#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
– Farhina Jannat
১৩.
বাংলোর বিছানায় শুইয়ে দিয়ে অপলক নেত্রে সিদ্রার দিকে তাকিয়ে রইল রাইয়্যান। প্রচণ্ড অপরাধবোধে মনটা ভারী হয়ে আছে ওর। শেষের কথাটা বলেই বুঝেছিল, বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে, কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। চড় খেয়ে মাথা আরো ঠিক রাখতে পারেনি। কিন্তু সিদ্রা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতেই হুঁশ ফিরেছে ওর, এটা কি করলাম! প্রথমদিন যখন মার খেয়ে সিদ্রা জ্ঞান হারিয়েছিল, সেদিনই মনে মনে ঠিক করেছিল রাইয়্যান, যাই করি, আর গায়ে হাত তুলবনা। এতটা অমানুষ হতে ওর নিজেরও গায়ে বাধে। কিন্তু সিদ্রার মিথ্যা কথাগুলো শুনলেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় ওর। দোষ করেছিস তো সেটা স্বীকার কর, তা না, সব সময় এক কথা জপে যাচ্ছে, আমি কিছু করিনি। হাতেনাতে প্রমাণ পাবার পর এত মিথ্যা কি সহ্য করা যায়!
তাড়াতাড়ি করে সিদ্রার মাথাটা তুলে ধরতে গিয়ে চেহারার দিকে তাকায় রাইয়্যান, প্রচণ্ড অবাক হয় ও। অনেকদিন মেয়েটার চেহারা ভাল করে খেয়াল করা হয়নি। মেয়েটা সব সময় মাথা নিচু করে কাজ করে, আর ইদানীং কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছিল। এক মাস আগের চেহারার সাথে মেলানোই যাচ্ছেনা, এত বদলে গেছে। চাপা ভেঙে গেছে, চোখের নিচে কালি, কোথায় সেই আগের রূপ-লাবণ্য! শুধু একটা জিনিস আগের মতই আছে, নিষ্পাপ পবিত্র একটা নূরানি আভা।
কিডন্যাপ করার দিন নেকাব খুলে বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছিল রাইয়্যান, পাক্কা কয়েক মিনিট চোখ সরাতে পারেনি। তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে ছবি বের করে মিলিয়েছিল, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, এটাই সেই মেয়ে। এখনো ওর দিকে তাকালেই সেই পবিত্রতার ছটা অনুভব করে রাইয়্যান, বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি কাজ করে, যেন কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। তখন জোর করে ওই অনুভূতিটা দূরে সরিয়ে রাখে রাইয়্যান, মনে করে ফারহানের কথা। এই রূপ তো ও নষ্টই তো করতে চেয়েছিল, কিন্তু আজ এত খারাপ লাগছে কেন!
এবার সিদ্রার শরীরের দিকে খেয়াল করল রাইয়্যান। ঢোলা জামা আর ওড়নায় ঢাকা থাকা সত্বেও বোঝা যাচ্ছে কত শুকিয়ে গেছে মেয়েটা। ঘরে নেয়ার জন্য দুই হাত দিয়ে পাঁজাকোলায় তুলল ওকে। এবার আঁতকে উঠলো রাইয়্যান, এত হালকা! কম করে হলেও দশ কেজি ওজন কমেছে মেয়েটার। একমাসের খাওয়া-দাওয়ার অনিয়মে এই অবস্থা! এভাবে চলতে থাকলে তো মেয়েটা অসুখে পড়ে যাবে। নাহ! খাওয়া দাওয়ার শাস্তিটা বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে গেছে, এবার একটু শিথিল করতে হবে। এতদিনে মাছ-গোস্ত তো দূরের কথা, একটা ডিমও খেতে দিইনি আমি ওকে।
কিন্তু, এখানে মাছ-গোস্ত আনা ঝামেলার ব্যাপার। খালার এমনিতেই অনেক কষ্ট হচ্ছে, আরো ঝামেলা বাড়ানো ঠিক হবেনা। আর শীতের সময় পাহাড়ে যেই ঠাণ্ডা পড়ে, তখন তো এখানে রাখাই যাবেনা। তার থেকে বরং বাংলোয় নিয়ে যাই একে। কিন্তু বাংলোয় গেলে তো হাতের নাগালে অনেক কিছু পেয়ে যাবে, যদি পালানোর চেষ্টা করে? হুম, আমাকে এমন কিছু একটা করতে হবে, যাতে ও নিজে থেকেই পালানোর চিন্তা বাদ দেয়, ভাবল রাইয়্যান।
