‘নয়নতারা’
লিখা- ফারিয়া নোভা
(পর্ব-৪)
ফাদার গম্ভীর হয়ে আছেন। নয়নতারা এবার পিচ্ছির দিকে এগিয়ে যায়।
নয়নতারা – কিরে তিনু, পুতুল দেখে কেউ এভাবে ভয় পায়?
তিনু- আপু দেখো পুতুলের গায়ে এটা কি ( ভয়ে)
নয়নতারা সেদিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
নয়নতারা- আরে বোকা এটা তো নকল ভুরু। কলেজে অভিনয় করেছিলাম সময় কেনা। এটা কিভাবে এখানে এলো বুঝতেই পারছি না।
এটা দেখে কেউ ভয় পায় নাকি? বোকা মেয়ে।
বাচ্চাকাচ্চাগুলো সবাই হাসছে। নিজেদের মধ্যে ভয়ের ভাব টা কেটে গেছে। নয়নতারা সবাই কে চকোলেট দিলো, ফাদার কেও একটা চকোলেট দিতে গেলো।
ততক্ষণে ফাদার ও স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন…..
নয়নতারা- কেমন আছেন, ফাদার?
ফাদার- আমার এতো সন্তান থাকতে আমি কি খারাপ থাকতে পারি মা? শুভ জন্মদিন, গড তোমার মঙ্গল করুক।
ফাদার খ্রিস্টধর্মাবলম্বী এবং বহির্দেশী। এদেশে বহুবছর থাকার সুবাদে বাংলা ভাষা তার নখদর্পণে।
নয়নতারা- ধন্যবাদ ফাদার। আমার গিফট?
নয়নতারা ও ফাদার দু’জনেই হাসছেন।
ফাদার- আমার ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে । একটু ওয়েট করো। আমি যাবো আর গিফট নিয়ে আসবো।
এটাই সুযোগ। সবার চোখ কে ফাঁকি দিয়ে নয়নতারা ফাদারের পিছু পিছু যাচ্ছে। এতিমখানার প্রত্যেক কোনা সবার জানা থাকলেও এই এক ফাদারের রুমে সবার যাওয়া বারণ।
নয়নের মনে হচ্ছে নিশ্চিত কোনো ক্লু পাওয়া তো যাবেই ও ঘরে।
দরজার আড়াল থেকে প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমটা দেখছে নয়নতারা। রুমের দেয়ালে বড় বড় দুটো ফটো ফ্রেম। কিন্তু কালো কাপড়ে ঢাকা।
নয়নতারা- অদ্ভুত, এইগুলো এভাবে ঢেকে রাখা হয়েছে কেন?
এদিকে ফাদার এক বড় সিন্দুক থেকে কি যেনো বের করছেন। তখন একটা ছেঁড়া কাগজ সিন্দুক থেকে মাটিতে পড়ে যায়। ফাদারের সেদিকে খেয়াল নেই।
উনি সিন্দুকে তালা লাগিয়ে রুম থেকে বের হচ্ছেন। নয়ন দরজার আড়াল থেকে সরে যায়।
ফাদার ও রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
ফাদার চলে যাওয়ার পর, নয়ন তালাবন্ধ রুমটার দিকে শেষবার তাকাতেই দরজার ফাঁকে একটা কাগজ আটকে থাকতে দেখতে পায়।
কাগজ টা খুলতেই নয়নতারা একটা নাম লিখা পায়, নামটা কালো কালিতে লিখে ক্রস টেনে দেয়া। বেশ পুরোনো একটা কাগজ।
নয়নতারা কাগজ টা ব্যাগে রেখে দেয়, আনমনে উচ্চারণ করে-
‘রিকভিয়া…..’
নয়নতারা দ্রুত পা চালায়, কারণ গিফট নিয়ে ফাদার হয়তো তাকেই খুঁজছে।
ফাদার ততক্ষণে এসে নয়নতারা কে খুঁজছে, নয়নতারে পেছন থেকে এসে ফাদার কে চমকে দেয়।
ফাদার- মাই সুইট প্রিন্সেস, তুমি সারাজীবন ছোটোই থেকো, এখন যেমনি আছো।
ফাদার ওর হাতে একটা পুতুল দেয়। মাটির পুতুল, গজ কাপড় কেটে পরিপাটি পুতুলের শাড়ি পড়ানো। মাথায় ছোট্ট মুকুট আঁকা।
নয়নতারা অদ্ভুত দৃষ্টিতে পুতুলটার দিকে তাকিয়ে আছে।
নয়নতারা- এটা কোথা থেকে পেয়েছেন ফাদার? এতো সুন্দর।
ফাদার- এটা তোমার মায়ের ছোটোবেলার খেলনা সুইট প্রিন্সেস। আমি অনেক যত্নে রেখেছিলাম। আজ তোমায় দিলাম।
নয়নতারার চোখ ভিজে আসে।
নয়নতারা- বেস্ট গিফট এটা ফাদার, থ্যাংক ইউ।
ফাদার- ওয়েলকাম, মাই প্রিন্সেস। চলো লাঞ্চ করে নেই একসাথে সবাই মিলে।
হৈ হৈ করে সবাই খেয়ে নেয়। নয়নতারা এবং মি. রোদিক বিকেলের দিকে বাসায় ফিরে আসে।
মি. রোদিক বেশ ক্লান্ত, তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন।
আর নয়নতারা? ওর মাথায় আরো বেশ কিছু প্রশ্নের জটলা বেঁধেছে।
ও নিজের সামনে মায়ের শেষ চিঠি, সেই রিকভিয়া শব্দের চিরকুট, মায়ের পুতুল নিয়ে বসেছে।
এগুলোর মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র আছে? নয়ন আনমনে ভাবে।
তবে রিকভিয়া শব্দটা তাকে ভাবাচ্ছে। কোথায় যেনো শুনেছে।
আঁধার ঘনিয়ে এসেছে, নয়নতারার মনের উত্তেজনাও ক্রমশ বাড়ছে।
আজ রাত ১২টা, গন্তব্য কবরস্থান…..
