‘নয়নতারা’
লিখা- ফারিয়া নোভা
(পর্ব-১০)
নয়নতারার যখন জ্ঞান ফিরে তখন সে বাবাকে মাথার কাছে বসে থাকতে দেখতে পায়।
মি. রোদিক- কিরে মা, এখন ভাল্লাগছে একটু?
নয়নতারা মাথা নেড়ে সম্মতিসূচক ইঙ্গিত দেয়।
মি. রোদিক – তাহলে এখন ঘুমা, আমি যাই কেমন? রাতে কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে ডাকবি কিন্তু।
নয়নতারা – ঠিক আছে বাবা, তুমি টেনশন করো না।
মি. রোদিক মেয়ের রুমের লাইট অফ করে দিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যান। এদিকে নয়নতারা বেশ অস্থির সময় কাটাচ্ছে। মনে মনে শুধু টগরের কথাই ভাবছে….
নয়নতারা- টগর, আপনি কোথায়? সাড়া দিন প্লিজ।
মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। নয়নতারা বুঝেছে টগর আসছে।
টগর- এতো উত্তেজিত কেনো তুমি তরী?
নয়নতারা- আপনি এসেছেন? সবকিছু খোলাসা করে বলুন দোহাই লাগে আপনার। আমি আর পারছিনা ( কাঁদছে)
টগর – আচ্ছা তাহলে শুনো, প্রত্যেক মানুষের জীবনে এক উদ্দেশ্য এবং কিছু নির্দিষ্ট কাজের দায়ভার নিয়ে জন্মায়। এসব সফল হলেই তাকে ফিরে যেতে হয় তাই তো দুনিয়ার নিয়ম।
নয়নতারা- মানে কি বলতে চাইছেন আপনি?
টগর- শান্ত হউ, মন দিয়ে শুনো। নিয়তি যখন মৃত্যুশয্যায় ছিলো, তখন রোদিক মানে তোমার বাবা পাগলপ্রায়। সে নিয়তি কে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিলো।
রোদিক নিজেও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো।
কিন্তু পারে নি নিয়তি কে দেয়া প্রতিজ্ঞার জন্য। নিয়তি ওর কাছে তোমাকে রেখে যায়। তোমাকে মানুষ করার দায়ভার অর্পন করে যায়।
ও বলেছিলো তুমি যখন সাবালিকা হবে, তখন নিজে এসে রোদিক কে তার কাছে নিয়ে আসবে।
রোদিক প্রতিরাতে সেই একি প্রার্থনা করে, নিজের মৃত্যুকামনা করে, নিজের নিয়তি কে কাছে পেতে চায়। রোদিক তার দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, কখনো বুঝতে দেয় নি তোমাকে ভেতর ভেতর সে কতটা বিধ্বস্ত হচ্ছে দিনের পর দিন।
রোদিকের জীবনের শেষ কাজ হচ্ছে নিয়তির গহনাগুলো তোমার কাছে বুঝিয়ে দেয়া। তখনি তার মুক্তি মিলবে, তাকে চলে যেতে হবে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে…….
নয়নতারা হতবাক। বাবা ও চলে গেলে সে কাকে নিয়ে বাঁচবে?
নয়নতারা- আপনি যে সব সত্যি বলছেন তার প্রমাণ কি?
টগর – আমি মিথ্যাই বা বলবো কেন? তবে আমি চলে যাবার সময় আজ ও তোমায় কিছু দেখিয়ে যাবো। তারপর নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ো।
নয়নতারা- ( চোখ ভিজে আছে) আমার থেকেই সবাইকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে কেন?
টগর – এ যে পৃথিবীর নিয়ম, খন্ডানোর সাধ্য কারো নেই।
আজ আমি তোমাকে দুটো কথা বলতে চাই যা তোমাকে পথ দেখাবে।
নয়নতারা- জ্বী, বলুন। আমি আর কিছু ভাবতে পারছিনা।
টগর – তোমার মাথায় কি কি ঘুরছে সব ই জানি, তুমি আমায় ও সন্দেহ করছো তাই স্বাভাবিক।
তাহলে শুনো- আশ্রমে যারা থাকে, বা তুমি যাদের দেখেছো একটা সময় তারা সবাই আশ্রম ছেড়ে চলে গেছে এবং পরবর্তীতে আর যোগাযোগ রাখে নি, কেনো বলো তো?
যে আশ্রমের কাছে তাদের এতো ঋণ, সব কি একদিনেই ভুলে গেলো?