খালা পানি নিয়ে আসলে হাতে পানি নিয়েও থেমে যায় রাইয়্যান। জ্ঞান ফিরলে নিয়ে যেতে ঝামেলা করতে পারে মেয়েটা, তার থেকে এভাবেই নিয়ে যাই। জোরে পা চালালে বেশিক্ষণ লাগবেনা, আশা করি এতটুকু দেরীতে জ্ঞান ফিরলে কোন সমস্যা হবেনা।
এসব ভেবে খালাকে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে পেছনে আসতে বলে নিজে সিদ্রাকে কাঁধে তুলে রওনা দিয়েছিল বাংলোর দিকে। দোতলায় যে এক্সট্রা ঘর আছে, সেটাতে এনে রেখেছে ও সিদ্রাকে। এটাচড বাথরুম থেকে পানি এনে ছিটালো সিদ্রার মুখে।
*****
রাইয়্যান নিজের ঘরে পায়চারি করতে করতে ভাবছিল, কি করা যায়, যাতে করে মেয়েটা নিজেই কখনো পালাতে চাইবেনা। সেটা কি আদৌ সম্ভব!
উত্তর ওকে সিদ্রাই দিয়ে দিল সেদিন ভোররাতে। চুপিচুপি ওর তাহাজ্জুদের মোনাজাত শুনতে গিয়েই বুঝে ফেলল রাইয়্যান, ওকে কি করতে হবে।
পরদিন সকালে টেবিলে নাস্তা করতে বসে সিদ্রাকে ডেকে আনতে বলল রাইয়্যান। সিদ্রা আসতেই ওকে বসতে বলল ও। এতো অবাক হল সিদ্রা, কি বলবে বুঝতে পারলনা। কোনমতে আমতা আমতা করে বলল,
“ঠিক আছে, আপনি খেয়ে নিন। আমি পরে খালার সাথে খেয়ে নিব”
“আচ্ছা, তাই নাকি? খালা, তোমাদের থালাও নিয়ে আসো। আমরা আজকে একসাথে নাস্তা করব”
খালা এসে হতভম্ব সিদ্রাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। একটা প্লেট ওর সামনে দিয়ে নিজেও পাশের চেয়ারে বসল। প্লেটের দিকে তাকিয়ে আরেকদফা অবাক হওয়ার পালা সিদ্রার।
শুকনো রুটির বদলে পরোটা, সাথে বিস্বাদ চেহারার কোন শাক বা সবজি না, কলিজা দিয়ে বুটের ডাল ভুনা, একটা ডিম পোচ, আবার একটা মিষ্টিও। দেখেতো সিদ্রার চোখও ডিমের মত হওয়ার যোগাড়। একবার প্লেটের দিকে একবার লোকটার দিকে তাকাতে লাগল সিদ্রা, যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা, কি দেখছে এসব।
কিন্তু মনে মনে বলল, আরে বাবা এত কি ভাবছিস, ভাল খাবার দিয়েছে, এর মেজাজ উলটে যাওয়ার আগে জলদি খেয়ে নে। তাই চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে পরোটা ছিড়ে ডাল দিয়ে মুখে পুরল ও। আহ! কি টেস্ট!! কবে শেষ পরোটা দিয়ে বুটের ডাল খেয়েছে, মনেও নাই। এরপর আর বিরতি না দিয়ে রাইয়্যানের দিকে মাঝে মাঝে চোরা চোখে তাকিয়ে গপগপ করে খেতে থাকল সিদ্রা। রাইয়্যান ওর কান্ড দেখে মুচকি মুচকি হাসছিল আর ও তাকাতেই চেহারা স্বাভাবিক করে ফেলছিল, চোখ নামিয়ে খাওয়ায় মনযোগ দিচ্ছিল।
কিন্তু বাদ বললেই কি আর বাদ দেয়া যায়। মাথার কাজই তো চিন্তা করা। ভাবতে লাগল সিদ্রা, লোকটা কাল থেকে হঠাৎ এত ভাল ব্যবহার করছে কেন? জ্ঞান ফেরার পর লোকটা এসেছিল কপালের ফোলা জায়গাটায় মুভ লাগাতে। লাগাতে দেয়নি অবশ্য সিদ্রা, ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। এহ! গরু মেরে জুতোদান করতে আসা। রাতে রান্নাও করতে হয়নি, খালা রান্না করে খাইয়ে এসেছে ঘরে গিয়ে আর খালা ওকে বলেছে, লোকটা নাকি ওকে রেস্ট নিতে বলেছে। উনার কি কোনভাবে মায়া হচ্ছে? নাহ! অসম্ভব ব্যাপার!! তাহলে কি মতলব উনার? আমাকেই বা হঠাৎ জঙ্গল থেকে এখানে আনার উদ্দেশ্য কি? নিশ্চয় নতুন কোন পরিকল্পনা আছে লোকটার। কিন্তু সেটা কি?
