তুমি_নামক_ব্যাধি পর্ব ১৯

#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নি_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৯

বলেই আমাকে সামনে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলো।

তিহাম ভাইয়া সিটবেল্ট লাগানোর জন্য এগিয়ে আসতেই বাঁধা দিলাম।দ্রুত বললাম,

—‘আমি পারি পারি! এক্ষুনি লাগাচ্ছি।’

তিহাম ভাইয়া আমায় থামিয়ে দিয়ে বলল,

—‘চুপচাপ বসো।সিটবেল্ট আমি লাগিয়ে দিবো মানে আমি লাগিয়ে দিবো। শোনো,কিছু কাজ সৃষ্টিই হয়েছে ছেলেদের জন্য। এই ধরো,তুমি শাড়ি কুচিসহ একাই পড়তে পারো।

তারপরো তুমি রোজ শাড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে যাতে আমি তোমার কুচি ঠিক করে দেই।দেন,চোখে কাজল তুমি লাগাতে পারো।তবুও ঝুম বৃষ্টির কোনো এক সন্ধ্যায় আমি নিজ হাতে তোমার চোখে কাজল পড়িয়ে দিবো।কখনো মাঝ রাতে ডেকে তুলে নিজ হাতে শাড়ি পড়িয়ে, নিজ হাতে সাজিয়ে, বিকেল বেলা লুকিয়ে কিনে আনা বেলী ফুলের মালা খোঁপায় গুজে দিয়ে বলল,আজ বাকি রাতটুকু আমরা জোসনা বিলাস করবো।শরতের স্নিগ্ধ বিকেলে তো……………….’

মুচকি হেসে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

—‘বুঝতে পেরেছি।আর বিস্তারিত বলতে হবে না।’

—‘এসব আমার অধিকার। আর আমি আবার ছোটবেলা থেকেই অনেক অধিকার সচেতন।সো,আমার অধিকার হরণের চিন্তা মস্তিষ্ক থেকে এক আলোকবর্ষ দূরে রাখবে।’

বলেই আমার সিটবেল্ট নিজ হাতে লাগিয়ে দিল।দুপাশের কাচ নামিয়ে মিষ্টি গন্ধের একটা স্প্রে করলো।আমার ডান হাতটা নিজের বাম হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,

—‘এখন ড্রাইভ করা শুরু করি। কি বলো?’

—‘আপনি নিজে ড্রাইভ করবেন?রিস্কি হয়ে যাবে না?’

—‘একদমই না।আমাদের দেশের চেয়ে এখানে ড্রাইভ করা বেশি নিরাপদ। দেখছো না কি সুন্দর ট্রাফিক আইন মেনে সব গাড়ি চলছে! ‘

মাথা নাড়লাম। তিহাম ভাইয়া আবার বললো,

—‘খারাপ লাগলে বলবে পিচ্চি। আর কথা বলো আমার সাথে, ভালো লাগবে।থার্টি মিনিটস লাগবে পৌঁছাতে। ‘

আমি অসহায় দৃষ্টিতে হাতের দিকে তাকাতেই তিহাম ভাইয়া মুচকি হেসে বলল,

—‘এটা ফিরে পাওয়ার আশা বাদ দাও।আমি ছাড়ছি না কিছুতেই।’

____________________

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় বসলাম।রুমটা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। ছবির মতো সুন্দর করে সাজানো। এতক্ষণ ভালো ভাবে দেখা হয়নি বলে যা বুঝতেই পারিনি।

আমার ছোটবেলা থেকে বেড রুম সুন্দর করে সাজানোর ইচ্ছে। অনলাইনে সবসময় সাজানো বেডরুমের পিক দেখতাম।আর কম্পেয়ার করতাম কোনটা বেশি সুন্দর!রুমটা একদম হোয়াইট কালারের এবং রুমের বেডশিট থেকে শুরু করে যাবতীয় জিনিস হোয়াইট। আমার বুঝতে আর বাকি রইল না যে তিহাম ভাইয়ার ফেবারিট কালারও হোয়াইট। মুচকি হেসে নিচে নামলাম।