দ্বিতীয়ত, তোমার মায়ের সেই পুতুল। এ কোনো যে সে পুতুল নয় তা তুমি দেখেই কিছুটা আন্দাজ করেছো হয়তো। খোঁজ নাও, হয়ত সব পর্দা সরে যাবে চোখের সামনে থেকে।
নয়নতারা জটিল সমস্যায় পড়েছে। টগরের একটা কথাও ফেলে দেয়ার মতো না , কিন্তু বিশ্বাস করাটাই বা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে?
তাছাড়া টগর আজ বাবা সম্পর্কে যা বলেছে, তা যদি সত্যি হয় তাহলে নয়নতারার জীবনে বড়সড় ঝড় বইতে চলেছে। তাছাড়া ওই গহনাগুলোর মধ্যে এমন কি আছে, যার জন্য মা এগুলো নয়নতারা কে দিতে বলেছেন??
মায়ের প্রত্যেকটা কাজের পেছনে ক্লু আছে, এটা নয়নতারা বুঝে গেছে। গহনাগুলো আজ নয়নতারার সঙ্গী হবে হয়তো, কিন্তু বাবা?
উনি যদি সত্যিই এভাবে কষ্ট পেয়ে থাকেন তাহলে তাকে এবার মুক্তি দেয়া উচিত।
কিন্তু এই এতো বড় গোলকধাঁধায় সে যে ভীষণ একা হয়ে যাবে….
টগর – তরী?
নয়নতারা- হুম( আনমনে)
টগর – আমার যে যাবার সময় হয়ে এসেছে , চোখ বন্ধ করো।
নয়নতারা চোখ বন্ধ করে ফেলে, মনে হচ্ছে চোখের উপর আবছা আলো পড়ছে , ভেসে উঠে দৃশ্যপট……
আবছা আলোতেও নয়নতারার জায়গাটা বেশ চেনা চেনা লাগছে। একি এ তো ওর বাবার রুম!
বাবা শুয়ে আছেন, মনে হচ্ছে কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নয়নতারা একটু ভালোভাবে খেয়াল করে দেখে বাবা কাঁদছেন। তার হাতে একটা ফটোফ্রেম।
তাতে নিয়তি এবং মি. রোদিকের বিয়ের ছবি। এই ছবিটা নয়নতারা কখনোই আগে দেখেনি।
বাবার কান্নার রোল বাড়ছে, শুধু চিৎকার করতে পারছেন নাহ মনে হয়।
নয়নতারারও বুকটা ফেটে যাচ্ছে বাবার কষ্টে। এতোটা কষ্ট তিনি নিজের ভেতর চাপিয়ে রেখেছেন ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে নয়নতারার।
বাবা যেনো ফিসফিসিয়ে কিছু বলছেন-
” আর কতদিন আমাকে এভাবে কষ্ট দিবে তুমি নিয়তি? আর কতদিন? আমাদের নয়নতারা নিজের ভালোটা বুঝতে শিখেছে এখন। জানি স্বার্থপরের মতো কথা বলছি আমি, কিন্তু তুমিও কম স্বার্থপর ছিলে না, আমায় একা করে চলে গেলে…..”
বাবার কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসছে, নয়নতারার আর সহ্য হচ্ছিলো না, সে চোখ খুলে ফেলে। বিড়বিড় করে বলে-
“ধন্যবাদ টগর…”
সেরাতে প্রচণ্ড কাঁদে নয়নতারা। তাকে পাথর হতে হবে, হতে হবে হৃদয়হীন। নাহয় এই কুৎসিত জগৎ যে তাকে গিলে নিবে।
ভোরের আলো ফুটেছে। নয়নতারা চুপিসারে বাবার রুমে ডুকে পা ধরে সালাম করে নেয়।
চোখ দিয়ে তখনো অশ্রু গড়াচ্ছে। বাবার জন্য রেখে যায় ছোট্ট চিঠি-
‘ ভালো থেকো বাবা, মায়ের সাথে।
উনাকে বলবে তোমার ই মতো আমিও উনাকে অনেক ভালোবাসি, তাই আজ তোমাকে উনার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম…….’
নয়নতারা বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে, বাবার অন্তিমকাল ঘনিয়ে আসার সেই মুহূর্ত তার নিজের চোখে দেখা যে সম্ভব নাহ।
চোখ দিয়ে এখনো জল গড়াচ্ছে, কি করবে, কোথায় যাবে কিছুই মনস্থির করতে পারছেনা সে।
একটা পার্কের কোণে চুপটি বসে আছে নয়নতারা, মনে মনে বারবার টগরের কথা ভাবছে।
কিন্তু টগর কোনো সাড়া দিচ্ছে নাহ।
এমন তো কখনো হয়নি যে, টগর কে ও মনে মনে ভেবেছে আর টগর সাড়া দেয় নি।
তাহলে কি টগর ও ওকে ছেড়ে চলে গেছে?
