অন্ধকারের মধ্যে পেছন থেকে কোন কিছুর স্পর্শে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাতেই একটা হাত আমার মুখ চেপে ধরে।ছোটাছুটি করার আগেই নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়!মুহূর্তেই ভয়ে আমার পুরো শরীর অবশ হয়ে যায়।মুখ দিয়ে অস্ফুট ধরনের শব্দ বের হয়!
হঠাৎ করেই কেউ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
–‘এত ভয় পাচ্ছো কেন?কুল!!আর ছাদে কখন এসেছ? শরীর তো একদম সাপের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। চিৎকার দিয়ো না।আমি তোমায় খেয়ে ফেলার জন্য আসিনি এত রাতে।শুধু পাঁচ মিনিট এভাবে তোমায় আগলে রাখতে দাও। ‘
বলেই সে আমার ঘন চুলে মুখ লুকালো। এতক্ষণ মাথায় নানী, দাদীর রূপকথার ভূত প্রেতের চেহারা ভাসছিল।মানুষের কন্ঠ কানে যেতেই মুহূর্তে মাথা থেকে ভূত, প্রেতের চিন্তা সরে সেখানে নতুন চিন্তা ভর করলো।আরে, এ ব্যাটা তো কোনো জলজ্যান্ত লুচিয়া পোলা!!হয়তো এত রাতে ছাদে একা পেয়ে…. ছি! ছি!!
দিলাম সজোরে এক ধাক্কা।প্রস্তুত ছিল না বলে ছাদের উপর পড়ে গেল।আমার সারা শরীর কাঁপছে ভয়ে।দৌঁড়ে নিচে যাওয়ার বুদ্ধিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি যেন।মুহূর্তেই ছেলেটা হাঁটুর কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। অন্ধকারের মধ্যেও বেশ টের পাচ্ছি ছেলেটার চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
ছেলেটা হাতের কনুই হাতাতে হাতাতে অনেকটা বিরক্তিতে বললো,
–‘কি, করছ এসব? ধাক্কা দিলে কেন এভাবে?? ‘
আমি অনেকটা রাগী মেজাজে কাপঁতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করলাম,
–‘ক-কে,কে আপনি??’
–‘কিহ?কে আমি?মজা করছো আমার সাথে?’
–‘কার দায় ঠেকেছে মাঝরাতে আপনার সাথে মজা করার!তাড়াতাড়ি বলুন কে আপনি?নাহলে কিন্তু আমি চোর বলে চিৎকার দিব।’
ছেলেটা চুপ করে রয়েছে। অন্ধকারে তার মুখ অস্পষ্ট। মুখের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না।হঠাৎ করেই ছেলেটা একটু জোরে হেসে উঠলো।হাসিটা শুনে ভয়ে কোথায় যেনো ছ্যাৎ করে উঠলো। খুব তাড়াতাড়ি ছেলেটা হাসি থামিয়ে বলল,
–‘আচ্ছা,আচ্ছা বাবা!বুঝেছি।তোমাকে হিরোদের স্টাইলে পূর্ণ পরিচয় দিতে হবে।ঠিক আছে। ‘
বলেই ছেলেটা হাঁটুর গেড়ে বসে শার্টের বুকপকেট থেকে ছোট একটা বাক্সজাতীয় কিছু বের করে দুই বাহু সামনে প্রসারিত করে বলা শুরু করল,
–‘ আমি তাজবীর আজমাইন তিহাম, মোঃ জহুরুল খন্দকারের দুইটিমাত্র পুত্রের মধ্যে সুযোগ্য প্রথম পুত্র তোমায় সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে একটা প্রস্তাব করছি,উইল ইউ ম্যারি মি তিথি?’
আমি চিৎকার দিতে গিয়ে মুখে হাত দিলাম।পেছন দিকে ছিটকে সরে এসে তোতলাতে তোতলাতে কোনোরকমে বললাম,
–‘স-স্যরি ভাইয়া।আমি তিথি নই।আমি দিয়ানা।মৃদুলা তাবাসসুম দিয়ানা। শায়লা ভাবীর ননদ।’
তিহাম ভাইয়া লজ্জা পেল নাকি রেগে গেল বুঝলাম না।বসা থেকে উঠে সরাসরি বলল,
–‘তুমি এখানে কেন এতরাতে?এখানে তো তিথির থাকার কথা।’
–‘মা-মানে?’
