#তুমিময়_প্রেম❤
#PART_24
#FABIYAH_MOMO
ক্যাম্পাসে যাবো! রেডি হচ্ছি! মুগ্ধ গাড়িতে বসে নিচ থেকে হর্ণ বাজাচ্ছেন! আমি ফাইজাকে বিদায় জানিয়ে তাড়াহুড়ো পায়ে গাড়িতে যেয়ে উঠলাম! মুগ্ধ তার পাশের সিটের দরজাটা খুলে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কখন এসে তার পাশের সিটটায় বসবো! আমি মুগ্ধের ইচ্ছাটা জলে ডুবিয়ে পেছনের সিটে গিয়ে বসলাম! মুগ্ধ বিষ্মিত চোখে আমাকে দেখছে! আমি কোলের ব্যাগটা সিটে রেখে ওর উদ্দেশ্য বললাম,
– সামনে তাকাও! পিছনে কি?
মুগ্ধ অসহায় বাচ্চার মতো মুখটা ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো! মনে আনন্দ লাগছে! কেন লাগছে? ব্যাপারটা বলি, শুনুন! যখন কেউ আপনাকে নিয়ে উচ্চমানের এক্সপেকটেশন রাখে সেটাকে ধুলিসাৎ করতে অন্যরকম শান্তি লাগে! এতে ওই ব্যক্তি কষ্ট পায় আর আপনি পান চরমভাবে শান্তি!
আমার আব্বু আম্মুকে নিয়ে মুগ্ধ যে ফুলপ্রুফ করেছে এখন সেটা আপনাদের বলি! মুগ্ধ আমার পরিবারের কাউকে অবশ্য কিডন্যাপ করেনি। উনারা আমার মামার বাসা মিরপুর-১১তে গিয়েছেন। মামীর ডেলিভারী ছিলো এবং একটা মামাতো বোন হয়েছে আমার। মামা মিরপুরে একা একটা ফ্ল্যাটে থাকেন বিধায় মামীর লেবার পেইনে মামা আব্বু আম্মুকে ওখানে আর্জেন্ট ডাকেন। আব্বু, আম্মু আমাকে একহাজারটা কল হয়তো করেছিলো বাট নবীন বরন অনুষ্ঠানে আমার সাথে যেই হলরুমের ঘটনাটি ঘটেছিলো ফোনটা ওখানেই ফেলে আসি। এরপর মুগ্ধের ট্র্যাপে ফাসি। শেষমেশ যখন আমি বাড়ি ফিরি তখন আব্বু আম্মু ও ছোট ভাই বাসায় ছিলো না। তারা হসপিটালে মামীর কাছে ছিলো। এখনো উনারা ওখানেই আছেন মামীর অবস্থা ভালো না। বেবি নাকি পজিশন বিগড়ে উল্টে আছে। গতকাল রাত সাড়ে তিনটা পযর্ন্ত রাদিফ মুগ্ধের কাছ থেকে সবটা দু’কানে শুনি এবং এটাও জানতে পারি আব্বু আম্মু আজ বিকেলের দিকে আমার খোঁজ নিতে নারায়ণগঞ্জ ফিরবেন। কেন আমি ফোন ধরছিনা, কোথায় গেলাম, গুম হলাম কিনা…সব চেক দিতে আব্বু আসবেন। গাড়ির জানালাটা একটু খুলে বাইরের বাতাসটা মুখে মাখছি। চোখ খুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কারন মুগ্ধ প্রচুর স্পিড দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। এই বান্দা আজীবন তাড়াহুড়োতে থাকে! ‘ধৈর্য্য, সবর, অপেক্ষা’ এই তিনটি জিনিসের সাথে তার সংযোগ নেই। জানালার উপর ডানহাতটা মেলে দিয়ে তাতে থুতনি বসিয়ে ভাবছি। মুগ্ধ খুব চালাক পার্সোনালিটির। মাথায় এতো বুদ্ধি গিজগিজ করে আগে জানতাম না। ওকে সবাই কেনো এতো মান্য করে এখন বুঝলাম। তুড়ি বাজাতেই যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে এই চতুর বান্দা।
মুগ্ধ গাড়িটা রাস্তার মোড়ে থামালো। আমি হাত থেকে থুতনি উঠিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসতেই মনে কিছু প্রশ্নের দাগ কাটলো। প্রথম প্রশ্ন, ও গাড়িটা এখানে কেনো থামালো? দ্বিতীয়, আজ এতো চুপচাপ? সর্বশেষ, আবার কোনো নতুন প্ল্যান করছে? কিছুক্ষন গাড়িতে নিরবতা চললো! মুগ্ধ মাথাটা আমার দিকে না ঘুরিয়ে বাঁ কাধ বরাবর করলো।
— গাড়ি থেকে নামো!
ভ্রুকুচকে এলো আমার!
— গাড়ি থেকে নামবো মানে? রাস্তার মোড় কি তোমার কাছে ক্যাম্পাসের গেট লাগছে? এটা ক্যাম্পাস!!
— ক্যাম্পাসের গেট পযর্ন্ত হেঁটে যাও। আমি তোমাকে নিজের গাড়ি করে ক্যাম্পাসে যেতে পারবো না। ভালো হবে তুমি এখানেই নামো।
— আশ্চর্য কিসিমের লোক তো! তন্ময় আমাকে ওর গাড়িতে করে ক্যাম্পাসের ভেতর পযর্ন্ত নিয়ে গেছে! আর তুমি এখানে নাটক করছো?
