#পথের_কাঁটা
#অন্তিম_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
সময়টা শীতকাল। শীতের ঠান্ডা বাতাসের দাপটে টিকে থাকা মুশকিল। হাড় হিম হয়ে আসে। গায়ে গরম কাপড় থাকা সত্ত্বেও শীত মানছে না। শহরের তুলনায় গ্রামে বরাবরই শীত বেশি থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উঠানে এসে দাঁড়ালেই দাঁতে দাঁতে বাড়ি লাগে, ঠিক এতটাই শীত। সময়ের স্রোত নদীর মতোই। কীভাবে যে এর মাঝেই আড়াই বছর কেটে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি কেউ। জামশেদ রহমান রান্নাঘরের একপাশে বসে আছেন গুটিশুটি হয়ে। গলায় মাফলার প্যাঁচানো আর শরীরে চাদর।
ত্রয়ী ঘড়ি দেখতে দেখতে ঘর থেকে বের হয়। শীতের কুয়াশা মাথায় নিয়েই তাকে অনেকটা পথ চলতে হবে। যেতে হবে হাসপাতালে। ত্রয়ী এখন একজন সফল ডাক্তার। কত দায়িত্ব তাঁর! ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। জামশেদ রহমানের উদ্দেশ্যে ত্রয়ী বলল,’বাবা আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।’
ঘড়ি থেকে চোখ তুলে বাবার দিকে তাকাতেই তার দু’হাত আপনা-আপনি কোমরে চলে যায়। দু’হাত কোমরে রেখে ত্রয়ী রাগী রাগী গলায় বলল,’তোমার কি একটুও ভয় করে না?’
জামশেদ রহমান জানেন ত্রয়ী কেন বকছে। তার কারণটা আহামরি কিছু না হলেও ত্রয়ীর কাছে বিশাল। মেয়ে যে তার ডাক্তার। তিনি বাচ্চাদের মতো মুখটা দুঃখী দুঃখী করে বলেন,’আবার কী করেছি মা?’
‘ঢং! কী করেছ জানো না? এত শীত এখন! তার মধ্যে তুমি একটা চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছো?’
‘কই একটা চাদর? দেখ, মাফলারও আছে গলায়।’ গলার মাফলারটি দেখিয়ে বললেন তিনি।
ত্রয়ী কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’তুমি কি আর শোধরাবে না?’
‘শুধরালে কি আর প্রতিদিন তুই আমায় বকবি?’
বাপ-মেয়ের খুনশুটি দেখে মুচকি মুচকি হাসছে মা। হরহামেশা-ই জামশেদ রহমান ত্রয়ীর কাছে বকা খাবেন এবং সেটা ইচ্ছে করেই। না হলে নাকি তার দিনটাই খারাপ যায়। ত্রয়ী যখন শাসন করে তখন জামশেদ রহমানও যেন পাঁচ বছরের বাচ্চা বনে যান। ত্রয়ী আর কিছু না বলে ঘরে চলে যায়। একটা সুয়েটার নিয়ে এসে সেটা পরিয়ে দিতে দিতে বলে,’তোমায় বলতে বলতে আমি জানি কবে পাগল হয়ে যাব। লোকে কি বলবে বলো তো? বলবে, মেয়ে ডাক্তার হলে কী হবে? নিজের বাবাকেই সুস্থ রাখতে পারে না।’
‘আমার মেয়ে লোকের কথার ধার ধারে না সেটা আমি ছাড়া আর ভালো কে জানে?’
এ কথার শেষে গভীরভাবে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে ত্রয়ী। সত্যিই তো, বাবার অজানা নয় এই বিষয়টা। তৎক্ষণাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মানকি টুপি পরাতে পরাতে বলে,’দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।’
‘একি রে! মানকি টুপিও পরতে হবে?’ অসহায়ভাবে বললেন তিনি। ত্রয়ী মেকি ধমক দিয়ে বলল,’উঁহুম! একদম চুপ। কোনো টাল-বাহানা করলে চলবে না। মানকি টুপি পরলে কানে বাতাস লাগবে না।’
‘যথাআজ্ঞা আম্মাজান।’
‘এখন আমি আসছি।’
‘সাবধানে যাস। আমি কি একটু এগিয়ে দেবো?’
