দ্রা খাবার নিয়ে অরুণের সামনে রাখলো। তখন চন্দ্রার বাবা উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
___জামাই খান আপনি। আমরা আপনি আসার আগেই রাতের খাবার খেয়ে ফেলেছি।
অরুণ অনেক জোরাজোরি করার পরও চন্দ্রার বাবা এখানে আর বসলোনা।
তার বাবা চলে যাওয়ার পরেই চন্দ্রা অরুণের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। অরুণ একমনে খাচ্ছে। কারণ তার সব পছন্দের খাবার সামনে রাখা। চন্দ্রা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে অরুণের খাওয়া দেখছে।
অরুণের খাওয়া মাঝ প্রায়, তখনই চন্দ্রার ভাবী এসে অরুণের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো।
অরুণ এতক্ষণে একটু মাথা তুলে ভাবীর দিকে তাকালো। তারপর কোনো শব্দ না করে খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিতেই তার ভাবী বললো,
___ আপনার বউকে জিজ্ঞাসা করেননি সে খেয়েছে কিনা?
অরুণ হাতের তোলা খাবারটা প্লেটে রেখে চন্দ্রার দিকে তাকালো, চন্দ্রা সাথে সাথে তার চোখ নিচু করে ফেললো।
ভেবেছিল না খেয়ে থাকার জন্য অরুণ তাকে বকা দিবে। যেটা ভালোবাসলে কেউ দিতে পারে।
কিন্তু সেটা না করে অরুণ বললো,
___ সে তো দিনদিন মুটকি হচ্ছে, তার আর খাওয়ার দরকার কি? আর হ্যাঁ ভাবী আপনি কিন্তু একদম ঠিক আছেন! জোশ একটা ফিগার আপনার।
চন্দ্রার হাসি মুখটা মূহুর্তেই অন্ধকার হয়ে গেলো। সে চোখ বড় করে সে অরুণের দিকে তাকালো, কিন্তু অরুণ তো খাচ্ছে। চন্দ্রা আর ভাবীর দিকে তাকিয়ে দেখলো উনি হেসে হেসে একদম নুইয়ে পড়তেছে৷
চন্দ্রার রাগের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো। সে মোটেও মুটকি নয়, তার ভাবী তার থেকে মোটা। সেখানে অরুণ বলছে সে মুটকি কিন্তু তার ভাবীর ফিগার ঠিক। ছি ছি তার নজর কতোদূর!
চন্দ্রা মন খারাপ করে সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো, তখনি শুনতে পেলো অরুণ বলছে,
___ আমি আজকে কেন আসছি জানেন? শুধু মাত্র আপনাকে দেখতে ভাবী।
বলতে বলতে অরুণ খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালো। আর কিছু শোনার আগেই চন্দ্রা রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রুমে চলে গেলো।
গিয়ে মনে মনে অরুণকে ইচ্ছে মতো বকতে লাগলো।
তারপর তার মাথায় আসলো, অরুণ নিজের বিছানায় তাকে জায়গা দেয় নাই। আজকে সেও তার বিছানায় অরুণকে থাকতে দিবেনা। প্রতিশোধ নেওয়ার সময় এসে গেছে।
যেই ভাবা সেই কাজ! চন্দ্রা নিচে একটা বালিশ রেখে দিলো। আর বিছানার মধ্যে কম্বল মুড়ি দিয়ে এমনভাবে শুয়েছে যে, এদিক ওদিক অল্প ফাঁকা থাকলেও কেউ অন্তত কোনোদিকেই থাকতে পারবেনা।
অরুণ গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রুমে প্রবেশ করেই দেখলো চন্দ্রার এইসব কান্ডকারখানা। হাসবে নাকি কাঁদবে ভুলে গেছে। চন্দ্রা উল্টো প্রতিশোধ নিচ্ছে এটা ভেবে তার হাসি পাচ্ছে কিন্তু আসলেই সে ফ্লোরে কীভাবে থাকবে এটা ভেবে এখনি ভেতর শিউরে ওঠতেছে। অরুণ ঘাড়ে হাত দিয়ে চুলকাচ্ছে আর এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। তারপর আস্তে আস্তে বললো,
___ এই রুমে অন্তত একটা সোফা সেট থাকা উচিত ছিল।
চন্দ্রা কম্বলের ভেতর থেকে মুখ বের করে বললো,
___আচ্ছা আচ্ছা এখানে থাকা উচিত ছিল তাইনা? আপনার রুমে তাহলে নেই কেন? ভুলে গেছেন আমাকে চারটা রাত কীভাবে রেখেছেন? আর আপনার রুমে তো কার্পেটও বিছানো নেই! অথচ আমার রুমে সেটাও আছে।
অরুণ চোখের মনি দুটোকে কতক্ষণ উপর নিচে করে ভেংচি দিয়ে নিচেই শুয়ে পড়লো। সত্যি সত্যি অরুণকে নিচে শুতে দেখে চন্দ্রা অবাক থেকে অবাক হয়ে গেলো। সে ভেবেছে অরুণ কখনোই মেনে নিবেনা,কিংবা তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিবে।
কিন্তু তার এই মেনে নেওয়াটাও এখন চন্দ্রার গ্রহণযোগ্য লাগছেনা। অরুণ কতক্ষণ মোবাইল চালালো। তারপর সেটাকে পাশে রেখেই ঘুমিয়ে গেলো।
কিন্তু চন্দ্রার ঘুম আসছেনা ৷ এটা করা সত্যিই তার উচিত হয়নি। চন্দ্রা যে ভুল করেছিল তার জন্য অরুণ যা করেছে তা অবশ্যই প্রাপ্য ছিল। কিন্তু সে যে অরুণকে উল্টো শাস্তি দিতে গেলো এটা নিঃসন্দেহে জঘন্য অপরাধ।
চন্দ্রা ভাবছে অরুণকে জাগাবে এবং উপরে আসতে বলবে,কিন্তু ঘুমের মানুষকে ডাকাটা তো ঠিক হবেনা।
চন্দ্রা বিছানা থেকে উঠে পড়লো, ভীষণ খিদে পেয়েছে তার। অরুণের সাথে রাগ করে রাতে না খেয়ে চলে আসা উচিত হয়নি! রুমের বিভিন্ন জায়গা খুঁজে কয়েকদিনের আগের রাখা কতগুলো শুকনো খাবার খুঁজে পেলো। এগুলো খাওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই, কারণ এখন খাওয়ার জন্য গেলে আর বিষয়টা কেউ টের পেলে ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাবে।
অতঃপর এগুলো অল্প খাওয়ার পর বুঝতে পারলো কিছুটা খিদের যন্ত্রণা কমেছে।
তারপর আর অতশত না ভেবে সেও কম্বল নিয়ে নিচে শুতে গেলো।
প্রথমে আস্তে আস্তে অরুণের গায়ে কম্বল দিয়ে দিলো, তারপর মধ্যে নিজের কোলবালিশটা মাঝে রেখে কম্বলের একটা ছোট অংশ টেনে সেও এখানেই শুয়ে পড়লো। তবে মনে মনে ভাবছে সকালে অরুণ এভাবে দেখলে রেগে যাবেনা তো!