তিহাম ভাইয়া এখানে ওনার খালামনি আর খালুর সাথে থাকে।ওনাদের বড় একটা ছেলে আছে।অনির্বান নাম। ভাইয়াটা তার স্ত্রী আর দুইটা বাচ্চা নিয়ে হিথ্রো শহরে থাকে।কারণ ভাইয়া হিথ্রো শহরে ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে।

চাকরির সূত্রেই তাদের সেখানে থাকা।তাই এখানে তিহাম ভাইয়া আর তার খালামণি,খালু একসাথে থাকে।অনির্বান ভাইয়া নাকি ইতালির একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে।ফরেনার মেয়েটাকে দেখার বড্ড ইচ্ছে বলে তিহাম ভাইয়া বলেছে আমায় হলিডের দিন নিয়ে যাবে।

প্রথম দিকে ভয় হয়েছিল এটা ভেবে যে এ বাসার লোকজন আমাকে কিভাবে না কিভাবে গ্রহন করবে।কিন্তু তিহাম ভাইয়ার খালামণির সাথে একবার কথা বলে ভয়টা কেটে গেছে। আমাকে উনি নিজের মেয়ে হিসেবেই গ্রহণ করেছে।নিচে নেমে দেখি আন্টি টিভি দেখছে। আমাকে দেখেই ওনার পাশে সোফায় বসাল।মুচকি হেসে বসে পড়লাম।

আন্টি বলল,

—‘মা,একদম নিজের বাসা মনে করে থাকবে।কোনো লজ্জা পাবে না।আর তিহাম কিন্তু তোমার ব্যাপারে সব বলেছে আমায়।তাই লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।’

আমি চমকে ভয়ার্ত চোখে তাকাতেই আন্টি হেসে বলল,

—‘এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।তিহাম আমাকে বলেছে যে ও তোমাকে ভালোবাসে।ছোটবেলা থেকে তিহামকে আমি বড় করেছি।আমার কাছে সব কথা বলে।কিন্তু তোমার কথা কিছু দিন আগে বলেছে।তিথির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে।আগে বললে আমি নিজে সব ঠিক করে দিতাম।তোমাকে প্রথম দেখার পরেই আমার মনে হলো তিহামের পছন্দের চোখ মারাত্মক। তোমার মতো মিষ্টি মেয়েকে যে কেউ পছন্দ করতে বাধ্য। এখন বলো,আগে পরে তোমার আমাকে মা বলেই ডাকতেই হবে।এখন থেকেই বলবে নাকি বিয়ের পরে বলবে?’

আমার হুট করেই নিজের মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে।চোখ দুটো ভিজে উঠার আগেই ওনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

—‘এখন থেকেই মা বলে ডাকবো মা।’

উনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন।সিঁড়ির দিকে শব্দ হতেই তাকালাম।তিহাম ভাইয়া এসে সোফায় বসে বলল,

—‘বাহ্!খালামনি।নতুন মেয়ে পেয়ে নিজের ছেলেকেই ভুলে গেলে!এই তুমি আমায় ভালোবাসো?’

খালামনি হেসে বলল,

—‘তোকে আমি কবেই ভালোবাসতাম!আচ্ছা শোন,খুব তাড়াতাড়ি আমি তোদের দুজনের বাসায় কথা বলবো তোদেন ব্যাপারে।আমি জানি সবাই অনেক খুশি হবে।তার আগে তিহাম তোকে বলি,তুই খবরদার দিয়ানা মাকে জ্বালাবি না।ওর থেকে দূরে থাকবি।মনে থাকে যেনো!’

তিহাম ভাইয়া মুখ ফুলিয়ে বলল,

—‘তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো সে কবে বিয়ে করতে পারবে আমায়?এতগুলো বছর যখন অপেক্ষা করতে পারলাম তখন তার মাস্টার্সের এক বছরও করতে পারবো।’

আমি মাথা নিচু করে নখ খুঁটছি।লজ্জায় অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। টপিক চেন্জ করতে আন্টিকে বললাম,

—‘মা,আমি মিষ্টি খাবো।’

তিহাম ভাইয়া বললো,

—‘তুমি কি কোনো সুখবর দিতে চাচ্ছো যার ফলে মিষ্টি মুখ করবে?’