–‘কিসের মানে?আমি তো আগেই জানতাম তিথি কোন রুমে থাকে। আজ বিকেলে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কত কষ্টে তিথিকে চিঠি দিয়ে আসলাম। বলেছিলাম,রাতে যেন অবশ্যই ছাদে আসে।তো তুমি এখানে কেন?ও কোথায়? ‘
অনেকটা আমতা আমতা করে মাথা নিচু করে বললাম,
–‘আসলে বড় ধরনের ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। ওর রুমে তো তখন আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে….. ‘
তিহাম ভাইয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে তা আমি না দেখেই অনেক ভালো করে বুঝতে পারছি।সে কোনোরকমে বলল,
–‘তু-তুমি মা-মানে?তুমি মানে?যে চিঠি দিয়েছি!ড্যাম ইট।বাই দা ওয়ে,তুমি চিঠি পড়েও বুঝতে পারনি ওটা তোমার জন্য নয়।’
–‘ আসলে আমি রহস্য পছন্দ করি না।ভেবেছিলাম কে না কে দিছে! মনে তেমন কৌতূহল সৃষ্টি হয়নি তাই খুলে পড়িনি।’
তিহাম ভাইয়া একটু নড়েচড়ে বলল,
–‘যদি একটু পড়তে তাহলে এই ব্লান্ডারটা হতো না।’
হঠাৎ চমকে উঠে বলে,
–‘তার মানে তুমি বইয়ের প্রথম পেজে লেখাটিও পড়নি!তাই না?’
আমি মিইয়ে গেলাম।বার বার মনে হচ্ছে এখনি অদৃশ্য হওয়ার ঔষধ খেয়ে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যাই।তিহাম ভাইয়া গলা হালকা উঁচু করে বলল,
–‘কি হলো? চুপ করে রয়েছো যে?’
আমি আর দ্বিতীয় কিছু না বলে দিলাম এক ছুট।আস্তে করে ওয়াশরুমে ঢুকে বড় বড় করে শ্বাস নিলাম।নিজেই নিজেকে বুঝালাম যে এটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। সকাল বেলা দেখা যাবে সব ঠিক হয়ে গেছে।পরমুহূর্তে বিকেলের ঘটনা মনে পড়লো।
(‘বহু বছর পরে,নিজের মৃত্যুশয্যায় শুয়ে অরেলিয়ানো সেগান্দোর মনে পড়ে যাবে জুন মাসের সেই বৃষ্টিস্নাত বিকেলটির কথা যখন সে শোবার ঘরে ঢুকেছিল তার প্রথম সন্তানের মুখদর্শন করার জন্য।
সে বলেছিল, আমরা তাকে হোসে আর্কাদিও বলে ডাকবো।
তার আগের বছর সুন্দরী যে রমণীকে সে বিয়ে করেছিল……………… ‘
এইটুকু পড়েই বুক মার্কটা দিয়ে চিহ্নিত করে বইটি পাশে রাখলাম। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। মাথা ব্যথার পূর্ব লক্ষণ।জানি,খুব শীঘ্রই মাথার ভেতর সেই অদৃশ্য দানবটা হানা দিবে। ভাংচুর করে দিবে সব। সেরেবেলাম, থ্যালামাস,হাইপো থ্যালামাছ সব একদম জট পাকিয়ে যাবে। আর তার তীব্র যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠবো আমি। টানা তিন-চার ঘন্টা ঘুম না দিলে এই দানব তার রাজত্ব কিছুতেই ছাড়বে না। মাঝে মাঝে ব্যথাটা এতটা নির্দয় হয় যে,মনে হয় এর থেকে মরে গেলেও শান্তি। তাছাড়া একটা ব্যাপার বহুদিন আগেই লক্ষ্য করেছি,যেইদিন বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান থাকে বা আমি লোক সমাগম জায়গায় যাই ওইদিনই মাথা ব্যথা বেশি তীব্র হয়। আমি অনেকটা নিশ্চিত যে আমার বিয়ের দিনও এই দানবটা আমায় ছাড়বে না।
বিছানা ছেড়ে উঠে বেলকুনিতে দাঁড়ালাম।মধ্যদুপুর এখন। চারিদিকে সুয্যিমামা তার তেজ দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। মাথা ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে সুয্যিমামাকে একটা ভেটকি কাটলাম।তাতে তার বিন্দুমাত্র তেজও কমল না। সামনে বেশ দূরেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখা যাচ্ছে। লাল রক্তে তার মাথা ছেয়ে আছে। গাছের নিচে অনেকগুলো কবুতর খুঁটে খুঁটে কি যেনো খাচ্ছে। আমি তাদের সংখ্যা গুনতে লাগলাম। ধবধবে সাদা এক কবুতরের মাথায় লাল টিকি। কি সুন্দরই না লাগছে দেখতে। এতকিছু পর্যবেক্ষণ করছি মাথা ব্যথাকে ভুলে থাকার জন্য। এক কাপ গরম কফি খেতে পারলে একটু ভালো লাগতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমায় এই ভরদুপুরে কফি করে খাওয়াবে কে? কার এত দায় পড়েছে? বাড়িতে থাকলে মাকে না হয় আবদার করতাম। কিন্তু আমি যে এখন আত্মীয়ের বাড়ি। তাই সব আবদার কিছুদিনের জন্য পরম শান্তিতে বিশ্রাম নিচ্ছে। থাক না ওরা পরম যত্নে!!