— তন্ময় তো আর স্বামী না।
তন্ময় আমার স্বামী না মানে? কি বুঝালো? ও স্বামী দেখে আমাকে গাড়ি থেকে রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিবে?শান্তমুখে কথাটা বলে সিটবেল্ট খুলে বাইরে গেল মুগ্ধ। পিছনে এসে আমার সিটের কাছে দরজা খুলে বেরুতে আজ্ঞা করলো। আমি হতভম্বের মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছি! ‘বের হও মম, কেউ দেখলে সিনক্রিয়েট হবে ‘ – কথাটা কানে পৌছাতেই মস্তিষ্ক বাইরে যাওয়ার জন্য আগে পা বাড়াতে সংকেত দিলো। আমি বের হতেই মুগ্ধ দরজা লাগিয়ে ওর ড্রাইভিং সিটে যেয়ে বসলো। সিটবেল্ট লাগাতেই আমার হকচকিত মুখের পানে কথার ঝুড়ি ফেলে বললো,
— চিন্তা করো না ক্যাম্পাসে তোমার হাসবেন্ড বলে পরিচয় দিবো না। আমার বাসা থেকে তোমার আমার যাত্রা এটুকুই থাকবে। সামনে আগানোর চেষ্টা করবো না। ক্লাস শেষে তুমি বাসায় যেতে পারো। ফাইজা ভাইয়ার কাছে যাবে। কিছুদিন ওখানেই থাকবে। ও আসলে পরে জানাবো। টেক কেয়ার।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো। এখনো গাড়িটার যাওয়ার দিকে দৃষ্টি স্থির করে আছি। ব্যাগটার বাদামী ফিতা আকড়ে হাটা দিয়েছি আমি। কবজি ঘুরিয়ে হাতঘড়িতে সময়টা দেখলাম। আরো পচিঁশ মিনিট সময় আছে ক্লাস শুরু হতে। যেতে লাগবৌ দশমিনিট। মুগ্ধের আচরণে খারাপ লাগছেনা। বরঞ্চ ওর বুদ্ধি দেখে সাব্বাশি দেওয়া লাগে! আসলেই ঠিক করেছে। আমাদের সমাজের মানুষ কতো গুণধর তা সবাই জানে। ক্যাম্পাসের ভেতরে শতশত শিক্ষার্থীর সামনে ওয়েল সোসাইটির মুগ্ধ সাহেবের গাড়ি থেকে নামলে সবাই নানারকম ধারনা করতো সিউর! ইতিবাচক ধারনার চাইতে নেতিবাচক ধারনাটা প্রাধান্য পেতো বেশি! সেদিন তন্ময়ের গাড়ি থেকে কি নেমেছি!! তাতেই মানুষ বলে ফেলেছে ‘আমি তন্ময়ের গার্লফ্রেন্ড নাকি?’ আজ মুগ্ধের গাড়ি থেকে নামলে নির্ঘাত স্ট্যাপ লাগতো ‘বারোভাতারী’! মুগ্ধ আসলেই একটা জিনিয়াস পাবলিক! মারাত্মক জিনিয়াস!
তিনটা লেকচার পরপর এটেন্ড করলাম। এখন গা গুলিয়ে বিরক্ত লাগছে। কলেজে উঠার পর থেকে আগের মতো টানা ক্লাস করার ইচ্ছাশক্তি নেই বলতে গেলে। এখন মনেহয় বড় হয়ে গেছি। ওসব লাগাতার ক্লাস বাচ্চারা করে।কারন, ভার্সিটি মানেই ক্লাস ড্রপ এবং পরীক্ষার রাতে পড়া এবং ফুলটাইম আনলিমিটেড আড্ডা দেওয়া! বই খাতা নিয়ে কাধে ব্যাগের ফিতাটা ঝুলিয়ে নজরুল চত্বরে গিয়ে বসলাম। চত্বরটা আজ ফাকা ফাকা। সবাই মাঠের আনাচে-কানাচে গোল হয়ে বসেছে। একটু দূরে শহীদ মিনারের সিড়িতে জেনি, রিমি, তন্ময়, নাসিফ ও মুগ্ধ বসে আড্ডা দিচ্ছে। সবার মন ফুরফুরে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত রামিমের অবস্থা এখন ভালো। আমি নোটখাতায় আজকের ইর্ম্পট্যান্ট টপিক টুকে লিখছি। জগতের সমগ্র জিনিস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গভীর নিমগ্নে কলম চালাচ্ছি।
— ‘বেবি কি লিখছিস?’
চোখ তুলে প্রশ্নকারীর দিকে তাকালাম। দেখি ইসরাত আর অর্পিতা দাড়িয়ে। অর্পিতা হাসিমুখে আমার বামপাশে বসলো এবং ইসু বসলো বসলো ডানপাশে। জবাব না দিয়ে আমি খাতায় কলম ঘুরাচ্ছি। অর্পিতা খচখচ শব্দ করে কিছু একটা ছিড়তেই বলে উঠলো,
— মম কি লিখছিস? নোট নাকি? আচ্ছা ক্লাসে তোর কি হয়েছিলো বলতো? তুই আলাদা হয়ে পিছনে বসলি কেনো?
ইসুও অর্পিতার সাথে যোগ দিয়ে বললো,
— তোর আজ কি হয়েছে রে? একা বসলি! একা ক্লাস করলি! এখন এখানেও একা আছিস! কি হয়েছে খোলাখুলি বলবি?
আমি বিরস মুখে বলে উঠলাম,
— প্লিজ ডিস্টার্ব করিস না। কাজ করছি। পারলে তোরা এখান থেকে যা।
অর্পিতা চোখে কাঠিন্য ভাব এনে ছোঁ মেরে হাত থেকে খাতাটা নিয়ে নিলো। আমি বিরক্ত মুখে চেতে উঠি!
— উফ অর্পিতা! আমার পড়াশোনা দেখে তোদের ভালো লাগছেনা!
— না ভালো লাগছেনা! তোর লোক দেখানো পড়াশোনা অন্যের সামনে দেখাবি। আমার সামনে না! তুই যদি কি হয়েছে না বলিস এক্ষুনি তোর খাতাটা কুটিকুটি করে ফেলবো!
— তুই আমাকে শান্তি দিবি? বল শান্তি দিবি?
— চড় দিবো!তুই শেয়ার না করা পযর্ন্ত তোর পিছু ছাড়বোনা বুঝছিস! এখন পটাপট উগলে দে কি হয়েছে!
ইসু পাশ থেকে অনুযোগের সুরে বলে উঠলো,
— তুই আমার বেস্টু! তুই কথা শেয়ার না করলে আমার ভালো লাগবে?
