‘অবিশ্বাস’
সাবিহা আফরিন
৪.
বহুবার আশফাকের ফোনে ট্রাই করার পরও পাওয়া গেল না আশফাককে। বাধ্য হয়ে আশফাকের মা রাহেলা বেগমের নাম্বারে ফোন করলেন রফিক সাহেব। দু’বার কল হতেই ফোন রিসিভ হল। ওপাশ থেকে রাহেলা বেগমের কন্ঠস্বর শোনা গেল, ‘হ্যালো..’
রফিক সাহেব অস্থির গলায় বলে উঠলেন,’আসসালামু আলাইকুম আপা। আমি নীরার বাবা বলছি।’
‘আমি নীরার বাবা বলছি’ কথাটা শুনতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রাহেলা বেগমের। এতক্ষণের ভালো থাকা মেজাজটা যেন নিমেষেই খারাপ হয়ে গেল,’আপনি?কেন ফোন করেছেন?’
নীরার বাবা উত্তেজিত কন্ঠে বলতে লাগলেন,’আপা.. আপা আমার কথাটা শুনুন। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে আপা। আমার নীরা অমন মেয়ে নয়।’
রাহেলা বেগম মনে মনে ধারণা করেছিলেন এমনই কিছু একটা হতে পারে। সত্যি বলতে নীরাকে তিনি নিজেও ভীষণ ভালোবাসতেন। এ বাড়িতে মেয়েটা তার বৌমা নয় বরং নিজের মেয়ে হয়ে এসেছিল। মায়ের আদর স্নেহ ভালোবাসা কোনো কিছুতেই কোনো কমতি রাখেন নি তিনি। মেয়েটাকে নিজের মেয়ের আসনে বসিয়ে ছিলেন। নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছিলেন যাতে বাবা মাকে ছেড়ে আসার পর কখনো তার এমন মনে না হয় যে এটা তার শ্বশুর বাড়ি। বরং যেন মনে হয় এটা তার নিজেরই বাড়ি। এটা ঠিক যে নীরা তার শ্বশুরকে কখনো দেখেনি। শ্বশুরের আদর ভালোবাসা পায় নি। তাই তিনি নীরাকে এতোটাই ভালোবাসা দিয়েছেন যাতে নীরার কখনো বাবা মা কিংবা শ্বশুরের অভাব বুঝতে না পারে। মেয়েটাও তাকে সারাদিন মা মা ডেকে ডেকে একেবারে অস্থির করে ফেলতো। যেন রাহেলা বেগম নীরার শাশুড়ী কম নিজেরই মা’ই বেশি। এমন কত বিকেল পার হয়েছে যখন বৌ শাশুড়ী মিলে বাড়ির বারান্দায় বসে একে অপরের মাথায় তেল লাগিয়ে দিত, এটা সেটা ওটা নিয়ে গল্পগুজব করতে করতে সারা বিকেল কখন যে পার হয়ে যেত খেয়ালই থাকতো না ওদের। এমন কত সূর্যাস্ত দেখেছে দু’জনে মিলে বাড়ির ছাদে কফির মগ হাতে দাড়িয়ে। কি ছিল না জীবনে তাদের? কি দেন নি তিনি নীরাকে? বিশ্বাস করে নিজের বাবাহারা, কত কষ্ট আর কত ত্যাগের বিনিময় মানুষ করা, তার সাত রাজার ধন ছেলেটাকে এমনকি এতো বছরের তিল তিল করে তার নিজ হাতে গড়ে তোলা সাজানো গোছানো সংসারটাকে ঐ দু’দিনের মেয়েটার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরিবর্তে মেয়েটা কি করল? ছিঃ! ভাবতেও ঘেন্না লাগে। এই মেয়েটাকেই কিনা তিনি নিজের মেয়ের মতোন ভালোবাসেছিলেন? নিজের মেয়ের আসনে বসিয়ে ছিলেন? তারও খারাপ লেগেছিল নীরাকে এভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। কিন্তু তার যে কিছুই করার ছিল না। হাজার হোক তিনি তার ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসেন। আর নীরা! সে তো পরের মেয়ে। নীরাকে দিয়ে তিনি খুব ভালো ভাবেই বুঝে গেছেন পর আজীবন পরই থাকে। পর কখনো আপন হয় না। নীরাই সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। এতো সব হওয়ার পর তিনি আর কোনো ভাবেই নীরাকে আশফাকের ত্রিসীমানায়ও আসতে দিতে পারেন না। দেবেনও না।
রাহেলা বেগম ধমকে উঠলেন,’চুপ করুন আপনি। একটা দুশ্চরিত্রা মেয়ে জন্ম দিয়ে এখন আবার বড় বড় কথা বলতে এসেছেন? আমরা নিজের চোখে দেখেছি সব। ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! আগে যদি জানতাম এমন একটা দুশ্চরিত্রার সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে হবে তাহলে এই বিয়ে আমি কোনোদিনও হতে দিতাম না। ‘