বেলকনি থেকে রুমে ঢুকেই নিজেকে বিছানায় মেলে দিলাম। কাঁথা দিয়ে পুরো নিজেকে মুড়িয়ে প্যাকেট বানিয়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুম রাজপুত্রের মন জয়ের চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।
–‘এই দিয়ানা, উঠ।উঠ বলছি।আর কতকাল ঘুমাবি খারাপ!!জলদি উঠে ফ্রেশ হ্।’
আমি আধো চোখ খুলে দেখলাম তিথি আমায় ডাকছে।ওকে দেখে চোখটা আবার বন্ধ করতেই ও আমায় এক ঝটকায় উঠিয়ে বলল,
–‘যা ফ্রেশ হয়ে নে।সন্ধ্যার আযান দিচ্ছে। ‘
চোখ কপালে তো দূরের কথা, মাথায় তুলে বললাম,
–‘ কিহ্,সন্ধ্যা হয়ে গেছে!! এত তাড়াতাড়ি। মনে তো হচ্ছে এই একটু আগে ঘুমালাম।’
তিথি বাঁকা সুরে বলল,
–‘ তোমার তো কত কিছুই মনে হয়। যা এখন ওয়াশরুমে যা। কথা আছে অনেক। কালকের দিনের জন্য প্ল্যান করতে হবে। ‘
আমি হুম বলে ওয়াশরুমে গেলাম। আজ তিন দিন হলো আমি এসেছি আমার বড় ভাইয়ের সাথে ভাবির বাপের বাড়ি।বাড়িটি আমার খুবই পরিচিত। ছোট্ট বেলায় অনেক আসতাম।আমার বড় ভাইয়ার যখন বিয়ে হয় তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়তাম। এখন আমি যথেষ্ট অ্যাডাল্ট।বলতে গেলে বুড়ি হয়ে গেছি।অনার্স কমপ্লিট করেছি এইবছর।মাস্টার্সের ডিগ্রিটা আমার বিদেশ নামক জায়গা থেকে নেয়ার ইচ্ছা। তাই কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দেশে আবেদন করেছি।যার ফলাফল কি হবে কে জানে! আপাতত আমার মাথার দানব চলে গেছে বলে মনটা ফুরফুরে।
তিথি আমার ভাবির ছোট বোন। আমাদের বয়স সেইম। খুবই অদ্ভুত ভাবে মিলে গেছে। ও এবার ডিগ্রি পাশ করেছে। পড়াশোনায় তেমন মন নেই ওর।কারণ সেই ছোট্ট বেলায় ওর বিয়ে ঠিকঠাক করে রেখেছেন ওর মামাতো ভাইয়ের সাথে,যে আমাদের থেকে বেশ কয়েক বছরের বড় এবং মোটামুটি দশ বছর হলো সে ইতালি থাকে।কিছুদিন হলো সে দেশে ফিরেছে।কাল পরিবারকে সাথে নিয়ে তিথিদের বাড়ি আসবে।তাই তিথি অনেক এক্সাইটেড। সেই ক্লাস ফাইভ অর সিক্সে ভাইয়াটাকে দেখেছি আমি।আমার সাথে তখন অনেক কথা হতো।বিদেশ যাওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই আর যোগাযোগ নেই। অনেক বছর পর দেখা হবে বলে আমারো ভালো লাগছে।
টাওয়াল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে রুমে ঢুকলাম।এটা তিথির রুম। মোটামুটি গোছানো। রুমটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হলো গাছ লতাপাতা আর রঙিন পাথরে ঘেরা জারের কচ্ছপ দুটি। ভয়ানক সুন্দর। কচ্ছপ প্রায় একশ বছর বাঁচে।এই দুটি দুনিয়ার আলো কতদিন দেখবে কে জানে!! ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বইটি খুঁজলাম।বিছানায় না পেয়ে মাথার পাশে টেবিলের দিকে তাকাতেই বইটি দেখতে পেলাম।টেবিল থেকে বইটি হাতে নিয়ে বুকের উপর ভর দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
“নিঃসঙ্তার একশ বছর”( One Hundred Years of Solitude) বইটি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখা অসাধারণ একটি বই যেটি ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয় অর্জন করে। তৃতীয় বারের মতো বইটি পড়ছি আমি। কিন্তু কোনো ক্লান্তি নেই।বইটি জাদুবাস্তবতা নিয়ে অর্থাৎ বাস্তবই কিন্তু অনেকটা জাদু বলে পাওয়া যেন।