হঠাৎ মস্তিষ্কের রিনরিন শব্দটা বেজে উঠলো! মুগ্ধ বলেছিলো, আমার ব্যাপারে যতপ্রকার কুটনামি সব এই ইসু করেছিলো! পুরো ক্যাম্পাসে আমার নামে মুখরোচক দুর্নাম গেয়েছে!তবে মুগ্ধ ও আমার বিয়ের কথাটা কি শেয়ার করা ঠিক হবে? মন বলছে ‘না’! করা ঠিক হবেনা! অর্পিতা আমার হাতটা ধরে বলে উঠলো,
— কথাগুলো বলে মনটা হালকা কর মেয়ে। এভাবে চুপ করে থাকলে মন ভারী হয়ে কান্না বসে যাবে।
অর্পিতাকে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ হিসেবে মস্তিষ্ক সাইরেন দিচ্ছে। কিন্তু ইসুকে নিয়ে নাহ্। কাজেই বুদ্ধি করে ইসুকে দূরে পাঠিয়ে তবেই অর্পিতাকে সব কথা বলা যাবে। নাহলে সত্যি দমবন্ধ হয়ে আমি মারা যাবো! ইসুকে ক্যান্টিন থেকে নুডলস আনতে পাঠিয়ে দিলাম। ওর আসতে কমপক্ষে বিশ মিনিট লাগবে! ততক্ষণে আমি অর্পিতাকে হাসঁফাসঁ করতে করতে সব বলে দিলাম। অর্পিতা চোয়াল ধুলিয়ে দূরে ছিটকে গিয়ে বসলো। চোখেমুখে ব্যাপক আশ্চর্যের ঝলক! অর্পিতা কাপাঁ কাপাঁ হাতে ব্যাগের চেইন খুলে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে। বেশিরভাগ পানি ওর জামার উপর পড়লো। আমি ঝাট দিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট পানি ফেলতেই অর্পিতা বোতলটা না লাগিয়ে পাশে পাটাতনের উপর রাখলো।
— অর্পি তোকে কথাগুলো বললাম প্লিজ আর কাউকে বলিস না। ইভেন ইসুকেও না। তোকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে তাই আগেভাগে না ভেবে বলে দিলাম।
অর্পি চুপ করে আছে। কিছুটা শান্তবোধ হলে আমার দিকে সম্পূর্ণ তাকিয়ে বলে উঠলো,
— তোর বিয়ের খবর শুনে আমার আত্মা কাপছিলো জানিস? থাক গে, ওগুলা মাথা বাদ। কথা শোন আমার! মন দিয়ে চুপচাপ শুনবি! একদম চুপ করে শুনবি! ওকে?
— হু।
— মুগ্ধ ভাই তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। এন্ড নাও, তুই না চাইলেও উনার ওয়াইফ! আবার তুই বললি উনার ফ্যামিলি কেউ নাই। উনি একা একটা ফ্ল্যাটের মধ্যে থাকেন। তুই জানিস একা থাকাটা কত কষ্টকর? আমি জানি! বাবা – মা কেউ নাইতো মুগ্ধ ভাইয়ার অবস্থাটা বুঝি। আর একটু আগে বললি না?মুগ্ধ ভাই তোকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিছে? ক্যাম্পাসে তোকে সাথে আনেনি! তুই যে আজাইরা মার্কা শর্ত দিছোস না? ওইটার জন্য বেচারা এমন করছে! উনার কি দোষ দিবি তুই? তুই তো নিজেই একটা দোষী!
— তুই আমাকে লেকচার দেয়ার জন্য চুপ থাকতে বলছিস?
— জীবনেও না। এগুলা তোর কাছে লেকচার লাগে? আমি অর্পিতা যা যা বলি সব সত্য! একটাও মাটিতে ফালানোর মতো কথা না! আরেকটা কথা ‘ইসু ইসু’ করে যে জানটা দিয়ে দেস না? সাবধানে থাকিস। এই মেয়ে বড়মাপের চালবাজ! তোর এই কথা শুনলে ইজ্জত কিভাবে হালুয়া করে টের পাবি।
— জানিস?সবাই বলে ইসু দুমুখো! বাট আদৌ আমি ধরতে পারলামনা।
— তুই তন্ময়ের গফ! কথাটা কিন্তু ইসুই ছড়াইছে! মুগ্ধ ভাই পরে সব কথা কিভাবে ঠিক করছে কে জানে? মুগ্ধ ভাইকে ভুলেও হাতছাড়া করিস না! পস্তাতে পস্তাতে মরে যাবি!
— অর্পি, আমি ওকে পছন্দ করিনা। যেখানে পছন্দ শব্দই আসেনা সেখানে আবার ভালোবাসা কিসের? ভালোবাসা কি পুতুলনাচ? যে দেখলে মজা পেলে ভালোবাসা হয়ে যাবে?
— মনের অনুভূতি বলার জন্য মুখের শব্দ লাগেনা বোকা। একটা মেয়ের চোখেই সব স্পষ্টভাবে লেখা থাকে। যে পড়তে পারে সে মোক্ষমভাবে ভালোবাসতেও জানে! লিমিট ক্রস করে পাগলামি করে! আমি ওই পাগলামি মিন করিনাই! যেটা এই যুগের বফ,গফ হাত পা কেটে প্রমাণ করে! ওইটা বালপাকনা ছ্যাঁচড়ামি ছাড়া কিছুই না! মুগ্ধ ভাইকে ডাক দে, তোকে এখনই হাতেনাতে প্রমাণ দেই!
— কিহ্! দলবল নিয়ে বসে আছে আর আমি এখান থেকে ডাক দিবো?অসম্ভব!
— তুই না দিলে আমি দেই। মুগ্ধ ভাই? এইযে ভাইয়া? হ্যাঁ আমি ডাকছি। একটু আসবেন এখানে? একটু? দরকার আছে তো…
ডাক দিলো মুগ্ধকে! কিন্তু সঙ্গে আসলো তন্ময়,নাসিফ! মুগ্ধ অর্পিতার ডাকে আমাদের সামনে এসে দাড়ালো। লম্বাটে হাইট, কালো কুচকুচে শার্ট, অফ হোয়াইটের গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, হাতাটা মোটা করে গোটানো, ছিমছাম দেহের আর্কষনীয় মুখটা নিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। অর্পিতা কনুই মেরে আমাকে তাকাতে বললো! আমি দুলিয়ে আকাশ দেখছি। বাপাশ থেকে লাগাতার কনুইয়ের গুতায় ঝাঝড়া হয়ে যাচ্ছে। উঠে একটা থাপ্পরও দিতে পারছিনা!
— ভাইয়া মাইন্ড করবেন না। আমি আপনার বোনের মতো। আপনাকে একটা কোয়েশ্চ্যান দিবো প্লিজ সল্ভ করে দিবেন? শুনেছি আপনার ব্রেন খুব চালু! প্লিজ ভাইয়া না করবেন না। ছোট্টবোনের অনুরোধ..