খাওয়া শেষ হতেই লোকটা বলল, “নাস্তা বানানোর ছুটি দিয়েছি আজকের মত, কিন্তু চায়ের ছুটি নাই। যা, জলদি জলদি চা নিয়ে আয়” মনে মনে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে একটা ভেঙচি কাটল সিদ্রা।
রান্নঘরে ঢুকে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল সিদ্রার। এত সুন্দর রান্নাঘর শুধু টিভিতেই দেখা যায়, এমনটাই ভাবতো ও। বিশাল একটা চকচকে ঘর জুড়ে কত ররকমের এপ্লায়েন্স যে সাজানো আছে, ও অনেকগুলার নামও জানেনা। খালা ওকে একটা ইন্ডাকশন ওভেনের সামনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ও এতে রান্না করতে জানে কিনা। মাথা নাড়তেই খালা ওকে বুঝিয়ে দিল, কিভাবে কি করতে হবে।
চা বানিয়ে খালার হাতে দিতেই খালা জানাল, লোকটা ওকেই নিয়ে যেতে বলেছে।
রাইয়্যান সুবিশাল ড্রয়িংরুমের একটা সিংগেল সোফায় বসে টিভিতে শেয়ার মার্কেটের খবর দেখছিল। নিচে নামার সময় একবার দেখেছিল, এখন লোকটার হাতে চায়ের কাপ দিয়ে ঘরটাতে আরেকবার ভাল করে চোখ বুলাল সিদ্রা। সম্পূর্ণ আধুনিক স্টাইলে সাজানো একটা ড্রয়িংরুম। দুই সেট সোফা দুইটা সেন্টার টেবিলের তিনদিক ঘিরে সাজানো হয়েছে। উলটোদিকের দেয়ালে একটা দৈত্যাকৃতির টেলিভিশন স্ক্রিন, যেটার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। মেঝেতে বহুমূল্য কার্পেট পাতা। ঘরের কর্ণার আর অন্য ফাঁকা জায়গাগুলো কেবিনেট, বুকশেলফ আর বড় বড় ভাস দিয়ে সাজানো। ভাসে নানাজাতের ইনডোর প্ল্যান্টস, দেয়ালজুড়ে পেইন্টিং, বাহারি শোপিস কি নেই ঘরে! শেলফভরা বই দেখে চোখ চকচক করে উঠলো ওর। প্রতিটা জিনিস থেকে যেন ঐশ্বর্য আর আভিজাত্য ঠিকরে বেরোচ্ছে, তবে রুচির ছাপ আছে। হায়রে, এসব বড়লোকেরা দুনিয়াকে বেহেস্ত বানিয়ে রাখে, অথচ আখিরাত নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা নাই এদের, কি কাজে আসবে এগুলো সেখানে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিদ্রা।
চা খাওয়ার পর রাইয়্যান উপরে চলে গেলে সিদ্রা শেলফের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিল। সবই ইংরেজি বই, ধুর! এসময় একটা দরজা চোখে পড়ল ওর ড্রয়িং আর ডাইনিং এর মাঝামাঝিতে। দরজাটা খুলতেই বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে গেল সিদ্রা। পাঁচিলঘেরা একটা বাগান। পাঁচিলের ওপর দিয়ে কোন পাহাড় দেখা যাচ্ছেনা, তবে গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে। তার মানে বাংলোটা কোন পাহাড় বা টিলার ওপরে অবস্থিত, ধারণা করল