প্রথম পেজ খুলতেই মেরুন রঙের কারুকার্য শোভিত একটা কাগজ নজরে এলো।হাতে নিয়ে দেখলাম চিঠি। নাম ধাম কিছু লেখা নেই। তবে বইয়ের প্রথম পেজে চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
–“এই,তুমি বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে ঘুমাও জানতাম না তো! একদম মায়ের পেটে নবজাত শিশু থাকে সেভাবে। কাঁথার উপর দিয়ে কি নিষ্পাপই না তোমায় লাগছিল।জানো,আমি একটা ভয়ংকর কাজ করেছি। প্লিজ, মাফ করে দিও।কাঁথার উপর দিয়েই তোমার গালে জীবনে প্রথমবারের মতো ঠোঁট ছুইয়ে দিয়েছি।ক্ষমা করবে তো?”
আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো মস্তিষ্কের সেরেব্রাম কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।ফলে চিন্তা, বুদ্ধি, ইচ্ছাশক্তি,বাকশক্তি সব হারিয়ে ফেলেছি।নিজেকে কেমন অনুভূতিহীন মনে হচ্ছে। নিজের অজান্তেই দুই হাত গাল স্পর্শ করলো।মাথাটা একটু ঝাঁকি দিয়ে সোজা হয়ে বসলাম।অনেকটা মুনি ঋষিদের ধ্যান করার মতো।
কিছুক্ষণ পর চিঠিটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম।চিঠিটা খুলে পড়ব কিনা ভেবে পাচ্ছি না।আমার জায়গা অন্য যে কেউ হলে একটানে চিঠিটা খুলে ফেলত।সর্বপ্রথম চোখে পড়ার পর আমারো তীব্র কৌতূহল হয়েছিল ভিতরের মানুষটির অগোছালো ভাবনার প্রত্যক্ষদর্শী হতে।কিন্তু এখন আর ইচ্ছে করছে না।নিজেকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে এইমাত্র প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধে আমি ঘায়েল হয়েছি।হয়তো কৌতূহলের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গেছি! আমার মন খারাপ হলো কিনা বুঝতে পারছি না।তবে বুকের ভেতর কোথায় যেনো সূক্ষ্ম ব্যথা হচ্ছে। এতটা সূক্ষ্ম যে তার নাগাল পাওয়া দুষ্কর।
চিঠিটা বইয়ের ভেতর রেখে বাইরে আসলাম।সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোকে দু’হাতে সরিয়ে দিয়ে অন্ধকার তার আধিপত্য বিস্তার শুরু করে দিয়েছে।তিথিকে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই ডালিম গাছের দিকে নজর পড়ল। দুটি টুনটুনি অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে। তাদের ছোট্ট চোখে যেন রাজ্যের ভয় আর অস্থিরতা। মনে হচ্ছে কিছু সময় আগে ঘূর্ণিঝড়ে তার সাজানো ক্ষুদ্র সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। মন খারাপের পরিমাণ আরো বেড়ে গেল। সেখানে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত পা চালিয়ে তিথিকে ডাকা শুরু করলাম।
তিথি রান্নাঘর থেকে দুই কাপ চা হাতে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসল।সে বলল,
–‘ চল,ছাদে গিয়ে বসি।’
যদিও আমর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না তবু ওকে না করলাম না। ঠোঁটটা হালকা প্রসারিত করে বললাম,
–‘চল!আমার হাতে এক কাপ দে।ঢেলে ফেলবিহ।’
ধীরপায়ে দুজন ছাদে উঠে আসলাম।আরাম করে বসে চায়ের কাপে দিলাম এক চুমুক। মন খারাপ ভাবটা যদি একটু কমে।তিথি চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–‘ কি রে,কেমন হয়েছে?’