প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে, দৌড়ে বাসায় গিয়ে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে নয়নতারার, এখনো হয়তো বাবা উঠে নি।
কিন্তু নাহ কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেনো ওকে বাঁধা দিচ্ছে। নয়নতারা নিজের মনের কাছে হার মেনে নিয়েছে।
‘বাবা আজ যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে, এর চেয়ে বড় চাওয়া আর কিছু হতে পারে না।’
উদাস মনে অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে নয়নতারা।
মনের মধ্যে ঝড় চলছে, এক অজানা বেদনাময় ঝড়। হঠাৎ ই মাথায় টগরের দুটো কথা ঘুরতে লাগলো –
প্রথমত, আশ্রমের পালিত সন্তানরা কোথায়? কি বা ছিলো তাদের নিয়তি? কেনো যোগাযোগ করেন নি আর তারা? তাহলে কি….
আর দ্বিতীয়ত, মায়ের সেই অদ্ভুত পুতুল। এই পুতুলেই বা কি রহস্য লুকিয়ে আছে?
নয়নতারা ব্যাগ থেকে পুতুলটা বের করে একমনে দেখছে। নয়নতারার মনে হলো –
পুতুলটার ঠোঁটের কোণে যেনো হাসি ফুটে উঠেছে।
নয়নতারার দেহ হিম হয়ে আসে, সে পুতুলটার থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আতংকে এখনো শরীর কাঁপছে ওর….
নয়নতারা জীবনের প্রত্যেক কাছের মানুষকে হারাচ্ছে এই গোলাকধাঁধার প্যাঁচে। এর একটা বিহিত করতেই হবে তার।
পুতুলটা সম্পর্কে জানতে হলে আগে জানতে হবে পুতুল টা কোথায় বানানো হয়েছে। কারিগর ই বা কে?
যেই ভাবা সেই কাজ। গন্তব্য এখন কুমোরপাড়া, সেখানেই হয়তো খোঁজ পাওয়া যাবে।
কিন্তু নয়নতারা ভুল ছিলো, সারাদিন যাবত কুমোরপাড়ার সকল বাড়ি বাড়ি গিয়েও এই পুতুলের কোনো হদীস পায় নি।
প্রচণ্ড বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সে।
কুমোরপাড়া থেকে বের হতে যাবে, তখনি একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর থেকে এক অতিবয়স্ক বৃদ্ধ বের হয়ে আসে। সে নয়নতারার দিকে এমনভাবে তাকায় যেনো ভুত দেখছে…
বৃদ্ধটি বলে উঠে-
‘তুই? এইহানে আবার? এহনো হেই আগের মতোই আছোস? এও সম্ভব?
নয়নতারা হতবাক। লোকটা এসব কি বলছে? সে তো আজ ই এখানে প্রথম এসেছে, তাহলে?
নয়নতারা- আপনি আমাকে চেনেন?
বৃদ্ধ- হেই চোখ, হেই অবয়ব আমি ভুলুম কেমনে?
নয়নতারা- দয়া করে একটু খুলে বলবেন আমাকে?
বৃদ্ধ- আয়, দাওয়াও বস।
নয়নতারা কুঁড়েঘরটার ছোট্ট বারান্দায় বসে।
বৃদ্ধ বলতে শুরু করে-
‘আজ থাইকা প্রায় বিশ বছর আগে , এক মাইয়া আইছিলো এক পুতুল হাতে। খুবই আইশ্চর্য হেই পুতুল…’
নয়নতারা – দাঁড়ান এক মিনিট, এই পুতুল না তো?
লোকটা পুতুলটাকে যেনো চরম অস্বস্থিতে পড়ে যায়।
আমার চোখের সামনে থাইকা এই পুতুল দূর কর এহনি!
বৃদ্ধের এই কথায় নয়নতারা চমকে যায়, পুতুল টা সরিয়ে নেয়।
বৃদ্ধ- এই সর্বনাশা পুতুল তোরে কেডা দিছে?
নয়নতারা – এইটা আমার মায়ের পুতুল।
বৃদ্ধ- তাইলে ওইডা তোর মা আছিলো, হে কি বাঁইচা আছে?
