গল্প: আমার গল্পে শুধু তুমি
লেখক:হাচনাইন হোসেন সাব্বির
পর্ব:১৪
প্রেম যেমন মানুষের হৃদয়কে সাগরের মতো বিশাল করে তোলে,,
তেমনই এই প্রেমই প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয়কে ছোট্ট তীলকের ন্যায় ক্ষুদ্র করে দেয়..
তখন ইচ্ছে করে সেই ভালোবাসার মানুষটিকে গোটা পৃথিবীর থেকে আলাদা করে দিতে,ইচ্ছে করে তাকে হৃদয়ের কোনো গোপন কুঠিরে যত্ন করে সাজিয়ে রাখতে।নিজের জন্য শুধু মাত্র নিজের জন্য]
তূর্য অন্তী মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে… -আমি আপনাকে সরাসরিই বলছি আমি আপনার সাথে যাবো না!
-আর ইউ সিউর
-১০০%….আমাদের বিয়েটার যাস্ট কোনো মানেই হয় না তূর্য ভাইয়া।আপনি জিদের বসে বিয়েটা করেছিলেন আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি যেই কারনে বিয়ে করেছিলেন তা তো সেদিনই মিটে গেছে নতুন করে আর চাওয়া পাওয়ার কোনো হিসেব কি বাকি আছে???
[অন্তী কথাগুলো বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।অন্তীর পরীক্ষা আজই শেষ হয়েছে।পরীক্ষার এই ক দিন তূর্য অন্তীর কাছেই ছিলো।অন্তী আর তূর্য বেশ কাছাকাছি ছিলো।এ কদিনে দুজন কাছা কাছি থাকলেও দুজনের মধ্যে দূরত্ব ছিলো যেন আকাশ ছোঁয়া।
কথায় আছে পাশাপাশি থাকলেই যেমন কাছে থাকা যায় না তেমন দূরে থাকলেও সেই দূরত্বটা কাছা কাছি থাকার চেয়ে অনেক বেশি গভীর হয়,,
তূর্য এই দূরত্ব ভাঙ্গতে চাইলেও অন্তী চায় নি।অন্তী হয়তো চাইলেও পারতো না।অন্তী যখনই তূর্যকে দেখতো তখনই বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠতো তূর্য আর জিনিয়ার সেই ছবি গুলো।
একটা মেয়ে পাহাড় সমান দুঃখ কষ্ট মানিয়ে নিতে পারলেও নিজের স্বামীকে অন্য কারো সাথে মানিয়ে নিতে পারে না…..
ডায়লগটা বড্ড পুরানো হলেও কথাটা চিরন্তন সত্য,, এর মাঝে একবার জিনিয়ার সাথে অন্তীর কথা হয়েছে…গোপনে!
বার জিনিয়া অন্তীকে একটা কথায় বলে গেছে,, -তূর্যকে ভালোবাসার যোগ্যতা তোমার নেই…তুমি নোংরা অসভ্য অযোগ্য একটা মেয়ে।একজন পুরুষ তোমার জীবনে থাকা অবস্থায় আরেক পুরুষের সাথে…..
অন্তী আর কথা বারাই নি,, অন্তীর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে অন্তী,তূর্য আর সাগরের অতীতের সব কিছুই জিনিয়া জানে হয়তো তূর্যই জানিয়েছে….
তূর্য ছাড়া কেই বা জানানোর আছে… সব মিলিয়ে অন্তীর মনে যে অভীমানের পাহাড় জমে গেছে তা ভাঙ্গা এতো সহজ নয় হয়তো কখনো ভাঙ্গবেও না]
তূর্য অন্তীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়,, অন্তীর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে তুলে ধরে।অন্তীর চোখে চোখ রাখে,,
-অন্তু অনেক তো হলো মান অভিমানের অধ্যায় এবার না হয়…. অন্তী এক ঝটকায় তূর্যর হাতটা সরিয়ে দেয়।
-আমি ডিভোর্স চাই….
-কি???
কথাটা শুনে তূর্য বেশ বড় সড় ধাক্কা খায়,, -আমি সত্যিই চাই মুক্তি চাই তোমার থেকে….
-কথাটা ভেবে বল?
-হু
-ভালো থাকিস
-হ্যা খুব ভালো থাকবো আমি…..
সেদিন তূর্য অন্তীর কথা ওখানেই শেষ হয়ে যায়।তূর্য চলে যায়।অন্তীর মা বোন দাদী কারো ডাকই সেদিন তূর্কে আটকাতে পারে নি।অন্তী অবশ্য তূর্যকে ডাকে নি।একটি বারও ডাকে নি।
অন্তীর ধারনা মানুষটা অনেক আগেই চলে গেছে অনেক দূরে….তার থেকে শত শহশ্র মাইল দূরে……
তাই তাকে ডেকেও লাভ হবে না।
এদিকে তিয়াশ অন্তীকে অনেক বার বুঝানোর চেষ্টা করে…আবার নিজেও বোঝার চেষ্টা করে দুজনের মাঝে ঠিক কি হয়েছে।তবে সব কিছুই তার ধ্যান ধরনার বাহিরে।না অন্তী তূর্যকে নিয়ে কোনো কথা বলছে না কাউকে বলতে দিচ্ছে।এমন কি চূর্যও মৌন ব্রত পালন করছে।
সব মিলিয়ে সব কিছু বেশ জট পাকিয়ে গেছে।
মাঝে কেটে গেছে প্রায় একটা মাস।অন্তী এখন খুব ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে।তাকে ভালো হতে হবে।খুব ভালো।তূর্য ভাইয়ার চেয়েও ভালোকিছু করতে হবে তাকে।মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে তাকে…..