সিদ্রা। বাগানটা মাঝারি আকৃতির। নানা রঙবেরঙ এর ছোটবড় ফুলের গাছ আছে, কয়েকটা বড় বড় গাছও দেখা যাচ্ছে, চিনেনা সিদ্রা ওগুলো। লোহার একটা বড় দোলনা আছে একপাশে, আরেক পাশে আবার ছাতার নিচে বেতের চেয়ার টেবিল সাজানো, মানে পুরো এলাহী কারবার। বাগান ঘুরে অনেকগুলো ফুলের গন্ধ শুঁকে, দোলনাটায় গিয়ে বসল সিদ্রা। দোল খেতে খেতে চোখে পড়ল, কোণার দিকে চালা দিয়ে হাফ দেয়াল তুলে ঘেরা একটা জায়গা। এগিয়ে গিয়ে দেখল, মাটির চুলায় রান্নার ব্যবস্থা আছে। এত আধুনিক রান্নাঘর থাকতে মাটির চুলার কি দরকার, বুঝে আসলনা ওর।
বাগান থেকে ঘরে ঢুকতেই কলিংবেলের আওয়াজ পেল সিদ্রা। অন্য কেউ এসেছে, বাইরের লোক, হয়তো আমাকে বাঁচাতে পারবে, নেকাব পরতে পরতে দৌড় দিল সিদ্রা দরজার দিকে। সামনের দেয়ালটা পেরোলেই দরজা চোখে পড়বে, এমন সময় হাতে হ্যাচকা টান অনুভব করল সিদ্রা। চিৎকার করে উঠার আগেই আরেক হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরল ওকে রাইয়্যান, চোখ বড় বড় হয়ে গেল সিদ্রার। অস্ফুট একটা গোঙানি হয়ে বেরোল চিৎকারটা। খালা ততক্ষণে দরজা খুলে ফেলেছে, একটা ছেলের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। সিদ্রার দিক থেকে নজর সরিয়ে দরজার দিকে কান পাতল রাইয়্যান। বুঝতে পারছেনা, বাজার দিতে আসা ছেলেটা কিছু শুনেছে কিনা।
এদিকে একটা লোক এত কাছে দাঁড়িয়ে আছে, ভীষণ অস্বস্তিতে ঘামছে সিদ্রা। তার ওপর এত শক্ত করে ধরেছে লোকটা, নড়তে চড়তে পারছেনা ও। বাম হাতটা পেছনে মুচড়ে ধরে রেখেছে, সেখানে ব্যথাও করছে। ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতেই চোখ গরম করে তাকাল লোকটা। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল ও কিন্তু দৃষ্টি সরিয়ে নিলনা লোকটা। ছেলেটার বকবক এখনো শোনা যাচ্ছে, কিন্তু লোকটা এভাবে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে কেন, চোখের রাগীভাবটাও যেন আর নেই। হার্টবিট সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়ছে, ভয়ে না আতঙ্কে, বুঝতে পারছেনা সিদ্রা। অবশেষে বাইরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হতেই লোকটা ছেড়ে দিল ওকে। দুজনে একসাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এবারে লোকটা ওর দিকে এমনভাবে তাকাল যেন ভস্ম করে ফেলবে। বাম হাতের কবজি ডান হাত দিয়ে ডলছিল সিদ্রা, কিন্তু এই দৃষ্টি দেখে পুরো স্ট্যাচু হয়ে গেল। মারবে নাকি? দৌড় দিব? কিন্তু এত কাছে দাঁড়িয়ে আছে ধরে ফেলবে তো, কি করি?