‘কোনো প্রয়োজন নেই।’
‘আচ্ছা।’ সুবোধ বালকের ন্যায় ঘাড় নাড়লেন তিনি।
ত্রয়ী জানে, বারণ করা সত্ত্বেও বাবা পিছু পিছু আসবে লুকিয়ে। এটাও নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। ত্রয়ী মুচকি মুচকি হাসে।
.
টিচার্সরুমে রুমে বসে সকালের পত্রিকা পড়ছিল জয়ী। পত্রিকা পড়া তার অভ্যাস নয়। কলেজে এসে সময় কাটাতে পড়ে। এই কলেজের সমাজকর্মের শিক্ষক হয়ে জয়েন করেছে এক বছর হবে। পত্রিকার একটা শিরোনামে জয়ীর চোখ আটকে যায়। ‘সুনামগঞ্জ জেলায় বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় তরুণীর আত্মহত্যা।’
বিস্তারিতও পড়ে জয়ী। যা বুঝল, বিয়ে ভাঙার কষ্টের চেয়েও গ্রামবাসীর নানান ধরণের কথা সহ্য করতে না পেরেই মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। জয়ীর বুকের গহিন থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। যদি আজ সে পৃথিবীর বুকে বেঁচে না থাকত, তাহলে তাকে নিয়েও হয়তো এমন একটা শিরোনাম তৈরি হতো।
সেদিনের পর জয়ীর পথচলাটা এত সহজ ছিল না। বরং বেঁচে থাকাটাও তার কাছে অভিশাপ বলে মনে হতো। গ্রামের মানুষ, সমাজের মানুষ যেন পণ করে বসেছিল কিছুতেই তারা জয়ীকে বাঁচতে দেবে না। না, তারা জয়ীকে প্রাণে মারবে না। মারবে কথার আঘাতে। মরে গেলে তো বেঁচেই গেল। কিন্তু এইযে গ্রামবাসীর কথা শোনা, অপমান, লাঞ্ছিত হওয়া এসবের পর জয়ীর মনে হতো সে ঠিক বেঁচে নেই। একদম জীবন্ত লাশের মতো। সে চুপ ছিল। নিরব রেখেছিল নিজেকে। গুটিয়ে নিয়েছিল সবার থেকে। কিন্তু বাবার হার্টঅ্যাটাক তাকে আরেকটা ধাক্কা দেয়। সে বুঝে যায়, শুধুমাত্র তার জন্যই আজ বাবার এই পরিস্থিতি। আরও একবার সে বোকার মতো সিদ্ধান্ত নেয়। হ্যাঁ, দ্বিতীয় সিদ্ধান্তও আত্মহত্যাই ছিল। তার বোধবুদ্ধি ছিল না তখন। নির্বোধ ছিল একদম নির্বোধ। কেননা জ্ঞানী ব্যক্তি, বুঝদার ব্যক্তি কখনও আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় না। জয়ী নিঃসন্দেহে এখন বুঝদার ব্যক্তি। কারণ আগের সেই বোকামির কথা মনে পড়লে সে নিজেকে নির্বোধ বলে গালি দেয়। আফসোস লাগে, কী করে সে এই কাজগুলো করতে গিয়েছিল। তখন আশার আলো হয়ে আসে ত্রয়ী। প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও আল্লাহ্ ত্রয়ীকেই পাঠায়। তবে এবার সে কান্নায়জড়িত ত্রয়ীকে দেখেনি। দেখেছে এক কঠোর ত্রয়ীকে। যার মাঝে নতুনভাবে বাঁচার, প্রতিবাদ করার, সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখানোর উদ্যম ছিল। সাহস ছিল। শুধু আগে কোথায় যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল ছিল। বাবার হার্টঅ্যাটাকের পরই এই দেয়ালটা ভেঙে-চুড়ে যায়। যার ফলে দেখা মেলে নতুন ত্রয়ীর। এক হাতে সে বাবা আর জয়ীকে সামলিয়েছে অন্য হাতে সমাজকে ঠেকিয়েছে।
জামশেদ রহমান কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর বাজারে যান। সঙ্গে ছিল ত্রয়ী। তখনও পর্যন্ত গ্রামবাসীর কানা-ঘুষা বন্ধ হয়নি। তখন তারা আরও একটা টপিক পেয়ে যায়। লোক দেখানো কষ্ট দেখিয়ে তারা আফসোসের স্বরে বলে,’কত আদর-যত্ন কইরাই না মাইয়া দুইডারে মানুষ করছিল মাষ্টার সাহেব। আর আইজ হেই মাইয়্যা গো কারণেই হার্টঅ্যাটাক করল। বাঁচব না তো। এমনে কি মানুষ বাঁচে?’