নয়নতারা- নাহ উনি আমার জন্মের সময় মারা গেছেন।
বৃদ্ধ- এইডা জীবননাশা পুতুল। এইডার খোঁজ নিয়া কি করবি? এইডা মাটিতে পুইতা ফেল।
নয়নতারা- কিন্তু আমার যে খুব দরকার, অনেকগুলো মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে যে, প্লিজ বলুন।
বৃদ্ধ কিচ্ছুক্ষণ ভেবে বললেন-
বৃদ্ধ- তয় শোন, তোর মা রে এই পুতুলের কারিগর এর নাম কয়া আমি আমার পোলা, বউ হারাইছি। খুন করা হইছে ওদের। এইবার হয়ত আমি মরুম। শোন আমি মরণে ভয় পাই না, আমি নিজেও মরতে চাই।
নয়নতারা হতবাক, উনি এসব কি বলছেন? তাহলে কি মা ও এই কারনেই মারা গেছেন?
বৃদ্ধ- আমিই জানি এই পুতুলের কারিগর কেডা! আমার এক বন্ধু আছিলো, ওয় এই আইশ্চর্য পুতুল বানাইছিলো জাদু বিদ্যায় কাজে লাগানির লাইগা।
একমাত্র আমি জানতাম হেইডা, যে এই পুতুলের কথা বাইরে কয়া দিবো তার ই মরা লাগবো।
কিন্তু আমার দোস্ত আমারে আরো কঠিন শাস্তি দিছে, আমার পরিবার রে চোখের সামনে মাইরা আমারে বাঁচায়া রাখছে তিলে তিলে মরার লাইগা।
বৃদ্ধ চোখ মুছলেন…..
নয়নতারা – ওনাকে কোথায় পাওয়া যাবে?
বৃদ্ধ- রুপনগর। শেখ ভিটায় পাবি। তুই অহন যা, আমার সময় হয়া আসছে। পালায়া যা এহনি….
নয়নতারা রীতিমতো কাঁপছে, লোকটা যা বলেছে তা কি সত্যি?
ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, নয়নতারা বৃদ্ধের কুঁড়েঘরের পেছনে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পরেই এক আত্মচিৎকার শুনতে পায় সে, খড়ের ফাঁকে চোখ রেখে দেখে বৃদ্ধ লোকটিকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে।
তার জিহ্বা টা বের হয়ে কেটে পড়ে আছে, চোখ দুটো নষ্ট করে দিয়েছে, দাঁতের পাটি খুলে নেয়া হয়েছে।
নয়নতারা নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না এই দৃশ্য দেখে, অঝোরে কাঁদছে।
তখনি বৃদ্ধের ঘরে লোক সমাগমের আওয়াজ পায়। নয়নতারা চুপিসারে অন্ধকারে গা এলিয়ে দেয় ।
তবু আবছা চিৎকার শুনতে পায়-
‘জেডো রে কেডা মাইরা ফালাইছে…..’
নয়নতারা সরু রাস্তা ধরে এগুচ্ছে, নিজেকে আজ বড্ড খুনি মনে হচ্ছে। তার জন্য দুটো জীবন বিপন্ন হলো।
‘ কেনো মা, কেনো? এই পাপের কালিমা বইতে আমায় জন্মই দিয়েছিলে কেনো? আমি যে আর পারছিনা…..’ – নয়নতারা মনে মনে বলে।
ও ঠিক করে এই জীবন রাখবে না, চোখের সামনে এতো মৃত্যু সইতে পারবে না।
ট্রেন আসার শব্দ শুনা যাচ্ছে, নয়নতারা রেললাইন ধরে এগুচ্ছে।
ট্রেন আর কিছুটা দূরে, একটু পরেই নয়নতারার দেহটা পিষে ফেলবে।
ঠিক তখনি কে জেনো নয়নতারাকে ধাক্কা মেরে লাইন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
নয়নতারা যখন উঠে বসে তখন কাউকে খুঁজে পায় না। বুঝতে পারে এ টগরের কাজ।
নয়নতারা – কেনো টগর, কেনো? আমি বেঁচে থেকে কি করবো? ( কাঁদছে)
টগর- তরী, বাসায় যায়। বাবা যে তোমার বিদায়ের অপেক্ষায়।
একথা শুনে নয়নতারার দেহ শিহরিত হয়ে উঠে, সে পাগলের মতো ছুটছে বাসার উদ্দেশ্য…..