“কি করতে যাচ্ছিলি তুই? সাহস খুব বেশি হয়ে গেছে না? প্রথমবার বলে মাফ করে দিলাম। কিন্তু…….. ভবিষ্যতে এমন কিছু করার চেষ্টা করলে বাইরে বেরোন একদম ঘুঁচিয়ে দিব। ঘরের মধ্যে আটকে রেখে দিব। অন্ধকারে পড়ে থাকতে হবে সারাদিন সারারাত। সেটা না চাইলে বাইরের কোন লোক আসলে সামনে আসার কথা চিন্তাও করবিনা”
কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিল সিদ্রা। ওর মনে ঢুকে গেছে মুক্তির নতুন আশা। এহ! উনার কথা শুনতে আমার বয়েই গেছে। এখানে বাইরের লোকের আসা-যাওয়া আছে। বাহ! তাহলে তো আমাকে এখানে এনে আপনি উপকারই করেছেন। যদি নিজে পালাতে নাও পারি, কোন একজনের সাথে দেখা করতেই হবে আমাকে, তারপর যা হবে দেখা যাবে। মুক্তি পাবার এটুকু আশার আলো পেয়েই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল সিদ্রা।
এদিকে রাইয়্যান ভাবছে যেটা ভেবেছি, সেটা তাড়াতাড়ি করতে হবে, আজকে যা হল তার পুনরাবৃত্তি হওয়ার রিস্ক নেয়া যাবেনা। পকেট থেকে মোবাইল বের করল ও।
খালা এসে দুজনকেই চিন্তার জগত থেকে ফিরিয়ে আনল। জানতে চাইল, বাজার এসে গেছে, এখন কি কি রান্না হবে।
“ভাত, গরুর গোস্ত, মুরগির কষা, মাছ ভাজা, ডাল, দুই রকমের ভাজি আর একটা সবজি তরকারি। আর এগুলো তুই করবি” সিদ্রার দিকে তাকিয়ে বলল রাইয়্যান।
“কি? আমি!?” মেনু শুনেই হা হয়ে গেছিল সিদ্রা আর শেষের কথা শুনে তো ঢোক গিলল।
বলে চলল লোকটা, ”ভেবেছিলাম, আজকের দিনটা তোকে রেস্ট নিতে দিব, কিন্তু তুই এইমাত্র যা করলি…..” হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রাইয়্যান “নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছিস! এখন জলদি গিয়ে রান্না শুরু কর, আমি ঠিক দুটোয় টেবিলে খাবার চাই” বলেই সিঁড়ির দিকে এগোল ও।
“ইশ! বললেই হল, আমি মাছ গোস্ত রান্না করতে পারিনা, এই যে শুনছেন, আমি পারবোনা এসব করতে” বলল সিদ্রা।
কে শুনে কার কথা, লোকটা গটগট করে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। ওইদিকে লক্ষ্য করে হাওয়ায় একটা ঘুষি ছুঁড়ল সিদ্রা। ধুর! একটা দিন আরামে কাটলনা আমার। খালা হাসছিল সিদ্রার কান্ড দেখে, এবার ওকে ঠেলে রান্নাঘরে নিয়ে চলল।
#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা
– Farhina Jannat
১৪.
খাবার টেবিলে বসে রাইয়্যান অবাক হয়ে গেল। মনে যা এসেছিলো তখন বলে দিয়েছে, কিন্তু মেয়েটা যে সত্যি সত্যি এসব রান্না করতে পারবে, এতটা আশা করেনি। এদিকওদিক তাকিয়ে সিদ্রাকে না দেখে ওর কথা খালাকে জিজ্ঞেস করল রাইয়্যান। খালা জানাল, ও গোসল করতে গেছে। মুখে লোকমা তুলতেই চমৎকৃত হয়ে গেল রাইয়্যান। এত ভাল রান্না বহুদিন খায়নি ও। খালার হাতের রান্না ভাল, কিন্তু আজকের রান্নাটা অনেকটা ওর মায়ের মত হয়েছে, যদিও পুরোপুরি নয়। ওদের মা রান্না করে খাওয়ানোর সুযোগ খুব বেশী পেতোনা, তাও মাঝেমাঝে যেটুকু করতো সেগুলোর স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে ওর।
ঢং এর কথা, রান্না পারিনা, মিথ্যুক একটা, মনে মনে বলল রাইয়্যান। এখন পর্যন্ত মেয়েটাকে কিছু না পারতে দেখিনি। পারিনা বললেও শেষমেশ ঠিকঠাক মতই করেছে সব কাজ। কাজ না করার জন্য মিথ্যে বলে, নাকি যা করে সেটা সিন্সিয়ারলি করে বলে ভাল হয়ে যায়, কোনটা?