এসব কথা যে ওদের কানে আসতো না তা নয়। সবই শুনত। তবুও চুপ থাকত সময়ের অপেক্ষায়।
চায়ের দোকান থেকে ডাক দেন প্রতিবেশী এক চাচা। সেখানে আরও অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন না জামশেদ রহমান। সেখানে গিয়ে বেঞ্চের খালি জায়গায় বসলেন। যে ডাক দিয়েছিল সে জিজ্ঞেস করল,’এখন কেমন আছো? শরীর কেমন?’
জামশেদ রহমান মাথা নাড়িয়ে বললেন,’আলহামদুলিল্লাহ্। আল্লাহ্’র রহমতে ভালো আছি।’
‘ভালো থাকলেই ভালো। তা তোমার বড়ো মাইয়া এখন আর পাগলামি করে নাকি? বিয়া-শাদী দিয়া ফালাও। আর ঘরে রাইখা কী হইব? আমার হাতে একটা ভালো পাত্র আছে। আগে একটা বিয়া করছিল। ঐ বউ নাই। ছেলে ধনী আছে। বিশাল জমি-জমা আছে। তুমি বললে ছেলেরে আসতে কই। কী কও?’
বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে আসে জামশেদ রহমানের। তিনি মনে মনে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তখনই ত্রয়ী বলল,’আসসালামু আলাইকুম চাচা। প্রথমেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি বড়োদের মাঝে কথা বলার জন্য। কিন্তু একদম চুপ থাকতেও পারলাম না। আপনার পাত্রর বর্ণনা শুনে মনে হলো, আপনি আসলে মেয়ে নয় কোনো পণ্য ক্রয় করার বিষয়ে কথা বলছেন। আমার আপু তো পণ্য নয়। রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। তাহলে অর্থের হিসাব কেন আসছে? তাছাড়া মেয়ে আমাদের পরিবারের। চিন্তাও আমাদের। আপনাদের এত টেনশন দেখে সত্যিই আমি আপ্লুত। আপনার ঘরে না একটা মেয়ে আছে? শুনেছি, পড়ালেখায় নাকি গণ্ডমূর্খ? এটা কিন্তু আমার কথা নয়। আপনারই মতো অনেকে বলে। তো যা হোক, ঐ মেয়েরে এই ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। ভালো পরামর্শ দিলাম।’
চাচা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। এতগুলো মানুষের সামনে হাঁটুর বয়সী এক মেয়ে তাকে অপদস্থ করেছে এটা তিনি কিছুতেই মানতে পারছেন না। তিনি প্রায় চেঁচিয়ে বললেন,’জামশেদ মাইয়ারে দেখি বেয়াদব বানাইছ। এই মাইয়া লইয়া এত গর্ব? ডাক্তার বানাইবা? ঘেঁচু হবে। কোনোদিনও তোমার এই স্বপ্ন পূরণ হইব না।’
জামশেদ রহমান বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ত্রয়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’কেন যে তুই এই বেয়াদবিগুলো আগে করিসনি মা!’
সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। এমন উত্তর কেউই প্রত্যাশা করেনি। বাকিদের কাছে যেটা অপমান, জামশেদ রহমানের কাছে সেটা প্রতিবাদ। যাওয়ার পূর্বে ত্রয়ী বলে গেল,’আল্লাহ্ সহায় থাকলে একদিন ঠিকই ডাক্তার হব। অসুস্থ হলে তখন আমার কাছে আসিয়েন। ফ্রি তে চিকিৎসা করাব। আপনাদের মতো নিন্দুক,কুটনৈতিক মানুষজন এত দ্রুত মরে গেলে ভালো মানুষগুলো শিক্ষা নেবে কীভাবে বলুন? তাই চিকিৎসা ফ্রিতেই করাব।’
এরপর ত্রয়ী বাবার হাত ধরে চলে যায়। ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে। এ কথাও গ্রামে রটে যায়। লোকে ত্রয়ীর বদনাম করে,কুৎসা রটে,বেয়াদব বলে। এতে ত্রয়ী বা তার পরিবার ধার ধারে না। কেউ কিছু বলতে আসলে প্রতিবাদ করে ত্রয়ী। ভয়ে কেউ কিছু বলতেও যায় না। জয়ীর কানেও কথাটা আসে। সে ভাবে, ত্রয়ী যদি বাবার সম্মানের জন্য,বোনের সম্মানের জন্য প্রতিবাদ করতে পারে তাহলে সে নিজে কেন তার জন্য প্রতিবাদ করতে পারবে না? ত্রয়ীর এই প্রতিবাদই পরিবর্তন করেছিল জয়ীকে। আর জয়ীর পরিবর্তন চুপ করিয়েছে সমাজকে। কারণ, জয়ীও কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। তখন থেকে সে আবারও স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ক্লাস নেয়। কাউকে কানাঘুষা করতে দেখলে সরাসরিই বলত,’এভাবে কানাকানি করে লাভ আছে? বললে জোড়েই বলেন। নয়তো বলবেন কৈ আর সে শুনবে খই। তখন একজনের বদনাম করতে গিয়ে আরেকজনের বদনাম হয়ে যাবে।’
বাচ্চারা জয়ীর দিকে আড়চোখে তাকালে জয়ী সবসময় ওদের বুঝাত। বলত সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে। এমনকি এটাও বলত, কখনও যদি কেউ এমন পরিস্থিতিতে পড়ে তাহলে কখনও যেন জয়ীর মতো সুইসাইড করার মতো সিদ্ধান্ত না নেয়। সংগ্রাম আর প্রতিবাদ করে টিকে থাকার মধ্যেও আত্মতৃপ্তি রয়েছে। কলিগরা মজার ছলে এসব নিয়ে কথা তুলত। অনেকটা কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো। জয়ীও তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেসে বলত,’তাহলেই আর বলেন স্যার ম্যাম, কী বোকাই না ছিলাম আমি?’
তারা অপ্রস্তুত হয়ে পড়তেন জয়ীর এমন সহজ-স্বাভাবিক ব্যবহারে। যে সহজেই দোষ স্বীকার করে নেয় তাকে দোষ দিয়ে মজা নেই। কাজেই তারাও হতাশ হয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিত।
‘আরে ম্যাম! এক পৃষ্ঠা আর কতবার পড়বেন?’ অনেকক্ষণ যাবৎ জয়ীকে আনমনে এক পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্নটি করল মনোবিজ্ঞান বিভাগের টিচার রিয়াদ আহমেদ।
জয়ী সচকিত হয়ে বলল,’আসলে ভাবছিলাম কিছু।’
‘এত মনোযোগ দিয়ে?’