কিন্তু অরুণকে নিচে রেখে উপরে তার একদম ঘুম আসছেনা৷ সকালে বকা খাওয়ার সম্পুর্ন প্রস্তুতি নিয়েই চন্দ্রা ঘুমিয়ে পড়লো।
শেষ রাতে অরুণ বিপরীত পাশ থেকে চন্দ্রার বরাবর ফিরে কোলবালিশের উপর হাত রাখলো, কিন্তু তার হাত কোলবালিশ পেরিয়ে গিয়ে কোনো একটা নরম জায়গায় পড়লো। অরুণ একদম ঘুম থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। পাশে তাকাতেই প্রথমে সে চমকে উঠলো,যখন পাশে চন্দ্রাকে দেখলো তখন সে একটা মুচকি হাসি দিলো। তারপর চন্দ্রার কপালে ছুঁয়ে যাওয়া চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দিলো।
কেন জানি মনে হচ্ছে এই মেয়েটা তাকে কোনো জাদু করেছে। এতো না চাওয়া সত্ত্বেও তার মায়ায় প্রচন্ডরকম আঁটকে যাচ্ছে। অরুণ চন্দ্রার দিকে আবারও তাকালো, আসলে সে চন্দ্রাকে যতটা মারাত্মক ভেবেছিল তার ছিঁটেফোঁটাও সে না। চন্দ্রাও ভীষণ সহজ সরল, শুধু ভুল একটা মানুষের জন্য জীবনে এতোগুলো পাগলামো করেছে।
অরুণ তার হাতটা আস্তে করে চন্দ্রার গালে রাখলো,
তারপর হাত সরিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার জন্য চলে আসবে তখনি চন্দ্রা অরুণের হাতটা দুইহাতে চেপে ধরে এক লাফে উঠে বসলো। হঠাৎ এভাবে উঠে যাওয়াতে অরুণ ভয় পেয়ে ছিঁটকে সরে যেতে গিয়েও পারলোনা। কারণ চন্দ্রা হাতে ধরে আছে।
অরুণ থতমত খেতে লাগলো আর তোঁতলাতে তোঁতলাতে বললো,
___ তু তু তুমি, তুমি সজাগ ছিলে?
চন্দ্রা ভ্রু দুটো উপরে তুলে, মুখ এপাশ ওপাশ করে তার হাত ছেড়ে ঝিমাতে ঝিমাতে বললো,
___ হুম হুম আমি সজাগ। না হলে বউ রেখে বউয়ের ভাবীর সাথে মিষ্টি মধুর আলাপ রসালাপ করা বরের কান্ড দেখা হবে কি করে?
অরুণ চুপ করে নিচে তাকিয়ে ভাবছে কি বলবে৷ কতক্ষণ ভেবে এটাই বুঝতে পারলো,,ওর সাথে অযথা এসব বলে লাভ নেই৷ দোষটা আসলে অরুণেরই। সে তাই চোখ বন্ধ করে বললো,
___এখনের ঘটে যাওয়া ব্যাপারের জন্য দুঃখিত আমি।
চন্দ্রা রাগী গলায় বললো,
___ কোনো দুঃখিতে কাজ হবেনা৷ আপনি অনুমতি ছাড়া আমার পেটে হাত দিয়েছেন, গালে হাত দিয়েছেন। আমি ক্ষমা করবোনা।
এই কথা শুনে অরুণের এখন সত্যি মরে যেতে ইচ্ছে করছে, তাও আবার বললো ..
___ মাফ করে দাও প্লিজ। ভুলে হাত লেগে গেছে। আর এমন হবেনা।
চন্দ্রা তখন উৎফুল্ল ভাব নিয়ে বললো,
___ ওকে ফাইন দিবো মাফ করে, সমস্যা নাই। আমার আবার মন অনেক বড়! কিন্তু একটা শর্ত আছে, আপনাকে আমার করা তিনটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তাহলে একদম পাক্কা মাফ করে দিবো প্রমিজ!
চলবে…..