(পর্ব-৫)
মি. রোদিক রাত ১০ টার মধ্যে ঘুমোতে যান। নয়নতারা বাবাকে খাওয়ানো শেষে চুপি চুপি নিজের জন্য একটা ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।
একটা ছোট্ট ‘কোরআন-শরীফ’, চাকু, ব্লেড, কম্পাস, দঁড়ি, কিছু পেরেক,হাতুড়ি, টর্চলাইট এবং মায়ের সেই চিঠিটা এগুলো ঢুকিয়ে নেয়।
এখন শুধু অপেক্ষা, কখন সময় হবে। ১১:৩০ মিনিটে নয়নতারা চুপিচুপি বাড়ির পেছনের দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়।
এতো রাতে সে একা একা হাঁটছে, ভয় ভয় লাগছে। কিছু দোকানপাট এখনো খোলা। তাই সে মাথায় স্কার্ফ জড়িয়ে নেয়।
যেনো কেউ তাকে চিনতে না পারে।
কবরস্থানের মেইন গেটের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে নয়ন ভাবছে এতো রাতে তো কবরস্থানে ঢুকা যাবেনা। এদিকে মা সাফ চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছেন কেউ যেনো জানতে না পারে।
এবার তাহলে কি করবে নয়নতারা? ১২ টা বাজতে আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি।
হঠাৎ ই মনে হলো তারর কাছে দড়ি আছে। সে তো অনায়েসে এই উঁচু দেয়াল টপকাতে পারে।
যেইভাবে সেই কাজ। হাতুড়ি দিয়ে পেরেক বাঁকিয়ে দড়ির মাথায় বেঁধে নেয় সেটা। তারপর ছুড়ে দেয়ালের দিকে।
দেয়ালের উপরের দিকে এক ভাঙ্গা অংশে পেরেক গেঁথে যায়।
নয়নতারা ভাবে, এতেই হবে। সে দড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে যায়।
পরে দেয় এক লাফ।
মাঠিতে পড়তেই নয়নতারার হাত-পা ছিলে যায়। কিন্তু সেদিকে ওর ভ্রুক্ষেপ নেই।
কবরস্থানের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ তার মনে ভয় ধরিয়ে দেয়।
কিন্তু ভীত হলে চলবে না।
মায়ের চিঠির রহস্য তাকে ভেদ করতেই হবে যে।
সে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
কিন্তু এই অন্ধকারে মায়ের কবরটাই যে খুঁজে পাচ্ছে না ও।
এদিকে টর্চলাইট জ্বালালে গার্ড রা বুঝে ফেলবে। তখন পড়তে হবে আরেক সমস্যায়।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর নয়নতারা তার মায়ের কবরের সারির নাম্বার টা খুঁজে পায়।
আর কিছুদূরেই মায়ের কবর।
নয়নতারার পা যেনো আর চলতে চাইছে না। মনের মধ্যে ভয় টা ঝাপ্টে ধরেছে। ঘড়ির কাটায় প্রায় ১২ টা বাজতে চললো।
তখনি মৃদু বাতাস বইতে শুরু করলো। নয়নতারার কানের কাছে কে যেনো ফিসফিস করে বললো –
‘তরীইইইই…..’
নয়নের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। তাহলে কি সে ধরা পড়ে গেলো? তাকে কি কেউ ফলো করছিলো?
নয়নতারা পেছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলো না।
সে আবারো শুনতে পেলো কেউ ডাকছে-
তরী….
নয়নতারার কন্ঠ টা বেশ চেনা মনে হচ্ছিলো, কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারছেনা। ভয়জড়িত কন্ঠে সে বলে উঠে,
– কে আপনি?
তরী তুমি আমায় চেনো নাহ?