‘কিছু কথা থাকে যেটাতে মনোযোগ দেওয়া লাগে না। আপনা-আপনিই মনোযোগ চলে আসে।’
এরপর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,’আমার ক্লাস আছে এখন। আসছি আমি।’
জয়ী চলে যাওয়ার পরও রিয়াদ স্যার যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে আছে। একটুও নড়চড় হয়নি। জয়ীর সম্পর্কে সবটাই জানে সে। সেই সাথে জানে সমাজ আর গ্রামবাসী সম্পর্কে। সত্য-মিথ্যাও যাচাই করেছে সে। তার আগে থেকেই একদম প্রথম যেদিন জয়ীকে কলেজে দেখেছিল সেদিন থেকেই আলাদা ভালো লাগা কাজ করত। জয়ীর সম্পর্কে সব জানার পর ভালোলাগাটা আরও বেশি কাজ করা শুরু করেছে। খুব শীঘ্রই সে তার বাবা-মাকে জয়ীর বাসায় পাঠাতে চায়। জয়ী রাজি হবে কি? হোক না হোক, প্রস্তাব পাঠাতে তো অসুবিধে নেই। মনে মনে বিয়ের কথা ভেবে মুচকি হাসে সে।
_____________
পেশেন্ট দেখে নিজের চেম্বারে এসে বসে আছে ত্রয়ী। হাতে একটা বই। অবসর সময়টা সে বই পড়েই কাটায়। বাবার ইচ্ছে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ত্রয়ীকে বাইরের দেশে পাঠাবে। ত্রয়ীর অবশ্য মত নেই। সে বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে দু’মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে শান্তিতে জীবন-যাপন করতে চায়।
ত্রয়ীর ফোন বাজছে। অঙ্কন ফোন করছে। সকাল থেকেই অনবরত ফোন করে যাচ্ছে। দেখেও ইগনোর করছে ত্রয়ী। ফোন ধরলে নতুন কোনো কথা নেই। ঘুরে-ফিরে এক কথা। সে ত্রয়ীকে ভালোবাসে। অঙ্কনের এমন পাগলামো এক মুহুর্তের জন্য হলেও ত্রয়ীকে ভাবিয়ে তোলে। অবসর সময়ে একবার হলেও অঙ্কনের কথা মনে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনকে কন্ট্রোলে এনে নেয়। ত্রয়ীর এই গুণটা বেশ ভালো। অনবরত বাজতে থাকা ফোনটি এবার রিসিভ করল ত্রয়ী। ওপাশ থেকে করুণসুরে ভেসে এলো,’ওগো ডাক্তারনি, এত ব্যস্ত সময় পার করো যে ফোন ধরারও সময় পাও না?’
ত্রয়ী নিশ্চুপ। অঙ্কন বলল,’মুখে কি কুলুপ এঁটে বসে আছো? কথা বলো না কেন?’
‘কী বলব?’
‘আমি শিখিয়ে দেবো?’
‘আজ আপনাকে খুব খুশি মনে হচ্ছে।’
‘বাহ্! ডাক্তারনি দেখি আজকাল মনও পড়তে পারে। হুম খুশি তো বটেই।’
‘ভালো।’
‘শুধু ভালো?’
‘আর কী?’
‘জিজ্ঞেস করবে না কেন এত খুশি?’
‘বলেন।’
‘ধুর! রসকষ নাই একদম মনে। আচ্ছা শোনো, গ্রামে আসছি আজকে।’
‘ও। কখন?’
‘রওনা দিয়েছি। গাড়িতে আছি এখন।’
‘আচ্ছা সাবধানে আসবেন।’
‘আরে শোনো, ব্যস্ত নাকি তুমি?’
‘না ফ্রি আছি। বলেন।’
‘তুমি এতো কম কথা বলো কেন? বাড়ির ছোটো ছেলে-মেয়েরা নাকি অনেক চঞ্চল হয়। তুমি এত চুপচাপ স্বভাবের কেন?’
‘আমি তো এমনই।’
‘ভালো হয়েছে। বিয়ের পর আমি বকবক করব আর তুমি শুনবে।’
‘আপনি বেশি বেশি ভাবা শুরু করেছেন। আমি আগেও বলেছি এটা সম্ভব না।’
‘চুপ করো তুমি। আগে ভাবতাম না। এখন থেকে ভাবব। তুমি বিয়ে না করে কোথায় যাও এবার দেখব। আমার পক্ষে জয়ী আছে।’
‘বুঝলাম না।’
‘বুঝতে হবে না। শুধু এইটুকু বলি বিয়েতে তোমায় রাজি করানোর দায়িত্ব জয়ী নিয়েছে। আর জয়ীর ব্যাপারে একটা গোপন খবর জানি আমি।’
‘কী গোপন খবর?’