আন্টি হেসে বলল,

—‘তিহাম তুই থাম তো।দিয়ানা তুমি কিচেনে যাও।দেখো ফ্রিজে আছে। ‘

উঠে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে বললাম,

—‘মা,বড়রা যেমন মতামত দিবে আমি সেটাতেই রাজি।তোমরা যা ভালো মনে করো তাই করো।’

বলে দ্রুত কিচেনে ঢুকলাম।বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেললাম।বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি এই মাত্র তিহাম ভাইয়াকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ দিয়ে দিলাম।কি যে ভালো লাগছে!ফ্রিজ খুলে একটা মিষ্টির জায়গায় দুটো খেয়ে ফেললাম।

________________

গভীর রাত।কান পেতে বৃষ্টির শব্দ শুনছি।আজ তিনদিন হলো এদেশে এসেছি। এখনো দেশটাকে আপন করে নিতে পারিনি।কিন্তু আজ হঠাৎ করে ঝুম বৃষ্টির শব্দ কানে যেতেই মনে হচ্ছে আমি আমার বাসায়, আমার রুমে শুয়ে আছি।

ইশ!যদি এখন একটু বৃষ্টিতে ভিজতে পারতাম!বাসায় থাকতে এমন কোনো বৃষ্টির দিন যায় নি,যার এক ফোঁটা বারি আমার গায়ে পরশ ভুলিয়ে যায়নি।বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এমন হয়ে গেছে যে মাঝরাতে ভিজলেও জ্বর হয় না এখন।

দরজায় হালকা আওয়াজে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে বরফের মতো জমে গেলাম।তিহাম ভাইয়া রুমে ঢুকেছে। কিন্তু আমি তো ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়েছিলাম।তাহলে?তিহাম ভাইয়া একটু এগিয়ে এসে হাতের ডুব্লিকেট চাবি দেখিয়ে বলল,

—‘এটা তোমার মা দিয়েছে।সো,আমাকে দোষ দিবে না।এখন চলো।’

আমি দ্রুত উঠে বসলাম।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—‘কোথায় যাবো?’

তিহাম ভাইয়া স্বাভাবিক ভাবে বলল,

—‘বৃষ্টিতে ভিজবো।ছাদে চলো।’

—‘কি!মাথা খারাপ আপনার?এখন কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে?আর যদি আপনার খালামনি খালু জেনে যায়? ‘

—‘এখন বৃষ্টিতে ভিজবো মানে এখন ভিজবো। খালামনি,খালু নিচে থাকে।খালুর পায়ের ব্যথা বলে উপরে উঠে না।আর উঠলেও,নাথিং টু ডু।আমি আমার বউকে নিয়েই ভিজবো।প্রতিবেশী নয়।’

—‘আপনি অসুস্থ হয়ে যাবেন।যাবো না আমি।’

তিহাম ভাইয়া চাবিটা প্যান্টের পকেটে রেখে আমার পাশে এসে বসলো।ইদানীং ছেলেটাকে অনেক ভয় লাগে।ভয়ে কুঁকড়ে আছি আমি।আমার দিকে ঝুঁকে বললো,

—‘শেষবারের মতো বলছি,তুমি কি পায়ে হেঁটে যাবে?’

ফট করে বলে ফেললাম,

—‘না।’

ব্যস!উনি দুহাতে শক্ত করে আমায় কোলে তুলে নিলো।আমি কিছু বলার আগেই বলল,

—‘কোনো কথা না।একদম চুপ।নইলে তোমার মুখ আটকানোর ব্যবস্থা আমার ভালো মতো জানা আছে। এর আগেও আটকেছিলাম।’

লজ্জায় ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম।তিহাম ভাইয়া হেসে বলল,

—‘এখন ওড়না ছেড়ে গলাটা ধরবে নাকি?পড়ে হাত পা ভাঙলে আমি কিন্তু বিয়ে করতে পারবো না,আগেই বলে রাখলাম। ‘

আমি দুহাত দিয়ে ওনার গলাটা জড়িয়ে বুকের মাঝে মুখ লুকালাম।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here