–‘আমি দু’চোখে কৌতূহল নিয়ে বললাম,
–‘তুই বানিয়েছিস?’
ও খুশিমনে বলে উঠলো,
–‘হুম।কেমন হয়েছে?’
আমি মুখটা ভেঙচিয়ে বললাম,
–‘ইয়াক থু! কি বানিয়েছিস এটা? পুরা চায়ের ফালুদা করে ফেলেছিস।চা তোকে কক্ষনো ক্ষমা করবে না। ‘
–‘সত্যি পঁচা হয়েছে?’
–‘আলবাৎ সত্যি। এই চা তোর হবু বরকে কি খাওয়ালে সে বিয়ে তো দূরের কথা, একদম তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালাবে।’
মুহুর্তেই তিথির মুখটা কালো মেঘে ছেয়ে গেল।আমি শব্দ করে হেসে বললাম,
–‘ওরে আমার দুঃখীনি রে! আরে আমি তো মজা করছিলাম। চা সত্যি দূর্দান্ত হয়েছে।দেখিস তোর বর তোর আর কোনো খাবার পছন্দ না করলেও চায়ের প্রেমে ঠিকই পড়বে।”
তিথি এতক্ষণে হেসে ফেলল।ওর মুখ থেকে কালো মেঘ সরে গিয়ে গ্রীষ্মকালের প্রখর রৌদ্র ঝিলিমিলি করছে।চা টা সত্যি দারুণ হয়েছে। অনেকটা জিয়া উদ্যানের চায়ের মতো।আরেক কাপ চায়ের তীব্র বাসনা অঙ্কুরিত হওয়ার আগেই বিনষ্ট করে দিলাম।
_________
ক্রমেই রাত বাড়ার সাথে সাথে মন খারাপের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।এই মন খারাপের উৎস খুঁজে পাচ্ছি না।সন্ধ্যার ওই ব্যাপার নাকি টুনটুনি পাখির ব্যাপারে মন খারাপ তা বুঝতে পারছি না।ঘুমও আসছে না।জানি, আসবেও না।কারণ আমার বেড ফোবিয়া আছে।একা এক বেডে না ঘুমালে ঘুম আসে। যদি কোনো রকম বুঝতে পারি আমার পাশে কেউ শুয়ে আছে,তাহলে সব শেষ। সে আমার থেকে এক হাত দূরে থাকলেও ঘুম আসে না।বান্ধবীরা অনেক পঁচায় সেজন্য। যে বিয়ে হলে কি করবো!
তিথি আমার পাশে ঘুমিয়ে আছে। গভীর ঘুমে সে হয়তো ঘুমরাজ্যে তার রাজকুমারের সাথে হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর মুখটা দেখে কেন জানি খুব মায়া লাগলো। ঘুমের মধ্যে কি সুন্দরীই না লাগছে ওকে!! পাশ ফিরে বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম ১১ঃ৫৬ বাজে।বেশি রাত নয়। আস্তে করে উঠে গুটিগুটি পায়ে ছাদে উঠে গেলাম।পুরো বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে।
চারিদিকও একদম সুনশান।প্রকৃতি যেন আধো ঘুমন্ত। নিজেকে এই মুহূর্তে নিস্তব্ধপুরীর রাজকন্যা মনে হচ্ছে। যে রাজ্যে কোনো রাজা নেই,নেই কোনো প্রজা।এমনকি নেই কোনো রাজপুত্র। শুধু রাজকন্যা একা আর একা।কি মনে হলো,আমি চেয়ার ছেড়ে ছাদে হাঁটু পেতে বসলাম। চারিদিক মুগ্ধ হয়ে দেখছি।নিস্তব্ধপুরীর সবকিছু এখন স্বপ্নে বিভোর।দেখতে দেখতে চোখে ঘোর লাগে।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে কোনো ধারণা নেই।হঠাৎ করেই তিহাম ভাইয়া এসে জড়িয়ে ধরলো।)
ছি!তিথি যদি এসব জানতে পারে?আস্তে করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তিথির পাশে শুয়ে পড়লাম।কাল সকালে তিহাম ভাইয়া এলে তার সামনে যে কিভাবে দাঁড়াবো তা জানা নেই!
(চলবে)
#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০১
#