রফিক সাহেব আহত কন্ঠে বলতে লাগলেন,’আপা আপা আমার কথাটা একটিবার শুনুন।’
রাহেলা বেগম এবার গর্জে উঠলেন,’কি শুনবো আপনার কথা হ্যা? কি শুনবো? আমার তো এখন মনে হচ্ছে এর পেছনে আপনাদেরও হাত আছে। বড়লোক ছেলে ফাঁসিয়ে তাদের থেকে টাকা উসুল করাই আপনাদের কাজ।’
রফিক সাহেব বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে গেলেন। ‘বড়লোকের ছেলে ফাঁসিয়ে তাদের থেকে টাকা উসুল করা’ বলতে রাহেলা বেগম কী বোঝাতে চাইলেন? নীরার সাথে তো বিয়ের আগে আশফাকের কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না যে নীরা তাকে তার প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করবে। বরং রাহেলা বেগম নিজে নীরাকে পছন্দ করেছিলেন আশফাকের সহধর্মিণী হিসেবে। এটা ঠিক তারা মধ্যবিত্ত পরিবার, সেই তুলনায় আশফাকরা যথেষ্ট বিত্তবান। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদের মেয়ে এতোটাই সস্তা হয়ে যাবে যে তাকে আশফাকের কাঁধে একেবারে গছিয়ে দিতে হবে। বরং দু’পরিবারের সম্মতিতেই এই বিয়েটা হয়েছিল। আশফাককে তিনি নিজের মেয়ের জন্য এই ভেবেই পছন্দ করেছিলেন যে আশফাক একজন সৎ এবং সচ্চরিত্রবান পুরুষ। কারণ ছেলে যতই কোটিপতি হোক না কেন সৎ আর সচ্চরিত্রবান না হলে সে ছেলের টাকা দিয়ে তার মেয়ে কখনোই সুখী হতে পারবে না এটা তিনি খুব ভালোই জানতেন। টাকা দিয়ে আর যাইহোক সুখ অন্তত কেনা যায় না। তিনি সবসময়ই চাইতেন তার মেয়েটা কম পাক,কম খাক তবুও যেন জীবনে কখনো অসুখী না হয়। আজ যদি আশফাক খুব সাধারণ আর স্বল্প মাইনের চাকরিও করতো তবুও রফিক সাহেব তার হাতে নিজের মেয়েকে তুলে দিতেন। কারণ এই যুগে এমন সৎ ছেলে পাওয়া যে বড়ই দুষ্কর। তাই সেদিন আশফাককে দেখার আর আশফাকের সম্পর্কে সমস্ত কিছু জানার পর তিনি আর রাহেলা বেগমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারেন নি। নইলে এর আগেও কতশত উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেকে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র তারা সৎ ছিল না বলে। আর আজ তাকেই কিনা শুনতে হচ্ছে সে তার মেয়েকে দিয়ে ব্যবসা করায়। বড়লোকের ছেলে ফাঁসিয়ে টাকা পয়সা উসুল করে নেয়। এ-ই কি প্রাপ্য ছিল তার? রফিক সাহেব অনেকক্ষণ পর বলতে পারলেন। নিজেকে সামলে ভীষণ কষ্টে আহত কন্ঠে বলে উঠলেন,’কি বলছেন এসব?’
রাহেলা বেগম গলায় আগের জোর বজায় রেখেই বললেন,’ঠিকই বলছি। আপনারা আপনাদের মেয়ের চরিত্র সম্পর্কে সব জেনে শুনেও আমার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। কি করে পারলেন আমাদের মা ছেলেকে এই ভাবে ঠকাতে? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন। আমার ছেলে আর আপনার মেয়েকে কোনোদিনও ঘরে তুলবে না। এটা সে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। আমি আমার ছেলেকে ভালো পরিবারের এবং চরিত্রবান মেয়ে দেখে আবার বিয়ে দেবো। আপনাদের মতো ঠক জোচ্চর আর আপনার মেয়ে মতো চরিত্রহীনা দেখে নয়।’
রফিক সাহেব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন,’আপা আপা আমার কথাটা একবার শুনুন। আপা..’