মুগ্ধ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক বোঝালো। তন্ময় নাসিফের ব্যাপারটা ঘাপলা লাগছে। তাই তারা চোখাচোখি করে বিনা শব্দে কথা বলছে। অর্পিতা আমার খাতা থেকে একটা পেজ ছিড়ে কলম নিয়ে কিছু একটা লিখলো এবং কাগজটা মুগ্ধের দিকে বাড়িয়ে দিতেই মুগ্ধ নিয়ে দেখতে লাগলো। তন্ময় ও নাসিফ দেখল, কাগজে সাংকেতিক ভাষায় কিছু লেখা,
‘m mmmm mmm mmmm’
মুগ্ধ লোয়ার লিপটা আলতো করে দাঁতে চেপে ভাবছে। মম আড়চোখে তিনজনের অবস্থা দেখে মনেই মন হাসলো! কারন, তারা এসব পারবেনা! মুগ্ধ তো আরো আগে না যতই সে বুদ্ধিমান হোক! নাসিফ কাগজটায় চোখ বুলিয়ে কপাল কুচকে আছে। তন্ময় কাগজটার একটা কোণা ধরে বিষ্ময়সূচকে বললো,
— দোস্ত ধরতে পারছিস কেউ? এটা কিসের ইকুয়েশন? ম্যাথ না ফিজিক্সের?
অর্পিতা হালকা কেশে বললো,
— ভাইয়া এটা নরমাল প্রবলেম। যাদের আইকিউ(IQ) ভালো তারা পারবে। যাদের নেই তারা কলম কামড়াবে।
— এই মেয়ে! কাদের গাধা বলছো! র্যাগ দিবো নাকি!
— ভাইয়া..
মুগ্ধ অর্পিতাকে থামিয়ে বলে উঠলো,
— আহ্ তন্ময়। পারছিস না চুপ থাক! থ্রেট কেন দিচ্ছিস!
— সরি ডুড।
ঠিক দুই মিনিট পেরুতেই মুগ্ধ বললো গলা ঝেড়ে বললো,
— তন্ময়? নাসিফ? চল! জুনিয়রদের কাহিনি নিয়ে মাথা নষ্ট করার সময় নেই। নিজেরা বুঝেনা ! আমাদের দিয়ে করায়!
তন্ময় নাসিফ মুখ গম্ভীর করে চলে যেতে লাগলো। অর্পিতা হাতে হাত ডলে উশখুশ করছে! ওদের না-ও করতে পারছেনা! আবার আটকাতেও পারছেনা! মুগ্ধ কাগজটা দুই ভাজঁ করে অর্পিতার হাত টেনে হাতে ধরিয়ে দিতেই স্বর খাদে ঢেলে স্পষ্ট বাক্যে বললো!
— ওয়ান ‘এম’, ডাবল ‘এম’ ডাবল ‘এম’, ট্রিপ্যাল ‘এম’, ডাবল ‘এম’ ডাবল ‘এম’… ইকুয়েল টু(=) ‘আই লাভ ইউ মম’ ! গিভ দিস টু ইউর ফ্রেন্ড, এন্ড স্যা টু হার, সাম লাভ ওয়ার্ডস ফ্রম রাদিফ মুগ্ধ!
বাকাঁ হাসি উপহার দিয়ে প্রস্থান করলো মুগ্ধ! আমার ও অর্পিতার দুজনের অবস্থা পুরোপুরি জবানবন্দ!
.
.
বাসায় ফিরলাম! একগাদা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আব্বুকে শান্ত ভাবে ট্যাকেল করেছি। আব্বু আজ বাসায় থেকে কাল সকালে আবার রওনা দিবেন আম্মুকে আনতে। আজ আম্মু আসেনি, কাল আসবে। রাতের খাবার হিসেবে গরম ও ডিম ভাজা ছাড়া উপায় নেই। ঘরে বাজার নেই! আবার রাত করে বাজার খোলাও থাকেনা। পেয়াঁজ, মরিচ কাটছি। ডিম কাপে নিয়ে চামচ দিয়ে ফেটছি। দ্রুত হাত চালাতেই দরজায় বেল পড়লো! ঘড়ির দিকে দেখলাম! সাড়ে দশটা! এই রাতে কে আসলো?
— আব্বু? আব্বু শুনছো? দরজাটা একটু খুলে দেখো তো কে এসেছে।।
খট করে কিছু খুলার শব্দ পেলাম। আব্বু বাথরুমের দরজা ধরে উকি দিয়ে বলছেন,
— আমি বাথরুমে। তুমি দরজাটা খুলে দেখো!
ডিমের কাপ চুলার কাছে রেখে দরজা খুলতে গেলাম। দারোয়ান একটা সাদা ব্যাগ এগিয়ে বলছেন পার্সেলটা নাকি আমার নামে এসেছে! আমি কিছুটা অবাক। দরজা লাগিয়ে পার্সেল নিয়ে টেবিলের উপর রাখতেই আব্বু বাথরুম থেকে গলা উচিয়ে বললো,
— মম? কে এসেছে?
আমি পার্সেল খুলতে খুলতে বললাম, ‘পার্সেল দিছে আব্বু!’ ব্যাগটা খুলে দেখি খাবারের ঘ্রাণ আসছে। স্ট্যাপলার দেয়া কাগজের ব্যাগটা ছিড়ে দেখি দুটো সাদা প্যাকেট! ভুরভুর করে বিরিয়ানীর গন্ধ আসছে। প্যাকেটে সত্যি সত্যি বিরিয়ানী! একদফা চমকে আছি! এটা নিশ্চয়ই মুগ্ধের কাজ! ও ছাড়া কেউ এই আকাম করতে যাবেনা! দৌড়ে রুমে গিয়ে ওকে কল করছি! আজ মনের মাধুরী মিশিয়ে একচোট খারাপ ভাষায় গালি দিবোই! ফোন বাজতেই ও রিসিভ!
— হ্যালো,
— ভাই একটা কথা বলবা? ছেলেদের লজ্জা শরম কি কম থাকে? এইযে জঘন্য ভাষায় অপমান করি! গায়ে কি ছিটেফোঁটাও লাগেনা?
— আরে! আমি করেছিটা কি? আমাকে ভাই বলছো কেনো? এটা কোন ধরনের অসভ্যতা?
— অসভ্যতার এখনো করিনি! তাই ভালো করে জিজ্ঞেস করছি! খাবার পাঠাতে বলছিলো কে? আমি?