‘রিয়াদ নামে কাউকে চেনো?’
‘অনেকেই তো আছে এই নামে।’
‘তোমার আপুর কলেজের স্যার।’
‘ওহ হ্যাঁ। আপু বলেছিল কয়েকবার।’
‘দুজনে তো ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিল। আজ আসবে ছেলে তার পরিবার নিয়ে।’
‘আপু তো আমায় কিছু বলেনি।’
‘বলবে কী? তুমি তো রোবট।’
ত্রয়ী নিশ্চুপ। অঙ্কন বলল,’আচ্ছা রাখছি তাহলে। অনেকক্ষণ বিরক্ত করলাম। বাকিটা বাড়িতে ফিরে।’
‘আল্লাহ্ হাফেজ।’
‘শোনো শোনো।’
‘বলেন।’
‘ভালোবাসি ডাক্তারনি।’
ত্রয়ী এবারও নিশ্চুপ। ওপাশ থেকে অঙ্কনের হাসির শব্দ শোনা গেল। তার পরপরই লাইনটা কেটে গেল।
‘ম্যাম বিজি? আসব?’ চেম্বারের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল জয়ী। মুখে প্রশস্ত হাসি। ত্রয়ী হেসে ফেলল। বলল,’অবশ্যই। আপনার জন্য সব ব্যস্ততা বাদ।’
‘চাপা মারিস না তো আর! এখন যদি কোনো পেশেন্টের ডাক পড়ে তাহলে তুই দৌঁড়ে চলে যাবি আমি জানি।’ ভেতরে আসতে আসতে বলল জয়ী। ত্রয়ীর সামনের চেয়ারটাতে বসল। জয়ী এখন সবসময়ই হাসি-খুশি থাকে। তবে আজকে বেশিই খুশি। তবে কি অঙ্কনের বলা কথাটাই সত্যি? একবার কি জিজ্ঞেস করবে? না, থাক। বলার হলে আপুই বলবে।
জয়ীর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছে সে। ত্রয়ী সেই অপেক্ষাতেই আছে। জয়ী এবার প্রফুল্ল হয়ে টেবিলের ওপর দু’হাত রেখে বলল,’তোকে একটা কথা বলব ত্রয়ী।’
‘কী কথা?’
‘রিয়াদের কথা বলেছিলাম না? সে আজ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে।’
‘এজন্যই কি তুমি এত খুশি?’
জয়ী উত্তরে হাসল। ত্রয়ী জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা আপু, এর আগে তুমি কাউকে ভালোবাসোনি?’
‘না। এমনকি যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাকেও না। আল্লাহ্ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন রে ত্রয়ী।’
‘তা তো অবশ্যই।’
‘তোকে কত কথা শুনিয়েছিলাম। কষ্ট দিয়েছিলাম। আমার ওপর তোর কখনও রাগ হয়নি?’