বাসার কাছে আসতেই প্রচণ্ড শোরগোল শুনতে পায় নয়নতারা। ওর পা যেনো আর চলতে চাইছে না।
গ্যারেজটার সামনেই কফিনটা রাখা হয়েছে, নয়নতারা চুপ করে ওখানে বসে যায়।
আত্মীয়স্বজন ওকে ঘিরে ধরে-
‘কই ছিলি মা? তোর বাবা যে আর নাই…..
নয়নতারা টু শব্দটিও করে না, চুপ করে বসে থাকে। একফোঁটা জল ও গড়ায় না চোখ থেকে।
বাবার চেহারাটা শেষবারের মতো দেখে নেয়, কি অমায়িক লাগছে বাবাকে।
নয়নতারা একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে চায়, কিন্তু আত্মীয়স্বজন বারণ করে, গোসলের পর ছোঁয়া ঠিক না।
গভীর রাত হয়ে এসেছে, নয়নতারা বাবার লাশের পাশে ঠায় বসে আছে, কেউ ওকে সরাতে পারে নি।
ফজরের নামাযের পর ই দাফন কাজ সম্পন্ন হবে।
ভোর প্রায় হয়ে এসেছে, বাবা কে নিয়ে যেতে লোকজন উদ্যত হয়েছে।
নয়নতারা কফিনের একসাইড ঝাপটে ধরে আছে, কিছুতেই নিতে দিবে না।
শেষপর্যন্ত মায়ার বাঁধন কাটিয়ে বাবাকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, নয়নতারা অশ্রুসিক্ত চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
বাবা কে নিয়ে যাওয়ার পর ও দৌড়ে বাবার রুমে যায়, গিয়ে দেখতে পায়-
ওর চিরকুট টা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে রাখা হয়েছে, আর ওয়ারড্রোবের উপর একটা খাম পড়ে আছে।
নয়নতারা খাম টা লুকিয়ে ফেলে যেনো কেউ দেখতে না পায়।
তারপর অঝোর ধারায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে , বাড়ির প্রত্যেক কোণায় বাবার স্মৃতি, কিভাবে টিকবে সে?
বেশকিছুদিন ই নয়নতারার সাথে ওর কিছু আত্মীয়স্বজন ছিলো, মেয়েটাকে একা রেখে যাওয়ায় ওরা ভরসা পান নি।
এরপর নয়নতারার দেখভালের জন্য একজন গভর্নেস রাখা হয়।
এর মাঝে ফাদার বেশ কয়েকবার এসে নয়নতারা কে দেখে যান।
এই কিছুদিনে নয়নতারা কারো সাথে কোনোরকম কথা বলে নি। তবে ফাদারের কিছুদিন পর পর দেখতে আসা টা তাকে ভাবাচ্ছিলো? তার কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিলো?
নয়নতারা চুপচাপ থাকলেও রাতের গভীর অন্ধকারে ওর রুম থেকে কারো সাথে কথা বলার আওয়াজ আসে।
একদিন ওর গভর্নেস রাতে পানি খেতে উঠে বুঝতে পারে নয়নতারা কারো সাথে কথা বলছে, কিন্তু কান পেতে শুনেও দ্বিতীয় কারো আওয়াজ পায় নি। সেদিন থেকেই কুলসুম বানু নয়নতারা কে কিছুটা ভয় পেতে শুরু করেন। তিনি ভেবেছিলেন- মেয়েটা বাবার শোকে উন্মাদ হয়ে গেছে হয়তো।
বেশি কিছুদিন পর এক গভীর রাতে-
‘তরী….’
নয়নতারা – হুম, টগর বলো।
টগর – চোখের নিচে যে কালি পড়েছে সেদিকে খেয়াল আছে?
নয়নতারা – ঘুমোতে পারি না, চোখ বুজলেই বাবার অবয়ব ভাসে।
টগর – আজ অনেকদিন হলো রোদিক মারা গেছে , নিজেকে সামলাও।
নয়নতারা – এইতো আছি বেশ।
টগর – মরে বেঁচে আছো। তুমি কি সব ভুলে গেছো? তোমার মায়ের শেষ চিঠিতে উনি কি বলে গিয়েছিলেন?
রোদিকের দেয়া খামটাও তো আজ পর্যন্ত খুলো নি।
নয়নতারা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে।
টগর – কিছু বলো, তোমার হাতে অনেক নিষ্পাপ প্রাণের দায়িত্ব যে, রাখবে না মায়ের কথা?
নয়নতারা – রাখবো, আমাকে রাখতে হবে যে।
নয়নতারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, হাতে তার মি. রোদিকের রেখে যাওয়া সেই খাম……
(চলবে)