এখন অন্তী যখন নিজের জীবনে ডালপালা মেলাতে ব্যস্ত তখন তূর্য ব্যস্ত নিজেকে গুটিয়ে নিতে।
নতুন চাকুরিতে জয়েন্ট করার পূর্বেই রিজাইন দিয়ে দিয়েছে তূর্য।এদিকে অন্তী নামক পাখিটাকে মুক্ত করারও সমস্ত ব্যবস্থা প্রায় করে ফেলেছে সে।এবার সত্যিই সত্যিই এদেশ থেকে সারা জীবনের জন্য সে নিজের পাঠ চুকিয়ে নিতে চায়।
সব মিলিয়ে দুজনের পথ দুদিকে ছুটে গেছে। বর্তমানে তমশা বেগমের নাজে হাল অবস্থা।এক দিকে যেমন তার বড় বউ তার উপর হুকুম জাড়ি করছে তার উপর এই দুদিনের অতিথি পাখিটাও তাকে কথায় কথায় ঝাড়ছে।
কোনো কিছু একটু উনিশ কুড়ি হলেই জিনিয়া সাথে সাথে তাকে চার পাঁচ টা কড়া কথা শুনিয়ে দেয়। আজকাল প্রভার আচরনও মনের ক্যানভাসে বাধিয়ে রাখার মতো।
তমশা বেগম মনে প্রানে চাইছেন এই অতিথি পাখিটাকে বিদায় করতে তবে এ পাখি যে খালি হাতে যাবার নয় তা তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছেন।
যদি জিনিয়ার যাওয়ার হয় তো তূর্যকে নিয়েই যাবে আর যদি থেকে যাওয়ার হয় তবুও তূর্যর সাথেই থাকবে!!
তূর্য ছাড়া সে আর কিচ্ছু চায় না কউকে চায় না,, তূর্যও আজকাল কোনো কিছুতেই নিজেকে জড়াই না। তমশা বেগম অন্তীকে এই বাড়িতে ফিরিয়ে আনার কথা বললে তূর্য মুখের উপর বলে দেয়,,
অন্তী আর কখনো এই বাড়িতে ফিরবে না।না আমি ওকে এই বাড়িতে নিয়ে আসবো না ও নিজে এই বাড়িতে আসবে।অন্তীর ফিরে আসা নিয়ে এই বাড়িতে আর কোনো কথা হবে না
ব্যাস ছেলের মুখের উপর আর কথা বলতে পারেন নি তিনি।ভেতর ভেতর বেশ আগুন জ্বলছে তমশা বেগমের। তবে তার ধারনা ছিলো অন্তী যদি এসে তূর্যর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেয় তাহলে ছেলের মন অবশ্যই গলবে…ছেলের কানে যে সব চেয়ে বেশি বিষ তিনি নিজেই ঢেলেছেন।তাই এই এখন যা করার তাকেই করতে হবে।
এসব ছাইপাঁশ ভেবে তমসা বেগম অন্তীকে ফোন করে।অন্তীকে এক কথায় জানিয়ে দেয় সে যেন ফিরে আসে। বাড়ির বউকে বাড়িতেই মানায়।
কিন্তু অন্তী ফুপ্পির মুখের উপর জানিয়ে দেয়,,, -ও বাড়িতে সে আর ফিরবে না।
এবার তমশা বেগমের রাগ দেখে কে রাগে ফোনটা আছাড় মারে মাটিতে,, দুদিনের তার সাহস কতো শ্বাশুরির মুখের উপর কথা বলে,,, এতো কিছুর মাঝে কেটে যায় আরো এক সপ্তাহ্
তূর্য অন্তীর ডিভোর্স পেপার রেডি এখন সই করা বাঁকি। তূর্য বিকালে উকিলের কাছে গিয়ে কাগজটা নিয়ে সরাসরি অন্তীর কাছে চলে যায়।অন্তীকে তার মুক্তির চাবি কাঠিটা পৌছে দিতে পারলে তার দায়িত্ব শেষ।
তূর্য প্রায় রাত আটটা নাগাদ অন্তীদের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। কয়েকবার কলিং বাজাতেই অন্তী এসে দরজাটা খুলে দেয়। অন্তী তূর্যকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে।
-তু………তু…মানে আপনি??(অবাক হয়ে)
-হু….
-কিছু বলবেন?