— খাবার? আমাকে পাগল কুকুর কামড়ায় না বুঝছো! আমি তোমার বাসায় খাবার পাঠাইনি।
— তাহলে কে পাঠাইছে? কে জানছে আমার বাসার অবস্থা?
— তা আমি কি করে বলবো?
— তুমি পাঠাওনি?
— না,
— সিউর!
— ফাইজার কসম!
ফোন কেটে দিলাম। অনবরত ভাবছি কে কাজটা করলো? খাবারের কথা মুগ্ধ ছাড়া কে জানবে? উহু, বিষয়টা সোজা ঠেকছেনা! মোটেও সোজা ঠেকছে না! খাওয়া পর্ব শেষে রুমে এসে রামিমের খোঁজ নিতে জেনিকে কল দিলাম। যদিও জেনিকে আমার সহ্য না! জেনি কলটা ধরে বলে উঠলো,
— তুমি আমার ফোনে কল দিয়েছে কেনো!
— তোর ফোন কি গ্রিনিজের মাল? ফোন দেওয়া যাবেনা?
— মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ!
— আমি বাংলাতেই কথা বলছি! তুইও ইংলিশ ভাষা সাইড পকেটে ঢুকা! আর বল রামিম কেমন আছে? জ্ঞান ফিরেছে?
— সেটা তোমাকে কোন শখে বলতে যাবো!
— আহহা! তুই আমাকে শখের ডেফিনেশন না দিয়ে রামিমের খবর বল! এক্সট্রা কথা বলবি আরেক কল সোজা মুগ্ধের ফোনে বাজবে!
— রামিম সুস্থ আছে। জ্ঞান ফিরেছে।
— গুড! এরপর বল ওর উপর এ্যাটাক কে করেছে জানা গেছে?
— না। তন্ময় ও নাসিফ বলেছে ব্যাপারটা ওরা দেখবে।
— কেনো? মুগ্ধ জানে?
— কেউ জানিনা। মুগ্ধকে বলবো ভেবেছি ও আমাদের কারোর সাথে কেনো জানি কথাই বলছেনা।
— আচ্ছা। এখন কোথায় তুই?
— রামিমের কেবিনে।
— ও কি ঘুমে?
— না।
— একটা কাজ কর। ফোনটা ওর পাশে রেখে কেবিন থেকে বাইরে যা।
— হোয়াট?
— যা বলছি তাই কর! কথা না শুনলে..
— যাচ্ছি..
‘রামিম মম তোর সাথে কথা বলবে! তুই পারবি?’
‘হ্যাঁ জেনি পারবো’
উপরোক্ত দুইটি বাক্য শেষে কিছুক্ষণ সময় পেরুলো। রামিম ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো,
— হহ্যালো..
— রামিম? কেমন আছো? কি অবস্থা? শরীর কি এখনো প্রচুর খারাপ?
— ননা ভাবি..
— আমি তোমার ভাবি না রামিম।
— আআপনার সসাথে বসের বিয়ে হইছে ভভাবি। আমি সসব জজানি।
— কিভাবে? কি করে?
— ভভাবি ওওসব কথা বাদদ দদেন, আপনি আআমার ককথা শুনেন.. তন্ময় খুখুব খখারাপ..আপনি এএকা থাককবেন না..ওওরা গুরুততর প্ল্যানন বানাইছে ভভাবি, ওওরা জানে বিয়ের বব্যাপারে..
এটুকু বলেই খুকখুক করে কাশতে শুরু করলো রামিম। কাশতে কাশতে দম বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা! মম বিচলিত হয়ে ফোনের মধ্যেই চেচাতে লাগলো,
— রামিম! তুই ঠিক আছো! রামিম? রামিম জবাব দাও! তুমি অসম্পূর্ণ কথা বলতে পারো না! সব বলো প্লিজ!
কাশতে কাশতে রামিম গলা পরিস্কার করে প্রতিটা শব্দ থেমে থেমে বললো,
— আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়…এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়…আপনাকে শেষ কইরা বসকে হাত করার নীনীল নকশা ককরছে..
#তুমিময়_প্রেম❤
#PART_25
#FABIYAH_MOMO
১.
মুগ্ধের বাসায় যাবো! ওর পেয়ারা বন্ধু তন্ময়ের ইতিহাস বলতে! আব্বুকে বিদায় করে কোনোরকমে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে! উদ্দেশ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুগ্ধের বাসায় পৌছানো এবং সবটা খুলে ওকে জানানো। মুগ্ধের বাসায় যেতেই দারোয়ান আমার হাতে একগুচ্ছ চাবি ধরিয়ে দিল এবং বলল, এগুলো বাসার এক্সট্রা চাবি, যা মুগ্ধ কেবল আমার জন্য বরাদ্দ রেখেছে। আমি চাবি হাতে দ্রুতপায়ে একেবারে থামলাম মুগ্ধের রুমের কাঠালি দরজার কাছে। দরজা ভেতর থেকে লাগানো। মুগ্ধ এখনো ঘুমাচ্ছে। চাবি গুচ্ছা থেকে বেছে বেছে একটা চাবি নিয়ে নবে ঢুকিয়ে দিলাম মোচড়! ব্যস! দরজা খুলেছে! আমি টুপ করে ঢুকে পড়ি। দরজাটাও চাপিয়ে দেই। চোখের সামনে বিশাল মাঠের মতো মস্ত এক বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে মুগ্ধ। পা থেকে মাথা পযর্ন্ত কম্বল দিয়ে ঢাকা। আমি আস্তে করে কাধের ব্যাগটা রেখে ওর মাথার কাছে বসি। সাদা নরম তুলতুলে কম্বলটা ধীরগতিতে সরিয়ে দেই। মুগ্ধের চোখে সকালের মিষ্টি আমেজের রোদটা যেয়ে পড়লো। এতে মুগ্ধ নড়েচড়ে ঘুমে ঢুলু চোখে উঠে বসলো। শরীর টানা দেওয়ার জন্য কম্বলটা গা থেকে সরতেই আমি এক চিৎকার দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলি! মুগ্ধ চোখ কচলে আমার উদ্দেশ্যে বললো,
— ভূত দেখছো? চিৎকার দিলে কেনো?
আমি থতমত গলায় তোতলাতে তোতলাতে বলি,
— তু তুমি উ উদাম!
— উদাম কি শব্দ?