“খালা, রান্না কি ওই মেয়ে করেছে?”
মাথা ঝাঁকাল খালা। জানাল, আপনি তো আমাকে সাহায্য করতে নিষেধ করেছিলেন, আমি তেমন কিছু করিনি। শুধু রান্নার যোগাড়গুলো করে দিয়েছি, নাহলে তো এত জলদি খাবার রেডি হতনা। কেন, বেশী খারাপ হয়েছে কি, জানতে চাইল খালা।
“আরে না, দারুণ হয়েছে। খেয়ে দেখ তুমি। দেখেছো, মেয়েটা কি পরিমাণ মিথ্যুক! বলে কিনা রান্না করতে পারিনা! তুমি তো ওর কথা খুব বিশ্বাস কর দেখি!”
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে কান পেতে ছিল সিদ্রা। লোকটার কথা শুনে বিশেষ কায়দায় ডান হাত উপর নিচ করে ইয়েস! বলে উঠলো। জীবনের প্রথম এত কিছু রান্না করেছে, তাও আবার কোন রেসিপি ছাড়া। রান্নায় সময় তো আম্মুকে হেল্প করতো, দেখতো সবকিছুই, সেগুলোই মনে করে করে রেঁধেছে, এখন খেতে কেমন হয়েছে জানতে তো ইচ্ছে হবেই। প্রতিটা জিনিস কতবার করে যে চেখে দেখতে হয়েছে হিসাব নেই। কিন্তু ও সামনে থাকলে লোকটা সত্যি কথা জীবনেও বলবেনা বুঝেই গোসলের কথা বলে উপরে চলে এসেছে। উনি যখন বলেছে দারুণ হয়েছে, তার মানে আসলেই ভাল হয়েছে। খুশিমনে গোসল করতে ঢুকল সিদ্রা।
খেতে বসে নিজেও মুগ্ধ হয়ে গেল সিদ্রা, এত ভাল রান্না ও করেছে! দীর্ঘ একমাস পর এতগুলো আইটেম দিয়ে পেটপুরে ভাত খেল সিদ্রা। কৃতজ্ঞতা জানাল আল্লাহর দরবারে আর প্রার্থনা করল, ইয়া আল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা তোমার জন্য। যেভাবে আমার পেটপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা তুমি করেছো, সেভাবে লোকটার ভুল ভাঙার আর আমাকে সসম্মানে মুক্তি পাবার ব্যবস্থাও করে দাও। তুমি তো সর্বশক্তিমান, অসীম দয়ালু আর উত্তম পরিকল্পনাকারী।
***
রাতে খাওয়ার পর টেবিল আর রান্নাঘর গুছিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে, পেছন থেকে লোকটা ডাকল সিদ্রাকে। ধুর! আবার কি, বিরক্ত হল সিদ্রা, অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুরলো ও। লোকটা জিজ্ঞেস করল, “কফি বানাতে পারিস?”
মাথা ঝাঁকাল সিদ্রা। মনটা ভারী হয়ে গেল ওর। কফি! আমি নাই, মুনিরাকে কফি বানিয়ে দেওয়ারও কেউ নাই, ও কি নিজে নিজে কফি বানিয়ে খায়?
“যা, আমার জন্য কফি বানিয়ে আন, চিনি…….”
“১ চামচ, জানি আমি“ কথাটা শেষ করে রান্নাঘরের দিকে এগোল সিদ্রা, শুনতে পেল লোকটা বলছে, “খবরদার! প্রথমদিনের চায়ের দশা করলে কিন্তু কপালে দুঃখ আছে তোর”
ওইদিনের চা করার কথা মনে পড়তেই মুখে হাসি ফুটে উঠল সিদ্রার, কিন্তু পরের ঘটনা মনে পড়তেই হাসি মিলিয়ে গেল, রাগে শক্ত হয়ে উঠলো চেহারা। রাগের চোটে চা বানানোর ছোট হাতলওয়ালা সসপ্যানটা শব্দ করে ইন্ডাকশনের উপর রাখতে গিয়ে নিচেই পড়ে গেল।
শব্দতো হলই, রাতের নিরবতায় সেটা আরো প্রকটভাবে শোনা গেল। দৌড়ে এল রাইয়্যান রান্নাঘরে। দেখল সিদ্রা মগ থেকে পানি ঢালছে সসপ্যানের ভেতর।
“কি করছিস তুই?”