-আমাকে ভেতরে যেতে বলবি না??
-ওওও হু
-দরকার ছিলো
-কাকে?আমাকে??
-না হলে আর কাকে?
-আসলে আপনার আমাকে প্রয়োজন হতে পারে তা আমার কল্পনারও বাহিরে,,
-তাই!
-হু
-বেশ ভালো….
তূর্য ভেতরে ঢুকেই দেখে গোটা বাড়িতে পিনপিনে নিরবতা!বেশ কৌতূহল নিয়েই তূর্য অন্তীকে জিঙ্গেস করে,,
-মামীরা কোই…
-নেই!! সবাই নানু বাড়িতে গেছে….আজ নানুর মিলাদ ছিলো তাও তো ভূলে গেছো!
-তুই যাস নি?
-না আমা পড়া আছে….
-বাড়িতে তুই একা নাকি?
-একা কোই বাবা আছে তো?
-শুধু মামা আর কেউ নেই?
-না
-সবাই তোকে একা রেখে গেলো কি করে!!তুই তো ভীতুর ডিম.
-কি!!
-ঐ সব বাদ দাও কেন এসেছো?
-তোকে মুক্তি দিতে….
-মানে??
অন্তী কথাটা বলতেই তূর্য হাতে রাখা ডিভোর্স পেপারটা অন্তীর দিকে এগিয়ে দেয়।
অন্তী পেপারটাতে চোখ বুলিয়ে আবার তূর্যর দিকে এগিয়ে দেয়।
-কি হলো সই করবি না?
-করবো না কেন এখুনি করছি….পেনটা আনতে দাও অন্তী,,, (কথাটা বলে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই দুম করে ক্যারেন্ট টা চলে যায়।আজ সারা দিনই আকাশটা বেশ মেঘলা ছিলো।তবে সন্ধ্যে থেকে একটু বেশি।খানিকের মধ্যেই বেশ ঝড়ো হাওয়া বইতো শুরু করে।আবার বৃষ্টিও শুরু হয়ে যায়।)
তূর্য পকেট থেকে ফোনটা বার করে অন্তীর সামনে ধরতেই দেখে অন্তী সেখানে দাড়িয়ে ঢকঢক করে কাঁপছে। অন্তীর বরাবরই অন্ধকারে বেশ ভয়।যাকে বলে যা….তা রকমের ভয়।
তূর্য আলোটা জ্বালিয়ে অন্তীর কাছে যেতেই অন্তী তূর্যকে জড়িয়ে ধরে…..
প্রায় এক ঘন্টার মতো দুজনই ড্রইং রুমে মোম জ্বালিয়ে বসে আসে।ক্যারেন্ট আসার নামই নেই।এদিকে বাহিরে ঝড়ের মাত্রা এতো বেড়ে গেছে যে তূর্যর বাড়ি ফিরার মতো জো নেই।
অবশেষে অন্তীই তূর্যকে প্রস্তাব দেয় আজ রাতে এখানে থেকে যাওয়ার জন্য।তূর্যও রাজি হয়ে যায়। অন্তীকে এভাবে একা ফেলে যেতে তারও ইচ্ছে করছে না।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তূর্য বারান্দায় দাড়িয়ে স্মোক করছে আর বৃষ্টি দেখছে।চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাদের অতীতের স্মৃতি গুলো।আজই হতো সব শেষ হয়ে যাবে।
আজ না হয়তো কাল সব কিছু শেষ হয়ে যাবে এতো দিনের ভালো বাসা সংসার সব।
আসলেই কি একটা সই সব শেষ করে দিতে পারে???
হয়তো!!
তূর্য একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পেছন ফিরে একটা লম্বা ধূয়া ছাড়তেই কারো কাশির শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হয়।
অন্তী দাড়িয়ে আছে তার সামনে।পড়নে লাল রঙ্গের একটা শাড়ি!
তূর্য অন্তীকে দেখে একটু অবাক হয়,,, তূর্য প্রশ্ন করার আগেই অন্তী বলে উঠে,,, -তোমাকে না বলেছি আমার সামনে সিগারেট খাবে না!!
-হু
-তাহলে….ইচ্ছে করছে খুব!
-ওওও
-শাড়ি কেন পড়লি?
-এটা ফুপ্পি কিনে দিয়েছিলো একবারও পড়া হয়নি তাই ভাবলাম আজকে পড়ি। দেখো তূর্য ভাইয়া আমাকে ভালো লাগছে???
-তুই একটা কাজ বড্ড ভালো পাড়িস।
-কি কাজ জানিস??
-নাহ্
-আমাকে পোড়াতে…..তুই বড্ড পুড়াস আমায়।বড্ড বেশি! কথাটা বলেই তূর্য অন্তীকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়।অন্তী তূর্যর ঠোট থেকে সিগারেটটা সড়িয়ে তূর্যর ঠোটে নিজের ঠোট মিলিয়ে দেয়……
তূর্য অন্তীকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে……
আমায় একটু ভালোবাসবে তূর্য ভাইয়া??