আমি দুইহাতে মুখ ঢেকেই বেড থেকে দাড়িয়ে পড়ি! বিচলিত গলায় বলে উঠি,
— আরে তোমার গায়ে কিছুই নেই! তুমি খালি গায়ে!
আমার কথা শুনে মুগ্ধ নিজের দিকে তাকালো। রাতে ওর খালি গায়ে ঘুমানোর স্বভাব। শুধু একটা ট্রাওজার পড়ে ঘুমায়। মুগ্ধ কম্বল দিয়ে গা ঢেকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
— লজ্জার কি আছে পাগল? তোমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে এতোক্ষনে কতোওও আদর করতো। ডিপলি একটা মনিং কিস দিতো মাস্ট!
— ছি! বাসি মুখে কিস! বমি করে দিবো!
— তাহলে ব্রাশ করি! একটা কিস দাও!
— আগে তুমি গা ঢাকো! নাহলে আমি এক্ষুনি চলে যাবো!
মুগ্ধ বিরক্ত গলায় বললো,
— চোখ খুলুন ম্যাডাম! আমি আপনাকে নিজের গা দেখিয়ে পাগল বানাতে চাইনা। এসব বাজে স্বভাব থাকলে অলেরেডি মুগ্ধের ক্যারেক্টারলেসের সার্টিফিকেট থাকতো।
আমি অতি আস্তে আস্তে মুখ থেকে হাত সরিয়ে ফেলি। ওর চোখ এখনো বন্ধ করা। পুরো বাচ্চা বাচ্চা লাগছে ওকে! এলোমেলো চুলগুলো কপাল ঢেকে দিয়েছে। আমি পাশে যেয়ে বসতেই মুগ্ধ বাচ্চার মতো ঠোট উল্টে বললো,
— আমি কিন্তু উদাম টুদাম না। ট্রাউজার পড়ে আছি। বাট তুমি আমাকে নিয়ে কি কি অশ্লীল চিন্তাভাবনা করেছো হু নৌস? একটা কাজ করো প্লিজ। আলমারি থেকে টিশার্ট এনে দাও। আর হুট করে এতো সকালে তুমি এখানে? কোনো প্রবলেম?
আমি আলমারি থেকে টিশার্ট নিতেই বলে উঠলাম,
— আমি কালরাতে আসতে চেয়েছিলাম। তোমার ফোন ট্রায় করেছি বন্ধ ছিলো। না পারতে সকালের বাস ধরে চলে এসেছি। এই নাও টিশার্ট..
মুগ্ধ টিশার্টটা হাতে নিয়ে বললো,
— সিট! ফোনটা চার্জে ঢুকাতে ভুলে গেছি। আমি টিশার্ট পড়বো তুমি অন্যদিকে তাকাবে? চাইলে আমাকে দেখতে পারো। আই হেভ নো প্রবলেম।
কথা শেষ করে মুগ্ধ মিচকে একটা হাসি দিলো। আমি সাথেসাথে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলা শুরু করলাম,
— তোমার কল কাটার পর জেনিকে কল করেছিলাম। রামিমের খোঁজখবর নিতে। রামিমের সাথে কথাও হয়েছে..
মুগ্ধ টিশার্টের গলা দিয়ে মাথা ঢুকাতেই বিষ্মিত কন্ঠে বললো,
— কি বললে? রামিমের সাথে কথা বলেছো! হাও ইজ দিস পসিবল!
— প্লিজ আমি কথা শেষ করি। তারপর বলো।
— সরি! ডান পাকনি এখন তাকাতে পারো।
আমি মুখ ঘুরিয়ে মুগ্ধের দিকে ফিরলাম।
— একটা প্রমিস করবে?
— ইয়েস প্রমিস। বলো।
— রামিমের এক্সিডেন্টটা তন্ময় করেছে মুগ্ধ! তন্ময় একটা শয়তান! তলে তল তোমাকেও মারার জন্য প্ল্যান করেছে! আরেকটা কথা! আমাদের বিয়ের ব্যাপারে ও সবটা জানে! তুমিই বলো যেখানে তোমার বাসার চাকররা এই বিয়ে সম্বন্ধে কিছু জানেনা সেখানে তন্ময় জানলো কি করে? আমার মাথা আওলা হয়ে আছে মুগ্ধ! আমি কোনোকিচ্ছু ভাবতে পারছিনা!
মুগ্ধ কপালের চিন্তার ভাঁজ পড়লো। এই মূহুর্তে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে মুগ্ধকে। কিছুক্ষণ চুপটি থেকে কৌতুহল গলায় বললো,
— কথাগুলো রামিম বলেছে? বিয়ের ম্যাটার ও জানে?
আমি মাথা উপর-নিচ নাড়লাম! যার অর্থ ”হ্যাঁ”!
— মামলা সিরিয়াস! ওয়েট! মুখটা ধুয়ে আসি!
মুগ্ধ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
— পাকনি আই ডোন্ট নো! বাট আমার হেভি ডাউট হচ্ছে তন্ময়ের উপর! তন্ময়ের মতো মিথ্যুক আমি সেকেন্ড একটা দেখিনি! ওর মাথায় কত খারাপ কনসাইন্স থাকতে পারে জাস্ট আই নো!
মুগ্ধ আলমারি থেকে শার্ট, প্যান্ট, ঘড়ি বের করে রেডি হচ্ছে! আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি! ওর টিশার্ট ছাড়া গা আরেকবার দেখলে সিরিয়াসলি আমি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবো! এমনেই চোখের সামনে একটু আগের দৃশ্য ভাসছে! চোখবন্ধ করলেও একই অবস্থা দেখছি! ওমন ইয়াং একটা ছেলের শরীর দেখতে মেয়েদের চমৎকার লাগলেও আমার জাস্ট একপলক দেখতেই শ্বাস ভারী হয়ে আসছে! নো নেভার তাকানো যাবেনা!
২.