“আশ্চর্য, আপনিই না কফি বানাতে বললেন, এখন আবার জিজ্ঞেস করছেন কি করছি!” চোখ ঘুরিয়ে উত্তর দিল সিদ্রা।
“হ্যাঁ বলেছি, কিন্তু তার জন্য সসপ্যান আর ইন্ডাকশন কেন?”
“কেন? আপনি কি নরমাল পানিতে কফি চিনি গুলিয়ে খান?”
“ভেরি ফানি! তোরও যেমন বুদ্ধি!! কফি মেকার আছে কি জন্য?”
আড়চোখে কফি মেকারটার দিকে তাকাল সিদ্রা। “ও, আমি ওইটার ব্যবহার জানিনা। আমি যেভাবে জানি, সেভাবেই বানাচ্ছি” মগে কফি আর চিনি নিল সিদ্রা।
“আমি কফি মেকারের কফি ছাড়া খাইনা, খালা কই? তোকে শিখিয়ে দিবে কিভাবে কি করতে হয়”
“খালার মাথা ব্যথা, শুয়ে পড়েছে। আমি কালকে শিখে নিব। আপনি এভাবে খেলে খান, নাহলে আমি গেলাম” পানি দিয়ে কফি চিনি ফেটাচ্ছিল, সেটা থামিয়ে দিল সিদ্রা।
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই দেখিয়ে দিচ্ছি, এত কঠিন কিছু না”
তারপর রাইয়্যান ওকে কফি মেকার দিয়ে এক মগ কফি বানিয়ে দেখিয়ে দিল। ধোঁয়াওঠা মগটা হাতে নিয়ে বলল, “দেখলি, কত সহজ?”
এর মধ্যে সিদ্রাও শেষ করে ফেলেছিল ওরটা। কফির মগটা রাইয়্যানের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “আমারটাই বেশি সহজ আর টেস্টিও। শুধু শুধু জিনিস মাখানো, পরিষ্কার তো আপনাকে করতে হয়না, হুহ!”
“বেশ, তোর বানানো কফি আমি খাবো, আর আমারটা তুই। অনেস্টলি বলতে হবে, কোনটা খেতে বেশি ভাল” টাশকি খেল সিদ্রা, রাতবিরাতে লোকটাকে ভুতে টুতে ধরলোনাতো!
“বুদ্ধি ভাল, কিন্তু আপনি অনেস্টলি বলবেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে আমার। আর রাতে কফি খেলে আমার ঘুম হয়না। সো, দুইটাই আপনি খান আর নিজে বিচার করেন। এরপর যেভাবে বলবেন, সেভাবেই নাহয় বানিয়ে দিব, ওকে?” বলে হাতের সসপ্যানটা জায়গামত ঝুলিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল সিদ্রা।
হা হয়ে গেল রাইয়্যান, এমন জবাব এক্সপেক্টই করেনি। রেগেও গেল, আমার অনেস্টি নিয়ে প্রশ্ন তোলা, এতবড় সাহস! দ্রুতবেগে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ও, “ওই, তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! আর এক পা এগোলে একদম ঠ্যাঙ ভেঙে দিব। তোর রাতে ঘুম হল কি হলনা তাতে আমার কি? চুপচাপ নিচে এসে কফি খাবি, উত্তর দিবি, তারপর তুই যেতে পারবি”
লোকটা যে ফাঁকাআওয়াজ দিচ্ছেনা, পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ভালই জানা আছে ওর, ধীরপদে নিচে নেমে এল সিদ্রা। অনেকদিন পর কফির ঘ্রাণে বড্ড লোভ হচ্ছিল, কিন্তু এত রাতে একা একা লোকটার সাথে কফি খেতে ভরসা পাচ্ছিলনা বলেই ঘুম না হওয়ার অজুহাত দিয়েছিল ও।
কফিতে চুমুক দিয়ে তাজ্জব হয়ে গেল দুজনেই। সিদ্রা এর আগে কখনো কফি মেকার দিয়ে বানানো কফি খায়নি, কফিটাও বিদেশী ভাল ব্র্যান্ডের, তার ওপর এতদিন পরে খাচ্ছে, টেস্ট তো বেশি লাগবেই। আর রাইয়্যানও সবসময় এক টাইপের কফি খেয়ে অভ্যস্ত, চামচ দিয়ে ফেটিয়ে ফোম তোলা এই কফিও ওর কাছে কফি মেকারের কফির থেকে বেশি স্বাদের লাগল। দুজনেই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে, অনেস্টলি বলতে গেলে তো নিজেই ফেঁসে যাবে।