– নাহ আমি আপনাকে চিনি নাহ। তরী কে? আমাকেই বা তরী বলেই ডাকছেন কেন? সামনে আসুন বলছি।
– তুমি যতবার, যতরুপে জন্মগ্রহণ করো না কেনো, তুমি যে আমার তরীই থাকবে।
এসব কি বলছে লোকটা? তাহলে কি উনি মাকে চিনতেন?
তখনি আকাশ থেকে একটা তারা খসে পড়লো। নয়নতারার একমুহূর্তে মনে হলো মা যেনো তাকে কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
তরী কি ভাবছো এতো?
– শুনুন আমার হেয়ালি ভাল্লাগছেনা একদম। কি দরকার আপনার আমার সাথে? দয়া করে সামনে আসুন, আমি দেখতে চাই আপনাকে।
আমাকে দেখার সময় যে হয় নি এখনো তরী। তোমার সাথে যে আমার জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক, তা কি এভাবে বলা যায়?
নয়নতারার প্রচন্ড রাগ হয়। ও টর্চলাইট জ্বালিয়ে দেয়। কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ বাতাসে ভাসমান একটা অগ্নিকুণ্ড ওর চোখে পড়ে।
প্রচন্ড মাথা ঘুরছে নয়নতারার।
এদিকে গার্ডদের হাঁকডাক শুনা যাচ্ছিলো-
কে ওখানে?
(পর্ব-৬)
নয়নতারার যখন হুশ আসে, তখন সে নিজেকে নিজের বেডরুমে আবিষ্কার করে।
ভোরের আলো দরজা জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে ডুকছে। এদিকে নয়নতারার মাথাটা প্রচণ্ড ধরে আছে, কাল রাতে কি হয়েছিলো সে কিছুই মনে করতে পারছে নাহ।
নয়নতারা বিছানা ছেড়ে জানালা খুলে দেয়। সকালের মিষ্টি রোদ যখন শরীরে লাগছে , নয়নতারার তখন বেশ ভালোই লাগছে।
আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ই নয়নতারার কাল রাতের কথা সব ই মনে পড়তে শুরু করে। ও ভয়ে শিউরে উঠে।
ও বাড়িতে পৌছালো কিভাবে?
তাহলে কি ওই লোকটাই?
কিন্তু কাল তো নয়নতারা কিছুই দেখতে পায় নি।
ওই অগ্নিকুণ্ড টাই বা কিসের?
তাহলে কি লোকটা কোনো প্রেতাত্মা?
ভাবনায় ছেদ পড়ে বাবার ডাকে-
মি. রোদিক- কিরে মা, এখনো উঠিস নি? ফ্রেস হয়ে আয়, কলেজ যাবিনা?
নয়নতারা- আসছি বাবা।
বাবা মেয়েতে নাস্তা করতে বসে।
মি. রোদিক- কিরে আজ কলেজ যাচ্ছিস তো?
নয়নতারা- আজ তো যেতেই হবে, কালও যায় নি।
মি. রোদিক- গুড, তারপর পড়ালেখার কি অবস্থা?
নয়নতারা- এইতো চলছে। আচ্ছা বাবা একটা প্রশ্ন করি?
মি. রোদিক- তো জিজ্ঞেস করছিস কেন? করে ফেল।
নয়নতারা- আশ্রমের ফাদার কে তোমার কেমন মনে হয়?
মি. রোদিক- উনি প্রচণ্ড দয়ালু একজন মানুষ, নিজের সারাটাজীবন আশ্রমের বাচ্চাদের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানিস?
নয়নতারা – কি বাবা? (উৎসাহিত)
মি. রোদিক- উনাকে যখন থেকে দেখছি তখন থেকে মনে হয় উনার বয়স টা একি আছে। ঈশ্বর মনে হয় উনাকে অনেক আয়ু দিয়েছেন মানুষের সেবা করার জন্য…..
ফাদারের মধ্যে যে কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে আছে তা নয়নতারা আগেই বুঝে ফেলেছে। বাবার কথায় সন্দেহটা আরো কিছুগুন বেড়ে গেলো।
নয়নতারা -আচ্ছা বাবা, তুমি ফাদার কে কবে থেকে চেনো?
মি. রোদিক- তা প্রায় ১৮ বছর তো হবেই।
নয়নতারা- ইন্টারেস্টিং! ১৮ বছরে তো অনেক পরিবর্তন আসার কথা।
মি. রোদিক- এসেছে তো। আমার যৌবন পেড়িয়ে চুলে এখন পাক ধরেছে।
বাবার এই কথায় নয়নতারা আর বাবা দুজনেই হাসছে।
মি. রোদিক- চল, অফিসে যাওয়ার সময় তোকে কলেজে ড্রপ করে দেই।
নয়নতারা- ঠিক আছে।
নয়নতারার মাথায় নতুন এক চিন্তা ডুকেছে। সে কাল রাতের লোকটার কথা প্রায় ভুলেই গেছে…..
(চলবে)