ভার্সিটির প্রাঙ্গণে পা রাখতেই আমার চোখ ছানাবড়া! সবাই দৌড়াচ্ছে কেনো? কিছু হয়েছে? সবাই দেখি একদিকে পালাচ্ছে! আমার হৃৎ গতি হঠাৎ বেড়ে যেতে লাগলো! সবার চোখমুখে আলাদা রকমের ভয় দেখছি! রহস্যজনক ভয়! মুগ্ধ কোথায়? ওকে যে দেখছিনা! আমাকে এখানেই থাকতে বলে মুগ্ধ গাড়ি করে ঢুকেছিলো।আমি কাউকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করবো, কেউই আমার ডাকে শুনছেনা! পায়ের দৌড়াদৌড়িতে বাতাসের ধূলো উড়ছে! অনুভব করলাম কলিজাটা ধুকপুক করছে! দূর থেকে একটা ডাক শুনতে পেলাম! কেউ আমার ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে! আমি উৎসটার খোঁজে এদিক ওদিক দেখতেই মাঠের শেষপ্রান্তটার হলরুমের ওখানে অর্পিতা দাড়িয়ে! দুহাত দিয়ে ঠোটের চারপাশ ঘিরে বেগতিক হারে চিল্লাচ্ছে! আমি দৌড়ে হাফাতে হাফাতে অর্পিতার কাধ ধরে থামলাম। অর্পিতা কান্নার সুরে অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
— গন্ডগোল হয়ে গেছে দোস্ত! গন্ডগোল হয়ে গেছে! তন্ময়, নাসিফ, আহাদ মিলে মুগ্ধ ভাইকে পিটাচ্ছে! অনেক ফোন করেছি তুই ধরিসনি!! একনাগাড়ে দশমিনিট ধরে মারছে!! ভাইকে বাঁচা প্লিজ! কুত্তাগুলা মেরে ফেলবে ওকে!!
আমার আত্মাটা যেনো সাথে নেই কথাটা শুনার পর! আপনাআপনি অর্পিতার কাধ থেকে পড়ে গেলো হাতটা। বুকের মধ্যে ধুপধুপ করে হাতুড়ি চালাচ্ছে কেউ! কানেও যেনো শব্দটা বিধছে খুব! বহু কষ্টে ঢোক গিলে অর্পিকে প্রশ্ন করলাম,
— উউনি ককোথায়?
অর্পি কান্না করে বলে উঠলো,
— হহলরুমে
শরীরের শেষটুকু শক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছি! এই দৌড়টা জীবনের শেষ দৌড় এমন নীতিনিষ্ঠে দৌড়াচ্ছি! বুকটা ফেটে ছিন্নভিন্ন লাগছে প্রচুর! এই বুঝি ওরা উনাকে মেরে ফেললো! হলরুমের দরজায় কি ভীড়! ভেতরে যাওয়া মুশকিল! নাহ!! এভাবে হাতে হাত রেখে তামাশা দেখার সময় নেই!ওরা মুগ্ধকে মেরেই ফেলবে! জামার হাতায় চোখ ডলে হলরুমের উল্টোদিকে যাচ্ছি! ওখানে একটা জানালা সর্বদা খোলা থাকে! জানালার নিকটস্থ হতেই নাসিফের হো হো হাসির গলা শোনা যাচ্ছে। আমি জানালা টপকে ভেতরে ঢুকতেই গায়ের সবগুলো পশম কাটাঁ দিয়ে উঠলো! হিরহির করে আলোর গতিতে রক্ত সন্ঞ্চালন বৃদ্ধি পাচ্ছে! আমার পুরো শরীর কাবু হারিয়ে ফেলেছে! মুগ্ধের মাখন রঙের শার্টটা রক্তে লালটম্বুর!হলরুমের ময়লা ফ্লোরে কালো প্যান্টটা ধূসরবর্ণে মাখামাখি। দুইহাত মাথার দুইদিকে মেলে উপুড় হয়ে কাশছে মুগ্ধ! কাশির সাথে মুখ থেকে লালরক্ত বেরুচ্ছে! তন্ময় লাগামহীন পিটিয়ে হাফিয়ে উঠেছে বিধায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছে!
সকালেই না মানুষটাকে হাসিখুশি সুস্থ দেখলাম? লজ্জামিশ্রিত ভাবনায় উনাকে মনের কোণে আনলাম। কি করে দিলো ওরা মুগ্ধকে? কি করে দিলো? জানালা ধরেই কেঁদে দেই আমি। চোখ কুচকে ফুপিয়ে কেদেঁ দেই! মম কাদলে চলবেনা! কাদিস না! থামা নিজেকে! জানোয়ারগুলাকে আগে টাইট কর! তোর মুগ্ধকে পিটিয়েছে না? তুইও কুত্তার মতো পিটাবি! একটাকেও ছাড় দিবিনা! জোরে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে হাতের তালু চোখের পানি মুছে ওড়নাটা হাতে নিলাম! কাধ থেকে কোমর বরাবর বাকা করে বেধেঁ ব্যাগের ভেতর থেকে প্রয়োজনীয় সরন্জামাদি নিয়ে হাতে পুড়লাম! আমি ওদের পেছনদিকে বিধায় এখনো ওরা দেখেনি আমায়! চুপিচুপি বিনা শব্দে ওদের পেছনে দাড়াতেই ওরা বলছে,
— মাম্মা? এই শালাকে মেরে কোথায় ফালাবি? মরা লাশ তো সাথে রাখা যাবেনা।
তন্ময় বললো,
— হুর বেক্কল! এইটা মরছে নাকি! এখনো মরেনাই! শালার নিশ্বাস পড়তেছে! মাথায় দুইটা জোরে দেওয়া লাগবো!
আহাদ বলে উঠলো,
— দেখ মামা! যেমনেই হোক লাশ ড্রেনে ফালাইস না! নদীতে ফালাইতে গেলেও কেউ না কেউ মাস্ট বি দেখবো! তার চেয়ে ভালো ! কবরস্থানে কবর দেওয়া!
নাসিফ ধমকে বলে উঠলো,
— গাধার বাচ্চা! ঘিলু নাই? কবরস্থানের মানুষ মনেহয় তোর চাচা লাগে বললেই একেবারে কবর দিয়ে দিবো!