রাহেলা বেগম তার মুখের ওপর ফোন কেটে দিলেন। নীরা আর তার মা দু’জনেই পাশে দাড়িয়ে ছিল কি বলে তা শোনার জন্য। দু’জনেই উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রফিক সাহেবের দিকে৷ বাবার মলিন মুখ দেখে নীরার বুঝতে বাকি রইল না কি হয়েছে। চোখ ছলছল করছে তার। নিশ্চয়ই তার বাবাকে অপমান করা হয়েছে। আজ তার জন্য তার বাবাকে অপমানিত হতে হয়েছে ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছিল নীরার।
রফিক সাহেব নীরার দিকে ফিরে সামান্য হাসার চেষ্টা করে মলিন গলায় বললেন,’ তুই চিন্তা করিস না মা। প্রয়োজনে আমি আশফাকের কাছে যাব। ওর হাতে পায়ে ধরবো। ওকে বোঝাবো। সত্যিটা খুলে বললে নিশ্চয়ই ও আর তোর ওপর রাগ করে থাকতে পারবে না তুই দেখে নিস।’
নীরার চোখ উঁপচে জল বেরিয়ে এল। মুখে ওড়না চেপে বাবার ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। রফিক সাহেব ঠিক করলেন আগামীকালই সশরীরে গিয়ে উপস্থিত হবেন আশফাকদের বাড়ি। ফোনে এভাবে বলে কিছুই করতে পারবেন না তিনি। তারচেয়ে ভালো খোলামেলা কথা বলে সব মিটমাট করে নেওয়া। এর জন্য যদি তাকে অপমানিত হতেও হয় তবে তিনি সে অপমান মেনে প্রস্তুত। তবুও নিজের একমাত্র আদরের মেয়ে তিনি আর এভাবে কিছুতেই দেখতে পারছেন না।
পরদিন রফিক সাহেব আশফাকদের বাড়ি এসে উপস্থিত হলেন। কলিং বেল টিপতেই আশফাকের মা রাহেলা বেগম এসে দরজা খুলে দিলেন। নীরার বাবাকে দেখতেই মুখের হাসি মুছে গিয়ে মুখটা থমথমে হয়ে উঠল তার।
‘আপনি? কোন সাহসে আমার বাড়িতে এসেছেন?’ চাপা গর্জন করে উঠলেন রাহেলা বেগম।
রফিক সাহেব অনুনয়ের সুরে বললেন,’আপা আমার আপনার সাথে আর আশফাকের সাথে কিছু কথা আছে। দয়া করে আমাকে একটু সময় দিন। আর আশফাক বাবাকে একটু ডেকে দিন। আমি বেশি সময় নেব না। কথাগুলো বলেই চলে যাব।’
‘আশফাক বাড়িতে নেই। আর আমারও আপনার সাথে কোনো কথা বলার বা আপনার কোনো কথা শোনার ইচ্ছে নেই।’
‘এমনটা করবেন না আপা। আমার মেয়েটা শেষ হয়ে যাবে।’ আহাজারি করে উঠলেন রফিক সাহেব।
‘আপনার ঐ দুশ্চরিত্রা মেয়ের যা খুশি তা-ই হোক নাহয় জাহান্নামে যাক তাতে আমাদের কি?’
‘আপা..!’ চাপা আর্তনাদ করে উঠে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রফিক সাহেব।
‘বেরিয়ে যান, এক্ষুণি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আর কোনোদিনও যেন আপনাদের কারো ছায়া এ বাড়ি কিংবা আমার ছেলের আশেপাশেও না দেখি।’
রাহেলা বেগম রফিক সাহেবের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। লজ্জায় অপমানে সংকুচিত হয়ে গেল রফিক সাহেব।আশফাকের অফিসে গেলেও আশফাক তার সাথে দেখা করল না। মেয়ের সংসারের অনিশ্চয়তা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। মেয়ের চিন্তায় অনেকটা ভেঙে পড়লেন। এমনকি বেশ অসুস্থও হয়ে পড়লেন।
চলবে…