‘না। কারণ আমি জানতাম, যেদিন তুমি নিজেকে সামলিয়ে নিতে পারবে সেদিন নিজেই ভুল আর সঠিকের মাঝে তফাৎ খুঁজে পাবে।’
‘যদি কষ্ট পেয়ে থাকিস মাফ করে দিস বোন।’
‘তুমি কি আজই শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করেছ? না মানে, যেভাবে মাফটাফ চেয়ে নিচ্ছ!’ টিপ্পনী কেটে বলল ত্রয়ী।
জয়ী চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,’আমার সাথে বিটলামি না? তোমাকেও বাড়ি থেকে বের করার ব্যবস্থা খুব শীঘ্রই করব আমি।’
‘কচু।’
‘তুই কচুরডগা।’
এভাবে দু’বোনের কিছুক্ষণ ঝগড়া চলে। দুপুরের পর দুজনে একসাথেই বাড়িতে ফিরে। এখন আর কেউ ফিসফিসিয়ে ওদের বদনাম করে না। লাভ হয় না যে! গায়েই মাখে না। এখন আনমনেই ঐসব লোকদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,’মেয়ে দুটোর দম আছে।’
এখন অপছন্দ করার মানুষের চেয়ে পছন্দ করে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। সমাজের নীতিই এটা। যখন তোমার সময় খারাপ যাবে তখন তারা চেষ্টা করবে টেনে-হিঁচড়ে আরও নিচে নামানোর জন্য। খুব কম সংখ্যক মানুষই সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়। আর যখন সময় ভালো যাবে, তখন পাশে মানুষের সংখ্যাও বাড়বে। তথাকথিত আছে, ‘পায়ের নিচে মাটি শক্ত হলে, কাঁধে হাত রাখার মানুষের অভাব হয় না।’ ওদেরও এখন অনেক মানুষ পছন্দ করে। যেচে কথা বলে। ভালো ভালো ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। স্বাভাবিক। অন্যদের মতো সমাজের চাপাকলে পড়ে ওরা দুমড়ে-মুচড়ে যায়নি। বরং জেগে উঠেছে। সংগ্রাম করেছে। সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে দিয়েছে, ‘তোমরা সমাজের কীট। সমাজকে কলুষিত করেছে তোমাদের মতোই মানুষগুলো। আজকাল ভালো মানুষদের জন্য সমাজ মানে আতঙ্ক। আর এই তোমাদের মতো সমাজে থাকা পথের কাঁটাগুলো উপড়ে ফেলে আমরা সামনে এগিয়ে গিয়েছি।’
শেষে গল্পের দুটো ম্যাসেজ দিয়ে ইতি টানছি।
ম্যাসেজ-১ঃ ‘একটা বিয়ে ভাঙা মেয়ে কখনও সমাজের কারো পথের কাঁটা হয় না। বরং ঐ মেয়েটির জীবনে সমাজের কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষই পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, যা মাড়িয়ে যাওয়া দুষ্কর। আর যে পারে সে সফল, সে স্বাধীন।’
ম্যাসেজ-২ঃ ‘মেয়ে মানেই বাবা-মায়ের পথের কাঁটা নয়, মেয়ে মানেই সমাজের পথের কাঁটা নয়। বরঞ্চ সমাজই ভেঙে পড়া একটা মেয়ের পথের কাঁটা। মেয়ে মানে আত্মত্যাগী, মেয়ে মানে রাজকন্যা। মেয়ে মানে বাবা-মায়ের ভরসা।’
(সমাপ্ত)
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। গল্পটার শুরুর দিকে, মানে প্রথম পর্বেই আমি অনেক ধরণের কথা শুনেছি। যারা বলেছিলেন, এই গল্পের আদি-অন্ত মুখস্থ আশা করছি আজ তাদের ভুল ধারণা ভেঙেছে। প্রথম পর্ব পড়েই আমার গল্পের শেষটা বোঝা মুশকিল। না, রহস্য গল্প নয়। সামাজিক একটা গল্প। তবুও বলব, আপনাদের সাথে আমার চিন্তা-ধারণা খুব কমই মিলবে। সবসময় চেষ্টা করি বাস্তবমুখী কিছু লেখার। এটাও তেমন বাস্তবতা থেকে তুলে এনেছি। সমাজকে আমি তুচ্ছতাচ্ছল্য বা অবজ্ঞা করিনি। আমি শুধু বুঝিয়েছি, একজন মেয়ে কখনও বৃহৎ সমাজের পথের কাঁটা হতে পারে না বরঞ্চ ঐ শ্রেণির মানুষগুলোই একটা মেয়ের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের কথার আঘাত মেয়েটির বাঁচার অবলম্বন কেড়ে নেয়। অনেকে বেছে নেয় সুইসাইডের পথও। সুইসাইড কখনও সমাধান হতে পারে না। বাঁচতে হলে সংগ্রাম করতে হবে। সে নারী হোক বা পুরুষ। আর ভরসা রাখতে হবে আল্লাহ্’র ওপর। অবশ্যই বলে যাবেন, পুরো গল্পটি কেমন লেগেছে। হ্যাপি রিডিং।]
.