হঠাৎ রাইয়্যান টেবিলের ওপরে রাখা ল্যাপটপটা সিদ্রার দিকে ঘুরিয়ে দিল। ওদিকে তাকাতেই খুশিতে চোখে পানি চলে এল সিদ্রার। মুনিরা! কতদিন পর বোনকে দেখছে ও, হোকনা নেকাব পরা ছবি! আগের পরের ছবিগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল সিদ্রা। বিভিন্ন সাইড এঙ্গেল থেকে তোলা ছবিগুলো, ওর অজান্তে তোলা হয়েছে। বেশভুষা দেখে বুঝতে পারল সিদ্রা, এগুলো ওর ভার্সিটি যাওয়ার বা আসার পথে তোলা হয়েছে, ছবির নিচে ডেটও দেখা যাচ্ছে, আজকের তোলা!
কিন্তু লোকটা হঠাৎ আমাকে মুনিরার ছবি দেখাচ্ছে কেন, অজানা আশঙ্কায় দুলে উঠলো সিদ্রার মন। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে রাইয়্যানের দিকে তাকাল সিদ্রা।
“তুই তো তোর বোনকে অনেক মিস করিস, তাই ছবিগুলো পাঠাতে বললাম আমার সেক্রেটারিকে” একটু যেন বাঁকা স্বরে বলল লোকটা।
“জাযাকাল্লাহ! জাজাকাল্লাহু খইরন!!” দুচোখভরা পানি নিয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল সিদ্রা।
“কি বললি ওটা?” বুঝতে পারেনি রাইয়্যান সিদ্রার কথা।
“আমি বললাম, আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন”
“কেন?” অবাক হল রাইয়্যান।
“আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন, কিন্তু আজকে এতদিন পর নিজের বোনকে দেখে অনেক খুশি হয়েছি, আর সেটা আপনার জন্য, তাই”
“থ্যাংকইউ বা ধন্যবাদ বললেই তো হয়ে যেতো”
“শুধু মুখে থ্যাংকইউ বা ধন্যবাদ বললে কি হয়? যাকে বলা হয় তার কি কোন উপকার হয়? বরং জাযাকাল্লাহু খইরন বলে আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করা হয়, সেটা কি বেশি ভাল না?”
এত অবাক হল রাইয়্যান, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলনা ও। এখনো সিদ্রা চোখে পানি নিয়ে স্ক্রিনের উপর হাত বুলাচ্ছে, যেন আদর করছে বোনকে। মেয়েটার মুখের এই খুশিটা মুহূর্তের মধ্যেই কেড়ে নিতে মন সাই দিলনা রাইয়্যানের। যে কথা বলার জন্য এই ছবি তোলানো, সেটা কিছুতেই অনেক চেষ্টা করেও মুখে আনতে পারলোনা।
রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবল সিদ্রা, বন্দীজীবনের সবথেকে অদ্ভুত দিন ছিল আজ। সারাদিন একের পর এক যা ঘটল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা। এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? এই লোকের ভাল ব্যবহারে তো আরো ভয় করছে আমার। বড় ঝড়ের পূর্বে সবকিছু শান্ত হয়ে যায়, এটাও তেমন কিছু নয়তো? হে আল্লাহ্, তুমি রক্ষা কর আমাকে। আনফরচুনেটলি, সিদ্রার ভয়টা অমূলক ছিলনা।
***
পরদিন দুপুরে আবার কলিংবেল বাজলো দরজায়। আগেরবারের মতই ছুটে গেল সিদ্রা, তবে নিশ্চিন্তে, ওকে আটকাবার কেউ নেই এখন, লোকটা চলে গেছে।
(চলবে)