ওরা নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটিতে ব্যস্ত থাকলে পেছন থেকে সামনে এসে আমি শুরু করি হামলা! টিনের বোতলটা জোরে ঝাকিয়ে ডিরেক্ট হামলা চোখে, পেপার স্প্রে দিয়ে! ওরা চোখ ধরে চিল্লাচিল্লি করছে! কেউ চোখ মেলে তাকাতে পারছেনা! এইসুযোগে আমি মুগ্ধকে ডাকছি! ও চোখটা পযর্ন্ত খুলতে পারছেনা! ওড়নাটা দিয়ে তাড়াতাড়ি ওর মুখ ঢেকে দেই! বাতাসে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় পেপার গ্যাস যেভাবে ছড়াচ্ছে বেশিক্ষন থাকা যাবেনা এখানে! মুগ্ধকে উঠিয়ে যতদ্রুত সম্ভব ধরে ধরে হলরুমের পিছন গেটে দিয়ে বের হলাম! মাথায় শুধু একটাই কথা পাক খাচ্ছে, মুগ্ধ বাচঁবে তো? তুই ওকে বাচাঁতে পারবি??? পেছন থেকে চেচামেচি করছে ওরা,
‘তোকে আমরা ছাড়বোনা! মুগ্ধকে মেরেই ফেলবো! তুই ওকে যেখানেই নিস যাস কেনো! আকাশ পাতাল ভেদ করতে হলেও মারবো! মার্ক মাই ওয়ার্ডস!’
৩.
রাদিফ মুগ্ধ চিকিৎসাধীন! প্রচুর রক্ত গেছে ওর! আমার নিজের জামাটাই ওর রক্তে চটচটে আকার ধারন করেছে! ওড়নাটা চিপলে বেসিন ভর্তি রক্ত ঝড়বে! অর্পির সাহায্য নিয়ে মুগ্ধকে বাসায় এনে ব্যবস্থা করেছি! ভেতরে একটা ডাক্তার, দুটো নার্স মিলে ওর ট্রিটমেন্ট করছে ! আমি রুমের বাইরে পায়চারি করছি। সার্ভেন্টরা সবাই এটা ওটা এনে হেল্প করছে। সবচেয়ে বড় সাহায্য করেছে মুগ্ধকে রক্ত দিয়ে! ডাক্তার এসে ব্লাড চাইলেই তিনজন এগিয়ে আসে!
— ‘স্যারের ব্লাড আমি দিবো ডাক্তারসাহেব!আমার থেকে রক্ত নিন!’
আরেকজন বলে উঠলো,
— ‘ডাক্তার বাবু! আমার শরীরে যত্টুক রক্ত আছে নিয়ে নেন! তারপরও আপনে মুগ্ধ বাবারে বাচায়া দেন ডাক্তার বাবু!
আমি হতবিহ্বল হয়ে কাদছিলাম শুধু! সার্ভেন্টদের এমন রক্তদান হৈহৈ দৃশ্য আমার কাছে একটা রঙিন দৃশ্যপট! আচ্ছা মুগ্ধ এমন কি জাদু করেছে উনাদের মনে এতো দাগ চিড়ে গিয়েছে?বেশিরভাগ সার্ভেন্ট দরজার বাইরে ফ্লোরে বসে দুহাত তোলে দোয়া পড়ছে। হয়তো প্রতিটি মোনাজাতে কাদঁতে কাদঁতে মুগ্ধের জন্য অকুল কন্ঠে সুস্থতা কামনা করছে। একটু দূরে গিয়ে দাড়ালাম। অনবরত চোখের স্থল ভরে ভরে পানি গড়াচ্ছে। বারবার মুছলেও যেনো অশ্রুর সোডিয়াম ক্লোরাইডের কমতি হচ্ছেনা। আমার পাশে এসে সেদিনের বৃদ্ধাটা দাড়ালো। আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলেন,
— মিস্টি মা টা? নাক ফুলিয়ে ফেলছো… কান্না করেনা মা। ও দেখো সুস্থ হয়ে যাবে।
আমি হেঁচকির সুরে আটকা গলায় বললাম,
— সসুস্থ হহবে তো?
বৃদ্ধা আঙ্গুল উচিয়ে সার্ভেন্টদের দিকে দেখালেন এবং নম্র গলায় বললেন,
— এদের মোনাজাত বিফলে যাবে না মিস্টি মা। পরিস্কার মন থেকে নিজেকে ভিখারি করে আল্লাহর দরবারে চাচ্ছে। আল্লাহ কি শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেয়? দেয় না। মানুষ শূন্যহাতে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আল্লাহ্ নাহ্! ভরসা রাখো। সব ঠিক হবে। আমার দাদুভাইয়ের কিচ্ছু হবেনা।
আমি অস্পষ্ট সুরে থেমে বলি,
— উউনি আআপনার নানাতি?
বৃদ্ধা আমার চোখের পানি মুছে বললেন,
— হুম মিস্টি মা। দাদুভাই আমার। যাও দাদুকে দেখে আসো। ডাক্তার ভেতরে যেতে অনুমতি দিয়েছে।
আমি হ্যাঁ সূচকে মাথা নাড়িয়ে দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। চোখের সামনে সটান হয়ে শুয়ে আছে মুগ্ধ! সকালের পরিস্কার চাদরটা এখন রক্তে মত্ত! সুস্থ ফাজলামি করা মানুষটা এখন বিছানায় আহত! মুগ্ধ চুপ করে আমাকে দেখছে। কপাল কুচকে ঠোট নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠোটের কোনাটা একদম চিড়ে আছে! একটা সেবিকা পাশ থেকে বললেন,
— আপনি পেশেন্টকে কথা বলতে দিবেননা প্লিজ! উনি এখনো দূর্বল! চুপচাপ পাশে বসে কথা বলুন। উনাকে মনের ভুলেও টু শব্দ করতে দিবেন না। চলি।
নার্সটা চলে যেতেই আমি বিছানায় বসলাম। মুগ্ধ ঠোটটা নাড়াচ্ছে এখনো! যন্ত্রণায় কথা বলছেনা একটুও!
আমি শাষন গলায় বললাম,
— ভালো হইছেনা একা একা মার খেতে! ভালো হইছে? মনের স্বাদ মিটছে আপনার? না করছিলাম না? কথা কানে নিছেন?
মুগ্ধ জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
— সরি! আ’ম সরি।
ঠোঁট কাপিয়ে শক্ত করে থাকলেও আমি ওইটুকু শব্দ শুনেই ডুকরে কেদেঁ দেই। যদি আজ আমার ক্যাম্পাসে যেতে দেরি হতো? যদি আজ অর্পিতা সঠিক সময়ে ওকে গাড়িতে না তুলতো? তাহলে কি এই দুটি শব্দ শোনার মতো অবস্থাটুকু বাচঁতো? নাকি লাশে পরিণত হওয়ার মতো মুরদা হয়ে যেতো? কে জানে?
-চলবে
#ফাবিয়াহ্_মম
(